অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২ (২)
ইসরাত জাহান ফারিয়া
এলিজার পা থমকে গেল। হৃদপিন্ড ধ্বক করে উঠল তার। নিঃশ্বাস আটকে গেল গলার কাছটাতে। চোখেমুখে খেলে গেল প্রবল বিস্ময়। দোয়া? তাকে কী দোয়া বলে সম্বোধন করল লোকটা? না-কি সে কী ভুল শুনল? কতদিন পর কেউ তাকে এই নামে ডাকলো? বাবা ছাড়া এই নামে কেউ তো ডাকতো না তাকে, না এই নামটা কাছের মানুষ ছাড়া তেমন কেউ জানে। এলিজা ধীর গতিতে পেছনে ফিরে স্থবির দৃষ্টি মেলে এলোমেলো চুলে, আলুথালু বেশে চেয়ারে বসে থাকা লোকটার দিকে চাইল। আর সে তাকাতেই উন্মাদ, রক্তাভ পুরুষালি চোখ জোড়ায় ক্ষণিকের কৌতূহল ঝিলিক মেরে পরক্ষনেই যেন দপ করে নিভে গেল। এলিজার দ্বিধা ভরা পেলব মুখ খানার দিকে দৃষ্টি তাক করা আরসালানের ব্যগ্র কণ্ঠটা বলে উঠল, “একজন হসপিটাল ফেরত মানুষ এতো রাতে অহেতুক নিশ্চয় এখানে আসেনি।”
এ বাড়িতে আসার পর থেকে দেখেছে বেশিরভাগ সময় লোকটা নিজের ঘরেই থেকেছে। বের হলেও খুব কম, মাঝে মাঝে রাতে। সামনা-সামনি কয়েকবার পড়লেও সাক্ষাৎ হয়ে উঠেনি। নূন্যতম ফর্মালিটি মেনেও না, কুশল বিনিময়েও না। এলিজাও বলেনি, আরসালান ইনজান শেখও না। বিষয়টা অস্বস্তিদায়ক, কিন্তু কী করবে? ভাইয়াকে বলতে শুনেছে, লোকটা রগচটা, উন্মাদ প্রকৃতির। মানুষকে সহ্য করতে পারে না। সেদিনের কান্ডের পর এটাও জেনেছে লোকটা ড্রাগ এডিক্টেড। এ ধরনের মানুষদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে এলিজা। অথচ এই লোকটা প্রথম কথোপকথনেই ‘তুমি’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করছে, তাকে নির্বোধ বোঝাতে চাইছে? মনে উদ্রেক হওয়া অসংখ্য প্রশ্ন চেপে এলিজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে চট করে বলে ফেলল, “হেতু যদি থেকে থাকে বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এলিজার কথাটা বড্ড রুক্ষ শোনাল। শুনে অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেও ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল আরসালান। অন্ধকারে ডোবা বসার ঘরের ভেন্টিলেটরের ফাঁকফোকর দিয়ে আসা হলদে আলোর সরু রেখায় আলোকিত নারীমুখটা দেখে তার গলাটা শুকিয়ে এলো। আরো বেশি তৃষ্ণা অনুভব করল, কিন্তু পানি খেল না। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে পানির গ্লাসটা মেঝেতে ফেলে, এলিজার মুখে কড়া দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অস্থির ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সিঁড়িতে পা রাখল ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মাঝখানে কী হলো, ধপ করে বসে পড়ল দোতলায় উঠার সিঁড়িটাতে, শার্টের দুটো বোতাম খুলে। ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে এলিজা খেয়াল করল লোকটার হাত ভীষণভাবে কাঁপছে, স্থির থাকছে না। তারপরও লোকটা তাকে কিছু বলছে না, কাউকে ডাকছেও না। পানিটাও ফেলে দিলো। কেন? তার কথায় কী ইগো হার্ট হয়েছে? অবশ্য হবেই তো। লোকটা তার আত্মীয় ঠিক, কিন্তু তার সঙ্গে তো স্বাভাবিক সম্পর্ক বা পরিচয় নেই। যদিও আত্মীয় হলেই যে পরিচিত হতে হবে এমন থিওরিতেও সে বিশ্বাসী না। তারপরেও এমন স্বরে কেন বলল সে কথাটা, যাতে একজন মানুষের পানি খেতেও বাঁধে! এলিজার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেল।
সারা বাড়ি শুনশান নীরব। অন্ধকার বিরাজ করছে চর্তুদিকে। দোতলার সিঁড়ি থেকে আসা হলদে রঙের টিমটিমে বাতিটায় যা একটু আলো এসে আশপাশটা একটু আলোকিত করেছে, তাতে অবশ্য অন্ধকার কাটেনি। বরং ঘন হয়েছে। অসুস্থ লোকটাকে পানি পান করানোর জন্য এতো রাতে কাকে ডেকে আনবে এলিজা, সে ঠিক বুঝতে পারল না৷ দ্বিধায় পড়ে এক মুহূর্ত ভেবে ঠিক করল শারাফকে দিয়ে কাজটা করাবে, কিন্তু দু-চোখে ঘুম নেমে আসা বাচ্চাটার দ্বারা এমন একটা কাজ করাতে তার মন সায় দিলো না। অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলো, সে নিজেই পানি পান করানোর মতো দায়িত্বটা নেবে। শুধুমাত্র অসুস্থ একজন বলে। যেই ভাবা সেই কাজ। যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে আরসালানের মুখের সামনে গ্লাসটা ধরতেই কিছুটা চৈতন্য ফিরল তার। পর মুহূর্তেই লোকটা ভ্রু কুঞ্চন করে, জ্বলজ্বলে চাহনি ছুঁড়ল ওর দিকে।
সেই চাহনির প্রখরতা পরিমাপ করে এলিজা একটু ঘাবড়েও গেল৷ তাতে পুরুষের ধারালো চাহনি যেন আরো গাঢ় হলো। বুকের ভেতরটা দম চাপা অনুভবে পালতৌলা নৌকার ন্যায় দুলতে লাগল আরসালানের। পরমুহূর্তে মাথা নিচু করে সে হেসে ফেলল নিঃশব্দে। কতো মেয়ে তার সংস্পর্শে এসেছে, তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। কিন্তু তার এভাবে কী কোনো মেয়ে কাছে এসেছে? উহু, মনে পড়ছে না তার। যারা আসতো তারা নিজেদের স্বার্থ আদায়ে, কামনা মেটাতে, তাকে প্রলুব্ধ করতে আসতো। অথচ এই মেয়েটা তার রাগ বুঝে, পানি হাতে তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে এসেছে? অ্যামেইজিং ব্যাপারস্যাপার। এসেছে অবশ্য ভালোই হয়েছে। নয়তো এই মেয়েটার চোখে যে সমুদ্র দেখতে পাচ্ছে, একটা আকাশ দেখতে পাচ্ছে সেটা দেখা হতো না। আচ্ছা, সমুদ্র আর আকাশ যে-ই চোখ ধারণ করে, সেই চোখের মালকিন নিশ্চয় যে সে কেউ নয়? লেবু রঙের জামা পরণে মেয়েটার পানে আরসালান সরু অথচ গভীর চোখে তাকিয়ে রয়। এলিজা বুঝতে পারে না লোকটার ওমন দৃষ্টির মানে!
সে গলা খাকারি দেয়, তাতে সম্বিৎ ফিরে আরসালানের। পানি পান করাতে আসা মেয়েটার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই একটানে গ্লাসটা খালি করে ফেলে সে। এরপর খেয়ালে বা বেখেয়ালে এলিজার ওড়নার আঁচলটা টেনে কম্পিত হাতে নিজের মুখ মুছতে শুরু করে। আকস্মিক এমন কান্ডে চমকে উঠে এক ঝটকায় নিজের ওড়না ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায় এলিজা। ভাষাহীন হয়ে গেল সে। বোঝার চেষ্টা করল, ইচ্ছেকৃত না-কি অনিচ্ছাকৃত ভুল এটা? না কি সে ভুল, আসলেই এতকিছু ভেবে কাজটা করেনি লোকটা? আরসালান অবশ্য এমন ভাব করল যেন সে বুঝতেই পারেনি কী করেছে। এলিজা সংযত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আর কিছু প্রয়োজন?”
শরীরে বোধহয় রক্তের ছুটোছুটি, তেজ বেড়েছে। মাথার ভেতরটাও এলোমেলো লাগছে। শরীরের আগুন নিভিয়ে দেয়া ঐ নেশাদ্রব্য যতক্ষণ না তার ভেতরে প্রবেশ করছে, ততক্ষণ এই অস্থিরতা, অশান্তিতে ভুগবে সে। রেলিংয়ে মাথাটা ঠেকিয়ে রাখা সে এলিজার প্রশ্নটা শুনে জবাবে একটা শব্দও ব্যয় করল না। বড়ো করে শ্বাস টানলো। শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে বারবার ভেজানোর চেষ্টা করে প্রশ্নটা ছুঁড়ল আরসালান, ‘‘প্রয়োজন? হু? তুমি হবে না কি?”
এরপর নিভে আসা সচকিত চোখে কেমন করে যে হাসলো এলিজার দিকে তাকিয়ে, মেয়েটা শিউরে উঠে জামার একাংশ মুঠো করে ধরল। বিভ্রান্ত হয়ে দুই সিঁড়ি নিচে নেমে দাঁড়ালো। তা দেখে হো হো করে হেসে ফেলল আরসালান। এলিজা কিংকর্তব্যবিমুঢ়! ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। লোকটার কথাবার্তা, চাহনির ধরণ, হাসি কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে চাইল না সে। শারাফকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েও কোনোরূপ ভনিতা না করেই বলল, ‘‘ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে।”
“ইউ শ্যুড গো নাও।”
এলিজা যত দ্রুত সম্ভব সে ঘরে ফিরতে চায়। কিন্তু এভাবে লোকটাকে ফেলে যাওয়াটা সম্ভব নয় তার পক্ষে, বিবেকে বাঁধছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো, ইহসানকে ডেকে দেবে। তারপর যা করার ভাইয়াই করবে। তাকে অন্তত একটা বেগানা পুরুষকে নিয়ে অস্থির হতে হবে না। এমনিতে যা হয়েছে তা যথেষ্ট! ভাবনার এ পর্যায়ে এসে মনোস্থির করতেই আকস্মিক এলিজার চোখ ইনজান শেখের এমন একটা নিষিদ্ধ জায়গায় চলে গেল যে ও আঁৎকে উঠে নিজের দু-চোখ বন্ধ করে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর তাড়া দেওয়া ভীষণ বিব্রত কণ্ঠে শারাফকে বলল, ‘চলো শারু, আমরা যাই।’
সিঁড়িটার একপাশে দাঁড়িয়ে শারাফ এতক্ষণ হা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তার জান মামাকে। কিন্তু কিছু বলছিল না, মূলত ভয় পাচ্ছিল সে মামাকে। কেননা, এই মামা খুব রাগী। একদম পছন্দ করে না বাচ্চাদের। খুব জোরে ধমক দেয় নয়তো গায়ে হাত তুলে। দু’য়েক বার কেমিকে আনার অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে শারাফের সঙ্গে জান মামার আলাপ হয়নি। অবশ্য ধমক খেতে হয়েছে তখনো। কিন্তু সেই রেশ ধরে যে, মামার ইজ্জত হরণ হতে দেখবে সেরকম অভদ্র, খারাপ বাচ্চাও সে নয়। এলিজ আন্টিকে একটুখানি দাঁড়াতে বলে সে জান মামার কাছে ছুটে গিয়ে কানেকানে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, ‘জান মামা, তোমার প্যান্টের চেইন খোলা।’
একটুও বিচলিত দেখাল না আরসালানকে। কাঠখোট্টা স্বরে বলল, “তাতে তোর কী?”
“লজ্জা মামা। এলিজ আন্টি তোমার ইন্টুপিন্টু দেখে ফেলবে।”
শারাফ এটুকু বলে নিজ হাত দিয়ে মুখ চাপলো। আরসালান বিরক্ত মুখে ধমকে বলল, “দেখুক!
দেখার জিনিসই এসব।”
শারাফের আবার কান্নার মতো পেয়ে গেল। কিন্তু সে কাঁদলো না। ভয়ে ভয়ে মামার প্যান্টের চেইনে হাত দিলো সে, লাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু জোর দিয়ে টানতে পারল না। আরসালান ওর ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেখে যেন খুব মজা পেল। একপলক এলিজাকে দেখে নিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, “তোর এলিজ আন্টি ওদিকে ফিরে আছে। বোধহয় আমার ইন্টুপিন্টু দেখে ফেলেছে। এবার কী হবে রে? আমার মানসম্মান তো গেলই, তোরটাও যাবে।”
ভয়ে, লজ্জায় শারাফের মুখখানি এতটুকু হয়ে এলেও সে বুদ্ধি হারাল না। আচমকা ধপ করে আরসালানের কোলে বসে পড়ে এলিজাকে ডেকে উঠল, “এলিজ আন্টি, তুমি ঘরে যাও। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যাও।”
এলিজা ভীষণ অবাক ও অপ্রস্তুত হয়ে পেছনে ফিরে তাকাল একটুখানি। সংযত দৃষ্টি ওর দিকে নিবদ্ধ
রেখেই বলল, “তুমি যাবে না?”
ব্যাকুল কণ্ঠে বলল শারাফ, “তুমি যাও, তারপর।”
শারাফের কাঁদোকাঁদো মুখ দেখে এলিজা বোধহয়
বুঝে গেল কেন এরকম করছে বাচ্চাটা। বিব্রত হয়ে দ্রুত প্রস্থান করল সেখান থেকে। দ্বিগভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর যাওয়া দেখল আরসালান। এরপর শারাফের গালে একটা চুমু খেয়ে ছেড়ে দিলো। ছাড়া পেয়ে শারাফ এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ছুটে চলে গেল। রেলিংয়ে ভর রেখে আরসালান নিজেও উঠে দাঁড়াল, প্যান্টের চেইন টেনে লাগাল। এরপর নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। ভারসাম্যহীন তার হাঁটার গতি। হাঁটতে হাঁটতেই সে শেক্সপিয়রের পঙক্তি আওড়াল, “সে যতোটা লাজুক, ততোটা সুন্দর। সে তার লজ্জার চেয়েও বেশি সুন্দর।”
ঘরে যাওয়ার পর ইহসান হন্তদন্ত হয়ে তাকে দেখতে এসেছিল। ইনজানের বেশ ভালোই লাগছিল ভাইয়ের এই অস্থিরতা। কিন্তু নিজের শরীরের অস্থিরতায় টিকতে না পেরে যখন ভাইয়ের পাণিপ্রার্থী হলো, জানতে পারল, ঘর থেকে নে শা দ্রব্যগুলো তার ভাইই সরিয়ে দিয়েছে। যাতে সে এগুলো গ্রহণ করতে না পারে। কিন্তু এগুলো ছাড়া সে কী করে নিজের যন্ত্রণা কমাবে? প্রচন্ড রাগে চিসেল দিয়ে একটু একটু করে হাতের চামড়া কেটে র ক্তপাত ঘটিয়ে প্রশান্তি পাওয়ার চেষ্টা করল সে। আর সেই রক্ত দিয়ে আর্ট পেপারে একটা ছবি আঁকল। শেষরাতে যখন আঁকা শেষ হলো, খুব বিরক্তি নিয়ে দেখল তার অঙ্কিত নারীটার চোখ এবং ঠোঁট, হুবহু ঐ অনিতা রেহমানের ছোটো মেয়ে এলিজের মতো। অথচ সে আঁকতে চেয়েছিল বেগুনি ফুল অর্থাৎ ল্যাভন্ডারকে!
দু’দিন যাবৎ ছেলের শরীর গরম। থার্মোমিটার জানান দিচ্ছে তাপমাত্রা খুব একটা সুবিধার নয়। জ্বর-সর্দির মতো অবস্থা। এই নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ইহসান। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ আনা হয়েছে, কিন্তু তাতে তার উদ্বিগ্নতা কমছে না। ছেলেটা এমনিতেই বেশি কাঁদে, কিন্তু অসুখে পড়ার পড় থেকে কাঁদছেও না। অশান্ত ছেলেটা বড্ড শান্ত হয়ে গেছে। কোলে নিলে বুকে মুখ চেপে ঘুমায় সারাক্ষণ। ইহসানের ভালো লাগে না এতো শান্ত বাচ্চাকে দেখে। ছেলে কোলে নিয়ে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়ায় সে। দু’দিন যাবৎ রেস্তোরাঁতেও যাচ্ছে না। তার উদ্বিগ্নতা বুঝতে পারে আজিজ শেখ। তিনি নিজেও ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু সুযোগ পেয়ে ছেলেকে কথা শোনাতে ছাড়েন না। এইতো আজ সকালেই খাবার টেবিলে বসে ইহসানকে বসার ঘরে দেখে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, “বলছিলাম না, বাপ হইলে সব বুঝব? এখন বুঝে তো, সন্তানের কিছু হইলে বুক কেমনে ফাটে? কী আব্বাজান, বুঝো তো?”
ইহসান মুখ বাঁকায়, “আমি তো বুঝি কিন্তু আপনি বোধহয় বোঝেন না।”
আজিজ শেখ ভ্রু উঁচান, “কেন মনে হইলো আমি বুঝি না?”
“বুঝলে তো পায়ে পাড়া দিয়ে খোঁচা দিতে আসতেন না। না যেচে পড়ে কথা বলতে আসতেন।”
“তুমিও তো কম খোঁচা দাও না আমায়।”
“খোঁচা? আমি তো বাস্তব সত্যি শোনাই আপনাকে।”
“বাস্তব পকেটে রাখো আর আমারে আব্বা বইলা ডাইকো আব্বাজান। আমারও তো ইচ্ছা হয় তোমার থেইকা আব্বা ডাক শুনতে।”
খাওয়ার টেবিলে ইমরানও ছিল। সে সচরাচর এসব বিষয়ে নাক গলায় না। কিন্তু আজ বসাল। পরোটাতে ডিম পুরে কামড় বসিয়ে বলল, “হু, মাঝেমধ্যে ডাকলেও পারো। ক্ষতি কী ডাকলে? আমিও তো ডাকি। জানও ডাকে। কয়দিন পরে জানের কুকুর, কেমিও ডাকবে।”
বলে আচমকা হেসে উঠল ইমরান। মিতু কটমট করে চাইল ওর দিকে। পিঠের মধ্যে জোরে চিমটি বসিয়ে দিলো। ইমরান থেমে গিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টি ছুঁড়ল ওর দিকে। ইহসান বিরক্ত হয়ে উঠেই চলে আসে এ পর্যায়ে। সৃজা রান্নাঘরে ছিল, ওকে উঠে যেতে দেখে চলে আসে। করিডোরে পৌঁছাতেই মৃদু স্বরে বলে ইহসানকে, “সবসময় না ডাকো, মাঝেমধ্যে বাবা তো ডাকতেই পারো। আংকেল অনেক আশা করে বোধহয় তোমার থেকে।”
সবকিছু জানার পরেও সৃজা এমন কথা বলে ফেলল? এমনটা ওর থেকে এমন কথা আশা করেনি ইহসান। কাঠখোট্টা কণ্ঠস্বরে বলল, “আমার মায়ের সঙ্গে হওয়া বিভীষিকাময় অন্যায় গুলো জানার পর থেকে আমার আর ইচ্ছে হয় না এই লোকটাকে বাবা বলে ডাকতে। যখনি ভেবেছি ডাকব, তখনি চোখের সামনে মায়ের মুখটা ভেসে উঠে। শব্দ আসে না, আমি পারি না আর ডাকতে। তাই এই লোকের আশাও পূরণ হবে না কখনো, সে যতকিছুই হোক না কেন! তুই পারতি?”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২
এই পৃথিবীর সব মানুষের মনস্তত্ত্ব বোধহয় এক। গর্ভধারিণীর সঙ্গে অন্যায় করা যে কাউকেই, কখনোই ক্ষমা করা যায় না, এমনকি যদি সে তার জন্মদাতা হয় তবুও। ইহসান যেমন পারছে না, সৃজাও বোধহয় পারবে না। সে আড়চোখে ইহসানকে দেখল ঝাপসা দৃষ্টিতে।