অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ইহসান তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “কী বোঝাতে চান আপনি?”
“সব পুড়ব, আর তোমার আব্বা চাইয়া চাইয়া দেখব! তার কিছুই করার থাকব না চাঁদ…”
মোজতবার মনোজের বিদ্রুপাত্মক কথাটা শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে ইহসান বোঝার চেষ্টা করে, লোকটা কী বোঝাতে চাইল! খুব ভালো কিছু যে না, সেটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো।

সৈয়দ মোজতবার মনোজ অবশ্য আরসালান ইনজানের কেবিনে প্রবেশের সুযোগ কিংবা
অনুমতি কিছুই পেলেন না৷ তার আগেই বাঁধা পেলেন আজিজ শেখের সেক্রেটারি প্রদীপ বড়ুয়ার কাছ থেকে। প্রদীপ বড়ুয়া কিছুতেই তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিলো না, বরং আজিজ শেখের হুকুম পেয়ে ভীষণ অপমান করে লোক জড়ো করে ফেললেন মুহূর্তের মধ্যে। সাবেক এম পি এবং বর্তমান এম পির বাবা হলেন মোজতবার মনোজ। সাধারণ মানুষের কাছে তার ক্লিন একটা ইমেজ আছে। যদিও সবই উপরে উপরে, ভেতরে ভেতরে শয়তানিতে তিনিও কম যান না। কিন্তু নিজের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতেই আক্রোশ আর প্রতিশোধের আগুন মনে চাপা দিয়েই তিনি হাসপাতাল থেকে প্রস্থান করেন নিজের সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে। ইহসান দেখল, রাগে ফেটে পড়া মুখখানা নিয়ে মোজতবার মনোজ চলে যাচ্ছেন। তার কানে ফোন। ফোনেই কারো উপর উচ্চস্বরে রাগ ঝাড়ছেন। রাগের চোটে তার শরীর কাঁপছে, হাত কাঁপছে। আগ্রাসী কণ্ঠে কাউকে বলছেন, “আমার বুক খালি কইরা পুত্র সুখ করে? ওর পুত্র সুখ কয়দিন টেকে আমিও দেখব।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সন্তানহারা হওয়ার বেদনা ভাষার বাইরে। এটি এমন এক অপরিমেয় শূন্যতা, যা সমস্ত আনন্দকে শূন্যতার গহব্বরে ঠেলে দেয়। জীবনের মূলে আঘাত হানে। সময়ের সাথে যন্ত্রণা হয়তো ম্লান হয়, কিন্তু ক্ষতি থেকে যায় অমোচনীয়। মোজতবার মনোজ অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় ভাবে ছেলেকে হারিয়েছেন।
কিন্তু নিজে ক্ষমতাবান হওয়া স্বত্তেও পাননি সঠিক বিচার। অথচ যার জন্য তিনি সন্তানকে হারিয়েছেন, সে দিব্যি রক্ষা পেয়ে গেছে। আজিজ শেখ তাকে আগলে রেখেছেন। কোনো একটা আঁচও তার শরীরে লাগতে দেননি। ক্ষোভ তো মোজতবা সাহেবের থাকারই কথা। কিন্তু ইহসানের কেন এতো বিরক্তি মোজতবার মনোজের উপর? কেন একটুও ভালো লাগল না বরং রাগ হলো? তার কী এতোটাই স্বার্থপরতা জন্মেছে এ লোকটার প্রতি, যেমনটা সে তার বাবার মধ্যে ঘৃণা করতো? মাসখানিক আগে
নিজ হাতে পা ভেঙে দেয়া, গুলি বিদ্ধ করা ছোটো ভাইটাকে নিয়ে একটু বেশি অন্যরকম ভাবনা ভেবে ফেলে ইহসান। আর সেটা বুঝতে পারা মাত্রই নিজের উপর তার কেমন বিতৃষ্ণা জন্মায়, ঘৃণা লাগে।

আরসালান এখন অনেকটাই সুস্থ, আজিজ শেখ কক্ষে উপস্থিত নেই তবে ইহসান আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষটাতে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। বরং আরসালানের উচ্চস্বর পরিভ্রমণ করছে। বিরক্তি লুকিয়ে ইহসান জোর করে ভাইয়ের মুখে ঔষধ গুঁজে দিয়ে নার্সকে বলে, “একে এভাবে খাওয়াতে হয়, বুঝিয়ে শুনিয়ে না। এ বুঝ নেওয়ার মানুষ না। আস্ত একটা অমানুষ।”

নার্স বেচারি কতক্ষণ ‘হা’ হয়ে তাকিয়ে থেকে নিজের কাজ শেষ করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। যেন এখানে থাকলেই সে দু-ভাইয়ের ঝামেলার মধ্য মণিতে পরিণত হবে। এরচেয়ে যাওয়া যাক, এই আধপাগল রোগীর ব্যপার তার ভাই বুঝে নেবে। নার্স যাওয়ামাত্রই ইহসান খ্যাঁকিয়ে উঠে আরসালানের উপর। যেন সে এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিল, “বদমাইশের বাচ্চা! ঔষধ নিয়েও তামাশা শুরু করেছিস, নতুন নাটক?”
বেডের একপাশে পা ঝুলিয়ে থাকা আরসালান ঘাড়ে হাত রেখে মালিশ করতে করতে হেসে উঠে, “রেগে গেলে এটুকুতেই। অবশ্য রাগাটাই স্বাভাবিক। আমি বুঝি, অনেক দুঃখ তোমার! আচ্ছা, দু’দিন ধরে আমার পেছনে পড়ে আছ, ভালোমন্দের খেয়াল রাখছ। ওদিকে, ল্যাভেন্ডার ভালো আছে? ভেবো না আমি কিছু করেছি। শুধুমাত্র খোঁজ নিচ্ছি।”

হুট করে সৃজার কথা জিজ্ঞেস করায় ইহসান আবারও রেগে গেল, “ভাবি লাগে তোর, বড়ো ভাবি।”
“বা *ল আমার! ভাবিফাবি আমার মুখে আসে না। অবশ্য আনতে চাইও না। আমি ওকে ল্যাভেন্ডার ডাকি আর ডাকবও। তোমার ইচ্ছে করলে তুমি ওকে ভাবিফাবি ডেকো।”
“আমি ওকে ভাবি ডাকব? আমি? ও আমার কবুল পড়া বউ। আমার বাচ্চার মা।”
হটকারী ভঙ্গিতে আরসালান নাক সিঁটকালো, “ছিহ!”
“ইহসান দাঁতে দাঁত চাপলো, “ছিহ মানে?”

ভাইকে রেগে যেতে দেখে মনে পুলক জাগলো আরসালানের। আরো একটু রাগিয়ে দিতে ফিসফিস করে বলল, “কোনো পদ্ধতি-টদ্ধতি ব্যবহার করোনি? বিবাহিত জীবন এঞ্জয় করার আগেই একেবারে দুই দুইটা? আরে আমার নীতিনও তো এসব ব্যাপার ভালো বুঝে। আর তুমি আমার ভাই হয়ে চ্যা*ট বুঝো! বংশরক্ষার নামে ডাবল ডাবল এনে দেশের জনসংখ্যার বারোটা বাজানোর ধান্ধা!”
ইহসান রক্তচক্ষু মেলে তাকাল, “পদ্ধতি তোর বাপের ব্যবহার করা উচিৎ ছিল। তাহলে তোর মতো একটা বদ মাইশের হাত থেকে পৃথিবী বেঁচে যেতো, আমি বেঁচে যেতাম।”
আরসালান চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। পরক্ষণেই নড়েচড়ে উঠে বসে আগ্রহী চিত্তে বলল, “তাহলে আবার দেখা যেতো তোমাকে জ্বালানোর জন্য আমি তোমার ছেলে হয়ে জন্ম নিয়েছি। তখন কী করতে? আমাকে ফেলে দিতে? তোমার তো আবার বাচ্চা প্রীতি আছে।”

কী থেকে কী বলছে, কাকে কী বলছে কোনো জ্ঞান আছে এই শয়তানের। আবার দেখো, হাসছেও। হাসি দেখে কে বলবে এটা বিশ্ব বেহায়া? বরং কুপোকাত হয়ে যাবে। সে ছেলে হোক, বা মেয়ে। ইহসান বিদ্বেষ নিয়ে তাকাল, “বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে জান!”
“মারবে?”
“যদি বাড়ি যেতে চাস তাহলে মুখ বন্ধ রাখ।”
এরপর সত্যিই কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটলো। মিনিট পনেরো হবে। এরমধ্যেই আরসালান পা নাড়াতে লাগল একনাগাড়ে। প্রসঙ্গ বদলে বলল, “তোমার আব্বাজান কোথায় গেল?”
‘তোমার আব্বাজান’ বলাতে ইহসান বিরক্ত হলেও জবাব দিলো, “ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে।”
“আজ বাড়ি যাব না?”
ইহসান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “যাব, একটু সময় লাগবে।”
“কেন?”
“সে তোর ডাক্তার বলবে।”

আরসালানকে মহাবিরক্ত দেখাল, “ঐ টাকলা আবার কী বলবে?”
ইহসান চোখ গরম করে বলল, “জানতে হবে তো তুই আদৌ বাড়ি যাওয়ার জন্য ফিট কি না!”
“আমি চলে যাই, তোমরা ওসব ঝামেলা মিটিয়ে আসো? সত্যি বলছি, ল্যাভেন্ডারের কিছু করব না। আমি শুধু বাড়ি যাব।”
আরসালানকে বেশ অধৈর্য, উত্তেজিত দেখাল। ইহসান বোঝার চেষ্টা করল ওকে। গায়ে হাত দিয়ে তাপমাত্রাও দেখে নিল। আরসালান বিরক্ত ও প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, “এই তুমি বুঝতে পারছ না? আমাকে বাড়িতে যেতে হবে। এখনি যাব। বাড়ি গিয়ে শাওয়ার নিয়ে, ভাত খেয়ে ঘুম দেব। একেবারে রাতে উঠব। এরপর একসঙ্গে কফি পান করব।”
বলার সময় ওর শরীরটা হালকা কাঁপছিল, ঘামছিল। মুখটাও লাল হয়ে উঠল ভীষণ। ইহসান সূক্ষ্ম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় ধীর স্বরে বলল, “সব হবে৷ তবে ডিসচার্জ হওয়া পর্যন্ত থাকতে হবে!”

কিন্তু ডিসচার্জ নিয়ে বাড়ি ফেরার পর আরসালান ইনজান শেখকে শাওয়ার নিতে হলো, ভাত খেতে হলো, ঔষধ খেতে হলো ইহসানের হাতে। এসমস্ত নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে নিজের ঘরে একা হলো যখন, তখন ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন বারোটা ছয়, এ এম। নিজের ঘরের ডেস্কে রাখা সাদা পাউডারের প্যাকেট, ট্যাবলেটের পাতা, তামাকের গুঁড়ো, নীতিনের কিনে দেয়া বেনসন, ডার্বি, বিড়ির প্যাকেট, খালি সিরিঞ্জ এসবের কিছুই পেল না সে। সারাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাভ হলো না। শরীরটা ঘেমে, আগুন গরম হয়ে, গলা শুকিয়ে যখন একাকার? একটুখানি পানির আশায় সে হাত বাড়ালো বেডসাইড টেবিলের দিকে। কিন্তু ভূমিকম্পের ন্যায় কম্পিত হাতটি দুশমনি করল তার সাথে। কাচের জগটাকে ধরতে পারল না। বরং উলটে পড়ে তার শুকনো, খড়খড়ে মেঝেটা ভিজিয়ে দিলো। কিন্তু পানি তো চাই তার! পানি খেতে হবে।

এরপর যা করার, যা খোঁজার খুঁজে নেবে। না পেলে বাবাকে বলবে। আরসালান দরজা খুলে সেই অসুস্থ, অস্থির শরীরটা নিয়ে যখন দোতলার করিডোরে এলো, সে পায়ে কোনো সাড় পেল না। টেনে টেনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে অন্ধকার বসার ঘর পেরিয়ে ডাইনিংয়ের একটা চেয়ার টেনে কোনোমতে বসল, কিন্তু হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা নেওয়ার শক্তি পেল না। থরথর করে কাঁপা হাতটার দিকে তাকিয়ে রইল সে ক্ষুদ্ধ চোখে। এভাবে কতক্ষণ গত হলো সে জানে না। চৈতন্য জাগল তার মেয়েলি সুবাসে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল তৎক্ষনাৎ, পুনমের ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে, গায়ে চাদরের মতো ওড়না জড়িয়ে এসেছে মেয়েটা, পানি নিতে।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭১

আবার তার দিকেও একগ্লাস বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটার কী জানা নেই, দেখতে পাচ্ছে না তার হাতে একটুও শক্তি নেই? সে তুলতে পারবে না গ্লাসটা? আরসালান বিরক্ত হলো। লেবু রঙের ওড়না পরণে মেয়েটা শারাফকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই সে গুরুগম্ভীর স্বরে ডেকে উঠল, “এই দোয়া! আমার হাত নাড়াতে পারছি না। বোধহয় প্যারালাইজড হয়ে গেছে। গলাটাও শুকিয়ে কাঠ। পানিটা প্রয়োজন। কীভাবে পান করব? কোনো সলিউশন জানা আছে তোমার? তুমি তো সলিউশন জানা মেয়ে।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২ (২)