অশ্রুবন্দি পর্ব ৬১
ইসরাত জাহান ফারিয়া
পুরো একটা রাত ছেলেকে ছাড়া কাটিয়ে সকালবেলা যখন বাচ্চাকে কোলে পেল, সৃজা বুকে নিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে ইহসানকে জ্বালাতে ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, “আমার পুঁচকুকে কে বেশি যত্ন করেছে? বড়ো আব্বা? নাকি নিজের আব্বা? তোমার আব্বাজান তো আজকাল বউটারই যত্ন নেয় না, মেয়ে ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। নিশ্চয় বড়ো আব্বাই তোমার বেস্ট টেক কেয়ার করেছে? তাই না?”
ইহসান বাচ্চাদের খাবার প্রস্তুত করছিল, সৃজার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। তবে কিছু বলল না। আস্তেধীরে ফিডার তৈরি করে বাচ্চাদের মুখে দিয়ে সৃজার গা ঘেঁষে বসলো। এরপর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তো? মায়ের যত্ন কীভাবে নিলে সে খুশি হবে
জানতে পারি কী?”
কণ্ঠের শীতলতা বুঝে সৃজা বিস্মিত হলেও তড়িঘড়ি করে বলল, “এত জেনে কী কাজ?”
“অভিযোগ যখন এসেছেই তখন নিজেকে শুধরে নেওয়াটাই উত্তম কি না? আমি দিনদিন নিজেকে শুধরে নিচ্ছি, নেওয়ার চেষ্টা করছি। সবার আবদার, কথা রাখার চেষ্টা করছি। সবারটা যখন রাখছিই তোমারটা বাদ দেব কেন? আফটার অল, আমার অর্ধাঙ্গিনী তুমি, আমার বাচ্চাদের
মা তুমি! ”
‘তুমি’ সম্বোধন শুনে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকা সৃজা বিপদ বুঝে এ পর্যায়ে উঠে যেতে চাইলে ইহসান একটানে নিজের উরুর উপর বসিয়ে দিলো সৃজাকে। ছোটাছুটি করে ব্যর্থ হয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় মেয়েটা বলল, “আমাকে ছাড়ো। বাচ্চাদের খেয়াল রাখো গিয়ে। ওরা দেখছে…”
ইহসান ওর কথার পরোয়াই করল না। গম্ভীরমুখে বলল, “দেখুক ওরা, ওদের আব্বা কীভাবে ওদের আম্মাকে আদর করে। এখন তুমি নিজেরটা বলো, কী চাই তোমার? স্বামীর ক্রেডিট কার্ড না কি তার উদোম বুকের ঊষ্ণতা? যেটা চাও সেটাই পাবে।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
উত্তপ্ত গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ে পড়ছে সৃজার। ঠোঁটের ছোঁয়াও পড়ছে। ছোট্ট ছোট্ট আদুরে ছোঁয়ায় বেসামাল হয়ে উঠা সৃজা দূরে সরে যেতে চাইল কিন্তু দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যাওয়া ইহসানের সঙ্গে শক্তিতে পেরে উঠল না৷ বলিষ্ঠ পুরুষালি বক্ষের নিচে চাপা পড়ে গেল নিমিষেই। সৃজার যখন একেবারে নাজেহাল অবস্থা, তখনই ওকে ছেড়ে দিলো ইহসান। পরণের পোশাক ঝেড়ে ঠিকঠাক করে নিয়ে, চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে একদম সাধু পুরুষের মতো বাচ্চাদের যত্ন নিতে লাগল সে। সৃজা কটমট করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। অথচ ইহসান এমন একটা ভান করল যেন সে একজন সাধু পুরুষ, সৃজাকে কিছুই করেনি।
সৃজা রাগে-দুঃখে কাঁচি দিয়ে ওর শার্ট কুচি কুচি
করে ছিঁড়ে বারান্দা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আজিজ শেখ তপ্ত মেজাজে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলছিলেন পুকুর পরিষ্কার করা নিয়ে। ক’দিন পর নাতিদের জন্য একটা গ্র্যান্ড পার্টির আয়োজন করবেন তিনি। এখন থেকেই তা-ই হরস্থুল শুরু করেছেন। দারোয়ানকে তিনি আগাছা কাটতে বলেছিলেন, কিন্তু দারোয়ান এখন অবধি
সেটা করেনি দেখে ঝাড়ছিলেন, ঠিক তখনি সফেদ রঙা কাপড়ের কতগুলো ছেঁড়া কাটা অংশ, সুতো তার মাথায় এসে পড়ল! আজিজ শেখ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন এ কাজে। দারোয়ান তো অবাক হয়ে বলেই ফেলল, চাঁদের বুড়িমা সুতা উড়াচ্ছেন। এই সুতা যখন একবার কারো গায়ে লাগে, তার অতিসত্ত্বর বিবাহ নিশ্চিত!
আজিজ শেখ বুঝে পেলেন না এটা কী হলো? কোথা থেকে এই সফেদ কাপড়ের আমদানি? আর তার মাথায়ই এসে কেন পড়ল? সকাল থেকেই যত্তসব বিরক্তিকর কাজকর্মে বাঁধা পড়ছেন তিনি। প্রথমে তো পটিভরা কাপড় নিজ হাতে তুলেছেন এখন আবার কোথা থেকে কীসব এসে মাথায় পড়ছে! মেজাজ খারাপ করে তিনি দারোয়ানকে প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বললেন, “অতিসত্বর তোর বিবাহ নিশ্চিত, আমি নিশ্চিত করমু হারামির পুত্! তোর তেত্রিশ হালি দাঁতের খিটখিটানি আমি তোর পেছনে ভরে দিমু।”
দারোয়ানের হাসি ওখানেই থেমে গেল এবং আজিজ শেখ তার মুখে সফেদ কাপড়টা ছুঁড়ে মেরে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।
বাচ্চাদের আগমন ও তাদের সুস্থ হয়ে উঠা উপলক্ষে ইহসান তার কাছের কিছু মানুষদের নিয়ে ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে ভেবেছে। যেখানে থাকবে একান্তই তার কাছের মানুষজন। কাকে কাকে ইনভাইট করা হবে সেই নিয়ে যখন আলোচনা চলছিল তখন সৃজা পুনমের নামটা বিশেষভাবে উল্লেখ করল। কারণ ও নিশ্চিত, ভাইয়েরা সালেহা বেগমকে যে চোখেই দেখুক না কেন; পুনমকে বোনের চোখেই দেখে। পুনমের প্রতি তাদের রুষ্টতা নেই, যেটা আছে সেটা স্নেহ। তাই বড়ো ভাই হিসেবে ইহসানের উচিৎ বোনের অভিমান ভাঙিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান হবে সেখানে পুনম না থাকলে সালেহা বেগমের নিশ্চয় ভালো লাগবে না। সে তো দেখে, সালেহা বেগম কতটা দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। স্বামীর সবকিছু মুখবুজে মেনে নিয়ে সংসার সামলাচ্ছেন একা হাতে। কখনো মুখফুটে নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথাও বলতে গেলেও পারে না।
ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে৷ বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনের মধ্যে আছেই একটা মাত্র মেয়ে তার, অথচ তাকে কাছে পাচ্ছে না, চোখের দেখা দেখতে পারছে না এটা যে কতোটা যন্ত্রণার মা হওয়ার পর থেকে প্রতি পদে পদে সৃজা সেটা টের পাচ্ছে। সৃজা এটা জেনেও অবাক হয়েছে যে, পুনমের ছোটো ছোটো দুটো ছেলে আছে অথচ সালেহা বেগম না কি এখনও নিজের নাতিদের দেখতেই পারেননি! তাই বাড়িতে যখন একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছেই, সবাই যেহেতু আসবেই পুনম কেন বাদ থাকবে? তাছাড়া ননদের সঙ্গে ইস্মির পরিচিতি থাকলেও সৃজার সঙ্গে তো আলাপন হয়নি পুনমের! এলিজা যেমন ওর ছোটোবোন পুনমও তো ওর কাছে সেরকমই। তা-ই সৃজা ইহসানকে খুব করে অনুরোধ করল, পুনমকে যাতে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। ইহসান ওর আবদারে সায় জানালেও সে দ্বিধায় ছিল, পুনম আসবে কি না এ ভেবে! এর আগে অনেকবার সে পুনমকে বাড়িতে ফেরানোর চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু তাদেরই তো জেদী বোন! মেয়েটা আসেনি মানে আসেইনি। শত বলে-কয়ে, আবদার করেও এ বাড়িমুখো করতে পারেনি মেয়েটাকে।
পুনমের মেয়র শ্বশুর সৈয়দ আসাদউল্লাহ গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। পরপর মৃত্যুবরণ করেন শ্বাশুড়ি রাবিয়া সুলতানাও। এখন পুনম তার স্বামী-সন্তান, ছোট দেবর, তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে যৌথভাবে বসবাস করছে সংসারের পুরো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। এসব রেখে মেয়েটা যে আসতে চাইবে না সেটা জানতো ইহসান। তবুও পরদিন ইজহানকে টেনে-হিঁচড়ে পুনমের বাড়ি নিয়ে গেল সে। ভরদুপুরে দুই ভাইকে দেখে পুনম বিস্মিত হবার সুযোগ পেল না, কান্নাকাটি করে একাকার হলো। ইজহান বোনের
কান্না দেখে তাকে ন্যাকু বলে কতক্ষণ ক্ষেপাল। ইহসান ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বিয়ের পর রাগ করে নিজের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া বোনের রাগ ভাঙাতে বসল। তার সৃজার কথা, দুটো চাঁদপাখির কথা, আরেকটা চাঁদপাখির আগমনের কথা শুনে পুনমের খুব ইচ্ছে হলো সবাইকে দেখতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু ইজহান সাফ সাফ মানা করে দিলো, বাড়িতে গেলেই সে তার টনা-মনাকে দেখতে দেবে। বাইরে থেকে কাউকে সে এলাউ করবে না।
বদনজরের একটা ব্যাপার আছে তো না কি? ইহসান ওর কথায় বিরক্ত হলেও ফোন বের করে বাচ্চাদের ছবি দেখাল, সৃজার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলো। ইস্মিও কথা বলল। বারবার করে পুনমকে বলল বাড়িতে ফেরার কথা! ফোনে সৃজা-ইস্মিতার সঙ্গে কথা বিনিময়ে ব্যস্ত ইহসান আর পুনম। এদিকে ইজহান একপাশে বসে গম্ভীরমুখে বসে আড়চোখে দেখে যাচ্ছে পুনমের দুটো ছেলেকে। একজনের তিন বছর, আরেকজনের দেড় বছর। অথচ এতো কম কথা বলা, এতো শান্ত কোনো ছেলেবাচ্চা ইজহান আদৌ দেখেনি। আসার পর থেকেই ও দেখে যাচ্ছে, পুনমের ছেলেগুলো বুঝদার বাচ্চাদের মতো কোনো শব্দ না করে, চেঁচামেচি না করে খেলা করছে। অথচ তার টনা? ৭ সপ্তাহ বয়স অথচ কোলে উঠালেই গলা ফাটিয়ে কাঁদছে, বমি করছে, হিসু করে ভিজিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাকে নয়, আজিজ শেখের কোলে উঠলেও টনাটা এরকম করছে। হাগুমুতু করে জামাকাপড় নষ্ট করে দিচ্ছে। ইজহান পুনমের বড়ো ছেলেটাকে কাছে ডেকে এনে উরুতে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর নাম কী রে?”
আধো আধো বুলিতে বাচ্চাটা নিজের নাম বলল, “শারাফ তাশফির।”
“কে রাখল এমন একটা নাম?”
“পাপা।”
“নামের মিনিং কী?”
“পজিটিভ প্রাইড।”
তিন বছরের একটা বাচ্চা নিশ্চয় তার নামের অর্থ জানবে না। বা জানলেও ঠিকঠাকমতো বলতে পারবে না এটাই ভেবেছিল ইজহান। কিন্তু শারাফের মুখে ইংরেজিতে ওর নামের অর্থ শুনে ইজহান পুরোপুরি বিস্মিত হয়ে গেল। অবাক ভঙ্গিতেই সে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল, “তোর ভাইয়ের নাম কী?”
“শামির তাশফির, মানে শার্প স্টোন।”
তিন বছর বয়সে ইজহান নিশ্চয় নিজের নামটুকুও বলতে পারতো না অথচ শারাফের পরিণত কথা আর বিনয়ী ব্যবহার দেখে সে থমকে গেছে। তিন বছরের শিশুর মুখে এমন মধুর ভাষা, এমন স্মার্টনেস—কে বিশ্বাস করবে? তখন তো দেখল, একা একাই হিসু করে এসে প্যান্টের জিপার একা একাই টেনে লাগিয়েছে। পুনম ছেলেটাকে কীভাবে এতো বুদ্ধিমান বানাল? নাহ! টনাটাকেও এ বয়স থেকেই সব ট্রেনিং দিতে হবে। ম্যানার্স শেখাতে হবে, ঘটে বুদ্ধি ঢুকিয়ে পরিপক্ব বানাতে হবে। নয়তো লোকের কোলে হাগুমুতু করা ছাড়া আর কিছু শিখবে না। ইজহান শারাফের গাল টেনে দিলো, “বাহ! কে শিখিয়েছে রে এসব তোকে?”
“মাম্মা পাপা।”
“আমি কে হই বল তো!”
“মামা হও।”
ইজহান শারাফের গাল টেনে দিলো, “সব জেনে বসে আছিস ব্যাটা, গ্রেট গ্রেট!”
“হু, মাম্মা বলে আমি খুব ট্যালেন্টেড বাচ্চা।…”
“তোর মাম্মা ঠিকই বলে।”
বলে ইজহান ওর নাক টেনে দিয়ে ছোটোজনকে ডেকে ওকেও কোলে নিয়ে বসাল। ছোটটা যদিও ভালোভাবে কথা বলা শেখেনি তবুও এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে দু’জনের পছন্দ-অপছন্দ সব জেনে নিলো ইজহান। মিজুকে কল করে বলে দিলো সবকিছু নিয়ে আসতে। বাচ্চারাও মামার সাথে খুব মিশে গেল। কে, কোন সুপারহিরোকে নিজেদের আইডল মানে সেটা নিয়েও গল্প হলো। নিজের পালা এলে ইজহান বলল, ইস্মিতা নামক সুপারহিরোইন ছাড়া অন্য কোনো সুপার হিরোইনকে তার পছন্দ না। বাচ্চারা অবাক হয়ে মামার নিজস্ব সুপার হিরোইনকে দেখতে চাইলে ইজহান বলল, শেখ বাড়িতে চল। তখন দেখতে পাবি। নয়তো দেখা যাবে না। তোর সান মামা, আমারও দুটো চাঁদপাখি আছে। নানী বাড়ি গেলে ওদেরও দেখতে পাবি। জলদি জলদি যাবি কিন্তু!
শারাফ মাথা নাড়ল, সে জলদি জলদিই নানী বাড়ি গিয়ে মামার সুপার হিরোইন আর চাঁদপাখিদের দেখে আসবে। শামির কিছু না বুঝলেও সেও ভাইয়ের দেখাদেখি মাথা নেড়ে রাজি হলো।
এদিকে মামা-ভাগ্নের মিল-মহব্বত দেখে, ইজহানের কথা শুনে বিস্মিত পুনম ইহসানকে জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া আসলেই এতো বদলে গেছে? বাচ্চাদের সঙ্গে এভাবে মিশে যেতে শিখেছে? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
ইহসান ভাইকে একপলক দেখে নিয়ে হাসলো, “না শিখলে বউ থাকবে? বউকে আটকে রাখার জন্যই তোর ভাইয়ের এমন বদল। বাড়িতে চল, আরো কত, কী দেখবি! আমার বাচ্চাদের তো আমিই কাছে পাই না এরজন্য। কোলে নিলেই এসে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাতে রেখে দিচ্ছে, ঘরভর্তি করে খাবারদাবার, খেলনাপাতি কিনে আনছে…”
পুনম অবিশ্বাস্য গলায় বলল, “আসলেই?”
“হুঁ, আসলেই। আমি এখনো দ্বিধাদ্বন্দে ভুগি, ও যদি এতোই ভালো বাবা হবে, তো সেবার কেন ওরকম একটা কান্ড করল? বাচ্চাটা এলে, ইস্মিতার সঙ্গে সম্পর্কটা আরো আগেই স্বাভাবিক হয়ে যেতো। এ নিজের দোষেই বাচ্চাটাকে হারিয়ে এখন দেখ, অন্যের বাচ্চাদের জন্য কতোটা পাগল! ট্রেনিং পর্যন্ত নিচ্ছে কীভাবে বাচ্চা সামলাতে হয়, বুঝলি! যাক, দেরিতে হলেও যখন বোধবুদ্ধি উদয় হয়েছে, ভালো থাকবে এটাই আশা করি।”
ইহসানের মুখে কথাগুলো শুনে পুনম সত্যিই পুলকিত হলো। মনে মনে সেও প্রার্থনা করল তার এই আধপাগল ভাইটা যাতে সবসময় এমনই থাকে, আজকের মতো। আগেরবারের মতো যাতে বদলে না যায়! ঐ ইন্সিডেন্টটা মনে আছে পুনমের, বাচ্চা হারানোর পর ইস্মি যখন বাপের বাড়ি চলে গেল…একটা ভাতের দানাও গলা দিয়ে নামাতো না ইজহান। ঘর অন্ধকার করে বসে থাকতো। বাইরে বেরুতো না। আজিজ শেখ জোর করেও ওকে চৌকাঠ মারাতে পারেননি। শেষে তো অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো! পুরোনো কথাগুলো ভেবে পুনম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইহসান তাড়া দিলো চলে যাওয়ার জন্য। তাকে আরো কয়েক জায়গায় যেতে হবে, কাজ আছে। বাড়িও ফিরতে হবে দ্রুত। পুনম অবশ্য ছাড়ল না ভাইদের, দুই জা মিলে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিলো জোর করে। বিদায়ের পূর্বে ইহসান বারবার করে বলল, সে নিজে এসে ইনভাইট করেছে পুনম যাতে তার মান রেখে দু’দিন পর অবশ্যই অবশ্যই বাড়িতে যায়। নয়তো চড়িয়ে তার গাল লাল করে দেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানই করা হবে না। ইজহান তো রীতিমতো হুমকি দিয়েছে, পুনম যদি স্বেচ্ছায় না আসে তার টনা-মনার অনুষ্ঠানে, তাহলে তাকে তার দুই ছেলেসহ তুলে নিয়ে যাবে। নিজের রগচটা ভাইদের হুমকিধমকি শুনে পুনম হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেল না। তবে সত্যিই ওর ইচ্ছে করল নতুন মানুষগুলোকে একপলক দেখার জন্য, যাদের জন্য তার ভাইয়েরা একটু হলেও সামাজিক আচরণ করতে শিখেছে। পুনম ফোন করল তার স্বামীকে। প্রয়াত মেয়র সৈয়দ আকবরউল্লাহের মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসায়ের দায়ভার এসে পড়েছে পুনমের স্বামী আর দেবরের কাঁধে। ব্যস্ততাও বেড়েছে তাদের। ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হয় পুনমের স্বামী আহাদকে।
বর্তমানেও সে ব্যবসার কাজে দুবাই থাকলেও ফোনে স্ত্রীকে সে অনুমতি দিয়েছে। খুশি মনেই বলেছে, যতদিন খুশি ততদিন বাপের বাড়িতে বেড়িয়ে আসুক! বিয়ের পর তো একদিনও যায়নি। সব জমা হয়ে আছে লিস্টে! এখন বাচ্চাসমেত গিয়ে সুদে-আসলে উসুল করে আসুক, কোনো সমস্যা নেই। তবে তার অধম স্বামীটাকে যাতে এই চক্করে ভুলে না যায়, এটা এনশিওর করলেই হবে। এনশিওর করার জন্য দিনে তিন’বার ফোন করলেই চলবে নিজে থেকে। স্বামীর অমায়িক আচরণে কৃতজ্ঞ পুনম ভেবে পায় না এই লোকটা এমন অদ্ভুত কেন, এতো ভালো কেন? সে যা বলে তা-ই কেন নিদ্বির্ধায় মেনে নেয়? একটুও না করতে পারে না কেন ওকে? এই ভালোবাসা কী আসলেই সে ডিজার্ভ করে? হু, করে। আর করে বলেই ডেসটিনি তাদের এক করে দিয়েছে সব অভিযোগ আর বিতৃষ্ণা দূর করে দিয়ে।
বাচ্চাদের নাম রাখা অনুষ্ঠান নিয়ে ইহসান যদিও বাবার সঙ্গে কোনো আলোচনা বা একাত্মতা পোষণ করেনি, চায়ওনি বাবার সাহায্য বা তার কোনো মতামত, তবুও আজিজ শেখ ঠিক করলেন সেই একি দিনে তিনি তার
দিক থেকে সবাইকে ইনভাইট করে বিশাল আয়োজন করে নাতি-নাতনিদের আকিকা অনুষ্ঠান পালন করবেন। যাতে লোকে দেখে হা হয়ে যায়। আজিজ শেখের পরিকল্পনা জানতে পেরে ইহসান প্রচন্ড রাগ করল। মানে কী? এই লোকের জন্য কি সে তার বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে পারবে না শান্তিমতো? করবি তো নিজের মতো কর, তাই বলে তার ফিক্সড করে দেওয়া ডেইটেই? মানে এই লোক কি কখনো ওকে শান্তি দেবে না? ইহসান প্রচন্ড রাগে কাঁপতে লাগল। ইজহানই তখন বলল, আজিজ শেখের যা করতে ইচ্ছে করে করুক, নিজের টাকা খরচ করে সে যা খুশি করুক তাতে কারো তো কিছু যায় আসবে না। মানুষ যদি নিজ কর্মে সুখ খুঁজে পায়, তাকে সেভাবেই সুখী থাকতে দেওয়া উচিৎ। ইহসানের উচিৎ নয় নাক গলানো। কারণ এতে শুধু তিক্ততা বাড়বে, অনুষ্ঠানের আনন্দ পন্ড হবে। বাচ্চাদের সুন্দর একটা দিন তিক্তময় হয়ে উঠবে। তাই আজিজ শেখের কার্যক্রমে পাত্তা না দিয়ে সবকিছু যেভাবে আগাচ্ছিল সেভাবেই আগানো উচিৎ। অগত্যা ইহসান অনেক কষ্টে নিজের মনকে মানাল এই বলে যে, সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাছের মানুষদের নিয়েই আকিকা
অনুষ্ঠান করবে। তার বাপের যা খুশি করতে ইচ্ছে হয় করুক, সে চেয়েও দেখবে না।
একপ্রকার ভাইয়ের বৌদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল আর দুই ভাইয়ের অত্যাচারে বাড়িতে না আসার প্রতিজ্ঞা ভেঙে অনেকটা বাধ্য হয়েই বাপের বাড়িতে এসেছে আজ পুনম। আর শারাফ, শামির এসেছে সান মামার ছোট্ট দুটি চাঁদপাখি আর ইজু মামার সুপার হিরোইনকে স্বচক্ষে দেখতে। ইহসান গিয়ে ওদের নিয়ে এসেছে। সালেহা বেগম জানতেন না পুনম আসবে, হুট করে বিকেলে ইহসানের সঙ্গে মেয়েকে বাড়িতে ফিরতে দেখে তিনি স্তব্ধ ও হতচকিত! বহুদিন পর দেখে গর্ভে ধরা একমাত্র মেয়েকে দেখে সালেহা বেগমের চোখের জল বাঁধ মানেনি। রান্নাঘরের দরজায় খুন্তি হাতে দাঁড়িয়েই তিনি কেঁদে ফেলেন। সহজসরল, ভীতু, অসহায় মাকে এতদিন পর দেখে পুনমও নিজেকে আটকাতে পারেনি। মাকে জড়িয়ে ধরে সেও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল! সালেহা বেগম তো কান্নার মাঝেই মেয়েকে চড়-থাপ্পড় শুরু দিতে শুরু করলেন! পুনম মায়ের রাগ, অভিমান বোঝে, তাই বাঁধা দেয় না আর। মায়ের বুকে ছোট্ট পুনম যেভাবে লেপ্টে থাকতো, বিশ বছরের বড়ো পুনম সেভাবেই পড়ে রইল মায়ের বুকে।
মান-অভিমানের পালা সেরে দুই মা-মেয়েতে মিলে এখন সাংসারিক গল্পে মনোযোগ দিয়েছে। শারাফ আর শামিরকে কাছ ছাড়াই করছেন না তিনি। মায়ের খুশি দেখে পুনম মনে হচ্ছে, সে যা করেছে তা ঠিক হয়নি। অন্তত নিজের মায়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ রাখা উচিৎ ছিল। সে ছাড়া আর কে আছে সালেহা বেগমের? ভাইয়েরা ওকে নিজের বোন মনে করলেও তার মাকে এখনো অবধি নিজের মায়ের আসনে বসাতে পারেনি। সেই হিসেবে সালেহা বেগম তার চেয়েও বেশি দুঃখী। অথচ বাবা নামক লোকটা কোনোদিনই তার মায়ের দুঃখ ঘোচানোর দায়িত্ব নেয়নি। এতবছর পর বাড়িতে ফিরলেও পুনম তাই আজিজ শেখের সাথে কথাবার্তা বলেনি। যদিও আজিজ শেখ আম্মাজান ডেকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল কয়েকবার, কিন্তু বাবার এই মেকি আদরের ডাক সে খুব কৌশলে এড়িয়ে গেছে। যেই লোক নিজের মেয়ের স্বপ্ন ভেঙে দেয়, নিজের মেয়েকে বিশ্বাস না করে একটা কুলাঙ্গারকে বিশ্বাস করতে পারে তার প্রতি আর যাইহোক সম্মান আসে না। ভালোর মধ্যে একটা কাজই ভালো করেছে আজিজ শেখ। একটা সঠিক পুরুষের হাতে তুলে দিয়েছে পুনমকে। যে লোকটা তাকে খুব ভালোবাসে, সম্মান করে, তার সব আবদার মেটানোর চেষ্টা করে। এমনকি পড়াশোনার আবদারটাও রেখেছে। সংসার সামলে, বাচ্চাদের সামলে গ্যাপ দিয়েও অনার্স প্রথম বর্ষের পড়াশোনাটা সে কন্টিনিউস করছে।
এদিকে পুনমকে প্রথমবারের মতো দেখে, কথা বলে সৃজার খুব ভাব হয়ে গেলেও সালেহা বেগমের সঙ্গে পুনমের মিল দেখে সৃজার খুব নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছিল! মা-বাবা থাকলে নিশ্চয় তার বাচ্চাদুটোকে নিয়ে এভাবেই আনন্দ করতো? ছোট্ট সৃজা বড়ো হয়েছে, বিয়ে হয়েছে,
সে দুইটা পাখির মা হয়ে গেছে, তার একটা স্বামী আছে, একটা সংসার হয়েছে। সৃজার কী মায়ের সামনে সংসারী রুপে যেতে খুব লজ্জা লাগতো? উফ! সৃজা এই আনন্দঘন পরিবেশগুলো কেন পায়নি? নিজের সবগুলো মানুষকে একসঙ্গে আনন্দে দেখার একটা আফসোস যে রয়েছে,
এটা কি কখনো মিটবে না? আসলেই কখনো মিটবে না। বেঁচে থাকলেই না আশা রাখা যেতো, মানুষগুলো তো এই পৃথিবীতেই নেই! হুট করেই মা-বাবাহীন পৃথিবীর সবকিছু কেন যেন বিষাদ ঠেকল সৃজার কাছে।
অশ্রুবন্দি পর্ব ৬০
এই প্রথম বোধহয় শেখ বাড়িটাকে একটু প্রাণবন্ত লাগছে। আজিজ শেখ মনভরে দেখছেন তার মেয়ে আর ছেলেদের সুখী সুখী মুখ। তবুও সবকিছুর মধ্যে তিনি তার ছোটো ছেলেকে খুব মিস করছেন। ছেলেকে ছাড়া এ অনুষ্ঠানটা তার জমবেই না, এক লোকমা খাবারও তার গলা দিয়ে নামবে না যেখানে তিনি জানেন, তার ছোটো রাজপুত্রটা এখন দেশে আছে। আজিজ শেখের কী হলো কে জানে, ছেলের প্রতি স্নেহে অন্ধ হয়ে তিনি রাত এগারোটায় ফোন
করে খুব করে ইনজানকে আবদার করলেন পরশু দিন বাচ্চাদের আকিকা অনুষ্ঠানে যেন সে আসে। তাহলেই তার পরিবারটা পূর্ণ হবে।