অশ্রুবন্দি পর্ব ৬২ (২)
ইসরাত জাহান ফারিয়া
দোতলা বিশাল বাড়িটি পুরোনো আমলের নকশায় নির্মিত। একেকটা জানালা, বারান্দা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বিশাল। বাইরে থেকেই বোঝা যায় ঘরগুলো বড়ো বড়ো ঘর। ভেতরে স্যান্ডস্টোন রঙ হলেও বাইরের দেয়ালে হলদেটে রঙ ঘষা। গল্প-উপন্যাসে জমিদারদের বাড়ি যেমন থাকে ঠিক তেমনি আভিজাত্যপূর্ণ এই শেখ বাড়িটা। খুব বড়ো আর প্রশস্ত। লোহার গেইট, ঘাসে ঢাকা বিশাল উঠোন, সুড়কি বিছানো পথ। পথের দু’পাশে সাদা রঙের পাথর দিয়ে বর্ডার দেওয়া। একপাশে বিশাল একটা বাগান। তাতে বাহারি ধরনের ফুল, দেশি-বিদেশি সব রকমের। বাড়ির পেছনে একটা পুকুর। তার পাড়ে সারি সারি গাছ লাগানো। বেশিরভাগই নারকেল গাছ। পুকুরের পানি স্বচ্ছ। তাতে চড়ে বেড়াচ্ছে কয়েক জোড়া রাজহাঁস। বাড়ির ছাদে উড়ছে কবুতর। পুকুরে রাজহাঁস আর ছাদে কবুতরের উড়াউড়ি ব্যাপারটা খুব নান্দনিক। প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য গাছ-পালা। যেগুলোর বয়স তিন যুগেরও বেশি।
বাড়িটির শেষ প্রান্তের প্রাচীরের পরই বোধহয় রেল লাইন। শেখ বাড়িতে পা রাখামাত্রই এলিজার কানে এসেছে ট্রেনের সেই ঝক…ঝকা…ঝক শব্দ। নীলু ফুপিও শুনেছে। তারা এসেছে একটু আগে। এই বারোটার পরে! এই নিয়ে সৃজা দু’জনের উপরই ভীষণ অভিমান করেছে। অবশ্য করবেই তো! যেখানে বারবার করে বলে দিয়েছে তারা যেন সকাল সকালই চলে আসে, সেখানে সারারাত পড়াশোনা গুছিয়ে, এলার্ম দিতে ভুলে যাওয়ার কারণে এলিজা সকালে ঘুম থেকেই উঠেছে নয়টার দিকে। উঠে তড়িঘড়ি করে গোছগাছ সেরে তৈরি হয়ে, বাড়ির দায়িত্ব ভাড়াটে আংকেলের উপর চাপিয়ে দিয়ে আসতে আসতেই এতোটা দেরি হয়েছে তাদের।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বোনের রাগ দেখে এলিজার অসহায় লাগছে, বারবার সরি বলছে কিন্তু সৃজা ওর সঙ্গে ফর্মালিটি করে কথা বলা বন্ধ করছে না। ‘আপনি, আপনি’ সম্বোধনে কথা বলছে। যেটা শুনতে একটুও ভালো লাগছে না এলিজার। বোনের রাগ ভাঙানোর চক্করে সে বাচ্চাদুটোকে পর্যন্ত আদর দিতে পারছে না। একবার বোনের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার দুটো হাওয়াই মিঠাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে অসহায় নজরে। শেষমেশ আর না পেরে এলিজা উঠে গিয়ে বোনকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অভিমানী কণ্ঠে বলল, “শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে আপু। একদম মায়ের মতোন। আমার তোমাকে মন ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তুমি এরকম রাগ করে থাকলে আমি কীভাবে আমার মাতৃতুল্য আপুকে দেখি বলো তো?”
এলিজার কথা শুনে সৃজার রাগ কিছুটা কমলও।
কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “মায়ের মতোন দেখালেই তো আর মা হয়ে যায় না। তেমন আমিও হতে পারিনি তোর মা। নয়তো আমার কথাকে এভাবে হেলাফেলা করতে পারতি না। বলেছিলাম দু’দিন আগে আসতে, এলি না। বলেছিস তোর এক্সাম। মেনে নিলাম। তারপর বললি, আজ একদম ভোর ভোর চলে আসবি। কিন্তু তাও কথা রাখলি না, সারারাত পড়াশোনা করে এসেছিস বেলা করে। ওকে ফাইন। তুই থাক, তোর পড়াশোনা নিয়েই থাক। আমাকে আর আমার বাচ্চাদের দেখতে আসার প্রয়োজন নেই।”
ইহসান একপাশে বসে গালে হাত দিয়ে দুই বোনের মান-অভিমানের খেলা দেখছে। সে কিছুই বলছে না। এলিজার শুকনো মুখ দেখে হাসিও পাচ্ছে মাঝেমধ্যে। কিন্তু বাইরে সেসব কিছুই প্রকাশ করছে না। সিরিয়াস থাকার ভান করছে। কারণ এরকম একটা বিশেষ দিনে দেরি করে এসে এলিজ মোটেই ঠিক করেনি। কান্ড-জ্ঞানহীনের মতো আচরণ করেছে। যেটা ওর সঙ্গে যায় না। এটুকু বকাঝকা ওর প্রাপ্য। নীলু বেগম দুই নাতি-নাতনিকে নিয়ে ব্যস্ত। তার এদিকে খেয়াল নেই। কিন্তু সৃজার থেকে এমন নিষ্ঠুর আচরণে অনভ্যস্ত এলিজা ব্যগ্র স্বরে বলল, “একটা ভুল
করে ফেলেছি আমি অজান্তে। তারজন্য বারবার সরি বলছি এরপরেও তুমি দূরে ঠেলে দেবে আমাকে? আমার কারো কাছে যাবার নেই বলে? আপু তুমি এতো কঠিন?”
ইমোশনাল ফুল কথাবার্তা এলিজ বলে না কখনো। কিন্তু পারতপক্ষে যখন বলে তখন খুবই করুণ শোনায় সেটা। সৃজার বুকটা কেঁপে উঠল নিমিষেই। আসলেই তো, মেয়েটা এই প্রথমবার এখানে এসেছে। একটু দেরি না হয় করেই ফেলেছে। তাই বলে এতোটা কঠিন হওয়া ঠিক হয়নি। সৃজা একটু সময় স্থির থেকে পেছনে ফিরে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আর আমার বুঝি যাবার মতো অনেকেই আছে?”
“ফুপি আছে, ভাইয়া আছে, দুইটা হাওয়াই মিঠাই আছে। এলিজ তো তোমাকে দেওয়া ছোট্ট একটা কথাই রাখতে পারে না। তার না থাকলেও চলবে।”
“পুরো দুনিয়া থাকলেও এলিজকে লাগবে আমার। কোনো কথা না রাখতে পারলেও এই মেয়েটাকে দরকার আমার। এলিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য হলেও ওকে প্রয়োজন আমার।”
এলিজা ওর বুকের মধ্যে ঘাপটি মেরে বলল, “আমার সাথে ঠিকঠাক করে কথা বলো আপু। তুমি এমন করলে আমার একটুও ভালো লাগে না।”
অভিমানের পালা শেষ করে সৃজা ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল, “আমারও ভালো লাগেনি এলিজের
সঙ্গে এভাবে কথা বলতে। কিন্তু আমার রাগ হচ্ছিল তোর উপর। আমি কতো এক্সাইটেড ছিলাম বল তো! এই প্রথম আমার আপনজনেরা এ বাড়িতে আসবে, আমার বাচ্চাদের একটা বিশেষ দিনে। সেখানে বারোটা অবধি আমার পরিবারের কেউ নেই, বিষয়টা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল!”
“আমি সত্যিই কান্ড-জ্ঞানহীনের মতো কাজ করেছি। যেটা করা উচিৎ হয়নি। সরি আপু।”
সৃজা ওর মুখটা আগলে নিয়ে কপালে ছিটকে এসে পড়া লম্বা কালচে-বাদামি চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে নরম গলায় বলল, “ওকেহ! সরি এক্সসেপ্টেড। আর কখনো এমন ভুল করবি না। এখন ঠিকঠাক করে দেখে বল শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে!”
বোনের অভিমান ভাঙাতে পেরে এলিজার ঠোঁটে
হাসি ফুটে উঠল। স্বস্তি পেল সে৷ জহুরি চোখে বোনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সরু গলায় বলল, পাহাড়ের পাদদেশে শাড়ির আঁচল ঘাসে বিছিয়ে বসে কাঁদতে থাকা, বৃষ্টিবিলাসে মগ্ন উপন্যাসের নায়িকার মতো লাগছে। ছোট ছোট মেঘকণাদের ছোঁয়ায় শাড়িতে অপরুপ রূপবতী হয়ে উঠা প্রেমিকাকে দূর থেকে দেখে ক্ষণে ক্ষণে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে প্রেমিক। আর প্রেমিকের সেই দৃষ্টি দেখে প্রেমিকা বিরহ জ্বালায় কাঁদছে। হ্যাঁ, এলিজের আপুকে সাদা-নীল জামদানিতে ঠিক সেরকমই দেখাচ্ছে। একদম বৃষ্টিভেজা আকাশনীলার মতোন। এলিজা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, সৃজা তো শাড়ি পরতে জানে না তাহলে এত সুন্দর করে কে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে? সৃজা মুখ ফসকে ইহসানের কথা বলতে গিয়েও আমতাআমতা করে বলল, ইউটিউব দেখে সে নিজে নিজে পরেছে। মিথ্যেটা বলেই সৃজা আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, মেয়ের মুখে ফিডার ধরে তাকে খাওয়ানোর ভান করতে থাকা ইহসান মিটিমিটি হাসছে, শয়তানি হাসি। সৃজার গালদুটো কেমন লাল হয়ে উঠল ইহসানের ঠোঁটের কোণের অস্পষ্ট শয়তানি হাসিতে!
সিঁদুরে লাল সালোয়ার-কামিজে এলিজাকে দেখাচ্ছে ঠিক অভিমানী, নরম, তবু চোখ জুড়িয়ে দেওয়া একটা রক্তরঙ গোলাপ। ফুলস্লিভ জামায় হাতদুটো ঢাকা,
মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করে, দু’পাশ থেকে সামান্য চুল তুলে টুইস্ট করে পেছনে আটকে দেওয়ায় খুব পরিপাটি দেখাচ্ছে ওকে। কোমড় ছাড়ানো কালচে-বাদামি অবশিষ্ট চুলগুলো খোলা, হালকা বাতাসে দুলছে নরম ভাঁজে ভাঁজে। চোখে নেই একফোঁটা কাজল, ঠোঁটেও কোনো রঙ নেই। তবু ওর মধ্যে এমন এক শুচিতা মেশানো যে ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, না সেজেও কাউকে যদি অবিশ্বাস্য সুন্দর লাগ, তাহলে সেটা এলিজা ছাড়া আর কেউ নয়।
সাজগোজবিহীন এলিজার অনাড়ম্বর রূপটা ওকে সবার থেকে এতোটাই আলাদা করে তুলেছে যে, ওর অতিরিক্ত ফর্সা, মিষ্টি অথচ খুঁতওয়ালা মুখের দীপ্তি থেকে কেউই চোখ সরাতে পারছিল না। সকলের এমন দৃষ্টিতে এলিজা প্রচন্ড বিব্রতবোধ করে মাথায় ওড়না তুলে দিলেও ওর সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া কয়েকজন এসে তো তাদের ছেলে, ভাতিজার জন্য বিয়ের প্রস্তাবই দিয়ে বসল নীলু বেগমের কাছে। সরল-সোজা নীলু বেগম কোনোমতে এটা-সেটা বলে পরিস্থিতি সামলালেও রাগে-দুঃখে এলিজা ঠিক করল, সে ঘরেই বসে থাকবে। বেরুবে না। সৃজাও বোনের অস্বস্তি বুঝে ওকে আর জোর করেনি। তবে ইস্মির বাবা আর ভাই আকাশ যখন এলো, অল্পতেই মিশে গিয়ে আকাশ মামাকে লালপরী দেখানোর জন্য শারাফ এসে একপ্রকার জোর করে এলিজাকে সঙ্গে নিয়ে গেল।
তবে ফর্মালিটি রক্ষার্থে আকাশের সঙ্গে পরিচয়ের পর জানা গেল, সে এলিজার ভার্সিটির একজন অ্যালামনাই—একসময়কার সিনিয়র। বহু আগেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে এখন চার বছর ধরে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত। তবুও ভার্সিটির সিনিয়র ভাই আকাশের সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে এলিজা অনেকখানি সহজ হয়ে গেল ওর সঙ্গে। দু’জনের মধ্যে বেশিরভাগ কথাই হলো ভার্সিটি আর পড়াশোনা রিলেটেড। দূর থেকে নিজের আঠাশোর্ধ্ব ছেলেকে একটা সুন্দরী, মিষ্টি দেখতে মেয়ের সঙ্গে দেখতে পেয়ে ইস্মির বাবা সিরাজুল ইসলাম মনে মনে একটা ব্যাপার ভাবলেন! সেই ভেবেই তিনি ইস্মিতাকে একফাঁকে নিজের মনে আসা ভাবনাটা খুলে বললেন। বাবার কথা শুনে পেটে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব করতে থাকা ইস্মি তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে পারল না। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলো। সিরাজুল ইসলামকে বলল, অনুষ্ঠান শেষ হোক। সে কথাটা বলে দেখবে।
আযরান শেহজীর শেখ,
আজওয়া শেহরিন শেখ।
সকলের সম্মতিতে নাম ঠিক করে দোয়া দুরুদ পাঠ করে, দান-খয়রাত করে বাচ্চাদের মঙ্গল কামনায় একটু আগেই আকিকা অনুষ্ঠানের মূল সৌন্দর্য সম্পন্ন হয়েছে। অতিথিরা যারা এসেছে সকলেই এতো এতো উপহার নিয়ে এসেছে বাচ্চাদের জন্য যে ঘরভর্তি হয়ে গেছে। ফকির-মিসকিন যারা এসেছে তারা সকলেই তৃপ্তিভরে খেয়ে বাচ্চাদের দোয়া দিয়ে যাচ্ছে। ভেতরে বেশি চেঁচামেচি নেই। হৈ-হুল্লোড় যা হচ্ছে বাড়ির বাইরের উঠোনে, যেখানে আজিজ শেখ তার নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করছে। ইহসান সেখানে যায়নি, যাওয়ার ইচ্ছেও ওর নেই। তবে যাদের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে, তাদেরকে সে যথাযথ আপ্যায়ন করার চেষ্টা করেছে। অনেকক্ষণ যাবৎ অনুষ্ঠান সামলে সে ক্লান্ত। তাছাড়া মেয়ে কান্নাকাটি করছিল বলে বেশিক্ষণ আর দূরে থাকতে পারেনি। সবকিছুর দায়িত্ব ঘ্যানঘ্যান করে মাথা খাওয়া ইজহানের উপর ছেড়ে দিয়ে তীব্র গরমে কান্নাকাটি করে অস্থির হওয়া মেয়েকে শান্ত করেছে সে।
আপাতত টুকটুকে লাল ফ্রক পরনে ইহসান কন্যা আজওয়া শেহরিন শেখ বাবার বুকের কাছে পাঞ্জাবির অংশটা ছোট্ট হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুমাচ্ছে। আর মেয়ের ঘুমের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য ইহসান গত একঘন্টা যাবৎ একই ভাবে পিঠ সোজা করে বসে আছে। আর সৃজা ছেলেকে নিয়ে আছে পুনমের ঘরে। সেখানে ইস্মি, এলিজা, নীলু বেগম ছাড়াও, মিজুর স্ত্রী সায়মাসহ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসা অনেকেই আছেন। সকলে মিলে আড্ডার মতো আসর জমিয়েছে, যে আড্ডার মূল বিষয়ই কীভাবে বাচ্চা মানুষ করতে হয়, কীভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় সেসব। মেয়েলি আড্ডায় ইহসানের কোনো কাজ নেই, তাই সে মেয়ে নিয়ে বসার ঘরেই আছে। এখান থেকেই সে তদারকি করতে পারছে তার লোফার ভাইকে। যে যেচে পড়ে মেজবানদারির দায়িত্ব নিয়েছে ঠিক কিন্তু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ঘুমন্ত মেয়ে কোলে নিয়ে বসে থাকা ইহসান ভাইকে নাস্তানাবুদ হতে দেখে ক্রুর হাসছে। তার নাকে ইদানীং যেভাবে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছিল সবকিছু সামলাবে বলে, এখন সামলাক! দেখুক কী মজা! ইহসান যখন এসব ভেবে আনমনে হাসছিল, তখনি ওর ঘোর কাটে বাচ্চা ছেলের কণ্ঠ শুনে। ইহসান তাকিয়ে দেখল শারাফ তার কাছে দাঁড়িয়ে। খুব মনোযোগ দিয়ে তার ঘুমন্ত মেয়েকে দেখছে। দেখা শেষ করে শান্ত স্বরে ইহসানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ও কি ঘুমাচ্ছে মামা?”
ইহসান মেয়েকে একপলক দেখে নিয়ে ওর মাথায় আলতো হাত ছুঁইয়ে বলল, “হুম, ঘুমাচ্ছে। কেন বলো তো?”
“ওকে নিয়ে খেলা করতে চেয়েছিলাম।”
গোমড়া মুখে কথাটা একটু জোরেই বলেছিল শারাফ। যার ফলে ঘুমন্ত আজওয়ার কপাল কুঁচকে গেল খানিকটা৷ মেয়ের ঘুম হালকা হচ্ছে বুঝতে পেরে ইহসান ঠোঁটে আঙুল চেপে ‘হুঁশশশ’ শব্দ করে শারাফকে চুপ থাকার ইশারা করে ফিসফিস করে বলল, “ওর ঘুম ভাঙিয়ে খেলার অফার করাটা কী ঠিক হবে বাবা?”
শারাফ দু’পাশে মাথা নাড়ল। যার মানে কাউকে ঘুম থেকে তুলে খেলা করার অফার করাটা ঠিক হবে না। এটা ব্যাড ম্যানার্সের মধ্যে পড়ে। বাবা শিখিয়েছে তাকে। আর বাবা যা শেখায় তা ভোলে না শারাফ। সে বুঝদার বাচ্চাদের মতো নিচু স্বরে বলল, “ঠিক আছে চাঁদপাখিকে পরে খেলতে ডাকব, যখন ওর ঘুম ভাঙবে। তুমি তখন পারমিশন দেবে তো?”
শারাফের মুখে ‘চাঁদপাখি’ সম্বোধন শুনে ইহসান মেয়ের দিকে তাকাল। আসলেই তার কন্যা একটা চাঁদপাখি। এত্তো আদর আদর একটা চেহারা, বাপ হয়েও মাঝেমাঝে চকলেটের মতো গিলে ফেলতে ইচ্ছে করে মেয়েকে। ইহসান হাসলো শারাফের দিকে তাকিয়ে, “অবশ্যই দেব। কেন দেব না? তুমি তো ভালো ছেলে, ভালো ছেলেদের কাছে বোন দেওয়াই যায়!”
“বোন, কে?”
শারাফের ভ্রু কুঁচকে গেল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল ইহসানের দিকে। এইটুকু বাচ্চার ভাবভঙ্গিমা দেখে বিস্মিত হলো ইহসান। সে মেয়েকে ইশারা করে দেখিয়ে শারাফকে বলল, “এইযে, এই পরীটা,
এটাই তোমার বোন। কেন, তুমি জানো না?”
“না, ও তো চাঁদপাখি। আমার বোন না।”
শারাফ বিস্মিত হয়ে গেল। ইহসান ওর পাকামো
কথা শুনে হেসে ফেলল, “চাঁদপাখি দেখেছ?”
শারাফ নেতিবাচক উত্তর দিয়ে বলল, “ওকেই প্রথম দেখেছি। ইজু মামা বলেছে, তারও না কি আরেকটা চাঁদপাখি আসবে। আমার কোলে দেবে বলেছে…”
ইহসানের এতো হাসি পেল যে আরেকটু হলে মেয়ের ঘুমই ভাঙিয়ে ফেলতো। বহুকষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে শারাফকে বলল, “তুমি নিজেও তো একটা চাঁদ বাবা! আরো দু দুটো চাঁদপাখি কোলে নিতে পারবে?”
“খুব পারব। আমি তো পাপার সাথে জিমও করি। আমার অনেক শক্তি!”
শারাফ তার মাসল বের করে দেখাল। তার মধ্যে সুপারম্যানের শক্তি আছে সেটাও বলল। কীভাবে কীভাবে সে তার চাঁদপাখিদের প্রটেক্ট করবে সেটা নিয়েও বিস্তর আলোচনা করল ইহসানের সঙ্গে।
ওর সবগুলো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে চোখ
বড়ো বড়ো করে তাকাল ইহসান ওর দিকে। ভাবটা এমন যে, সে সত্যিই বিশ্বাস করেছে শারাফের গায়ে
অনেক শক্তি। সেই সঙ্গে কল্পনাও করল, তার আযরান কবে এতো বড়ো হবে আর তার সঙ্গে এভাবে মনখুলে কথা বলবে। সেই দিনটা আসতে ঠিক কতো দেরি? ইহসানের কি সৌভাগ্য হবে দিনগুলো দেখার? কেন যেন আচমকা ইহসানের বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো! যার কোনো মানেই সে বুঝল না।
মেহমানদারিতে অপটু ইজহান তার পরণের সাদা পাঞ্জাবিটাতে তরকারির ঝোল ফেলে পাঞ্জাবিটা একদম নষ্ট করে ফেলেছে। এরজন্য মেজাজ খারাপ ইজহানের। কারো সাথে রাগ দেখাতে না পেরে একটু পরপরই মিজুকে অহেতুক ধমক দিচ্ছে। বেচারা মিজু বউ নিয়ে এসেছিল অনুষ্ঠানে, ভেবেছিল আজ একটু নিস্তার পাবে এই আধপাগল স্যারের রোষানল থেকে। কিন্তু তা আর হলো কই? সে একবুক দুঃখ নিয়ে স্যারের প্রতিটা কথা মেনে চলার চেষ্টা করছে। এই একে ডাল এনে দিচ্ছে তো অন্যজনের প্লেটে মাংস তুলে দিচ্ছে।
একবার এই টেবিলে ডাক পড়ছে তো অন্য টেবিলে ডাক পড়ছে। এদিকে পাঁচ নম্বর টেবিলের এক ব্যবসায়ী তার পনেরো বছরের বড়ো ছেলেকে নিয়ে খেতে বসেছে। কিন্তু একটু পরপরই ইজহানকে ডেকে বলছে, আমার ছেলে বড়ো মাছ খায় না, ওকে চিংড়ীর মালাইকারীটা দাও। দেশী মুরগী না ওকে সোনালী মুরগীর রোস্ট দাও। বোরহানিটা খেতে দারুণ, আরেকটু এনে দাও। পোলাওটা ঝরঝরে, লোকের মতো কাচ্চি করোনি ভালোই করেছ। ঐ একপদে কিছু হয়? টাকা বাঁচানোর জন্য লোকে আজকাল যত্তসব কিপটামি শিখেছে। খেয়ে আর উপহারের পয়সা উসুল করা যায় না। তবে তোমাদের আপ্যায়নটা ভালো হয়েছে। অনেকদিন পর পেটপুরে নানা পদের ভোজন সারলাম। দেখতে হবে তো, শেখ বাড়ির আপ্যায়ন বলে কথা!
তৈলাক্ত কথাবার্তা সহ্য হয় না ইজহানের। সঙ্গে সঙ্গেই ওর মেজাজ আবারও খারাপ হয়ে গেল। বাঁকা স্বরে কিছু একটা বলে উঠতে যাবে তখনি কোথা থেকে ইহসান এসে ওকে থামিয়ে দিলো৷ গগম্ভীর স্বরে বলল, “জামাকাপড় ময়লা হয়ে গেছে। ফ্রেশ হো গিয়ে। আমি এদিকটা দেখছি।”
ইজহান ভ্রু কুঁচকে সন্দেহ নিয়ে বলল, “আমার মনা কোথায়? তোর কোলে না ছিলো? কোথায় ফেলে এসেছিস ওকে? রাখতে না পারলে নিলি কেন? বাপ হওয়ার দু-পয়সার যোগ্যতাও তো তোর নেই…”
যেভাবে ‘আমার মনা’ সম্বোধন করেছে, তাতে মনে হচ্ছে মেয়েটা যেন ওরই। ইহসান কটমট করে বলল, “শোন, আমি ওর বাবা। মেয়ের ভালোমন্দের জন্য সব করতে পারি, জীবনও দিতে পারি। তাই পরেরবার অধিকারবোধ দেখাবি, কিন্তু আমার সামনে না। কৈফিয়ত চাইবি, আমার থেকে না। ওকে?”
বলে চলে গেল। গা জ্বলতে থাকা ইজহান তিতিবিরক্ত মুখে গালি ছুঁড়ল কয়েকটা। কিন্তু পাঞ্জাবি বদলাতে হবে বলে আর কোনো ঝামেলা না করে সে নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। বসার ঘরে আসতেই চোখাচোখি হয়ে গেল তার সমন্ধী আকাশের সঙ্গে। ইজহান সূঁচালো চোখে দেখল টুকটুকে লাল পরী এলিজা আকাশের সঙ্গে বসে আলাপে মজেছে। দেখেই গা-টা দ্বিতীয়বারের মতো জ্বলে গেল ইজহানের। আকাশকে সে ইহসানের মতোই দুচক্ষে সহ্য করতে পারে না। এও কম চেষ্টা করেনি, কম কানপড়া দেয়নি ইস্মিতাকে যেন তাকে ছেড়ে চলে যায়! তেমনিভাবে, আকাশও ইজহানকে সহ্য করতে পারে না। আদরের বোন ইস্মিকে জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছে, বাচ্চা নষ্ট করেছে এসবের জন্য আজও সে ইজহানের উপর রাগ। কিন্তু কী আর করা, ইহসান নিজে গিয়ে নিমন্ত্রণ করে এসেছে। না এলে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে, তাই বাবাকে নিয়ে শেখ বাড়িতে পা রেখেছে আকাশ।
তবুও সম্পর্ক আছে একটা আকাশের সঙ্গে, স্ত্রীর ভাই হয় সে। তাই না চাইতেও ইজহান গিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল ওকে। আকাশ সেসবের উত্তর দিলো ঠিক, কিন্তু চিবিয়ে চিবিয়ে। এলিজা ওদের মধ্যকার শীতলতা বুঝতে পেরে খুবই বিব্রতবোধ করল। হাতে একটা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল দিয়ে গিয়েছিল ইহসান, সেটা ইজহানকে দিয়ে উঠে পড়ল সে। এলিজা চলে যেতেই ইজহান আকাশকে উদ্দেশ্য করে বাঁকা স্বরে বলল, “শেখ বাড়িতে কখনো পা রাখব না বলে ঠাঁটবাট দেখানো আকাশ সাহেব আজ আমার বাড়িতে? বাহ! নিজের বাড়িতে হনুমানের ছায়া দেখে ধন্য হয়ে গেলাম। তবে খুব শ্রীঘ্রই আমার মেয়ের আকিকা খেতেও এ বাড়িতে আসতে হবে। প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে দ্বিতীয়বার এ বাড়িতে পা রাখতে লজ্জা করবে না আপনার হনুমান আকাশশশশ?”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৬২
কথার ধাঁচ গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়ার মতো হলেও যথাসম্ভব ঠান্ডা থাকার চেষ্টা করে আকাশ মুচকি হেসে বলল, “যেখানে আমার বোন আছে, যাকে তুলে নিয়ে এসেছেন আপনি সেখানে ওরকম হাজারো প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে বোনের ভালোমন্দ দেখতে আসতেই হবে আমাকে। তাছাড়া মামা যখন হচ্ছিই তখন তো আরো বেশি করে আসব, আপনি না ডাকলেও আসব শেখ বাড়িতে। শুনছেন, বদমেজাজি ইজহান শেখখখখ?”