অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৫
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইজহান কটমট করে তাকাতে চাইল ইস্মির দিকে। কিন্তু কেন যেন পারল না সে; আচমকা পুরুষদের কান্না করতে নেই থিওরিকে ভুল প্রমাণ করে কেঁদে ফেলল! হতভম্ব, হতবাক ইস্মি স্বামীর গাল ধরে উদগ্রীব হয়ে উঠল, “কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন? মেয়েকে পছন্দ হয়নি?”
“ও তো তোমাকে কপি-পেস্ট করে এসেছে, এলিজের মতো গায়ের রঙ নিয়ে! ও খুব সুন্দরী! আমার তো সামনে যেতে লজ্জা লাগছে!”
ইস্মি হতবাক, “মেয়ে সুন্দরী; এরজন্য আপনি কাঁদছেন?”
“না৷ আমি আমার ছেলের জন্য কাঁদছি।”
ইস্মি চেয়েছিল একটা সন্তান। সেটা ছেলে-মেয়ে যেটাই হোক না কেন আলাদা করে তার কোনো চাহিদা ছিল না। সৃষ্টিকর্তার দানেই সে বিশ্বাস রেখেছিল। কিন্তু ইজহান মায়ের বায়না করেছিল বলে সে-ও দোয়া করেছিল যাতে তার মেয়েই হয়, একটা টুকটুকে মেয়ে এসেছেও। কিন্তু মেয়ের মুখ দেখার পর ইজহান শেখ এখন ছেলের জন্য কাঁদছে? স্বামীর দ্বিমুখী আচরণে ইস্মি রীতিমতো বোবা বনে গেল। বুকের ভেতর আতঙ্ক জাগ্রত হলো এই ভেবে যে, লোকটা আবার আগের রুপ ধারণ করবে না তো? সেই স্বার্থপর ইজহান, যে নিজের ইচ্ছের বাইরে কিছু মেনে নিতে পারে না এবং আদায় না হলে সমস্ত কিছু ওলটপালট করে দেওয়ার প্রবণতা জেগে উঠে। আরেকটা ব্যাপারও ওর ভিতরে গুঞ্জন তুলল যে, ইজহান যদি মেয়েকে কোলে না নেয়? বাবার ভালোবাসা না দেয়? তাহলে তো ইস্মি সইতে পারবে না। ওর মন মরে যাবে! কিন্তু আজওয়াকে তো লোকটা খুব ভালোবাসে। তাহলে নিজের ঔরসের প্রতি কী দুমুখো আচরণ করবে মানুষটা? প্রবল বিস্ময় আর একরাশ ভীতি নিয়ে ঢোক গিলে ইজহানকে শুধাল ইস্মি, “ছেলের জন্য কাঁদছেন? কিন্তু আপনি তো মেয়েই চেয়ে এসেছেন প্রথম থেকে? খুশি হোননি মা পেয়ে?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
চাপা ভয়টা প্রকাশ হয়ে গেল ওর কণ্ঠের কাঁপুনিতে। ইজহান বিবশ চোখে ওর দিকে তাকাল। নীরবে দেখে গেল কতক্ষণ! ইহসান ওকে সাবধান করে গেছে, মেয়েটা সদ্য মা হয়েছে, হাসিকান্না মিলিয়ে অনুভূতি বা মানসিকতাটাই এখন থাকবে স্পর্শকাতর। এই সময়ে সে যাতে এমন কোনো অযাচিত আচরণ না করে যাতে ইস্মিতার মনে দাগ কাটে, কোনো বিরুপ প্রভাব পড়ে। ইজহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল! ইস্মিতাকে এখন মনে করানোটা উচিৎ হবে কি তার সেই পাপাচার? তাদের জীবনে না থাকা সেই প্রাণটার কথা? তিন মাস বয়সী সেই সন্তানকে অবহেলা করলেও, ভালো না বাসলেও ইজহান শেখকে এখন যেমন যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে ; ইস্মিতা নিশ্চয় তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিল। এটুকু মাথায় আসতেই ইজহান প্রকাশ করল না আর নিজের অভিব্যক্তি। বলল, “খড়কুটো ধরে কোনোমতে বাঁচতে চেয়েছিলাম আমি অথচ তুমি আমাকে দিয়ে দিল পুরো পৃথিবী। চাওয়ার চেয়েও বেশিকিছু দিয়েছ যা আমাকে কেউ কোনোদিন দেয়নি। আমি ইজহান শেখ, চাইলেও তোমার ভালোবাসার একরত্তি ভাগও শোধ দিতে পারব না। এতটা কৃতজ্ঞ, এতটা খুশি বহুদিন হইনি ইস্মিতা… যে খুশিটা তুমি আজ দিয়েছ আমায়।”
জোয়ার শেষে শান্ত হয়ে যাওয়া সমুদ্রের মতো, ঝড় থামার পর প্রকৃতিতে নেমে আসা নিস্তব্ধতার মতো, আর কালো মেঘ সরে গিয়ে আকাশে ঠিকরে ওঠা গোলাকার চাঁদের মোহনীয় প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনই ইস্মিতার মনে হলো, এতোদিন বুকের ভেতর বয়ে চলা ঝড়, সমস্ত অবর্ণনীয় দহন এক লহমায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। সময় থেমে গেছে। আর থেমে গেছে ইস্মি নিজেও। দু’হাতে আগলে ধরল সে ইজহানের মুখটা। ভেতরের জমে থাকা অস্পষ্ট ভালোবাসাটা হঠাৎ করেই স্বীকার করার মতো সাহস পেয়ে বিগলিত চিত্তে বলল, “নিজেও তো একসময় শূন্য ছিলেন। আমি তো বহুদিন ভালোবেসে উঠতে পারিনি আপনাকে। আপনি শিশুসুলভ আবদার করতেন, জ্বালাতেন, আমি বিরক্ত হতাম। সেই বিরক্তি ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে উঠল। আর সেই অভ্যাস কখন যে ভালোবাসায় গাঁথা পড়ে গেল, তা টেরই পাইনি। একটা সময় এলো যখন আপনাকে শুধরে দিতে দিতে, সামলে নিতে নিতে, আপনাকে মানুষ করে তুলতে গিয়ে আপনি নিজেই আশ্রয় হয়ে উঠলেন আমার জন্য! অথচ আপনি বুঝতেই পারলেন না, ইজহান শেখ! আপনাকে খুশি করার আড়ালে আমি আসলে নিজেকেই একটু একটু করে পূর্ণ করছিলাম…”
ইজহান রাগ করল না, হাসলো কেমন করে যেন! বলল, “তবুও তো ইস্মিতা নিজের গর্ভে আমার ঔরস ধারণ করেছে—দু’বার। প্রথমজনকে আমি হারিয়ে ফেলেছি নিজের খেয়ালে, অবহেলায়। অথচ সে আমারই অংশ ছিল। সেই ছোট্ট প্রাণটা আজ নেই শুধু আমার কারণে। সে আমাকে ক্ষমা করেনি, এখনো না। হয়তো কখনোই করবে না। কিন্তু আমি কি শান্তি পাচ্ছি? আমি কি পারছি নিঃশ্বাস নিতে স্বস্তিতে? পারছি না একটুও! ওর কথা মনে পড়লেই বুকের ভেতর কিসে যেন চেপে ধরছে। জানি, এই কষ্ট আমি নিজেই ডেকে এনেছি। কিন্তু সে কি বুঝবে তার বাপের বুকেও ক্ষত আছে? বাপের জন্য একটু মায়া করবে?”
ইস্মিকে একরাশ হতবিহ্বলতায় ডুবিয়ে দিয়ে ইজহান আবারও কাতর গলায় বলল তাকে, “ইস্মিতার ইজহান শেখ আজ একটুখানি, শুধুমাত্র একটুখানি উপলব্ধি করতে পেরেছে সে এখনো অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর হয়ে যায়নি। কিছুটা মনুষ্যত্ব এখনও তার ভেতর বেঁচে আছে! সেই মনুষ্যত্বের জোরেই বলছি, ইস্মিতা আর্শি তুমি কি এই অধম, কুলাঙ্গারকে কখনো মাফ করবে? যে তোমার প্রথম সন্তানকে তোমার কোলে আসতে দেয়নি, যে তোমাকে রানি বানিয়ে দিতে পারেনি, যে তোমাকে শূন্য করে রেখেছিল বহু দিন, মাস, বছর?”
সেই ছোট্ট প্রাণের কথা মনে করে ইস্মি কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে ইজহানের রক্তিম মুখখানি ছুঁয়ে, কাতর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। পর মুহূর্তেই চেপে রাখা কান্না বিধ্বংসীর মতো বেরিয়ে এলো দ্বিতীয়বার। স্বামী নামক আত্মকেন্দ্রিক লোকটার বুকে মুখ ডুবিয়ে, সেখানটা ঝুম বর্ষণের মতো ভিজিয়ে দিয়ে ইস্মি যখন থামল, অস্ফুটস্বরে শুধু বলতেই পারল, “ইজহান শেখ অকৃতজ্ঞ, কুলাঙ্গার না। সে আমার দুটো সন্তানের বাবা! যাকে ইস্মিতা আর্শি নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে, অনেকটা বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। এই লোকটার একটু ভাগও সে অন্য কাউকে দিতে রাজি নয়, তার মেয়েকেও নয়। এই লোকটার পুরোটা ভাগ ইস্মিতা আর্শির নিজেরই লাগবে।”
এমন একটা মুহূর্তে এসে, ক্রন্দনরত বউয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে, হেসে ফেলল ইজহান। নাকে নাক ঠেকিয়ে বলল, “আর এই পাষণ্ডী মহিলাকেও আমার লাগবে, যে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিন-রাত বলবে, ‘পাশে আছি,’ ‘ভালোবাসি।’ এই নির্দয় মহিলাকেই আমাকে আমার মেয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে হবে, দেখভাল করতে হবে, রান্না করে খাওয়াতে হবে আমাকে, আমার মা—কেও।
এই হিংসুটে ইস্মিতা আর্শিকেই আমার চাই ক্ষণস্থায়ী, দীর্ঘস্থায়ী দুটো জীবনেই।”
অশ্রুভেজা চোখে এবার ইস্মি নিজে হেসে ফেলল! মনোমুগ্ধকর চোখে স্বামীকে দেখতে দেখতে, নরম গলায় বলল, “আপনি বলছেন, ভালোবাসতে হবে। অথচ আমি ভালোবাসি আপনাকে। যতটুকু পেরেছি, নিজেকে হারিয়ে, আপনার অন্ধকারে আলোর মতো থেকেছি। বাকিটা জীবনও আপনার হয়ে থাকতে চাই পূর্ণ, অপূর্ণ হয়েও৷ শুধু এইটুকু নিশ্চিত করতে যে আমি একা নই, অবাঞ্ছিত নই। আমাকে ভালোবাসার জন্য একটা মহাপাগল ইজহান শেখ আছে! তার জন্য আমি বারবার সব ছেড়ে আসব৷ শুধু একবার
বলুক সে, ‘থেকো, চিরকাল!’
‘থেকো, চিরকাল!’
স্বগোতক্তি করে ইজহান যত্ন নিয়ে শক্ত একটা চুমু বসাল তার ইস্মিতার কপালে। ঠোঁটের ছোঁয়ায় বিষাদ কেটে, দু’জনের মাঝেই আস্তেধীরে জন্ম নিচ্ছিল একদলা সুখানুভূতি। বিশাল একটা কালো মেঘের বাহন আকাশ পাড়ি দিয়ে, গোলাকার চাঁদের জোৎস্না ছড়িয়ে দেওয়া পর্যন্ত স্থায়ী রইল মুহূর্তটুকু!
বাংলা ক্যালেন্ডার বলছে আজ আষাঢ় মাসের এক তারিখ। মানে আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। এখন রাত। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সময় ঠিক সাড়ে এগারোটা। অথচ রাত্রির অন্ধকারেও আকাশ জুড়ে এক নদী বিষণ্ণতা। বৃষ্টি নেই তবে শীতল হাওয়ায় চারিপাশ উত্তাল। কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকেই আকাশে একটা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে, দ্যুতি ছড়াচ্ছে শেখ বাড়ির বিশাল ছাদটায়। ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে পুকুর পাড়ের ঝোপ থেকে। নীতিনের কেনা সস্তার সিগারেটে ঠোঁটের ভাঁজে ফেলে একহাতে স্কচের গ্লাস নিয়ে ছাদের রেলিঙয়ে শুয়ে আছে আরসালান ইনজান শেখ। তার শুকনো জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি কামিনী ঝাড়ের নিচে উঁচু ঢিবির মতোন জায়গাটায়। যেখানটাতে তাকাতেও তার বিরক্তি, অথচ তার ক্ষোভ যার উপর সেই নারীটিই চিরনিদ্রায় শায়িত ওখানে। অনেক বছর আগের পুরোনো কথার ঝুলি খুলে বসেছে আরসালান অথচ সেসবের শ্রোতা এই বিশাল আকাশটা ছাড়া আর কেউ না।
কথা শোনার মতো কেউ নেই, রাগ বোঝার মতো কেউ নেই এটা বুঝতেই আরসালনের আরো রাগ হয়, শরীর বয়ে চলা রক্ত জমাট হয় তবুও ভেতরের দহনটা একটুর জন্যও নিভে না। বিড়বিড় করে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে সে বলে, “তোমার জন্য এসেছি আমি, তোমার জন্য! তুমি ছাড়া আর কোনো কারণ নেই আমার এ বাড়িতে আসার…কোনো কারণ নেই। অথচ তুমিই চুপ করে আছ, আমার কথা শুনছ না? তুমি ইহসান শেখের মাম্মাম…তাহলে আমাকে জন্ম দিয়েছিলে কেন? হ্যাঁ?”
হাওয়ায় দুলতে থাকা কামিনী ঝাড় থেকে কয়েকটা সুগন্ধিশুভ্র ফুল ঝড়ে পারে ভেজা মাটিতে। অথচ
জবাব দেয় না মাটির নিচে শায়িত মানবীটি।আরসালান বিরক্তি নিয়ে তা দেখে। চোখ ফেরায়, তাকায় আকাশে। আশ্চর্য! সেখানেও মেঘ-চাঁদের সুখ দেখতে হচ্ছে! চারিদিকে সবার এতো সুখ তাকেই কেন দেখতে হচ্ছে? চাঁদ-তারার সুখ, প্রকৃতির সুখ, তার বাবার সুখ, ভাইদের সুখ অথচ তার জীবনে কোনো সুখ নেই। ইহসান শেখ বলে, তার না কি সে যোগ্যতাই নেই। কী করলে সে যোগ্যতা হবে ভেবেছে সে, ভেবে কিছু পায়নি। নিভু নিভু ধূমায়িত শলাকায় শেষ টান দিয়ে আরসালান চোখ বুঁজে। গহীন রাতের আঁধার আর নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে নীতিনের শোনা একটা গান মনে পড়ে তার,
আড়ালে আড়ালে
কোথায় হারালে?
ফিরে তুমি আর আসবে না বুঝি?
কতরাত কেটে গেছে আঁধারে
নেইতো ভোরের দেখা
বোঝাব কীভাবে?
কত ঘুম মিশে গেছে অজানায়
জানে শুধু দু চোখ,
ভুল সে স্বভাবে!
ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে ভাইকে গুণগুণ করে গান গাইতে শুনে ইহসান। গান শেষ হতেই গলা খাকারি দিয়ে আরসালানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রেলিঙয়ে শোয়ারত অবস্থায়ই ফিরে তাকায় আরসালান। ভাইকে দেখে বিস্মিত হবার ভান করে। রাত নামা বাতাসে ছুঁয়ে কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো উড়ছে ইহসানের। চোখমুখ রক্তাভ, রাগের চোটে নাক কাঁপছে। দীর্ঘক্ষণের নিশ্চুপতায় ইতি টেনে ক্রোধ নিয়ে জিজ্ঞেস করে “আমার ক্ষতি করতে আবার চলে এসেছিস?”
আকাঙ্খিত ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখে আরসালান
উঠে বসে এবার। গম্ভীরমুখে বলে, “তুমি তো দাওনি, তবে লাভলি ফাদার তোমার বাচ্চাদের আকিকার দাওয়াত ঠিকই দিলো, যে করেই হোক আসতেই বলল। তার না কি সাধ জেগেছে সন্তানদের একসাথে দেখে চোখ জুড়ানোর। আমিও ভাবলাম, কতদিন আর এদিকওদিক ঘুরব, নিজের বাড়ি থাকতে? তোমাকে জ্বালাতেও পারছি না বহুদিন, উলটো নিজেই জ্বলছি তোমাদের সেদিনের কিসিং মোমেন্ট দেখে, তাই ভাবলাম চলেই আসি…”
তেড়ে এসে ওকে চেপে ধরে ইহসান। অতিষ্ঠ কণ্ঠে বলে, “আরেহ শশশালা, তুই চাইছিস টা কী? আমাকে মারবি?
তো মেরে ফেল। নিস্তার দে আমাকে।”
আরসালান নিশ্চুপ তাকিয়ে। ইহসান ফের বলে, “এই তোকে না আমি গু লি করেছি, এরপরও ভয়ডর করে না তোর আমাকে? জান দিবি তবুও আমাকে কেয়ার করবি না, এরকম টাইপ?”
“জিনিস দিচ্ছ না তো, দিলে…ভয় করব তোমাকে।”
ইহসান কথাটা বুঝে নেয় তবে ইঙ্গিতটা ধরে না। উল্টো ওকে ছেড়ে দিয়ে রেলিংয়ে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, “আয় তোকে বিয়ে করিয়ে দিই, আমাকে ভয় না পেলেও বউকে ঠিকই ভয় পাবি। আফটার অল ম্যারেজে তোর এলার্জি!”
একটু থেমে ভাবুক হয় ইহসান৷ আরসালানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বলে, “আচ্ছা তুই তো হাইপার সে* ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত তোর বাপের মতো। তো আজকাল কি সেটা কমে গেছে? মেইন সিস্টেমে সমস্যা? কাজ করে না? না কি এতটাই ওভার হয়ে গেছে যে শুধু অন্যের জিনিসপত্রের দিকে হাত বাড়াস, কেড়ে নিতে চাস! এত চুলকানি তোর? আমাকে বল! তোকে ভালো ডাক্তার দেখাব। জিজ্ঞেস করব কেন তোর চরিত্র এতোটা নিচু! তোর বাপ নষ্টামি করেও তো বিয়ে করেছে, দু-দুটো করেছে। তাহলে তুই কেন এমন! জানতে হবে আমাকে। আচ্ছা সব কথা ঠিক তো, না কি তোর সব ফাপড়? কোনো মেয়েই তোর মতো বিকৃত মানুষকে সহ্য করে না? লাত্থিঝাটা দেয়? আর অপমান লুকাতে, নিজেকে মহাপুরুষ প্রমাণ করতে তুই ভুগিচুগি বোঝাস আমাদের, কোনটা?”
পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলায় চোখদুটো রাগে কাঁপতে লাগল আরসালানের। ঘাড় বাঁকা করে ইহসানকে বলল সে, “আসো প্রুফ দেই।”
চোয়াল বরাবর ঘুষি বসাতে গিয়েও নিজেকে আটকে ফেলে ইহসান। এই নির্লজ্জ, নষ্টকে মেরে সে শুধু শক্তিই খরচ করছে। এই সাইকো ঠিক হয়নি। ঠোঁট ভিজিয়ে রাগ সংবরণ করে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে, “নট ইন্টারেস্টেড!”
“নট ইন্টারেস্টেড বলেই বাচ্চা এনে ফেললে দুটো? স্ট্রেঞ্জ! মনে হচ্ছে না ভুল করেছ?”
“আমি ওদের বাপ। ঠিক করেছি না ভুল করেছি আমি বুঝব। তুই চাচা হোস ওদের, যদিও নষ্ট মনের। তবুও আমি আমার বাপ-মা দুটোকে বলে দেব চাচা ডেকে তোর কষ্ট যেন একটু হলেও কমিয়ে দেয়…আফটার অল নিজের বলতে কেউ নেই তোর। না একটা বউ, না বাচ্চাকাচ্চা…”
“উপহাস করছ?”
“ফ্যাক্ট বলছি।”
“অহংকার করছ, তোমার সব আছে বলে?”
কঠিন গলায় বলে ইহসান, “আমার কাছে সব নেই, বউ-বাচ্চা ছাড়া।”
অ্যালকোহল পান করার কারণে বেশ চড়ে গিয়েছে ততক্ষণে নেশাটা। কথাবার্তা এলোমেলো হচ্ছে টের পেলেও ইহসানের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করছিল আরসালান। বুকে কাঁটার মতো বিঁধে তাকে নিয়ন্ত্রণহারা করে তুলছিল ক্রমশই। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে হাতের গ্লাসটা মুঠোয় চেপে ধরতেই ভাঙল সেটা, কাচ ঢুকে কাটল হাতটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো তৎক্ষনাৎ। ফ্যাসফেসে, ধারাল কণ্ঠে বলল সে, “আমারও তো কেউ নেই। আমার বুঝি নিজের কেউ লাগে না? তোমরা সবাই এতো স্বার্থপর কেন? নিজেদের কথাই ভাবো শুধু! তোমার ঐ পাগল মায়ের মতো! তোমাদের মতো সেও স্বার্থপর! না, সে আরো বেশি স্বার্থপর! তার গর্ভে জন্ম নিয়ে একটা জীবন আমার ভালোবাসাহীন কাটছে, লোকের বাঁকাত্যাড়া কথা হজম করে কাটছে। আর এখন তোমরা একেক ভাই নিজেদের আলাদা পরিবার গঠন করে আমাকে লাত্থি মেরে জীবন থেকে বের করে দিচ্ছ, যেন আমি কেউ না তোমাদের! আর তুমি? তুমি তো বারবার আমাকে কাঙাল প্রমাণ করছ! তোমার ঐ মা—টা? যাকে ভিক্টিম মনে করো তুমি, স্বার্থপর মহিলাকে মাফ করব না আমি। নিজে বেঁচে গেছে, তার ছোটো ছেলের জীবন ধ্বংস করে, একদিন সব ক’টাকে আমি কাঙাল করে দেব আমার জীবন হেলাফেলা করে নষ্ট করে দেওয়ার কারণে…”
হাতে কাচ বিঁধেছে, কেটে রক্ত অঝোরে রক্ত ঝরছে! অথচ আরসালানের সেদিকে বিকার নেই। ক্ষোভ আর ক্রোধে সে ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে নিজের মেজাজের উপর। ইহসানের মাথার ভেতরটা এলোমেলো লাগে ভাইয়ের কথাগুলো শুনে। শার্টের কলার ধরে সে দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় চিৎকার করে, “এতো পাগলামো কেন করছিস জান? কীসের এতো ক্ষোভ তোর আমার উপর? তুই তো ভালোবাসা বুঝিস না, সৃজাকে ভালোবাসিস না। তাহলে কেন এই হঠকারীতা করছিস আমার সঙ্গে? তোর জন্য প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকতে হয়! কখন, কী করে বসিস এই টেনশনে আমি আজকাল নিজের উপর এতটাই উদাসীন আর ডিজাপয়েন্টেড যে ঠিক যে কারো সঙ্গে দুটো কথা বলব, ভেবে সিদ্ধান্ত নেব সেইটাই পারছি না। আমি আমার নিজেকেই হারিয়ে ফেলছি তোর পিছনে কুত্তার মতো ছুটতে ছুটতে।
ছোটোবেলা থেকে তুই আমার পেছনে লেগে আছিস, আর কত সইব আমি? একটু বলবি আমায়, কবে নিস্তার দিবি? কতোবার মারতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম, মারতে পারলাম না৷ তোর শাস্তিই নয় ওটা। আমি কী করি বলতো? একদিকে ভ্রাতৃত্বের টানে তোকে মারতে গেলে হাত কাঁপে, বুক কাঁপে অন্যদিকে তোর কার্যকলাপ মনে এলে ইচ্ছে করে কু পি য়ে ফালাফালা করি তোকে। আমি কী করি তুই বলে দে আমায়…নয়তো আমাকে মেরে এরপর তুই তোর জীবন সাজা, তোর মনমতো। যে জীবনে আমি নেই, যে জীবনে আমার সৃজাকে তুই নিস্তার দিবি…”
আরসালান ইনজান শেখ তাকিয়ে থাকে তার ভাইয়ের দিকে জ্বলজ্বলে নেত্রে। বুকের ভেতর দহন শুরু হয়, মস্তিষ্ক ঘট পাকায় তার মাথার ভেতর। নিতে পারে না সে ভাইয়ের কথাগুলো। রাগে-জেদে মিলেমিশে এক সমুদ্রে পতিত হয় তার। অথচ চোখদুটো বুজে ভাইকে সে আচমকা জড়িয়ে ধরে। ইহসান অবাকও হয় না, আঁকড়েও ধরে না ওকে। বরংচ মেঘ স্বরে বলে, “ছাড় আমাকে! তোর মতো খু নী আমাকে ছুঁলে আমার গা ঘিনঘিন করে, বমি পায়। মনে হয় মরে যাই…”
“কিন্তু আমি তোমাকে মরতে দেখতে চাই না। আমি চাই তুমি আমাকে সুখী দেখো আর আফসোস করো।”
“কাউকে সুখী দেখলে আমার আফসোস হয় না, আমি খুশি হোই। দোয়া দেই আরো সুখী থাকার জন্য।”
ক্ষোভ আর অট্টহাস্যে ভরা কণ্ঠে বলল আরসালান, “তুমি সবসময় চেষ্টা করো আমাকে কষ্ট দেওয়ার, কষ্টে দেখার, অথচ আমি তেমন থাকি না। খুব আমুদে থাকি, ফূর্তি করি, নিজেকে নিজে ভালো রাখি। তোমার একটুও লোভ হয় না আমার লাইফ স্টাইলের প্রতি?”
ইহসান এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। পরক্ষণেই শক্ত গলায় জবাব দিলো, “তোর কোনোকিছুর প্রতিই আমার লোভ লাগে না। ভালো, খারাপ কোনোটাতেই না। ইনফ্যাক্ট, আমি কিছু অনুভবই করি না তোর প্রতি। আর তুই যে বলছিস তুই এসব করে নিজেকে নিজে ভালো রাখিস, আসলেই কি তুই ভালো থাকিস?”
আরসালান ভালো থাকে না, আসলেই সে ভালো থাকে না। অথচ সে ভালো থাকার ভান করে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের সামনে। এই অকাট্য সত্যি কথাটা শুনলে তার বড়ো ভাই তাকে নিয়ে অট্টহাসি হাসবে, তাচ্ছিল্যভরে তাকাবে৷ যেটা সে আসলেই সহ্য করতে পারবে না। সে আচমকাই শান্ত হয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘আমি ভালো থাকি, এসব করেই আমি ভালো থাকি।’
অথচ সে বলতে পারল না। তার আগেই ছাদের দরজায় একটা মেয়েলি অবয়বে চোখ আটকে গেল তার। একদম চুপ করে গেল সে।
“ভাইয়া আছ এখানে? আপু ডাকছে তোমায়!”
অন্ধকার সিঁড়িঘর থেকে রিনরিনে অথচ শক্ত একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বরে কিছুটা চমকে উঠল ইহসান। ঘাড় ফিরিয়ে ছাদের দরজার দিকে তাকাল সে। দরজাটা খোলাই ছিল, শীতল বাতাসে বারি খাচ্ছিল বারবার। এলিজা সেটা দু’হাতে ঠেলে রেখেছে, চোখমুখে তার অপ্রস্তুত ভাব। ইহসান ছেড়ে দিলো আরসালানকে। কলার থেকে সন্তপর্ণে নামিয়ে আনলো নিজের হাতটা। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখের ভাষায় ভাইকে শাসিয়ে ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল এলিজার দিকে। টুকটাক দু-একটা কথা বলল, এরপর এলিজাকে নিয়েই নেমে গেল। অথচ আরসালান ইনজান শেখ সচকিত চোখে লক্ষ্য করল, লাল জামা পরণে মোমবাতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তখনকার সেই মেয়েটাই এটা। সিঁড়ির একেকটা ধাপ পেরুতে পেরুতে মোট তিনবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে এবার মেয়েটা। একবার তার মুখের দিকে, আর দু’বার তার কাটা হাতের দিকে। যেখান থেকে অঝোরে র ক্ত ঝরছে!
আষাঢ়স্য দ্বিতীয় দিবস। গাঢ় কালো মেঘমল্লারে ডুবে আছে আকাশ। বৃষ্টিময় দিন। ভোর থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। চারপাশের রুক্ষ গাছপালা সজীব হয়ে প্রশান্তি ছড়াচ্ছে প্রকৃতিতে। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তবে বাজ পড়ছে না। ঝাপসা কাচের জানালা গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির একেকটা ফোঁটা। উদাসীন নয়নে ভিজতে থাকা প্রকৃতি দেখায় মগ্ন ইস্মিতা আর্শিকে চেক আপ শেষে ডাক্তার জানাল, সবকিছু ঠিক আছে। কোনো অতিরঞ্জিত সমস্যা নেই। মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফেরা যাবে আজই। বাড়ি যাবার খবরটা শুনে ইস্মির সঙ্গে সঙ্গে ইজহানও সুস্থির হলো। হাসপাতাল তার বড্ড অপছন্দের জায়গা, কেমন রুগ্ন রুগ্ন লাগে সুস্থ মানুষকেও। বাড়ি ফিরতে পারলেই সে সবচেয়ে খুশি। আযরান-আজওয়াকে কখন তার মা’কে দেখাবে এই নিয়েও ভীষণ উত্তেজিত সে। আকাশ আর মিজুর সঙ্গে হস্পিটালের বিল বিষয়ক যাবতীয় ফর্মালিটির বিষয়ে কথা বলতে সে বাইরে গেল। আলাপচারিতা শেষে কেবিনে ফিরে বসামাত্রই দরজা ঠেলে একজন নার্স ঢুকল। জানাল, ঘুম ভাঙার পর থেকে ইস্মিতা আর্শির মেয়েশিশুটি খুব জোর কাঁদছে; তাকে এখন খাওয়ানোর সময়! মা যেন প্রস্তুতি নিয়ে রাখে! নার্সের কথা কর্ণগোচর হতেই ইজহান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। গর্জে উঠে বলল, “এতটকু বাচ্চাকে এখনো কিছু খাওয়ানো হয়নি মানে? না খাইয়ে রেখেছেন ওকে? আশ্চর্য! আপনাদের খাম-খেয়ালিপনার জন্য আমার মেয়ের কিছু হলে আমি থানায় কমপ্লেইন জানাব আপনাদের নামে।”
নার্সকে যথেষ্ট বিরক্ত দেখাল, “আপনার বেবি তো রাত ধরে ফর্মুলা খাচ্ছে, কিন্তু ম্যাম বলে দিয়েছেন ওকে যাতে মায়ের দুধ দেওয়া হয়! আপনি থানায় কমপ্লেইন দিলে তার কোনো ভিত্তিই থাকবে না স্যার!”
ঝাঁঝিয়ে উঠা ইজহানের মাথায় প্রথমে খেলল না কথাটা! ইস্মির দিকে তাকাতেই মেয়েটা যখন অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো, সে বোকার মতো তাকিয়ে রইল বউয়ের দিকে। ইস্মির মনে হলো কোনো গর্তে লুকিয়ে পড়তে! রাতে কয়েকবার ফিডিং করানোর চেষ্টা করেছিল সে মেয়েকে, কিন্তু কাজে দেয়নি। বাধ্য হয়ে ফর্মুলা খাইয়েছে ডাক্তারের পরামর্শে। সারারাত নার্সদের কাছে ছিল বলে তারাই সব করেছে। কিন্তু মায়ের দুধের গুরুত্ব বেশি বলে, বারবার চেষ্টা করতে বলেছে ডাক্তার। ঔষধও দিয়েছে তেমন। সবটাই সে করেছে ইজহানের আড়ালে বা অনুপস্থিতিতে। লোকটার বেফাঁস মন্তব্য বা কান্ডে লজ্জা পাবে বলে বিষয়টা জানতেই দেয়নি ওকে ইস্মি। সে সময়টুকুতে নানান বাহানায় ওকে কক্ষের বাইরে এই-সেই কাজে পাঠিয়ে দিতো বলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। কিন্তু এখন? কী বলে লোকটার থেকে নিজের লজ্জা লুকোবে সে?
ইজহান অবশ্য কিছুই বলল না। বুকের ভেতর হার্টবিট জোরাল হলেও আগ্রহ নিয়ে বসে রইল। তোয়ালেতে মুড়িয়ে পুনম যখন ইজহানের বহু আকাঙ্খিত মাকে নিয়ে কক্ষে এলো, ইজহান এক সমুদ্র আবেগ আর নরম দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখল। লাল দুটো ঠোঁটে ক্ষিধের যন্ত্রণা নিয়ে অসহায়ের মতোন কান্না করা শিশুটির একেকটা চিৎকার সে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারল না। ইজহান শেখের মেয়ে সে; ও কেন এতো কান্নাকাটি করবে? বাবা-মায়ের প্রাণভোমরা সে; এতো কেন অসহায় দেখাবে তাকে? বাবা হয়ে মেয়ের আর্ত সুর সহ্য করতে পারল না ইজহান মোটেও। চট করে পুনমের কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে অসংখ্য চুমুর সাগরে ভাসিয়ে দিতেই সে টের পেল, ষোলো ঘন্টা আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া তার শত্রু ওরফে মা—তার দিকে এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে! কী যে হলো! লজ্জায় চোখমুখ আবারও লাল হয়ে গেল ইজহানের; ইস্মির দিকে মেয়েকে বাড়িয়ে দিয়ে কাঠ কাঠ স্বরে বলল, “ও এভাবে তাকায় কেন? ওকে এভাবে তাকাতে মানা করো!”
পৃথিবীর সব সুখ নিয়ে এতোক্ষণ বাবা-মেয়েকে দেখছিল ইস্মিতা। স্বামীর কথায় এবারে তার ঘোর ভাঙল, হাসিও পেল খুব। কিন্তু স্বামীর আদেশ মেনে নিয়ে আদর আদর স্বরে মেয়েকে বলল সে, “মা, এভাবে তাকায় না। বাবা হয় তোমার। বাবার দিকে এভাবে তাকালে তোমার বাবা লজ্জা পাচ্ছে!”
একবার, দুবার, তিনবার… বলা হলো। কিন্তু ঘন্টাখানিক বয়সের মেয়েশিশুটি, যার চোখদুটোতে বাবাকে দেখার বিস্ময়; সে মোটেও ইজহান পত্নীর কথা শুনল না, মাকে বিরক্তি দেখিয়ে বাবার দিকে তাকিয়েই রইল। পুনম তা দেখে হাসতে হাসতে বলল, “এই আদরটা বাবা পাগল হবে দেখো ভাবি, বাবার নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে। তোমাকে যেমন ভাইয়া ঘুরাতো, ঠিক তেমনি…”
বোনের কথা শুনে ইজহান একটা ধমক দিতেই যাচ্ছিল কিন্তু মেয়ে ভয় পেতে পারে সালেহা বেগমের থেকে এমন সতর্কবাতা পেয়ে সে নিভে গেল। ছোট করে পুনমকে বলল, “তুই কি ভবিষ্যত বিশারদ? কীভাবে জানিস এতো কিছু?”
“এরজন্য ভবিষ্যত বিশারদ হবার কী আছে? সিক্স সেন্থ বলে একটা ব্যপার আছে! তুমি কোলে নিতেই মেয়ে কেমন চুপ মেরে গেল দেখেছ?”
মনের বাগানে হাজারো প্রজাপতি ডানা মেলল ইজহানের। পেটের ভেতর গুঁড়গুঁড় করল, তার শব্দও হলো। সবকিছু কেমন হালকা লাগল। তোয়ালের ভেতরে হাত-পা নেড়ে অদৃশ্যভাবে তার সব আকর্ষণ কেড়ে নেওয়া মেয়েকে তার কাছে সদ্য ফোটা ফুল মনে হলো। মনে হলো মেয়ের চোখ
তার ভেতরের আগুনকে ঝুম বর্ষার পানি দ্বারা নিভিয়ে দিচ্ছে! ইজহান ইস্মিতাকে কেমন উদাসীন গলায় বলল, “ওকে এভাবে তাকাতে বারণ করো, বারণ করো!”
ইস্মি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো হেসে বলল, “কিন্তু ও আমার কথা শুনবে না।”
বিস্ময় নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল ইজহান, “কেন?”
স্বামীর গালে হাত রেখে ভীষণ মায়া মায়া কণ্ঠে ইস্মি বলল ওকে, “ও আপনার মা। আর মা কখনো তার ছেলের থেকে দৃষ্টি ফেরায় না। আপনার মেয়েও ফেরাবে না। সে আমি যতোই বলি!”
বুকের ভেতর লক্ষ তারাবাজির বিস্ফোরণ, আর মহাকাশের সব নক্ষত্রের আলো ইজহান শেখের পৃথিবীটাকে অন্য এক রঙিন দুনিয়ায় স্বাগত জানাল। জন্মদাতা মাও কখনো তার দিকে ভালো করে তাকায়নি, ভালোবাসা নিয়ে এক পলক দেখেনি—সীমাহীন আফসোসে আর দংশনে এতোকাল যে বুকটা চৈত্রের রোদে পুড়ে খাঁক হতো, সেই বুকটা সাইবেরিয়ার সবচেয়ে শীতলতম স্থানের চেয়েও শীতল ঠেকল ইজহানের। মেয়েকে সে বুকে চেপে ধরল, আলতো অথচ শক্তভাবে। মেয়েও বাবার
সাদা টি-শার্টের বুকের অংশটুকু এমনভাবে চেপে ধরল, তফাতে বসে থাকা সালেহা বেগম চোখভরা জল শাড়ির কোণে মুছে নিয়ে বলে ফেললেন, “মা পাইছ তো বাপজান? একদম মনমতো?”
ইজহান অস্ফুটস্বরে জবাবে বলল, “পেয়েছি!”
সালেহা বেগম পুত্রের পানে চেয়েছিলেন আকুতিভরা চোখে। পেটে না ধরেও এদের চার ভাইকে সে ছেলে মানে, পুনমের চেয়ে কোনো অংশে কম ভাবেন না তাদের নিয়ে। অথচ কোনো কালেই তাদের মা হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। অপরিচিত, অনাকাঙ্খিত একজনের সঙ্গে মানুষ যেমন আচরণ করে ঠিক তেমনই আচরণ পেতেন ওদের থেকে। ছোটো পুত্রকে তো নিজের হাতে তুলে ভাত পর্যন্ত খাইয়ে দিয়েছেন কতকাল; সেও দেয়নি মায়ের জায়গা। সালেহা বেগমের বুকের ভেতরটা হু হু করে, তবুও পুত্রদের সুখ দেখে তিনি খুশি হোন। তার স্বস্তির জায়গা এটাই যে, ছেলেগুলো একটা জালিম বাপের রক্ত নিয়ে পৃথিবীতে এসেও জালিম বাপের মতো পুরোপুরি হয়ে যায়নি, একটু-আধটু মানুষও হয়েছে! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিঁড়ে, ম্লান হাসি দেখা যায় ঠোঁটের কোণে। ইস্মি টের পায় তা, পুনমও। তাদের চোখের সান্ত্বনার চাহনি সালেহা বেগমকে বুঝ দেয়, যতোই ভাইয়েরা স্বীকৃতি না দেক, তিনি মা-ই হোন আজিজ পুত্রদের!
কক্ষটাতে নির্জনতা জেঁকে ধরেছিল কয়েকটা মুহূর্ত, কেটে গেল সেটা ইজহান কন্যার ক্ষুর্ধাত কান্নার জোরে। উচাটন হয়ে ইজহান মেয়েকে তুলে দেয় ইস্মির কোলে। আগ্রহভরা স্বরে বলে, “ওর ক্ষিধে পেয়েছে, খাওয়াও ওকে।”
বলে বেশ আগ্রহ চিত্তে বসল ইজহান। যার মানে সে এখানেই আছে এবং বসে বসে মেয়ের খাওয়া দেখবে। স্বামী হলেও তার দিকে বিস্ফোরিত আর অসহায় নেত্রে তাকাল ইস্মি। সালেহা বেগমও লজ্জায় পড়ে মুখে আঁচল টানেন। পুনম অপ্রস্তুত অবস্থা কাটাতে বলল, “বাইরে যাও ভাইয়া, বেবি খাবে। তোমার এখানে কোনো কাজ নেই।”
ভ্রু কুঁচকে ফেলল ইজহান, “তার মানে আমার চেয়েও বেশি কাজ তোদের? বাপের চেয়েও ফুফু বেশি দরকারি?”
“এক্ষেত্রে অবশ্যই।”
“কেন?”
“ভাবিকে হেল্প করতে হবে, যেটা তুমি পারবে না। তাছাড়া ভাবিও লজ্জা পাবে। তুমি প্লিজ যাও…”
ইজহান সন্দেহ নিয়ে তাকাল, “আমাকে বের করে আমার মেয়ের খাবারে নজর দেওয়ার ধান্ধা! তোরা বেরু…”
কান গরম হয়ে উঠে ইস্মির। পুনম মেজাজ খারাপ করে ফেলে, “ভাইয়া তুমি খুব নির্লজ্জ!”
ক্ষ্যাপাটে কণ্ঠে বোনকে ধমক দিলো ইজহান, “মেয়ের খাওয়া দেখলে কেউ নির্লজ্জ হয়ে যায় না। এটুকুও জানিস না অথচ শারাফের মা হয়ে গেলি তুই? আশ্চর্য! না, আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকব আর মেয়ের খাওয়াও দেখব…”
“কী দিনকাল আইলো গো আল্লাহ! ছি ছি…”
বিড়বিড় করে বলল সালেহা বেগম। মুখে তার আঁচল চাপা। অথচ ইজহান স্পষ্ট শুনে ফেলল তা। কপালে ভাঁজ ফেলে একটু শক্ত গলায়ই বলল সে, “আপনি এরকম করছেন কেন? মেয়েকে সামলাতে পারেন না আবার ছি ছি হচ্ছে?”
বলে বিরক্ত চোখে ইস্মিতার দিকে তাকাল সে, স্বামীর বেলাজ আচরণে ইস্মিও হতাশ। লজ্জা বিসর্জন দিয়ে না হয় আধপাগল লোকটাকে ম্যানেজ করে মেয়েকে ফিডিং করাতো সে, কিন্তু নার্স, শ্বাশুড়ি, ননদ তো আছে! এরা তো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে। ইস্মি তাই শক্ত করেই বলল, “বাইরে যান।”
ইজহান শক্ত হয়ে বসে রইল, দৃঢ় স্বরে বলল,
অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৪
“যাব না, এখানেই থাকব।”
ক্ষিধের জ্বালায় মেয়ে কাঁদছে এদিকে লোকটা মেয়েদের মতো ঝগড়া আর জেদ করছে! ইস্মি না পেরে রুষ্ট গলায় ধমকে উঠল ইজহানকে, “আশ্চর্য! আপনি অবুঝ শিশু? দামড়া একটা লোক অথচ বাচ্চাদের মতো বিহেভ! যান বাইরে… ”
দামড়া, ইজহান শেখ দামড়া?