অশ্রুবন্দি পর্ব ৭০

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭০
ইসরাত জাহান ফারিয়া

শারাফ আরেকটা কাজ করল; সোফায় উঠে ইজহানের পরণের টি-শার্টের বোতাম ধরে টানাটানি করতে করতে বলল, ‘‘ইজু মামা, জামা খোলো!
বোন খাবে!”

ইজহানের কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। থমকে গেল সে। বাচ্চা একটা ছেলে এসব কী করছে তার সঙ্গে? রীতিমতো মানসম্মান নিয়ে টানাটানি! বসার ঘরে হাসাহাসির রোল পড়ে গেল। পুনম তো হাসতে হাসতে সৃজার উপর পড়েই যাচ্ছিল, হাত ধরে আটকাল বলে রক্ষা। ইস্মির মনটা যদিও ভার ছিল, তবুও সে হেসে ফেলল। বউয়ের হাসি দেখে ভেতরে ভেতরে একটু প্রশান্তির দেখা পেলেও ইজহান বাইরে থেকে গম্ভীর থাকার ভান করল। বোতাম খোলার চেষ্টা করতে থাকা শারাফের ছোট্ট হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গম্ভীরমুখে বলল, “বোন খাবে না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কেন খাবে না? তুমিই তো বললে ওর ক্ষিধে পেয়েছে, ও খাবে।”
“হ্যাঁ, ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু ও এসব খাবে না।”
“তাহলে কী খাবে?”
ভেতরে ভেতরে রাগ আর লজ্জায় অদ্ভুত অনুভূতিতে গাঁট হয়ে যাচ্ছিল ইজহান। কিন্তু বাইরে থেকে তা প্রকাশ করল না। সে পুরুষ মানুষ, মেয়েদের মতো মিনমিন স্বভাব করাটা তাকে মানায় না। যদিও মাঝেমাঝে সে মিনমিন করে, তবে সেটা শুধু এবং শুধু তার ইস্মিতার রাগ গলানোর সময়, ওর খারাপ লাগা কমানোর সময়! হালকা কেশে শারাফের প্রশ্নের জবাব দিল, “আমি জানি না।”

“আমি জানি, ও দু দু খাবে।”
কান গরম হয়ে গেল উপস্থিত থাকা প্রত্যক সদস্যের। সেই সঙ্গে ইজহানেরও। সে এবার ঘর কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “শাট আপ, শারাফ!”
ধমক খেয়ে শারাফের ভীষণ রাগ হলো ইজু মামার উপর। পাপড় সেই কখন থেকে কাঁদছে অথচ খাবার দিচ্ছে না মামা! উল্টো তাকেই বকা দিচ্ছে? ভীষণ অভিমানে শারাফ মুখ কালো করে একবার তার মাম্মার দিকে তাকাল। ঠোঁট ফুলিয়ে অভিযোগ দিলো, “মাম্মা, ইজু মামা বোনকে খেতে না দিয়ে কষ্ট দিচ্ছে। ইজু মামা খুব পাজি, খুব খারাপ। আমার খুব কান্না পাচ্ছে।”

বলতে বলতে সে ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল। চিৎকার বেরুল না তবে ফুঁপাতে লাগল ঠিকই। শারাফের মতো শান্তশিষ্ট, ভদ্র বাচ্চার এই রুপ দেখে সকলেই হতভম্ব! একমাত্র পুনম ছাড়া। কেননা, সন্তানকে মা’ই ভালো বুঝতে পারে, চিনতে পারে। আর এতটুকু বয়সে পুনমও জেনে গেছে, তার বড় পুত্রের মন অত্যধিক কোমল। এই বয়সেই সে বড়দের মতো সবাইকে নিয়ে চিন্তা করে, মা-বাবার সব কথা শোনে। ছোট্ট ছোট্ট ভাইবোনদেরও খুব ভালোবাসে। হোক সেটা চাচাতো, হোক সেটা মামাতো!

ইজহানের ধমক খেয়ে শারাফকে কাঁদতে দেখে ইহসান রেগে গেল। ইজহানকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করর শারাফকে এসে কোলে তুলে নিলো। আদর করে বোঝাতে লাগল ইজু মামা তাকে সেভাবে বকা দেয়নি, শুধু থামতে বলেছে। এরজন্য কাঁদার কোনো মানেই হয় না। বোকারাই এভাবে কাঁদে। শারাফ তো ভালো ছেলে, সবাইকে ভালোবাসে। সবাই কত কষ্ট পাবে শারাফ কাঁদলে? সান মামার কথায় শারাফের ফুঁপানো থামলো না, বরং কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো। বাচ্চাটা যে মনে মনে খুব ব্যথিত হয়েছে তা সকলেই বুঝতে পারল। ইস্মির বিরক্তি যেন আরো বাড়ল ইজহানের উপর৷ এতটুকু বাচ্চাকে লোকটা কাঁদায়?

পাষাণ কোথাকার! পুনম, সৃজা, এসে শারাফকে কোলে নিয়ে খুব করে বোঝাল, তবুও কাজ হলো না। কথায় আছে না, নিরীহ মানুষ রেগে গেলে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে? শারাফের কান্নাটাও তেমনি হলো। সে সচরাচর কাঁদে না, তবে যখন কাঁদে তখন তাকে থামানো কষ্টসাধ্য! এলিজা এসে শারাফকে একটু বোঝাল, কিন্তু শারাফ বারবার ইজু মামা পচা বলে দোষারোপ করতেই লাগল। এসব শুনে ইজহানের খুব খারাপ লাগল। পাংশুটে মুখে মেয়ে কোলে নিয়ে বসেই রইল সে। ক্ষণে ক্ষণে তার চোখের সামনে বিভ্রম তৈরি হতে লাগল—পরিষ্কার দেখল, শারাফ আসলে কাঁদছে না।কাঁদছে তার ছেলে। সেই ছেলে, যাকে সে ঐদিন হাসপাতালের কেবিনেও দেখেছিল, তার কান কামড়ে ধরেছিল দাঁতহীন মাড়ি দ্বারা! ইজহান একটা সময় ধৈর্যহারা হয়ে মেয়েকে রেখে শারাফকে এসে কোলে তুলে নিলো, চোখেমুখে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলল, “এখনও কাঁদবি রে বাপ? কতো আদর করলাম তোকে বল তো?”

শারাফ মামার গলা জড়িয়ে ধরেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “ক্ষিধে পেলে খুব পেটে ব্যথা করে। বোন না খেলে ওরও পেটে ব্যথা করবে। পেট ব্যথা হলে ডাক্তু সূচ ফুটিয়ে দেয়…”
শারাফের কথার প্রতুত্তরে ইজহান অনুশোচনা নিয়ে তকাল ওর দিকে। আহারে বাচ্চাটা! তার মেয়ের জন্যই তো এত চিন্তা করছিল, অথচ সে কী করল? অবুঝ শিশুটাকে ধমক দিলো। একরাশ খারাপ লাগা অনুভূতি কাজ করল তার মনের ভেতর। কিছু বলতে উদ্যত হতেই ঝড়ের বেগে আরসালান এসে ইজহানের কোল থেকে শারাফকে সরিয়ে পাশে বসিয়ে দিলো। এরপর সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে ইজহানের টি-শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে শারাফকে উদ্দেশ্য করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তোর মামা দু দু দিচ্ছে তোর বোনকে, তুই কেঁদে আমার মাথা খারাপ করে দিস না। হেই পুনম, তোর ছেলেকে থামা! আমার হাত কিন্তু কন্ট্রোলে থাকবে না বেশিক্ষণ। অলরেডি মাথাব্যথা হয়ে গেছে!”

ঘরভর্তি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ইজহান নিজের পাশে আরসালানকে দেখে, তার কর্মকাজ দেখে ভস্মীভূত নজরে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। খপ করে বোতামের উপর থাকা ব্যস্ত হাতটাকে চেপে ধরে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, “এটুকু বাচ্চার খাবার যোগানের সাধ্যি আমার নেই। আমি মেয়েমানুষ না, এটা তোর বোঝা উচিৎ।”
আরসালান চট করেই চুপ হয়ে ডিভাইনে হেলান দিয়ে বসে ভাবুক বনে গেল। বিড়বিড় করে বলল, “মেয়ে না, তুমি ছেলে? বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরো, মেয়ে কোলে নিয়ে ঘুরো। কেমন ছেলে তুমি?”

দিন-রাত ড্রা গের প্রভাবে থাকায় এসেছে থেকে এতগুলো দিন আরসালান নিজের ঘর থেকে খুব কমই বের হয়েছে। বের হলেও হাতেগোনা কয়েকবার, নয়তো রাত হলে বেরিয়েছে। তারা ভাইয়েরা যে চিন্তায় ছিল, তা নিয়ে তেমন কোনো বিশেষ ঝামেলাও করেনি। সৃজাকে নিয়ে যেমন কোনো ঘটনা ঘটায়নি, তেমনি পারিবারিক কোনো আনন্দানুষ্ঠান, বৈঠকের ধারেকাছেও আসেনি। কুকুরটাকেও আসতে দিতো না, আটকে রাখতো। দু’দিন যাবৎ ওটাকে একটু আধটু বের করলেও নিজে সেই আগের রুটিনেই চলছে। এমনকি তিনবেলা খাবারটাও যে কখন খায়, তারও ঠিক নেই। সেই ছেলে কি না সকাল দশটায়, ঘুমঘুম চোখে, ঢুলঢুলু অবস্থায় নিজের বাড়ির বসার ঘরে একঘর ভর্তি লোকের সামনে তার ইজ্জত মারতে এসেছে? ইজহান যেন ভীষণ বিস্মিত হলো, নিচু ও শক্ত কণ্ঠে সতর্ক করল, “ঘরে যা! তুই এখনো নেশার প্রভাবে, ঘুমের ঘোরে আছিস।”

ইজহানকে অবাক করে দিয়ে নিভু নিভু চোখে তাকাল আরসালান। জোরাল কণ্ঠে বলল, “ঘোরে না, ঘুমেই আছি। পি পেয়েছে বলে ওয়াশরুমে যেতে নিলাম, ওমনি তোমাদের হাসাহাসি, বাচ্চাদের কান্নাকাটি কানের পোকাটা মেরে দিল। রাগ হবে না ভাই, বলো? আমি কি আর সারারাত তোমাদের মতো সুখ নিদ্রায় যেতে পারি? সুখ তো ছেড়ে গেছে আমায়। পি টাও শান্তিতে করতে দিচ্ছ না এখন!”

রাগে তিরতির করে ঠোঁট কাঁপল ইজহানের, বলার মতো শব্দ না পেয়ে। সংযম হারিয়ে না সিনক্রিয়েট করে বসে সাইকোটার সাথে, এই দ্বিধায় আরসালানকে ছাড়িয়ে এক ঝটকায় সে উঠে দাঁড়াল। অশ্রাব্য দুটো গালি ছুঁড়ে মেয়েকে নিয়ে ইস্মিতার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অভিমানী ইস্মি কাঠ মুখে তাকাল স্বামীর পানে, পরপরই উল্টো ঘুরে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। তৎক্ষনাৎ ইজহান বড় বড় পা ফেলে ওর সামনে এসে দাঁড়াল, মুখে কিছু না বলে মেয়েকে ইশারা করে দেখিয়ে ‘ওর খাদ্য চাই’ এমন বোঝাল। বুঝেও ইস্মি প্রতিক্রিয়া দেখাল না, মেয়েকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখল। অনেকক্ষণ যাবৎ মেয়েটা না খাওয়া, বুকের ভেতরটা হু হু করে কাঁদছে মেয়েকে একটু ছোঁয়ার আশায় কিন্তু সে মেয়েকে ছুঁচ্ছে না। কেন ছোঁবে? লাঞ্চিত হওয়ার জন্য? অভিমান আর অপরাধবোধে ক্লিষ্ট ইস্মি সিদ্ধান্ত নিলো যতক্ষণ না ইজহান নিজের ভুল শুধরে নেবে ততক্ষণ সে মেয়েকে ছুঁবে না, যেন লোকটা বুঝতে পারে ইস্মিকে ঐভাবে কথা শুনিয়ে সে কতটা ভুল করেছে, কতটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে!

ইস্মি ইজহানকে পাশ কেটে চলে যেতেই নিবে তখনি আবার ইজহান ওর পথ আটকাল। খপ করে ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অনেকটা জবরদস্তি করেই নিজেদের ঘরে চলে এলো। এদিকে ইস্মি রেগে বোম! বারবার ওর হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে চাইছিল। ইজহান দরজা আটকে দিয়ে জোর করে ওকে এনে বিছানায় বসাল, নিজে বসল মেঝেতে। এরপর অনেকটা ধমকেই বলল, “অনেক তো হাসির পাত্র বানালি, এবার চল মেয়েকে খাওয়াবি।”
প্রথমে দু’বার জবাব না দিলেও তৃতীয়বারের মাথায় ইস্মি কাঠ কাঠ গলায় বলল, “অযথা আমাকে ঘাঁটাবেন না, আমি মেয়ের কেউ না। একথা আপনিই বলেছেন।”

ইজহান কী করবে ভেবে পেল না। এই কথা তো সত্যি, সে এমন কঠিন কথা দ্বারা ইস্মিতাকে আঘাত দিয়েছে , যেটা ছিল অনুচিত, মহা অন্যায়! যে অন্যায়ের ক্ষমা হয় না। তবুও সে তো এতকিছু ভেবে বলেনি। ক্ষমা করে দেওয়াটাই কি উচিত না ইস্মিতার? এরপরও পাষাণী দিচ্ছে না, তাকে অপরাধী বানিয়েই রাখছে। ইজহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবুঝ চেহারা বানিয়ে নরম স্বরে বলল, “কে বলেছে এই কথা? যে বলেছে সে একটা ছাগলপাঠা, না না বলদ! উহু, দামড়া! না, তাও নয়! সে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ স্বামী, খারাপ বাবা। সে বাবা হওয়ার যোগ্যই নয়!”

বলতে বলতে গলা ভার হয়ে, চোখদুটো ভিজে উঠল ইজহানের। সঙ্গে সঙ্গে মুখ আড়াল করল সে ইস্মির শাড়ির ভাঁজে। হতভম্ব ইস্মি নড়েচড়ে উঠতেই দু’হাতে আঁকড়ে ধরল তার কোমড়৷ ভেজা স্বরে, অনুরোধের সহিত বলল, “আমার মা অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে, তুমি তাকে খাওয়াও। বিনিময়ে তার বাবা না খেয়ে থাকবে, বাজে কথার শাস্তি পাবে। তবুও তুমি তাকে খাওয়াও, আমার চেয়ে তোমাকে ওর বেশি প্রয়োজন।”
অভিমানী ইস্মির মন টলল, বুকে ঝড় তুলল। মেয়েকে ফিডিং করাতে করাতে একটুখানি কাঁদলও সে বোধহয়! ইজহান দেখল না, চুপ করে অনুভব করল।

সোফায় পা তুলে বসে এক এক করে সবাইকে শাণিত চোখে পরখ করছে আরসালান। কারণ এখানের সবাইকে সে চেনে না, ঐ যে কেমন হলদেটে একটা জামা পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটাকেও সে চেনে না। চেনে না বললে অবশ্য ভুল হবে, সে চেনে। যখন লিলাক শেডের জামা পরে, অথবা হালকা বেগুনি! তার মা যেদিন মরে গেছিল, সেদিন এমনই বেগুনি রঙের একটা জামা পরণে ছিল। কী সুন্দর লাগছিল! বাদামি চোখের, লালচে-কালো চুলের মাকে একদম পরীর মতো দেখাচ্ছিল। সে জিজ্ঞেস করেছিল,

‘এটা কোন রং মাম্মা?’
আরসালানের মাম্মা সেদিন শক্ত মুখে বলেছিলেন, “ল্যাভেন্ডার।”
সেই প্রথম তার রঙ চেনা। ল্যাভেন্ডার! মাম্মা সেদিন নিজে থেকেই ফটো অ্যালবাম বের করে ল্যাভেন্ডার বাগানের ছবি দেখিয়েছিল তাকে, তার নানা, নানী, বড়ো নানা ভাইয়ের ছবিও দেখিয়েছিল। দেখে খুব কেঁদেছিল মা। ছোট্ট আরসালান হাত দিয়ে মাম্মার চোখ মুছে দিয়েছিল। সেজন্য অবশ্য মাম্মা তাকে খুব বকেছিল।

কিন্তু সে একটুও মন খারাপ করেনি। বরং কাছ থেকে মন ভরে মাম্মাকে দেখেছিল সে। কোল ঘেঁষে শুয়েওছিল, কিন্তু মা তাকে চড় দিয়েছিল গালে। রাগ হয়েছিল আরসালানের। বলেছিল, ‘মাম্মা, তুমি মরে যাও!’ কে জানতো, মাম্মা তুমি মরে যাও বললেই মাম্মা সত্যিই মরে যাবে? সে আর দেখতে পাবে না? সেদিন বিকেলেই আরসালান তার মাম্মাকে ল্যাভেন্ডার রঙের জামাটা পরেই ছাদ থেকে পড়ে যেতে দেখল! ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে যখন মরে গেল; আরসালান দেখেছিল, মায়ের সারা শরীর চুপচুপে হয়ে গেছে রঙিন তরল দ্বারা। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কী?’

বাবা বলেছিল, ‘রক্ত।’
‘এমন কেন?’
‘রক্ত এমনই হয় আব্বাজান— লাল!’
দ্বিতীয় রঙটা চিনিয়েছিল তাকে তার বাবা, আজিজ শেখ নামক মানুষটি। আর এই লাল রঙ খুব মানায় ঐ মেয়েটিকে, শারাফকে ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে!
আরসালান চোখ চেপে ধরে হাসে। বলে, ‘এই! তোরা সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার পি করা দেখবি? দেখলে দেখ! এই যে এই, ল্যাভেন্ডার আর লালপরী! তোমরাও দেখবে? আচ্ছা দেখো, আমি একটুও হ্যাজিটেট ফিল করব না।’

উঁচু কণ্ঠে অবলীলায় অবান্তর, নোংরা, বাজে বকল আরসালান। লজ্জায় পড়ি-মরি করে চাকর-বাকরদের একেকজন ছুট লাগাল। সৃজা, পুনমকে নিয়ে সরে এলো। সকলে অপ্রস্তুত! কেউ আর ভেবে দেখল না আরসালান কাকে ল্যাভেন্ডার আর লালপরী সম্বোধন করেছে,
শুধুমাত্র একজন ছাড়া!

এলিজা, শারাফের মতো বাচ্চাটা এখানে উপস্থিত। এদের তোয়াক্কা না করে লাগামহীনের মতো এতগুলো বাজে কথা বলে ফেলল আরসালান! রুক্ষ, শীতল চোখে ইহসান তখন তার ছোটো ভাইয়ের দিকেই তাকিয়ে। হাতদুটো ভাঁজ করা। কয়েকটা মুহূর্ত সে চোখ সরাল না আরসালানের উপর থেকে। তীক্ষ্ণ চোখে দেখে গেল ওর ঢুলুঢুলু, উদ্ভ্রান্ত অবস্থা, ঠোঁটের বাঁকা হাসি, দৃষ্টির কৌতুক আর ঔদ্ধত্য! দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত থাকার চেষ্টা করে আরসালানকে বসা থেকে টেনে দাঁড় করাতে করাতে নিচু স্বরে বলল, “আমি রাগছি।”

বেহেড আরসালান তাচ্ছিল্য হাসলো, “আমার উপর রাগ করা তো তোমার ফরজ। আর ফরজ কাজের সওয়াব থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে, এতোটাও বোকা নয় আমার ভাই। আমি জানি।”
রাগমিশ্রিত চোখে তাকালেও ইহসান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিজেকে সংযত রাখল৷ ধীর কণ্ঠে বলল, “চল!”
“কোথায়?”
“তোর ঘরে!”

ঘাড়ের উপর দিয়ে এক হাত নিয়ে ইহসানকে আঁকড়ে ধরে একপা ফেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল আরসালান, “এ বাড়িতে আমার ঘরও আছে? অথচ এ বাড়িটা তোমাদের লিখেপড়ে দিয়ে দিয়েছে আজিজ শেখ। আর আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে মূলা।”
“যখন আমাদের লিখে দিয়েছে তখন তো জানতো না তুই আসবি।”
“ঠিক, তার মানে আমি অনাকাঙ্ক্ষিত!”

‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ শব্দটি মাথায় গেঁথে গেল ইহসানের। হ্যাঁ, আরসালান ইনজান শেখ অনাকাঙ্ক্ষিত,
অনাকাঙ্ক্ষিত সে নিজে আর ইজহানও, এমনকি ইমরানও। তাহলে জান কেন নিজেকে একলা অনাকাঙ্ক্ষিত দাবি করে? কেন এই ছেলেটাকে এতগুলো বছরেও সে বোঝাতে পারল না, যে আগুনে সে জ্বলে, তার বাকি ভাইরাও সেই একই আগুনে জ্বলে? ইহসান চুপ করে রইল। জবাব না পেয়ে আরসালান এতক্ষণ ঘোলাটে দৃষ্টি ভাইকেই দেখছিল, ভাইয়ের নীরবতায় একটু ক্ষেপে গেল সে। হাজার বার করতে থাকা একটা প্রশ্ন সে আবারও করল ইহসানকে,

“এজন্যই তোমার মা আমায় ভালোবাসেনি?”
ইহসান শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো, “আমি তো জানতাম না সে তোকে ভালোবেসেছে কি না!”
“কিন্তু আমি জানি!”
এই বলে সে ইহসানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দু’হাতে প্রথমে নিজের চুল টেনে ধরল, এরপর টি-টেবিলটাতে লাথি বসাল। যখন দেখল ওটার কিছুই হলো না, বরং পায়ে লেগেছে। তখন রাগ সীমা অতিক্রম করল তার, একপাশে সাজিয়ে রাখা আজিজ শেখের বড্ড শখের বেলজিয়াম কাচের ফুলদানিটা ভেঙ্গে ফেলল। পরপর সোফার কুশন সব ছিঁড়েছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। ভাঙল কর্ণার, দেয়ালের ফটোফ্রেম, ডাইনিং টেবিলের কাচ এবং সবশেষে টেলিভিশন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভাঙা কাচের টুকরোয় বসার ঘরের মেঝেটা ঢেকে গেল।

ভাঙচুরের শব্দে সারা বাড়ি তখন কাঁপছে। আজিজ শেখ বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঘরে, ইমরানও। তারা যে যেমন অবস্থায় ছিল, ছুটে এলো। এমনকি ইজহান-ইস্মিতা, সৃজা, পুনমও। এসে দেখল ভাঙা কাচের উপর মুমূর্ষু রোগীর ন্যায় বসে হাঁপাচ্ছে আরসালান। চোখমুখ উদ্ভ্রান্ত। তার পরণের কালো টি-শার্টটা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। অথচ সে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে আর বুক চেপে ধরছে। প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়েই তবে সে থামল। এদিকে আজিজ শেখের চোখদুটো জ্বলে উঠল ছেলের অবস্থা দেখে। অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। বিচলিত ইমরান এসে তাকে ধরতেই তিনি ব্যগ্র স্বরে বললেন, “আমার জানের কী হইল? ও পইড়া আছে কেন? ওরে ধরো বাপজান।”

কাচের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেহাল অবস্থা। এক ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক ছেলেকে ক্ষত-বিক্ষত হতে তো তিনি দেখতে পারেন না। তাই আজিজ শেখ উচাটন ভঙ্গিতে ইমরানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “না, না। তোমার ধরতে হইব না। আমিই যাই জানের কাছে। সরো, ছাড়ো আমারে।”
আজিজ শেখ ভাঙা কাচে পা রেখেই ছুটে ধরতে গেলেন পুত্রকে, কিন্তু তার আগেই ইহসান নিজে গিয়ে ধরল জ্ঞানশূন্য ভাইকে। উত্তেজিত না হয়ে একজনকে ডেকে পানি আনতে বলে ইমরানকে পাঠাল আরসালানের ইনহেলার খুঁজে আনতে। এরপর চুপচাপ বসে রইল ভাইয়ের পাশেই, তার হাত ধরে।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৬৯

এদিকে আকস্মিক এমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত কোন্দলের মুখোমুখি হয়ে সকলেই যখন অপ্রসন্ন, অপ্রস্তুত! এলিজা তখন সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে গেল ভাংচুরের খেলায় মেতে উঠা, নিজেকে একঘরে বন্দী করে রাখা আজিজ পুত্র আর কেমির মালিককে! ভয় পাবে বলে শারাফকে নিয়ে এলিজা সেখান থেকে সরে গেল ইহসানের ইশারায়। যাওয়ার আগে আরো একবার নিষ্পলক চোখে দেখে নিলো আরসালান ইনজান শেখকে৷ যার বিড়বিড় করে বলা একটা
কথাই বারবার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘সে শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছে। মাম্মা আমায় ভালোবাসেনি, বাসেনি, বাসেনি!’

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭১