অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৪
ইসরাত জাহান ফারিয়া
বর্ষা মৌসুম চলছে। আষাঢ়ের শুরুতে টানা তিন-চারদিন বৃষ্টি হবার পর গত কয়েক সপ্তাহ আর বৃষ্টির দেখা মেলেনি। ঠা ঠা রোদ্দুর ছিল। আজ আবার প্রকৃতি অন্যরকম। রোদে চারদিকে চকচক করলেও তবে তাতে তেজ নেই। বরং এক ধরণের মিষ্টতা জড়িয়ে আছে৷ নীল আকাশটাতে রাশি রাশি মেঘের ভেলা ভাসছে। বাতাস উত্তাল। আবহাওয়ার রুপবদল দেখে এলিজার ধারণা আজ বৃষ্টি হবে। ঝুম বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে নেবে তার মনের সকল ঝড়ো হাওয়া।
গোসল সেরে চুলে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে এলিজা ছাদে এসেছে। উদ্দেশ্য ভেজা কাপড়গুলো শুকানোর জন্য নেড়ে দেওয়া। বালতিতে থাকা একটা একটা কাপড়ের পানি নিংড়ে দড়িতে টানিয়ে, অন্যহাতে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিচ্ছে। মাঝেমাঝে রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, দূরের রেল লাইনে দৃষ্টি দিচ্ছে। পুকুরে ভেসে বেড়ানো হাঁসগুলো দেখছে। আবার কখনো চোখবুঁজে বাতাস অনুভব করছে। আসমানি রঙের ফুল হাতা কামিজে শরীর ঢেকে রাখা মেয়েটার আপাদমস্তক সূঁচালো চোখে পরখ করতে গিয়ে গলাটা বড্ড শুকিয়ে আসে ইটে বাঁধানো পানির ট্যাংকের উপরে শুয়ে থাকা আজিজ পুত্রের।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কনুইয়ে ভর দিয়ে বাহাতের উপর মাথা রেখে এককাত হয়ে শুয়ে শুয়ে নির্নিমেষ দেখতেই থাকে দুটো দিন তার থেকে পালিয়ে বেড়ানো মেয়েটাকে। ইচ্ছে করে মেয়েটাকে সামনে বসিয়ে একধ্যানে তাকিয়ে থাকতে। এতো কেন টানছে এই মেয়েটা তাকে? শরীরে শিহরণ জাগানো মেয়েটার উপর তার আক্রোশ জন্মে খুব। নিঃশব্দে মই বেয়ে ট্যাংকের উপর থেকে নেমে এসে আনমনা মেয়েটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। নাকে আসে উন্মাদনা ছড়ানো সুবাস। ঠিক যেন ল্যাভেন্ডারের সৌরভ আর মিষ্টতা। বিমোহিত হয়ে পড়া আরসালান শেখ আচমকা উন্মত্ত হাতে একটানে পেছন থেকে টেনে মেয়েটাকে নিজের বুকে এনে তার চুলের ভাঁজে নাক ঠেকায়। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে তার। মাতাল মনে হয় নিজেকে। আরেহ! কো কেইনেও তো এতো নেশা ছিল না। না ছিল ও য়াইনে। আরসালান চুলের ভাঁজে মুখ গুঁজে আরো।
অপরদিকে, এলিজার মস্তিষ্ক থমকে যায় কিছু সময়ের জন্য। ধরতে পারে না সে ব্যাপারটা। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে ওর চেষ্টা থেমে যায়
ভার হয়ে আসা পুরুষালি কণ্ঠের গোঙানি শুনতেই।
মনে পড়ে গত দুটো দিন এই নোংরা লোকটার ছায়া যাতে মাড়াতে না হয়, সেভাবেই চলেছে সে এই বাড়িতে। যাতে তার বিগড়ানো মস্তিষ্কের জোরে করা কর্মকাণ্ডের দায়ভার এলিজার উপর না বর্তায়। কেউ যাতে আঙুল উঠিয়ে বলতে না পারে, ‘এলিজা রেহমান তার রুপ দেখিয়ে আকর্ষিত করেছে বিকৃত মস্তিষ্কের আরসালান শেখকে।’
এতোটা সামলে, একপ্রকার লুকিয়ে চলার পরেও আজ এই অবস্থার মুখোমুখি হতে হলো ওকে? ঘৃণায় শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল ওর। প্রচন্ড একটা ধাক্কায় সে এই বিকারগ্রস্ত লোকটার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
শরীরে, হাতে এক ছটাক মাংস নেই, খায়ও না বোধহয় মেয়েটা। হাড্ডি শুধু। গাল লাল হয়ে চিড়বিড় করছে ইনজান শেখের। চোখে ফুটে উঠেছে ক্রোধ। আরে, সে কী পথের কুকুর? ইভটিজার? তাকে কেন এভাবে চড় মারা হলো? সাহস পেল কোথায় এই মেয়েটা?
আরসালান গালে হাত ঘষলো দু’বার। চোখ বুজে ব্যথা গিলে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালালো।
একটা মুহূর্ত সেখানে আর দাঁড়ানোর মতো রুচিতে কুলালো না এলিজার। বালতি, ভেজা জামাকাপড় যেভাবে ছিল সেভাবে রেখেই নিচে চলে এলো। দ্রুতপদে সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে নামলো৷ একেবারে নিচের রান্নাঘরে সৃজার কাছে যাবে ইনজান শেখের নোংরামির ব্যাপারে জানাতে, পেছন থেকে এসে খপ করে ওর হাত টেনে ধরে নিজের গালে ছুঁইয়ে দিলো আরসালান। এত দ্রুত ঘটলো ব্যপারটা যে এলিজা বুঝে উঠতেই পারল না। বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। ইনজান শেখ ফিচেল কণ্ঠে বলল, “ব্যথা সেরে গেছে।”
ঘৃণাভরা কণ্ঠে বলল এলিজা, “আমি ভাইয়াকে সব বলে দেব। আজ, এক্ষুনি বলব।”
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠে তিনটে শব্দ উচ্চারণ করে চলে গেল সে। এলিজা এক ছুটে চলে গেল নিচে রান্নাঘরে। তার বোনের কাছে। গিয়ে হড়বড় করে বলল, “আপু, ভাইয়া কোথায়?”
এলিজা হাঁপাচ্ছে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে মেয়েটার। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। পিঠের অংশ সম্পূর্ণটাই ভেজা। এতো এলোমেলো, বিধস্ত দেখাচ্ছে কেন মেয়েটাকে? সৃজা ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ল। কাছে এসে ওর কাঁধ ধরে বলল, “কী হয়েছে? এমন করছিস কেন? তোর ভাইয়া তো রেস্তোরাঁয়।”
“ফিরবে কখন?”
সৃজা বলল, “সন্ধ্যার দিকে। কিন্তু কী হয়েছে? আমাকে বলবি না? এলিজ, আমি তোর আপু। কিছু একটা হয়েছে আমি বুঝতে পারছি। তুই বল আমাকে কী সমস্যা!”
নোংরা লোকটা তার হাত ধরেছে, চুল ছুঁয়েছে। মনে পড়লেই রাগে গা কাঁপছে এলিজার। বোনকে সরাসরি বলে আর চিন্তা দিতে চাইল না বলেই নিভে গেল এলিজা। বলল, “বাড়ি যাব।”
“শুক্রবারে যাবি কথা তো হয়েই গেছে।”
“আজ যেতে চাই।”
“কিন্তু কেন? কেউ কিছু বলেছে?”
“বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে।”
সচকিত চোখে ওকে পরখ করছে সৃজা। কিছু একটা হয়েছে যে সেটা নিশ্চিত, কিন্তু কী হয়েছে সেটা ধরতে পারছে না। আবার এলিজাও বলছে না। জোর করলেও যে জানা যাবে না এটাও নিশ্চিত। সৃজা এলিজাকে নিয়ে ঘরে চলে এলো। পানি খেতে দিলো ওকে। কিছুক্ষণ পর অশান্ত এলিজা শান্ত হয়ে আসতেই সৃজা নমনীয় হয়ে আগলে নিলো বোনকে। জিজ্ঞেস করল, “কেউ খারাপ ব্যবহার করেছে?”
এলিজার কী যে হলো, মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসলো। জবাব পেয়ে ভেতরে ভেতরে উৎকণ্ঠিত হলেও বাইরে তা প্রকাশ করল না সৃজা। স্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
বলবে কী বলবে না এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলেও এই মুহূর্তে এলিজার মনে হলো বিকৃত চিন্তাধারার আরসালান শেখের কথা সৃজাকে বলে দেওয়াই উচিৎ। এরা যে কতোটা বিপদজনক তা তো সে দেখলই। ওর সঙ্গে যদি এমন করতে পারে, অন্য যে কারো সঙ্গেই জা নো য়ারটা এমন করতে পারবে। একটুও বাঁধবে না তার। নিজের মনকে স্থির করে এলিজা সবটা খুলে বলবে সৃজাকে তার আগেই পুনমের জোরালো কণ্ঠের চিৎকার শুনে থেমে গেল। বিচলিত চিত্তে বলল, “পুনম আপুর গলা না এটা? এভাবে চিৎকার করল যে?”
দু’বোন নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, পরক্ষণে দু’জনেই বেরুলো কী হয়েছে তা দেখার জন্য। পুনমের উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল আরসালানের ঘর থেকে। ততক্ষণে ইস্মিও চিৎকার শুনে বেরিয়েছে। তিনজনে একত্রে সেই ঘরের দিকে গেল। গিয়ে অবশ্য যা দেখল তারজন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। সৃজা ইস্মিকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে ঘরের ভেতর গেলেও এলিজা দরজার বাইরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভিন সেন্ট ভ্যানগগের বিখ্যাত চিত্রকর্ম স্ট্যারীও নাইটের থিমে সিলিং সাজানো৷ লিলাক শেডে মাখানো দেয়াল। ছোট ছোট গাঢ় বেগুনি রঙের ল্যাভেন্ডার আঁকানো তাতে। লক্ষ তারা বাজি অঙ্কিত একটা রুপকথার দেশে এসে পড়েছে বলে বোধ হলো ওর। অথচ রুপকথার দেশের রাজপুত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে কতোটা নিম্নমানের, সেটা মস্তিষ্কে খেলতেই এসব চিত্রকর্মগুলোর প্রতি অসম্মান করা হয়েছে বলেই ঠাহর হলো এলিজার।
কেমিকে আসতে দেওয়া হয় না আরসালানের কাছে। কখন, কী করে বসে কুকুরটাকে তাই। শারাফই সারাক্ষণ ওর সঙ্গে থাকে, খেলে। আজ খেলতে খেলতে একফাঁকে মনিবের ঘরে ঢুকে পড়েছিল কেমি। ভয়ে ভয়ে ওকে আনতে গিয়েই তো শারাফ দেখল জান মামার গাল কেটে রক্ত পড়ছে। এরপর গিয়ে মাম্মাকে ডেকে আনলো সে। পুনম এসে দেখে গালেমুখে রক্ত নিয়ে মূর্তির মতো বসে আছে আরসালান। হাতে একটা রেজার। তাতে লেগে আছে লাল তরল। চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে, শেইভ করতে গিয়ে তার গাল কেটে গেছে। কিন্তু এভাবে কাটবে কেন? শেইভ করলে এভাবে তো ক্ষতবিক্ষত হয় না। দেখে মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে এভাবে কাটা হয়েছে।
পুনমের এতসব প্রশ্নের একটা জবাবও দিলো না আরসালান। এলিজাকে দেখে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল এক পলক। এরপর মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকল। পুনম জোর করে গেল ওকে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে দিতে। আরসালান বাঁধা দিলো ওকে, “তুই কেন লাগিয়ে দিবি? ব্যথা তো তুই দিসনি।”
পুনম হতভম্ব, “নিজেরটা নিজে কীভাবে করবে?”
“করব না।”
“ভাইয়া তুমি পাগল?”
আরসালান ঠান্ডা চোখে তাকাল পুনমের দিকে। পরক্ষণেই ওর হাতে থাকা ফার্স্ট এইডের সমস্ত জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দিলো মেঝেতে। সৃজা আহত গলায় ডেকে উঠল, “পাগলামোই হচ্ছে এটা ভাইয়া।”
শীতল প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আরসালান ওকে, “আমাকে পাগল বলছ?”
“আপনার কাজকর্মে তাই প্রকাশ পাচ্ছে। ক্ষতি যা কিছু তা আপনার হচ্ছে, আমাদের না। পাগলে বুঝে না ওসব।”
শক্ত শোনাল সৃজার কণ্ঠস্বর। ইনডিরেক্টলি পাগলই বলছে তাকে ল্যাভেন্ডার? আরসালানের ভেতরটা রাগে ফেটে পড়ল। এলিজাকে দেখে তার আরো রাগ লাগল। দু’দিনের ছেমড়ি তাকে চড় মারে, তাকে! হাতটা গুঁড়িয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল। দেয়নি বলেই নিজেকে ক্ষত করে রাগ মেটানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল সে, “যারা অন্যের গায়ে হাত তুলে তারা খুব সাধু? আর আমি আদর করি বলে মাথাখারাপ? বৈষম্য করিস? তোদের সব বৈষম্য আমার সাথেই?”
কথাটার মর্মার্থ সৃজা, ইস্মি, পুনম কেউই ধরতে পারল না। তাদের হতাশাযুক্ত চাহনি এই উন্মাদ লোকটার পানেই নিবদ্ধ। এলিজা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। ওর বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না ব্যাপারটা। খানিক আগে তার সঙ্গে করা অসভ্যতামির শাস্তিটা সে এই অসভ্যের বা গালেই দিয়েছিল। আর এখন? অসভ্যটা নিজের গাল নিজেই কেটেছে? এলিজা সেখান থেকে সরে এলো। ঘরে এসে নিজেও মূর্তির মতো বসে রইল কতক্ষণ। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অনেক অনেক প্রশ্ন মস্তিষ্কে উদয় হয়েছে। অথচ সেগুলো শুধুই ওর ধারণা। তাও উন্মাদ লোকটার কিছু কিছু আচরণের থেকেই ধারণা করা। মাথা ভার ভার লাগছে ওর। বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল এলিজা। একসময় শারাফ এসে ওকে ধীরকণ্ঠে ডাকল, “এলিজ আন্টি? শুনছ?”
অস্ফুট স্বরে বলল এলিজা, “হু, সোনা?”
“জান মামা নিজে নিজে গাল কেটেছে।”
এলিজা উঠে বসলো, “তুমি কীভাবে জানো?”
“কেমি ওই ঘর চলে গেছিল। মামা দেখলে মারবে ওকে, আমি ভয় পেয়ে আনতে গেছিলাম। তখনি দেখলাম মামা বসে বসে গাল কাটছে। আমাকে দেখে কী বলল জানো?”
“কী?”
“বলল আমার আর তোমারও গাল কেটে দেবে।”
এলিজা হতবিহ্বল, “আমাদের?”
“হুম।”
“কেন?”
“ওর কেমিকে ধরি তাই।”
এলিজার ঘৃণাটা আরো বাড়লো। ছিহ! কেমিকে নিয়েও কত কী করে বেড়াচ্ছে জা নো য়ারটা।
রিহ্যাব সেন্টারের বিষয়ে খুঁটিনাটি তথ্য জেনে অনিচ্ছাবশত আকাশকে একবার শেখ বাড়িতে যেতে হলো। গিয়ে অবশ্য ইহসানকে সে বাড়িতে পেলো না। জন্মদিনের পার্টি অ্যারেঞ্জের কাজে সে তার স্টাফদের নিয়ে রেঁস্তোরায় ব্যস্ত। ফিরতে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে। অগত্যা কী আর করার! আকাশকে অপেক্ষায় থাকতে হলো ইহসানের। তখন দুপুরের শেষ। ইস্মি জোরাজুরি করে ভাইয়ের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে গেল। বোনের কান্ডে হতাশ আকাশ ইজহান কন্যাকে নিয়ে বসে রইল সোফায়। হাত-পা নেড়ে নেড়ে ছোট্ট ইজহান কন্যা নিজের চঞ্চলতা জানান দিলো মামাকে। আকাশ সব ভুলে সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এই পরীটা ইজহান শেখের ঔরস? কী আচানক ব্যাপার! আকাশ ওর গালে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, ‘মিষ্টি একটা মামণি তুমি। তোমার মাটাও আমার মিষ্টি বোন। তবে তোমার পাপাটা পচা, খুব বেশিই পচা। খুব জ্বালাতন করে আমাকে।’
আকাশ আরো কতো শত কথা বলল, অভিযোগ দিলো ইজহান শেখের নামে তার মেয়ের কাছে, শামিরের উচ্ছ্বাসে তার টনক নড়ল। তাকিয়ে দেখল আকাশ, শামিরের গায়ে কোনো পোশাক নেই। পায়ে বড়ো বড়ো স্যান্ডেল, সম্ভবত আজিজ শেখের। হাতে একটা আধখাওয়া ফিডার। সেটা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে ফর্মুলা দুধ পড়ে সারা গা আঠালো হয়ে আছে ওর। আকাশ ইজহান কন্যার দিক থেকে নজর সরিয়ে ওর দিকে তাকাতেই ‘আকু মামু, আকু মামু’ বলে ছুটে এসে ওর পা ধরে ঝুলে পড়ল শামির। আকাশ ওর কান্ড দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারল না। একহাতে তুলে নিয়ে উরুর উপর বসিয়ে দিলো ওকে। গাল টিপে বলল, “শামির বাবু ভালো আছে?”
মুখ ভার করে শামির বলল, “নেই।”
“কেন?”
কাঁদোকাঁদো কণ্ঠ শামিরের, “মাম্মা বকেচে।”
“কেন বকেছে সোনা বাচ্চাটাকে?”
“ময়লা ধরেচি তাই।”
আকাশ হাসলো, “উমম, এটা তো আসলেই বকার কাজ। কিন্তু শামির বাবুর এ অবস্থা কেন? জামাকাপড় কোথায়?”
শামির হাত-পা নেড়ে বলল, “মাম্মা নেংটু করে দিয়েচে।”
আকাশ ভ্রু কুঁচকাল, “আচ্ছা তাই? তো গোসল নিয়ে পরিষ্কার হয়ে আসা হোক?”
“না না। গোচল ভালো লাগে না।”
“তাহলে তো জীবাণু লেগে থাকবে।”
“জীবাণু ভালো।”
“উহু, পচা। ওসবে জ্বর হবে, শামির বাবুর ইমিউনিটি দুর্বল হয়ে যাবে। একটুও শক্তি থাকবে না। শক্তি বাঁচাতে হলে জীবাণুর সাথে ফাইট করতে হবে, ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে শামির বাবু কতটা স্ট্রং।”
আসলেই তো, শামিরকে স্ট্রং হতে হবে। জীবাণুদের সাথে ফাইট করে ওদের হারিয়ে দিতে হবে। নয়তো লোকে হাসবে। শামির মাথা দুলিয়ে একমত হলো তার আকু মামার সঙ্গে।
আরসালানের ওসব কান্ডের পর অনেক কসরত করে ওকে ব্যান্ডেজ করে দিতে পেরেছে পুনম৷ মূলত সৃজার নাছোড়বান্দা কথার জোরেই এই অসাধ্য সাধন হয়েছে। মাথাটা তাই হ্যাং মেরে ছিল পুনমের। খাওয়া হয়নি বলে ফিডারে একটু ফর্মুলা বানিয়ে শামিরকে খেতে দিয়ে গোসলে ঢুকেছিল পুনম। অথচ শামির না খেয়ে ফর্মুলাটা বারান্দার টবের গাছে ঢেলে দিয়েছে, নিজের মতো ঝাঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে সারা গা ভিজিয়েছে। টবের মাটি খাবলে তুলে শরীর কর্দমাক্ত করেছে। গোসল সেরে এসে ছেলের কান্ড দেখে পুনম হতবাক।
মেজাজ খারাপ ছিল আগেই, দুটো ধমক দিয়ে বসিয়ে যেইমাত্র গেল একটুখানি গরম পানি করে শরীরটা মুছে দেওয়ার জন্য, ফাঁকা পেয়ে ঘরের বাইরে চলে এসেছে শামির। অপরিষ্কার অবস্থায়ই আবার আকাশের উরুতে উঠে বসেছে। পাশেই ইজহান কন্যা আছে। বাচ্চাটার গায়ে লাগবে তো নাকি? খুঁজতে এসে ছেলের কান্ড দেখে রেগে গেল পুনম। আকাশকে সরি বলে ওর কাছ থেকে নিয়ে যাবার জন্য হাত বাড়াতেই মুখ ঘুরিয়ে আকাশের কোলেই ঘাপ্টি মারল শামির। উঠে না আসায় ছেলেকে আরো একটা ধমক দিলো পুনম। মায়ের জোরেশোরে দেওয়া ধমকে শামির আকাশের কোল থেকে নেমে গিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করল। পুনম অপ্রস্তুত ও লজ্জিত হয়ে পড়ল আকাশের সামনে। বলল, “কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। ও ইদানীং একটু জেদী হয়েছে।”
“আমি কিছু মনে করিনি। বাচ্চারা একটু-আধটু এরকম করেই থাকে। এটাতো নরমাল।”
পুনম গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাচ্চাটার সব আজেবাজে স্বভাব তৈরি হয়েছে এই বাড়িতে এসে, আজিজ শেখের আশকারা পেয়ে। তার এক কথা, এতো শান্তশিষ্ট নাতিনাতনি তার দরকার নেই। বাচ্চা-কাচ্চা চুপচাপ থাকলে ভালো লাগে নাকি?
তারা ঘরময় ছুটোছুটি করবে, খেলবে, কাঁদবে, চিৎকার করবে, বায়না করবে এটাই তো সুন্দর!
তাই নাতিদের নিজের কাছাকাছি রেখে বায়না ধরা শিখাচ্ছেন তিনি। শারাফ যদিও বোঝে এসব করা ঠিক নয়, কিন্তু শামিরটাকে একটু একটু করে বিগড়ে ফেলছেন তিনি। এ নিয়ে পুনম খুবই রাগান্বিত আজিজ শেখের উপর। পারতপক্ষে এখন ছেলেকে তার কাছে ঘেঁষতে দেয় না সে। তবুও ক’টা দিন যাবৎ শামির তাকে খুব জ্বালাচ্ছ। ক’টা দিন বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে যদি বাচ্চাদের অভ্যাস-নীতি নষ্ট করে ফেলে, আহাদ কী ভাববে? ও বলল, “আগে এরকম ছিল না, জানেন। এ বাড়িতে আসার পর থেকেই আপনার তালুই মশাইয়ের আস্কারা পেয়ে ও এসব শিখেছে। কী যে করি ওকে নিয়ে!”
“এতো ভাবতে হবে না। বুঝিয়ে বললেই ঠিক হয়ে যাবে। দেখি শামির বাবু এদিকে আসুন তো!
মামা আপনার জন্য ক্যান্ডি এনেছে…”
পকেট থেকে একটা ক্যান্ডি স্টিক বের করল আকাশ। এরপর আবারও আদরের স্বরে ডাকলো শামিরকে। ক্যান্ডি প্যাকেটের মচমচে শব্দ শুনে গড়াগড়ি থামিয়ে উঠে এলো শামির। আকাশের বাড়িয়ে দেওয়া ক্যান্ডিটার দিকে একবার তাকিয়ে এরপর মায়ের দিকে কান্নাভেজা চোখে তাকাল। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল, “মাম্মা, এটা নেই?”
“নাও।”
আকাশ বলল, “তার আগে সরি বলতে হবে মাম্মাকে।
মাম্মা তো শামির বাবুর আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছে।”
শামির মায়ের কাছে গিয়ে তার জামা টেনে ধরে অপরাধী মুখে বলল, “মাম্মাম, চরি।”
“ইট’স ওকে বেবি।”
শামির আচমকা এদিকওদিক সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে মাকে বলল, “শালাফ কুতাই? ওকে লুকিয়ে খাই? চক্লেত খেলে বকা দেয় পচাটা।”
শারাফ সামনে থাকলে ভাই অন্তঃপ্রাণ, এখন সামনে নেই তাই ওকে পচা বলা হচ্ছে। এই ছেলেটা যে হাড়ে-বজ্জাত হবে এটা পুনম টের পাচ্ছে। আকাশ শামিরকে ততক্ষণে পরিষ্কার হয়ে আসার জন্য রাজি করিয়ে ফেলল। ওকে সরি আর থ্যাংক্স জানিয়ে পুনম শামিরকে নিয়ে চলে এলো। করিডোরে উঠতেই আরসালানকে দেখল রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে। পুনমকে দেখেই কটমট করে জিজ্ঞেস করল, “কার্টুনটা আবার এসেছে?”
“কে কার্টুন?”
আকাশকে দেখিয়ে জবাব দিলো আরসালান, “এইটা।”
পুনম বিরক্তি নিয়ে বলল, “ভাইয়া তুমি একটা যা তা।”
বলে চলে এলো। আর দাঁড়াল না ভাইয়ের অবান্তর প্রশ্ন শুনতে। শামির মায়ের গালে চুমু খেয়ে নিজেকে মায়ের গলা আঁকড়ে ধরে বলল, “মাম্মা শালাফকে বেশি লাভ করে? নাকি শামিলকে?”
এসব আবার কেমন ধরনের প্রশ্ন? ছেলেদের সামনে, ওদের বিষয়ে কখনো তো এরকম কিছু মাথায় আসেনি, বলেওনি সে বা কেউ। তাহলে শামির এমন কথা কোথা থেকে শিখলো? পুনম ওর গাল চেপে চুমু খেয়ে বলল, “মাম্মা দু’জন কে সমান ভালোবাসে। কিন্তু তোমাকে এ কথা কে বলল?”
শামির আনমনে জবাব দিলো, “জান মামা।”
সালাদের জন্য টমেটো কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছে ইস্মি। শুনে এলিজা নিজে থেকে এলো ওকে সাহায্য করতে। যদিও ইস্মি মানা করেছিল তাও আকাশের খাবারটা এলিজা বেড়ে দিলো ডাইনিংয়ে। এরপর গিয়ে ওকে ডেকে আনলো। খেতে এসে আকাশ বোনের হাত কেটেছে শুনে কিছুটা রেগেই বলল, “তোর খেয়াল কোথায় থাকে যে হাত কেটে ফেলিস? ইজহান শেখ তো আবার আমার পেছনে লাগবে তার বউ আমাকে খাওয়াতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে শুনলে।”
ইস্মি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “খাও তো ভাইয়া।”
এলিজাও বলল, “জি। খেয়ে নিন ভাইয়া। ইস্মি ভাবিকে একদম লজ্জা দিবেন না। আপনি বড়ো ভাই হোন ওর।”
আকাশ যদিও মজা করেই কথাটা বলেছিল, তবে বোন লজ্জা পাচ্ছে দেখে এই টপিকে আর কথা বলল না। খাওয়ায় মন দিয়ে টুকটাক গল্পসল্প করল বোন আর এলিজার সঙ্গে। ওর খাওয়া শেষ হলো। আরেকটু সময় শারাফের সাথে কাটালো। তারমধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এলো। ইহসানও বাড়ি ফিরলো। রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সব কথাবার্তা নিয়ে নিয়ে আলোচনা হলো দু’জনের। মাসিক খরচ, উন্নত চিকিৎসা, সিকিউরড ইনভায়রনমেন্ট সব মিলিয়ে মিরপুরের সিডি টিএসে রাখার সিদ্ধান্তই উপযুক্ত বলে মনে হলো তাদের।
এরপর ধরণীতে আবার রাত নেমে এলো। ঘড়ির কাঁটা আটটায় পৌঁছালো। সেদিনের মতো দেরি করতে চাইল না বলে আকাশ আজ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতেই ইহসান ওকে নাস্তার জন্য বসিয়ে রাখল। তন্মধ্যে ইজহান শেখ অফিস থেকে ফিরে শালাকে দেখে মুখ বাঁকা করে উপরে চলে গেল। আকাশের ভীষণ হাসি পেল ওর কান্ড দেখে। ইহসান বলল, “পাত্তা দিও না। এ শুধরাবে না। চা টা নাও।”
চা-টা খেয়ে আকাশ বেরিয়েই পড়বে, কী মনে করে ইস্মিকে দিয়ে এলিজাকে ডেকে এনে ওর ফোন নাম্বারটা নিলো। ইহসান ওকে গেইট অবধি এগিয়ে দিতে নিজেও সঙ্গ নিলো। বারান্দা মতো জায়গাটা পেরিয়ে ঘাসে ভরা উঠোনে পা রাখতেই হঠাৎ উপর থেকে, একটা ভারী ফুলের টব এসে আকাশের ঠিক সামনে পড়ল। ইহসান তৎক্ষনাৎ টান দিয়ে সরিয়ে নিলো আকাশকে, ও হুমড়ি খেয়ে ইহসানের উপরে পড়ে গেল৷ অসাবধানতা বশত পড়ে পা মচকে গেল। এলিজা তখনো দরজার কাছেই ইস্মির সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। হুট করে ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ শুনে চোখ তুলে উপরে তাকাতেই একটা ছায়াকে সে সরে যেতে দেখল। এলিজা অবশ্য একা দেখল না, ইহসানও দেখল। তারা দু’জনেই চিনতে পারল, এটা আর কেউ নয়। উন্মাদ আরসালান ইনজান শেখ!
এলিজার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে, সেইরাতে সত্যিই ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল। বৃষ্টির ছোঁয়ায় শেখ বাড়ির বাগানের সবুজ গাছের পাতাগুলো যেমন প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল, তেমনি ফুলেরাও সুবাস ছড়াচ্ছিল। আকাশ নামক কার্টুনটার মাথায় টবটা ফেলার অপরাধে মেরেধরে, ঘাড় ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়ার শাস্তিটা অতোটাও গুরুতর শাস্তি মনে হয় না আরসালানের। শুধু বৃষ্টিতে ভিজে তার ঠান্ডা লাগছিল এই যা! এলিজা রেহমান বোধহয় মমতাময়ী ক্যাটাগরির কেউ, তা নয়তো দুপুরের ঐ কান্ডের পর দারোয়ানকে দিয়ে ছাতা পাঠাবে কেন তার জন্য? অথচ তার নিজের ভাইয়েরা কেউ একবার তার খোঁজও নেয়নি। বাপটাকেও নিতে দেয়নি।
কী পাষাণ আর স্বার্থপর সবগুলো৷ সে তাচ্ছিল্যসরুপ কিছু গালি দিয়ে পরণের ফর্মাল শার্টটা খুলে মাটিতে ছুঁড়ে পা দিয়ে পিষে ছাতা হাতে এরপর গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। টকটকে লাল হয়ে আসা চোখ জোড়া নিয়ে সে আকাশকে উদ্দেশ্যে করে বলে, “বাই* বাচ্চাকে জায়গা দেয়, আমার জায়গা কেড়ে নিয়ে? ওকে আমি শেষ করে ফেলব।”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৩
আজিজ পুত্রকে দেখতে ভয়ংকর লাগছে। তার চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথাগুলো শুনে দারোয়ানের শরীরটা কেমন হিম হয়ে আসে। তার মানসপটে ভেসে উঠে সতেরো-আঠারো বছরের উন্মাদ ইনজান শেখকে। মাকে গালি দেওয়ার অপরাধে যে তারই বয়সী এক বন্ধুকে মেরে ফেলেছিল।