অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৪

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৪
ইসরাত জাহান ফারিয়া

তিন মাসের ছোট্ট একটা ভ্রূণ; ছেলে না মেয়ে ছিল জানতে ইচ্ছে হয়নি ইজহানের। একটা বোলে করে যখন ছিন্নভিন্ন অংশগুলো ওর সামনে রেখেছিল, দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছে করেনি ইজহানের। তবে বুকের ভেতর কিছু একটা ফাঁকা ঠেকছিল ওর। দপদপ করছিল যন্ত্রণারা। ইজহানের সম্পূর্ণ খেয়াল ছিল তখন তার ইস্মিতাকে ঘিরে। তাই এতো বেশি ভাবেওনি সে ঐ ভ্রুণটাকে নিয়ে। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় ইজহানের বুক কেঁপে উঠছে পুরোনো পাপের কথা মনে করে। দম বন্ধ লাগছে। ঐটুকু ভ্রুণটা কী ছিল? তার বাপ না কি মা? কীভাবে পেরেছিল সে এতো নিষ্ঠুর হতে? তার প্রথম সন্তান ছিল তো, তার আর ইস্মিতার প্রথম ভালোবাসার ফসল। সে টিকতে দেয়নি ওকে। নিজের বাচ্চাকে!

ঘাড়ে খুব যন্ত্রণা করছিল ইজহানের। ঝাপসা দেখছিল চারপাশ। সদ্য জন্মানো মেয়ের মুখটাও সে দেখতে পাচ্ছিল না, বারবার সেখানে একটা ছেলেশিশুর মুখ ভেসে উঠছিল! সহ্য করতে না পেরে দৃষ্টি ফেরাতেই ইজহান আরো দেখল, ছেলেশিশুটা তার কোল থেকে নেমে মেঝেতে বসে হামাগুড়ি দিচ্ছে, কোলে উঠার পায়তারা করছে, দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে…আধো আধো স্বরে ডাকছে তাকে ‘পাপা’ বলে। ইজহানের চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করল, চোখ কচলাল সে। কিন্তু তাও বাচ্চাটা দৃষ্টিসীমানা থেকে গেল না, বরং ওর পায়ের কাছে এসে বসলো। ওর জুতা টানলো, মোজা টানলো। এরপর ধীরেধীরে ওর কোল বেয়ে উপরে উঠে এলো। দাঁতহীন মাড়ি দ্বারা ওর কান কামড়ে ধরল, আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরল তার আঙুল। ইজহানের কেন যেন দম বন্ধ হয়ে এলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে সে ডাকতে চাইল বাচ্চাটাকে, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরুতে চাইল না৷ বহুকষ্টে যখন পাপা বলে সম্বোধন করল, নিমিষেই বাচ্চাটাকে দেখল সে কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে। অভিমান আর অভিযোগ মিশ্রিত চাহনি তার। খুব অভিমানের। এটুকু একটা বাচ্চার সেই অভিমান, অভিযোগের সেই দৃষ্টি দেখে আচানক ইজহানের বুকের রক্ত ছলকে উঠল। হাঁসফাঁস করে উঠল সে, ‘আমার বাচ্চা’ বলে। ইহসান রিপোর্ট দেখছিল, দ্রুত এসে ধরল ওকে। ইজহানের প্যালপিটিশন হচ্ছে বুঝতে পেরে রুমাল ভিজিয়ে এনে চোখমুখ মুছিয়ে দিয়ে ওকে ধীরেধীরে শান্ত করানোর জন্য সময় দিলো সে। সম্বিৎ ফিরে পেল ইজহান কয়েক মুহূর্ত পর। প্রশ্নোক্ত চাহনিতে ইহসানকে সামনে দেখে মুহূর্তেই আবার ছেলেশিশুটির মায়াবী চেহারাটা মানসপটে ভেসে উঠল তার। চোখ থেকে বড়ো বড়ো কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ওর। ইহসান ভাইয়ের চোখে পানি দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল, “কী হয়েছে তোর? কষ্ট হচ্ছে? এতো দুর্বল হলে হয়? আম্মাজান তো হাসবে তোকে দেখে!”

আচমকা ত্রিশোর্ধ্ব ইজহান নিজের ব্যক্তিত্ব ভুলে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল। মাথার দু’পাশে চেপে ধরে নিজের প্রতি ঘৃণা, আক্রোশ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “আমি আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছি, আমার বাচ্চাকে। ও আমার ছেলে ছিল, ছোট্ট একটা ছেলে। আমি যাকে আসতে দিইনি! জানিস, ও এক্ষুনি এসেছিল আমার কাছে! এতটুকু একটা বাচ্চা, দুধের শিশু! দাঁত উঠেনি ওর। অথচ আমি..আমি ওকে হারিয়ে ফেললাম। কী করে হারাতে দিলাম? আল্লাহ! ও আমার সন্তান ছিল! এতো বড়ো বড়ো চোখ ওর, ঠোঁট ভেঙে কাঁদল ও আমার দিকে তাকিয়ে, ঘৃণাভরা চোখে! আমি কীভাবে ওর চোখ থেকে নিজের জন্য ঘৃণা মুছব? ও কখনো মাফ করবে না আমার মতো কুলা ঙ্গার বাপকে। আমি..আমি কেমন ন ষ্ট বাপ, আল্লাহ!”
ইহসান হতভম্ব হয়ে বসে রইল। ভাষা খুঁজে পেল না ভাইকে বলার মতো! নির্বাক, নির্জীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অনুভব করল তার এই ভাইটা তার চেয়ে কয়েকগুণ ভালো, কয়েক হাজারগুণ ভালো। যাকে তার ভাই ভুল করে পৃথিবীতে আসতে দেয়নি; ঐ বাচ্চাটাও তার ভাইয়ের প্রতিটি অশ্রুর বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে বাপের জন্য পানাহ চাইবে!

সারাটা দিন অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠা প্রকৃতিকে প্রশান্তির দোরগোড়ায় ভাসিয়ে দিতে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বজ্রসহ শিলাবৃষ্টি শুরু হয়েছে। যার দরুণ শেখ বাড়িটি ঢেকে আছে আঁধারের ছায়াতলে। শেফালি বুয়া কোথা থেকে মোমবাতি জোগাড় করে এনেছে, তবে তা যথেষ্ট নয়! সৃজার নির্দেশে এলিজা আধভাঙ্গা মোম হাতে ঘর থেকে বেরিয়েছে দারোয়ানকে বলে আরো কিছু মোমবাতি কিংবা চার্জার লাইটের ব্যবস্থা করা যায় কি না জিজ্ঞেস করতে! আপাতত মোমের হলদেটে আলোয় আঁধার কেটেছে ইহসানের ঘরটিতে। অন্ধকার কাটলেও তীব্র বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে গলা ফাটিয়ে কেঁদে চলেছে আযরান, আজওয়া। বুকে চেপে তাদের অভয় দেওয়ার চেষ্টা করছে সৃজা আর মিজুর ষোড়শী বউ সায়মা। নীলু বেগম দোয়াদুরুদ পড়ছে, চেষ্টা করছে কীভাবে ওদের ভয় কাটিয়ে শান্ত করানো যায় তা নিয়ে। কিন্তু বাচ্চাদুটোর কান্নাকাটি আর ভয় কমছে না। ক্রমেই বাড়ছে। হসপিটালে ছুটোছুটি করার ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে ফোন করছে ইহসান। কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে এতক্ষণ যাবৎ কল লাগছিল না।

অনেকক্ষণ যাবৎ চেষ্টার পর যাও এবার কল ঢুকেছে, নতুন রাজকন্যা আগমনের খবরটুকু দিয়ে উৎফুল্লতা প্রকাশ করতেই তার কানে এসেছে সন্তানদের কান্নাকাটির শব্দ। সৃজা তাকে জানিয়েছে, বজ্রপাতের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ছোট্ট পাখি দুটো কান্নাকাটি করছে, খাচ্ছেও না। তবে নীলু ফুফুরা সবাই আছে ওদের পাশে। ছেলে-মেয়ের অবস্থা শুনে ইহসান স্থির থাকতে পারছে না। ভেতর থেকে সে ভীষণ উদগ্রীব হয়ে পড়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পুরো বাড়িটাকে সাউন্ডপ্রুফ করার ব্যবস্থা করবে এবং সেটা আগামীকালই। অবস্থা এমন যে, ঝড়-বৃষ্টির তোয়াক্কা করতে রাজি নয়, দুটো নিষ্পাপ প্রাণকে সে কীভাবে অভয় দেবে সেই নিয়ে তার চিন্তা, পারলে তক্ষুনি বাড়ি চলে যায়! কিন্তু সৃজা তাকে উৎকণ্ঠিত হতে বারণ করল। কারণ বাচ্চারা ঘুমানোর চেষ্টায় আছে। আলাপনের এ পর্যায়ে একটুখানি স্থবিরতা আসতেই নিচতলা থেকে সৃজার কানে এলো পুরুষালি অচেনা কণ্ঠটি, যেটি ‘ল্যাভেন্ডার’ সম্বোধনে কাউকে ডাকছে!
ফোনের ওপাশে থাকা ইহসানের কানে পুরুষালি উচ্চস্বরটি দামামা বাজালেও সে ঠাহর করতে পারল না কণ্ঠটি কার!

তবুও সে মৌনতা অবলম্বন করে বুঝতে চাইল ঘটনা কী! শেখ বাড়ির ছোটো পুত্র বাড়ি ফিরেছে খবরটি তখনো ইহসান পত্নীর অজানা। অপরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনে ইহসানকে বলে কলটা হোল্ড করে নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দেখল জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে এলিজা সিঁড়ি মাথায় দাঁড়িয়ে, ওড়না মাথায় টেনে ঢাকছে নিজেকে। নিচের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লম্বাটে, সুর্দশন এক আগন্তুক পুরুষ। ভিজে চুপসে আছে তার মাথার চুল, পরণের স্যুট থেকে পায়ের জুতা অবধি৷ বা-হাতে কুকুরের গলার বেল্ট ধরা, বাদামি রঙের একটা কুকুর ভিজ বের করে আছে, সেও ভেজা৷ অথচ আগন্তুকের সেদিকে খেয়াল নেই। সে আধো অন্ধকারকেন অবমূল্যায়ন করে একদৃষ্টিতে এলিজার দিকেই তাকিয়ে। চাহনিতে নেই কোনো আড়ষ্টতা, নিষ্পলক তাকিয়ে পরখ করে যাচ্ছে ওড়নার আড়ালে ঢেকে যাওয়া তার বোনকে। যার আচরণেও বিস্ময়ের সহিত লেপ্টে আছে একরাশ বিরক্তি। এলিজা পর্দানশীল নয় তবে যথেষ্ট শালীন মেয়ে। সে পছন্দ করে নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখতে।

পর পুরুষদের সামনে যায়, তবে যথেষ্ট পরিমাণ চেষ্টা করে নিজেকে শালীন রেখে তাদের সামনে যেতে। ভদ্রসভ্য পোশাকেই সে অভ্যস্ত। তবুও তার ঠিকরে পরা সৌন্দর্য অন্যকে খুব আকৃষ্ট করে ফেলে সহজেই, সেজন্য মেয়েটা চেষ্টা করে লোকসমাগম স্থানে কম যাওয়ার। বা, গেলেও নিজেকে ঢেকেঢুকে যায়। কেননা, কেউ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তিতে গা কাঁটা দেয় ওর। তাই মাথায় ওড়না টেনে ইয়া বড়ো একটা ঘোমটার আড়ালে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে মেয়েটা আজকাল। কিন্তু শেখ বাড়িতে এসে প্রথমদিনই যেসমস্ত ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে সেসব মোটেও পছন্দ হচ্ছে না এলিজার। মোমবাতির ব্যবস্থা করতে এসে যে আগন্তুকের দেখা পাবে আর আগন্তুক তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকবে ব্যপারটা ওর জন্য বেশ বিরক্তিকরই বটে! অপরিচিত লোকটার নজরের সামনে যে এলিজা অপ্রস্তুত এবং বিরক্ত সেটা বুঝতে পেরেই সৃজা দ্রুতপদে বোনের কাছে এসে দাঁড়াল। পরণের আকাশনীল শাড়ির ঘোমটাটা টেনে তুলে নিলো মাথায়। একটা বৌ বৌ স্নিগ্ধতা এসে ছড়িয়ে পড়ল মুখে। আগন্তুক লোকটার চক্ষুদ্বয় এলিজা থেকে সরে গিয়ে এবারে পড়ল তার উপর। কয়েক সেকেন্ড বাঁকা চোখে তাকিয়ে থেকে রাশভারি স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “হেই ল্যাভেন্ডার, কেমন আছ?”

আচাম্বিত দুই বোন একে-অপরের মুখের দিকে তাকাল। কেউই বুঝতে পারল না যুবকটি প্রশ্নটা কাকে করেছে৷ তবে ‘ল্যাভেন্ডার’ নামের কাউকে যে লোকটি চাইছে, তা বোঝা গেল। কিন্তু শেখ বাড়িতে তো এই অদ্ভুত, বিদেশী ফুলের নামের কেউ থাকে না৷ তাহলে লোকটা কাকে খুঁজছে? পরক্ষণেই সৃজার ঠাহর হল যুবক প্রশ্নটা করেছে তাদের দিকে তাকিয়ে। তার আর এলিজার! অথচ তারা দু’জনের কেউ এই লোককে চেনে না, কোনোদিন দেখেনিও। তাছাড়া সৃজা যদিও এ বাড়ির বউ, এলিজা আজই প্রথম এ বাড়িতে এসেছে! তাহলে কাহিনীটা কী? চুপ থেকে আগন্তুকের প্রশ্নের অর্থোদ্ভেদ করা যাবে না বলে বড়ো বোন হিসেবে সৃজা নিজেই জবাব দিলো, “ল্যাভেন্ডার? আপনি কী এই নামের কাউকে চাইছেন? তাহলে আপনাকে দুঃখিত বলতে হচ্ছে। কারণ এখানে ল্যাভেন্ডার নামের কেউ নেই, এ বাড়িতেও এ নামের কেউ থাকে না।”

রুক্ষ স্বরে কথাগুলো বলার সময় সৃজা লক্ষ্য করছিল আগন্তুকের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি তবে চোখে অদ্ভুত এক মাদকতা। যেটা তার সহ এলিজার দিকেই ঘুরপাক খাচ্ছিল বারবার। বিষয়টা মোটেও ভালো লাগল না ওর। মোমবাতিটা নিজের হাতে নিয়ে এলিজাকে টেনে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে কঠিন স্বরে কিছু একটা বলতে যাবে সেই মুহুর্তেই সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে থাকা আজিজ শেখের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “এই সালেহা, পুনম, মিতু, ইমরান বাইর হয়ে আয়! আমার বাপধন ফিরছে! আমার জান বাড়িতে আসছে! তোরা কে, কোথায় আছিস আলোর ব্যবস্থা কর…”

অন্ধকারে এক টুকরো আগুন নিয়ে সিঁড়িমাথায় দাঁড়িয়ে থাকা সৃজার উপর তখনি চোখ পড়ল আজিজ শেখের। সঙ্গে সঙ্গেই কিছুটা ধমকের স্বরে বললেন, “ঐখানে খাড়ায়া আছো কেন? নিচে আসো। আমার বাপধন ফিরছে, ইহসানের ছোটোভাই। সম্পর্কে তোমার দেবর হয়! আসো, আইসা পরিচিত হওওওও…”
মকবুলসহ আরো ক’জন চাকর-বাকর হারিকেন, লণ্ঠন নিয়ে ছুটে এলো আজিজ শেখের চিৎকারে। ঘরে দোর দিয়ে আকিকা অনুষ্ঠানের একেকটা দোষ-ত্রুটি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝামেলা বাঁধানো মিতুও ইমরানকে নিয়ে ছুটে এলো। সকলেই বিস্ময়ে হতবাক আরসালান ইনজান শেখকে দেখে! ভেজা পোশাক থেকে চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির একেকটি ফোঁটার সঙ্গে যেন এই সুদর্শনের সৌন্দর্যও ঠিকরে পড়ছিল। মানে একজন যুবক এতোটাও সৌম্যদর্শন হতে পারে তা যেন আজিজ পুত্রকে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না।

সকলকে নিজের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত আরসালান আলগা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ‘হাই’ জানাল সবাইকে। বিপরীতে সকলে ভীতি, কৌতূহল নিয়ে ওর সঙ্গে পরিচিত হলো নয়তো কুশল বিনিময়ে লিপ্ত হলো। আজিজ শেখের নির্দেশে মকবুল ছুটে এসে আরসালানের গা থেকে ভেজা স্যুট, পা থেকে শু’জোড়া খুলে টা তোয়ালে দিয়ে ওর মাথা মুছে দিতে উদ্যত হলে আজিজ শেখ নিজেই ছেলেকে চেয়ারে বসিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছে দিতে লাগলেন যত্ন নিয়ে। এদিকে শ্বশুরের কথা শুনে সৃজা অবাক ও বেশ অপ্রস্তুত। সে জানে, ইহসানরা চার ভাই। ইহসান-ইজহান, ইমরান আর ছোটো ভাই ইনজান। যে কি না বেশ কয়েক বছর যাবৎ বিদেশে অবস্থান করছে। দেশে ফিরেনি একটি বারের জন্যও। সালেহা বেগমের এ নিয়েও আফসোসের শেষ নেই! অথচ ছোটো ছেলে আজ বাড়ি ফিরল, কাউকে কিছু না জানিয়ে, ভাইদের অনুপস্থিতিতে, এ বিরুপ আবহাওয়াকে সঙ্গী করে!

সৃজা যখন এসব নিয়েই ভাবনায় মত্ত সেসময়ই মকবুলকে দেওয়া আজিজ শেখের আরো একটা ধমকের স্বর ওর ঘোর কাটাল। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন পুরুষের সঙ্গে ঠিক কীভাবে পরিচিত হতে হয় তা অজানা সৃজার। তার উপর পুরুষটার চাহনি যদি সুবিধার বলে মনে না হয় বা সম্পর্কে যদি সে আপন দেবর হয় তাহলে কোথা থেকে কী বলে পরিচিত হলে সেটা উপযুক্ত হবে বুঝতে পারল না সৃজা। তবে শ্বশুরের উচ্ছ্বসিত আচরণে ভদ্রতা রক্ষার্থে বিব্রত সৃজা নেমে এলো পরিচিত হতে। এলিজা এলো না, মোমবাতি হাতে সরে দাঁড়াল একপাশে। ল্যাভেন্ডারের পদশব্দ অনুসরণ করে আরসালান ইনজান শেখ চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে। ঠোঁটজুড়ে হাসি বিচরণ করল তার। মাথাভর্তি কিলবিল করতে থাকা একেকটা কুচিন্তা তাকে শীতল স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল বহুদূর। প্রশান্তির শ্বাস ফেলে আগ্রহী চিত্তে নড়েচড়ে বসে কান খাড়া করল সে সৃজার রিনরিনে কণ্ঠস্বরের একেকটা শব্দ, বাক্য শোনার আশায়। এদিকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত তবে বিনীত ভঙ্গিতেই বলার চেষ্টা করল সৃজা, “দুঃখিত! আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই বা এর আগে পরিচিত হবার কোনো সুযোগ হয়নি বলে আপনি ঠিক কে সেটা আন্দাজ করতে পারিনি। তবে এখন যখন পরিচয় জানা গেল, এতোদিন পর যখন বাড়িতে ফিরেছেন তখন আপনার আগমনে খুব খুশি হয়েছি। আমি সৃজা রেহমান। আপনার বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী। শেখ বাড়ির বড়ো বউ।”

“আরসালান ইনজান, শেখ বাড়ির ছোটো পুত্র!”
রাশভারি কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই সৃজা অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল। কী বলবে তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারল না। ম্লান হেসে তবুও বলল, “সম্পর্কে আপনি আমার দেবর হোন। আমি কী আপনাকে ভাইয়া বলে ডাকব?”
আরসালান এবার সৃজার চোখে চোখ রেখে তাকাল। একটু ঝুঁকে ঠোঁটে হাসি নিয়ে সরু গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল, “তুই, তুমি, আপনি যা খুশি ডাকতে পারো সেসবে আমার বিধি নিষেধ নেই। আই ডোন্ট কেয়ার! বাট আমি কি তোমায় ল্যাভেন্ডার বলে ডাকতে পারি?”
আশ্চর্যান্বিত হলো সৃজা রেহমান। প্রথম পরিচয়েই ‘তুমি’ সম্বোধন; তার উপর ‘ল্যাভেন্ডার’ ডাকার অনুমতি চাইছে লোকটা! কথাবার্তাও কেমন অদ্ভুত, গা-ছাড়াহীন। প্রবল বিস্ময়ে সৃজা বলে উঠে, “ল্যাভেন্ডার? কিন্তু আমার নাম সৃজা রেহমান!”

“সমস্যা নেই, আমি আদর করে ডাকব! তোমার উচিৎ পারমিশন দিয়ে দেওয়া।”
বিশ্রি একটা অনুভূতিতে গা শিউরে উঠে সৃজার। বুঝতে পারে না সামনে দাঁড়ানো লোকটার আবদার স্বাভাবিকভাবে নেবে না কি জটিলভাবে। দোটানায় ভুগতে থাকা সৃজা অবশ্য বেশিক্ষণ সময় নিলো না। জটিলভাবেই নিলো ব্যাপারটা। অস্বস্তি থেকে রেহাই পেতে বলল, “আপনি বরং আমাকে ভাবি বলেই ডাকুন ভাইয়া, আমি তাতেই খুশি হবো!”

মালিকের কথার অবাধ্য হয়েছে শাড়ি পরণে মেয়েটা, ল্যাব্রাডর জাতের বাদামি কেমি ঘেউঘেউ স্বরে ডেকে উঠল। সৃজা যদিও কুকুর ভয় পায় না তবুও ভয় পেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল হঠাৎ। কেমির কান্ডে ভীষণ রাগান্বিত হলো আরসালান তার তথাকথিত বাপকে— থামিয়ে দিলো প্রচন্ড এক হুঙ্কারে, রক্তবর্ণ চোখে চেয়ে। ওর ওমন আচরণে ভয় পেয়ে গুটিশুটি মেরে পায়ের নিকট কুন্ডলী পাকিয়ে বসে পড়ল কেমি।
এদিকে পায়ের রক্তগুলো তরতর করে মাথায় উঠতে লাগল আরসালানের। হাতদুটো মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো তার। বেগুনি ফুল এটা কী শোনাল আরসালান ইনজান শেখকে? এতোবছর যাবৎ এতো সুন্দর ডাকনামে সম্বোধন করে যাকে নিয়ে ভাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে সে ভেতর থেকে, সেই মেয়ে কি না তাকে ভাবি বলে সম্বোধন করতে বলছে? সে জোর করে হাসার প্রচেষ্টা করল, “এজ ইয়র উইশ, ল্যাভেন্ডার!”

আজিজ পুত্র যতোটা সুদর্শন তার কথাবার্তাও তেমন অদ্ভুত! ‘এজ ইয়র উইশ’ বলে ‘ভাবি’ ডাকার সম্মতি প্রদান করলেও ঠিকই ‘ল্যাভেন্ডার’ ডাকছে! এসে থেকেও ল্যাভেন্ডারকে চাইছিল, ওকেই খুঁজছিল কি? ব্যাপারটাতে কেমন যেন খটকা লাগল সৃজার! তবে মানে বুঝতে ব্যর্থ হলো। এদিকে ছেলের কথোপকথনের বাহার দেখে কিছুটা অবাক হয়ে পুত্রের মুখপানে তাকানো মাত্রই কিছুটা ঝটকার মতো খেলেন আজিজ শেখ। ছেলের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসিটা দেখে এতক্ষণে তার বোধোদয় হলো ইহসানের সঙ্গে তার জানের দ্বন্দের কথা, ইহসান পত্নীকে নিয়ে তার ছোটো ছেলের কুটিল সব ভাবনা! অপ্রস্তুত হয়ে কেশে উঠলেন তিনি। গলা খাকারি দিয়ে ভ্রু কুঁচকে, সন্দেহী নজরে ইনজানের দিকে চেয়ে থাকা সৃজাকে বললেন, “সোনা মণিরা কই? আন্ধারে ওদের কোথায় রাইখা আসছ? যাও যাও ঘরে যাও, ওদের দেখভাল করো গিয়ে। আর সালেহা, পুনমরে পাঠাই দাও নিচে। বলো গিয়ে আমার বাপধন আসছে…”

যুবক বয়সে বড়ো কিন্তু সম্পর্কে ছোটো। অথচ তার আচরণ মোটেও ভালো লাগার মতো নয়। সৃজা আর চাইছিল না এখানে থাকতে, মূলত আরসালানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তাই ওখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে আসতে চাইল ও। আজিজ শেখকে বলল, “আন্টি আর পুনম ওরা ইস্মি ভাবির সঙ্গে হসপিটালে গেছে।” কথাটা বলে সৃজা চলে যেতে উদ্যত হচ্ছিল, কিন্তু কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় থেমে গেল। আজিজ শেখকে বলল, “হসপিটাল থেকে একটু আগেই খবর এসেছে, ভাইয়া-ভাবির ঘর আলো করে আল্লাহ একটা পরী দিয়েছে, ছোট্ট একটা রাজকন্যা এসেছে!”
“আলহামদুলিল্লাহ!”

বংশধর জন্ম নিয়েছে আরো একজন! সৃষ্টিকর্তার অশেষ শুকরিয়া আদায় করলেন আজিজ শেখ। খুশির জোয়ার বইল তার চোখেমুখে। নিজে নিজেই বললেন, “সবই আমার নাতি-নাতনি ভাগ্য! ওদের আকিকার দিনই দেখলা কতকিছু হইলো? আরেকজন নাতনি পৃথিবীর মুখ দেখল, আমার ছোটোবাপ ফিরলো! বংশ, বাড়ি সবেতেই সোনা ফলল! শীতল, বৃষ্টিময় আর পুনরাবৃত্তিমূলক খুশির একটা দিন!”
তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছারত অবস্থায় ফাঁকে ফাঁকে আরসালান দেখল, আকাশনীলে মোড়ানো ল্যাভেন্ডার চলে যাচ্ছে এমিলি ইয়াসমিনের কক্ষের দিকে, সঙ্গে যাচ্ছে রক্তলাল রঙ জড়িয়ে থাকা মোমের পুতুল সরুপ মেয়েলি দেহাবয়বও। যার গালে-কপালে কাঁটা দাগ, চোখদুটোতে মহাসমুদ্রের উচ্ছ্বাস! অথচ অন্ধকারে মুখটা ভালোভাবে দেখতে পারেনি আজিজ পুত্র! সেইদিকে তীক্ষ নজর বিদ্যমান রেখে নিচু স্বরে বিড়বিড় করল ইনজান, “তোমার বংশ নির্বংশ হয় না কেন?”

বৃষ্টির দাপট কমেছে মাত্রই। সৃজা যখন এলিজাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল তখনি ইলেকট্রিসিটি চলে এলো। ঝলমলে আলোয় ভরে উঠল পুরো বাড়ি, ইহসানের ঘরটি। ইলেকট্রিসিটি চলে আসায় সৃজা স্বস্তির শ্বাস ফেলতেই নীলু ফুপি ওকে বলল, “ফোন বাজতেছে অনেকক্ষণ ধরে, ইহসানের কল। বাবু কানতেছিল, ধরতে পারি নাই!”
প্রয়োজনীয় কল হতে পারে বলে সঙ্গে সঙ্গেই সৃজা কলব্যাক করল ইহসানের নাম্বারে। সেকেন্ডেই রিসিভ হলো কলটি। উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করল ইহসান, “কোথায় ছিলি? বাচ্চারা বেশি কাঁদছে?”
“না না, একজন ঘুমিয়েছে। আরেকজন জেগে। তবে জ্বালাচ্ছে না। আমি নিচে গিয়েছিলাম। তোমার ভাই এসেছে। আংকেল ডাকছিল পরিচিত হতে…”
কানে ভুল শুনল না কি ইহসান শেখ? কপালে ভাঁজ ফেলে সরু গলায় দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল সে অর্ধাঙ্গিনীকে, “কার কথা বললি রে জান? কে এসেছে?”
“বৃষ্টিতে ভিজেটিজে তোমার ছোটো ভাই এসেছে। আরসালান ইনজান, ফ্রম প্যারিস!”
বিস্মিত, অবাক, হতভম্ব কিছুই হলো না ইহসান। পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেল। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে দপদপ করতে থাকা কপালে আঙ্গুল চালাল সে, “আমি বেশিদিন বাঁচব না জানিস বউ? আমি আর বাঁচব না।”

কণ্ঠস্বরটি শীতল আর আর্তনাদের মতো মনে হলো। নিমিষেই ভড়কে গেল সৃজা, ধমকে উঠল জোরেসোরে, “এসব কী অলক্ষুণে কথা বলছ? কী হয়েছে তোমার? এক্ষুনি চুপ করো, আদার ওয়াইজ আমি কিন্তু…”
“কিন্তু কী সৃজা?”
দৃঢ় ও ব্যথিত গলায় বলল সৃজা, “আমিও বাঁচব না। তোমার সঙ্গে যাব।”
“আমার মায়ের মতো আমার বাচ্চাদের মাতৃহীন করে কোত্থাও যেতে পারবি না রে তুই! আমি তোকে ক্ষমা করব না।”
বিচলিত, উচাটন কণ্ঠস্বর সৃজার, “আমাকে ছেড়ে উল্টাপাল্টা কোথাও যাবার আগে তুমিও মনে রেখো, আমি তোমায় মাফ করব না। কখনো না। পুরো পৃথিবী পায়ের কাছে এনে দিলেও না। তাই দ্বিতীয়বার ভুলেও এসব কথা উচ্চারণ করো না। তুমি কেন বোঝো না, আমার মাথার উপর হাত রাখার মতো একটা মানুষ বলতে তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার? কেউ নেই। আমি সৃজা অন্তঃসারশূন্য মেয়েমানুষ। যার মধ্যে গুণ তো দূরের কথা বাচ্চা সামলানোর ক্ষমতাটুকুও ক্ষীণ। বলো না, কী হয়েছে? হঠাৎ করে এমন বললে কেন তুমি? আমি তো তোমার ভাই আসার সংবাদ দিলাম। তুমি খুশি হওনি?”

সত্য প্রকাশ করার মতো সাহস নেই ইহসানের, তাই তেঁতো স্বরে বলল, “হয়েছি। তবে ব্যাপার কী জানিস? আমার এই ভাইটা ইজহানের চেয়েও অন্যরকম! ওর কথাবার্তা, আচরণ কিছুই ঠিক নেই। বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করে না। সাইকোলজিস্টের অধীনে রেখেও ওর মধ্যে পরিবর্তন আনা যায়নি। তাই আমার ভয় হচ্ছে ও না আবার কিছু উল্টাপাল্টা করে বসে! তুই প্লিজ সাবধানে থাক, আমি আসছি।”
এসব কথা শুনে সৃজা বিচলিত হয়ে পড়ল ভেতরে ভেতরে। মুখে বলল, “জানো, আমাকে বারবার ল্যাভেন্ডার ডাকছিল, আবার অনুমতিও চাইছিল! কথাবার্তা খুব অদ্ভুত! অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম আমি! তবে একটা ব্যাপার যা বুঝলাম, তোমার এই ভাইটা সবার থেকে আলাদা। কিছু একটা তারমধ্যে ঠিক নেই।”

ইহসানের প্রচন্ড মাথা ধরে গেল এসব শুনে। কু* বাচ্চাটা শুরু করে দিয়েছে তার ফাত্রামি? সে আর কী করবে? কী করলে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে? কেন বারবার তার অনুপস্থিতিতেই ইনজান চলে আসে? কেন? ইজহানও তো তাকে এতো যন্ত্রণা দেয়নি! এত্তো যন্ত্রণা, এত্তো সংশয় এই জীবনে! ইহসানের হঠাৎ খুব অসহায় লাগল! সৃজাকে এটা-সেটা বুঝিয়ে ফোনটা কেটে আজিজ শেখকে কল দিয়ে কতক্ষণ ঝাড়ল সে। এরপর দু’হাতে মুখ ঢেকে কতক্ষণ বসে রইল হসপিটালের করিডোরে ওয়েটিং চেয়ারেই। এদিকের পরিস্থিতি যদিও হাতের মুঠোয়, সব ঠিকঠাক! শুধুমাত্র ইজহানকেই ইস্মিতার কাছে পাঠাতে পারছে না সে, মেয়ে কোলে নিয়ে প্রথম বাচ্চাটার কথা মনে করে এখনো অশ্রু ফেলছে৷ গাধাটার হৃদয় যে এতোটা দুর্বল, সে যে এভাবে কাঁদতেও পারে এই বিরল দৃশ্যটি দেখে ইহসানের মোটেও ইচ্ছে করছে না ভাইকে রেখে কোথাও যাওয়ার! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ঝাপসা চোখদুটো আড়ালে ঢলে নিয়ে ভাইকে বোঝাতে বসলো সে। অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, শান্ত করে আরসালানের আগমনের খবরটুকু দিয়ে ইহসান যখন ইজহানকে ইস্মিতার কেবিনে পাঠাতে সক্ষম হলো ইহসান। একটা যুদ্ধ শেষ করে যোদ্ধারা যেমন নিস্তার নেওয়ার আশায় মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়, ইহসানেরও ইচ্ছে করল হস্পিটালের গুমোট আবহাওয়া থেকে নিজেকে একটু প্রশান্তির চাদরে ডুবিয়ে রাখতে। তৎক্ষনাৎই আকাশকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল।

এদিকে মূর্তিমান ইজহান গিয়েই ইস্মির পায়ের কাছে বসে পড়ল। শরীর অসাড় হওয়া ব্যথা নিয়েও এতক্ষণ পর ইজহানের অপেক্ষায় থাকা ইস্মি লোকটার উপর অভিমানের পাহাড় জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু স্বামীর কান্ডে ওর অভিমানের পাহাড় বরফের ন্যায় গলে গেল। চমকে উঠে বসার চেষ্টা করল ইস্মিতা, বিচলিত কণ্ঠে ডাকলো সে ইজহানকে, “ওখানে কী? এখানে আসুন! আমার বুকে আসুন!”
ইজহান ওর পায়ের পাতায় অগণিত চুমু খেয়ে ইস্মির কাছে আসলো অনুভব করল তার আধপাগল স্বামীটির অশ্রুভেজা চোখ! অথচ প্রাণপণে লুকানোর চেষ্টা করছে তার থেকে। বিব্রত ও বিস্মিত ইস্মি ইতোপূর্বে কখনো ওকে এতোটা দুর্বল হয়ে পড়তে দেখেনি। তাই স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দু’দন্ড সময় নিলো না সে। পড়ে পড়ে নিজেও কাঁদলো। ইজহান তার ইস্মিতার চোখে-ঠোঁটে চুমু খেয়ে নাকে নাক ঠেকিয়ে ব্যাকুল চিত্তে বলল, “দুটো দিতে পারলে না আমাকে? টনা-মনার মতো? কেন দিলে না আমাকে ইস্মিতা? আমার ভেতরটা মা’কে পেয়েও কেন এমন খালি খালি লাগছে?”

ইস্মি ওর কথা শুনে, অদ্ভুত চাওয়া শুনে বিস্মিত হয়ে গেল। ম্লানমুখে হাসলো, “ওসব কী আমার হাতে আছে? তবে আপনি বললে আরো কয়েকটা নিতে সমস্যা নেই আমার!”
ঐটুকুনি মেয়েই যা যন্ত্রণা দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তাতেই আরেকটু হলে হার্ট-অ্যাটাক করতো ইজহান শেখ! বাচ্চার দরকার হলেও ইস্মিতাকে আর গর্ভবতী করা যাবে না। কিন্তু বউয়ের কাছে কী আর নিজেকে কাপুরুষ প্রমাণ করা যায়? ইজহান তাই আবেগ বাদ দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “তোর শখ দেখে আমার চোখ কপালে উঠে যাচ্ছে ইস্মিতা! এতো ষড়যন্ত্র জানিস তুই?”
“আপনার ইচ্ছে বুঝে আমারও মা হতে ইচ্ছে করছে!”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৩

ইজহান কটমট করে তাকাতে চাইল ইস্মির দিকে। কিন্তু কেন যেন পারল না সে; আচমকা পুরুষদের কান্না করতে নেই থিওরিকে ভুল প্রমাণ করে কেঁদে ফেলল! হতভম্ব, হতবাক ইস্মি স্বামীর গাল ধরে উদগ্রীব হয়ে উঠল, “কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন? মেয়েকে পছন্দ হয়নি?”
“ও তো তোমাকে কপি-পেস্ট করে এসেছে, এলিজের মতো গায়ের রঙ নিয়ে! ও খুব সুন্দরী! আমার তো সামনে যেতে লজ্জা লাগছে!”
ইস্মি হতবাক, “মেয়ে সুন্দরী; এরজন্য আপনি কাঁদছেন?”
“না৷ আমি আমার ছেলের জন্য কাঁদছি।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৫