অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২ (৪)

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২ (৪)
ইসরাত জাহান ফারিয়া

সন্ধ্যের দিকে ইনজানের চেতনা হালকা হয় তীব্র গা ঘামা ক্লান্তি, গলার মধ্যে শুষ্কতা, মাথাব্যথা নিয়ে।
ধীরে ধীরে চোখ মেলার পর বুঝতে পারে সে বিছানায় উপুড় অবস্থায় শোয়া। যার দরুণ বালিশে তার নাক ঠেকানো, গরম নিঃশ্বাস সেখানে পড়ছে। এতক্ষণ উলটো হয়ে শুয়ে থাকায় ঘাড় টনটন করছে। একটুখানি মুক্ত বাতাসের খোঁজ করা প্রাণটা চিৎ হয়ে শুলো ধীরেধীরে। হাত বুলাতে গিয়ে টের পেল ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মাথাটা একটু নাড়াতেই ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেল তার। শরীরটা অদ্ভুত হালকা, যেন সে শূন্যে ভাসছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি অস্বস্তিকর কিছু একটা… মাথার উপরে কি যেন নেই! সে ধীরে ধীরে হাত তোলে মাথায়, আর মুহূর্তেই গা দিয়ে ঠাণ্ডা ঘাম ঝরতে শুরু করে। চুল নেই! ভয়ানক অবিশ্বাস এক ঝটকায় উঠে বসে ভাঙা আয়নার দিকে তাকাতেই ওর চোখদুটো স্থির হয়ে যায়।

এটা কে?
আরসালান ইনজান শেখ?
তার ওয়েভি লং হেয়ারগুলো আধা ইঞ্চি পরিমাণ হয়ে গেল কীভাবে?
অবিশ্বাস্য ভঙ্গিয়ে ছুটে গিয়ে ফাটলধরা আয়নাটার সামনে দাঁড়ায় সে। দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। ওয়েভি লং হেয়ারগুলোর বদলে আধা ইঞ্চির মতো চুল, পাতলা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে। দাঁড়িগোঁফ ট্রিম করা, কিন্তু খোঁচা খোঁচা রয়ে গেছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে, টিনএজ ছেলেদের মতোন। আরসালানের হাত-পা কাঁপতে শুরু করে নিজের এই জেলফেরত কয়েদির মতোন রুপ দেখে। তার অচেতন অবস্থায় সুযোগ নিয়ে কে করেছে এসব কাজ? কার এতো বড়ো সাহস? জানা নেই, আরসালান ছিঁড়ে ফেলবে তাকে? সবাই তো জানে। সেজন্য কেউ তো কাছেই ঘেঁষে না ভয়ে। তবে অকুতোভয়টা কার? তার ভাইয়ের? ইহসান শেখের? অবশ্য সে ছাড়া আর কে এমন সাহস দেখাবে? কিন্তু ভাই কেন করল তার সাথে এমনটা? কীভাবে করতে পারল? এতো কষ্ট দিয়েও মন ভরছে না তার? সংযমের পরীক্ষা নিয়েও শান্তি হচ্ছে না তার? অস্তিত্বের দিকে হাত বাড়াতেই হলো? আরসালান গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। দেয়ালে থাবা মেরে বলে ওঠে, ”আমার ভালো থাকাতে তোমার সবসময় খারাপ হয়, তাই না ব্রো? এতো ঘৃণা পুষো আমার সবকিছুতে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লাগাতার সে ঘুষি বসায় দেয়ালে, হাত কেটেছিঁড়ে চুইয়ে রক্ত পড়ে তার। বাইরে থেকে বন্ধ দরজাটায় পরপর কয়েকটা লাথি বসায়। অনেকক্ষণ পর ইহসানের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। আরসালানকে থামতে বলছে সে। থামে আরসালান ঠিকই, কিন্তু তার ঘরের ভাঙা আয়নাটাকে আরো চূর্ণবিচূর্ণ করার পর।
দরজা খুলে চৌকাঠেই দাঁড়ায় ইহসান। শীতল চোখে দেখে তার ভাইয়ের দুরবস্থা। ভঙ্গুর দেহটা নিয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। পায়ের নিচে কাচের টুকরো ছড়িয়ে আছে। কেটেছেও অনেকটা। ইহসান কপালে ভাঁজ ফেলে এগিয়ে গিয়ে দেখতে থাকে কোথায়, কোথায় কেটেছে ওর। কিন্তু আরসালান দেয় না। ক্ষোভে সরিয়ে নেয় বারবার।
রুক্ষ স্বরে বলে উঠে, “আমার চুল, দাঁড়ি? আমার
ছেলেধরা ভিশন কোথায় গেল?”

ইহসানের সোজাসাপটা জবাব, “কেটে ফেলেছি।”
“চুল কেটে কি ঠান্ডা করতে চাইলে? আমার তো ঠান্ডা লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে মগজের ভিতরে আগুন জ্বলছে!”
তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখ লাল, কণ্ঠ রুক্ষ। ইহসান মুখ তুলে ওর হাত আবারও টেনে নিয়ে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিতে দিতে বলে, “তুই আগে নিজেকে আয়নায় দেখেছিস কখনও? যা হাল করে রেখেছিস চেহারার, তাতে তোকে শ্মশান থেকে ফেরত আনা লাশ বলেই লাগত। এখন অন্তত একটু মানুষ দেখাচ্ছে।”
আরসালান তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তাই? আমি মানুষ? মানুষ হলে আমাকে বন্দীর মতো রাখা হচ্ছে কেন?”
ইহসান ধীরেসুস্থে ওর হাতের ক্ষত ব্যান্ডেজ করে ওর বিক্ষিপ্ত চোখে চোখ রেখে তাকায়। বলে, “বন্দী থাকতে
চাস না?”

“তুমি চাও?”
“কে চায়?”
“তাহলে আমি কেন চাইব?”
“কারণ তুই খুব বেশি উগ্র।”
“উগ্রতা আটকাতে পারবে এভাবে আমাকে আটকে রেখে?”
“আটকে রাখতে চাইছি না তো।”

ইহসান বলতেই, সটান উঠে গেল আরসালান। এরপর গায়ে থাকা ছেঁড়া গেঞ্জিটা আরো টেনে ছিঁড়ে ফেলে মেঝেতে ছুঁড়ে মেরে টলতে টলতে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কয়দিন পর? তিনদিন। ইহসান কিছু বলল না, না রাগ দেখাল। বরং যেতে দিলো। কারণ আসলেই এভাবে কাউকে আটকে রাখা যায় না। আর সে যা করতে চাইছে, তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। একটু স্পেস দেওয়াই যাক। ইহসান ঘরটা পরিষ্কার করে বেরিয়ে এসে দেখল, মূর্তির মতোন শক্ত হয়ে সোফায় বসে আছে জান। চোখমুখ ভাবলেশহীন। কেমি তার পা চাটছে আর সে কেমির মাথায় হাত ঘষছে। পাশে বসে আজিজ শেখ তার মান ভাঙানোর চেষ্টা করছে। ইহসানের সেখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না। সে চলে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু আজিজ শেখ তাকে চলে যেতে দেখেই বিক্ষিপ্ত গলা চড়িয়ে বললেন, “ওর এই অবস্থা কেন করলা আব্বাজান? কাজটা ঠিক করো নাই তুমি। যা করতে চাইছ মানা করি নাই, কিন্তু চুল ফালানোর কি প্রয়োজন ছিল? বাড়াবাড়ি হইসে এইডা।”
ইহসান সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জবাব দিলো, “যেন দুঃখে আপনার চোখে জল চলে আসে। তো, জল এসেছে? নাকি আসেনি? না আসলে আনুন। কারণ আপনার ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার।”
আজিজ শেখ অগ্নিচোখে দেখলেন ওকে।

শেফালি বুয়াকে কাজে কুটাবাছার কাজের সাহায্য করছিল সৃজা, এলিজা। সন্ধ্যের নাস্তা এবং রাতের রান্না হচ্ছে তিন পদ। ভাত, ডাল আর গরুর মাংস। মাংসের সুঘ্রাণ রান্নাঘরের বাইরে অবধি চলে এসেছে। সোফায় একধ্যানে বসে থাকা আরসালান, এমনকি কেমির নাকেও সেই ঘ্রাণ এসে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেমি তো ওর পায়ের কাছ থেকে উঠে গিয়ে রান্নাঘরের দরজায় বুভুক্ষের মতোন দাঁড়িয়ে থেকে এলিজার থেকে দু টুকরো মাংস নিয়ে এসেছে। দরজার বাইরে বাটিতে তুলে খাচ্ছে। আরসালান চেয়ে চেয়ে দেখে কেমিকে। এ ক’দিন যাবৎ নাওয়া খাওয়া বন্ধ তার। পানি ছাড়া পেটে কিছুই পড়েনি। এখন মাংসের ঘ্রাণ নাকে লাগতেই সে টের পাচ্ছে ভয়ংকর ক্ষুধায় তার পেটে রীতিমতো ইঁদুর নাচছে।

চা বানিয়েছিল সৃজা ইহসানের জন্য। সেটা দিতেই ঘরে যাবে, বসার ঘরের সামনে আসতেই দেখল আরসালান নিস্তেজ ভঙ্গিতে সোফায় শুয়ে আছে। টকটকে লাল চোখ। চেহারার হাল বেহাল। তার উপর নতুন লুকে পনেরো-বিশ বছরের তরুণের মতো লাগছে৷ অথচ লোকটা কী এক জীবনের মায়াজালে আটকে আছে, বেরুনোর চেষ্টা নেই। কেন নেই? সৃজা আগ্রহবোধ করে জানার জন্য। কিন্তু অযাচিত আগ্রহ দেখানো ঠিক হবে না ভেবেই নিজেকে সংযত করে। পরক্ষণেই কী ভেবে ট্রে’টা নিয়ে সে ইল
ইনজানের কাছে গেল। হালকা কেশে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ
করে বলল, “চা খাবেন?”

কীসের ভাবনায় যেন মগ্ন ছিল ইনজান, সৃজার কণ্ঠস্বর শুনে ধ্যানে ফিরল। আশ্চর্য! ল্যাভেন্ডার তাকে চা সাধতে এসেছে? ইম্প্রেসিং! সে ঘাড় নাড়ে, ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে, “কেন খাব?”
তৎক্ষনাৎ কী উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারে না সৃজা। বলে, “কেন খাবেন তা তো জানি না। আমি শুধু অফার করলাম। আপনার প্রয়োজন হলে বা খেতে ইচ্ছে করলে অফার গ্রহণ করতেই পারেন। তাতে শেফ একটু খুশি হবে।”
“শেফ?”
“এইযে, আপনার সামনে দাঁড়িয়ে।”

ইনজানের হঠাৎ খুব মজা লাগল। বাঁকা স্বরে শুধাল, “আচ্ছা, আমি বললেই চা হাজির করবে তুমি?”
“বললেই হাজির করব ব্যাপারটা এমন না। তবে চেষ্টা করা যায়।”
আরসালান নিষ্পলক চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। সৃজা এবারে একটু বিব্রতবোধ করে৷ চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে আবারও বলে, “আপনার চা।”
“চা ভালো বানাও বুঝি?”
“শুধু ভালো না, খুব ভালো বানাই।”
আরসালান ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়, “এতো কনফিডেন্স?”
সৃজা বলে, “সবাই যখন খেয়ে প্রশংসা করে, নিজের কাছেও যখন ভালো লাগে তখন নিজের কাজের উপর, কনফিডেন্স নিয়ে কোনো সমস্যা সন্দেহ থাকার প্রশ্নই তো উঠে না।”
আরসালান হেসে ফেলল, খুব স্বাভাবিক দেখাল ওকে। কে বলবে, লোকটা এডিক্টেড? এই ভাইটার জন্য ইহসান কতোটা দুশ্চিন্তায় আছে, সে তো কাছ থেকে দেখছে।
সৃজার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরুল।

চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে আরসালান বেশ আয়েশ করেই সেটা পান করল। তার বাহ্যিক আচরণেই সৃজা বুঝতে পারে চা-টা ভালো লেগেছে ওর। হুট করে কী হয়, সৃজা রান্নাঘরে গিয়ে থালায় ভাত, তরকারি, সালাদ সাজিয়ে এনে ওর সামনে রেখে বলে, “আপনি তো কিছুই খাননি দু’দিন যাবৎ। এই নিন আজকের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ। ডিনারটা না হয় আরেকটু রাতে নেবেন।”

বেগুনি ফুল তাহলে খেয়াল রেখেছে তার দিকে, সে খাচ্ছে কী খায়নি? আরসালান হতভম্ব হয় না। একটুও না। বরং তার মজা লাগে। পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে। অনিতা রেহমানকে মনে পড়ে। ঐ মহিলার মেয়েই তো ল্যাভেন্ডার। তার দ্বারা এসব যেন খুব স্বাভাবিক। সে ভাতের থালা নিয়ে বাটিতে থাকা সবটা গরুর মাংসের কারি ঢেলে দিয়ে গপাগপ মুখে তুলতে থাকে। সৃজা হতভম্ব হয় ওর খাওয়ার ধরণ দেখে৷ চমকে উঠে বলে, “আস্তেধীরে খান ভাইয়া।”
লোকমা তুলতে তুলতে ইনজান বলে, “ভাইয়া ডেকো না ল্যাভেন্ডার। আচ্ছা, মাংসটা কে রেঁধেছে? তুমি? আসলেই বেস্ট শেফ তুমি!”

নাকেমুখে ভাত, ঝোল মেখে একাকার। প্রশংসা শুনে সৃজা স্তিমিত নেত্রে তাকিয়ে থেকে হতাশ স্বরে জবাব দেয়, “ওটা আমার বোন মানে এলিজা রেঁধেছে।”
তৎক্ষনাৎ খাওয়া থামিয়ে দেয় আরসালান। বিস্ময় নিয়ে তাকায়৷ বলে, “লালপরী রাঁধতেও শিখে গেছে?”
সৃজার তার ভুল শুধরে দিলো, “আমার বোনের কথা বলেছি। এলিজা, আমার ছোটো বোন। ও রেঁধেছে।”
সেই সময়টাতেই ডাক পড়ে সৃজার। ইহসান ডাকছে। চা নিয়ে আসতে কতক্ষণ, জিজ্ঞেস করছে। সৃজা চট করে আরসালানের পানে তাকায়। বিব্রত স্বরে বলে, “আপনার কিছু লাগলে শেফালি খালাকে ডাকবেন। খালা রান্নাঘরেই আছে। আমি একটু আসছি।”
দুটো বাক্য বলেই সৃজা চলে যেতে নেয়, কিন্তু কী মনে করে আবার ফিরে আসে৷ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “একটা প্রশ্ন করি?”
“হাজারটা করো।”
“ল্যাভেন্ডার কে?”

আরসালান রহস্যময় তাকায়। হেসে বলে, “আমার না হওয়া মায়ের মেয়ে। আমার না হওয়া বোন। জানো তো, ওর উপর আমার খুব দরদ।”
বিভ্রান্ত হয় সৃজা। মানে কী, তার ভাবনা ভুল? ঐ-যে শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে একটা পার্সেল এসেছিল ল্যাভেন্ডারের নামে, সেটার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই? কেউ ছিল না তার পেছনে? সৃজা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে আসে। ইনজান ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “আমার না হওয়া বোন৷ তোমাকে আমার ভালো লাগে। এতোই ভালো যে, তোমার অজান্তে তোমার পিছু লেগেছি বহুবার। অথচ তুমি টেরই পাওনি।”

বলে হাসে সে। অনিতা রেহমানের বড়ো মেয়েটাকে কিছুটা ভিন্নভাবেই ভালো লাগে তার। এমন ভালো, যেটা সে ইহসানের সামনেই একাধিকবার স্বীকার করেছে। বিনিময়ে পেয়েছে কেবল তার ভাইয়ের অগ্নিদৃষ্টি। কিন্তু সত্যিই মেয়েটি অসাধারণ! কথাবার্তা, আচরণ, রূপ—সবদিক থেকেই তার মাঝে দশে নয় পাওয়ার মতো কিছু আছে। কিন্তু মেয়েটা উদাসীন প্রকৃতির। নয়তো এতদিনে বুঝে যেত, স্বামীর ছোটো ভাইটি তাকে প্রতিনিয়ত নিরীক্ষণ করছে। অবশ্য পরখ করে বলতে সে যে তার রুপ-সৌন্দর্য দেখে ব্যপারটা কিন্তু এমন না। সে খোঁজে এমন কিছু, যা দেখে তার ভাই ল্যাভেন্ডারের প্রতি নিজের জীবন উজাড় করে দিয়েছে। এ বাড়িতে ফেরার সময় তার ইচ্ছা ছিল ভাইয়ের কাছ থেকে ল্যাভেন্ডারকে ছিনিয়ে নেবে, নিজের করে নেবে। কিন্তু সেদিন ছাদে ভাইয়ের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ক্রোধে হাত কেটে ফেলার পর, লাল জামা পরা মেয়েটা এসে যখন দাঁড়াল, এক মুহূর্তের জন্য তার সবকিছু কেমন থমকে গিয়েছিল। মেয়েটির মুখে কী যেন এক অদ্ভুত সাদৃশ্য ছিল অনিতা রেহমানের সঙ্গে। বহুদিন পর তার ভেতরটা কেমন উলটপালট হয়ে পড়েছিল।

এরপর! জন্ম দায়িনী মায়ের ঘ্রাণ মিশে থাকা এ বাড়িটাতে সে নিজ ঘরে দিনের পর দিন বন্দী থেকেছে। ল্যাভেন্ডারকে নিজের করে পাবার জন্য কিছুই করেনি। কেন করেনি, তা মন জানে না। তবে সেদিন রাতে তৃষ্ণার্ত তাকে পানি খাওয়ানো কিংবা অবচেতনে ভুল ছবি এঁকে ফেলার পরে মন তাকে আবছাভাবে যা জানান দিলো, মনে পড়তেই রান্নাঘরের দিকে চোখ যায় তার৷

খাওয়াদাওয়া সেরে আরসালান টি-টেবিলের উপর থেকে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে চোখ বুলায়। তাতে যুতসই কিছু খুঁজে পায় না। বিরক্ত হয়ে ম্যাগাজিনটা রেখে দেয় সে৷ রান্নাঘরে চোখ যায়, ওখানে এখন কেউ নেই৷ কেমিটা অনেকক্ষণ তার পায়ের কাছে বসে ঝিমুচ্ছে। আরসালানের ইচ্ছে করে ওর ঘুমটা ভাঙিয়ে দিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলে, “ডু ইউ লাভ মি ড্যাডি?”
কেমি লাফিয়ে উঠে তার কোলে আসে, গা ঘেঁষে মাথা ঘষে। মুখ চেটে দেয়। আরসালান ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠে, “তুই আমার মুখ চাটিস, ঘন্টার পর ঘন্টা পাশে বসে থাকিস, এমনভাবে তাকাস যেন আমি তোর গোটা পৃথিবী কিন্তু এসবের মধ্যে ভালোবাসা কোথায় আমি বুঝতে পারি না রে।”
“বোবা প্রাণী কথা বলতে পারলে ঠিকই বলতো, সে আপনাকে কতটা ভালোবাসে। কিন্তু আপনি ওর আচরণ দেখেও বুঝতে পারছেন না?”

কৌতুকপূর্ণ পুরুষালি কণ্ঠ। কানে বাজতেই আরসালান চোখ তুলে তাকায়৷ পরনে প্যাস্টেল ব্লু শার্ট, অফিস ফেরত চেহারার এক যুবক দাঁড়িয়ে। যার মুখে লেগে আছে অমায়িক হাসি। আরসালান আপাদমস্তক তাকে দেখে নেয়। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল আছে, দাঁড়িগোফও আছে ভালোই। দেখেই বিতৃষ্ণা জন্মায় মনে আরসালানের। এ কে? আবার এসে তাকে জ্ঞান দিচ্ছে? তাকে কি চুলের বাহাদুরি দেখাচ্ছে? তার যে নেই এটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাচ্ছে? আরসালানের গা-পিত্তি জ্বলে উঠল।
ততক্ষণে যুবক এগিয়ে এসে পরিচিত হবার জন্য তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “সামনাসামনি দেখা হয়নি তবে আপনাকে দেখেই চিনতে পেরেছি। আপনি ইনজান শেখ। এ বাড়ির ছোটো ছেলে। আমি আকাশ— ইস্মিতার বড়ো ভাই, ইজহান শেখের সমন্ধি।”

আরসালান শুনলো, দেখল তবে হ্যান্ড শেইক করার জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হাতটাতে সে হাত মেলাল না। ভ্রু কুঞ্চন করে রুঢ স্বরে বলল, “তো? আমি কী করব?”
আকাশ কিছুটা অপমানিত হওয়ার কথা, কিন্তু নিজেকে সংযত করে নিলো। এই না হলে শেখ পরিবারের ছেলে? আচরণে যেন বলে দিতে হয়, তারা আজিজ শেখের ছেলে, তারা আলাদা। সে ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল, “আপনি কী করবেন না করবেন, সেটা সত্যিই আপনার ব্যাপার। তবে পরিচিত থাকা ভালো। ভবিষ্যতে, কে জানে, কোনোদিন কোথাও একে-অন্যের কাজে লেগে যেতে পারি।
বাই দ্য ওয়ে, আপনার পোষা প্রাণীটা সুন্দর! নিশ্চয়ই মনিবভক্ত?”

মনিব ভক্ত না কি চোখে দেখতে পাচ্ছে না? রাহে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো ওর হাত। নিশপিশ করতে লাগল একনাগাড়ে৷ কে না কে, তার সাথে যেচে পড়ে এসে কথা বলছে। জ্ঞান দিচ্ছে। তাকে অর্থব বোঝাতে চাইছে। তার বাহ্যিক অবয়ব নিয়ে নিশ্চয় মনে মনে ঠাট্টা করছে? সে পাত্তা দিলো না। ম্যাগাজিনে চোখ বুলাল। আকাশ আর ঘাঁটাল না। তবে অপ্রস্তুত হলো ভীষণ। এরপর যখন সম্বিৎ ফিরল, সে খেয়াল করল শারাফ তার গালে হাত দিয়ে ডাকছে।
আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল।
শারাফকে কাছে টেনে হাঁটুর উপর বসিয়ে হেসে
বলল, “এ দেখি চাঁদ!”
শারাফ গালে মুখে হাত বুলিয়ে দিলো ওর। আকাশ চমৎকার হেসে সেই আদর ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

“তো, কেমন আছ শারু?”
“ফাইন। তুমি?”
“আমিও ভালো আছি।”
“আসবে বলেও আর এলে না কেন তুমি?”
“ব্যস্ত ছিলাম সোনা। এজন্য তো তোমার পাপড় বোনকেও দেখতে আসতে পারিনি।”
শারাফ অভিমানী গলায় বলল, “আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল। আজ এসেও ডাকলে না তুমি আমাকে।”
বাচ্চাটা এত ভদ্র আর মনখোলা, এমনভাবে কথা বলে যে আদর না করে থাকা যায় না। আকাশ ওর কথা শুনে নিজেও মন খারাপের ভান করে বলল, “ভুল হয়ে গেছে সোনা। আমি ভেবেছিলাম তুমি বাড়ি চলে গেছ।”
“মাম্মা বলেছে আমরা আরো থাকব।”
আকাশ ওর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “তাহলে তো ভালো হলো। পাপড়কে দেখতে আসলে তোমার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে।”

“তুমি আমাদের বাড়িও যেও। আমি আমার সব টয়সগুলো তোমাকে দেখাব। আর এখানে তো কেমিও আছে, আসো তোমাকে দেখাই। এই কেমি এখানে আসো।”
বলে শারাফ কেমিকে ডাকল। ভীষণ উৎসাহিত দেখাল ওকে। ততক্ষণে অবশ্য পরিচিত মুখ দেখে কেমি নিজেই এগিয়ে গেছে শারাফের কাছে।
শারাফ আকাশের সঙ্গে কেমিকে পরিচয় করিয়ে দিলো। আদুরে চেহারার প্রাণীটাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায় না তার মালিকের রুক্ষ আচরণের জন্য। আকাশ কেমির গায়ে হাত বুলিয়ে আদর দিতেই কেমিও মিশে যায় তার সঙ্গে। তার চকচকে রিস্টওয়াচটা শুঁকতে থাকে। হাত চেটে দেয়। আকাশ হেসে ওর মাথায় হাত রাখে।
কাউকে নিয়ে মাথাব্যথা যেহেতু নেই, এতদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না আরসালানের। ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা বদলের সময় হুট করে কেমিকে আকাশের নিকটে দেখে তার শিরায় শিরায় রাগ ছড়িয়ে পড়ল। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠল, “কেমি, কাম হেয়ার।”

কেমি ওর ডাক শুনে তাকায়, কিন্তু কাছে যায় না। ফিরে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। যেন এই খেলাটা সে বেশ উপভোগ করছে। এটা…এটা বোধহয় প্রথম! কেমির অবাধ্যতা করল জানের সঙ্গে। আরসালানের মেজাজ বিগড়ে গেল। রাগ চরমে উঠল তার। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, “কাম হেয়ার, আদারওয়াইজ তোকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসব।”

মনিবের চিৎকার শুনে কেমি চমকে উঠল। পরক্ষনেই ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে, কুঁইকুঁই করে ক্ষমা চায়। তবুও আরসালানের রাগ কমে না৷ সে চিৎকার করে চাকরকে ডেকে আদেশের সুরে বলল, “এইটাকে এক্ষুনি ভালো করে পরিষ্কার করে আনবি, নয়তো ওকেসহ তোকেও রাস্তায় ফেলে আসব।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২ (৩)

জান মামার রাগ দেখে শারাফ ভয়ে আকাশের হাত আঁকড়ে ধরে বসে। সত্যিই কী, জান মামা কেমিকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসবে? ওর মন খারাপ হয়ে যায়, চোখে জলে টলমল করতে শুরু করে। এদিকে আকাশ হতচকিত। ব্যবহারেই বুঝেছিল লোকটা শর্ট টেম্পার্ড। কিন্তু এমন অভাবনীয় আচরণ করতে পারে সে কল্পনা করেনি। এই লোক কী ইজহান শেখের চেয়েও এককাঠি উপরে?

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২ (৫)