অশ্রুবন্দি পর্ব ৬২ (৩)
ইসরাত জাহান ফারিয়া
মুচকি হাসির সহিত আকাশের মুখ থেকে বেরুনো কথাগুলো শুনে ইজহানের ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল। তার সমন্ধী এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছে কেন তার সাথে? আগে তো এমন ভাবে কথা বলতো যে ইজহানের মাথায়ই রক্ত উঠিয়ে দিতো। কিন্তু আজ হাসিমুখে এসব বলে সে কি বোঝাতে চাচ্ছে? বেশ বিভ্রান্ত দেখাল ইজহানকে। পাঞ্জাবি বদল করতে
না যেয়ে গিয়ে বসলো সোফায়, ঠিক আকাশের মুখোমুখি যেটা। আরাম করে হেলে বসে হাতদুটো একটা অপরটার সাথে মিলিয়ে কণ্ঠস্বরে সন্দেহ ঢেলে বলল, “ব্যাপার কী, সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে যে আকাশ সাহেবের মুখে আজ এতো মধু?”
বোন জামাইয়ের প্রশ্ন শুনে আকাশ কিছুক্ষণ নিরুত্তর তাকিয়ে উত্তর দেয়, “মধুর চাকের খোঁজ পেয়েছি যে, তাই!”
বলেই হেসে ফেলল। আকাশের হাসিটা দেখতে ইস্মিতার মতোন। মানে কী? এই আকাশের মধ্যে তার বৌয়ের সৌন্দর্যের ছাপ কেন থাকবে? কেন? ইস্মিতার একটু হাসলেই যেখানে তার পৃথিবী বরফের মতো গলে যায় সেখানে এই হনুমানটাকে দেখলেই তো ওর থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা করে। দেয় না শুধুমাত্র ইস্মিতা ওর উপর রেগে যাবে বলে! ইজহান পলকহীন এবং বিরক্তির চোখে চেয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। সে সোজা হয়ে বসে পাঞ্জাবির হাতাদুটো গোটাতে গোটাতে গলা খাকারি দিয়ে বলল, “শেখ বাড়িতে
মধুর চাকের খোঁজ পেয়েছেন, এটাও আপনার মুখ থেকে শুনতে হলো? সত্যিই আজ সূর্য পশ্চিম দিকে উঠেছে, নয়তো যে বাড়ির প্রতিটা জিনিসে বিষের ছোঁয়া আছে বলে আগে গজরাতেন সেখানে আজ মধুর খোঁজ পেতেন না। ভালো ভালো, এভাবেই নিজের চিন্তাধারাকে আপগ্রেড করতে থাকুন। লাইফটা আমার মতোই সুন্দর হয়ে যাবে। তখন চাইলেও কোনো হনুমানের নজর লাগবে না। এই আমাকেই দেখুন না, বেশ অনেকদিন ধরে হনুমানের নজরের আশেপাশে যাইনি বলে তিন সন্তানের বড়োআব্বা, আব্বা হয়ে গেছি।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বারবার তাকে ‘হনুমান’ সম্বোধন করায় আকাশের প্রচন্ড রাগ হলেও প্রতুত্তরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সে, ইস্মির কথা ভেবে! কারণ মেয়েটা অনেক করে অনুরোধ করেছে ওকে, অনুষ্ঠান বাড়িতে বদমেজাজি ইজহানের সঙ্গে সে যেন বিবাদে না জড়ায়। দু’জনের মিলমিশ না করলেও ঝগড়া যেন না করে, সামনে পড়লে ফর্মালিটি রক্ষার্থে হলেও যেন দুটো ভালোমন্দ কথা জিজ্ঞেস করে। এটুকু ইস্মির চাওয়া, এটুকু করলে মেয়েটা কষ্ট পাবে না। বোনের মন রক্ষার্থে যদি তার বদমেজাজি স্বামীর কথাগুলো হজম করে বিবাদ আটকানো যায়, তাহলে সেখানে সমস্যা কোথায়? আকাশ তাই পূর্বের মতোই ঠোঁটে হাসি রেখে স্তিমিত স্বরে বলল, “তাহলে তো আমিও তিনজনের বড়ো মামা হয়ে গেছি, কী বলেন ইজহান শেখ?”
ঘাড়টা বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আকাশকে দেখল ইজহান। পরক্ষনেই তাচ্ছিল্যসরুপ বলল, “হনুমানেরাও মামা হয়? মামা হওয়ার যোগ্য? সরি টু সে, কোনো হনুমানকে অন্তত আমি আমার মেয়ের মামা হিসেবে মেনে নিতে পারব না।”
আকাশ স্থির ও রুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুখোমুখি বসা ইজহানের দিকে। মন থেকে যাকে সে, ডমিনেটিং ও ডাম্ব লোক হিসেবে জানে এবং মানে। যে নিজের স্বার্থ হাসিলে কথার জোরে, হাত-পায়ের জোরে জিততে চায়। যে তার বোনের জীবনটাকে একটা অদৃশ্য শেকলে বন্দী করে এর নাম দিয়েছে ভালোবাসা। যেখানে সে পাগলামো ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না, সেখানে তার বোন না কি এই লোককে ভালোবাসে।
আকাশ বুঝে না একসময় যাকে চরম মাত্রায় ঘৃণা করতো, একসাথে থাকতে থাকতে কী এমন যাদু করল এই লোকটা তার বোনকে যে, দুটো দিনও ছেড়ে গিয়ে থাকতে পারে না? ওর করার কিছু থাকতো যদি ইস্মিতা চাইতো, যেখানে বোনই এই লোকের কাছে ফিরে আসে বারবার সেখানে সে আর কী করবে, মেনে নেওয়া ছাড়া? বুক চিঁড়ানো লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপমানটা যেন গায়ে মাখেনি এমন করে হাসলো আকাশ। এরপর একটুখানি এগিয়ে, ঝুঁকে, নিচু স্বরে বলল, “আপনার অপমানের বদৌলতে আমি যদি এখন অপমান করি তাহলে আপনার স্বভাবই এরকম যে, অনুষ্ঠান বাড়িতে এক্ষুণি একটা বিশ্রি ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলতে দু’বার ভাববেন না আমিও হয়তো নিজেকে থামাতে পারব না, সিনক্রিয়েট করে ফেলব। কিন্তু এতে কী হবে জানেন?
আমার বোনটা কষ্ট পাবে, অপমানিত হবে। আপনি হয়তো আমার বোনের ভালোমন্দ, দুঃখ-কষ্ট বুঝেন না, কিন্তু আমি তো তার বড়ো ভাই? ছোটো থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে বড়ো করেছি ওকে। যাকে ছোটো থেকে আগলে আগলে বড়ো করেছি তাকে কষ্ট দিতে, তার চোখে জল আমার বিবেকে বাঁধবে। আর তা-ই কথায় কথায় আপনার অপমানগুলো হজম করে নিচ্ছি। রিয়েক্ট করছি না। কী বলুন তো, আপনি বোনের ভালো স্বামী হতে না পারলেও আমি তো ওর ভালো ভাই। তাই স্টিল
ভদ্র আছি আর থাকবও। কোনোভাবেই আমাকে ক্ষ্যাপাতে পারবেন না।” এক মুহূর্ত বিরক্তি নিয়ে আকাশ ঠান্ডা ও বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল,
“আরেকটা কথা, লোকে বলে মাহমুদুল হাসান আকাশ আর ইস্মিতা আর্শি দুই ভাইবোনের চেহারায় বেশ মিল। তাদের ব্যবহার থেকে শুরু করে নম্রতা, ভদ্রতা সবকিছুই চোখে পড়ার মতো। তারা পড়াশোনায় ভালো, দেখতে চমৎকার! উচ্চতা ভালো, গায়ের রঙ ভালো। চোখ এবং হাসি দুটোই ফিরে, চেয়ে দেখার মতোন। খুঁত হিসেবে একমাত্র তাদের কানদুটো বড়ো আর কিছুটা বাঁকানো। হনুমান না বললেও ছোটবেলায় খরগোশের কান বলেও মজা নিতো অনেকেই। আমি কাঁদতাম না কিন্তু আমার বোকা বোনটা ঠিকই কাঁদতো এসব টিটকারি শুনে। এখন আমার বোন যদি জানতে পারে, সে যারজন্য হাত পুড়িয়ে রান্না করে, মুখে তুলে তিনবেলা গিলিয়ে দেয় সেই স্বামী তার চেহারার আদলকে আড়ালে-আবডালে হনুমান বলে সম্বোধন করে তার কি খুব ভালো লাগবে ইজহান শেখ?”
আকাশের লম্বা লেকচার শুনে ততক্ষণে চোখমুখ দেখার মতো হয়েছে ইজহানের।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে, কালবৈশাখী ঝড়টা তার মুখের উপর দিয়ে বয়ে গেছে এই মুহূর্তে। হাত নিশপিশ করছে তার। আড়চোখে একবার বসার ঘরে নজর বুলিয়ে সে দেখে নিলো লোকজনের উপস্থিতি। এরপর উঠে এসে আকাশের কলার চেপে ধরল একহাতে। কটমট করে বলল, “মুখ দিয়ে ‘তুই’ বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, কিন্তু আমি ‘আপনি’ বলে সম্বোধনে সম্বোধন করতে হচ্ছে। কেননা, আমি নিজেকে কন্ট্রোল করছি। বউ বলেছে আজ নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে। আমি বউয়ের বাধ্য স্বামী তাই বউয়ের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। আর ওকে মেনে চলি বলেই তার ভাইকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করছি। তো টপিক যা ছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, জীবনে খরগোশের বাচ্চা কয়টা দেখেছেন সমন্ধী ভাইজান?
যে টুপ করে বলে ফেললেন ইস্মিতার কান খরগোশের মতো বাঁকাত্যাড়া? হু? আবার নিজের সাথে মিলিয়ে বলছেনও, আমার বউয়ের সাথে আপনার চেহারার মিল আছে…’’এইটুকু বলে ইজহান আকাশের মুখটা ধরে এদিকওদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে নাক সিঁটকে বলল, “কিন্তু আমি তো মিলের ‘ম’—ও দেখতে পাচ্ছি না, বিন্দুমাত্রও না। মনেই হচ্ছে না, আপনি ইস্মিতার বড়ো ভাই। বানিয়ে বানিয়ে একটা কথা কেন বলে ফেললেন সমন্ধী ভাইজান? আমার তো এক ঘুষিতে আপনার নাকের পাটা গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আমার ‘টনা’ বাবার পটি পরিষ্কার করাতে ইচ্ছে করছে! উফ! কীভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ডাহা একটা মিথ্যা কথা বলার মতো স্পর্ধা হলো আপনার? এতোবড়ো স্পর্ধাওয়ালা বুকের পাটা’টা আমি আজ দেখবই দেখব…”
“কী দেখবেন আপনি?”
চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকাল ইজহান। তিক্ত মুখে, কোমর ধরে ইস্মিকে দাঁড়ানো দেখে চট করে কলার থেকে হাতটা নামিয়ে নিলো সে। ঢোক গিলে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে অপ্রস্তুত স্বরে বলল, “দেখছিলাম সমন্ধী ভাইজানের শার্টটা কোন ফেব্রিকের, আমার গায়ে কেমন দেখাবে!” এই বলে ইজহান আকাশের দিকে তাকিয়ে কটমট করে ইশারা করল, সে যেন সহমত মিলিয়ে ইস্মির সামনে স্বীকারোক্তি দেয়। চট করে ভোল পালটে ফেলা ইজহান শেখের মুখভঙ্গি দেখে আকাশ বিস্মিত হলেও পরক্ষণেই ঠোঁটে একপ্রস্ত হাসি ঝুলিয়ে ইস্মিকে বুঝ দিলো৷ আসলেই ইজহান তার শার্টের ফেব্রিক দেখছিল! ইস্মির বিশ্বাস হতে চাইল না, সে নিশ্চিত; দু’জন ঝগড়াই করছিল। এখন তাকে দেখে ভং ধরছে! পায়ের ধারে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিলো ওর, তবুও শক্ত কণ্ঠে বলল, “ঠিক তো? আমাকে মিথ্যা বলা হচ্ছে না তো?”
ইজহান এগিয়ে গিয়ে ওর হাতদুটো ধরে ফেলল,
কৌশল করে সত্যিটাকে এমনভাবে মিথ্যে বানাল যে, অবিশ্বাসের কিছু রইল না। ইস্মির তবু্ও দ্বিধা গ্রল না। ভাইয়ের টুকটাক কথা বলতে উদ্যত হচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ইজহান ওকে একপ্রকার ছিনিয়ে চলে এলো। নিজেদের ঘরের দিকে যেতে যেতে পথিমধ্যে গোমড়ামুখে বলল, “আজ খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করছ, পাখির মতো এদিক-ওদিক উড়ছ! একটু বিশ্রাম নিলে কী হয়? একটা দুর্ঘটনা ঘটলে কী করব আমি বলো তো? কতবার বারণ করেছি নিচে নামবেই না তুমি?”
ইস্মি নিজের অস্বস্তি বুঝতে না দিয়ে ওর বাহু আঁকড়ে ধরে ধীরেধীরে কদম ফেলতে ফেলতে বলল, “আজ আযরান-আজওয়ার বিশেষ একটা দিন। আমি তাদের বড়ো আম্মা হয়ে কীভাবে ঘরে বসে থাকি বলুন তো? পাখি দুইটাকে দেখে চোখ জুড়াচ্ছিলাম বুঝলেন? ঘরে বসে থাকলে চোখ জুড়াতো? হু?”
অতীতের ইজহান এসব শুনে রাগে ভস্ম হয়ে গেলেও আজকের ইজহান এ পর্যায়ে গোমড়ামুখে বলল, “আমাকে দেখলে চোখ জুড়ায় না তোমার?”
সিঁড়িকোঠা পেরিয়ে প্যাসেজে উঠে এসেছে তারা। কেউ নেই আশেপাশে। লোকজন খাওয়াদাওয়া করে বিদায় নিচ্ছে। মিজুকে দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। ক্যামেরা হাতে ভিডিয়ো ক্যাপচারে ব্যস্ত সে। ইজহান
এ কাজ ধরিয়ে দিয়ে এসেছে তাকে। আকিকা অনুষ্ঠানের সম্পূর্ণ স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই মূলত মিজুকে ভিডিয়ো ম্যানের কাজ দিয়েছে ইজহান। দোতলার প্যাসেজ থেকে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত মিজুকে।
ইস্মি আশপাশটা আরো একবার ভালো করে দেখে নিয়ে ইজহানের দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল, “সত্যি শোনাব?”
“এ নিয়ে ইস্মিতার মুখে মিথ্যে শুনলে আমি জগৎ ত্যাগ করব।”
ইস্মি ওকে নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।পাঞ্জাবির যে অংশটাতে ঝোলের দাগ বসে গেছিল সেখানটাতে খুব আলতো করে হাত রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এরপর ওর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাল। শান্ত স্বরে বলল, “আপনি জানেন, আপনি খারাপ একটা লোক?”
“জানি।”
“এটা জানেন, আপনি একটা মহা পাগল লোক?”
“উহু!”
“এটা জানেন, আপনি তার চেয়েও বেশি ভালো একটা লোক?”
ইজহান চোখ তুলে চাইল ওর দিকে। দৃঢ়স্বরে বলল, “এটাও জানি না।”
“আপনি জানেন, আপনি এমন একটা লোক যাকে ইস্মিতা খুব যত্ন নিয়ে, মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে? ইদানীং খুব বিশ্বাসও করে, নিজের থেকেও বেশি?”
ইজহান চুপ, উত্তর দিলো না৷ ইস্মিও আর কিছু বলল না ওকে। দেয়াল ঘেঁষে দু’জনেই দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। একে-অপরের দিকে তাকিয়ে। আর তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ইজহানের উপলব্ধি হলো তার ইস্মিতার চোখদুটো পানিতে পূর্ণ। একদম টকটকে লাল। চোখ বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ছে। গাল-গলা ভিজে যাচ্ছে! ইজহান অকস্মাৎ মুখটা আগলে নেয় হাতের তালুতে। বলে, “কোনোভাবে কি ইস্মিতা কষ্ট পেয়েছে আমার থেকে? আমি কি তাকে লুকিয়ে কিছু করেছি? তাকে কষ্ট দেওয়ার মতো?” ইজহান যেন বিস্মিত ভঙ্গিতে মনে করার চেষ্টা করল সে কী করেছে; এবং সেকেন্ড গড়াতেই তার মনেও পড়ল। সহসা বলে উঠল, “হু করেছি। এক্ষুনি আমি ইস্মিতার অগোচরে তার ভাইয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। যেটা করব না বলে ইস্মিতাকে বলেছিলাম কিন্তু নিজেকে ঠিকঠাক কন্ট্রোল করতে পারিনি।”
বলেই সে ইস্মিকে ছেড়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বসার ঘরে শারাফকে কোলে নিয়ে আগ্রহভরে নিউজপেপারে এনিমেলের ছবি চেনাতে থাকা আকাশকে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলল ইজহান, “মাহমুদুল হাসান আকাশ, আমার ইস্মিতার বড়ো ভাই। যাকে একটু আগেই আমি অপমানিত করার চেষ্টা করেছি তাকে মন থেকে আমি সরি বলছি। আমার মোটেও উচিৎ হয়নি, ইস্মিতার ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলার, তাকে এভাবে অপমান করার। যদিও ইন্টেশন ছিলো না, কিন্তু কীভাবে যেন ভুলটা হয়েই গেল আমার দ্বারা। তো মাহমুদুল হাসান আকাশ, আমার ইস্মিতার বড়ো ভাই। শুনছেন আপনি? অনুগ্রহ করে আমার দোষত্রুটি বিবেচনা করে একটু আগের অপমানটা কি আপনি ভুলে যাবেন? তাহলে আমি আমার ইস্মিতার চোখদুটো মুছে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে পারতাম!”
লোকলজ্জা, সংকোচ বাদ দিলেও বাড়িভর্তি একগাদা মেহমান, একটা অনুষ্ঠান বাড়ি! কোনোকিছু বিবেচনায় না নিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে একজন পূর্ণবয়স্ক লোক ঘোষণা দিয়ে নিজের ভুল প্রকাশ করছে ছোটোদের মতো, অনুমতি প্রার্থনা করছে তার ইস্মিতার চোখের জল মুছে দেওয়ার। মাহমুদুল হাসান আকাশ কি পারে, বোনের চোখের জল মুছতে চাওয়া লোকটার অনুমতি নাকচ করার? সে মুচকি হেসে ভদ্র গলায় বলল, “ইজহান শেখ, আমার বোনের ভালোমন্দ হাজব্যান্ড! আমি ভুলে গেলাম একটু আগে আপনার করা দোষত্রুটি, অপমান সবকিছু। সব মানে সব। আগাগোড়া সব। আপনি আপনার ইস্মিতার চোখের জল মুছে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে পারেন,
ক্যারি অন।”
কোলে বসা শারাফ সবকিছু দেখে প্রশ্নোক্ত গলায় আকাশকে জিজ্ঞেস করল, “মামার সুপার উইমেন কাঁদছে কেন?”
আকাশ হেসে ফিসফিসিয়ে বলল তাকে, “বেশি ভালোবাসা পাচ্ছে তো, তাই!”
ক্যামেরা হাতে ভিডিয়ো ক্যাপচার করতে থাকা মিজু পুরো ঘটনাটাই ক্যাপচার করে হাসলো। মনে মনে স্যারকে পাগল স্বামী হিসেবে আখ্যায়িত করল।
পুরোটা দিন তীব্র গরমে অতিষ্ঠতার সঙ্গে কাটাতে হয়েছে সকলকে। কিন্তু বিকেল চারটায় এই ঝড়ো, শীতল হাওয়া, তপ্ত সূর্যের প্রখরতা কমে গিয়ে মিষ্টি রোদকুচি ছড়ানো কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে জানে না ইস্মি। তবে প্রকৃতির শীতলতা দেখে মনে হচ্ছে আজ বৃষ্টি নামার দিন। বৃষ্টির সাথে সাথে প্রেমও নামার দিন। নয়তো ঠিক একটু আগে, একটুখানি আগে তার চোখের জল মোছার জন্য ব্যাকুল হয়ে নিজের দোষত্রুটি স্বীকার করে নেওয়া স্বামীটির প্রেমে পিছলে গেল কেন ইস্মি? সারা শরীর ভেঙ্গে আসা তীব্র ব্যথা নিয়েও সে তাই স্বামীর উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে কাঁদতে ব্যস্ত। ওদিকে ইজহান বুঝতে পারছে না, তার ইস্মিতা এভাবে কাঁদছে কেন! সে তো মাফ চাইলই তার সমন্ধীর কাছে, এরপরেও কী চায় এই মহিলা? ভাইয়ের পায়ে ধরাতে চায় ইনিয়েবিনিয়ে? আচ্ছা সে না-হয় তা-ই করবে। কিন্তু মুখফুটে বলবে তো একবার, এনশিওর করার জন্য হলেও? সে অসহায় নজরে, রুক্ষ হাতদুটো দিয়ে জাপ্টে ধরে ইস্মিকে নিজের বুকে মিশিয়ে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কাঁদছ কেন? কাঁদবে না। আমার ভালো লাগে না তোমাকে এভাবে দেখলে। দুশ্চিন্তা লাগে, ভয় করে। বলো তো যাই, আকাশ সাহেবের পায়ে ধরে মাফ চা….”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না সে, তার আগেই অগণিত ঠোঁটের স্পর্শে ভিজে গেল তার পুরুষালি ঠোঁট, উন্মুক্ত রোমশ বুক। ইজহান পাথরের মতো জমে গেল হঠাৎ আক্রমণে। ঠিক জানে না সে, তবে অনুমান করল শ’য়ের নিচে হবে না ইস্মির এই কামুকীয় স্পর্শ। সে এক পৃথিবী দ্বিধা নিয়ে ইস্মিকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী হচ্ছে?”
“জমানো আদর বিলি।”
ভূমিকম্প ঘটিয়ে যেন থেমে গেছে ইস্মি, ওকে দেখে এই মুহূর্তে সেটাই মনে হলো ইজহানের। তবুও দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করল সে। ইস্মি এবারে ওর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে ডুকরে কেঁদে ফেলল, “তুমি একটা মহা পাগল লোক ইজহান শেখ! আর মহা বোকা। একটা ভীতুর ডিম। আর এই ভীতুর ডিমটাকে আজকে আমার খুব ভয় করছে, নিজের থেকেও বেশি।”
ইজহান বেমালুম কথা বলতে ভুলে গেল ইস্মির মুখে এসব শুনে। এই মহিলা কী পাগল হয়ে গেল না কি তাকে পাগল বানানোর পায়তারা করছে? এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? সে চুপচাপ ইস্মিকে পরখ করতে লাগল। কেন যেন, ইস্মির আচরণ দেখে ওর খটকা লাগছে। কিছু ঠিক নেই মনে হচ্ছে! কীসের জন্য, কেন হচ্ছে এসব জানা নেই তার। অস্ফুটস্বরে ঢোক গিলে বলল, “কী হয়েছে? এমন করছ কেন?”
পেটে চিনচিন ব্যথা সয়ে নিয়ে ইস্মি দাঁতে দাঁত চেপে চোখের জল নিয়ে ওকে পরখ করতে করতে বলল, “কিছু হয়নি। আজ সারাদিন কাছেই তো পাইনি আপনাকে, তাই একটু দেখছিলাম। অনেক খাটুনি গেছে, না? নিন, এখন একটু বিশ্রাম করুন তো।”
“বাচ্চাদের দেখে আসি একবার!”
“ওরা ঘুমুচ্ছে। আমি জানি আপনি গেলে ওদের ঘুমাতে দেবেন না, তুলে নিয়ে আসবেন। এসব কিন্তু ভালো নয়। চুপচাপ আমি যা বলছি শুনুন!”
ঘরে এসে পাঞ্জাবি খুলে ফ্রেশ হওয়ার পর থেকেই উদোম গায়ে আছে ইজহান। পরণে নাইকের লোগো সম্বলিত নেভি ব্লু ট্রাউজার ওর। ওভাবেই ঘুমানোর জন্য ওকে একপ্রকার জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিলো ইস্মি। এরপর অতি সাবধানে, নিজের ব্যথার যন্ত্রণা সহ্য করে ড্রয়ার থেকে ঔষধের পাতা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “অনুষ্ঠান নিয়ে ভাবতে হবে না, অনুষ্ঠান শেষের পথে। মেহমানরাও চলে যাচ্ছে। বাকিসব ভাইয়ারা সামলে নেবে। আপনি এখন
কঠিন বিশ্রাম নেবেন।”
ইজহান ঘুমের ঔষধ হাতে নিয়ে বিস্মিত হতেই ইস্মি বলল, “এটা নিন, ভালো ঘুম হবে।”
বুঝতেই পারল না ইজহান তার ইস্মিতার অদ্ভুত আচরণের মানে। তবে তর্কে গেল না সে। ইস্মির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে পড়ে ঔষধটা মুখে নিলো ঠিক, কিন্তু গিলল না সেটা। অগোচরে ফেলে দিলো এবং ইস্মির কথামতো ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। ওকে চুপচাপ শান্ত হয়ে শুয়ে পড়তে দেখে ইস্মি স্বস্তির শ্বাস ফেলল। শিয়রে বসে কপালে দুটো চুমু খেয়ে, অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ইজহানকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে চাদরটা টেনে ওর গায়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইস্মি। বসেই রইল চুপচাপ ওখানে।
অভাবনীয়ভাবে পেটের ব্যথাটা হঠাৎ বেড়ে গেল ইস্মির। অথচ সে ভাবতেও পারেনি সেটা। এমন বাড়ল যে, ইস্মির মনে হলো কেউ হাতুড়ি দ্বারা ওর শরীরের একেকটা হাড় পিষে দিচ্ছে। তক্ষুনি ক্ষীণ সন্দেহ হলো ইস্মির, ব্যথাটা কি সত্যিই লেবার পেইনের? তার সন্দেহ কি ঠিক? সালেহা বেগম আর পুনমের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে কেন তাহলে লক্ষ্মণগুলো? ইস্মির অবশ্য নিজের প্রতি একটু ও ভয় করছে না যতোটা না দুশ্চিন্তা হচ্ছে ইজহানকে নিয়ে। একদম পাগল একটা লোক, তার হাতে সূঁচ ফুটলেও যেখানে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে সে যদি এটা শুনে ওকে নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তাহলে ইস্মি নিজেকে সামলাবে কী, তার তো বুক পুড়ে যাবে এই মানুষটার জন্য! সন্দেহ আগেই হয়েছিল ওর, তাই অস্থির লোকটাকে
ঘুম পাড়িয়ে রাখার পদক্ষেপ নিয়েছে সে এই সময়টাতে। এটা কতটুকু কাজে দেবে জানা নেই ইস্মির, কিন্তু সে চায় মানুষটা একটুও দুশ্চিন্তা না করুক তার জন্য, তাদের বাচ্চার জন্য! কিন্তু আসলেই কী কাজটা সে ঠিক করেছে? মা হবে সে, কিন্তু বাবা তো ইজহান। সে কী কখনো মানবে, যে মায়ের অপেক্ষায় এতগুলো দিন কাটিয়েছে, তার জন্মের সময় তাকেই সেখানে রাখা হয়নি? নাহ! মানবে না লোকটা। মানবে না ইস্মির কপটচারীতাও। ব্যাপারগুলো মাথায় খেলতেই আতঙ্কে ইস্মির ফর্সা চোখমুখ নীল দেখাল। পেটের ব্যথাটা ঠিক তখনি আরো প্রকট হয়ে গেল। এতক্ষণ মুখ বুজে সহ্য করে নিলেও আর যেন দাঁড়ানোর মতো শক্তি পেল না ইস্মি। চেপে রাখা আতঙ্ক আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে এলো ওর। তীব্র ব্যথায় পেটে হাত চাপা দিয়ে অর্ধ অচেতনের মতো হয়ে কাউচে বসে পড়ল।
ইজহান তার ইস্মিতার অদ্ভুত আচরণের রহস্য উদঘাটন করতে ঘুমানোর ভান করছিল এতক্ষণ, চোখটা তাতে লেগেই এসেছিল। কিন্তু হুট করে নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আর গোঙানি সরাসরি ওর মস্তিষ্কে আঘাত হানলো যেন! সে চট করে উঠে বসল বিছানায়। গা থেকে চাদর ফেলে তাকাতেই দেখল কাউচের উপর আধশোয়া হয়ে পেট চেপে ধরে গোঙাতে থাকা ইস্মিতাকে দেখে তার আত্মা উড়ে গেল। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কীভাবে যে খাট থেকে নেমে বউয়ের শিয়রে পৌঁছাল সে, জানে না। আলতো করে তুলে নিয়ে শক্ত করে বুকে চেপে আতঙ্কিত গলায় বলল, “কী হয়েছে? পড়ে গেছিলে? এভাবে বসে আছ কেন?”
ইজহান তৎক্ষনাৎ শাড়ি তুলে ওর পেট দেখল, ওখানে হাত বুলালো পাগলের মতো। ইস্মির চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছিল, তবে ইজহানকে এতটুকুতেই আতঙ্কিত দেখে ভীতি নিয়ে বলল, “আপনি উঠে এসেছেন কেন? আপনি ঘুমান গিয়ে…যান বলছি!”
ইজহান আগুন চোখে ওকে দেখল, গাল দুটো শক্ত করে ধরে পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠতেই ইস্মি ওকে এমন করতে দেখে ভয়ে জমে গিয়ে নিজেই বলল, “কিছু উল্টাপাল্টা হচ্ছে, পেটে খুব ব্যথা করছে। আমি বুঝতে পারছি এটা কী! দেখুন, ওয়াটার ব্রেক হচ্ছে…”
পা গড়িয়ে তরল গড়াচ্ছে। ইজহান আতঙ্কিত নয়নে সেটা দেখল। আর দেখতেই তার মাথা ঘুরতে লাগল। এসব কী? এমন কেন হচ্ছে? তবে কী…তবে কী বাচ্চাটা ভূমিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে? এভাবে? তার ইস্মিতাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে? এভাবে ওর শরীরটাকে ব্যথা বানিয়ে দিয়ে? ইজহানের বুক কাঁপতে লাগল, শরীর টলতে লাগল। এদিকে ব্যথাটা ক্রমেই মাত্রা ছাড়াচ্ছে। ইস্মি সহ্য করতে পারছে না। শুধুমাত্র ইজহানের ভয়ে সে খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি এতক্ষণ, কিন্তু এখন…আর সে পারছে না। ইস্মি আচমকা ইজহানের বুকে মাথা চেপে ওর পিঠে কিল-ঘুষি মেরে বাঁধ ভাঙা কান্নার জোয়ার বইয়ে দিলো , “বাপ হবেন আপনি, শুনছেন? একটু পর আপনার মা আপনার কোলে ঘাপটি মেরে থাকবে। শুনুন, উল্টাপাল্টা কিছু একটা হলে আমি যদি মরে যাই, আপনি কিন্তু কাঁদবেন না, শুনছেন? একদম কাঁদবেন না। ভেঙেও পড়বেন না। আপনার ভেঙে পড়া বারণ। আরেকটা বিয়েও করবেন না। পঁচাত্তর কেজির ইজহান শেখের ভার আমি সইতে পারলেও অন্য কেউ পারবে না…”
ইস্মিতার মুখে এ সময় মরার কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ইজহানের। চিৎকার করে বলল, “এই হা রা মি মহিলা, এসব বলছিস কেন? তুই না চেয়েছিলি বাচ্চা। নে, এখন ধর। পেট থেকে বের করে কোলে নিয়ে বসে থাক। নাচগান কর। আমার কী? পথের কাঙাল। আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছিস, তোকে তো আমি…”
আরকিছু বলতে পারল না ইজহান। ইস্মির হাতের চাপে তার মুখবন্ধ হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখল ঘর্মাক্ত মুখে, চোখে অশ্রুজল নিয়ে ইস্মিতা ব্যথায় ছটফট করছে। নড়তে পর্যন্ত পারছে না মেয়েটা। রাগ কেটে হুঁশটুকু ফিরতেই ইজহান চট করে ইস্মিকে রেখে উঠে দাঁড়াল। তার ইস্মিতার ব্যথা কমাতে, পেটের ভেতর ঘাপটি মেরে তার বউকে কান্না করানোর অপরাধে অপরাধী শত্রুকে ভূমিষ্ঠ করানোর জন্য টলমল পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে কাউকে ডাকতে যাবে ; দরজার কাছে রাখা কাচের ফ্লাওয়ার ভাসটার সঙ্গে একটা ধাক্কা খেল সে। ভাসটা মেঝেতে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ফেটে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। ইজহান কদম ফেলল ভাঙা কাচের টুকরোর উপরই। একগাদা কাচ পায়ে বিঁধল তার, টেরই পেল না। দরজা খুলে বাইরে এসে একপ্রকার চিৎকার করে ডাকল সে তার ভেড়াকে, টনা-মনার মা’কে, পুনমকে, আকাশকে সবাইকে।
মেহমান বিদায় করে ডেকোরেটার্সদের বিল মেটাতে থাকা ইহসান তার লোফার ভাইয়ের চিৎকার আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এলো সিঁড়ি ভেঙে। পরপর এলো আজিজ শেখসহ ইস্মির বাবা সিরাজুল ইসলাম আর আকাশও। বাকিরা এলো তার পরেই। নীলু বেগম, সায়মার কাছে ঘুমন্ত বাচ্চাদের রেখে সৃজা, এলিজা আর পুনম যখন ছুটে এলো, ইস্মিকে দেখেই ওরা বুঝে গেল কাহিনী কী! একপ্রকার ছুটে গিয়ে ধরল ওকে। ব্যথায় নিজের হাত কামড়াতে থাকা ইস্মির অবস্থা দেখে সৃজা সালেহা বেগমকে বলে পুরুষদের গাড়ি এবং হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দিলেও ইজহানকে বের করতে পারল না। সে ইস্মির পায়ের কাছে ঠাঁই বসে রইল। পুনম আর এলিজা ইস্মির হাতপায়ের তালু ম্যাসাজ করতে লাগল। নিজের পেইনের কথা মনে করে আতঙ্কে যদিও গলা শুকিয়ে আসছিল তবুও ইস্মিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ওকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করল সৃজা, “একটা পরীবাচ্চা আসবে তোমার, একদম ভয় করো না। বি ইজি। সহজ হও। ব্যথাটা কেমন? কথা বলো ইস্মি ভাবি, চোখ খোলা রাখো প্লিজ…”
অসহনীয় আর্তনাদের সহিত ইস্মি বারবার বলতে লাগল, “মরে যাওয়ার মতোন! আমি মরে যাচ্ছি, একদম মরে যাচ্ছি…ব্যথাটা মরে যাওয়ার মতোন! আল্লাহ, তুমি আমার বাচ্চাটাকে সুস্থ রাখো, ওর কিছু করো না, আল্লাহ!”
পায়ের কাছে বসে থাকা ইজহান উঠে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ইস্মির গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “পেট থেকে বের কর একবার তোর মেয়েকে, ওর কী হাল করি আমি দেখার জন্য হলেও বেঁচে থাকতে হবে তোকে। নয়তো আজ আমি বিষ খাব। নিম্নমানের বিষ। তুই তোর ছানা কোলে নিয়ে আমার কবরের সামনে বাড়ি বানিয়ে বসে থাকিস। আই সয়্যার আমি…আমি তোদের দুটোকেই কাঁচা খেয়ে ফেলব…” এরপর আরো কিছু বলতে উদ্যত হচ্ছিল, কিন্তু বলতে পারল না৷ ঢলে পড়ে গেল ইজহান সোফার উপর। মাথাটা বারি খেল শক্ত কাঠের পাটাতনে। বিকট একটা শব্দ হলো, এরপর সব চুপচাপ। ইস্মি নিজেও ব্যথা ভুলে বিস্ফোরিত চোখে দেখল নিজের স্বামীকে। পরক্ষণেই চেঁচিয়ে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল তার। ঘরের ভেতর শুরু
হলো চেঁচামেচি। পুনমের ডাকে ইহসান ছুটে এসে ভাইয়ের অবস্থা দেখে ওকে টেনেটুনে তুলে বিছানায় শুইয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিতে দিতে গালে চাপড় দিয়ে দু’বার ডাকল, “গাধারে! যাবি না তুই তোর মেয়েকে আনতে? তাহলে ঘুমিয়েই থাক, তোকে রেখে তোর বউকেই নিয়ে যাচ্ছি। রেডিমেড বাচ্চা কোলে নিস একেবারে। আমার ঝড়টা তো তুই সামলেছিলি, তোরটা এবার আমি সামলাই। এসবের বিনিময় তো শোধ করা যায় না, এবার আমার মতো তুইও থাক; আজীবন ঋণী থাক।”
ততক্ষণে আকাশ পাঁজাকোলে তুলে ইস্মিকে নিয়েছে গাড়ি অবধি নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ইস্মি তখনো ইজহানকে এভাবে রেখে যাবে না বলে বিলাপ করে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে, সে তার অসুস্থ স্বামীকে নিজে হাতে ভাত না খাইয়ে দিয়ে কোথাও যাবে না। মানে লেবার পেইনের ব্যথা নিয়ে কোনো মেয়ে তার সেন্সলেস হয়ে যাওয়া বরের জন্য এমন উতলা হতে পারে? আকাশ এদের স্বামী-স্ত্রীকে দেখে বুঝতে পারছে না সে পাগল, না কি মহা পাগলদের পাল্লায় এসে পড়েছে!
আকাশটা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। শীতল বাতাস জোরালোভাবে বইছে। রাস্তার ধুলো উড়ছে। বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস। পুরোপুরি সেন্স ফিরতে অনেকটা সময় নিলো ইজহান। হুঁশ ফিরতেই তার মাথায় প্রথমেই এলো ইস্মিতার কথা। চট করে উঠে বসে দেখল সে, তার ঘর শূন্য। কোথাও ইস্মি নেই। আছে জনা তিনেক চাকর। যারা তার সেবাযত্নে মশগুল। বিভ্রান্ত সে পায়ের তালু থেকে কাচের টুকরো বের করে ব্যান্ডেজ করতে থাকা মকবুলের দিকে তাকাতেই নিজে থেকেই মকবুল বলল, “ভাবীজানরে লইয়া সবাই হাসপাতালে যাইতেছে! আপনেরে রাইক্ষা যাইব না বলে ভাবীজান অনেক কান্নাকাটি করতেছিল, অনেক কষ্ট পাইছে ভাবীজান!”
ইজহান যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই, উদোম গায়ে ট্রাউজার পরিহিত অবস্থায়ই ফোনটা খুঁজে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতোন বেরিয়ে গেল সে। যেতে যেতে মিজুকে কল করতেই জানা গেল, তারা বেশিদূর যায়নি। চৌরাস্তার মোড়ে আছে। ইজহান তাকে বলল অপেক্ষা করতে, সে আসছে। ফোন কানে রেখেই ঝড়ো হাওয়ার মধ্যেও ছুটতে লাগল মোড়ের উদ্দেশ্যে। মিজু গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, নিজের স্যারকে ওমন খালি গায়ে রাস্তা ধরে ছুটে আসতে দেখে সে আহাম্মক হয়ে গেল। ইহসানের দিকে বোকার মতো তাকাতেই ইহসান গম্ভীরমুখে বলল, “মাথার ঠিক নেই তোমার স্যারের, তাই এ অবস্থা! এক কাজ করো, তোমার শার্টটা খুলে দাও। পরুক।”
মিজু আমতাআমতা করে বলল, “কিন্তু ভাইজান, আমি কী পরব? ভেতরে তো একটা স্যান্ডো গেঞ্জি শুধু। আমার তো লাজশরম আছে…”
আজিজ শেখও ছিলেন সেখানে। তিনি ছেলেকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে রইলেন। মিজুকে ধমকে বললেন, “ফকিন্নির বাচ্চা লাজশরম মারাস? কী এমন শরীর রে তোর, লোকে নজর দেওয়ার মতোন? আমার পোলারে দেখ, লোকে গিল্লা খাইতেছে। দুইটা পান মুইছা না দিলে পোলাডার উপর বদনজরের আছড় লাগব! খোল তোর দুই টাকার শার্ট…”
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেল মিজুর। চোখে পানিও চলে এলো হঠাৎ তার। সে ফকিন্নির বাচ্চা? তার শার্ট দুই টাকার? তার বাবার একজন স্কুল টিচার, শার্টটাও ইজি থেকে নেওয়া। ইজহান স্যার নিজে গিফট করেছে ওকে! মিজু চাপা শ্বাস ফেলল৷ এভাবে অপমান তো তার মাথাপাগলা স্যারও করেনি। অথচ আজিজ শেখ? কী অবলীলায় তাকে এতগুলো কথা বলে ফেলল! কিন্তু কী আর করার? স্যারের বাবা বলেছে, কথা না মানলে তার মতো ছা পোষা লোকের চাকরি থাকবে না। মিজু শার্টের বাটনে হাত রাখতেই পাশ থেকে ইহসান ওকে থামিয়ে দিলো। মানা করল ওকে খুলতে। আজিজ শেখের দিকে তাকিয়ে গমগমে, রুক্ষ স্বরে বলল, “ছেলের জন্য এতো দরদ থাকলে আপনার পোশাকটাই খুলে দিয়ে দিন, এমনিতেও আপনার ওখানে কোনো কাজ থাকবে না হাউকাউ করা ছাড়া। আপনি বরং, আপনার পাঞ্জাবিটা ইজহানকে দিয়ে বাড়ি গিয়ে হাউকাউ করুন, তাতে আপনার ছেলের মাথাটাই ঠান্ডা থাকবে।”
আজিজ শেখ কপালে ভাঁজ ফেলে ওকে কিছু বলতেই যাবে ইজহান হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়িতে উঠে বসলো। বসেই পুনমের পাশে বসা ব্যথায় কোঁকাতে থাকা ইস্মিতাকে একটানে নিজের বুকে নিয়ে কপালে চুমু খেতে খেতে বলল, “এই দেখো, আমি ভালো হয়ে গেছি। তোমার সঙ্গে যাবার মতো ভালো। এবার চলো, আমার শত্রুকে ভূমিষ্ঠ করাতে হবে তো, এই মিজু
দাঁড়িয়ে আছিস কেন? স্টার্ট দে না রে বাবা…”
মিজু হন্তদন্ত হয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসতেই ওপাশে গিয়ে ইহসান বসে পড়ল। পেছনে ইজহান-ইস্মি, সালেহা বেগম, পুনম। তারও পেছনের সিটে আকাশ আর সিরাজুল ইসলাম। তারা বসে বসে ইজহানের পাগলামো, বাড়াবাড়ি দেখছে চুপচাপ। এদিকে আজিজ শেখ গাড়িতে উঠে বসার প্রস্তুতি নিতেই ইজহান মিজুকে তাড়া দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
আজিজ শেখ ভ্রু কুঁচকে জবাবে বললেন, “কেন বাপজান? হাসপাতালে যাইতেছি তোমাদের সাথে।”
নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল ইজহান, “না, হাসপাতালে যাবে না। তুমি একটা স্বার্থপর লোক। যে গেলেই অশুভ কিছু হবে, উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করবে। যেমনটা করেছিলে সৃজার বেলায়। উহু, আমি কোনো রিস্ক নেব না। তুমি আসবে না আমাদের সাথে৷ একদম না।”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৬২ (২)
অতঃপর থমকিত, চমকিত, স্তব্ধ, ভাষা হারানো আজিজ শেখকে চৌরাস্তার মোড়ে রেখেই গাড়িটা সাঁই করে সামনে আগাল। ঝড়ো হাওয়াসহ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল তখনই। ছেলের আচরণে বুকের ভেতর ধাক্কা অনুভব করা হতবাক আজিজ শেখ ধীরপায়ে বাড়ি ফিরলেন ভিজে ভিজে। কিন্তু বাড়ির ফেরার পর গেইটের সামনে যখন কালো রঙের চকচকে রুবিকন জীপটাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখলেন, খানিক আগের ইজহানের শক্তপোক্ত রেস্ট্রিকশনের দরুণ তৈরি হওয়ার উদাসীন ভাবটা মুহূর্তেই কেটে গেল তার। ঠোঁটজুড়ে বিচরণ করল হাসি। উৎফুল্ল মনে তিনি গেইটের কাছাকাছি পৌঁছাতেই দারোয়ান ভীতি নিয়ে তাকে খবরটা দিলো, “ছোটো ভাইজানে বাড়ি আইছে স্যার…”