অশ্রুবন্দি পর্ব ৬২ (৪)

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬২ (৪)
ইসরাত জাহান ফারিয়া

হসপিটালে আসার পরপরই ইর্মাজেন্সিতে নেওয়া হয়েছে ইস্মিকে। গাইনী বিশেষজ্ঞ ওর পারচুরিশন পেইনের মাত্রা বিবেচনা ও চেকআপ শেষে জানিয়েছে চেষ্টা করলে নরমাল ডেলিভারিতেই বাচ্চা প্রসব করানো সম্ভব। তাতে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পেশেন্ট কো-অপারেট করলেই চলবে। ব্যথায় আর্তনাদ করতে করতে ইস্মি নিজেও সেটাতেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে সবাইকে অগ্রাহ্য করে।

এদিকে ইস্মির সিদ্ধান্তে নারাজ ইজহান। সি-সেকশন থাকতে অহেতুক এতো কষ্ট নিতে চাচ্ছে কেন ইস্মিতা তারজন্য সে চোটপাট শুরু করল। পরে যখন সবাই বোঝাল, সি-সেকশনে তো বড়ো কাটাকাটি করতে হবে
তার থেকে নরমাল ডেলিভারিই ভালো না? এটার কষ্ট সাময়িক, দু-দিনেই ইস্মিতা স্টেবল হয়ে যাবে; তখনই মত দিয়েছে ইজহান। সে মত দেওয়ার পরই ইস্মিকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর সঙ্গে ইজহানও ডেলিভারি রুমে প্রবেশ করতে চেয়েছিল, কিন্তু ইস্মিই ওকে নিতে চায়নি। দেখা যাবে, তাকে রেখে তার নার্ভ দুর্বল স্বামীকে নিয়েই ডাক্তারদের টানাহেঁচড়া করতে হবে। তাই অহেতুক
এই রিস্ক নেওয়ার কোনো মানেই হয় না। ইস্মির এমন নিষ্ঠুর আচরণে বুক ঝাঁঝড়া হয়ে গেছে ইজহানের। চুরমার হওয়া বুকে এতো চিন্তা, কষ্ট নিয়ে সে থাকতে পারছে না। আতঙ্কিত হয়ে উল্টাপাল্টা বকছে একটু পরপর। দাঁড়াতেও পারছিল না ঠিকঠাক, ঘেমে-নেয়ে একাকার হচ্ছিলো, দু’বার তো সেন্সলেসই হয়ে গেছিল। সেজন্য ওকে ডেলিভারি রুমের ওখানে থাকতে দেয়নি ইহসান, নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছে ওয়েটিং লাউঞ্জে। ইজহান বসতে চাচ্ছিল না এখানে, কথা কাটাকাটি করছিল। শেষ পর্যন্ত চড় খেয়ে বসতে বাধ্য হয়েছে। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে হসপিটালের পাশের মল থেকে একটা সাদা টি-শার্ট নিয়ে এসেছে আকাশ, সেটাই পরিয়ে দিয়েছে ওকে ইহসান। কিন্তু আগে একবার ডাইলেশন অ্যান্ড কারেটাজ হওয়ায় এবারে যদি কোনো সমস্যা হয় এই নিয়ে ভেবে ভেবে ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছে ইজহান। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও নার্ভাসনেসের কারণে তার প্রেশার ফল করেছে৷ দুর্বলচিত্তের ইজহানকে নিয়ে ইহসান পড়েছে বিপদে। এ সময়টা যে কতোটা কঠিন, নিজেও তো পার করে এসেছে। তাই ইহসান ধারণা করতে পারছে ইজহানের মানসিক অবস্থাটা এখন কেমন হতে পারে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আর পারছে বলেই, ভাইয়ের জন্য তার মায়া হচ্ছে!
এদিকে ইস্মির বাবা সিরাজুল ইসলাম মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে তো আছেই, তার উপর আধপাগল মেয়ে জামাইকে নিয়েও তিনি চিন্তিত। ইজহানের উদ্বিগ্ন অবস্থা দেখে তার ভয় হচ্ছে এক্ষুনি না এই ছেলে আবার হার্ট-অ্যাটাক করে ফেলে। ডেলিভারি সেকশনের দরোজা থেকে সরে গিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে ইজহানকে নিয়ে বসে থাকা ইহসানকে তিনি একান্তে ডাকলেন কিছু কথা বলার জন্য। এদিকে ইহসানের হাত শক্ত করে ধরে আতঙ্কিত হয়ে একনাগাড়ে বিড়বিড় করে কিছু বলছে ইজহান, তাই সে বুঝতে পারল না এই মুহূর্তে ভাইয়ের হাত ছাড়াটা কী ঠিক হবে? না কি সিরাজুল ইসলামের ডাক শোনাটা ঠিক হবে! দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে সে অবশ্য ইজহানের পাশে থাকারই সিদ্ধান্ত নিলো। ইস্মির বাবাকে বলল, “চাচাজান, কোনো গুরুত্বপূর্ণ দরকার না থাকলে একটু পরে আসি? আপনার মেয়েজামাই তো আমার হাত ছাড়ছে না।”

সিরাজুল ইসলাম ম্লানমুখে হেসে নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, “না না তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। আমি জামাইরে নিয়াই বলতাম, ওর তো প্রেশারটা ঠিক নাই, যদি দুইটা খাওয়াইয়া ঘুমানোর ব্যবস্থা করতা তাইলে ভালো হইতো। আমি কী আকাশরে কমু ডাক্তারের সাথে কথা বলতো? তারা আইসা না হয় ইনজেকশন দিয়া যাইতো…”
শ্বশুরের কথা কানে আসছিল ইজহানের। তবে অতোটা মনোযোগ দিচ্ছিল না। কিন্তু ওকে নিয়েই কথা হচ্ছে বুঝতে পেরে শতচিন্তার মধ্যেও সে একটু তাকিয়েছিল। তাকানোর ফলে যে, তাকে নিয়ে করা ষড়যন্ত্রটা সে ধরতে পেরে যাবে তা ভাবেনি। কী সুন্দর শ্বশুরমশাই তার ভাইকে পরামর্শ দিচ্ছে, ইস্মিকে রেখে তাকে যেন সেডেটিভের প্রভাবে রাখে! মানে ভাবা যায়? একটা মানুষ কতোটা বিবেকহীন হলে এসব কথা বলতে পারে? মেজাজটা চটে গেল তার। একটা চেয়ার উলটে ফেলে দিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে সে সিরাজুল সাহেবকে উদ্দেশ্য তিরিক্ষি স্বরে বলল,

“বাবা হওয়ার সংজ্ঞা জানেন? না কি নামেমাত্রই বাবা হয়েছেন? আপনার বউ যখন আপনার মেয়েকে জন্ম দিচ্ছিল, আপনি নিশ্চয় তখন ঘুমাচ্ছিলেন! সেজন্যই তো মেয়ের প্রতি মায়া-মহব্বত দেখি না। যেই দেখছেন ইস্মিতা একটা ক্রিটিকাল সিচুয়েশনে আছে ওমনি আমার ঘর ভাঙ্গার ধান্ধাবাজি শুরু করেছেন। এ সময় আমাকে ঘুম পাড়িয়ে পরে, ইস্মিতার কান ভাঙাবেন, উল্টাপাল্টা বোঝাবেন, ওর কাছে আমাকে কালার করে এটাকে ইস্যু বানিয়ে ওকে বোঝাবেন আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন, স্বার্থপর, ওকে ভালোবাসি না, ওকে মানসিক প্রেশার দেই, টর্চার করি। ও যাতে আমাকে ছেড়ে দেয়, আমার সংসার ছেড়ে দেয়! কী ভেবেছেন? আমি টের পাই না শ্বশুর আব্বা? আমি সব টের পাই। আমি বুঝতে পারছি না, এতো ভালোবাসি আমি ইস্মিতাকে, এরপরেও স্বার্থপরের মতো আমার থেকে কীভাবে কেড়ে নিতে চান ওকে? আপনি আমার ইস্মিতার বাবা হলো কীভাবে! আশ্চর্য!”

যার জন্য করি চুরি সে-ই বলে চোর? সিরাজুল ইসলাম পুরোপুরি হতভম্ব বনে গেলেন। লজ্জায় মাথা কাটা গেল তার যখন ইজহান খোঁচা মারল এ বলে যে, তিনি বাবা হয়ে মেয়েকে ভালোবাসেন না, মেয়েকে কান ভাঙানি দেন, ঘর ভাঙানোর চেষ্টা করেন! অথচ তিনি ইস্মিতা আর্শির মতো এমন একজনের বাবা, যাকে স্ত্রী বিয়োগের পর আটটা বছর বুকে আগলে বড়ো করেছেন। ফুলের টোকাও দেননি। মন খারাপ নিয়েও সিরাজুল সাহেব অপ্রস্তুত হেসে, বেঁফাস কথাবার্তা না শোনার আশায় সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। ওদিকে সহজসরল শ্বশুরের সঙ্গে অভদ্র আচরণ করায় ইহসান ঝাড়ি মেরে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কটমট করে রুক্ষ স্বরে ইজহানকে বলল, “তুই কখনো মানুষ হবি না? শ্বশুরের সাথে এভাবে কথা বলে? তিনি কতোটা সহজসরল মানুষ তুই জানিস না? হারামি তোকে সাধে বলি?”
ব্যতিব্যস্ত ও মেজাজ হারানো গলায় ইজহান অতিষ্ঠ হয়ে খ্যাঁকিয়ে উঠল, “আমি আছি আমার জ্বালায়, একেকজন জ্ঞান দিতে আসছে। আরে আমি কী কারোর ধার ধারি নাকি যে জ্ঞানের পাহাড় সবাই আমার উপরই ঝাড়বে? মেয়ে নিতে এসেছি আমি এখানে। মেয়ে ফুটুক, বউ নিয়ে বাড়ি যাব আমি! আল্লাহ আমার বউ-বাচ্চা সুস্থ রাখুক। শালা, শ্বশুরের বদনজরের দৃষ্টি থেকে রক্ষা করুক ওদের! আমিন…”

হাসবে না কাঁদবে ইহসান? এটা তার ভাই? উদোম গায়ে, ঢুলুঢুলু চোখে, টলমল পায়ে একবুক ভয় নিয়েও তেজ দেখিয়ে কথা বলছে৷ অথচ ভেতরটা পুরোটাই ফাঁকা। রক্তাভ চোখের কোণে স্পষ্ট পানি। হঠাৎ এতো মায়া ঠেকল বুকের ভেতরে, ইহসান নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে বাদ দিলি কেন? আমিও যদি নজর লাগিয়ে দেই?”
“পরিপূর্ণ মানুষ কখনো অপূর্ণদের নজর দেয় না—তাদের চোখ থাকে ওপরে, সমতলের ঊর্ধ্বে। অপূর্ণরাই চেয়ে থাকে পরিপূর্ণদের দিকে—তৃষ্ণার্ত চোখে, অপূর্ণতা ঢাকার আশায়, একটু আলো পাওয়ার আশায়। তোর কাছে আমার আযরান-আজওয়া আছে…আর যে হৃদয়ে তারা আশ্রয় নেয়, সে হৃদয় কোনোদিন অপূর্ণ থাকে না। তাই তুই চাইলেই পূর্ণতা—তুই তো তোর ভেতরেই আমার অসমাপ্তির শেষ শব্দটা বয়ে নিয়ে চলেছিস।”

ইহসানের ঠোঁটের কোণে হঠাৎ অস্পষ্ট হাসি ছড়িয়ে পড়ল। এমন গুরুগম্ভীর কথাবার্তা তার ভাই কোথা থেকে শিখল? এসব কি বলে সে? পূর্ণতা, অপূর্ণতার মানে সে বোঝে? বোঝে ইহসান আজীবনেও পরিপূর্ণ হতে পারবে না একটা মানুষের জন্য, তার জন্মদাতা মায়ের জন্য? তার স্নেহের অভাবে? বোঝে না কেউ! ধীরপায়ে এগিয়ে ইজহানের একটা হাত নিজে থেকেই সে ধরল, যেন ভাইকে সে ভরসা দিলো। বউয়ের চিন্তায় দুনিয়া ভুলে যাওয়া ইজহান একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ভেড়াটার আচরণ সন্দেহজনক! এ এমন করছে কেন? আচ্ছা, যা খুশি করুক। সে এসব নিয়ে ভাবছে কেন? ডেলিভারি রুমে ইস্মি এখন কী করছে? বাচ্চাটা কী বেরিয়েছে, দুনিয়ার আলো দেখেছে? ইস্মিতার ব্যথা কী কমেছে? কেমন আছে মেয়েটা? ও কী যাবে একবার? স্টাফগুলো দরজা খুলবে? হাজারো প্রশ্নের ভারে ইজহানের মস্তিষ্কটা পাগল পাগল লাগল! শেষে এটাও মনে হলো, আচ্ছা মেয়েই হয়েছে তো? না কি আরেকটা আযরান? নাকি আজওয়ার আরেকটা বোন, তার মা? হু? ইজহানের দুর্বল মস্তিষ্ক আরো দুর্বল লাগল, চিন্তাধারার শক্তি হারিয়ে সে মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করতে লাগল, “একটা আজওয়া চাই আমার—আমার একটা মা। ভেড়াটার মায়ের মতো! ইহসান-ইজহানের মায়ের মতো। আল্লাহ ইস্মিতার পেটে আমার একটা মা’ই দিও, আমি খুব খেয়াল রাখব তার…”

পাশে বসা ইহসান ইজহানের বিড়বিড় করা কথাগুলো শুনে নির্বাক তাকিয়ে রইল। একটা মায়ের অভাবে তারা একেকটা ভাই স্বাভাবিক জীবন থেকে কতোটা বঞ্চিত হয়েছে এটা বাইরের কেউ বুঝতে পারবে না।তারা বড়ো হয়েছে বাবার সম্পদ উড়িয়ে, নিজেদের মতো, লক্ষ্যহীন। মা-হীন জীবন কেমন, তারা জানে। এটাও জানে, অঢেল সম্পদের পাহাড়ে থাকলেও, বাবার ছায়া থাকলেও একটা আপন মায়ের অভাব কেউ পূরণ করতে পারে না, কেউ না। মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা এতো দামী আর দুর্লভ যে পুরো পৃথিবীর বিনিময়েও তা এনে দেওয়া সম্ভব হয় না। যদিও সম্ভব হয়, তার বেশিরভাগটাই হয় মেকি, লোক দেখানো। ইহসান চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভাবে সে, এই দিনগুলো আর কখনো ফিরে আসবে? দু-ভাই এভাবে পাশাপাশি বসে থেকে তাদের আর কোন মায়ের আগমনের আশায় একে-অন্যের ভরসা হবে? আচ্ছা, ইজহানের প্রার্থনাটা এবারের মতো সত্যিই হতে পারে না? আরেকটা মা এসে তাদের মাতৃহীন জীবনটা সুন্দর ফুলে ভরিয়ে দিতে পারে না?

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬২ (৩)

অবশ্যই দিতে পারে এবং দিলোও। আধঘন্টা যাবৎ কঠোর চেষ্টার পর মা ডাক শোনার আশায় তৃষ্ণার্ত ইস্মিতাকে, বাচ্চা অপছন্দ করা একটা মহাপাগল ইজহানকে সৃষ্টিকর্তা একটা ‘মা’—ই দিলো। যাকে প্রথমবার কোলে নিয়ে ইজহান জ্ঞান হারিয়ে ফেলল!

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৩