অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৮
ইসরাত জাহান ফারিয়া
শেখ বাড়ির ছেলে দ্বারা তাঁর ভাইয়ের পরিবারে ঘটে যাওয়া নির্মম সত্যিগুলো জানেন নীল বেগম। আর জানেন বলেই এ বাড়িতে তিনি খুব একটা স্বস্তি যে পাচ্ছেন তা নয়। মনকে বহু বুঝ দিয়ে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করছিলেন, পারতপক্ষে আজিজ শেখ নামক স্বার্থপর লোকটার সামনেও পড়েননি! কিন্তু যখন থেকে এ বাড়িতে সেই খুনে ছেলেটার আগমন ঘটেছে তখন থেকেই তিনি উদগ্রীব! এখানে থাকলে প্রতিনিয়ত খু নীটার মুখদর্শন করতে হবে বলে তার মন একটুও সায় দিচ্ছে না এখানে থাকতে। কিন্তু ইহসানের মুখের দিকে চেয়েই তিনি রয়ে গেছেন।
ছেলেটা তো কম করেনি তাদের জন্য, নিজেও ভুগেছে ভাইয়ের জন্য! ছেলেটার অনুরোধ, আকুতির মাঝেও প্রবলভাবে তিনি বুঝতে পেরেছেন খু নে ভাইটার আগমনে ইহসান নিজেও কতোটা অস্থিরতা আর দোটানায় পড়েছে। তাছাড়া ইহসান আশ্বস্ত করেছে তাকে; সে থাকতে এ বাড়িতে তাদের কোনো সমস্যা হতে দেবে না ইনজানের দ্বারা!
নীলু বেগম সাদাসিধে মেয়েমানুষ। পার্থিব বিষয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই।
দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সাধ কেন যেন তার ঠিক আসে না; এরপরেও নিজের মৃত্যু কামনা করতে পারেন না তিনি। মরে গিয়ে নিজের না হয় একটা গতি হলো, কিন্তু ভাইয়ের রেখে যাওয়া মেয়ে দুটো? তারা যে একা হয়ে যাবে। তিনি ছাড়া দুকূলে তো আর কেউ নেই ওদের৷ তাই তো ওদেরকে একা করে রেখে যেতে তার বড্ড ভয় হয়! অবশ্য ইহসান যেভাবে তাদের উপর ছায়া হয়ে আছে, তাতে ওর হাতে সব গছিয়ে দিয়ে আজকাল মরতেও আপত্তি নেই নীলু বেগমের।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
চাপড়া চাপড়া অন্ধকার আর উত্তুরে হাওয়ায় একটা দুটো করে গাছগাছালির পাতা নড়ার দৃশ্যে মিশে আছে রাতের সৌন্দর্য। পাতা ঝরার শনশন আওয়াজে আদুরে হয়ে উঠা শান্য, শীতল আবহাওয়ায় শেখ বাড়ির প্রতিটা সদস্যই ঘুমে। একমাত্র ইহসান শেখ ছাড়া। সারাদিন বাচ্চা দুটোকে সামলানোর ফাঁকে মিনিট পাঁচেক সময় পেলেও সৃজা রেহমান যেখানে মরার মতো ঘুমিয়ে ক্লান্তি কাটানোর চেষ্টা করে, সেখানে নিজের রেস্তোরাঁ, ব্যবসা, বউয়ের নোট জোগাড় করা, বাজারসদাই করা থেকে শুরু করে বাড়িতে ফিরে ভাইয়ের সঙ্গে একদফা কথা-কাটাকাটি করা, বাচ্চাদের সামলানো এমন কোন কাজ নেই যেটা ইহসান সামলাচ্ছে না?
একা হাতে সব সামলাচ্ছে, কারো সাহায্য নিচ্ছে না, চাইছেও না। নিজের কর্মযজ্ঞ সামলেই যেখানে বেশিরভাগ পুরুষ ক্লান্ত হয়ে বাকি কাজের দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়, সেখানে এই লোকটার কী একটুও ক্লান্ত লাগে না? ইচ্ছে করে না পুরুষালি দেহটিকে একটুখানি বিশ্রাম দেই, পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও? না, ইহসান শেখ বিশ্রাম নেওয়ার মানুষ নয়। সে একটা রোবট, যাকে চালনা করতে চার্জেরও প্রয়োজন পড়ে না। নয়তো রাত তিনটায় ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে অন্য কেউ যেখানে ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতো, সেখানে এই লোক দিব্যি বারান্দায় বসে চায়ের কাপে ডুবে আছে, মেয়ে উঠে যদি কাঁদে এই শঙ্কা নিয়ে! ক্লান্তিতে চোখ লেগে আসায় টানা একচল্লিশ মিনিট ঘুমানোর পর সৃজা রেহমানের ঘুমটা যখন চায়ের কাপের টুংটাং শব্দে হালকা হলো, সেই থেকেই মেয়েটা দেখে যাচ্ছে নিজের একান্ত পুরুষটির খামখেয়ালি কর্মকাণ্ড।
যা প্রতি মুহূর্তে তার মনে বিরক্তির উদ্রেক করছে!
বিরক্তি নিয়েই শোয়া থেকে উঠে বসল সৃজা। এলোমেলো হয়ে পিঠের নিচে পড়ে থাকা চুলগুলোকে হাতখোঁপা করে এদিকওদিক খুঁজল তার পরণের ওড়নাটা। দেখল, ওড়নার একাংশ তার ছেলে আযরানের পিঠের নিচে চাপা পড়ে আছে। যেটাতে টান দিয়ে আনতে গেলে তার পাজি ছেলের ঘুম ভাঙবে নির্ঘাত। এরপর চিৎকার করে সে তার বোনের ঘুমটাও ভাঙাবে। সৃজার আচমকা বড্ড হাসি পেল, তার এই পাজি ছেলেটার কপালে না জানি কোন মেয়ে জুট্র! কিছু হলেই কেঁদেকুটে একসার হয়ে মা-বাবাকে যেভাবে জ্বালাচ্ছে তাতে সৃজা নিশ্চিত আযরান নিজের জীবন সঙ্গীকে তার বাপের মতোই জ্বালাবে! সৃজা ঘুমন্ত ছেলের কপালে আলতো একটা চুমু খেয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘অনেক বড়ো হও বাবা, মা তোমাকে অনেক বড়ো হতে দেখতে চাই।’
আজওয়াও হয়েছে ঠিক তার বাবার কার্বন কপি, এলিজা ঠিকই বলেছিল। দিনদিন বাবার মুখটাই নিজের মুখে বসিয়ে নিচ্ছে মেয়েটা, যেভাবে তাকায়… মাঝেমধ্যে সৃজার মনে হয় বাপের মতো এক্ষুনি
একটা ধমক দিয়ে বসবে তাকে!
গায়ে জড়ানো আকাশি রঙের সালোয়ার-কামিজের ওড়না না পেয়ে সৃজা চেয়ারের উপর থেকে একটা চাদর জড়িয়ে নিলো তার গায়ে। এরপর ল্যাম্পের আলোটা কমিয়ে ধীরপায়ে বারান্দার দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। বিয়ের পরবর্তী দিনগুলোতে এমন অনেক পূর্ণিমা রাতে দু’জনে বারান্দায় জোৎস্না বিলাস করেছে, গল্প করে কাটিয়েছে। রাত ভোর হওয়া দেখেছে, সকাল হতে দেখেছে…
একমনে বাইরের নিস্তব্ধ পরিবেশে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা থাকা স্বত্তেও সৃজার উপস্থিতিটা কেমন করে যেন টের পেয়ে গেল ইহসান, পেছনে না ফিরেই ওকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বলল, “ঠিক ঠিক একচল্লিশ মিনিট ঘুমানো দু-মাস বয়সী বাচ্চার মায়েদের হেলথের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। আযরানের মায়ের এখন ঘুমানো উচিৎ, বারান্দায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করা না। অ্যাম আই রাইট?”
ভাবনায় মত্ত সৃজা পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলো। জবাবে বলল, “ঘরে-বাইরে সামলে এসেও যে পুরুষ এক মিনিটের জন্যও চোখের পাতা এক করে না, তার এতো উপদেশ দেওয়া মানায়? আমার মতে তো না।”
অভিযোগ শুনে ম্লান হাসলো ইহসান। চট করে পেছনে ফিরে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দৃষ্টি স্থির করল সৃজার ঘুম ঘুম মুখটাতে। ভ্রু উঁচিয়ে শান্ত স্বরে
জিজ্ঞেস করল, “কী? স্বামীর জন্য মন পুড়ছে নাকি সৃজা রেহমানের?”
“মন থাকলে পুড়তেই পারে। তোমার মতো স্বামী যার আছে, তার মন তো পুড়তে বাধ্য।”
ইহসান হাত বাড়িয়ে টেনে এনে ওকে কাছে বসালো। ঘাড়ের উপর চিবুক রেখে দু’হাতে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ব্যগ্র স্বরে বলল, “মন পোড়া তো ভালো ব্যাপার না, কী করা যায়?”
“কিছুই করতে হবে না মহাশয়, আপনি গিয়ে পিঠটা একটু বিছানায় লাগান, কয়েক ঘন্টা চোখ দুটোকে বিশ্রাম দিন। আমার অশান্ত মনটাকে শান্ত করে দিন, তাতেই চলবে।”
“সম্ভব না, আমি শুলেই মেয়ে উঠে যাবে।”
“মেয়ের জন্য আমি আছি, তুমি যাও…”
“বেশি পাকামি না করে চুপচাপ গিয়ে এখন বিছানায় শোবি…আমার জন্য এত চিন্তা করতে হবে না।”
“আমাদের এতো যত্ন নিচ্ছ, খেয়াল রাখছ, টাইম মেইনটেইন করে খাবার খাওয়াচ্ছ, ঔষধ দিচ্ছ। কোনোকিছুতেই কমতি রাখছ না, কার্পণ্য করছ না। অথচ নিজে অসময়ে খাবার খাচ্ছ, শরীরের যত্ন নিচ্ছ না, ঘরে-বাইরে সবদিকে নজর! অন্যের প্রতি উদার হয়ে নিজের প্রতি দিনদিন বড্ড নিষ্ঠুর আর খামখেয়ালি হচ্ছ; অথচ আমি বাচ্চাদেরই দেখভাল করতে পারছি না! তোমার প্রতিও বড্ড বেখেয়ালি! আমার কি কষ্ট লাগে না তোমাকে এভাবে দেখলে? আমার বড্ড কষ্ট হয়। রাগও হয়। মনে হয়, আমি তোমার জীবনে একটা উটকো ঝামেলা বৈকি কিছুই নয়।”
সৃজার কণ্ঠস্বর অভিমানী হয়ে উঠল। নিজের অপারগতার জন্য যে রাগ সেটাও প্রকাশ পেয়ে গেল ওর কথায়। ইহসান ওকে আরেকটু আগলে নিয়ে একদম কোলেই তুলে ফেলল, গালের পাশে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, “আমার বাচ্চা পেটে ধরে, রাতদিন এক করে ওদের লালনপালন করে, সামলাতে গিয়ে তোর সুন্দর চোখদুটোর নিচে কালির ছাপ পড়েছে, গাল ভেঙেছে, শরীর ভেঙেছে। তোকে দেখে কেন যেন আমার অস্বস্তি বাড়ে, অপরাধবোধ বাড়ে। আমাকে বাবা বানাতে গিয়েই তো ঘুমহীন রাত কাটাচ্ছিস একের পর এক! এসবের পরেও তুই আমার বাগানের সবচেয়ে সুন্দর গোলাপ। যাকে এভাবে দেখে আমার হৃদয় জুড়ায়, চক্ষু শীতল হয়, সব না পাওয়া পাওয়া হতে দেখি। বিশ্বাস কর সৃজা, তুই আমার জীবনে আঁধার কেটে আসা একঝাঁক জোনাকির জ্বলজ্বলে আলো, যে আলোতে আমি আমার পৃথিবীকে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছি!”
নিজে থেকেই সৃজা ওর বুকের সাথে মিশে রইল অনেকটা ক্ষণ। বলল না আর কিছু। কআন পেতে চুপচাপ শুনতে লাগল মানুষটার হৃদস্পন্দন।
যা তার হৃদস্পন্দনকেও হার মানাচ্ছিল! ইহসান সৃজার পেলব গালদুটোতে আলতো করে চুমু বসাল। পরপর নাকের সাথে নাক ঠেকিয়ে ঠাট্টার সুরে বলল, “এই, আমাকে দেখ! আগের চেয়ে কেমন সুদর্শন হয়ে গেছি, ভুড়িও বোধহয় ইঞ্চি দুয়েক বেড়েছে। ভুড়ি কামানোর জন্য হলেও নিজের প্রতি একটু বেখেয়ালি হতেই হবে। হোই না একটু বেখেয়ালি, তাতে দোষের তো কিছু নেই…”
সৃজা ওর বুকে ঘুষি বসিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “একদম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবে না। অনেক বেশি চালাক তুমি!”
ইহসান ওর হাতদুটো মুঠোবন্দী করে বলে উঠল, “আমি চাই তুই আগের সৃজা হো, যাকে দেখে আমার মন মানতে বাধ্য হবে, এই মেয়েটাকে আমি সত্যিই ভালো রাখতে পারছি!”
কথাটাতে কী ছিল জানা নেই সৃজার, থেমে গিয়েও আচমকা গভীর স্বরে বলে উঠল, “আমাকে একটু শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরো তো, ইদানীং বাচ্চাদেরই আমার আদরের ভাগ দিয়ে দিচ্ছ! আমার কিন্তু বড্ড হিংসে হয় ইহসান শেখ!”
বলতে দেরি কিন্তু আদরে লিপ্ত হতে দেরি হয়নি ইহসান শেখের। উদাস বাতাসের আদরের চাদরে দু’জনে যখন গভীর প্রণয়ে উন্মত্ত; সেই সময়টাতেই হঠাৎ সৃজার চোখ পড়ল পুকুরঘাটে। একটা লম্বাটে লোক, মাথায় বোধহয় হ্যাট! ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামছে, হাতে সরু লাঠির মতো কিছু একটা নিয়ে।
সৃজার ভ্রু কুঁচকে গেল আচমকা। পরিচিত মনে হলো লোকটাকে। আলতো স্পর্শে, ফিসফিস কণ্ঠে ইহসানকে বলল, “ওটা আরসালান ভাইয়া না? অসময়ে ঘাটে কী করছে!”
নারিকেল পাতার শনশন আওয়াজে চারিদিকে তখন ভোর হবার ঘ্রাণ। চুলের ভাঁজে নাক ডুবিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলা ইহসান কথাটা শুনেই মাথা উঁচু করে তাকাল ঘাটের দিকে। দেখল তার অবাধ্য ও বেপরোয়া ছোটোভাইটি পুকুর ঘাটে নামছে। সঙ্গী করেছে তার কেমিকেও! একরাশ বিরক্তি
আর রাগ নিয়ে ইহসান তাকিয়ে রইল জানের দিকে। কেমিকে নিয়ে আরসালান পানিতে নেমেছে সাঁতার কাটতে! অথচ সাঁতার কাটছে কম, কেমিকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে বেশি। আবার মাঝেমধ্যে ঘাটে বসে বিরতিও নিচ্ছে। পরক্ষণেই নিজে লাফিয়ে পানিতে পরছে,
দেখাদেখি কেমিও। সরল মনের পোষ্য কুকুরটার প্রতি এই অমানবিকতা দেখে রাগ উঠে গেল ইহসানের। ইচ্ছে করল সামনে গিয়ে কষে চড় বসাতে ইতরটার দুই গালে। তাকিয়ে দেখল সৃজা অবাক হয়ে দেখছে ওর এই কান্ড। সে তৎক্ষনাৎ সৃজাকে নিয়ে ঘরে চলে এলো। সৃজা তখনো ঘোরে, বিহ্বল কণ্ঠে বলল,
“এটা কী ছিল?”
ইহসান পানি খেতে খেতে রাগমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলো, ”এটা ওর পাগলামো ছিল।”
“তাই বলে কেমিকেও? বাইরে কতো ঠান্ডা…”
“ও এসব বোঝে না, বুঝলেও গা করে না। আর এজন্যই ওর থেকে দূরে থাকতে বলি তোকে।”
সৃজা চিন্তিত স্বরে বলল, “ভাইয়ার তো ইমিডিয়েট কাউন্সেলিং প্রয়োজন!”
ইহসান স্পষ্ট জবাব দিলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল, “যে পাগল হয়েই জন্মেছে, তাকে কোনো কাউন্সেলিংই কাজে দেবে না।”
অতঃপর সৃজাকে ঘুমন্ত বাচ্চাদের কাছে রেখে ইহসান ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল কেমিকে উদ্ধার করে আনতে! মিনিট দশেক পর নিয়েও এলো কেমিকে, বারান্দায় নিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে পরিষ্কার স্থানে রাখল। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে লোমগুলো শুকিয়ে দিলো। বাটিতে করে বিস্কুট আর কেকও খেতে দিলো। কেমি একটুও জ্বালাল না। সারা বারান্দা ঘুরে ঘুরে বিস্কুট আর কেক খেল। মাঝেমাঝে ঘেউ ঘেউ স্বরে ডেকে উঠে নিজের মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও করল। সৃজা এসব দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে ইহসানকে বলল, “ভাইয়া ওকে আনতে দিলো?”
“না।”
“তাহলে? জোর করে আনলে?”
“অপশন ছিল না।”
আরসালান পুকুরঘাটের বসার জায়গাটায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি ভোরের ম্লান আকাশে নিবদ্ধ। কী দেখছে লোকটা জানা নেই সৃজার, কিন্তু তার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সৃজার বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
কামিনী গাছের ঝাড়! যেটার নিচে চার পুত্রের জন্মদাত্রী শায়িত! সেই স্থানে মেয়েটি দাঁড়িয়ে। ঠিক দাঁড়িয়ে নয়, মাঝেমধ্যে ছুটোছুটিও করছে পুনমের বাচ্চাদের সঙ্গে, কেমিকে নিয়ে। তারা হাসছে, খেলছে। ভেজা ঘাসের উপর থেকে ফুল কুড়াচ্ছে। অনেক ফুল, রাখার পর্যাপ্ত জায়গা নেই তাই মেয়েটি নিজের ওড়নায় কুর্চি ভরে নিচ্ছে। আরসালান ইনজান শেখ আলস্য ভরা দুপুরে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি পানরত অবস্থায় সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সেই লাল রঙা জামায় পা থেকে মাথা অবধি
জড়ানো মেয়েটিকে। কোমড় ছাড়ানো লম্বা খোলা চুল,
হাওয়ায় একটু একটু উড়ছে। বড্ড বিরক্ত করছিল বোধহয়! মাত্রাতিরিক্ত ফর্সা দুটো হাত তাদের শাসন করে বারবার গোলাপি আভা ছড়ানো কানের পৃষ্ঠে গুঁজে দিচ্ছিল। হাতের পৃষ্ঠ আর লম্বা আঙুলগুলো লাল রঙ দ্বারা রঞ্জিত। হাতদুটোও কী সুন্দর! ওমন সুন্দর হাত এর আগে কখনো দেখেছে কি না—আরসালান জানে না। তবে এর আগে সে এর আগে যা দেখেনি, আজ তা-ই দেখল! বাতাসের ঝাপটায় একটা মেয়ের মাথা থেকে ওড়না সরে গেলে, তার উপর গাছ থেকে শুভ্র রঙের ফুল ঝরে পড়লে, চোখ বন্ধ করে আলতো হেসে একটা মেয়ে ঠিক কীভাবে মস্তিষ্কের নিউরন অবধি কাঁপিয়ে দিতে পারে তা দেখল! বারান্দার রেলিংয়ে দু’হাত ভাঁজ করে সেখানে চিবুক রেখে বিবশ দৃষ্টিতে আরসালান ইনজান শেখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে গেল মেয়েটাকে। বহু বছর আগে এমন দেখতে একজনকে সে
মা বানাতে চেয়েছিল, মায়ের স্থান দিতে চেয়েছিল!
অথচ সেই নারীটি তার গালে থাপ্পড় মেরে তার ক্ষোভের শিকার হয়েছিল!
চারদিন হয়েছে ছোট্ট মা’কে তোয়ালেতে মুড়িয়ে বাড়ি ফিরেছে ইজহান। এ চারদিনে সে একবারের জন্যও বাড়ির বাইরে বেরুয়নি। সব কাজ সে বাড়িতে বসেই করেছে, বাকিসব মিজুর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। আপাতত তার দিন কাটছে বাচ্চাদের নিয়েই। তবে ইস্মিতার সঙ্গে এখনো একটা নীরব যুদ্ধ চলছে তার, ঠিকঠাক কথা বলছে না এখনো। ইস্মি যদিও চেষ্টা করছে, তবুও ইজহান এমন করছে। এমনটা করছে সে তার মনের কথায়। মন তাকে বলেছে এমন করলে বউয়ের অ্যাটেনশন পাওয়া যাবে। ছোট্ট মেয়ে পেয়ে বউয়ের মনে এমনিতেই একজন ভাগ বসিয়েছে,
ভারসাম্য বজায় রাখতে একটু নাটক করলে ক্ষতির তো কিছু নেই। এমনিতেও মেয়েকে সে অনেক ভালোবাসা দিচ্ছে! এতেও আবার মন খচখচ করে তার। বউয়ের ভালোবাসা পাওয়ার আশায় তার ছোট্ট মা টাকে আবার কম ভালোবাসছে না তো? ইজহান শেখের তাই মনে শান্তি নেই। মনের শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে আজওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নাম খুঁজছে সে, কিন্তু একটা নামও তার পছন্দ হচ্ছে না। তার এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের কথা শুনে মকবুল বলেছে, “স্যার আফনে আফনের মাইয়ার নামও যাতে ভাবিজানের নামে রাইখা দিন। এতো কনপিউশনের কিছু নাই। ভাবিজানের নামটা সুন্দর!
অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৭
মকবুলের প্রস্তাবটা মনে ধরেছিল ইজহানের, কিন্তু ইস্মিতাকে এই কথাটা বলার পর সে ভয়ংকর একটা ধমক খেয়েছে। তাকে আর মকবুলকে বোকার হদ্দ, গাধার গাধা বলেছে ইস্মিতা!