অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৩

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৩
ইসরাত জাহান ফারিয়া

মেয়েটার গা থেকে ফুলের সুবাস তার নাসারন্ধ্রকে অবশ করে দিচ্ছিল। সে বলবে না, নাইস স্মেল? অদ্ভুত! মেয়েটা ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়েছিল তার দিকে। রাগে ঠোঁট কাঁপছিল তিরতির করে। ঐ দুটো ঠোঁট? নাকি গোলাপের পাপড়ি? চোখ আর ঠোঁট দেখেই তো পেটের ভেতর লক্ষ্য-কোটি প্রজাপতি উড়তে শুরু করবে যেকোনো পুরুষের। কামাতুর হয়ে পড়বে তার মতো। ল্যাভেন্ডারও তো তাকে এতোটা আকর্ষণ করতে পারেনি যতোটা এই মেয়েটা করেছে!
সেদিনের ছোট্ট এলিজা রেহমান, সে চকলেট দিয়েছিল। এত দ্রুত বড়ো হয়ে গেল? আরসালান হাসলো একা ঘরে। তার ভেতর সত্তা বলে উঠল, “আমি চাচ্ছি তোমায়, যেমন করে বিষ ছড়িয়ে পড়ে। আমি তোমায় গ্রাস করতে চাচ্ছি, ধ্বংস করেও রেখে দিতে চাচ্ছি৷ বুঝলে তুমি?”

ব্যাপারটা মাথা থেকে কিছুতেই সরছে না এলিজার। রাগে, বিতৃষ্ণায় তেঁতো ঠেকছে, গা গুলাচ্ছে ওর। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে একটু আগের করিডোরের ঘটনাটা। কতোবার উঠে যে চোখেমুখে পানি দিয়েছে, ছোঁয়ার জায়গাটুকু পানিতে ঘষে শুদ্ধ করার চেষ্টা করছে এলিজার তবুও মনে হচ্ছে ইনজান শেখের ছোঁয়া এখনো ওর শরীরে লেগে আছে। লোকটা গা ঘেঁষেছিল ওর বিশ্রি ভাবে। বাহুতে বাহু ধাক্কা লাগছিল। মুখটা কানের কাছে নিয়ে এসেছিল৷ ঘাড়ে নিঃশ্বাস পড়ছিল ওর। ক্ষীণ স্বরে ফিসফিসিয়ে বলা কথাটা শুনে প্রচন্ড বাজে অনুভূতি হচ্ছিলো। মনে পড়লে এখনো গা ঘিনঘিন করছে ওর। নীলু ফুপি এশার নামাজ শেষ করে উঠার পর অনেকক্ষণ যাবৎ ওকে লক্ষ্য করছিলেন। মেয়েটার মলিন মুখ, অস্থিরতা

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দেখে বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেসও করেছিলেন কী সমস্যা ওর। এলিজা কিছুই বলতে পারেনি, উল্টো ফুপির কোলের মাঝে ঠাঁই নিয়েছে। এ কোন ফ্যাসাদে পড়ল সে? ফুপিকে বলল সে, “বাড়ি যাব ফুপি।”
“কাল যাবি? ইহসান তো দেবে না। বলেছে শুক্রবার। যদি রাগ করে?”
এলিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভাইয়া রেগে যাবে এটাও।যেমন ঠিক, তেমনি এই বাড়িতে ঐ নোংরা লোকটার ছায়া মাড়াতে পারবে না এটাও ঠিক। এলিজা আর
ঘর থেকেই বের হলো না।

আজওয়ার নখের খামচিতে আযরানের গালে দাগ পড়ে গেছে। এই নিয়ে কেঁদেকুটে একাকার আযরান। ভাইয়ের কান্নায় তাল মিলিয়ে আজওয়াও কান্না করতে উদ্যত হচ্ছিল, কান্নার ঢেউ উঠার আগেই সুযোগ বুঝে ওকে ইহসানের কোলে এনে দিয়ে গেছে পুনম। মেয়েটা এখন একদম শান্ত। কান্নার ভাবটা নেই। বাবাকে সে চেনে। তার কোলে মুখ রেখে হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করে খেলা করছে। মাঝেমধ্যে হাসতেও দেখা যাচ্ছে তাকে। ইহসান অভিভূত নজরে মেয়েকে দেখল। তার গালের দাঁড়িগুলো আজওয়ার হাতের মুঠোয় আসে। একবার ধরলে সহজে ছাড়তে চায় না মেয়েটা, কী মজা পায় কে জানে৷ ইহসান নিজেও অবশ্য ছাড়ায় না। পরীর মতো মেয়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে হয় না ছাড়াতে। সে মেয়ের হাতের তালুতে চুমু বসিয়ে কপালে আদর দেয়। সন্তানের প্রতি একজন বাবার ভালোবাসা প্রদান কী সুন্দর! প্রয়োজনীয় আলাপের ফাঁকে ফাঁকে আকাশ মুগ্ধ চোখে দেখেই গেল।

চাকুরীজীবি হলেও ছাত্রাবস্থায় আকাশ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পাড়া-মহল্লা, এলাকা, এলাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পেইন এবং সামাজিক কাজ করেছে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়সের, ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে তার উঠাবসা, পরিচয় হয়েছে। সেই সূত্রেই ওর মোটামুটি ধারণা আছে কোন রিহ্যাব সেন্টার বিশ্বস্ত। কোনটাতে আরসালান শেখকে এডমিট করালে আদতেই তার পরিচর্যা হবে, দু-নম্বরি না। ইহসান ওর সঙ্গে আলোচনা করে অনেক তথ্যই জেনে নিলো। আকাশ জানালো, ইনপেশেন্ট ফ্যাসিলিটি সমৃদ্ধ রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার সমন্ধে সে আরো খোঁজ খবর নিয়ে এরপর ওকে জানাবে। বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপনেই ওর সঙ্গে আলোচনা করল ইহসান, যাতে আরসালান জানতে না পারে। জানতে পারলে ও যে কী করবে, ভাবনার অতীত।

ঘড়ির কাঁটা ঢং ঢং শব্দ তুলেছে। সেই শব্দে বসার ঘরে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক আলাপে মগ্ন দুজন পুরুষের গল্পে ভাটা পড়ল৷ তাকিয়ে দেখল এগারোটা বেজে পঞ্চাশ সেকেন্ড। মানে রাত তখন গভীর হচ্ছে। শহরও ঘুমোতে চলেছে। আকাশের মনে পড়ল তার বাবা সিরাজুল ইসলাম একা বাসায়। হয়তো না খেয়ে এখনো তার ফেরার অপেক্ষায় আছেন। গল্প-আলাপের ছলে মাথা থেকে ব্যাপারটা সরে গিয়েছিল তার৷ ব্যতিব্যস্ত হয়ে আকাশ উঠে দাঁড়াল। টি-টেবিলের উপর পড়ে থাকা তার ওয়ালেট
এবং ফোনটা নিয়ে পকেটে পুরতে পুরতে বলল, “অনেকক্ষণ হয়ে গেল। আজ তাহলে উঠি।”
ইহসান ঘুমন্ত আজওয়াকে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে বলল, “যাচ্ছ যাও। তবে যাওয়ার আগে খেয়ে যেতে হবে।”
সময় দেখে নিয়ে আকাশ তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বলল, “বাসায় আব্বু একা। না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আজ পারব না।”

“আংকেল একা, সে কথা ঠিক৷ কিন্তু খেয়ে যেতে হবে তোমাকে। এটা কিন্তু অনুরোধ নয়, আদেশ।”
আকাশ দ্বিরুক্তি করে উঠতেই যাচ্ছিল ইহসান থামিয়ে দিলো ওকে, “উহু, নো আর্গুমেন্ট। এসব বিষয়ে কথা বাড়ালে আমি রেগে যাই। তখন কিন্তু বাড়াবাড়ি করে ফেলি আমি। পাপড়ের পাপার চেয়েও বেশি।”
নিজের দোষ নিজেই বলে বেড়াচ্ছে। আকাশ হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারল না। তবে এটা বুঝল, তর্কে যেয়ে লাভ নেই। ছিঁটওয়ালা মাথার অধিকারী ভাইরা তার পেছনে লেগে থাকবে। সে হতাশ হয়ে দু-হাত উল্টে বলল, “কী আর করার! আর্গুমেন্ট যেহেতু করা যাবে না, মানতেই হচ্ছে।”

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইজহান বলল, “মেনে নিলেই জীবন সুন্দর!”
আকাশও প্রতুত্তরে বলল, “কথাটা ভুল।”
ইজহান রাগী চোখে তাকাল, “ঠিক-বেঠিক শেখাবেন আমায়? আমার টিচার আপনি?”
আকাশের ছোট্ট জবাব, “শিক্ষার কোনো বয়স নেই।”
ইজহান রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগল। আকাশ তা দেখে সৌজন্যমাখা হাসি দিলো, কিন্তু তাতে ইজহানের গায়ে জ্বালা ধরে গেল।

শেফালি বুয়ার সাহায্য নিয়ে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিলো সৃজা। এলিজাকে ডাকলো না। এই মেয়ে এলে সৃজাকে কিছু করতে দিতো না৷ আজ যেমন জোর করে একা হাতে রান্না করেছে তেমনি সব গোছগাছ করে টেবিল সাজিয়ে দিতো। মেয়েটা মাঝেমধ্যে এমন আচরণ করে, যেন তার মা। সৃজা অবশ্য উপভোগ করে ওর কর্তৃত্ব। এই যেমন, ইজহান রাজিই হচ্ছিলো না সকলের সাথে একসাথে বসে খেতে। ইস্মিতা তার পাশে না থাকলে খাওয়া জমে না। এসব বলে বায়না করছিল। এলিজাও নাছোড়বান্দা। ছেলেরা সব একসাথে খাবে, মেয়েরা সব পরে একসাথে বসবে।
তাকে আজ ছেলেদের সাথে বসেই খেতে হবে,

বিকল্প নেই৷ পাপড়ের আব্বু বলে ছাড় দেওয়া যাবে না। ছাড়ও দেয়নি ইজহানকে। অগত্যা কী আর করার, মেয়ে টেনে আনায় ইজহান শেখ ফেলতে পারল না ওর কথা। তাই ইঁচড়েপাকা মেয়েটার রান্না করা গরুর মাংস আর আমের ডাল টেস্ট করতেই বসা। নয়তো এলিজার শত জোড়াজুড়িতেও সে ভেড়া আর হনুমানের সাথে একসাথে খেতে বসতো না। মনকে এই বোঝ দিলো ইজহান। অবশ্য ইমরানকেও খেতে ডেকেছে সৃজা। একবার রাতের খাওয়া সেরে দ্বিতীয়বারের মতো সে খেতে এসেছে, মিতুর শত বারণ উপেক্ষা করে। এজন্য মিতু গাল ফুলিয়ে রেখেছে। ইমরান অবশ্য আজ পাত্তা দেয়নি। এই মহিলার নাটক এখন তার বিরক্ত লাগে।

আজিজ শেখকেও ডাকার কথা ভেবেছিল সৃজা৷ পরে সালেহা বেগম ওকে বলল, তিনি গেলে ইহসান রাগ করে না খেয়েই উঠে যাবে। কী দরকার ছেলেটাকে রাগানোর? সৃজা তার খাবারটা ঘরেই দিয়ে এসেছে। আজিজ শেখ খাবার ফিরিয়ে দিলেন না, স্বাচ্ছন্দ্যে খেয়ে নিয়েছেন। সন্তানরা এক টেবিলে খেতে বসেছে এতেই তার দারুণ সুখ, আনন্দ। তাকে ডাকলো কিনা এতে তার বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। পেটপুরে মাংস-ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলে বললেন, “বহুদিন পরে মনে হইল গোশত খাইলাম। কীসব রান্ধিস-বান্ধিস মুখেও তোলা যায় না।”

সালেহা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ জীবনে তার রান্না, এমনকি তার কোনোকিছু নিয়েই এ লোকটা বিন্দুমাত্র প্রশংসা দূর সহানুভূতির চোখেও দেখেনি। উল্টো করেছে অবজ্ঞা, অবহেলা। এইযে, বাড়ির ছেলেগুলো তাকে মায়ের আসনে না বসাতে পারলেও কোনোদিন তার রান্না নিয়ে কটুক্তি করেনি বরং বিতন্ডতা না করেই খেয়ে নিয়েছে। মুখে ভালোমন্দ স্বীকার না করলেও তাদের চোখেমুখের প্রশান্তিতেই তিনি বুঝে যেতেন কার, কেমন লেগেছে। প্রাপ্তিটুকু নিজেই কুড়িয়ে নিতেন। কিন্তু এই ক্ষমতার দাপট দেখানো লোকটা, তার দুর্বোধ্য স্বামী! সবাই যে রান্না তৃপ্তি নিতে খেতো, তিনি সেটা পরবর্তীতে তার মুখের উপর ছুঁড়ে মারতো। আর আজ এলিজার রান্না খেয়ে বলছে বহুদিন পর সে ভালো রান্না খেলো? সালেহা বেগম পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভালোমন্দ কোনো অনুভূতিই তাকে আর ঘায়েল করতে পারে না। সব অনুভূতি তার মরে গেছে।

টেবিলে বসেছে ইহসান। যদিও ডাইনিংয়ে বসে সে খায় না, কিন্তু সৃজার জোড়াজুড়িতে আজ বসল। আকাশকে বলল, “আজ এলিজ রান্না করেছে। ওর রান্নার হাত ভালো। খেয়ে রিভিউ দিও, কেমন?”
আজকালকার মেয়েরা তো নিজের কাজটুকুই করে না, তার উপর রান্না! হাত পুড়িয়ে রান্না না শেখে এরা ঘরে বসেই অর্ডার করে নয়তো রেস্টরেন্ট এ গিয়ে ডিনার সেরে আসতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সেখানে গরুর মাংসের মতো জটিল একটা পদ এলিজা করে ফেলল? ভালোই লাগল আকাশের। কথায় আছে, রুপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী! এলিজা বোধহয় সেই পর্যায়ের কেউ। সে তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া শুরু করল।

আকাশের পাতে একটু পরপরই তারকারি, ভুনা, ডাল তুলে দিচ্ছে ইহসান। বেশ ভালোই খাতিরদারি করছে সে। অবশ্য মেহমান বলে কথা, আপ্যায়নে ত্রুটি রাখা যায় না। আড়চোখে সেসব দেখে নিলো ইজহান। তার মুখ অন্ধকার। তরকারিটা খেতে অসম্ভব ভালো হয়েছে। কিন্তু আকাশকে আপ্যায়ন করার চক্করে বাটি প্রায় খালি। যদিও খাবার নিয়ে ছোটোলোকি করার লোক নয় ইজহান, এরপরেও মেজাজ খারপ হয়ে গেল। এই ভেড়াটা শালাটাকে এতো আদিক্ষেতা করছে এদিকে তার পাতে যে মাত্র চার টুকরো মাংস পড়েছে সেটা দেখেনি? এত রাগ হলো ইজহানের, বলার বাইরে।

বক্সভর্তি খাবার র‍্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে টেবিলের একপাশে রাখল সৃজা। এরপর সেগুলো শক্ত একটা ব্যাগে ভরতে ভরতে আকাশের উদ্দেশ্যে বলল, “এটা নিয়ে যাবেন ভাইয়া৷ আংকেলের জন্য একটু ভাত-তরকারি আছে এতে।”
আকাশ ওর কান্ড দেখে খাওয়া থামিয়ে বলল,“এসবের আবার কী দরকার ছিল?”
ইহসান গম্ভীরমুখে বলল, “দরকারের কথা আসছে কেন? ভালোবেসে দিয়েছে।”
ইজহান খ্যাঁকিয়ে উঠল, “ভালোবাসা বুঝে নাকি? বুঝে কেবল কীভাবে অন্যের ঘর ভাঙা যায়। পিএইচডিও তো করেছে এই বিষয়ে।”

ইহসান বিরক্ত চোখে ভাইকে দেখল, “আর তুই কী বুঝিস? অন্যের মেয়েকে তুলে আনা ছাড়া? চুপচাপ খা। অসহ্য একটা।”
ইজহানের মুখ থমথমে হয়ে গেল। অগ্নিচোখে ভেড়াকে এরপর হনুমানকে দেখে গালাগাল দিলো মনে মনে। আকাশ ওর রুক্ষ চাহনি দেখে ঝামেলা এড়াতে ইহসানকে বলল, “ওকে ওকে। আমি চুপ৷ কথা বললেই ঝামেলা তৈরি হচ্ছে।”

ইজহান এক লোকমা মুখে তুলে বাঁকা স্বরে বলল, “ঝামেলা যে তৈরি করে, এতদিনে বুঝল হনুমানটা।”
আকাশ ঠোঁটে হাসি বজায় রেখেই ওর দিকে তাকাল। বলল, “জীবন যে কত সহজ, আর সুন্দর করা যায় সেটার একটুখানি অংশ আপনি এই বয়সে এসে বুঝেছেন। বুঝে উপভোগ করছেন। আপনার এই পরিবর্তন চোখে লাগার মতো। ওহ হ্যাঁ, নিজ হাতে খেতে শেখার জন্যেও আরেকটা এপ্রিশিয়েট পাওয়ার যোগ্য আপনি, পাপড়ের পাপা।”
ইজহান খাওয়া থামিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকাল। বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেল না। নাকের ডগা তার টকটকে লাল হয়ে গেছে। এই আকাশটাও কম যায় না, সেই প্রথমদিনের মতোই ইজহানের কথার তালে তাল মিলিয়ে জবাব দিয়ে দেয়। ইহসান বহু কষ্টে নিজের হাসি চাপার চেষ্টা করল, কিন্তু পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সৃজা সেটা বুঝতে পেরে ওর পিঠে খোঁচা দিয়ে চোখ রাঙাল। বিড়বিড় করে বলল, “রেগে গেছে। তুমি হাসিতে ফেটে পড়ে আগুনে আর ঘি ঢেলো না।”

বলে সৃজা রান্নাঘরে চলে গেল। একটা বাহানা দিয়ে ইহসান নিজেও উঠে এলো ওর পেছন পেছন। হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাতটা ধুয়ে চোখমুখ অন্ধকার
করে সৃজাকে জিজ্ঞেস করল, “এই মেয়ে, আমি কোথায় ঘি ঢাললাম? হাসি পেলে হাসব না?”
সৃজা বাঁকা স্বরে বলল, “নিজে যেন ভালো মানুষ?”
ইহসান ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল, “তো খারাপ?”
“তারচেয়েও বড়ো মিচকা শয়তান।”
ইহসান হঠাৎ এঁটো হাত দিয়েই ওর কোমড় চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “ওহ তাই? কীভাবে বুঝলি?”
শক্ত গলায় বলল সৃজা, “বিয়ে কীভাবে করেছিলে আমাকে? থাপ্পড় দিয়ে গালের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলে। অথচ নিজে একই দোষে দোষী হয়ে আবার ভাইকে দোষারোপ করো। হিপ্রোকেট কোথাকার।”

“আমি জোর করলেও জবরদস্তি করিনি।”
“দুটো আলাদা নাকি?”
ইহসান ওর নাকে নাক ঘষে বলল, “আলাদা।”
“ভালোওবাসো দু’জন একই পদ্ধতি অবলম্বন করে, যাতে ছেড়ে না যাওয়া যায়। আবার বলছ আলাদা?”
“আলাদাই।”
“সুবিধাবাদী লোক।”
“তোর বেলায়ই।”
হঠাৎই ইহসান দু’হাতের আজলায় ওর মুখটা নিয়ে কেমন ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “এই সৃজা, আজকাল আমার এতো খালি খালি লাগে কেন বল তো, কম ভালোবাসছিস আমায়? বড্ড পুড়ে বুকটা।”

ওর ব্যাকুলতা ছুঁয়ে গেল সৃজাকে। আশ্চর্য হলো ও! কিন্তু বুঝতে দিলো না। ওকে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, “ছাড়ো আমাকে। খেতে বসে উঠে এসেছে। যত্তসব নাটক। যাও গিয়ে খাওয়া শেষ করো।”
ইহসান ওর ধাক্কায় সরে গেছিল কয়েক পা পেছনে। সৃজা ভেবেছিল ও চলে যাবে, তাই এঁটো প্লেটগুলো পরিষ্কার করতে ডিশ ওয়াশার নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু তা হলো না। আচমকা ইহসান এসে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো করে ওকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। হতভম্ব সৃজা কিছু বলার সুযোগ পেল না তার আগেই ওর ওষ্ঠাধরে অগণিত পুরুষালি ঠোঁটের ছোঁয়া পড়ল। অনাকাঙ্খিত মুহূর্ত তৈরি হওয়ায় সৃজা অবাধ্য হতে চাইছিল ইহসানের। কিন্তু ইহসান ওকে তো ছাড়লোই না উলটো ওকে আরো রাগিয়ে দিতে একহাত ওর কামিজের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে বেসামাল ছোঁয়া দিতে দিতে বলল, “সুবিধাবাদী লোক সুযোগ খোঁজে। তাদের সামনে এভাবে আসা বারণ।”

ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা বেজে বিয়াল্লিশ মিনিটের কাঁটায়। সমস্ত আদর-আপ্যায়ন শেষে বিদায় নিয়ে আকাশ বেরিয়ে পড়তে যাবে, জুতা রাখার র্যাগে গিয়ে সে নিজের জুতা জোড়া খুঁজে পেল না। আশ্চর্য! সে এখানেই রেখে গেছিল জুতা, তাহলে কোথায় গেল? ইস্মি আনাচে-কানাচেতে খুঁজল, জুতার টিকিটাও পেল না। এসব অযাচিত মজা ইহসানের পছন্দ নয়। একজন মানুষের জুতা লুকিয়ে রাখার মধ্যে কী মহত্ম আর মজা আছে? আশ্চর্য! সবাইকে ধমকে একাকার করল সে। বলেছে কে নিয়েছে ওর জুতা, সে যাতে ফিরিয়ে দেয়। মেহমানের সাথে এসমস্ত মশকারি তার একদম পছন্দ নয়। আজিজ শেখও ছেলের সাথে তাল মিলিয়ে একে-তাকে বকতে বকতে বাড়ি মাথায় করলেন। সকলকে উতলা হয়ে উঠতে দেখে আকাশ অপ্রস্তুত বনে গেল। আটশো টাকার জুতা নিয়ে এমন হাঙ্গামার চেয়ে খালি পায়ে কিংবা ইহসানের দেওয়া স্লিপার পায়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়া ভালো। সে সবাইকে শান্ত হতে বলল। কিন্তু আজিজ শেখ খ্যাঁকিয়ে উঠলেন, “না, আমিও দেখমু এই ঘরের শত্রু বিভীষণটা কে? জানার দরকার আছে এই বাড়িতে বইসা কে পেছন মারতেছে। এই খোঁজ তোরা সবখানে।”

কাহিনী দেখে ইজহান এসে ইস্মিকে টেনেটুনে ঘরে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “আর খুঁজে লাভ হবে না। এখানে বসো। ঘেমে কী অবস্থা হয়েছে তোমার!”
বলে ভেজা তোয়ালে দিয়ে ওর চোখমুখ মুছে দিলো। ওর আচরণ দেখে ইস্মির মনে সন্দেহ তৈরি হলো। ভোঁতা কণ্ঠে বলল, “মানে কী? আপনি নিশ্চিত কীভাবে আর খুঁজে লাভ হবে না?”
ইজহান পাংশুটে মুখে তাকিয়ে রইল, জবাব দিলো না।
ইস্মি রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে গেল, “এসব আপনার কাজ তাই না? সব আপনার কাজ। কেন করলেন এই কান্ডটা? ভাইয়া এখন কীভাবে বাড়ি যাবে?”

ধরা পড়ে ইজহান বাধ্য হলো সব স্বীকার করতে। সব শুনে ইস্মির মুখ শক্ত হয়ে গেল। কণ্ঠে নামল অবিশ্বাস্যতা। আকাশের সঙ্গে ইজহান শেখের বনিবনা যে হয় না বিষয়টা ইস্মি ভালোভাবেই জানে।
কিন্তু তাই বলে যে ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে আকাশের জুতা ফেলে দেওয়ার মতো বাচ্চামো কান্ড করতে পারে, তা ভাবেনি। ইস্মি হতাশ, প্রচন্ড হতাশ। এখন কোন মুখে আকাশকে গিয়ে বলবে, তার স্বামী বারান্দা দিয়ে ওর জুতা ঝোপে ফেলে দিয়েছে? রাগে রীতিমতো চোখ ভিজে আসছে ইস্মির।
ইজহান অপরাধী মুখ করে বিছানার এক কোণে বসে আছে। তার শার্টের বোতাম ছেঁড়া, চুল এলোমেলো। ইস্মি রাগ সামলাতে না পেরে ওর চুল টেনেটুনে একাকার করেছে। মেয়ের ভেজা কাঁথা ছুঁড়ে মেরেছে।

গন্ধে যেখানে টেকা দায়, সেখানে কাঁথাটা নিয়ে ইজহান বসেই আছে। প্রথমে জুতা ফেলতে গিয়েও কেমির লেজ কাটার খবর শুনে আর ফেলতে পারেনি। ফিরে এসে আকাশের ঔদ্ধত্যপনা দেখে অর্ধসমাপ্ত কাজটা সে সমাপ্ত করেছে। লোকে বলে, কোনো কাজ আধা করে রাখতে নেই৷ এতে ভালো নয় খারাপই হয়। ইজহান তাই প্রথা মেনে কাজটা যেমন সম্পন্ন করেছে, রাগও মিটিয়েছে। কিন্তু এতে যে বউটা রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করবে তা তো ভাবেনি। কীভাবে তার শার্টের বোতাম ছিঁড়ল, চুল টানল ইচ্ছেমতো! ইজহান হাত দিয়ে দেখল, কয়েকটা চুল উঠে হাতে চলে এসেছে। ওর ভেতরে আতঙ্কের ঢেউ খেলে গেল। সে আবার টাক হয়ে যাবে না তো? কীভাবে পারল এই নিষ্ঠুর কাজটা করতে ইস্মিতা? ইজহানের অভিমান লাগল ভীষণ। আড়চোখে দেখার চেষ্টা করল ইস্মিকে, কিন্তু সরাসরি চোখ তুলে তাকাল না। কারণ তার মেয়েটাও মায়ের কোলে ঘাপ্টি মেরে নিজের ক্ষিধে মেটাচ্ছে। এই মেয়েও জেনে গেছে, সে জুতা চোর।

ইস্মি ওর চোরা চোখের চাহনি দেখে আরো রেগে গেল৷ তিতিবিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি একটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।”
“এই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীটা তোমার কপালে জুটেছে, তার মানে তুমি একেই ডিজার্ভ করতে।”
“পাপ করেছিলাম বোধহয়, তাই।”
ইজহান আঁধার মুখে বলল, “আমাকে পেয়েছ, মানে পুণ্যের ফল।”
“পুণ্য যদি করেই থাকতাম তাহলে অন্তত মাথায় বুদ্ধি আছে এমন কাউকেই পেতাম। পাইনি যেহেতু, এটা নিশ্চিত, পাপীই আমি।”

ইস্মি ক্ষোভে ভরা কণ্ঠে বলতে বলতে মুখ ঘুরিয়ে বসল। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে নিলো। তার জীবন তামা তামা করে দেওয়া এই লোক ভালো হবার নয়, সে বুঝে গেছে। ইস্মির প্রচন্ড রাগ লাগছে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। আকাশকে গিয়ে সে এখন কী বলবে? ইজহান ওর অভিমান বোধহয় বুঝতে পারল৷ তাই নিম্ন স্বরে বলল, “পিউমার জুতা গুলো পড়েই আছে, প্যাকেটও খুলিনি। ভেবেছিলাম নেক্সট মিটিংয়ের দিন পড়ে যাব। ওগুলো দিয়ে দেই?”
ইস্মি ঝাঁঝিয়ে উঠল, “যা খুশি করুন। আমাকে বলবেন তো কিছু একটা করে ফেলব।’’
“কী করে ফেলবে তুমি?”
“ভাইয়ার সাথে চলে যাব।”

কত বড় সাহস! ভাইয়ের সাথে চলে যাবে! রাগতে গিয়েও ইজহান সতর্ক রইল। ভুলভাল কিছু না বলার আপ্রাণ চেষ্টা করে হাসি এঁকে বলল, “আমাকে নেবে না?”
ইস্মিতা অতিষ্ঠ কণ্ঠে জবাব দিলো, “বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী লোক নিয়ে চলার ধৈর্য আমার এতটুকুও অবশিষ্ট নেই। আপনি বাড়িতেই থাকুন আর এর ওর পেছনে লাগুন। আমাকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি দিন।”
“মরণের আগে মুক্তি পাবে না, অবশ্য পরেও না।”
কঠোর গলায় কথাটা বলে ইজহান উঠে গিয়ে তার জুতার র্যাগ থেকে ব্র‍্যান্ডেড নতুন জুতা জোড়া বের করে গটগটিয়ে হেঁটে নিচে চলে গেল। জুতার খোঁজে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় থাকা আকাশের কাছে গিয়ে জুতার বাক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার গিফট হনুমান ভাইয়া।”

আকাশ ভ্রু কুঁচকে ফেলল, “আমার জন্য উপহার?”
“নিজ হাতে কিনেছি।”
অবিশ্বাস্য নজরে চাইল আকাশ, “আপনি?”
“আর কে?”
“মতলবটা কী আপনার?”
“মতলব মানে?”
আকাশের ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি বিদ্যমান, “না মানে, আপনি তো দুচোখে আমাকে সহ্য করতে পারেন না। হঠাৎ এতো দরদ উথলে পড়ছে, দেখে অবাকই হলাম।”
ইজহান কটমট করে বলল, “জুতা জোড়া নিয়ে আমাকে ধন্য করুন হনুমান সাহেব। নয়তো আপনার বোন আমাকে হার্ট-অ্যাটাক করিয়ে দেবে। দুটো চুমুও দেবে না। চুমু না খেলে আমার ঘুমও আসে না।”
এই লোকের ঠোঁটকাটা কথা শুনে আকাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “আপনার যে মাথায় সমস্যা আছে সেটা আরো একবার নিশ্চিত হওয়া গেল।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭২ (৫)

এই বলে ইজহানের দেওয়া জুতার বাক্সটা তার হাতেই ধরিয়ে দিয়ে আকাশ ইস্মির থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। জ্বলন্ত চোখে ইজহান তাকিয়ে দেখল, ইহসানের বাড়িতে পড়ার স্লিপার জোড়া পায়ে দিয়েই আকাশ বেরিয়ে গেছে। তার ব্র‍্যান্ডের জুতা গুলো নিলো না।
সিঁড়ির রেলিঙে উঠে বসে এই পুরো ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখে আপেলে কামড় বসাতে বসাতে আরসালান শেখ ভাবলেশহীন স্বরে বলল, “আমাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে আমার ভাইদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাবি, তোর প্যান্ট খুলে নেব আমি।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৪