অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৯

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৯
ইসরাত জাহান ফারিয়া

সাড়ে নয়মাসের প্রেগ্ন্যাসি জার্নি শেষ হওয়ার পর মেয়েকে আগলে রাখাই ইস্মির প্রধান কাজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খাওয়ানোর সময়টা বাদে মেয়েকে সে কাছেই পাচ্ছে না৷ কারণ সব কাজ শিকেয় তুলে তার গুণধর স্বামী ইজহান শেখ সারাক্ষণ মেয়ে নিয়ে পড়ে আছে, টনা-মনার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। নামেমাত্র অফিসের কাজ দেখছে। ইস্মির তেমন কোনোকিছুই করতে হচ্ছে না। তবে গত কয়েকটা দিন যাবৎ ইজহানের সঙ্গে তার ছোটখাটো মান-অভিমানের খেলাটা যেন কাটছেই না। লোকটা অহেতুক কারণে যেমন রাগ করে, তেমনি বোকাবোকা কথা বলে, জেদ করে পরিস্থিতি আরো নাগালের বাইরে নিয়ে যায়।

না চাইতেও ইস্মি তখন একটু আকটু তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে, যেটা ইজহানের একদম পছন্দ নয়। অথচ রাতেও মেয়ের নাম রাখা নিয়েও ইস্মি ধমক দিয়েছে ওকে। রাগ দেখিয়ে একা একা ঘুমিয়েও পড়েছে। কয়েকবার মেয়েকে উঠে যখন খাইয়েছে তখন খেয়াল করেছে ইজহান ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। সারারাত মেয়েকে পাহারা দিয়েছে আর নিজে জমিয়ে রাখা কাজ দেখেছে। ইস্মি অতোটা পাত্তা দেয়নি ওকে। মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ওর মনোযোগ না পেয়ে ইজহান অবশ্য কিছুই বলেনি। মেয়েকে খাইয়ে ইস্মি যখন শুয়ে পড়ল আবার, সে-ও এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। তবে ইস্মির পাশে নয়, ওর পায়ের নিচে। কিছু বলবে ভেবেও ইস্মি আর বলেনি। কী দরকার, এতো রাতে লোকটাকে ঘাঁটানোর? সুযোগ পেলেই তো এখন আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে উঠবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সেজন্য কিছু না বলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একটানা ঘুমিয়ে একেবারে সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ইস্মির খেয়াল হলো রাতে অভিমান করে তার পায়ের নিচে শোয়ার পর এখনো লম্বা-চওড়া শরীরটা নিয়ে একটুখানি জায়গার মধ্যে ইজহান গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। নিষ্পাপ মুখশ্রীটা দেখেই ইস্মির মায়া হলো। মনে হলো লোকটাকে রাতে এভাবে না ধমকালেও সে পারতো। এমনিতে সারাক্ষণ খ্যাকখ্যাক করলে কী হবে কথা বলার তো এতোকিছু ভেবে বলে না; যা মনে আসে তা-ই বলে ফেলে! তবে গত রাতের ঝামেলার জন্য ইজহানকেও পুরোপুরি দোষারোপ করা যায় না। মেয়ে রাতে খেতে গিয়ে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিল, খাচ্ছিল না ঠিকঠাক।

কেঁদেকুটে অবস্থা খারাপ করে ফেলছিল। সেজন্যই মূলত মন মেজাজ ভালো ছিল না ইস্মর। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাশে তাকিয়ে মেয়েকে একবার দেখে নিয়ে ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমু খেতেই হঠাৎ মেয়ের পায়ের দিকে নজর যেতেই চমকে উঠল সে। কতক্ষণ হতভম্ব হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে ইজহানের আঙুলের সঙ্গে মেয়ের পায়ে আটকানো সরু বেল্টটা ছাড়িয়ে নিলো। মেয়ে উঠে কাঁদলে যাতে চট করেই উঠে যেতে পারে তারজন্য এই ব্যবস্থা, আর এই উদ্ভট ব্যবস্থাটা কে করেছে? মেয়ের পিতা মহামান্য ইজহান শেখ! রাগের সঙ্গে সঙ্গে ইস্মির পেট মুচড়ে হাসিও পেল। কিন্তু সে হাসলো না।সাবধানে, ধীরেধীরে একটুখানি সরে গিয়ে ইজহানের দুটো হাতের ভাঁজ সরিয়ে ওর বুকের মাঝখানে ঢুকে চুপচাপ ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইল।

পরিচিত স্পর্শ, সুবাস নাকে ঠেকতেই ঘুমের মধ্যেও নড়েচড়ে উঠল ইজহান। হাত নাড়তে গিয়ে টের পেল সেটাকে আবদ্ধ করে কেউ তার বুকের উপর ঘাপ্টি মেরে শুয়ে আছে। সটান চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখল, তার নির্দয় রানি তার বুকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। গত রাতে তাকে আজেবাজে বকে যে কষ্ট দিয়েছে ইস্মিতা; সেই কষ্টের পাহাড় না ভেঙেই কাছাকাছি এসে শুয়েছে? বড্ড বাড় বেড়েছে এই মহিলার। বেশি আদর দিয়ে সে নিজেই মাথায় তুলেছে, এখন মাথা থেকে নামাতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ! নির্দয় মহিলার গ্রীবা দেশে কতক্ষণ নিজের সুখ রচনা করে আচমকাই তার ওষ্ঠাধর নিজের ঠোঁট দ্বারা চেপে ধরল ইজহান, একটুও শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিলো না মেয়েটাকে। ঘুমের ভান ধরে স্বামীর মান ভাঙানোর পায়তারা করা ইস্মি প্রথমে ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই হাঁপিয়ে উঠে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পুরুষালি শক্তির সঙ্গে একটুও পেরে উঠল না সে। না পেরে ইস্মি যখন ইজহান শেখের চুলগুলো মুঠোবন্দী করে টেনে ধরল, নির্দয় মহিলাকে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলল সে বিছানাতে। এরপর উল্টোপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ক্রোধভরা কণ্ঠে বলল, “কাছে আসবি না।”

ইস্মি না শোনার ভান করে এবারে ওর পিঠের উপর আধশোয়া হয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল ওকে। অপরাধী কণ্ঠে বলল, “গতরাতে একটু বেশিই ধমকে ফেলেছি আপনাকে। এমন ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। আসলে মেয়ে খাচ্ছিল না তো, আমার খুব হতাশ লাগছিল! ভুল হয়েছে, আর হবে না।”
“দূরে সর।”
“সরব না।”
ইজহান চটে গেল, “কী বলেছি কানে যায়নি, না? দূরে সর, সরতে বলছি তো না কি!”
“বললাম তো আর হবে না। মাফ করে দিন না!”

ইজহান ক্ষ্যাপা সিংহের ন্যায় বিছানায় উঠে বসল। তার চোখ দিয়ে রাগের আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। আক্রোশ ভরা কণ্ঠে বলল, “এই মহিলা, তুই কী ভাবিস আমাকে? পথের কুকুর? তোর জন্য পথে পথে, জনে জনে ধর্ণা দিয়ে বেড়ানো ফকির? তোর প্রেমে মজনু আমি? দেবদাস? হ্যাঁ? শক্ত কথা দিয়ে আমার বুকটা চিঁড়ে ফেলবি এরপর ন্যাকামি করে মাফ চাইবি আর ভাববি আমি বারবার তোকে মাফ করব? গদগদ হয়ে তোর আঁচল ধরে ঘুরব? এতোটা ছাগল মনে হয় তোর আমাকে? এতোটা গুরুত্বহীন আমি? যা গুরুত্বহীনই। আমি অমনই। পাল্টাব না। সারাজীবন এমনি থাকব। এবার যা, ভেবেচিন্তে কথা বলা, মেয়ের খাওয়া দেখতে না চাওয়া, বউয়ের নামে মেয়ের নাম রাখতে না চাওয়া কোনো বুদ্ধিমান, ব্যক্তিত্বওয়ালা পুরুষ মানুষ খুঁজে নে গিয়ে। আমার আর মেয়ের ধারেকাছেও ঘেঁষবি না। তুই আমার মেয়ের মা না।”

ইস্মির বুক কাঁপছে! ভাবেনি ইজহান এতোটা জোরে ধমক দেবে। এভাবে কথা বলবে। প্রথমে ওর ভীষণ অভিমান হচ্ছিল, কিন্তু শেষ কথাগুলো যখন শুনল তখন ও হতভম্ব হয়ে গেল। চোখ ছাপিয়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া অশ্রুধারা লুকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, “আসলে লোকে ঠিকই বলে, কিছু কিছু মানুষ কখনো পাল্টায় না, তারা পাল্টানোর ভান করে। যখন বুঝে যায় কেউ তাকে ভালোবাসে, তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তখন সুযোগ বুঝে ছুঁড়ে ফেলে।”
ইজহান হতবাক চোখে চেয়ে রইল। কেমন যেন মাথাটা একটু ঘুরে উঠল তার। ঘাড়ের পেছনে একহাত দিয়ে মালিশ করতে করতে খানিকটা এগিয়ে এলো ইস্মির দিকে। ব্যগ্র কণ্ঠে বলল, “কী বুঝাতে চাইছ? আমি এমন কী বললাম?”
“পেটে ধরলেই মায়ের অধিকার পাওয়া যায় না; সব সয়ে ঘর করলেই স্ত্রীর মর্যাদা পাওয়া যায় না। চিন্তা নেই, আপনার বা আপনার মেয়ের কাছে আমি ঘেঁষব না, একটুও জ্বালাব না, ছুঁব না!”

কাঠখোট্টা কণ্ঠে কথাগুলো বলে ইস্মি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেটা দেখে ইজহান একটা কাচের গ্লাস মেঝেতে আছাড় মারতেই সেটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেল। সেই শব্দে ইজহান শেখের ছোট্ট মা ভয় পেয়ে অস্ফুটস্বরে শব্দ করতেই ইজহান তাকিয়ে দেখল, মেয়ে জেগে গেছে। এই মুহূর্তে তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। ইজহান চট করে মেয়ের কাছে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “তুমি কি ভয় পেয়েছ মা?”

পিতার কথা শুনে মেয়ে এবার ভ্রু কুঁচকে নিলো, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে নিজের একটা হাত নাড়াল। ইজহানের মনে হলো মেয়ে তাকে বলছে, ‘সে ভয় পেয়েছে।’ একটা খারাপ লাগা অনুভূতি কাজ করল তার মনের মাঝে। ঢোক গিলে বলল, “ইস্মিতা দায়ী এসবের জন্য, আমার দোষ নেই। আমি তো ভালোই থাকতে চাই, তোমার মা কীসব করে যেন আমাকে রাগিয়ে দেয়। আমি পারি না নিজেকে সামলাতে আম্মাজান, কিছুতেই পারি না।”
মেয়ে আগের মতোই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিতে বিস্ময়। ইজহান প্রথম দিনের মতো লজ্জা পায়। ফিসফিস করে বলে, “ইস্মিতা খুব খারাপ, তোমার পাপাকে ভালোবাসে না। কথায় কথায় অপমান করে, আঘাত করে। ওর কাছে ঘেঁষো না তুমি। কোলেও উঠো না। পাপা আছি তো এসবের জন্য। তোমাকে কোলে নেব, ঘুম পাড়াব, খাওয়াব, আর খুব খুব ভালোবাসব। নিজের থেকেও বেশি।”

বলতে বলতে ঝুঁকে বসে মেয়েকে কোলে নিতে গেল সে, কিন্তু তুলতেই গলা ফাটিয়ে কান্না জুড়ে দিলো মেয়ে। ইজহান চমকে উঠে মেয়েকে বুকের ভেতররই ঢুকিয়ে ফেলে পারলে! কিন্তু মেয়ের কান্না তাতে আরো বেড়ে গেল। কী করবে বুঝতে না পেরে ইজহান বাধ্য হয়ে মেয়েকে আগের জায়গায় শুইয়ে দিলো, তাতে অবশ্য লাভ হলো। মেয়ের চিৎকার থামলো। হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে কাঁদল, আগের চেয়ে কম। ইজহান স্বস্তির শ্বাস ফেললেও টের পেল তার বুক ধকধক করছে৷ গা ঘামছে। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে। হাতের পৃষ্ঠ দ্বারা সে তার কপাল মুছে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসল। মেয়ের কান্নাকাটি দেখতে দেখতে বিড়বিড় করে বলল, “কাঁদুনি পুতুল!”

গত তিনদিন ধরে সৃজা আরসালানকে লক্ষ্য করছে। অবশ্য ইচ্ছে করে যে করছে তা নয়। না চাইতেও তার সামনে এমনসব কান্ড ঘটছে যে আরসালানের কর্মকান্ডের প্রতি সে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। যেমন, এই নিয়ে তিনদিন সে রাত্রিবেলা বারান্দায় গেলেই দেখেছে পুকুরপাড়ে একটা না একটা অদ্ভুত কান্ড করছে শেখ বাড়ির ছোটো পুত্র। প্রথমদিন কেমিকে নিয়ে সুইমিং করলেও পরেরদিন করেছে ফিশিং আর বারবিকিউ পার্টি। যেটা সে একা একাই করেছে কেমিকে সঙ্গী করে। তৃতীয় দিন টেন্ট বসিয়েছে। দুটো নারকেল গাছকে ভিত্তি করে হেমক লাগিয়ে সেখানে শুয়ে রাত পার করেছে।

চতুর্থদিন পাড়ে একশো একটা জারুল গাছের চারা এনে লাগিয়েছে। লাগিয়েছে লাগাক। কিন্তু তাই বলে এমন একটা সময়ে? যেখানে রাতের শেষ আর দিনের শুরুই হয়নি? ইহসান যত যাই বলুক, ভাইয়ের মতোই দেখেছে সৃজা ওকে। সে হিসেবে কেন যেন সৃজার মায়া জন্মেছে আরসালানের প্রতি। মনে হয়, লোকটা আসলেই খুব একা। আর একাকিত্ব থেকেই তার এই অবস্থা! বাড়ি ভর্তি এত এত মানুষ, কে নেই? মা। তাছাড়া তো ভাই-বোন, বাবা…সবাই আছে। এরপরেও লোকটা নিজের ঘরেই পড়ে থাকে বেশিরভাগ সময়। খাবারটাও সময়মত খায় না, ডাইনিংয়ে বসে খায় না, কারো সঙ্গে তেমন কথাও বলে না।

সারাক্ষণ যেন ঢুলে, রাতেই একটু স্বাভাবিক দেখা যায়। যতবার খাবার খেতে দেখেছে ততবার ইমরানকে দেখেছে ওকে ভাত মেখে খাওয়াচ্ছে। মেঝো ভাইয়ের হাতে বেশ তৃপ্তি নিয়েই যেন খায় লোকটা। আরো যা চোখে পড়েছে তা হলো, প্রথম কয়েকদিন বেশিরভাগ সময় কেমিকে নিজের ঘরেই আটকে রাখতো, ততোটা বের হতে দিতো না। কিন্তু গত দু’দিন ধরে কেমিকে সে বের হতে দিচ্ছে। বলে দিয়েছে যে, তার কেমিকে যাতে কেউ টাচ না করে। এরপরও নিজেদের সামলাতে না পেরে এলিজা, শারাফ আর চাকরের ছেলেটা ধরেছিল। আশ্চর্যজনক ভাবে ঐ ছেলেটাকে উত্তম-মধ্যম দিলেও শারাফ, এলিজাকে কিছুই বলেনি লোকটা। সেজন্য সৃজার ধারণা, আরসালানের মানসিক অবস্থাটা খুব গুরুতর। অতিসত্ত্বর চিকিৎকের শরণাপন্ন না হলে শোচনীয় অবস্থা হতে পারে। তবে আজিজ পুত্র যে খুব খারাপ তাও না। একই সাথে ভালো, খারাপ দুটো গুণই আছে। তবে খারাপটাই বেশি। যেটা তার দু-একটা ভালো কাজকে ঢেকে দেয়! এসবে অবশ্য সৃজা ইহসানের সতর্ক বার্তা ভুলে যায়নি। সে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলে আরসালানের কাছ থেকে।

তবে আরসালানের এই উচ্চ অহংকারী বা অদ্ভুত স্বভাব এ বাড়িতে একজনের বিরক্তির কারণ হচ্ছে। সে হলো ইমরানের স্ত্রী মিতু। সামনাসামনি কিছু বলতে না পারলেও রান্নাঘরে এসে সে তার ক্ষোভ ঝাড়ে। কেন তার স্বামীর হাতে খাবে আরসালান শেখ? তার কি হাত-পা নেই? যথেষ্ট আছে। অথচ সেসব তো কাজে লাগায়ই না, উল্টো পরে পরে ঘুমায় সারাদিন। যত্তসব বিগড়ে যাওয়া লোক। তার স্বামীকেই পেয়েছে৷ আহারে তার সরল সিধা স্বামী! মুখফুটে বাপ, ভাইদের কিছু বলে না দেখে তাকেই পেয়ে বসেছে। মিতু অবশ্য আরেকজনের উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না। সে হলো এলিজা। তার বোন লিথু যখন এ বাড়িতে আসতো তখন যেন সবার মুখে ছাই পড়তো। আর বড়ো বউয়ের বোন এসেছে; সুন্দরী, মিষ্টভাষী দেখে মেয়েটাকে সবাই কত গদগদ করছে। এলিজা, এলিজা বলে চাকর-বাকররাও তাকে মান দিচ্ছে। আর বোবা বড়ো বউ ইস্মির ভাই আকাশ! সেও এ বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু করেছে ভাগ্নিকে দেখবে বলে। সে এলেও সবার কঈ খুশি!পুনমের ছেলেদুটো তো হৈ হৈ করছে রীতিমতো! যা দেখে আরো গা জ্বলে মিতুর, ইচ্ছে করে দুটোর গালেই থাপ্পড় বসিয়ে দিতে।

এদিকে বিয়ের এতদিন পরেও তাদের কেন বাচ্চা নেই? সে কি বাজা নাকি? বড়ো দুই বউ বাড়িতে বাচ্চা দিয়ে তো রানি বনে গেছে, আর মিতু হয়েছে চাকরানি। এটা গতরাতে ঝগড়ার সময় ইমরান বলেছে। যে ইমরান বিয়ের এতদিনেও মুখফুটে ‘টু’ শব্দটাও করেনি তার সঙ্গে, সে আজকাল বাচ্চা চাই বলে বলে ওর মাথা খেয়ে দিচ্ছে! মিতুর মনে হচ্ছে এ বাড়িতে শুধুমাত্র সে-ই একা পড়ে গেছে। সব তার শত্রু, বিশেষ করে বড়ো বউ সৃজা। বরের ভালোবাসায় যেন মাটিতে পা-ই পড়ে না। এই মেয়ের জন্যই তার বাপের বাড়ির কেউ এ বাড়িতে আগের মতো আসতে পারে না। আর
ওদিকে তার বোনটা? তপনটাকে বিয়ে করে ডিভোর্স দিয়ে, এখন জেলের ভাত খাওয়াচ্ছে পেটে আড়াই মাসের একটা বাচ্চা নিয়ে! রাগে-হিংসায় রীতিমতো গা জ্বলে মিতুর আজিজ পুত্রদের এত্ত সুখ দেখে।

সেই তখন ঘর থেকে বের হওয়ার পরে ইস্মি আর ঘরেই আসেনি। মেয়েটার সঙ্গে যে খুব ভালো কিছু করেনি তা বুঝতে পেরেই ইজহানের নিজের উপর বেশ রাগ হলো। কেন বলল সে এসব অবান্তর, অযৌক্তিক কথা? কেন বলল, ইস্মিতা তার মেয়ের মা না? তাদের কাছে যেন সে না ঘেঁষে? সে কেন এত কষ্ট দেয় ইস্মিতাকে? এসব ভেবে মাথা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় ইজহানের। নিজের উপর তিক্ততা আর অপরাধবোধ থেকেই সে মেয়ের দিকে নজর দেয়। মেয়ে তখন শুকনো মুখে, ক্ষিধে নিয়ে ছটফট করে জানান দিচ্ছে তার এখন মাকে প্রয়োজন, পাপাকে না। মেয়ের দৃষ্টির মমার্থ এমনই ভেবে নিয়েছে ইজহান।

আর তাইতো সে মেয়ের কোমল, ছোট্ট পা দুটো ধরে অনেকবার ক্ষমাও চেয়েছে। কিন্তু মেয়ে তাকে ক্ষমা করেছে কি না সে বোঝেনি। তবে মেয়েকে তার বুকের দিকে বারবার মুখ গুঁজতে দেখে লজ্জার সঙ্গে সঙ্গে এটাও টের পেল, সন্তানের থেকে মাকে কেন দূরে রাখা অনুচিৎ! অতঃপর মেয়েকে নিয়েই সে খুঁজতে বেরিয়েছে ইস্মিকে। পেয়েছে রান্নাঘরে। সালেহা বেগমের সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করছে। যেদিন থেকে ইজহান জেনেছে ইস্মিতার গর্ভে তার একটা প্রতিদ্বন্দ্বী লালিত হচ্ছে, সেদিন থেকেই তার রান্না, কাজকর্ম সব বন্ধ। ইস্মির রান্না ছাড়া যে ইজহানের মুখে ভাত রুচতো না সে স্ত্রীর গর্ভাবস্থার পুরো সময়টা অন্যের হাতের রান্না খেয়ে কাটিয়েছে।

তবে অন্যের হাতের রান্না খেয়ে যে তার পোষাচ্ছে না, সেটা ইস্মি ঠিকই বুঝতে পারতো। তাই মাঝেমধ্যে ইজহানের অনুপস্থিতি সে নানাপদ রান্না করে রাখতো, খাওয়ার সময় চেনা স্বাদ পেয়ে সন্দেহী চোখে ইজহান তাকাতো ওর দিকে, প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতো। কিন্তু ইস্মি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে বা বুঝতে দিতো না এসব সে রেঁধেছে। তাই এই গোপনীয় তথ্যটি এখনো অজানা ইজহানের। প্রেগ্ন্যাসি জার্নির শেষে এই প্রথম ইস্মিতা রান্না ঘরে ঢুকেছে। তাও আবার তার অবাধ্য হয়ে। রাগ হলেও মেয়ের স্বার্থে ইজহান তা প্রকাশ করল না। বরংচ মেয়েকে নিয়ে বউয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল, কাশি দিয়েও দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। কিন্তু ইস্মি তাকাল না। একমনে রুটি বেলতে আর সেঁকতে লাগল। যেন স্বামী-সন্তানের চেয়েও তার কাছে এই কাজটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ!

শেখ বাড়ির দোতলাটা বহু বছর আগে আজিজ শেখ ছেড়ে দিয়েছেন তার সন্তানদের জন্য। লম্বা করিডোরের দখিনে থাকা ঘরটা ছিল তার প্রিয়তমা স্ত্রী, তার চার সন্তানের মা এমিলি ইয়াসমিনের; যেটা এখন ইহসানের। আর তার বিপরীতে থাকা ঘরটা হলো ইজহানের শোয়ার ঘর। আরেকটা বড়ো ঘর অবশ্য আছে, একেবারে শেষ মাথায়। সেটা আরসালান ইনজান শেখের। যেটাতে কারো যাওয়ার অনুমতি নেই। এমনকি পুনমের নিজস্ব ঘরটাও দোতলায় অবস্থিত। বলতে গেলে ইমরান-মিতু, আজিজ শেখ, আর গেস্টরুমগুলো ছাড়া সকলের ঘরই দোতলায় অবস্থিত। বহুদিন বিদেশে অবস্থান করা আরসালানের ঘরটা এতোদিন লক করা ছিল, সেই সঙ্গে বিয়ের পর বাবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করা পুনমের ঘরটাও।

সপ্তাহান্তে চাকর দিয়ে ঘরদুটো পরিষ্কার করে রাখতেন আজিজ শেখ। তবে এখন যেহেতু ছেলে-মেয়ে বাড়ি এসেছে তাই তাদের ঘর খোলা হয়েছে। এদিকে বাড়িতে আসার পর পুনম বাড়ির সবার সঙ্গে মিলেমিশে, আনন্দ করে কাটালেও রাতটা থাকে সালেহা বেগমের সঙ্গে। আজিজ শেখ নিজেই অবশ্য সালেহা বেগমকে অনুমতি দিয়েছেন মেয়ের সঙ্গে থাকতে। দুটো ছোট বাচ্চা সামলানো তো আর মুখের কথা না। যদিও শারাফ যথেষ্ট ভদ্র, দুষ্টু বাচ্চা না। তবে শামির একটু চঞ্চল। আর রাত হলেই বেশি জ্বালায় মাকে। তাই পুনম মাকে নিয়েই থাকে সাথে। রাতে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে মা-মেয়েতে মিলে সুখ-দুঃখের গল্প করে কাটায়। পুনমের পাশের ঘরটাতে থাকছে নীলু বেগম আর এলিজা।

গত রাতে তাদের সঙ্গে শুয়েছে শারাফ। কারণ এলিজা আন্টির সঙ্গ সে খুবই উপভোগ করছে। দু’জনে মিলে রাতে-‘দ্যা জঙ্গল বুক’ মুভি দেখেছে। এবং প্ল্যান করেছে আজকের দিনে তারা কী কী করে কাটাবে সেসব! ঘুম থেকে উঠতে পারেনি সে সকালে, এলিজা আন্টি ডেকে দিয়েছে ওকে, নিজ হাতে ফ্রেশও করিয়ে দিয়েছে, ফিডারও বানিয়ে খাইয়েছে। নীলু ফুপিকে বলতে শুনেছে এখন সাড়ে দশটা বাজে। এলিজা আন্টির ঘর থেকে মায়ের ঘরে যেতে গিয়ে দেখল, ইজু মামা বোনকে কোলে নিয়ে করিডোরে পায়চারি করছে। বোন কাঁদছে। অথচ মামা তাকে শান্ত করাতে পারছে না। শারাফের ভ্রু কুঁচকে এলো। ছোটো বাচ্চাদের কান্না একদম ভালো লাগে না, কেমন যেন কষ্ট হয় তার। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে সান মামার মেয়ে আজওয়া কাঁদলে।

ঐ মেয়েটা বেশি কাঁদে। আযরানও বেশি কাঁদে। শামিরের থেকেও বেশি। তবে সে খেয়াল করেছে আজওয়ার সঙ্গে টয়’স নিয়ে খেলা করলে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেও হেসে ফেলে, হাসলে আবার ওর দুই গালে দুটো গর্ত হয়। দেখতে কী সুন্দর! মাম্মা বলেছে এটাকে টোল বলে, ইংরেজিতে ডিম্পল! শারাফ মিলিয়ে একটা নামও রেখেছে আজওয়ার—টোল বতী। এই নামটা রাখতে ওকে হেল্প করেছে ওর পাপা। ইজু মামার মেয়েও সুন্দর, ওর চোখের পাপড়ি ঘন। শারাফ তারও একটা নাম রেখেছে, পাপড়! পাপড়কে সে বোন হিসেবে মেনে নিয়েছে, কিন্তু টোল বতীকে না। বোন হিসেবে পছন্দ নয় তার আজওয়াকে, বরংচ খেলার সাথী হিসেবেই বেশি পছন্দ! শারাফ গুটিগুটি পায়ে ইজু মামার দিকে এগিয়ে গেল। ইজহান তখনো ওকে খেয়াল করেনি, শারাফ ওর পরণের প্যান্ট টেনে ধরে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলল। দুশ্চিন্তার মাঝেও এই মিষ্টি বাচ্চাটাকে দেখে ইজহানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। বলল,

“কী রে ব্যাটা, এত সকালে কোথা থেকে এলি?”
“এলিজ আন্টির ঘর থেকে।”
“ওহ! রাতে ঘুম হয়েছে ঠিকঠাক?”
“হয়েছে।”
ইজহান ওকে নিয়ে গিয়ে বসল বসার ঘরের সোফায়। শারাফ তখনি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল, “বোন কাঁদে কেন?”
“খিদে পেয়েছে তাই!”
“ওকে খাইয়ে দাও।”
শারাফের প্রশ্ন শুনে ইজহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গোমড়ামুখে বলে, “আমার কাছে ওর খাবার নেই।”
“কেন নেই?”
ইজহান বলতে পারল না কেন নেই, সে স্মিত হাসি দিলো শুধু। শারাফ নিজের ফিডারটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা খাবে?”

ইজহান মাথা নাড়াল, যার অর্থ না। শারাফ এবার বেশ ভাবুক হয়ে গেল। একটু ভেবে নিজে থেকেই বলল,
“ও তো ছোট! ছোটরা তো আযরান-আজওয়া, শামিরের মতো খাবার খায়। তাই না?”
ইজহান মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল। শারাফ বলল, “ওরা তো দু দু খায়, শামিরও মাম্মার দু দু খায়। বোনকে তুমি দু দু দাও ইজু মামা, তাহলে আর কাঁদবে না।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৮

শারাফের মুখে একথা শুনে ইজহান হতভম্ব হয়ে গেল। বড়বড় চোখ করে তাকাল ওর দিকে। বুঝে পেল না এই বাচ্চাটাকে সে কী বলবে! তখনি পেছন থেকে হাসির শব্দ পাওয়া গেল, ইজহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল পুনম। সে রান্নাঘরে ছিল সৃজা আর ইস্মির সঙ্গে। এতক্ষণ ছেলে আর তার মামার কথোপকথন সবটাই তার কানে এসেছে। শারাফের বোকা বোকা কথাটা শুনে পুনম আর নিজে হাসি আটকাতে পারেনি। ফিক করে হেসে ফেলেছে। সৃজা আর ইস্মিও। সিঁড়ি দিয়ে নামারত অবস্থায় ইহসান আর এলিজাও শুনে ফেলেছে শারাফের কথা। ইজহানের মুখ লাল হয়ে গেল। ভেবে কূল পেল না তার মানসম্মান এখনো আছে না কি গেছে? এসবের মধ্যেই শারাফ আরেকটা কাজ করল; সোফায় উঠে ইজহানের পরণের টি-শার্টের বোতাম ধরে টানাটানি করতে করতে বলল, ‘‘ইজু মামা, জামা খোলো! বোন খাবে!”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭০