অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৬ (৩)

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৬ (৩)
ইসরাত জাহান ফারিয়া

শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হলো না ইজহানের৷ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিংয়ে ডাক পড়লো তার। সিরাজ সাহেবকে ফোন করে বলে দিলো, তারা পরদিন যাবে৷ কিন্তু পরেরদিনও যাওয়া হলো না। আজওয়ার জ্বর হয়ে গেল। আর ইজহান তো তার একটা বাচ্চাকে ছেড়েও শ্বশুরবাড়ি যাবে না। তাই সেদিনও যাওয়া হলো না। এর কয়েকদিন পর হঠাৎ খবর এলো ইস্মির ফুপুর শরীর খারাপ। প্রায় যায় যায় অবস্থা। এই অবস্থায় সে ইস্মিকে দেখতে চেয়েছে। অগত্য কী আর করার!

ফুপু শ্বাশুড়ির শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে ইজহান বউকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। গিয়ে দেখল তার ফুপু শ্বাশুড়ি রাবেয়া বেগম দিব্যি সুস্থ। তবে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, তার মাথায় চুল নেই। যেটুকু আছে সেটা ছোট্ট একটা ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখা। দেখে হাসি পেল ইজহানের। রাবেয়া বেগম ঢোলাঢালা ম্যাক্সি পরিধান করে হাঁটাহাঁটি করছে, পান খাচ্ছে, এর ওর সাথে গল্প করছে। এমনকি আইরাহকে কোলে নিয়ে আদরটাদর পর্যন্ত করল। ইস্মিকে দেখে কতক্ষণ কান্নাকাটি করে হায়-হতাশ করে তার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি সবার গল্প বলা শুরু করলেন। বহুদিন পর ইস্মিও আগ্রহ নিয়ে সবার খোঁজখবর নিলো। এক কথায়, দেখে মনেই হলো না রাবেয়া বেগম অসুস্থ। একফাঁকে ইস্মি মেয়েকে ওর কাছে দিয়ে ওয়াশরুমে গেলে ফুপু শ্বাশুড়ি রাবেয়া বেগম ইজহানকে বাঁকা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তো তোমার মাইয়ার নাম কি রাখছ?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

”আইরাহ ইজহানজাদী!”
ইজহান শেখের মেয়ের নাম। সুন্দর নামটা রেখে দিয়েছিল এলিজা আর ইহসান। বলা যায়, শোধবোধ আরকি! আযরান-আজওয়া নাম দুটো যেমন সে আর এলিজা মিলে রেখেছিল; তেমনি তার মেয়ের নামও ইহসান আর এলিজা রেখেছে।
তবে এই নাম শুনে রাবেয়া বেগম চোখমুখ কুঁচকে বললেন, “ইতা নাম কেডায় রাখছে? ওর চেহারার লগে তো টুনটুনি পাখির নামডা মিলে।”
ইজহান বিরক্তি নিয়ে বলল, ”এলিজ আর আমার ভাই রেখে দিয়েছে। আপনার দেওয়া বিচ্ছিরি নামের চেয়ে শতগুণ ভালো।”

রাবেয়া বেগম পান চিবুতে চিবুতে বললেন, “কইছে তোমারে! আয়রা না বাইরা। নাম শুইনাই মনে হয় বাইল্লা মাছ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতাছে। জম্মের অপছন্দ আমার বাইল্লা মাছ।”
ইজহানের এত রাগ হলো! সে কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল, “আপনার না যায় যায় অবস্থা? আপনি তো দিব্যি সুস্থ!”
আঙুলের ডগায় চুন লাগিয়ে রাবেয়া বেগম খ্যাটখ্যাটে গলায় বলল, “আধপাগল জামাই হুনো, তুমি যদি হুনতা আমার ডেঙ্গু জ্বর, তাইলে তো আমার ইস্মিটারে আসতেই দিতা না। তাই ওগো শিখাই দিসি তোমারে কইতে যে, আমার শ্বাস যায় যায় অবস্থা।”

ইজহান রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি আধপাগল?”
জবাবে রাবেয়া বেগম বললেন, “পুরা পাগল। পাবনা ফেরত পাগল।”
“কে বলল এই কথা?”
“তোমার হওর মশাই।”
চোয়াল শক্ত করে ফেলল ইজহান। তাকে পাবনার পাগল বলা? এই শ্বশুরটাকে তো সে দেখে নেবে। ফুপু শ্বাশুড়ি আবারও ওকে বলল, “শুনলাম তুমি নাকি মাইয়াটার পড়াশোনা করতে দেও নাই? মূর্খ বানাই রাখছ? অথচ পড়াশোনায় কত ভালো আছিলো আমার ইস্মি!” বলে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে আবার বলল, “কোথাও ঘুরতে-টুরতে নিয়েও নাকি যাও না? কেন বাবা, তোমার না কাড়ি কাড়ি ট্যাহাপয়সা? এসব কি কবরে লইয়া যাইবা? যৌবনে যদি স্বামীর লগে মাইয়াটা ঘুরতে যাইতেই না পারে, ওর একটা আফসোস থাইকা যাইব না সারাজীবন? এই পাঠাডা স্বামী না আসামি রে বাবা!”

বিড়বিড় করল রাবেয়া বেগম। সে পাঠা? তাকে টাকাপয়সা নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলা? রেগে উঠে উচিৎ জবাব দিতে গেলে ইস্মি এসে আড়ালে নিয়ে জানাল, তার ফুপু মানসিক সমস্যায় ভুগছে দীর্ঘদিন যাবৎ। যাকে দেখে তাকেই উল্টাপাল্টা বলে। সে যাতে কিছু মনে না করে। অগত্যা চোয়াল শক্ত করে বুড়ির অভিযোগ শুনে গেল। এরপর ঘন্টা তিনেকের মতো সেখানে কাটিয়ে ফুপু শ্বাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে থমথমে চেহারায় বেরিয়ে এলো ইস্মিকে নিয়ে।
ফেরার সময় চিরপরিচিত পথ বাদ দিয়ে গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে N8 রোড ধরে এগুতে লাগলে ইস্মি ভ্রু কুঁচকে ইজহানের দিকে তাকাল। কিছুই জানে না এমন একটা ভাব করে ইজহান ঠোঁট গোল করে গাল চুলকাতে চুলকাতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ইস্মি মিজুকেই জিজ্ঞেস করল, “বাড়ির পথ তো অন্যদিকে। আপনি ওদিকে যাচ্ছেন কেন ভাই?”

“স্যার বলছে।”
কোথায় যাচ্ছে, এই প্রশ্নটা ইজহানকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেল সে। ত্যাদড় লোক কিছুই বলবে না তাকে। উল্টো খ্যাঁকিয়ে উঠবে! কিন্তু এদিকওদিক গেলে বাড়ি ফিরবে কখন? সঙ্গে তো বাচ্চা মেয়েটা আছে নাকি? ইস্মি বেশ বিরক্ত হলো।
যানজট খুব একটা ছিল না। তাই দেড় ঘন্টার মধ্যেই মাওয়াঘাটে পৌঁছে গেল ওরা। মিজু ওদের একটা জায়গায় নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা পার্ক করতে চলে গেলেও ইস্মি যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ইজহান মুখে কিছু না বলে ওর হিজাবটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে মেয়েকে কোলে নিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী সমস্যা?”
ইস্মি অপ্রস্তুত গলায় বলল, “কোনো সমস্যা না।”

“তাহলে দাঁড়ানো কেন? যৌবনে ঘুরাঘুরি করে মনের সাধ পূরণ করিয়ে দিলাম তো। কত লোক দেখ, এইযে তাকিয়ে আছে তোর দিকে। আনন্দ হচ্ছে না?”
ইস্মি বোরকার আড়ালে নিজের হাতদুটো ঢুকিয়ে ফেলল আরো। বিব্রত স্বরে বলল, “না।”
“আমার হাতের থাপ্পড় খেয়ে কোনদিন মরে যাস, পরে তো আফসোস নিয়ে মরবি। তার আগে পরপুরুষের মেলা দেখে যা।”
রাবেয়া বেগমের খোঁচা শুনে যে লোকটা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে সেটা বেশ বুঝল ইস্মি। সে ইজহানের বাহু চেপে ধরল, “এতো সুন্দর বর থাকতে পরপুরুষের দিকে নজর দিতে হবে? তার আগে তো আমার চোখদুটো অন্ধ হয়ে যাবে।”

ইজহান অগ্নিচোখে তাকাল, “উল্টাপাল্টা কথা বলা বন্ধ করো।”
ততক্ষণে গাড়ি পার্ক করে মিজু এসে পড়েছে। তারা যেখানে দাঁড়ানো সে জায়গাটা একদম পদ্মার পাড় ঘেঁষে। একপাশে অসংখ্য খাবারের হোটেল, অন্যপাশে চেয়ার-টেবিল সাজানো। সবগুলো মানুষে ভর্তি। ইজহান নাক সিঁটকাচ্ছে বারবার। স্যাঁতসেঁতে মাটিতে পা ফেলতেও তার গা ঘিনঘিন করছে। তবে এখনো পর্যন্ত সে চুপচাপ আছে। বেশিকিছু বলছে না। মিজু লোক দিয়ে আগেই তুলনামূলক নিরিবিলি, পরিচ্ছন্ন একটা জায়গা বুকিং করে রেখেছিল। সেখানেই নিয়ে গেল তাদের।
রাত তখন ঠিক ৮টা।

ঢাকা-মাওয়া সড়ক ধরে শত শত গাড়ি ছুটে চলছে। দূর থেকে দৃশ্যটা দেখতে অপার্থিব লাগছে। ইস্মিতারা বসে আছে পদ্মা সেতুর ঠিক নিচে, মাটির ধারে একটুখানি উঁচু জায়গায়। ঘাটের পাশে পুরনো কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে তাদের মতোই ঘুরতে আসা অনেকেই। কেউ পুরো পরিবার নিয়ে এসেছে, কেউ জীবনসঙ্গী বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে আবার কেউবা একা। চায়ের কাপের ধোঁয়া উঠে আসছে ধীর লয়ে। মিষ্টি গন্ধে মেশানো তেলেভাজার ধোঁয়া, মচমচে ইলিশ ভাজা, পোড়া বেগুন আর নুন-মরিচ-মুগডালের ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে এসব কিছুতেই মন নেই ইজহানের। পদ্মার হাওয়ায় কাগজের ঠোঙা উড়ছে, ইজহান পায়ের নিচে চেপে ধরেছে সেটা। গাঢ় বাদামি শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রেখে, ব্রিজের উপর দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি দেখাচ্ছে মেয়েকে। আইরাহ হাসছে খিলখিল করে। তাকে দেখে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে। চলন্ত গাড়িবহর দেখেও মেয়েমানুষ খুশি হয়, ইজহান শেখ ভেবেই পায় না কীভাবে সম্ভব!

পদ্মা তখন কালো কাচের মতো চকচকে,
সেই কাচে জ্যোৎস্নার আলো পড়ে পড়ে ভেঙে যাচ্ছে ঢেউয়ের ফোঁটায় ফোঁটায়। সেতুর দিক থেকে নেমে আসা আলোগুলো ধীরে ধীরে পানিতে গলে মিশে গেছে৷ লাইটপোস্টের নিচে গাঢ় হলুদ রঙের ঝাপসা আলোয় নেমে এসেছে এক অপার্থিব ঘোর। এখানকার বাতাসটা একটু অসম্ভব সতেজ। গায়ে এসে লাগলেই নদীর শীতল ছোঁয়া টের পাওয়া যাচ্ছে। বহুদিন পর ইস্মিতা মুগ্ধতা মেশানো চোখে সব দেখছে। খুশিতে তার কান্না পাচ্ছে। এত বছরে প্রথম কোনো খোলামেলা জায়গায় তাকে নিয়ে এসেছে ইজহান শেখ, শহরের বাইরে আলো-আঁধারির একাকিত্বে। কতদিন পর সে এভাবে মুক্ত আকাশের নিচে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, ভেবেই চিত্ত শিহরিত হলো৷ মেয়েকে ঝুনঝুনি কিনে দিয়ে সেটক নিয়ে খেলায় মত্ত ইজহানকে বলল, “আমাকে আবার নিয়ে আসবেন এখানে? আমি নদীর জলে একটু পা ভিজিয়ে বসে থাকতে চাই। একা একা।”

ইজহান কঠিন মুখে বলল, “একা হলে আসা যাবে না।”
“আচ্ছা, আপনিও তাহলে পানিতে পা ভেজাতে চান?”
ইজহান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমার বউ তো চায়।”
ইস্মি হাসি আটকে বলল, “বউ তো এটাও চায়, ইজহান শেখ সাথে থাকুক।”
“থাকবে।’’
ইস্মি ওর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল। আহারে! দিনদিন আবেগী যাচ্ছে ইস্মিতাটা। আগে কোথায় বরকে সামলাতো, এখন তাকেই সামলাতে হচ্ছে। ইজহান আলতো করে ঠোঁট রাখল ইস্মিতার শিফনের হিজাবটার উপর। ইস্মি ওর কাঁধে নাক ঘষে ভার স্বরে বলল, “সর্দি মাখিয়ে দিয়েছি।”
“কোনো ব্যাপার না। বউ থাকলে শার্টের বুকে সর্দি লাগবে এটা তো খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। সাধারণ ব্যাপারে ইজহান শেখ রাগ করে না।”
ইস্মি হাসি আটকে বলল, “তাই?”

“অবশ্যই।”
ঠিক তখনি কমবয়েসী একটা ছেলে মেন্যুকার্ড নিয়ে এসে একটানা বলল, “এ স্যার? চা-দিমু? আমাদের এইখানে সাতরঙা চা ছাড়াও দশ রকমের চা পাওয়া যায়। দুইকাপ অর্ডার করলে এক কাপ ফি-রি!”
ইজহান চোখ গরম করে তাকাল লোকটার দিকে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, “আমার কি টাকার এতই অভাব যে ফি-রিতে চা খেতে হবে? আর তোর যে দোকান, দেখেই তো পেট গুলিয়ে আসছে। এক কাপে সব মুখ লাগিয়ে খাচ্ছে…”
দোকানি ছেলেটা মেজাজ খারাপ করে বলল, “ওয়ান টাইম কাপ স্যার। এক কাপে মুখ লাগাই খাওনের মানেই নাই।”

“রাখ তোর ওয়ান টাইম। ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে এনে বড় বড় কথা।”
ইস্মি বুঝল এক্ষুনি একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে দেবে এই লোক। সে ছেলেটাকে ইশারায় যেতে বলে ইজহানের বাহুতে হাত রেখে আমতা-আমতা করে বলল, “আমাকে এখানকার ইলিশ ভাজা খাওয়াবেন না?”
“নোংরা খাবারে এতো ঝোঁক কেন?”
“নোংরা খাবার?”
“পরিবেশ নোংরা বলেছি। নদীর নোংরা পানিতে মাছ ধোয়। শ্যাওলা পড়া জায়গায় রেখে মাছ কাটে। এরপর ইট, বালুর গুড়া মেশানো মশলা দিয়ে মবিলে মাছ ভাজে। ওসব খাওয়ার চেয়ে আত্ম হ ত্যা করা ভালো। আসছে ইলিশভাজা খেতে…”

যেন মনে করলেই বমি পাচ্ছে তার। ইজহান শেখ কতক্ষণ এমনই করল। কিন্তু যা হোক, তা হোক ইস্মি জেদ ধরল তাকে মবিলে ভাজা ইলিশ, বেগুন ভর্তা খাওয়াতেই হবে। মাওয়ায় ঘুরতে এসে যদি অপরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে এখানকার বিখ্যাত খাবারই না খায় তাহলে স্মৃতিটা পাকাপোক্ত হবে কীভাবে? স্মৃতি জমানোর ধান্ধায় ওসব অখাদ্য খাওয়ার ধান্ধা! ইজহান ওর কোনো কথা শুনল না।রেগেমেগে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ল। যার মানে,
এখন ফেরার সময়। আইরাহ ধারালো নখ দিয়ে বারবার তার গায়ে আঘাত করছে। ইজহান একপর্যায়ে মেয়ের হাত মুঠোয় ধরে ছোট ছোট চোখ করে দেখে বলল, “খুব বড় হয়ে গেছে মা, বাড়ি ফিরেই কেটে দেব। মায়ের মতো তুমি এখন আমাকে জ্বালাচ্ছ, ওসব বন্ধ করো। পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি না?”

আইরাহ’র তার কথা শুনে ছোট্ট, কোমল হাতটা পাপার মুঠো থেকে বের করে আবার পাপার মুখে আঘাত করল। ইজহান শেখের মনে হলো, ইস্মিতাকে বকা দেওয়ায় তার মেয়ে তাকে পানিশমেন্ট দিচ্ছে। দিক পানিশমেন্ট! তবুও ওসব নোংরা পরিবেশের খাবার সে খেতে দেবে না৷ ঘুরতে নিয়ে এসেছে এটাই বেশি।

এদিকে জেদ করে ইস্মি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও একসময় গাড়িতে উঠে চুপচাপ বসে রইল। এই লোকটা নিজের মর্জিমাফিক সব করে। এক্ষুনি বুকে টেনে এক্ষুণি পায়ে ঠেলে দিয়েছে এমন তো কতবার হয়েছে? এটা সে ভুলে যায় কেন? সামান্য মাছই তো, না খাওয়ালে না খাওয়াক। কতশত সাধ-আহ্লাদই তো সে বাদ দিয়েছে এ লোকটার জন্য! এতে কষ্ট পাওয়ার কি আছে? তবুও ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ক্ষিধে পাওয়ায় আইরাহ কান্নাকাটি শুরু করেছে গাড়িতে বসেই। ইস্মির অসহ্য লাগছিল বিধায় প্রচন্ড জোরে মেয়েকে ধমক দিয়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে আইরাহ ভয়ে কেঁপে উঠে কান্না বন্ধ করে দিলো। সিঁটিয়ে গেল পাপার বুকে। ইজহান রক্তগরম চোখে তাকাল ইস্মির দিকে। ওর চাহনি দেখে টলমল চোখ মুছে দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েকে নিয়ে ব্রেস্টফিড করাতে লাগল ইস্মি।

বাইরে উত্তাল বাতাস। গাড়ির গতির সাথে পাল্লা দিয়ে যেন বেগটাও বাড়ছে। ইস্মি রাগ ভুলে জানালা আটকে দিতে বলল ইজহানকে। উইন্ডো ক্লোজ করে দিতেই আইরাহ তিড়িংবিড়িং করে হাত-পা ছুঁড়ে ঘাড় উঁচু করে হেলে বসতে চাইল। ইস্মি ওকে বসিয়ে দিতেই জোর ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠল। কান্নার কারণ বুঝতে একটু সময় লাগল সকলের। স্ট্রিট লাইটের আলোয় গাড়ির ভেতরটা ঝকমক করছিল এতক্ষণ, উইন্ডো ক্লোজ করে দেওয়ায় সেটা আর হচ্ছে না। মেয়ের কাছে এটা মজার খেলা। তাই সে কাঁদছে। ওকে ধরে রাখতে গিয়ে ইস্মি হাতটাও নাড়াতে পারছে না। এতটুকু একটা বাচ্চার জেদ দেখে ইস্মি অবশ্য হতবাক হলো না। দেখতে হবে তো মেয়েটা কার!

ইজহান মেয়ের অসন্তোষ বোঝে জানালাটা হালকা ফাঁকা করে মেয়েকে নিজের উরুর উপর বসাল। ছোট ছোট লাল চেরিফুল ছাপা সাদা জামা আর কপালে হ্যাডব্যান্ড। ডাগরডাগর চোখে বড়ো বড়ো পাপড়ি, ফোলা ফোলা গাল আর লাল দুটো ঠোঁট। দেখলেই আদর করতে হাত নিশপিশ করে। ইজহান আইরাহ’র গাল টেনে দিতেই তাকে বেশ বিরক্ত দেখাল। থাবা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো। তার মেয়ে বসা শিখেনি। ঘাড়টা সোজা রাখতে শিখেছে। এভাবে বসে সে তার পাপার হাতের আঙুল কামড়ায়। এতেই তার দারুণ আনন্দ। ইজহান বেশ জানে। আকস্মিক তার কিছু মনে পড়তেই মুখ কালো করে ইস্মিকে বলল, ”আমার মেয়েকে কিন্তু আমি দূরে যেতে দেব না। কথাটা সবার মাথায় ঢুকিয়ে রাখা হোক।”

ইস্মি অবাক, “মানে? আমার মেয়ে আমি দূরে যেতে দেব কেন? আশ্চর্য!”
ইজহান দাঁত কটমট করে বলল, “তখন ঐ মহিলাটা যখন বলল বড়ো হলে তার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দেবে? তুইও তো হি হি করে হাসলি।”
হসপিটালে পাশের বেডের এক মহিলা তার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদরটাদর করে মজা করেই বলেছিল কথাটা। অথচ এই লোক শুনে ফেলেছে। সব কথায় কান পেতে রাখে এই লোক। ইস্মি বিরক্তি নিয়ে বলল, “তো মেয়ের বিয়ে দিতে হবে না? সারাজীবন আইবুড়ো করে রাখবেন নাকি?”
”আইবুড়ো করে রাখব কেন? মেয়েকে অবশ্যই বিয়ে দেব। তবে দূরে কোথাও না, কাছে। যাতে সবসময় আমার কাছে, আমার সঙ্গে থাকতে পারে।”

বলে দু’গালে চুমু খেয়ে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল আইরাহকে। মেয়েটা পাপার বুকে ঢুকে গো গো শব্দ করল যেন পাপার কথায় সে সহমত। সামনে থেকে মিজু আগ্রহ নিয়ে বলল, “ঘরজামাই আনবেন নাকি স্যার?”
মানে লাজলজ্জা নেই নাকি কিছু? ঘরজামাই আনবে কেন সে? ওসব মেরুদণ্ডহীন, কাপুরুষের কাছে তো সে মেয়ে বিয়ে দেবেই না। মিজুটা কীভাবে এই কথা ভাবল? ইজহান খ্যাঁকিয়ে উঠল। মিজু চুপসে গিয়ে বলল, “মেয়েরে দূরেও পাঠাইবেন না, আবার ঘরজামাইও আনবেন না। তাইলে কীভাবে কী স্যার?”
ইজহান আরাম করে দুপা ছড়িয়ে বসে বাঁকা হেসে বলল, “ঘরেই তো আমার মেয়ের জামাই আছে। তো বাইরে থেকে আনব কেন? ঘরের ছেলে, ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে।”
ইস্মি অবাক গলায় প্রশ্ন করল, “মানে?”

“ভেড়ার ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব। এটাই সহজ সমাধান।”
ইস্মির কাশি উঠে গেল এই কথা শুনে। মেয়ের বয়স চারমাসে পড়েনি অথচ লোকটা কার কাছে মেয়ের বিয়ে দেবে সেটাও ঠিক করে ফেলেছে? ইস্মি আমতা-আমতা করে বলল, “আযরান ওর ভাই। ওরা ভাই-বোন।”
“কীসের ভাইবোন? টনা আমার মেয়ের জামাই। আমিতো ওকে সেভাবেই গড়েপিঠে নিচ্ছি। যাতে ভবিষ্যতে আমার মেয়ে অভিযোগ করার সুযোগ না পায়। কিন্তু যা বুঝলাম, বাপের ছায়া অনেক বেশি ওর মধ্যে। নাহ, আরো স্ট্রিক্টলি হ্যান্ডেল করতে হবে বিষয়টা।”
চিন্তিত দেখাল তাকে। ইস্মি বলল, ”সবই বুঝলাম। কিন্তু আপনার শিক্ষা-দীক্ষায় বড় হলে আযরান তো আপনার মতো একটা আধপাগল হবে। আপনি যেমন আমাকে টাইটে রাখেন, আপনার মেয়েকেও তখন কিন্তু সে টাইটে রাখবে। পড়াশোনা বন্ধ করে রান্নাবান্না, কাপড় কাচা আর স্বামী সেবায় লাগিয়ে রাখবে। অবশ্য মেয়েদের কাজই তো এসব।”

তার এইটুকু মেয়ে দিয়ে রান্না করাবে, কাপড় কাচাবে? টনাটার এতো সাহস? শাণিত চোখে তাকাল ইজহান বউয়ের পানে। ইস্মি এমন একটা ভাব করল, যেন সে মহাখুশি। আল্লাহ দিয়েছে মেয়ে, এবার বুঝুক মেয়ের বাপ হওয়া কতটা কঠিন। এদিকে ইজহান দ্বিধান্বিত হয়ে গেল। আসলেই কি, তার শিক্ষায় বড় হলে টনাটা তার মেয়েকে…
আর ভাবতে পারল না। তার আগেই ইস্মি ঠেস মারা কণ্ঠে বলল, “ভাইয়া মতামত দিয়েছে তো? আপনার মেয়েকে তার ছেলের জন্য নিতে আপত্তি নেই তো?”

বিরক্তিসূচক ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে বলল ইজহান, “ভেড়ার আবার আপত্তি কীসের? আমার পরীর মতো মেয়ে ওর শুশু করা ছেলেকে বিয়ে করবে এটাই ওর রাজকপাল। তাছাড়া ওর মতের ধার ধারছেটা কে? ছেলে-মেয়ে আমার, ওদের নিয়ে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা আমিই নেব।”
একরোখা কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেল ইজহান।

ইস্মিতা আর মিজু তার কথা শুনে বাক্যহারা হয়ে বসে রইল। কেউই আর কথা বাড়াল না। ভালোমন্দ, ঝগড়া, খুনসুটি মুহূর্তের পরই হঠাৎ অভাবনীয় একটা মুহূর্ত এলো। ঘটনাটা ঘটল গাড়িটা যখন আমিনবাজার হয়ে হেমায়েতপুর পৌঁছাল তখন। মিজুর চোখে পড়ল একটা মালবাহী ভ্যান বহুক্ষণ ধরে তাদের গাড়িকে ফলো করছে। রাত গভীর হচ্ছে, শহরের কোলাহল স্তিমিত হয়ে আসছে, কিন্তু রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা হয়নি এখনো। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও, ভ্যানটার নাছোড় গতি দেখে মিজুর ভেতরে খচখচে সন্দেহ জাগতে লাগল। সে গতি বাড়ালো। পেছনের ভ্যানটাও বাড়াল গতি। এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছন থেকে আচমকা এসে ধাক্কা বসাল ভ্যানটা। একবার না, পরপর দু’বার। শেষবারের ধাক্কায় গাড়িটা রাস্তার পাশে গাদাগাদি করে রাখা মোটা সিমেন্টের থামে গিয়ে ঠোক্কর খেল। প্রচণ্ড শব্দে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল ট্রাংক ডোর আর টেল লাইট। আচমকা ধাক্কায় ইজহানের উরুতে খেলারত অবস্থায় থাকা আইরাহ ছিটকে গিয়ে পড়ল সামনের সিটের হাতলে। পাশের জানালায় আছড়ে পড়ল ইস্মিতার মাথা। কপালে প্রচন্ড ব্যথা লাগা ইজহান কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েকে যে কীভাবে কাছে আনলো, আর অন্য হাত দিয়ে ইস্মিকে টেনে আনল নিজের দিকে সে টের পেল না। বিস্ময়ভরা চোখে দেখল, ওপাশের জানালার কাচটা ভেঙে ইস্মিতার গাল কেটে গেছে। তার নিজের হাতেও লেগেছে সেই কাচ, রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

আইরাহ’র কপাল ফুলে গেছে। ঠোঁট কেটে গেছে। মেয়ের অবস্থা দেখে হতভম্ব ইজহান আঙুল দিয়ে কাটা ঠোঁটটা ছুঁতেই সশব্দে কেঁদে উঠল আইরাহ। ইজহানের বোধ ফিরল। চমকে পিছনে তাকাতেই দেখল, মালবাহী ভ্যানটা থেমে গেছে। তবে প্রস্তুতি নিচ্ছে এগিয়ে আসার। কী হতে যাচ্ছে ভেবে বুক ধকধক করে উঠলেও মাথা ঠান্ডা রাখল ইজহান। এক মুহূর্ত দেরি না করে চিৎকার করে মিজুকে বলে দিল কী করতে হবে। মিজুর মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। ধাক্কায় তার কান দিয়ে রক্ত পড়ছে, একপাশ ফুলে উঠেছে। কিন্তু ইজহানের তার কথা কানে ঢুকল।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৬ (২)

এবং সেটাই তাকে ফিরিয়ে আনল নিয়ন্ত্রণে। ইঞ্জিন তখনও সচল, গাড়ি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বাম হাতে স্টিয়ারিং ধরে মিজু গতি তুলল। সাইড-মিররে এক ঝলক দেখে নিল ভ্যানটাও আবার গতি নিচ্ছে। তখনই সে একটা দ্রুত বাঁক নিল, বাসস্টপ পেরিয়ে রাস্তার ডান পাশের এক সরু গলিতে ঢুকে গেল। পিছু নেওয়া ভ্যানটা আটকে গেল গলির মাথায়ই। রক্তাক্ত এদিকে মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া এতবড়ো দুর্ঘটনা আর মেয়ের অবস্থা দেখে জোরাল শব্দে কেঁদে উঠল ইস্মিতা।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৭