অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৬
ইসরাত জাহান ফারিয়া
আরসালান ইনজান শেখের করা প্রতিটা কাজ মানসিকভাবে পীড়া দিচ্ছে এলিজার মস্তিষ্কে৷ তায়ে মনের শান্তি বিনষ্ট হচ্ছিল ক্রমাগতই। একটা বিকৃত মানসিকতার লোকের জন্য নিজের মনকে অস্বস্তি দিতে সে নারাজ। তাই শুক্রবারের অপেক্ষায় না থেকে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের বাহানা দিয়ে আজকেই বাড়ি যাওয়ার জন্য ইহসানকে রাজি করাল এলিজা। এদিকে বাড়ির অশান্তির মাঝে অতিষ্ঠ ইহসান নিজেও আর চাইল না, ওরা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হোক।
রোদের তেজ কম। বাতাস উত্তাল, শীতল। কদম গাছের পরতে পরতে ঝুলে থাকা গোলগাল হলদে ফুলগুলোর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফুপিকে তাড়া দিলো এলিজা, সব গোছগাছ ঠিকঠাক হয়েছে কি-না সেটা দেখে নিতে। আধভেজা একটা শাড়ি আলাদা করে পলিথিনে মুড়িয়ে ব্যাগের ভেতর রাখতে রাখতে নীলু বেগম বললেন, “তোর বইগুলো আলাদা ব্যাগে নে। এই ব্যাগে রাখলে শাড়ির ভেজা পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যাবে।”
নির্জন নিশীথে যখন শেখ বাড়ির সকলে তন্দ্রায় ডুবে যেতো, মাঝেমধ্যে একাডেমিক বইয়ে চোখ বুলিয়ে নিতো এলিজা। সে পড়ুয়া মেয়ে। ক্লাস টপার। একেবারে পড়াহীন থাকতে পারে না। আগে থেকেই জানা ছিল, এ বাড়িতে লম্বা একটা সময় কাটাতে হবে। তাই আসার সময় সঙ্গে করে নিজের কোর্সের দুটো বই নিয়ে এসেছিল৷ নীলু ফুপি সেগুলোই আলাদা ব্যাগে রাখতে বলছে। এলিজা নিজের টোট ব্যাগে বইগুলো ঢুকিয়ে রাখল।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বইয়ের ও জামাকাপড়ের ব্যাগসহ আরো বাড়তি দুটো ব্যাগ যোগ হলো এবার। একটাতে বিরল ও বিদেশি প্রজাতির কিছু ফুলগাছের বীজ, ডাল, চারা আর কলম। মালি কাকা দিয়েছে ওকে। টবে লাগিয়ে কীভাবে যত্ন করতে হবে সেসবও বিশদভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এবার শুধু টবে আর ছাদে লাগানোর পালা। যখন বীজ বা কলম থেকে চারাগাছ বের হয়ে আস্তে আস্তে বড়ো হয়, ফুল দেয়, ফল দেয়, পৃথিবীটা যেন এক অন্য রকম সুন্দর হয়ে ওঠে। সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার ইচ্ছা থেকে নিজেকে আটকে রাখতে পারে না এলিজা, যেন প্রকৃতি ওর হৃদয়কে নতুন করে প্রাণিত করে।যাইহোক, এই ব্যাগ বাদ দিলেও আরেকটা যে ব্যাগ স্তূপাকারে রাখা আছে তাতে আছে ডিপ করা খাবার-দাবার।
অনেকদিন এক জায়গায় কাটিয়ে গিয়ে হুট করে, অসময়ে বাড়িতে ফিরে সব গুছিয়ে, বাজারসদাই করে রান্নাবান্না করা মস্ত ঝামেলার কাজ। তাছাড়া নীলু ফুপির শরীরটাও ভালো নেই। ডাক্তার বলেছে যথাসম্ভব বিশ্রামে থাকতে তাকে। অগত্যা এলিজাকেই সব করতে হবে। তাই রাতেরসহ পরদিনের রান্না করে সৃজা টিফিন ক্যারিয়ারে গুছিয়ে দিয়েছে। বাড়ি গিয়ে ডিফ্রোস্ট করে গরম করে নিলেই চলবে। সঙ্গে করে এতসব খাবার দিয়ে দেওয়ায় নীলু বেগম আর এলিজা বেশ বিব্রত হয়ে গেলেও ইহসান গমগমে স্বরে বলল, ”পিঠাপুলি, পোলাও-মাংস, ফলফলাদি আমিও কম কিনি না। তারপরও শ্যাওড়াপাড়ার নাইমুর সাহেবের বোন প্রতিবার ঐ বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় বাবা সোনা ডেকে আমার কাঁধে বোঝা তুলে দেয় কোন আহ্লাদে, কোন যুক্তিতে? সেসব আহ্লাদ আর যুক্তির পেছনের কারণ আমি জানতে চাই!”
অগত্যা তার কথার উপর নীলু বেগম বা এলিজা কেউই কোনো জোর খাটাতে পারেনি। এদিকে ওরা চলে যাবে শুনে কমবেশি সবারই মন খারাপ। বেশি খারাপ শারাফের। তার রীতিমতো কান্না পাচ্ছে। এলিজা আন্টিই তো এতোদিন তার সব কাজের সাথী ছিল। খাওয়া, খেলা, গল্প করা, ঘুম সবকিছুর! এবার কে তার সঙ্গী হবে? কেমিকে খাওয়াবে, গোসল করাবে, মিষ্টি করে গল্প শোনাবে? শারাফের মুখভার দেখে এলিজার নিজেরও খারাপ লাগল৷ আসার পর থেকেই এ বাচ্চাটা তার ন্যাওটা হয়ে পড়েছে। সবকিছু মাকে বলার আগে তাকে বলছে। এলিজাও শারাফের প্রতি অসম্ভব টান অনুভব করছে। একটুও ইচ্ছে করছে না শারাফকে বা কেমিকে রেখে চলে যেতে। কিন্তু যা কিছু শুরু হয়েছে, বা যা হচ্ছে তা থেকে নিস্তার পেতে এ বাড়ি তাকে ছাড়তেই হবে। আর কিছুর জন্য না হোক, অন্তত নিজের মানসিক শান্তির জন্য!
এদিকে উড়ে এসে জুড়ে বসা আপদ বিদায় হচ্ছে বলে মিতুর মনটাও আজ উৎফুল্ল। নিজের বোনকে এনে আগের মতো রাখতে না পারায় জ্বালাটা নেহাৎই কম নয়। বক্র হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে একফাঁকে এলিজাকে বলেই ফেলল, “বাব্বাহ! এতো বড়ো বাড়ি প্রথমবার দেখছ মনে হয়? তাই এতোদিন বেড়াইছো, তাই না?”
ততদিনে মিতুর প্রতি বিরুপ ধারণা হয়েই গেছে এলিজার। এই মহিলা যে তাদের উপস্থিতি প্রথমদিন থেকেই সহ্য করতে পারেনি তা স্পষ্ট বোঝা যেতো তার আচরণে। খোঁচা বুঝে প্রতুত্তরে এলিজা আন্তরিক হেসে বলল, “বড়ো বাড়িতে যে ছোটো মনের কিছু মানুষ থাকে, এমনটাও প্রথমবারই দেখলাম।”
কথার পিঠে এমন জবাব পেয়ে মিতুর চোখ কপালে উঠল। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেল। দু’টাকার মেয়ে, তাকে ছোটো মনের বলেছে? ইমরানের কাছে কেঁদে কেঁদে নালিশ জানাল সে৷ অফিসের একটা ফাইলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ব্যস্ত ইমরান তিতিবিরক্ত স্বরে বলল, “উচিত কথাই তো বলেছে। অহেতুক পেছনে লাগতে যাও কেন?”
মিতু হতভম্ব হয়ে গেল, “কী বললে তুমি?”
“যা শুনেছ, ঠিক ঠিক সেটাই বলেছি।”
“ইমরান!”
“আওয়াজ নিচে, ইম্পোর্টেন্ট কাজ করছি।”
বলে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিলো সে।
মিতুর এই মেয়েলি ন্যাকামিতে আর গা ভাসাল না। সারাক্ষণ নাটকের তালে থাকে।
অসহ্য একটা মেয়ে!
দারোয়ানের খুপড়ি ঘর থেকে আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠল আরসালান দুপুরের দিকে। ভেজা শার্টখানা দুমড়েমুচড়ে পড়ে ছিল চেয়ারের হাতলে, ততক্ষণে শুকিয়ে ভাঁজ ভেঙেছে ওটার। একলাফে চৌকি থেকে নেমে উদোম কাঁধে ভ্যাপসা গন্ধ ছড়ানো শার্টটা কাঁধে তুলে সে অন্দর বাড়ির দিকে পা বাড়াল। পাথুরে পথ পেছনে রেখে বারান্দায় উঠে আধভিড়ানো সদর দরজাটা লাথি মেরে খুলল সে। ধড়াম শব্দে দরজাটা খোলার শব্দ হতেই রান্নাঘর থেকে সৃজা বেরিয়ে এসে দেখল আরসালান ঢুকছে। সারারাত বাড়ির বাইরে কাটিয়ে যেখানে অবস্থা বেহাল হওয়ার কথা সেখানে ওকে দেখে মনে হচ্ছে সুন্দর এক রাজপুত্র ঘুম থেকে উঠে বনে-বাদাড়ে মর্নিং ওয়াক করে ফিরে এসেছে। চোখেমুখে ক্লান্তি বা রাগের লেশমাত্র নেই। কয়েক সেকেন্ড মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে থাকল সৃজা। কিছু বলার জন্য শব্দ খুঁজে পেল না। আরসালান ওর পানে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকাল। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল সৃজা। দাঁড়িয়ে না থেকে তৎক্ষনাৎ রান্নাঘরে চলে এলো।
বাইক ভাঙার পেছনে যে আরসালানই জড়িত সেটা আলাদা করে কাউকে আর বোঝানোর প্রয়োজন নেই। ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখার আশা করেছিল আরসালান। কিন্তু কাউকে এ নিয়ে ‘টু’ শব্দ করতে না দেখে আরসালান একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলেও ঠিকই বুঝল তার বড়ো ভাই, নিজের ভালো মানুষি রুপটাই জাহির করেছে সবার সামনে। দেখাচ্ছে সবাইকে সে কতো ভালো আর ধৈর্যবান পুরুষ! ঠোঁট গোল করে শিস বাজাতে বাজাতে নিজের ঘরে চলে গেল আরসালান। কুসুম গরম পানিতে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে শটর্স পরিহিত অবস্থায় ঘরের ভেতরেই কেমিকে নিয়ে ফুটবল খেলে ওকে দুইটা চটকানা মারল ওর অবাধ্য হওয়ায়। ঘেউঘেউ শব্দ তুলে প্রতিবাদ জানানোয় একসময় লাথি মেরে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলো।
এরপর ভেজা প্যান্টের পকেট থেকে বেনসনের একটা প্যাকেট বের করে সেটা টেনে ছিঁড়ে খুলে লাইটার দিয়ে জ্বালালো। ভয়ভীতি আর হুমকি দিয়ে দারোয়ানকে দিয়ে সাত সকালেই দোকান থেকে আনিয়ে নিয়েছিল সে। গত কয়েকদিনের জমানো তৃষ্ণা একত্র করে শলাকায় টান দিতেই ধোঁয়া ঢুকল নাকমুখ দিয়ে। আরসালানের শরীরটা কেঁপে উঠল বিষাদময় আনন্দে। ঝুল বারান্দার রেলিঙয়ে উঠে বসে একটার পর একটা শলাকা নিঃশেষ করতে থাকল সে। নিঃশেষে সর্বসুখ, উপলব্ধিটা বেশ লাগল তার।
পুকুরে মাছের খাবার ছাড়ারত অবস্থায় ছেলের কান্ড দেখে বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আজিজ শেখের। এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না সেখানে। লুঙ্গিটা কাছা মেরে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন ওর ঘরে।
দরজা ঠেলে এক পা করে এগুতে এগুতে ভয় কাতুরে চেহারা বানিয়ে হতবাক কণ্ঠে বললেন, ‘আব্বাজান, ঐখানে বসছ ক্যান? পইড়া কোমড়ের হাড্ডি-গুড্ডি ভাঙব তোমার৷ নাইমা আসো।”
তাকিয়ে দেখলও না আরসালান তার জন্মদাতাকে। শব্দ করে থুতু ছুঁড়ে মারল নিচের দিকে। ফ্যাসফ্যাসে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘এই বুড়ো, চুপ।’
খানিক থমকালেন আজিজ শেখ। পা এগুতে পারলেন না তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাষায়। বুকের ভেতরটা কেমন অচেনা অস্বস্তিতে ব্যথার মতো করে উঠল, বুঝলেন না তিনি। বললেন, “এইভাবে কথা বলে না আব্বাজান।”
“খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো পশুর মুখ দিয়ে ভালো কথা বেরুবে, এমনটা আশা করা বোকামি মিস্টার শেখ।”
আজিজ শেখের বুঝতে পারলেন ছেলের রাগের কারণ। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাচ্চা ছেলের রাগ ভাঙানোর মতো করে বললেন, “রাগ করে না বাপ। দেখলাই তো তোমার ভাই আমায় কেমন একঘরে আটকায়া রাখছিল? তুমি কি ভাবছ আমি সুখে ঘুমাইছি ঘরের মধ্যে? এক সেকেন্ডের জন্যও চোখের পাতা এক হয় নাই আমার।”
আরসালান তাচ্ছিল্যভরে বলল, “হু কেয়ারস?”
অপমানটুকু গায়ে মাখলেন না আজিজ শেখ। সরল কণ্ঠেই আবদার ছুঁড়লেন, “পইড়া যাবা। নাইমা আসো।”
কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে বলল আরসালান, “ঘ্যানঘ্যান বন্ধ না করলে এক্ষুনি লাফ মারব। চার ছেলের গর্বিত বাপ এরপর তিন ছেলের বাপ হবে। গর্ব করার একটা কারণ না হয় না-ই থাকল। বউ হারানোর শোক তো পেলে, এবার পুত্র হারানোর শোক কেমন হয় একটু না হয় ধারণা নিলে। সব ব্যাপারে ধারণা থাকাটা কিন্তু মস্তিষ্কের জন্য ভালো। পরবর্তীতে চাপ কম পড়ে। নলেজ অফ পেইন মেকস দ্য মাইন্ড স্ট্রংগার অ্যান্ড দ্য জার্নি ইজিয়ার। ব্যাপারটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং!”
আজিজ শেখ রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, “আমারে কী ভাবো, হে? আমি খুশি হব তোমাদের কিছু হইলে? এতোটা পাষাণ মন তো না আমার। কেন বুঝো না, ইহসানের কিছু হইলে যেমন আমি বাঁচব না তেমন তোমার ক্ষেত্রেও, তোমার বাকি ভাইদের ক্ষেত্রেও। তোমরা সবাই আমার সন্তান, আমার রক্ত, অংশ।”
সন্তান, রক্ত, অংশ এসব সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা শুনে হাসলো আরসালান। তথাপি ঘাড় ফিরিয়ে কুটিল চোখে তাকাল৷ ঠোঁট উল্টে বলল, “তাই?”
“হো।”
ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবলো একটু আরসালান। এরপর চুপচাপ এক লাফ দিয়ে নেমে এলো রেলিঙ থেকে। ওকে নামতে দেখেই হাফ ছেড়ে সুস্থির হলেন আজিজ শেখ। ঘরে ঢুকে ভেজা তোয়ালেটা নিয়েই আরসালান বিছানায় হাত-পা চারিদিকে মেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল। আজিজ শেখ একগ্লাস পানি এবং পেইন কিলার এনে ওর মুখের সামনে ধরে বললেন, “আব্বাজান, খাইয়া নেও।”
অস্পষ্ট স্বরে বলল আরসালান, “তুমি খাও বুড়ো।”
আজিজ শেখ চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন, “তোমার বাপের বয়স ছাপ্পান্ন। এইডা কী এমন বয়স যে বুড়া ডাকতেছ?”
হঠাৎই উঠে বসলো আরসালান। গ্লাসটা সজোরে ছুঁড়ে মারল দরজার দিকে। টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে সেটা করিডোর অবধি ছিটকে পড়ল। কী এমন বললেন যে ছেলের মাথা গরম হয়ে গেল? আজিজ শেখ হতভম্ব! আরসালান তার হাত থেকে ঔষধের পাতা নিয়ে সেগুলোও জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মেরে ক্রোধ নিয়ে বলল, “বুড়ো না? তাহলে আরো কয়টা বিয়ে করো। অনিতা রেহমানের মতো একটা মা নিয়ে এসো। আমার তো মা চাই নাকি?”
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে আজিজ শেখের সম্বিৎ ফিরল। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললেন, “এইডা কোনো কথা বাপ?”
বাঁকা স্বরে বলল আরসালান, ”এটাই কথা এবং শেষ কথা।” আগের চেয়েও গলা চড়ল ওর, “তোমার জন্য, তুমি দায়ী বুড়ো। তুমি ল্যাভেন্ডারের মাকে বিয়ে করতে রাজি হলে কিচ্ছু হতো না। ঐ মহিলাটা আমার স্বপ্নে আসতো না, বাস্তবে থাকতো।”
হুট করে কোথা থেকে এসে ইহসান ওর গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে গলা চেপে ধরল। রক্তাভ চোখজোড়া নিয়ে নিচু স্বরে বলল, “আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলছিস তুই। আর একবারও যেন তোর মুখে ঐ নাম না শুনি। নয়তো তোকে আমি…”
বলে আরো শক্ত করে গলা চেপে ধরল ওর।
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে শরীর নীল হয়ে আসতে চাইল আরসালানের। কিন্তু সে প্রতিক্রিয়া করল না, হাসল। আজিজ শেখ ভড়কে গিয়ে পেছন থেকে ধস্তাধস্তি করে ছাড়িয়ে নিলেন ইহসানকে। অনেক কসরত করতে হলো ইহসানকে সরাতে। সরে গিয়ে ইহসান একটা কথাও বলল না। চেয়ারের পায়ায় লাথি মেরে চোখের হুঙ্কারে অনেককিছু বুঝিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আজিজ শেখ রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে দেখলেন ওকে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। ছুটে আসেন আরসালানের কাছে। ছেলেটা হাসছে। সুন্দর হাসি, কিন্তু আজিজ শেখ ওর উপরে হঠাৎ ক্ষেপে যান। বিষাদগ্রস্ত কণ্ঠে বলেন, “তোমার নিজের মায়ের সাথে অবিচার না এইটা?”
টকটকে লাল চোখে তাকাল আরসালান বাবার দিকে। থেমে থেমে ঘৃণাভরা স্বর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “গো টু হেল।”
এদিকে আরসালানের ঘর থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম এগুতেই ইহসান মুখোমুখি হয়ে গেল সৃজার। তৎক্ষনাৎ পাদু’টো থেমে গিয়ে জমে গেল ওর। বুকের ভেতরটাতে কামড় পড়ল। হাত, কপাল ঘেমে উঠল। একদৃষ্টে শুধু তাকিয়েই রইল সৃজার মুখপানে। কিছু একটা খোঁজার, বোঝার চেষ্টা করছে সে প্রাণপণে। অন্যদিকে সৃজার মুখভঙ্গি স্থির, চক্ষুদ্বয় শীতল। কী ভাবছে বা ওর মনে কী চলছে বোঝা যাচ্ছে না। ইহসানের হৃদযন্ত্র হাজার মেইল গতিতে ছুটতে লাগল। অস্থির ভঙ্গিতে পা দুটো এগিয়ে নিয়ে ওর অতি নিকটে গিয়ে দাঁড়াল। ধীরস্বরে ডাকল ওকে, “সৃজা?”
সৃজা চোখ তুলে তাকাল ওর মুখের দিকে। অসন্তোষ নিয়ে বলল, “ভাইয়ের গলা চেপে ধরে কেউ এভাবে?”
ইহসান ব্যাহত কণ্ঠে বলল, “মাথা ঠিক ছিল না।”
কিছু বলল না সৃজা। কেমন করে যেন চেয়েই রইল ওর দিকে। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর নীরবতা ভেঙ্গে গাঢ় স্বরে বলল, “নিজেকে সংযত রাখতে শিখতে হয়।সংযমী হতে না পারলে অনেককিছু আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়, চাইলেও ফিরে পাই না। শূন্যতা রয় যায় চিরকাল।”
ওর কথায় কী যেন একটা ছিল, ইহসান বজ্রাহতের মতো চমকে গিয়ে ঢোক গিলল। ধীরপায়ে আরেকটু এগিয়ে গেল ওর কাছে। হাতদুটো নিজের মুঠোবন্দী করে প্রগাঢ় স্বরে বলল, “এসব কেন বলছিস?”
ওড়নার একাংশ মুঠোকিছুই ধরে সৃজা হাসার প্রচেষ্টা করে বলল, “এমনিই বললাম।”
সন্দেহী কণ্ঠে বলল ইহসান, “এমনি?”
সৃজা হাসলো, “দার্শনিক কথাবার্তা বলতে ইচ্ছে করল, তাই একটু জ্ঞান ঝাড়লাম। এতো সিরিয়াস হচ্ছো কেন?”
“তোর জ্ঞান ঝাড়ার কথাবার্তা শুনলে ভয় হয় রে টনার মা।”
কথাটুকু বলে ইহসান হাত বাড়িয়ে ওর কোমড় টেনে পাশের করিডোরে সরে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে গালের সাথে গাল মিশিয়ে, টপাটপ কয়েকটা চুমু বসিয়ে দিলো। আচমকা সৃজা ওকে ধাক্কা দিয়ে
সরিয়ে দিয়ে লজ্জাবনত হয়ে গাল মুছতে মুছতে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, “পেছনে কে দেখো…”
ইহসান বিরক্তি নিয়ে পেছনে ফিরে দেখল ইস্মি আর ইজহান দাঁড়িয়ে আছে। তার কপালে তিনটা ভাঁজ। দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ মেজাজ খারাপ তার। তবে চোখেমুখে অদ্ভুত, গা জ্বালানো প্রতিক্রিয়া লেপ্টে আছে। ইহসান সৃজাকে ছেড়ে দাঁড়াল। একটু অপ্রস্তুত বোধ করলেও তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলল, “দুই ঘন্টা আগে দেখলাম অফিসে যাচ্ছিস, অথচ এখনো বাড়িতেই? ব্যাপার কী?”
ইজহান বাঁকা হেসে বলল, “ভেড়া-ভেড়ীর চুমু খাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য আজকে অফিস কামাই দিলাম।”
“একটা চড় মারব বদমাইশ।”
“বাহ রে বাহ! যেখানে-সেখানে চিপকা চিপকি করবি, ঘেঁষাঘেঁষি করবি, কামড়াকামড়ি করবি, চুমু খাবি আর আমি সেটা দেখার জন্য অফিস ফাঁকি দিতে পারব না?”
লজ্জায় মুখে আঁচল চাপা দিলো ইস্মি। হাত বাড়িয়ে পিঠে চিমটি কাটল। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে সৃজা ওকে নিয়ে সেখান থেকে ছুটে পালাল। সেদিকে একবার দেখে ইহসান চোয়াল শক্ত করে ইজহানের পরণের শার্টের বোতাম খুলে দিয়ে কাঁধ ঝেড়ে দিতে দিতে বলল, “তোর লজ্জা নেই? মুখ দিয়ে আবার বলে বেড়াচ্ছিস?”
“মুখ দিয়েই তো বলে, পাছা দিয়ে তো না যে লজ্জা পাব।”
“নির্লজ্জ একটা।”
ইহসান চোখ গরম করে তাকাল। ইজহান পথ অতিক্রম করতে করতে বলল, “লজ্জাবাবার কোলে টনা-মনা আকাশ থেকে টপকে পড়েছে।”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৫
ইহসান রেগে গিয়ে একটা ধাক্কা মারল ওকে। ইজহান পড়ে গেল মেঝেতে। পড়ে গিয়ে অবশ্য সে রেগে গেল না। হেসে উঠল করিডোর কাঁপিয়ে। ইহসান ভ্রুকুটি করে ওর দিকে তাকাতেই ইজহান ভ্রু নাচিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “লজ্জাবাবার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্লজ্জের মতো একটু বেশিই কাজ করে, তাই না?”
কড়াচোখে ওর দিকে তাকাতে গিয়ে ইহসান নিজেও হেসে ফেলল।