অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৫

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৫
ইসরাত জাহান ফারিয়া

মাঝরাতের আকাশটা কালো মেঘমল্লারে ভরপুর। দুএকটা রাতজাগা পাখি ভেজা অবস্থায় উড়ে যাচ্ছে দখিনা আকাশে। গাছাগাছালি দুলছে হাওয়া পেয়ে। সজীবতা ছড়ানো প্রশান্তিময় প্রকৃতি ঠান্ডা হাওয়ায় গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা! এলিজা ফুপির শিয়র থেকে উঠে জানালাটা বন্ধ করে আবারও শুয়ে পড়ল। মস্তিষ্কে কিলবিল করতে থাকা ভাবনাগুলো ফিরে এলো আবার। গত রাতে শেখ বাড়িতে ঘটা অনাকাঙ্খিত ঝঞ্জাটের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষদর্শী সে। আকাশের কিছু হয়নি ঠিক, তবে মাটি ভর্তি এই টবটা যদি একবার পড়তো, তাহলে মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতে পারতো।

ভাগ্যিস ইহসান ওকে সরিয়ে নিয়েছিল, তবুও বাজেভাবে পা মচকেছে আকাশের। তাই ইহসান যখন নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল, এলিজা আসলেই আরসালান শেখকে বারান্দায় দেখেছে কি-না, এলিজা সত্যটাই বলেছে। এরপর ইহসান এক মুহূর্তও সময় নেয়নি। ঘর থেকে হিড়হিড় করে টেনে নামিয়ে বসার ঘরে এনে আকাশের পায়ের কাছে ফেলেছিল ওকে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল আরসালান শেখ। দশ সেকেন্ডের মাথায় থুতু নিক্ষেপ করেছিল আকাশের উপর। ইহসান ক্ষিপ্ত হয়ে এসে চোয়ালে ঘুষি বসিয়ে দিতেই ঠোঁট কেটে গিয়েছিল লোকটার অথচ বাজে বকা থামায়নি। আকাশ যথেষ্ট ধৈর্যবান পুরুষ। রাগ আর অপমানে মুখখানা থমথম করলেও সে ঝামেলায় জড়ায়নি। নেহাৎই বোনের বাড়ি, আর সে ঝামেলাবাজ মানুষ নয়! তাই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে জোর করে বলেছিল, “ভাইয়া শান্ত হোন। আমার জন্য ঝামেলা করবেন না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার অসম্ভব চেষ্টার পর যে আকাশ কথাটা বলেছিল সেটা তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দেখেই এলিজা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ওর এতটা উদারতা দেখানোর পরেও কোনোরুপ অনুশোচনা দেখেনি এলিজা আরসালান শেখের চোখে। বরং উপহাস দেখেছে। এলিজা তখনি বুঝেছে, এটা খামখেয়ালিপনা নয়, ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিত একটা কাজ। তার উপর আরসালান শেখ যখন জানল এলিজা তাকে দায়ী করেছে, তখন এমনভাবে দেখছিল যেন চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে ওকে।
এলিজা অবশ্য ভয় পায়নি। এ ধরনের কাপুরুষদের ভয় পায় যে, সেও কাপুরুষ! নাকি কা-নারী? জানা আছে কিন্তু এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না এলিজার। একটা ব্যাপারেই খটকা কাটছে না ওর। এ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে গিয়েই ওর মাথার ভেতরটা জট পাকিয়ে গেছে। লোকটা তার মায়ের নাম নিয়ে কিছু একটা বলছিল, বলার সময় চোখেমুখ কেমন হয়ে গিয়েছিল লোকটার!

ইহসান জানে না রিহ্যাবে পাঠানোর ব্যাপারটা আরসালান কীভাবে টের পেয়ে গেছে। সে তো খোলাখুলি আলোচনা করেনি, আকাশের সঙ্গে আলোচনা করেছিল শুধু। তখন কী আশেপাশে ছিল জা নোয়ারটা? হয়তো কোনোভাবে শুনে নিয়েছে। কিন্তু এখানে আকাশের উপর কেন ক্ষিপ্ত আরসালান? ওর উপর কেন আক্রমণ করা হলো? নূন্যতম মানবিকতা, বিবেক নেই ওর মধ্যে। রিহ্যাবের সিদ্ধান্ত তো তার নেওয়া, একান্তই তার৷ তাহলে কেন জান তাকে কিছু না করে আকাশের উপর চড়াও হলো? ফরফর করে শেষরাতের বাতাস এসে ছুঁয়ে দেয় ওকে। ইহসান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে মাথাটা হেলিয়ে বসে। নত দৃষ্টিজোড়া হাতের উপর পড়ে। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে তাচ্ছিল্যের হাসি। গতরাতে আরসালানের ঔদ্ধত্যপনা সহ্য হয়নি। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। ক্ষুদ্ধ অবস্থায় মারতে গিয়েছিল সে জানকে, আজিজ শেখ ছাড়াতে এসেছিল৷ হাতাহাতির সময়টাতেই কেবিনেটের কাচ ভেঙে বাজেভাবে তার হাতে ঢুকেছে। কাটা হাতের চিকিৎসা করানোর মতো মানসিকতা ইহসানের ছিল না। সেই অবস্থাতেই অনবরত থাপ্পড় দিয়েছিল আরসালানের কাটা গালে। ক্ষত হয়ে রক্ত ঝরছিল দুজনের শরীর থেকেই। আজিজ শেখের চেঁচামেচিতে ইজহান এসে তাকে থামায়। ইমরান গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনে। পাঁচটা স্টিচ নিতে হয়েছে ওকে। ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাতটার দিকে তাকিয়ে ইহসানের ভেতরটা বিষিয়ে উঠে।

বেধড়ক মেরেছে সে জানকে। অথচ মার খেয়েও ইনজান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটুও বাঁধা দেয়নি ওকে। বরং গোঁয়াড়ের মতো একটা কথাই বিড়বিড় করছিল, সে আজিজ শেখের ছেলে। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠতে শিখেছে। ওসব রিহ্যাব-টিহ্যাব, জেলখানা তার জন্য না। সে এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। যদি জোরপূর্বক তাকে কিছু করতে বাধ্য করা হয় তাহলে সে কাউকে ছেড়ে দেবে না। আগে যারা বাঁধা হয়ে এসেছিল মাঝখানে, তাদেরকে সে সরিয়ে দিয়েছে৷ এবারও দেবে। সে
যে-ই হোক না কেন, তার ভাইরা ছাড়া। কথাগুলো বলার সময় কী হিংস্র দেখাচ্ছিল ওকে!

ইহসান ওর কণ্ঠস্বরের ভারত্ব শুনে, শীতল চোখের উত্তাপ দেখেই থমকে গিয়েছিল। বেশি সময় লাগেনি, ওর এটা বুঝতে যে, আরসালানকে কোনোভাবেই একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। শত চেষ্টা করেও না। সম্ভব হতো যদি ওর নিজের ভেতর সেই আকাঙ্খা, উদ্দামতা থাকতো, কিন্তু ওর ভেতর সেটা নেই। আর যে মানুষ নিজেকে বদলাতে চায় না, পৃথিবীর সব শক্তি এক হয়ে গেলেও তাকে বদলানো সম্ভব না। এক পর্যায়ে অনিতা মিসকে নিয়েও দুটো কথা বলে ফেলেছিল আরসালান। তৎক্ষনাৎ ওর মুখ চেপে ধরে কথাটুকু ওখানেই থামিয়ে দিয়েছিল ইহসান। কিন্তু ব্যাপারটা কারো খেয়াল হয়েছে কিনা ইহসান নিশ্চিত নয় এখনো। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ইহসান বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছে আরসালানকে। ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সারারাত ফটকের বাইরেই অশ্বত্থ গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল অমানুষটা। কোত্থাও যায়নি। কী পরিমাণ জেদ ওর শরীরে, কী পরিমাণ বিগড়ানো ওর মস্তিষ্ক!

পার্থিব জীবনের এই দোলাচাল তার আর ভালো লাগে না। বুকের ভেতরটা বড্ড হাসফাঁস লাগে। ইহসান বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিৎ! এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া? কিন্তু মায়ের এ ঘরটা ছাড়া সে থাকবে কেমন করে? তার যে অন্য কোথাও প্রশান্তির ঘুম আসে না! গত রাতেও এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমায়নি ইহসান। ব্যর্থতা, অস্থিরতা, দোটানা আর রাগ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। রাগ অবশ্য অন্য কারো উপর নয়, নিজের উপরই। মন বারবার তাকে জানান দিচ্ছে, সৃজাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে সে খুব বড়ো ভুল করেছে। আর এ ভুলের মাশুল গুণতে হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে আতঙ্কে থেকে। খুব বেশি ক্ষতি হতো কী, যদি সৃজা অন্য কারো ঘরণী হতো? না, হতো না। তবে সে একবুক যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতো। পেতো না হয় যন্ত্রণা। তাও সৃজা ভালো থাকতো তো! তার এখানে তো চালচুলোর ঠিক নেই। তার একটুখানি ভালোবাসা ছাড়া কারো আদর পাওয়ার নেই।

এরপরেও মেয়েটা হাসিমুখে সব মেনে নেয়, কোনো অভিযোগ করে না। অভিমান করে ঠিক, কিন্তু বুঝে আবার নিজে থেকেই কাছে টানে। ওর এই আচরণটাই তো ইহসানক্র ঘায়্রল করার মূলমন্ত্র। অথচ এই সরলতার উল্টো পিঠে
নজর দিলে ইহসান পরিষ্কার দেখে, সৃজা রেহমান যদি জানতে পারে, তার মায়ের মৃত্যুর পেছনে শেখ বাড়ির ছোটো ছেলে জড়িত আর সে সব জানে, তাহলে মেয়েটা কী পরিমাণ ঘৃণা করবে ওকে, ভাবতেই শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে ওর, মাথার ভেতরটা দপদপ করতে শুরু করে। মনে হচ্ছে একশো মণ ওজনের ভারী কোনো বস্তা তার মস্তিষ্কে খুঁটি গেঁড়ে বসেছে। চোখদুটো জ্বলছে প্রচন্ড। ইহসান বারান্দা থেকে উঠে গিয়ে বিছানার এককোণে সৃজার পাশে জায়গা বের করল নিজের জন্য। একহাতে সৃজার মাথাটা তুলে অন্যহাতটা গলিয়ে দিলো ওর পিঠের নিচে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল। সৃজা ঘুমের ঘোরে একটুখানি চোখ মেলে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, “সারারাত জেগেছ, এখন ঘুমাও।”

ইহসানের কিছুই ভালো লাগছিল না। বিষাদে নির্লিপ্ত ওর ভেতরটা। তবুও প্রচন্ড তৃষ্ণা নিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে আবদার করল, “একটু আদর করে দে না।”
এক কাত হয়ে ঘুমের ঘোরেই ওর চুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে বিলি কেটে দিলো সৃজা। কণ্ঠমণিতে চুমু খেল। ঠোঁটে আলতো পরশ দিতে দিতে নাকে নাক ঠেকিয়ে বলল, “দিলাম।”
বিষাদ একটুও কমেনি। চারপাশ থেকে কিছু একটা এসে যেন চেপে ধরছে ওকে। ইহসান টি-শার্টের বোতাম খুলে বুকের একপাশ উন্মুক্ত করে ভার স্বরে বলল, “এখানে একটা!”
একপলক তাকাল ওর দিকে সৃজা। এরপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল৷ উন্মুক্ত বুকে ঠোঁট ছুঁইয়ে কান পাতলো সেখানটাতে। হৃদযন্ত্রের গতি অস্বাভাবিক, যেন ট্রেন ছুটছে। সৃজা চেঁচিয়ে উঠল না, গাঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করল, “এতো অস্থিরতা কেন?”

“আমার কিছু ভালো লাগে না সৃজা। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তোর মাথাটা বুকে চেপে রাখি। কোথাও না যাই, কোনো কাজ না করি। শুধু তুই আর আমি থাকি।”
এতোটা অস্থিরতা নিয়ে আগে কখনো কথা বলেনি ইহসান। না এতো অসহায়ভাবে কথা বলেছে। সৃজার ভেতরটা কেঁপে উঠল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস করে ওর গালে হাত রেখে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলল, “তুমি আর আমিই তো আছি।”
“আমাকে কখনো ছেড়ে যাস না সৃজা। তুই ছেড়ে গেলে আমি একটুও বাঁচতে পারব না। মরে যাব। তুই কি চাস আমি মরে যাই?”
সৃজা চট করে উঠে বসল। সন্দেহজনক চোখে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে বলবে খোলাখুলি? এসব আজেবাজে কথা মুখ দিয়ে
আসছে কেন?”

ইহসান বুঝল উত্তপ্ত মস্তিষ্কের দৌরাত্ম্যে সে সিলবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন করে বসেছে। যা উচিৎ হয়নি। উত্তরদাতা ক্ষেপে গেছে। আর এ ক্ষ্যাপা উত্তরদাতাকে সে এভাবে, একটুখানি না অনেকখানিই ভয় পায়। হাসার প্রচেষ্টা করে একহাতে সৃজাকে টেনে নিজের কাছে আনতে চাইল ইহসান, কিন্তু সৃজা জিদ দেখিয়ে সেটা সরিয়ে দিলো। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে ইহসান ওর হাতদুটো মুঠোবন্দী করে ধরে ফেলল আচমকা। এরপর জোর করে বুকে টেনে নিয়ে বলল, “এভাবেই থাক না!”
কঠিন শোনাল সৃজার গলা, “আমি জানি, বুঝি তুমি দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ। সেজন্য বেশি ঘাঁটাই না। স্পেস দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তাই বলে উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবে আমি কিন্তু সেটা মেনে নেব না। আমি সরল হতে পারি কিন্তু সরলতার প্রতিমা নই।”

“আমি জানি সেটা।”
ইহসানের মুখটা দু’হাতে আগলে নিলো সৃজা। ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কী নিয়ে অস্থির হচ্ছ? ভাইয়ার ব্যপারে?”
“ও ঠিক হবে না সৃজা। উল্টো ওকে রেস্ট্রিকটেড রাখতে গেলে ওর নিজের কম আশেপাশের মানুষের ক্ষতি করে বসবে। আকাশের উপর কীভাবে চড়াও হলো দেখলি? অথচ আকাশকে আমি ডেকেছি। ছেলেটার কাছে মুখ দেখানোর জো রাখল না আমার। নেহাৎ আকাশ বুঝদার ছেলে। তাই বুঝতে পেরেছে।”
ইহসানের চিন্তার কারণ শুনে সৃজা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে শুধাল, “তুমি কি চাইছ?”
“সেটা আমি নিজেও জানি না।”

সৃজা ওর মাথাটা বুকে চেপে নিয়ে ছোট্ট করে বলল, “তুমি চেষ্টা করেছ, করছ, করবে এটা কম কিছু না। বাকিটা নিয়তিতে যা আছে তা-ই হবে। তুমি অতিরিক্ত ভেবো না। সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে আপাতত ঘুমাও।”
ইহসানকে বালিশে শুইয়ে দিলো সৃজা। কাঁথাটাও টেনে দিলো ওর পায়ের উপর। এরপর নিজেও ওর বুকে চেপে শুয়ে পড়ল। ইহসান শান্ত গলায় বলল, “শোন না, নীলু ফুপি আর এলিজকে সরি বলার আছে। আমি জোর করে বাড়িতে রেখে দিয়েছি ঠিক, কিন্তু একটা সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ দিতে পারিনি। একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই ছিল। ফুপি তো ঘর ছেড়ে বেরই হয়নি খুব একটা জানের অত্যাচারে। নিশ্চয় খুব বিরক্ত। আমি ক্ষমা চাইবার মতো সাহস পাচ্ছি না।”

নীলু ফুপি নিজ চোখেই দেখছে ইহসানের চেষ্টা, ওর কর্তব্যপালন। সেটা নিয়ে বেশ ক’বার নিজেই সৃজাকে বলেছেন ইহসানকে বলতে, সে যাতে তাদের নিয়ে না ভাবে, এতো অস্থির না হয়, লজ্জা না পায়। অথচ এই লোক লজ্জা, অপরাধবোধে কুণ্ঠিত। সৃজা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “তোমার হয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে নেব। এখন চুপচাপ ঘুমাও।”
সৃজার চুলগুলো নরম, হাত রাখতে ভালো লাগে। ইহসান চুলের ভাঁজে হাত রেখে ইতস্তত স্বরে বলল, “তোকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দেই?”
সৃজা কড়া কণ্ঠে বলল, “না।”
“একটু দেই না!”
“খেয়াল আছে, হাত কেটেছে তোমার? ভালো হাতটার উপর শুয়ে আছি আমি?”

ঝাঁঝালো কণ্ঠের বয়ান শুনে ইহসান চুপ করে গেল।
সৃজা কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করল, মেয়ের ডায়াপার চেঞ্জ করে দিলো। এরপর খাওয়াল। চোখটা লেগে এলো কখন টের পেল না। ইহসান চুপচাপ দেখল তা। সন্তপর্ণে ওকে বালিশে শুইয়ে দিলো সে। কিন্তু তার উষ্ণ শরীরের নড়চড় টের পেতেই আযরানের ঘুম ভেঙে গেল। পুত্রের ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ায় ইহসান অপরাধী চোখে চেয়ে রইল। আযরান কাঁদল না। কপাল কুঁচকে ফেলল। আজকাল অবশ্য আগের মতো ঘুম ভাঙলেই সে কাঁদে না। ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে কাঁদে। ইহসান সেই সময়টুকু ছেলেকে দিলো না। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে নিজে শুয়ে বুকের উপর আযরানকে টেনে নিয়ে একহাতে ছেলের পিঠ ঘষতে লাগল। মানসপটে ছোট্ট একটা স্মৃতি ভাসল ওর। কয়েক মাস বয়সী ছিল ইনজান। তার মা খুব অবহেলা করতো। আজিজ শেখের সাথে কতো রাত সে জানকে নিয়ে মায়ের শিয়রে বসে থেকেছে, ইয়ত্তা নেই। লোকটা মা’কে দিয়ে জোর করে জানকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতো, ব্যর্থ হলে গায়ে হাত তুলতো। ক্ষিপ্ত হয়ে সে একদিন কামড়ে দিয়েছিল লোকটার হাত। আজিজ শেখ হতবিহ্বল হয়ে গেছিলেন। মনে করে উদাস হলো সে।

আযরান ড্যাবড্যাব করে তার বাবাকে দেখছে। তার মুখে দুটো আঙুল। একটু পরপর মুখ থেকে আঙুলগুলো বের করে গো গো শব্দ তুলে বাবার মুখে থাপ্পড় মেরে মেরে সে খেলছে। এই খেলাতে সে ভারী আনন্দ পাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। ইহসান চোখ খুলে ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কপালে দুটো চুমু খেতেই আযরান কী বুঝল কে জানে, খেলা থামিয়ে দিয়ে ইহসানের দিকে তাকিয়ে রইল। ইহসানও ছেলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ওর ছোট্ট হাতটা মুঠোয় পুরে নিয়ে নিজের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে বলল, “তুমি আমায় কবে বাবা ডাকবে?”

গত রাতে শেখ বাড়িতে একটা ঝড় বয়ে গিয়েছিল আরসালানের দৌলতে। মনমেজাজ ভালো না কারোরই। নিজের ভাইয়ের প্রতি এই অসম্মান ইস্মিও মেনে নিতে পারেনি। সারারাত অস্থিরতায় কাটিয়েছে। ইজহানের ইচ্ছে করছিল না, তবুও নতুন ডিলের কাজ আটকে যাবে ভেবে টানা কয়েকদিন অফিস করতেই হবে তাকে। ইস্মিকে আদরটাদর করে একটুখানি মন ভালো করে দিয়ে গেলেও মেয়েটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না তার। তবুও ইস্মির ধমকানিতে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই বের হয়েছিল ইজহান। মরার উপর খাড়ার ঘা! মিজু মরাটার জ্বর, হাফবেলা ছুটি দিয়েছে সে। আজ তাই ইজহানকেই ড্রাইভ করতে হবে। চাবি নিয়ে গ্যারেজে তার প্রাডোটা নিতে এসে তার চক্ষুচড়ক গাছ হয়ে গেল, যখন দেখল ভেড়ার ইয়ামাহা বাইকটা এককাত হয়ে পড়ে আছে। আকস্মিক দেখে উত্তেজনা সামলাতে না পেরে
চেঁচিয়ে মকবুলকে ডেকে খবর পাঠাল সে।

ইজহান শেখ ডাকছে, জরুরি কিছু দেখানোর আছে তার। আধোঘুমের দোলাচলে দুলতে দুলতে বিছানা থেকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসতেই বিরক্ত ইহসান ফটকের ওখানেই থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। মস্তিষ্ক ঝলসে উঠল অজানা আশঙ্কায়। দ্রুত নিচে নেমে গ্যারেজে পৌঁছে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার ইয়ামাহা এমটি-১৫ বাইকটা! চকচকে কালো রঙের দানবটা দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে ওখানে। লুকিং গ্লাস দুটো ঝুলে আছে আধা ভাঙা অবস্থায়। একটার পুরোটা চুরমার হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, আর অন্যটা কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে একপাশে। গিয়ারটা জোর করে ঘুরিয়ে মচকে ফেলা হয়েছে। টায়ারগুলো ফুটো করা, রিমগুলোও আঁকাবাঁকা। ফুয়েল ট্যাংকের গায়ে লম্বা আঁচড়, ধাতব শাঁস উঠে এসে লালচে হয়ে আছে। সিট ছিঁড়ে একপাশ ঝুলে পড়ে আছে, তার নিচে কালো তেলের দাগ এখনো গড়িয়ে পড়ছে কংক্রিটে।

ইহসান কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে মুঠি শক্ত করল। তার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে, চোখের ভেতর জ্বলে উঠছে আগুন। এই বাইকটা সে নিজে পছন্দ করে কিনেছিল সৃজাকে ভার্সিটি নিয়ে যাওয়ার জন্য। কতোশতো স্মৃতি মিশে আছে এটার সঙ্গে! ইহসান চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করে।
কেউ তার বাইকটাকে উন্মাদ প্রতিশোধের শিকার বানাবে এটা সে কল্পনাও করেনি। ইহসান রক্তাভ চোখ মেলে একবার ফিরে তাকিয়ে দেখল, দারোয়ানের ছোট্ট ঘরটাতে হাত-পা মেলে ঘুমিয়ে আছে আরসালান। তাকে খুব নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে!

ইহসান কটমট করে চেয়ে থেকে এরপর গ্যারেজের বাইরে বেরিয়ে এলো। ইজহান বোধহয় বুঝল কী হতে যাচ্ছে এখন, সে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল ইহসানের সামনে। খ্যাঁকিয়ে উঠে বলল, “বাইক ভেঙেছে তাতে বাড়ি মাথায় তোলার প্রয়োজন নেই। আরো একটা কিনে নিলেই চলে৷ টাকা না থাকলে আমাকে বল, কার্ড দিয়ে দিচ্ছি।”
ইজহানের স্যুটের কলার চেপে ধরল ইহসান, “তোর কাছে আমি টাকা চেয়েছি? সবসময় এতো টাকার বড়াই দেখাস কেন আমায়?”
ইজহান অস্পষ্ট শব্দ করে বলল, “না মানে তুই তো ফকির।”
“তোর মনের ফকিরির চেয়ে বড়লোক আমি। এমন দু-চারটে বাইক আমি আমার একমাসের আয় দিয়ে কিনতে পারব। কিন্তু তোদের কী সমস্যা বল তো, তোরা ইমোশন, মেমোরি বুঝিস না। গৎবাঁধা জীবনে টাকা বুঝিস। তাই তোদের জীবনটা এমন এলোমেলো।”

কথায় কথা বাড়ে, ঝামেলা বাড়ে। ইহসান ঝামেলা করার সুযোগ দিতে চায় না আরসালানকে। পরে দেখে নেবে ওকে। নিজেকে সংযত করে বাঁকা হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে কিছুই হয়নি এমন ভান করে সেখান থেকে চলে গেল। এদিকে ভাইয়ের মুখে তাচ্ছিল্যের কথাগুলো শুনে কপালে ভাঁজ ফেলল ইজহান। মানে কী, সে ইমোশন বোঝে না? তাহলে মেয়ে কাঁদলে তার বুক ভার হয়ে আসে কেন? ইস্মিতাকে জোর করে তুলে এনে বিয়ের সময় ওর ঠোঁটে যে লিপস্টিক পরানো হয়নি, বাসররাতে ইস্মিতা যে তার মাথায় দুধের গ্লাস দিয়ে আঘাত করেছিল সেসব মেমোরি তো ঠিকই মনে আছে ইজহানের। সে মেজাজ খারাপ করে বাড়ির ভেতর চলে গেল। ইস্মি ওকে ফিরতে দেখে অবাক হয়ে বলল,

“একী! আপনি ফিরে এলেন যে? কিছু ফেলে গেছেন?”
“না।”
“তাহলে?”
“ভালো লাগে না অফিসে যেতে।”
“কেন?”
ইজহান হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল, “টাইম টু টাইম মেইনটেইন করে অফিস করতে ইচ্ছে করে না৷ ভাবছি ভেড়াটার মতো একটা রেস্তোরাঁ খুলে ব্যবসা করব। যখন ইচ্ছে করবে বাড়ি চলে আসব। ইচ্ছে না করলে সেদিন যাবই না।”
ইস্মি বাঁকা গলায় বলল, “এভাবে তো ব্যবসা লাটে উঠবে।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৪

“কই! ভেড়াটার তো লাটে উঠে না।”
“কিন্তু আপনার উঠবে।”
“কেন?”
“আদিক্ষেতা বেশি আপনার, সেজন্য।”
ইজহান শক্ত চোখে তাকাল ওর দিকে!

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৬