অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৭
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ঘরের ভেতরটা তখন অন্ধকারে ডোবা। আবছা আলোয় চোখে পড়ল, সেন্টার টেবিলের উপর এক পাউন্ডের ছোট্ট রেড ভেলভেট কেক, ছোট্ট ফুলদানিতে চারটা সাদা গোলাপ আর দুটো সুগন্ধি মোমবাতি দিয়ে ছোটোখাটো ডেকোরেশন করা। টেবিলের সামনে বাচ্চাদেরকে নিজের দুই উরুতে বসিয়ে রেখেছে ইহসান। দু’জোড়া চোখেই কৌতূহল। তাদের দৃষ্টি আপাতত সেদিকেই। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই ঝিকিমিকি জরি আর ফুলের বৃষ্টি ঝরা; টিমটিমে আলোয় আযরানের চোখে ঝিলিক, আজওয়ার হাতের কেকের ক্রিমে আঠালো আঙুল; সবকিছু দেখে ভ্রু দুটো কুঁচকে এলো সৃজার।
প্রশ্ন করার সুযোগই পেল না, তার আগেই ইহসানের বলা ‘হুররে’ ডাকটা বদ্ধ ঘরে যেন খাঁচা ভাঙা পাখির মতো উড়ে বেড়াল ঘরময়। সৃজা দরজার কাঠে পিঠ ঠেকিয়ে স্তব্ধ। বাপ আর ছেলে-মেয়ে মিলে কীসের আয়োজন করেছে? আজ কি বিশেষ কিছু? দ্বিধাভরে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতেই ইহসানের মুখ কালো হয়ে গেল। ফুরফুরে মেজাজটাও তার তুঙ্গে উঠল। কিছু না বলে বাচ্চাদের বুকে চাপা দিয়ে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল নিঃশব্দে। হতবিহ্বল সৃজা মস্তিষ্কে সামান্য চাপ প্রয়োগ করতেই মনে পড়ল, আজকের দিনটা বিশেষ! ঠিক এক বছর আগে, ২০১৭ সালের এই দিনে—দুটো থাপ্পড় খেয়ে বিয়ে নামক বন্ধনে জড়িয়েছিল সে, ইহসান শেখের সঙ্গে। সৃজার হাত অজান্তেই গালে চলে গেল। ওভাবেই কিছুক্ষণ মূর্তির মতো রইল। একটা সংসার, স্বামী, দুটো সন্তান…এইতো ব্যস!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সৃজা রেহমান একজন স্ত্রী আর দায়িত্ববান মা হয়ে উঠার চেষ্টায় পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার নামক মায়াজালে স্বেচ্ছায় নিজেকে জড়িয়েছে একটু একটু করে। সকাল-বিকেল হাসি-কান্না, যত্ন-ভালোবাসা, অস্ফুট অভিমান জমে জমে গাঁথা এক অদৃশ্য বন্ধন। কিছু ধোঁয়াশা, অব্যক্ত কষ্ট সবকিছুকে ঢেকে দৈনন্দিন ছোট ছোট সুখের আস্তরণে বন্ধনটার জোর দিন দিন বাড়ছেই। সবটা মিলিয়েই গড়ে উঠেছে সংসার নামক ছোট্ট জাল। এই জাল কি কাটার মতো? না। ভালোবাসাকে হয়তো মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু মায়া? মায়া তো শিকড়ের মতো গভীরে প্রোথিত। টান দিলে ব্যথা লাগে, ছিঁড়লে রক্ত ঝরে। বিয়ে পরবর্তী একটা বছর অনেকটুকু পাওয়া আর না পাওয়া নিয়ে কীভাবে গত হয়ে গেল, টেরই পায়নি সৃজা। দরজাটা আটকে ধীরপায়ে সে এগুলো বিছানার দিকে। স্যান্ডেল জোড়া খুলে উঠে বসলো বিছানায়। হাত রাখল ইহসানের পিঠে। ইতস্তত করে বলল, “মাথায় ছিল না দিনটা। এরজন্য এতো রাগ করতে হবে? উঠো প্লিজ।”
ইহসান প্রতুত্তর করল না। নড়লও না। সৃজা শক্তপোক্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল, এই মুখই তো তার জীবন এখন। সৃজা আরেকটু ঘেঁষল ওর কাছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে। পিঠে মুখ গুঁজে ধীরস্বরে বলতে লাগল, “এইতো সেদিনের কথা। তোমার লোহার মতো হাতের দুটো থাপ্পড় আর ধমক খেয়ে টুপ করে কবুল বলে দিলো একটা মেয়ে। কবুলের দোহাই দিয়ে তাকে সঙ্গে করে শেখবাড়ির দরজায় টেনে নিয়ে এলে। আন্টির কান্না, মেজোবউয়ের চোখ রাঙানি, আংকেলের গর্জন, তুমিও মেজাজ দেখালে। এরপর সন্ধ্যা নামতেই নতুন বউয়ের ঘরে তালা মেরে দিলে। ওভারসাইজের জামা কিনে এনে বললে—‘পর’। রাতে দারোয়ান চাচার হাতের ডাল আর লবণ ছাড়া ডিম ভেজে খাওয়ালে। ঘুমোতে গিয়ে কাঁদল বলে বুকে টেনে সান্ত্বনা দিলে। তারপর এই কবুলের সুযোগটা কাজে লাগিয়ে পটিয়ে ফেললে তোমার বউটাকে। আর বউটাও! তোমার দৌলতে কীভাবে যেন সে আহাম্মক একটা বউ হয়ে গেল৷ একদম আহাম্মক, যে একটা তারিখও মনে রাখতে পারেনি…”
ইহসান পিঠ ফিরিয়েই থাকে। গম্ভীরমুখে আচমকা উঠে, “আমি তোর মতো আহাম্মক বউ চাইনি। এমন বউকে চেয়েছি যে নিজের বিয়ের দিনতারিখ ভুলে যায় না।”
নিঃশ্বাসের শব্দ বেড়ে গেল ইহসানের। সৃজার হাতটা স্পষ্টই টের পেল তার বুকের তাল। মৃদুস্বরে বলল, “উফ! কী মিথ্যুক তুমি? বিয়ের সময় এতকিছু দেখেছিলে নাকি? হুমকি দিয়ে অসহায় করে দিচ্ছিলে আমাকে। ‘সৃজা শোন, তোর যা মানসিক অবস্থা দেখছি, তাতে বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হচ্ছে, আয় বিয়ে করে নিই। বিয়ে না করলে লোকে আরো বাজে কথা রটাবে। আমার তাতে একবিন্দু পরিমাণ কিছু যায়-আসে না সত্যি।
তবে তোর যে যায়-আসছে তা বেশ বুঝতে পারছি। তোর এই দুর্বল মানসিক অবস্থা দেখে আমার ভয় করছে, ভয় থেকেই বলছি তুই আর আমি আজকে বিয়ে করব। তোর জন্যই তোকে বিয়ে করব কিন্তু সবার মুখে ঝামা ঘষে দেব। ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে যা, তাহলে কেউ আর সাহস পাবে না উল্টাপাল্টা কথা বলার। নয়তো তুই আর তোর বোনকে কেউ আজেবাজে বকতে আসলে আমি জোর খাটিয়ে কিছু বলতে পারব না। কারণ সমাজটাই অসুস্থ… আর তোরা অভিভাবকহীন। আমি তোদের অভিভাবকের জায়গায় একটুখানি আসীন হতে চাই, কে যেন বলেছিল এসব ব্লা ব্লা ব্লা?”
পুরোপুরি নকল করে বলল কথাগুলো। ভাব গাম্ভীর্যতাও ঠিক রাখল। ইহসান হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। তবে তার মেজাজ খারাপ হলো।
ক্যাটক্যাটে স্বরে বলল, “আমি বলেই মহানুভবতা দেখিয়েছিলাম। তার প্রতিদান এই? তারিখ ভুলে যাওয়া? আমি তো মরে গেলেও ভুলব না আমার বিয়ের তারিখটা।”
সৃজা ওর মেজাজের থেকে অভিমান বেশি টের পেয়ে এবার বলল, “তোমার টেমা-টুলি আমার মাথার অর্ধেক খেয়ে বসে আছে। আর বাকিটা তুমি। দিনতারিখ মনে রাখার সুযোগ পাচ্ছি কই!”
বাচ্চা দুটো পাপার বুকের ওম নিচ্ছে। তাদের কথাও শুনছে চুপচাপ। মায়ের থেকে এবার তাদের চোখের দৃষ্টি পাপার মুখের দিকে। মায়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পাপা কী বলে তা শোনার জন্য যেন দু’জনেই উৎসুক। দু’জনের দৃষ্টি দেখে ইহসান ভ্রু কুঁচকালে আযরান নিজেও ভ্রু উঁচু করে ফেলল। ইহসান থতমত খেয়ে নিজের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক করতেই আযরান একগাল হাসলো। ইহসান তার গালে টোকা দিয়ে মেয়ের মুখ থেকে ছোট্ট দুটো আঙুল টেনে বের করে একটা চুমু খেয়ে সৃজার দিকে ফিরে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছেড়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “সুযোগ পাচ্ছিস না?”
মুগ্ধতা মেশানো চোখে ছেলে-মেয়ের আর তাদের পাপার কান্ড দেখছিল সৃজা। দু’জনেই পাপা ভক্ত। পাপা থাকলে মাকে তারা আর চেনেই না, কাছেই ঘেঁষে না, খাওয়ার সময় ছাড়া। ব্যাপারটাতে যদিও অনেকে মর্মাহত হয়, তবে সৃজা তার প্রিয় পুরুষের বুকে নিজের বাচ্চাদের দেখতেই বেশি প্রশান্তি অনুভব করে। ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল সৃজা,
“উহু।
তোমরা আমার পুরো মাথা দখল করে আছ। একটু জায়গাও ফাঁকা রাখোনি অন্যকিছু নিয়ে ভাবার।”
ইহসান আবারও ভ্রু কুঁচকাল, “মানে কী? আমরা তিনজন সত্যিই তোর মাথা খেয়ে বসে আছি?”
“তা নয়তো প্ল্যান থেকে আমাকে বাদ দিলে কেন?”
বলতে বলতে উঠে বসলো সৃজা। গায়ে ওড়না টেনে জড়াল। ইহসান জোরাল শব্দে হেসে উঠল এবার, “সারপ্রাইজ আবার বলতে আছে নাকি? আহাম্মক তুই!”
যদিও এতক্ষণ এটাই শুনতে চাচ্ছিল সৃজা, এবার পুলকিত হওয়ার ভান করে বলল, “সারপ্রাইজ?”
“অনলি ফর ইউ।”
“কিন্তু দিনটা তো তোমারও। আর আমি তো সেরকম কোনো আয়োজন করতে পারিনি।”
ইহসান একহাতে টেনে ওকে কাছে টেনে কোমড় জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে উষ্ণ নিঃশ্বাসে পুড়িয়ে দিতে দিতে বলল, “তুমিই তো আমার আয়োজন আহাম্মক বউ, আর কীসের আয়োজন করবে তুমি!”
ইহসান সৃজার দুই গালে শব্দ করে চুমু বসাল।
পাপা মাকে চুমু দিচ্ছে, তাতে কেমন অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে যে, ঘাপ্টি মেরে থাকা আযরান মুখে হাত দিয়ে সেই শব্দ নকল করে হেসে ফেলল। দেখাদেখি তার বোনও একই কাজ করল।
সৃজা আর ইহসান হাসির আওয়াজে ওদের দিকে তাকাল। দু’জনেই ভারী অবাক এবং বিব্রত। তবে বিস্ময়ের রেশ প্রথমে কাটল ইহসানের; সে একেবারে শিক্ষকের মতো আঙুল নেড়ে বলল, “দেখো, পার্টনারকে আদর দেওয়ার সঠিক নিয়ম হচ্ছে, প্রথমে তাকে ভালো করে চেপে ধরবে। তারপর দুই গালে ঠোঁট বসাবে। চুমুর শব্দ করতেই হবে, নইলে গোনায় ধরা হবে না। আর যদি সে মাছের মতো লাফালাফি করে, তখন পা দিয়ে আটকে দেবে।
সবশেষে, ধীরেসুস্থে আদর করবে। এটা কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল আদর স্ট্যান্ডার্ড। এই গোল্ডেন রুলস বাদ দিলে শাস্তি আছে। বুঝেছ?”
পাপার কথা বলার ভঙ্গিতে দু’ভাইবোন আবারও হেসে কুটিকুটি। সৃজার কান-মুখ লজ্জায় টকটকে লাল হয়ে উঠল, ভেতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি উদয় হলো। ইহসান ঠোঁট কামড়ে ওর দিকে ফিরতেই, সৃজা মেকি রাগান্বিত ভঙ্গিতে ওর বুকে কিল বসিয়ে দিল। ইহসান তড়িঘড়ি ওর হাতদুটো নিজের এক হাতে আটকে নিল। নড়চড় করার সুযোগ দিলো না।
সৃজার চোখে অবাক বিস্ময়ের পাশাপাশি কিছুটা ক্ষোভও ফুটে উঠল, কিন্তু ইহসান পাত্তা দিলো না।
ওকে এক ঝলক দেখে মুখের ভেতর জিভ ঘুরিয়ে, ডান ভ্রু উঁচিয়ে, এক পলকে ইশারা করে বলল,
“আপনি বুঝেছেন টনার মা?”
“কচু বুঝেছি।”
চাঁদের আলো আস্তে আস্তে ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে সৃজার মুখের ওপর নরম আলোর রেখা আঁকছে। মৃদু বাতাস ওর চুলে স্পর্শ করে একটুখানি এলোমেলো করে দিয়ে গেল। ইহসান অপলক তাকিয়ে রইল। ওর গাঢ় চাহনী দেখে সৃজা অস্বস্তি অনুভব করল। হৃদয়ের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করল। কিছু না বলে চুপচাপ ইহসানের বুকে মুখ গুঁজার চেষ্টা করল। ইহসান হঠাৎই অনুভব করল, চাঁদের আলোটা যেন তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে, এক ধরনের রহস্যময়ী শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার চোখে তৃষ্ণা জাগল, সেই আলোতে ডুবন্ত সৃজাকে দেখার। রুক্ষ হাতের আঙুলে মেয়েলি মুখে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা কয়েক গাছি চুল সরিয়ে দিয়ে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সৃজার মুখটাতে। সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতে না পেরে সৃজা অন্যদিকে তাকাতেই ইহসান ওর কানে কানে ফিসফিস করে, তীব্র গম্ভীর স্বরে বলল, “চাঁদেরও আলো দিয়ে মুখখানি দেখব পেয়ো নাকো লজ্জা খুব কাছে রাখব।”
বাতাসে শীতলতা আর চাঁদের আলোয় গা ভাসিয়ে সৃজা, এক গভীর অনুভূতির মধ্যে নিমজ্জিত হতে গিয়েও সৃজা সামলে নিলো নিজেকে। তীব্র এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসল। ক্ষোভমিশ্রিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “ফাজিল কোথাকার। বাচ্চাদের সামনে এসব কী শুরু করেছ? ওরা কীভাবে দেখছে!”
ইহসান হাসতে হাসতে বলল, “রিল্যাক্স, ওরা নাদান শিশু। কিচ্ছু বোঝেনি। আমি তো ওদের ভালো বাবা।না সোনারা?”
টনা-মনা আবারও হেসে পাপার শরীরে মিশে গেল। যার মানে, তাদের পাপা ভালো। ইহসানের চোখদুটোতে হঠাৎই একফোঁটা পানি ঝিলিক দিয়ে উঠল। মুহূর্তেই ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে সে তাড়া দিলো সবাইকে, “চলো চলো, আমরা এবার কেক কেটে তোমাদের মাকে ভূত বানিয়ে দেই। তোমরা কিন্তু ভয় পাবে না। ওকে?”
পাপার উৎসাহে আবারও দু’জন হাত-পা ছুঁড়ে আকুপাকু করতে লাগল। সৃজা তাদের কান্ড দেখে হেসে উঠল। সেই সঙ্গে নিচু স্বরে ইহসানকে সতর্কও করল, “ভূত বানানোর চেষ্টা করতেই পারো, কিন্তু পরে কাছে ঘেঁষতে চাইলে একদম জায়গামতো দেব। তখন যেন আফসোস করো না।”
পাংশুটে চেহারায় তাকাল ইহসান শেখ। এতো বড়ো হুমকি? সাহস কতো এই মেয়ের? রাতে তো সে দেখে নেবে। আবার দ্বিধায়ও পড়ল! সত্যিই যদি তাকে কাছে ঘেঁষতে না দেয়? নাহ! রিস্ক নেওয়া যাবে না। তাই উল্টাপাল্টা কিছু করল না সে। একসঙ্গে কেক কাটল, একে-অপরকে খাইয়ে দিলো। হাততালি দিলো।কৌতূহলের লাফালাফি করতে থাকা বাচ্চাদের আঙুলে একটুখানি ছুঁইয়ে দিলো। আনন্দে ডগমগ
হয়ে গেল তারা।
স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে চারজনের অনেকগুলো ফ্যামিলি ফটো নিলো তারা। আযরান-আজওয়ার উদ্দেশ্যে সৃজা আর ইহসান দু-জনেই আলাদা আলাদা করে অনেক অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসার কথা বলল। ভবিষ্যতে তাদের কোন স্থানে দেখতে চায় বাবা-মা হিসেবে, সেই আকাঙ্খা প্রকাশ করে ভিডিয়ো করে রাখল যেন বড়ো হয়ে তার ছেলে-মেয়ে এসব দেখে বাবা-মা’র জীবনে নিজেদের গুরুত্ব কতটা; সেটা বুঝতে পারে, হাসি-আনন্দে মেতে উঠল তাদের ছোট্ট ঘর আর বারান্দার গ্রিলের উপর বসা নিশাচর পাখিটা।
[বর্তমান]
ইহসান শেখ খুব ব্যস্ত তার কাজ নিয়ে। মেয়ের জ্বর ছিল বলে কয়েকটা দিন রেস্তোরাঁতে তো যায়ইনি। ব্যবসাতেও তেমন নজর দেয়নি। যার ফলে কাজ জমে পাহাড় হয়েছে। আজকের মতো কাজ গুছিয়ে এনে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথেই বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে যেতে হয়েছিল একটা কাজে। সেখান থেকে ফেরার পথেই তার চোখ আটকে গেছিল একটা শাড়িতে। মুহূর্তেই চোখে ভেসে উঠেছিল সৃজার মুখটা। এই মেয়েটা শাড়ি তেমন পরে না, পরতে জানেও না। তারপরেও সে কিছু শাড়ি কিনে দিয়েছে। যেগুলো আলমারিতে সারিবদ্ধ করে রাখাই আছে, পরে না কখনো মেয়েটা। কিন্তু অনেক শাড়ি থাকলেও এমন একটা বউ বউ টাইপের জমকালো শাড়ি দেওয়া হয়নি মেয়েটাকে। মনে পড়লো, এনিভার্সারিতে মেয়েটাকে সে তেমন কিছুই দিতে পারেনি। সামর্থ্য যে ছিল না এমন নয়, কিন্তু মাথায় আসেনি ব্যাপারটা। সে নিয়ে নিলো শাড়িটা। কী ভেবে এরপর গেল জুয়েলারির দোকানে।
বিবাহ বার্ষিকীর সেই দিনটা পেরিয়েছে মাসখানিক আগে। অথচ ইহসান শেখ আজ এসে বউকে এনিভার্সারির উপহার দিচ্ছে? সৃজা অবাক হয়েই ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখল তাতে একটা শাড়ি আর গয়নার বাক্স রাখা। উপরে তার নাম খোদাই করা। কৌতূহল নিয়ে সে ইহসানের দিকে তাকাল, যে দোটানা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পছন্দ হবে কি-না ভাবছে। এতোদিন পর এসে বিবাহ বার্ষিকীর উপহার দিয়ে লোকটা এমন বোকা বোকা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে সৃজার একটু হাসিই পেল। বেশ আগ্রহ নিয়ে র্যাপিং থেকে মুক্ত করতেই শাড়িটা তার চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। গাঢ় মেরুন রঙের বেনারসি শাড়ি, জমিনে সোনালি সুতো দিয়ে সুন্দর নকশা করা। শাড়ির আঁচলও একই ধরনের জমকালো নকশায় ভরপুর। নকশা আর রঙটা এতো সুন্দর, যে সৃজা চোখই সরাতে পারল না কতক্ষণ। ইহসান আড়ষ্ট ও উদগ্রীব কণ্ঠে শুধাল, “অভিজ্ঞতা নেই বেনারসি কেনার, কিন্তু এটা দেখেই মনে হলো আযরানের মায়ের গায়ে মানাবে। তাই… ”
ওকে কথা শেষ করতে দিলো না সৃজা। তার আগেই বিস্ময় নিয়ে বলল, “এক কথায় দারুণ। এরচেয়ে সুন্দর বেনারসি এর আগে সৃজা রেহমানের নজরে পড়েনি। পড়লে হয়তো সে এতোটা মুগ্ধ হতো না আজওয়ার পাপা।”
ইহসানের দ্বিধাবোধ কাটলো। নিজেই এবার এগিয়ে গিয়ে বাক্স থেকে বের করে সোনার চুড়ি দুটো সৃজার হাতে পরিয়ে দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। ফর্সা হাতদুটোয় চুড়িটা ঝলমল করে উঠল। যেন এই হাতের জন্যই চুড়ি দুটো বানানো। ইহসান ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো কোমল হাতদুটোতে। সৃজা তার বুকে লেপ্টে গিয়ে বলল, “এত দামী উপহার দিয়েছ, ঠিকই আছে। বউ হোই তো নাকি! কড়া একটা ধন্যবাদ দেওয়াই যায় তোমাকে।”
ইহসান মুখ কুঁচকে বলল, “ধন্যবাদ না দিয়ে ভালোবাসি বল না।”
সৃজা হাসতে হাসতে বলল, “ভালোবাসি কেনা হচ্ছে?”
“না কিনলে বলতে চাইছে না তো কেউ।”
“উহু, বেচব না।”
বলে ইহসানের পায়ের পাতায় উঠে গাঢ় একটা চুমু খেল ওর থুতনিতে। এরপর বিগলিত চিত্তে বলল,
“এই শাড়িটা আমি আমার ছেলের বউয়ের জন্য তুলে রাখব। এটা পরেই আযরান শেখের বউ হয়ে আসবে এ বাড়িতে। লাল টুকটুকে একটা মিষ্টি বউ!”
ইহসান ওর কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল,
“এইটুকু ছেলের আবার বউ? দাঁতই তো উঠেনি।
খৎনা করানোটাও বাকি। কে মেয়ে দেবে ওকে?”
সৃজা ওর বোকামো কথাবার্তা শুনে বোকামি নিয়ে বলল, “কেন? আমার ছেলে কি ফেলনা নাকি? সময় হলে মেয়ের বাপেরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যাবে আমার ছেলেকে জামাই হিসেবে নেওয়ার জন্য।”
ইহসান আবারও বোকার মতো কথা বলল, “আরে ও তো হাঁটাই শেখেনি। তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?”
সৃজা ওর পিঠে শক্ত একটা চিমটি বসিয়ে দিয়ে বলল, “পাগল আমি না তুমি হয়েছ। আমি কখন বললাম ওকে এখনি বিয়ে দেব? আমি তো ভবিষ্যতের কথা বলছি। আশ্চর্য লোক!”
ইহসান অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আরে! তার এটুকু ছেলেকে নিয়ে সে এসব কি ভাবছে? উৎকট ভাবনা যতসব। নিজের উপর বিরক্ত হলো সে। ঠিক তখনি বিছানার উপর অবহেলায় ফেলে রাখা তার ফোনটা বেজে উঠল। সৃজা উঠিয়ে দেখল স্ক্রিনে ‘Mizu’ নাম। ও বিচলিত কণ্ঠে বলল, “মিজু ভাইয়ের ফোন। দেখো তো…”
বলে ওর হাতে দিলো ফোনটা। ইজহান শেখ উল্টাপাল্টা কিছু করলেই মিজু তাকে ফোন করে। ইহসান সেটা খুব ভালোভাবেই জানে। আজ আবার কী করল ছাগলটা? ছোটো মাকে নিয়ে না ফুফু শ্বাশুড়িকে দেখতে গেল? নিশ্চয় ওখানে কোনো কান্ড ঘটিয়েছে রাগের মাথায়। ইহসান ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হড়বড় করে বলল মিজু, “ভাইজান, হাসপাতালে আসেন। আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করছে।”
ইহসান কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগই পেল না, তার আগেই মিজুর উদ্বেগজনিত কথাটা তাকে থামিয়ে দিলো। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, “এক্সিডেন্ট?”
মিজু এলোমেলো স্বরে বলতে লাগল, “এক্সিডেন্ট না ভাই ভুল বলছি। অ্যাটাক। কেউ অ্যাটাক করছে আমাদের গাড়িটার উপর। স্যার বলছিল দেখে মাওয়াতে গেছিলাম আমরা, ভাবি আর আইরাহকে নিয়ে। সেইখান থেকে ফেরার পথে আমিনবাজার আসতেই ফাঁকা রাস্তায় একটা ট্রাক পেছন থেকে ধাক্কা…”
আরকিছু বলতে পারল না মিজু, হু হু করে কেঁদে ফেলল, “আইরাহ মামণির মাথায় আঘাত লাগছে। কিন্তু হাসপাতালে আসার আগ অবধি জ্ঞান ছিল। কিন্তু এইখানে আনার পর থেইকা মামণিটার জ্ঞান ফিরছে না। ডাক্তাররা কীসব বলছে, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। ইস্মিতা ভাবিও মারাত্মক চোট পাইছে। ভাবিরে বুঝাইয়া কোনোমতে ইমার্জেন্সিতে পাঠাইসি। কিন্তু স্যার তো পাগলের মতো করতেছে।”
সংক্ষেপে সবটা শুনে ইহসান কোনোমতে বলল, “কী করছে ও?”
“জুনিয়র ডাক্তাররে মারধর করসে। নিজেও চোট পাইছে, র ক্তার ক্তি অবস্থা, স্টিচ নেওয়া লাগবে। কিন্তু স্যার ফার্স্ট এইডটা পর্যন্ত নিতেছে না। আপনি আসেন, আমার মাথা হ্যাং। একা কিচ্ছু বুঝতেসি না।”
আইরাহ! ইজহান শেখের প্রাণভোমরা, তার আরেকটা মা! তার ছোট্ট মামণিটাকে নিয়ে এতো বড়ো দুঃসংবাদ খবর কেন শুনতে হলো তাকে? ইহসান টের পেল তার পা দুটো মেঝেতে আটকে গেছে। শীতল ঠেকছে শরীর। চারদিক কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।
অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৬ (৩)
সৃজা আবছা আবছা শুনছিল মিজুর কথা। পুরোপুরি সবটা বুঝতে পারেনি। উৎকণ্ঠিত হয়ে ইহসানকে জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনি দেখল ইহসান শেখের পা দুটো টলছে। এবং টলমল অবস্থায়ই সে বেরিয়ে যাচ্ছে। সৃজা ছুটে গিয়ে পথ আগলালো ওর। দু’হাতে বাহু ধরে উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে? কে এক্সিডেন্ট করেছে আমাকে বলো প্লিজ। না বলে যেও না…”
“আমার মায়ের, আইরাহ মামণির।”