অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৩

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৩
ইসরাত জাহান ফারিয়া

আট বছরেরও বেশি সময় পর ছেলে বাড়িতে ফিরেছে, বিষয়টা আজিজ শেখের জন্য মহানন্দের। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি আনন্দ অনুভব করতে পারছেন না। কারণ বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎ সংযোগহীন আঁধারে তলিয়ে যাওয়া সারাবাড়ি খুঁজেও তিনি তার ছেলের হদিস পেলেন না। হতাশ হয়ে তিনি যখন ছাদে গেলেন ছেলের খোঁজ করতে তখন চারপাশ ঘুরে ছেলের অবয়বটুকু দেখতে পেলেন বাড়ির দখিনে শুভ্র সাদা ফুলের মোহনীয়তা ছড়ানো কামিনী ঝাড়ের নিচে। কালো স্যুটে গ্রিক দেবতার মতো দেখতে ছেলেটা উবু হয়ে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে, পাশে তার ল্যাব্রাডর জাতের কুকুরটিকে নিয়ে। আজিজ শেখ ছেলেকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। শংকর ছাতা হাতে নিয়ে আধভেজা হয়ে ছুটে গেলেন কামিনী ঝাড়ের নিচে। ঢোক গিলে ব্যাকুল হয়ে ডাকলেন, “আব্বাজান, বৃষ্টি পড়তাছে। তুমি এইখানে বইসা আছ কেন?”

জন্মদাতা পিতার আরসালান ইনজান শেখের! সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্কের! এই ডাকে সাড়া না দিয়ে না কি থাকা যায় না? বিষয়টা মনে পড়তেই আরসালান মুচকি হাসলো। বসারত অবস্থায়ই একবার নিজের কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে পেছনে ফিরে তাকাল, বাপের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঁকা হেসে বলল, “ছেলে এতো বছর পর বাড়িতে ফিরেছে, মায়ের সঙ্গে দেখা করবে না? আত্মার টানে ছুটে এসেছি।”
আজিজ শেখ ছাতা ফেলেই এবার ছেলের কাছে ছুটে এলেন, হাত ধরে টেনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে করতে বললেন, “এইটা তোমার মায়ের কবর, কবরের উপর এইভাবে বসতে হয় না আব্বাজান। পাপ হয় ভীষণ!”
চোখ বড়ো বড়ো করে অট্টহাসি চেপে বলল ইনজান, “এই এই এই, তোমার মুখে এসব কথা শুনলে আমার কিন্তু ভীষণ হাসি পাবে, এই মুহূর্তে তোমার হারানো প্রেমিকার কবরে দাঁড়িয়ে আমি হাসতে চাচ্ছি না…”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গম্ভীরমুখে কথাটা বলে আরসালান তার বাবার হাতটা ঝাড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো। আজিজ শেখ বিগড়াতে চাইলেন না ছেলেকে। তাই প্রসঙ্গ বদলে বললেন, “ভেতরে চলো আব্বাজান, তোমার কুত্তাটাও তো ভিজতাছে…”
স্যুটটা পুরোপুরি ভিজে গেছে, শু’তে—ও পানি ঢুকেছে। পুরো শরীর কর্দমাক্ত! ভীষণ বিরক্ত আরসালান ইনজান শেখ কঠিন গলায় সতর্ক করল আজিজ শেখকে, “উহু উহু উহু…. কুত্তা না। ও আমার বাপ, কেমি…”
আজিজ শেখ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। এই কুত্তাটাকে তার ছেলে বাপের জায়গা দিয়েছে, বাপ ডাকছে, এই দিনও তার দেখতে হলো? একটা কুকুর কখনো মানুষের জায়গা দখল করতে পারে? তার জায়গাটা এই বিদেশী কুকুরটা কেড়ে নিলো? একটা লাথি মেরে কেমিকে দূরে ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে হলো তার। তবে ছেলের মাথা ঠান্ডা রাখতেই নিজের ইচ্ছেকে সংযত করে নিয়েই তিনি বললেন,

“হ, তোমার বাপ। আমি জানি। কিন্তু ওরে নিয়া বেশিক্ষণ ভিজাটা ঠিক হইব না। সেনসেটিভ তো, অসুস্থ হইয়া যাইব। তাই বলতাছি ভেতরে চলো।”
গুরুগম্ভীর হয়ে এমিলি ইয়াসমিনের কবরের কালচে মাটির উপর ঝরে পড়া শুভ্র সাদা কামিনী ফুলে দৃষ্টি রেখে আরসালান মেনে নিলো বাবার কথা। কেমির গলার বেল্টটা ধরে টেনে ওকে নিয়ে একাই ফটকের দিকে রওয়ানা হলো। আজিজ শেখ পেছন থেকে সূক্ষ্ম চোখে তার সুর্দশন ছোটপুত্রের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন। এই ঝুম অন্ধকারে, ভেজা পথ ধরে ছেলেটা কীভাবে ঠিক পথ চিনে নিচ্ছে? দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা কোনোদিন কোথাও যায়ইনি, এ বাড়িতেই ছিল, প্রতিদিন আনাগোনা তার এ বাড়িতে! আজিজ শেখের বুকের ভেতরটা বিষাদগ্রস্ত আনন্দে কেমন উতলা হয়ে উঠল।

ইলেকট্রিসিটি নেই, আইপিএসটাও কাজ করছে না বলে সবকিছু অন্ধকার। ফটক পেরিয়ে, বারান্দা পেরিয়ে সদর দরজায় পা রাখতেই ছ’ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার অনুভূতিশূন্য আরসালান ইনজান শেখ বুঝতে পারল না সে কেন এ বাড়িতে ফিরেছে, ঘুম থেকে উঠেই আজ তার কেন মনে হলো বাড়িতে একবার যাওয়া দরকার! ঠোঁট বাঁকিয়ে ভাবল সে, ল্যাভেন্ডারকে কী একবার ডাকবে? ডাকলে আসবে? সে জানে আসবে না। কারণ, মেয়েটা তো জানেই না ল্যাভেন্ডার রঙের জামা পরণে তার এক গোপন প্রেমিক আছে, প্রেমিকটা তারই বিলাভড্ হাজব্যান্ডের ছোটো ভাই! চুপচুপে ভেজা চুলগুলোতে আরসালান একবার হাত চালিয়ে সেগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে ক্রুর হাসলো। ডাকলো সে তার ল্যাভেন্ডারকে অবশ্যই, সঙ্গে সঙ্গে ডেকে উঠল তার তথাকথিত বাপ— কেমিও! ঘেউঘেউ স্বরে, শেখ বাড়ি কাঁপিয়ে! সেই ডাকে যখন মোমবাতি হাতে লাল রঙা জামা পরিহিত, মোমের মতোই ফর্সা, খোলা চুলের একটা মেয়ে ছুটে এসে সিঁড়িতে এসে যখন দাঁড়াল; ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই হলো আরসালান ইনজান শেখের! তার মতোই এ অচেনা মেয়েটার গালে-কপালে কেটে যাওয়া দাগ, একদম তার মতো! আগুনের অস্পষ্ট আলোয় দাগগুলো জ্বলজ্বল করছে, যেমন চাঁদের কলঙ্ক চাঁদকে পুরো পৃথিবীর কাছে বিমোহিত করেছে, ঠিক তেমনই!

বাড়িতে আরো একজন রাজকন্যা এসেছে। আরো একজন ‘মা’ এসেছে তাদের জীবনে, হাজারো শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে ইহসান। কিন্তু নিজের উদ্বেলিত মনোভাবটা সে প্রকাশ করতে পারছে না কিছুতেই। ঝড়-বৃষ্টির কারণে গাছাপালা উপড়ে গিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ, সারা শহরের বিদ্যুৎহীন। তার মধ্যে বাড়িতে কোনোপ্রকার খবর দিতে পারছে না ইহসান নেটওয়ার্ক ইস্যুর কারণে। এতসব নিয়ে ইহসান এমনিতেই মহাবিরক্ত। তার মধ্যে ইজহান ক্ষণে ক্ষণে বোকার মতো কাজ করে, অর্থহীন কথা বলে তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে আর সবকিছু তাকে সামলাতে হচ্ছে! তখন মেয়ে কোলে নিয়ে সেন্স হারানোর পর জ্ঞান ফেরাতে যথেষ্ট কসরত করতে হয়েছে ডাক্তারকে।

সদ্য একটা ফুটফুটে রাজকন্যার বাবা হয়ে, মেয়ের মুখ দেখেই নার্ভের দুর্বলতা নিয়ে সেন্সলেস হয়ে যাওয়া, তা-ও ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী শক্ত-সামর্থ্য দেখতে একজন পুরুষ মানুষের? বাকরুদ্ধ ডাক্তার সত্যিই সেডেটিভের প্রভাবে রেখেছিল ওকে। কয়েক ঘন্টা ঔষধের প্রভাবে মরার মতো ঘুমানোর পর যখন চেতনা ফিরল, অবজারভেশনে রাখা ইস্মিতা যখন নার্স দিয়ে ডেকে পাঠাল সে তার স্বামীকে দেখতে চায় এই বলে, ইজহান তখন ভয়ংকর অপরাধবোধে মরে যাচ্ছে! ইস্মিতা তাকে সত্যিই একটা মা উপহার দিয়েছে। তার মা—টা এতো ছোট্ট, তার হাতের সমান। তোয়ালের ভেতরে ছোট্ট শরীরটা লুকিয়ে ড্যাবড্যাব করে দেখছিল তাকে, ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা নেড়ে কাঁদছিল খুব; অথচ সে তার মায়ের কান্না থামানোর কোনো চেষ্টা তো করলই না উল্টো নিজেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল; এটা কোনো বাবা পারে? তাদের সাথে হয়?

এটা স্ট্রং বাবা হওয়ার কোনো লক্ষ্মণ? মোটেই না। তার তো লজ্জা হওয়া উচিৎ, লজ্জায় পুকুরে ডুবে মরা উচিৎ। ইস্মিতাকে সে মুখ দেখাবে কেমন করে? এতসব অবান্তর প্রশ্ন করে করে ইহসানের কানের মাথা খাচ্ছে ইজহান। ভাইয়ের এই রুপ দেখে এক পৃথিবী বিস্ময় কাটছে না ইহসানের। তার ধারণা, সে বেশিদিন বাঁচবে না, মরে যাবে। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী হবে ইজহান। কীভাবে সে টলারেট করছে তার এই মহা পাগল ভাইটির এতসব যন্ত্রণা? তার দুটো বাচ্চার একটা বাচ্চাও তো এভাবে জ্বালায় না। সে চুপচাপ বসে ভাইয়ের উল্টাপাল্টা প্রশ্নগুলো শুনেই গেল, উত্তর দিলো না। আকস্মিক স্লাইডিং ডোর দিয়ে সাদা পোশাকের একজন নার্স কেবিনে প্রবেশ করতেই ইজহান নিজের বকবক থামিয়ে চুপ হয়ে প্রশ্নোক্ত দৃষ্টি মেলতেই নার্স একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধমক দিলো তাকে, “আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে দেখা করতে আমাকে দু-দু’বার পাঠিয়েছে অথচ আপনি এখনো বসে আছেন? অসুস্থ একটা মানুষের প্রতি আপনার একটুও দায়বদ্ধতা নেই, আশ্চর্য মানুষ তো আপনি!”

বলে দরজার দিকে যেতে যেতে তাচ্ছিল্যসরুপ বলল, “এসব কেয়ারলেস মানুষকে আল্লাহ এতো মিষ্টি বউ-বাচ্চা কেন যে দেয়, আফসোস এরা কদর করতে জানে না! এরা বাবা হবার যোগ্যই না!”
কথাগুলো কানে এলো ইহসানের। তার পছন্দ হলো না বিষয়টা। মানুষ সামনে থেকে ক্ষুদ্র কিছু ঘটনা দেখে কত সহজেই একজন অপরিচিতকে বিচার করে ফেলে অথচ ঘটনার পেছনেও যে কারণ থাকতে পারে তা একবারও যাচাই করে দেখে না৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুরুগম্ভীর স্বরে নার্সকে ডেকে উঠল সে।হকচকিয়ে উঠে নার্স পেছনে ফিরে বলল, “আমাকে বলছেন?”
ইহসান কঠিন গলায় বলল, “আপনাকেই বলছি!”
“জি বলুন।”

“আপনার কাজ কী এইখানে? পেশেন্টদের দেখভাল করা, সেবাযত্ন করা। তাদের পার্সোনাল বিষয়ে নাক গলানো না। অথচ আপনার মধ্যে প্রফেশনালিজমের থেকে পার্সোনালিজমই বেশি দেখা যাচ্ছে। যেটা ভালো লক্ষ্মণ না৷” এতটুকু বলে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ইহসান আবারও বলল, “আল্লাহ কাকে, কেন বউ-বাচ্চা দেবে, পরিবার গঠনের সুযোগ দেবে সেটা তিনি আপনার-আমার চেয়ে ভালো বুঝেন। তাই তাঁর সৃষ্টির প্রতি কখনো, কোনো প্রশ্ন তুলবেন না। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড আমি কী বোঝাতে চেয়েছি?”
নার্স আমতাআমতা করে বলল, “জি স্যার বুঝতে পেরেছি।”
“বুঝতে যেহেতু পেরেছেনই এখন নিজের ভুলটাও শুধরে নিন, ইউ সে সরি!”
“জি?”
“সে সরি টু মাই ব্রাদার, আপনি আমার ভাইকে এক্ষুনি সরি বলবেন..”
“কিন্তু স্যার…”

“আপনার সঙ্গে তর্কে জড়াতে চাচ্ছি না। সে সরি এন্ড গেট আউট অফ দিস রুম…”
কঠিন ও রুক্ষ শোনাল ইহসানের কণ্ঠস্বর। নার্স আমতা-আমতা করে ইজহানের দিকে তাকিয়ে ‘সরি’ বলল। কিন্তু ইজহানের মধ্যে সরি গ্রহণের কোনো লক্ষ্মণ দেখা গেল না। সে এতোক্ষণে ঝড়ে-বকে নার্সের দফারফা করে দিতো যদি তার ভাই চুপ করে থাকতো, ইহসান টাইট দেওয়ায় সে এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবারে সুযোগ পেতেই রুক্ষ স্বরে ইজহান বলল, “আমি তো বউয়ের কথা মান্য করে চলছি ইদানীং, তাই আপনাকে তেমন কিছুই বলছি না। তবে ফ্রিতে একটা অ্যাডভাইস দিচ্ছি, অন্যের বউ-বাচ্চার দিকে আপনার শকুনি নজরটা কম দেবেন। কারণ আপনি একজন নার্স, শকুন না। যান এবার…”
অপ্রস্তুত নার্স বেরিয়েই যাচ্ছিল, তবে ইজহান আবারও ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “পরেরবার যাতে আপনাকে আমার বউ-বাচ্চার ডিউটি করতে না দেখি! ভালো হবে না…”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬২ (৪)

“খারাপ কী হবে?”
“খারাপ কিছুই হবে না, কিন্তু আপনার চাকরিটাও থাকবে না।”
আশ্চর্য এবং ভীতগ্রস্ত হয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল নার্স। বুঝতে পারল না, সামান্য একটা বিষয়ে এতো রিয়েক্ট করে কী বুঝাতে চাইল লোকদুটো! তারা খুব ক্ষমতাবান লোক? তাদের এতো ক্ষমতা আছে তার চাকরি কেড়ে নেওয়ার? তাহলে তো অবশ্যই ঐ পেশেন্ট ইস্মিতা আর তার দুধের শিশুটা থেকে দূরে থাকতে হবে! কারণ, এতো সুন্দর, ফুটফুটে দেখতে মেয়ে বাচ্চাটাকে আসলেই তিনি চোখ দিয়ে গিলে খেয়েছে!

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৪