অশ্রুবন্দি পর্ব ৭১

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭১
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ছেলেটা অতি মানবীয় সৌন্দর্যের অধিকারী। তার মুখাবয়বে একবার চোখ পড়লে সেখান থেকে সহজে নজর সরানো কঠিন। কাটা দাগের ফর্সা মুখ, ধারালো চোয়াল, সুগঠিত নাক, ঘন ভ্রু, অন্ধকার রাতের তারার মতো তীক্ষ্ণ জ্বলজ্বলে দুটি চোখ; প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এমনভাবে তার মুখাবয়বে সাজানো যেন কোনো শিল্পী তার মুখটা যত্ন নিয়ে এঁকেছে। আরসালান ইনজান শেখ পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই তার মা’কে উল্টেপাল্টে এসেছে।

নজর লাগার ভয়ে আজিজ শেখ ছেলেটার দিকে তাকান না সচরাচর। তাকালে অবশ্য তার প্রিয়তমা, তার সন্তানদের মা এমির কথা মনে পড়ে। এমি, তার এমি! একটা শান্ত প্রজাপতি! ডানা মেলে যে উড়ে বেড়াতো গ্রামের বনে-বাদাড়ে। একা বসে ছবি আঁকতো। বাংলা বলতে পারতো না, তবে বুঝতে পারতো। টুকটাক যা বলতো তা ভাঙা ভাঙা। গ্রামের লোকে ওর বাংলা শুনে হাসলেও মুগ্ধ হতো আজিজ শেখ! সেই মুগ্ধতা থেকেই তো তার পিছু নেওয়া, সমাজ, সংস্কারের বাঁধা ডিঙিয়ে তাকে নিজের করে নেওয়া। লোকে বলে পদ্ধতিটা ভুল, অন্যায়। অথচ ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব দেওয়ার পরেও আজিজ শেখের ভালোবাসার কদর করতে চায়নি এমি, এমির বাবা। তার বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল জীবনের দোহাই দিয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভালোবাসা কী প্রত্যাখ্যান মানে? আজিজ শেখের ভাষ্যমতে তো না। আর সেজন্যই তো জবরদস্তি করা। এসবে তো নিজের কোনো ভুল খুঁজে পান না তিনি!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শান্তশিষ্ট, বাদামি চোখের সুন্দরী রমণী। যার পেলব দেহ আর লালচে কালো চুলের ভাঁজে তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন এক পৃথিবী সুখ! এমি চলে গেছে বহুদিন আগে, তাকে ছেড়ে, তার ছেলেদের ছেড়ে। যাওয়ার আগে শাপ দিয়েছিল, যে তার বাবাকে মৃত্যু নামক অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়ে, তাকে পরিবার, সমাজের কাছে কলঙ্কিত করে তার জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলেছিল, সেই লোকটার আলোভরা জীবনটা যাতে তলিয়ে যায় গহীন অন্ধকারে। একাকিত্ব, শূন্যতা যাতে গ্রাস করে নেয় তার থেকে সব ছিনিয়ে নিয়ে।মূলত এমি চেয়েছিল তাকে শাস্তি দিতে। যে শাস্তিতে আজিজ শেখ নামক অমানুষটা সব হারিয়ে পদে পদে ভুগবে, একা হয়ে যাবে সেই শাস্তি!

এমির ভাবনার পরিধি ছোট ছিল, অনেকটা অবোধ শিশুর মতো। কিন্তু আজিজ শেখ তো অবোধ নয়। জেদি, আত্মকেন্দ্রিক এবং নিজ স্বার্থে অটল থাকা, একজন মানুষ। আর সেজন্যই তো তিনি একা হয়ে যাননি। একাকিত্ব তাকে গ্রাস করতে পারেনি। কারণ তার কাছে ছিল অমূল্য রত্ন! এমিরই গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া তার নিজের রক্ত, তার সন্তান— চার চারটা পুত্র। যাদেরকে তিনি অন্ধের মতো ভালোবাসেন। যে ভালোবাসার পরিমাপ করা অসম্ভব! এমির দেওয়া এতো দামী উপহারগুলো থাকতে এমি ভাবলো কী করে তার মৃত্যুতে আজিজ শেখ একা হয়ে পড়বে? বোকা নারী! আফসোস!

নিঃস্তব্ধ কেবিনটার সাদা চাদরে আবৃত সিঙ্গেল বেডটায় শোয়ারত অক্সিজেন মাস্ক পরিহিত ধীরেধীরে উঠানামা করা পুরুষালি পশমাবৃত বুকটার দিকে তাকিয়ে পঞ্চাশোর্ধ আজিজ শেখ চক্ষু জুড়ান হাত বাড়িয়ে ছেলেকে ছোঁন। ঘামে লেপ্টে যাওয়া চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে আরসালানের মুখপানে তাকিয়ে থাকেন। বুকে জাপ্টে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করে ছেলেকে। অথচ তিনি তা করেন না। বরং ছেলের শিয়রে এসে বসা এমিকে দেখেন। কমবয়েসী সুন্দর একটা মুখ। গালে লালচে আভা। এলোমেলো, জট পাকানো রুক্ষ চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। মুখটা মলিন অথচ ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। আজিজ শেখ চমকালেন না। কেননা, তিনি জানেন এটা বিভ্রম। মাঝেমাঝেই বিভ্রম হয়ে তার কাছে আসে এমি। কত শাপ-শাপান্ত যে করে, ভালোই লাগে তার।তবে এবার এমি এসেছে অনেকদিন পর। আজিজ শেখ হেসে উঠেন, ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেন, “এই এমি! অনেকদিন পর আসছ যে, এখনো দেখি খোঁজ রাখো?”

এমি চোখ তুলে চায় তার দিকে, তীব্র একটা ঘৃণার চাহনি ছুঁড়ে পরক্ষনেই মুখটা নামিয়ে আরসালানের পানে তাকায়। আজিজ শেখ সেই চাহনি দু-চোখ ভরে দেখে, বিতৃষ্ণ মনটাকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। আরসালানের নিথর হাতটা মুঠোয় নিয়ে এমির দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলেন, “তুমি নাই, তুমি থাকবা না, তোমারে পাব না বললে কী হবে, এইতো তুমি আছ, আমিতো একা হয়ে যাই নাই। হবও না। যতদিন এরা আছে, আমার সন্তানরা আছে! বরংচ তুমিই ভুল ছিলা বোকা মহিলা, আস্ত বোকা। তাই প্রেম বুঝো নাই, ভালোবাসা বুঝো নাই। বুঝছ নিজের জেদ! এই জেদই তোমারে খাইছে। আচ্ছা, এখন যেইখানে আছ, সেইখানে ভালো আছ তো? ভালোই থাকবা। সেইখানে তো আর আমি নাই। তাছাড়া আমার ছেলেগুলোরে কষ্ট পাইতে দেখলে, ক্ষতি দেখলে নিশ্চয় তুমি ভালোই থাকো, তাই না এমি? কিন্তু আমি তো আমার ছেলেদের ক্ষতি সহ্য করতে পারি না। ওদের একটা আঁচ লাগলেও আমার কলিজা ছিঁড়ে যায়। আমার উত্তরাধিকাররা দুর্বল হোক এটা আমি চাই না। তবে হাজার হোক, ভালো না বাসলেও ওদের শরীরে তো তোমার রক্তও বইছে। এমন পাষাণ হও কীভাবে এমি?”

আজিজ শেখ অপেক্ষা করতে থাকেন এমির জবাবের, অথচ তা আসে না। এমি পাথরের মতো মুখ করে আগের মতোই বসে থাকে। আজিজ শেখ হঠাৎ করে রেগে যান এমির উপর। বলেন, “মনে আছে, জানের জন্মের পর কী করছিলা? এক বোতল সিরাপ খাওয়াই দিসিলা ওরে! পাষাণী… এতটুকু বাচ্চারে তুই মারতে চাইছস! আমার বাচ্চারে! কত্ত বড়ো কলিজা তোর এমি…”

কথা জড়িয়ে আসতে চায় ক্ষিপ্ত আজিজ শেখের। তাই তিনি শক্ত করে ছেলের হাতটা চেপে ধরলেন, মুখ থেকে বের হলো ভাঙা স্বর, “আমি না থাকলে সেইদিন..আমার বাচ্চাটা মইরা পইড়া থাকতো। বাচ্চা তো তোমারও!”
আজিজ শেখ ব্যাকুল হয়ে উঠেন। অথচ এমি তাকায় না, কোনো কথা বলে না, উঠে চুপচাপ চলে যায়। আজিজ শেখ অপলক নয়, হিসেবি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। সাতাশের এমিলি ইয়াসমিনের বিভ্রমটা আস্তে-ধীরে অনেক দূরে চলে যায়। আজিজ শেখ নিরাবেগ, যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে চোখ বুজে ফেলেন।

দরজাটা কাঠের। তার মাঝখানটায় জানালার মতো একটা ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে, যেটা কাচ দিয়ে আবদ্ধ। বাইরে থেকে ঐ একটুখানি অংশ দিয়েই ভেতরের পুরো ঘরটা দেখা যায়। একটা সাদা চাদরে মোড়ানো সিঙ্গেল বেড, তাতে আটকানো সরু লম্বা একটা লোহার স্টিক, তাতে স্যালাইন ঝোলানো। একপাশে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার, বেডসাইড টেবিল সাজানো। অন্যপাশে হৃদপিণ্ডের গতি পরিমাপক মেশিনটা বিপ বিপ শব্দ তুলছে…

ছোট্ট কাচটা ভেদ করে বেডে শোয়ারত নির্জীব ভাইটাকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখছে ইহসান। একশো চার ডিগ্রি জ্বর, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা আর সেইসঙ্গে অতিরিক্ত নে শাদ্রব্য গ্রহণের ফলে নানাবিধ জটিলতা নিয়ে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে আছে ইনজান শেখ। ইহসান হাতে থাকা রিপোর্টটার দিকে তাকায়, যেটা একটু আগেই সে ল্যাব থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে। জ্বর নিয়ে অতিরিক্ত
কো কেইন গ্রহণের ফলে শরীরে অক্সিজেনের সঠিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে হাইপোক্সিয়া দেখা দিয়েছে আরসালানের। চিকিৎসক জানিয়েছে, রাতটা হাসপাতালে কাটাতে হবে।

ভারি পাল্লার দরজাটা ঠেলে হাতে থাকা রিপোর্টগুলো নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলে শব্দ শুনে আজিজ শেখ চোখ তুলে তাকায়। দেখেন, তার অবাধ্য বড়ো ছেলে ইহসান এসেছে। তার মুখ গম্ভীর, মলিন। চোখদুটো টকটকে লাল, কেমন যেন প্রাণহীন! অথচ কাজে-কর্মে, দায়িত্ববোধে কমতি নেই। ছোটো ভাইকে সহ্য করতে পারে না এমনটা শুধু মুখেই বলে। সারাদিন যেভাবে ওকে নিয়ে অস্থির হয়েছে, ছোটাছুটি করেছে তাতে আজিজ শেখ বড়ো ছেলের উপর মাত্রাতিরিক্ত সন্তুষ্ট। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন
তবে ইহসানের মলিন মুখটা দেখতে ভালো লাগে না তার। উঠে ছেলের কাছে যান। টিস্যু দিয়ে ঘর্মাক্ত কপাল, মুখখানি মুছে দেন। ইহসান বাঁধা দেয় না। এক বোতল পানিও ধরিয়ে দেন ওর হাতে, বিনিময়ে ওর হাতে থাকা আরসালানের টেস্ট রিপোর্টগুলো নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে থাকেন। এ সময়টাতে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাল তাকে। অস্থির কণ্ঠে প্রশ্ন করেন ইহসানকে, “ডাক্তার কী বলল? জটিল কিছু?”

“কেন? হলে ভালো হতো?”
আজিজ শেখ তাজ্জব বনে গেলেন, “মানে কী বোঝাতে চাইতেছ তুমি? আমি খুশি হব জানের কিছু হইলে?”
“বোঝাতে চাইছি না, এটাই বুঝাচ্ছি।”
“ও আমার জান—আর ওর অসুস্থতায় আমি খুশি হব? পাগল হইছ তুমি? দেখ আব্বাজান, মন ভালো না। আলতু-ফালতু কথা বইলা মেজাজটার দফারফা কইরো না।”

ইহসান ঠান্ডা চোখে জন্মদাতার দিকে তাকাল, তার চেয়েও শীতল কণ্ঠে বলল, “আপনি যদি আমাদের বাপ না হতেন, আফসোস! আমার ভাইটার জীবন এভাবে হেলায় যেতো না। মাঝেমাঝে মনে হয় জন্মের আগে কোনো পাপ করেছিলাম যার দরুণ আপনি আমাদের বাপ। নয়তো আমরা কেন আপনার ঘরে জন্ম নিলাম বলুন তো?”
আজিজ শেখ স্তব্ধ হয়ে গেলেন ইহসানের মুখে এমন তিক্ত সত্য শুনে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। ঠোঁটদুটো শক্ত করে চেপে রাখলেন, যেন নিজের রাগকে আটকে রাখছেন। কয়েক সেকেন্ড পর ফস করে বলে উঠলেন, “আমি এতো খারাপ বাপ?”

ইহসান চোখ সরাল না, বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলল,
“ভালোবাসার স্বার্থে একজনের জীবন নষ্ট করেছেন, তার সন্তানদের এক অসম্পূর্ণ পৃথিবীতে ফেলে রেখেছেন। আপনি শুধু আপনার উগ্র ভালোবাসা দেখিয়েছেন, দায়িত্ববোধ না। তাহলে আজ ওকে এমন অবস্থায় দেখতে হতো না। আমার মা…”
কথাটুকু সমাপ্ত করার আগেই আজিজ শেখ এবার গর্জে উঠলেন, “তোমার মা থাকলে কী করত বল? জানের এমন অবস্থা হইতো না? জানো, তোমার মায়ের কেমন চিন্তাধারা ছিল? ও কী চাইত? নিজের মতো করে বাঁচতে, আঁকতে, উড়তে, আমারে ছাড়তে… আমি শুধু ওরে বেঁধে রাখতে চাইছিলাম আমার সংসারে, আমার সন্তানদের মা করে। এইটা কি দোষ?”

ইহসান রোষপূর্ণ চোখে তাকাল, “হ্যাঁ, দোষ! কারো স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া দোষ। তাকে ভালোবাসার নামে বেঁধে রাখা, জোর করা, বদনাম করা; সবই দোষ। মূল কথা, আপনি ভালোবাসেননি, দখল করেছেন।”
আজিজ শেখ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন এরপর বললেন, “তুমি আমারে ঘৃণা কোরো, আমি জানি। কিন্তু তুমি জানো না, তোমাদের জন্য আমি কতো কিছু হজম করছি, কতো কিছু ছাড় দিছি।”
“আপনি যা দিয়েছেন—আদর্শহীন ভালোবাসা, প্রশ্রয়, দম্ভ! সবকিছু ইনজানের জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে।”
আজিজ শেখ সংকট পূর্ণ চোখে তাকাল, “তছনছ?”
“হয়নি বলছেন?”
প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা না করে ইহসান বেরিয়ে আসে। তার ভেতরটা কেমন অদ্ভুত যন্ত্রণায় পুড়ছে। কেমন নিঃস্ব নিঃস্ব মনে হচ্ছে। এমনটা হচ্ছে জানের কথাগুলো শোনার পর থেকে। ছেলেটার একটাই অভিযোগ, তাকে কেউ ভালোবাসেনি।

ভালোবাসেনি, অদ্ভুত! এ জগতে কে আর কাকে
বিনা স্বার্থে ভালোবাসে? আপন মানুষ ছাড়া? বাপ আছে—নামে মাত্র! ভালোওবাসে লোকটা ছেলেদের, অথচ ছেলেরা সেসব অনুভব করতে, স্বীকার করতে চায় না। জানকে কে বোঝাবে এসব? ইহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। করিডোরের ওয়েটিং চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। পকেটে থাকা ফোনটা ভ্রাইবেশন হচ্ছে অনুভব করে চেক করে কল ব্যাক করে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে একটা সুন্দর নারীমুখ, যা দেখে বুকের ভেতরটা শীতল ঠেকে তার। ইহসান শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে, “ওড়না গলায় প্যাঁচিয়ে বসে আছিস কেন? টান খেলে তো মরে যাবি।”
“উফ, খেয়াল নেই। তোমার ছেলের যন্ত্রণায় কিচ্ছু খেয়াল নেই৷” বলতে বলতে সৃজা ওড়নাটা ঠিকঠাক করে গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করে “ওদিকের কী অবস্থা? ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে?”
“ফিরেছে, তবে এখন ঘুমাচ্ছে।”

সৃজা স্বস্তি পায়, “যাক, দুশ্চিন্তামুক্ত করলে। জানো তো, আন্টি যা কান্নাকাটি করছিল…”
কথার মাঝখানেই ওকে থামিয়ে দিয়ে ইহসান গম্ভীর স্বরে ডেকে ওঠে, “সৃজা?”
অপলক চেয়ে জবাব দেয়, “হু?”
“জান এডিক্টেড! বিষয়টা জানাইনি তোকে।”
সৃজা স্মিত হেসে জবাব দেয়, “এসব নিয়ে কথা না বলি? মানুষটা অসুস্থ!”
“কিন্তু… ”
“সবচেয়ে অন্ধকার রাতও এক নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি নিয়ে শেষ হয়, তাই আশা রাখি সব ঠিক হয়ে যাবে। আশা রাখতে তো কোনো দোষ নেই।”
এই মেয়েটা কখনোই, কোনোকিছুতে কঠিন হয় না। এতকিছু জানার পরেও না। ইহসান ভেবে পায় না, তার সৃজাটা এমন কেন? সে আবেশিত কণ্ঠে বলে, “সৃজা,

আই লাভ ইউ! আই লাভ ইউ আ লট!”
মেয়েটা হাসে, “জবাব এখন দিতেই হবে?”
“উহু, তোলা রাখ!“
“এখন রাখি? মেয়ে জ্বালাচ্ছে।”
ইহসান নিজেও হাসে, প্রশান্তিতে চোখ বুজে নেয়ম ছোটো করে বলে, “রাখ।”

তবে ফোন রাখতেই কললিস্টে গিয়ে ইহসানের চোখ কপালে উঠে। ৬১+ মিসড কল ফ্রম ইজহান। কখন দিলো এত কল? টের পেল না তো ইহসান। সে কল ব্যাক করে না, ম্যাসেজ লিখে, ‘রাতটা হাসপাতালে কাটাতে হবে। সুস্থ হলেই নিয়ে চলে আসব। বারবার ফোন করার দরকার নেই, আমি আপডেট জানাব। বাচ্চাদের খেয়াল রাখিস। উহ হ্যাঁ, আযরানের ফর্মুলাটা শেষের পথে। কাউকে একটা পাঠিয়ে আনিয়ে দিস। আমি টাকা সেন্ড করে দিচ্ছি।’
পাঁচ মিনিট পর দুটো রাগের ইমোজির সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা লেখা চ্যাট বক্সে ভেসে উঠল, ‘টাকা তোর পেছনে ভরে রাখ। তোর টাকায় আমি হিসু করি, পটি করি…’
ইহসানের ভারাক্রান্ত মনটা হাসলো একা একাই।

‘তুমি আজিজের ছেলে না? কী যেন নাম? ইহসান? না আরসালান?’
দুপুর তিনটা। রৌদ্রস্নাত দিন। একরাত হসপিটালে কাটানোর পর বিল পে করা নিয়ে কাউন্টারে কথা বলতে যাচ্ছিল ইহসান। কিন্তু পেছন থেকে তাকে উদ্দেশ্য করে ডাকা কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেয়ে সে থমকে দাঁড়াল। পেছনে ঘুরতেই দেখল কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে একটা লোককে দাঁড়িয়ে। পরিপাটি চেহারার সাদা পাঞ্জাবির উপর কালো রঙের কোট পরিহিত লোকটাকে দেখে বিস্মিতও হলো সে। লোকটাকে সে চেনে, একসময়ের তুখোড় রাজনীতিবিদ, সাবেক এমপি সৈয়দ মোজতবার মনোজ। বংশ পরম্পরায় যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত। যার পাঁচ পুত্রের ছোটো ছেলেটাকেই আরসালান পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিল…অথচ তৎকালীন এমপি হওয়া স্বত্তেও আজিজ শেখের টাকা আর ক্ষমতার কাছে তিনি হেরে পরাভূত হয়েছিলেন। অনেক বছর আগের ধামাচাপা দেওয়া ঘটনাটি চোখের সামনে ভেসে উঠল ইহসানের। রাশভারি স্বরে জবাব দিলো, “ইহসান, ইহসান শেখ।”
সাবেক এমপি একটু হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন ওর দিকে, সেইসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “বড়ো না তুমি?”

“জি।”
“বাহ, বাহ! আজিজ শেখের বড় চাঁদ, ভাবসাবই আলাদা তোমার। তো আমারে চিনছ তো নাকি?”
ইহসান তীক্ষ্ণ স্বরে উত্তর দিলো, “জি, চিনেছি।”
“কে আমি, কও তো?”
লোকটা ভণিতা করছে বুঝতে পেরে ইহসান বিরক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সৈয়দ মোজতবার মনোজ। সাবেক এমপি আর বর্তমান এমপির বাবা।”

গর্বে যেন বুক ফুলে উঠল সৈয়দ মোজতবার মনোজের। তিনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। কাঁধ চাপড়ে দিলেন ইহসানের। চুপচাপ সেটা সহ্য করল ইহসান। ঝামেলা করার মতো মন-মানসিকতা ওর নেই। এমনিতেই আরসালানের যন্ত্রণায় মন বিক্ষিপ্ত ওর। হতচ্ছাড়াটা জ্ঞান ফেরার পর থেকেই বাড়ি যাব, বাড়ি যাব করছে। ওকে স্বাভাবিক দেখে সৈয়দ মোজতবার ভ্রু কুঁচকে ফেললেও কেশে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়ে বললেন, “তাইলে তো এইটা ভালোই জানো যে, আমার ছোটো ছেলের সঙ্গে তোমার ছোটো ভাই পড়তো। নাম শুনছ তো ওর, সামির। সামিরের বন্ধুই তো তোমার ছোটো ভাই। তা খবর পাইলাম সে নাকি দেশে ফিরছে অনেক বছর পর! ছেলের মতো হয়, তাই ভাবলাম দেইখা আসি। কতদিন দেখি না ওরে….আগে কতো যাইতো সামিরের সঙ্গে আমাদের বাড়ি! তো হাসপাতালে কেন? বেশিই অসুস্থ নাকি ওয়?”

“তেমন কিছু না, জ্বর। দু-একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি জানেন কীভাবে?”
গলা খাকারি দিলো লোকটা, পাশের দু’জন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে হাসলেন। এরপর বললেন, “আমাদের অনেক পোষা কবুতর আছে। তারাই সব খবরাখবর নিয়া আসে। একটা উদাহরণ দেই? তোমার বাপের সঙ্গে তোমার শ্বাশুড়ির বিয়ের প্রস্তাব দিসিলো তোমার ছোটো ভাই, এমন আইকনিক ব্যাপার-স্যাপারও জানি। বুঝোই তো, রাজনীতির মানুষ আমরা। লিংক ভালো থাকতে হয় খুঁটিনাটি সব বিষয়ে!”

একচোখ টিপে গোয়ারের মতোন হো হো করে হেসে উঠল লোকটা। হাসির দমকে শরীরটাও দুলে উঠল তার। কেমন চতুর একটা ভাব ফুটে উঠল চোখে। ইহসানের ভালো লাগল না, সে শক্ত মুখে তাকিয়ে রইল। ওকে ওমন মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসি থামালেন মোজতবার মনোজ। খানিকটা ঝুঁকে এসে তিক্ত স্বরে বললেন, “তো তোমার ভাই কত নম্বর কেবিনে আছে? আসছি যখন দেইখাই যাই। মনটা একটু শান্ত করি। বুঝলা তো, অনেক বছরের আগুন জইমা আছে ভেতরে৷ বাইর হওয়ার জন্য টগবগ করতেসে, বড্ড যন্ত্রণা দিতেসে। ভেতরের আগুন বের করার এখনই যে সময়! তবে তাতে একটা দুঃখিত ঘটনা যে ঘটব, তা ভাইবাই মনটা খারাপ হয়ে আসছে আমার।”
ইহসান তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “কী বোঝাতে চান আপনি?”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭০

“তোমার আব্বা চাইয়া চাইয়া দেখব! তার কিছুই করার থাকব না এইটাই বোঝাতে চাই আমি চাঁদ…”
মোজতবার মনোজের বিদ্রুপাত্মক কথাটা শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে ইহসান বোঝার চেষ্টা করে, লোকটা কী বোঝাতে চাইল!

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২