অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৬
ইসরাত জাহান ফারিয়া
আষাঢ়স্য দ্বিতীয় দিবসের সূচনা। ঝুমঝুম বৃষ্টিতে সকালটা ভিজলেও দুপুরের পর মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যটা উঁকিঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছিল। খরতৌপ্ত রোদ্দুর তেজ ছড়িয়ে নিজের ক্ষীপ্রতা জানান দিচ্ছিল পৃথিবীকে। এই মেঘ, এই বৃষ্টি, এই রোদ্দুর…ক্ষণে ক্ষণে রুপ পাল্টানো প্রকৃতি অবশ্য সেজেছেও বেশ! গাছের পাতা পানিতে ধুয়ে যেমন সজীব হয়ে উঠেছে, তেমনি ফুলে ফুলে ভরেও উঠেছে। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে বর্ষণমুখর দিনের মিষ্টি ফুলের সুগন্ধ!
ছেলে-মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে সদ্য একটু অবসর পাওয়া সৃজা বোনকে নিয়ে বসেছে প্রকৃতির রুপসুধা উপভোগ করতে। বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে, সাদা কভারে মোড়ানো বালিশে মাথা রেখে পাশাপাশি শুয়ে আছে দুই বোন। শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে তাদের বড়ো বারান্দাটা, যেটা এলিজার শখের ফুলগাছ দিয়ে ভর্তি; প্রতি বর্ষায় ওখানে শীতলপাটি বিছিয়ে দুই বোন দুপুর বিলাসে মগ্ন হতো! শুয়ে-বসে, বই পড়ে, বৃষ্টির ছাঁট গায়ে মেখে তারা ডুবে যেতো ছোটোবেলায়। যে দিনগুলোতে তাদের সঙ্গে মা ছিল, সুস্থ একটা বাবা ছিল! যেখানে চারটি মানুষের ভরপুর সুখে ভরা একটা সংসার ছিল! মায়ের সঙ্গে সৃজার স্মৃতি যেহেতু বেশি সেজন্য বেশিরভাগ গল্পই সে বলতো মা’কে নিয়ে। বোনের কোলে মাথা রেখে এলিজা বুকের ভেতর ভার জমাতো। এক পৃথিবী দুঃখ আড়াল করতো।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অথচ মাকে নিয়ে কারো কাছে বলার মতো অতো বেশি গল্প থাকতো না তার। এলিজার সব গল্প ছিল তার বাবা আর বোনকে নিয়ে, ফুপিকে নিয়ে। তবে আজ সেসব কিছু হচ্ছে না। দুই বোন পাশাপাশি, চুপচাপ শুয়ে আছে। সৃজার একটা হাত এলিজার চুলের ভাঁজে। বোনের এই রেশমের মতো কোমল চুলগুলো তার খুব পছন্দের। যখন চুলের ভাঁজে হাত রাখে, সৃজার মনে হয় তার মা-ই তার পাশে আছে। এলিজা সবসময় ওকে মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয় বলে সৃজার কাছে এলিজা সবসময়ই আলাদা একটা স্নেহ পেয়ে থাকে। শেখ বাড়িতে এলিজা প্রথমবারের মতো এসেছে। কিন্তু গতদিনটা আকিকার ব্যস্ততা এবং আচানক সব ঘটনার মধ্য দিয়ে এমন কেটেছে যে, বোনের সঙ্গে গল্প করার জন্য ফুরসত খুব একটা পায়নি সৃজা। বোনটা আবার না তার নিঃসঙ্গ অনুভব করে! এমনিতে মেয়েটা খুব কম প্রকাশ করতে চায় নিজেকে। সৃজা খেয়াল করল, এলিজা খুব মনোযোগ দিয়ে তেজ নিয়ে উঁকি দেওয়া সূর্যকে কালো মেঘগুলো কীভাবে বারবার ঢেকে ফেলার চেষ্টা করছে তা অবলোকন করছে। বোনের দিকে এককাত হয়ে শুয়ে সৃজা ধীর স্বরে বলে, “এলিজ,
কী দেখছিস? আকাশ?”
“হুঁ, দেখো কালো মেঘটা বারবার কেমন সূর্যটাকে ঢেকে দিচ্ছে! একটুও আলো ছড়াতে দিচ্ছে না। আমাদের জীবনটাও এমন অদ্ভুত, তাই না? যতবার ভাবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, সব ভালো হবে তখনি একটা না একটা কালো ছায়া এসে জীবনটাকে উলটপালট করে দিয়ে যায়! কী অদ্ভুত!”
উদাসীন কণ্ঠে উত্তর আসে এলিজার নিকট থেকে। সৃজা ওর কথার মানে ধরতে না পারলেও বোঝার চেষ্টা করে ঠিক কোন কারণে এলিজ এমনকিছু উপলব্ধি করেছে, যা করার কথা নয়! কিন্তু সে যথোপযুক্ত কারণটা ধরতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “এর উল্টোটাও তো হতে পারে এলিজ! যেমন আমার দুঃখ ভরা, শূন্য, কলঙ্কিত জীবনের সব কালি মুছে চাঁদ-তারা হয়ে তোর ভাইয়া, আমার বাচ্চারা এসেছে, তেমনি ভালো কিছু এসে কালো ছায়াটাকে দূরও করে দিতে পারে, তাই না?”
মেঘ-রোদের লুকোচুরি দেখায় মগ্ন এলিজা নিজের কাজটাতে ইস্তফা দিয়ে বোনের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। আগ্রহ নিয়ে শুধোয়, “এমন করে আমাদের বাবা-মায়েরা ফিরে এলেও তো পারতো আপু! আমরা একা একা বড়ো হতাম না।”
এলিজের হতাশার মমোর্থ বুঝে সৃজা কিছু বলার চেষ্টা করে তন্মধ্যেই। অথচ এলিজা মিষ্টি করে হাসে, আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে সৃজার হাত চেপে ধরে বলে, “ না না, আমি দুঃখ করছি না। তবে সত্যিই যদি তাঁরা ফিরতো, আমাদের শৈশবটা কতো রঙিন হতো বলো তো! অথচ বাস্তবতা এটাই যে, আমাদের জীবনটা আর আগের মতো হবে না। না হোক, তুমি খুব সুখী থেকো আপু! আমি সত্যিই চাই ভাইয়া আর তোমার জীবনের সব দুঃখ-যাতনা, কলঙ্ক, ভুল যা কিছু আছে তা যেন ফুল হয়ে আসে তোমাদের জীবনে।”
এলিজের বয়সটা কতো? আঠারো-উনিশের মাঝামাঝি। অথচ সৃজার চোখে এই মেয়েটা এখনো সেই আট-ন’বছরের বাচ্চা মেয়ে। মাকে ছাড়া যে রাতে ঘুমাতে পারতো না, মাকে ছাড়া অন্য কারো হাতে খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো না, একা একা ইউনিফর্ম পরতে পারতো না, চুল বাঁধতে পারতো না, হোমওয়ার্ক করতেও আলসেমি করতো, সেই বাচ্চা মেয়েটা মাতৃবিয়োগের পর বহুদিনের অসুস্থতা শেষে যখন সুস্থ হলো রাগ-জেদ-বায়না করা একদম ভুলে গেল মেয়েটা। নিজে নিজে ইউনিফর্ম পরতে, জুতোর ফিতে বাঁধতে, চুল বাঁধতে, হোমওয়ার্ক করতে শিখল, নিজের হাতে খেতে পর্যন্ত শিখে গেল! তবে একটা জিনিসই শিখতে পারল না, মাকে ছাড়া ঘুমানো। সৃজাকেই তাই মায়ের জায়গাটা নিতে হয়েছিল! বাবার অসুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে সংসার সামলাতে যেমন পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিল তেমনি ছোট্ট বোনটাকেও পাখির ছানার মতোন আগলে বড়ো করেছে। সৃজা আপ্লুত চোখে মিষ্টি করে হাসে এসব ভেবে। যে দিনগুলোতে তার দুঃখগুলো সুখ হয়ে উঠতো এলিজকে দেখে, সেই মেয়েটাই আজ তাকে সুখ-দুঃখের অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কী অদ্ভুত! বোন হয়েও সৃজা মাঝেমধ্যে গুলিয়ে ফেলে, কে বড়ো? সে, না এলিজ? আশ্চর্য!
আরসালান ইনজান শেখের সঙ্গে যেটুকু সাক্ষাৎ হয়েছে এবং নতুন করে তার আচরণ দেখছে তাতে আজিজ পুত্রকে বড়োই অদ্ভুত মনে হয়েছে সৃজার। এতগুলো দিন পর দেশ ও পরিবারের কাছে ফেরার পর মানুষ কতো স্বস্তি পায়! ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলোতেও তাদের আগ্রহ থাকে চরমে। অথচ এই যুবকের মধ্যে তিল পরিমাণ আগ্রহ দেখেনি সৃজা। লোকটার বাড়ি ফেরার আজ দ্বিতীয় দিন। গত রাতে ঘুমানোর পর সে না কি এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি।
অথচ এখন বাজছে বিকেল সাড়ে পাঁচটা; এমনকি আজ সে ঘুম থেকে উঠবে না এটাও না কি জানিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তার কুকুর কেমিকেও— ডিস্টার্ব করতে বারণ করেছে। ছোটো ছেলের অসুবিধা হতে পারে, সে রেগে যেতে পারে এই ঘোষণা দিয়ে বাড়ির সবাইকে সাফসাফ সতর্ক করে দিয়েছে আজিজ শেখ, “আমার জান’রে যে বিরক্ত করব, তারে পুকুরের পানিতে ভিজাই রাখা হইবে সারারাত! এইটাও আমার কথা না, আমার পুতের কথা!”
সিঁড়ি দিয়ে উঠারত অবস্থায় বাপের সতর্কবাণী কানে এসেছে ইহসানের। বাপ-ভাইয়ের নাটকে সে রীতিমতো বিক্ষুদ্ধ, বিরক্ত। ভেতরের দুশ্চিন্তা চেপে রাখতে না পেরে একটা সময় সে সিদ্ধান্ত নিলো সৃজাকে সাবধান করা দরকার! নয়তো হারামিটা যেকানো সময় কিছু করে ওর ক্ষতি করে দেবে। গতরাতেই তো মাতলামো করে মকবুলকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, সে বেচারা এখন কোমড় নিয়ে নড়তে পর্যন্ত পারছে না। বিষয়টা জানাজানি হতে দেয়নি ইহসান, কোনোমতে কাটিয়েছে। কারণ সৃজা যদি জেনে যায় তার ভাই একজন ড্রা গ এডিক্টেড তাহলে সে খুবই ছোটো হয়ে যাবে। ইহসান নিজের ভেতর কথাগুলো সাজাল ক্রন্দনরত মেয়েকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে।
আজওয়া ঘুমিয়ে পড়লে ওকে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ইহসান সৃজাকে নিয়ে বসল। পরপর দুটো ঢোক গিলে মুখস্তবিদ্যার মতো গড়গড় করে বলে দিলো, “সৃজা, শোন!
তোর কাছে যদিও ব্যাপারটা উদ্ভট লাগবে তবুও একটা বিষয়ে তোকে আমি সতর্ক করছি! ইনজান যদিও আমার ছোটোভাই হয়, তাও ওকে আমি ঠিকমতো বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি আজ অবধি। সেই প্রেক্ষিতেই তোকে সতর্ক করছি! ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবি সবসময়। আমার ভাই বলে সামান্য ফর্মালিটিও দেখানোর দরকার নেই ওকে, যেমনটা তুই ইজহানকে দেখাস। ওকে?”
ডায়াপারগুলো গুছিয়ে রাখা অবস্থায় স্বামীর আকস্মিক কান্ডে হতবিহ্বল সৃজা এবার নড়েচড়ে বসে, প্রশ্ন চোখে তাকায়। ইহসান দেরি করে না। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলে, “আমার ভাই হলেও সে বড্ড হিংসুক প্রজাতির ছেলে। অবশ্য হিংসুক বলা যায় না ওকে, হিংস্র বলা যায়! কারণ ওর কাজগুলোই পশুদের মতো। যে নিজের প্রবৃত্তি মেটানোর জন্য অনেককিছু করতে পারে। নিজের খেয়ালখুশি মতো। ওর স্বভাবে চেঞ্জ আনতে অনেক কসরত করেছি একটা সময়, কিন্তু ফলাফল বিগ জিরো! তাছাড়া
ওর সঙ্গে আমার বহু পুরোনো দ্বন্দ্ব আছে, যে দ্বন্দ্বে আমার জিনিস কেড়ে নিয়ে আমাকে ফতুর বানিয়ে ও মজা পায় কিন্তু দিন শেষে জিতি আমি। জিতেও হেরে যাওয়ার বিরোধ থেকেই হতে পারে ইনজান আমার জন্য, তোর জন্য এবং আমার বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকারক।”
সৃজা পলকহীন চেয়ে রয়। শোনে ওর কথা। তীক্ষ্ণ চোখদুটোতে অতি সহজেই ধরা পড়ে ভাইয়ের প্রতি ইহসানের রুষ্টতা। সঙ্গে দ্বিধান্বিত স্নেহও। অদ্ভুত লাগে সৃজার। কিন্তু বরাবরের মতোই প্রশ্নহীন সে মেনে নেয় ইহসানের কথা। কারণ গতরাত থেকে আজকের এই বিকেল পর্যন্ত সময়টাতে সৃজা লক্ষ্য করেছে, আরসালান ইনজান শেখ একজন অদ্ভুত যুবক! তার মধ্যে কেমন একটা উদাসীনতা আছে! আচরণে আছে কৌতুকপূর্ণ রেশ। সব ভাইদের মতো তার মধ্যেও আলাদা একটা বৈচিত্রতা টের পেয়েছে সৃজা! কিন্তু পুরোপুরি ধরতে পারেনি ব্যাপারটা। তবে লোকটার চাহনি যে বিশেষ সুবিধার নয় তা অতি সহজেই ধরা পড়েছে ওর চোখে! সৃজা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগে তার। আজিজ শেখের চার পুত্র চার বৈশিষ্ট্যের লোক। শুধু একটা জায়গাতেই তাদের মিল! সবগুলো ভাইই তারা সুদর্শন! তারা স্বভাবে অদ্ভুত। কারোর সঙ্গে কারোর স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই। তাদের মা আর শৈশব এরজন্য দায়ী সেটা জানে সৃজা। কিন্তু আরসালান শেখের সঙ্গে ইহসানের আলাদা করে কী নিয়ে দ্বন্দ্ব এটাই ভেবে পাচ্ছে না সৃজা। নয়তো কেন বলল, ইনজান শেখের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে? লোকটা কী সত্যিই ক্ষতিকারক তারজন্য? তার বাচ্চাদের জন্য?
বিকেলের শেষ, গোধূলির শুরু। একটা দিন হসপিটালে কাটিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরছে ইজহান শেখ। হসপিটালের গেইট থেকেই, শরীরটা বেশি ভালো নয় বলে বাবাকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে গেছে আকাশ। বলেছে, রাতে শেখ বাড়িতে যাবে সে বোন আর ভাগ্নিকে দেখার জন্য। কয়েকবার অবশ্য বলেওছিল ইস্মিকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু ইজহান দেয়নি। মেজাজ দেখিয়েছে খুব। সকালের ঐ ঘটনার পর থেকেই লোকটার মেজাজ খারাপ, বেশ বুঝেছে ইস্মি। তখন থেকেই লোকটা ওর সঙ্গে কথা বলছে না, যদিও সব কাজ করে দিচ্ছে। হাত ধরে নিয়ে এসেছে, কথাটাই যা বলছে না। কিন্তু উদগ্রীব নয়নে তাকিয়েছে অনেকবার, ইস্মি খেয়াল করেছে!
অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৫
মুক্তোর মতো চকচকে প্রাডো গাড়িটার পেছনের সিটে ইস্মিতা, পুনম, সালেহা বেগম। ড্রাইভ করছে মিজু। তার পাশে বসা ইজহান, কোলে তোয়ালের ভেতরে তার ছোট্ট মেয়ে। সেই কখন মেয়ে ‘পি’ করে তাকে ভিজিয়ে ফেলেছে অথচ মেয়েকে পরিষ্কার করালেও ইজহান তেমনি বসে আছে। টু শব্দও করছে না। লোকটার যা খুঁতখুঁত স্বভাব! ইস্মিতা অনেকবার বলেছে ওকে চেঞ্জ করতে, কিন্তু ইজহান শেখ তাতে গা করেনি। যে মেয়েকে সন্তান দেওয়ার পরেও সবার সামনে নিজের স্বামীকে ‘দামড়া’ বলতে পারে সে কতটুকু তাকে ভালোবাসে তা জানা হয়ে গেছে ইজহান শেখের!