অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৯

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৯
ইসরাত জাহান ফারিয়া

বা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট। চড় খেয়েছে এটা নিশ্চিত। কিন্তু কার এতো সাহস ইজহান শেখের গালে থাপ্পড় বসায়? ইহসান খানিকটা ঝুঁকে এসে চোখ ছোটো ছোটো কোরে দাঁড়ি ভর্তি গালটা ভালোভাবে দেখে নিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “কে মারল?”
“মারেনি কেউ।”

অপ্রস্তুত গলা ইজহানের। ইস্মিতার হাতে চড় খেয়েছে সে, শুনলে বাড়ির সবাই…এমনকি কেমিটাও বোধহয় হাসবে। না, এ কথা জানানো যাবে না। সে মুখটা ফিরিয়ে নেয় অন্যপাশে। যেন ভেড়াটা আর না দেখে তার মুখ, প্রশ্ন না করে তাকে এ বিষয়ে। ইহসান জোর করে আবারও নিজের দিকে ফেরায় ওকে, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে এরপর উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ এনে ওর গালে লাগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে, “এক্সিডেন্টে লেগেছিল নাকি? খেয়াল করিনি তো এতদিন!”
বরফের ঠান্ডায় গাল জমে গেছে ইজহানের। সে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে একনাগাড়ে। যার মানে এক্সিডেন্টেই গালের ওখানে আঘাত লেগেছিল, যা এতদিনে প্রকট হয়েছে।শুনে ইহসান চিন্তিত স্বরে বলে, “চল, ডাক্তার দেখিয়ে আনি।”
ইজহান বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “না, লাগবে না৷”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কেন?”
“আমি ঠিক আছি।”
ইহসান নিচু স্বরে বলে, “তা তো দেখছিই, কেমন ঠিক আছিস! ফুলে আছিস লুচির মতো। থাপ্পড় যে খেয়েছিস এটা বল। কে দিয়েছে, ইস্মিতা? আচ্ছা, ব্যাপার না। বউয়েরা চড়-লাত্থি দেয়ই। ইট’স নরমাল। কিন্তু তোকে এখন কেমন লাগছে জানিস?”
“কেমন লাগছে?”
“ছোটোবেলায় প্যান্টের জিপারে বাজপাখিটা আটকে যাওয়ার পর যখন শুনলি ওটা কেটে ফেলতে হবে, তখন যে ভীতু ভীতু চেহারা হয়েছিল তেমন লাগছে তোকে এখন।”
ইজহানের ভ্রু কুঁচকে এসেছিল দুঃসহ অতীতের কথা মনে করে। তবে তার নিজেরও কিছু মনে পড়তেই সে ইহসানের দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসলো। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “যেখানে সেখানে শুশু করে দিতিস, তোর পাওয়ার প্ল্যান্ট তো সাইকেলের চাকায় আটকে গেছিল। ভুলে গেছিস নাকি?”

সৃজা চা দিতে এসেছিল ইহসানকে। ওর চোখদুটো কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম হলো দু-ভাইয়ের কথা শুনে। মানে যা তা বিষয় নিয়ে কথা বলছে এরা! তাও আবার বসার ঘরে বসে।
বাচ্চা রয়ে গেছে নাকি? হালকা কাশি দিয়ে সে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “তোমরা এতো দুষ্টু ছিলে?”
ইজহান মাথা নাড়ে। তড়িঘড়ি করে আগে জবাব দেয়, “আমি না, তোমার বর। ওর তো ডায়াপারও লাগতো বেশি। কেন তুমি এসব জানো না? ইস্মিতা তো আমার সব জানে।”
সৃজা চোরাচোখে ইহসানের দিকে তাকায়। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে, আসলেই কী? ইহসান থতমত খেলেও বিরক্ত চেহারা বানিয়ে ওকে বলে, “আমার চা দে, এসব পোঙটা ব্যাটামানুষের কথা কানে নিস না।”

ইজহান শেখ তেড়েমেরে বিশ্রি একটা গালি দিয়ে সুন্নতে খৎনার দিন কে, কী কাহিনী করেছিল সেই প্রসঙ্গে চলে গেল। বিরক্ত সৃজা চায়ের কাপ ওর
হাতে ধরিয়ে দিয়ে পগারপার হলো মাথাখারাপ দু’জনের বেফাঁস কথাবার্তা না শোনার জন্য। এদিকে
ইজহান ক্রুর দৃষ্টিতে দেখে ভাইকে। ইচ্ছে করে
একটা থাপ্পড় মেরে এর গালও লাল করে দেয়! ইস্মিতা থাপ্পড় মেরেছে, পরে আবার আদরও দিয়েছে এই মহিলা তাকে। প্রথমে অবশ্য জোরাজোরি কর‍তে হয়েছে, কিন্তু পরে ইস্মিতা নিজেই খুব করে তাকে আদর করে দিয়েছে। গালে, কপালে, ঠোঁটে, সারামুখে। ভীষণ আদর করে দিয়েছে ইজহানজাদীর মা তাকে। মিলমিশ করে নিয়েছে তার সাথে। ভেবেই পুলকিত বোধ করে ইজহান শেখ। আকস্মিক তার মাথায় দুর্ঘটনার মুহূর্তটা খেলে যায়, ইশ! সেদিন যদি কারো কিছু একটা হয়ে যেতো…সে কী করতো?

এতো আদর, এতো ভালোবাসা তাকে কে দিতো? ইহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুঝতে পারে কোন বিষয়ে ঘামছে তার কপাল। ইজহান হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে ইহসানের কলার চেপে ধরে ক্রোধে কম্পিত গলায় বলে, “এতো সোজা নয় তুই যেমনটা ভাবছিস, তোর বাপ আজিজ শেখ যতোটা ভাবছে! ইজহান শেখ কোনো মূলা নয় যে, সে জানতে পারব না কে আছে এসবের পেছনে! সব প্রমাণ হাওয়া করে দিলেও! আমি ইজহানজাদীর পাপা, টনা-মনার বড়ো পাপা।
অতো সহজ না আমাকে বোকা বানানো ভেড়ার দল…”
ইহসান চমকে উঠলেও নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে৷ রাগে উত্তেজিত ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে চোখ টিপে তির্যক হেসে বলে, “রিল্যাক্স, রিল্যাক্স ডুড!’’

কুচকুচে কালো, বলিষ্ঠ এবং নিথর একটা দেহ পড়ে আছে মাটিতে। লুঙ্গি পরণে উদোম গা। ক্ষতবিক্ষত পেট। মাথাটা পুরোপুরি গ লা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। মুখ থেঁ তলে দেওয়া হয়েছে পাথর দিয়ে। দু’হাতের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। মুখের ভেতর একটা দাঁতও অবশিষ্ট নেই। তবে জিবটুকু বের হয়ে আছে, চোখের ওখানটা শূন্য। কোনোকিছু দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হয়েছে লাল অক্ষিপট। এখনো কালো হয়ে আসা রঞ্জক পদার্থ গড়াচ্ছে কার্নিশ বেয়ে। কুচকুচে কালো দেহের অধিকারী ব্যক্তিটি প্রাণ ত্যাগ করেছে, ঘন্টাও পেরুয়নি। তিন হাত দূরে অবহেলিত ভাবে পড়ে থাকা ধাতব, চকচকে ছু ড়িটা থেকে এখনো ফোঁটায় ফোঁটায় তাজা র ক্ত ঝরে পায়ের নিচের সবুজ ঘাসগুলোকে রক্তিম করে দিচ্ছে। লাল তরলে রঞ্জিত হওয়া ফতুয়ার একেকটা বোতাম খুলতে খুলতে আজিজ শেখ ঘৃণিত চোখে মৃতদেহটিকে একবার দেখেন, এরপর থুতু ছুঁড়েন।

বীভৎস মৃ ত্যু উপহার দিয়েও তার মন পরিতৃপ্তি নয়। তার মনে হচ্ছে, খুব সহজ একটা মৃত্যু উপহার দিয়েছেন তিনি এই খু নে ভ্যান চালককে। যা তার প্রাপ্য ছিল না। বিরক্তিতে নিশপিশ করে উঠে তার হাত। আগুনের হলকা বয় দু-চোখ থেকে৷ ঠিক সে সময়টাতেই আজিজ শেখের কানে আসে, ভয়ার্ত গলার কান্নার শব্দ। আজিজ শেখ থমকে দাঁড়ান এক মুহূর্ত! কণ্ঠটা একটা বাচ্চার। ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। মাকে খুঁজছে। করুণ পরিস্থিতি। ভীষণ রকম বিরক্তিতে আজিজ শেখের কপাল কুঁচকে আসে। ট্যাপের পানি চোখেমুখে ছিটিয়ে, শরীরে লেগে থাকা রক্ত মুছে নেন ফতুয়াটা দিয়েই৷ এরপর আবার পানি দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছে গ্যারেজে প্রবেশ করেন। তার পোষা দোসররা তাকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা বানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। একজন জিজ্ঞেস করে, তার কিছু লাগবে কি-না! আজিজ শেখ সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বেবি চেয়ারে বসে থাকা বছর চারেকের ছোট্ট বাচ্চাটাকে দেখিয়ে গমগমে স্বরে ধমকে উঠে, “বান্দির বাচ্চারা! এইটুকু শিশু কান্নাকাটি করে ক্যান? চুপ করাইতে পারোস না? ভেড়ার বা* খাইয়া পুরুষ হইছস?”

থাপ্পড় খেয়ে লোকটা ভড়কে যায়। গালে হাত দিয়েই জবাব দেয়, “এই বাইচ্চা চুপ করে না চাচা। দুইটা চটকানাও দিছি, ডরায় না। খালি মায়ের কাছে যাইব বইলা চিক্কার দিতেছে।”
“বাচ্চা তো মায়ের কাছে যাইব বইলাই চিক্কার দিব! তুই চটকানা মারলি কেন? বাচ্চার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস কই পাইলি?”
আজিজ শেখ মুচড়ে ধরেন চ্যালাটার হাত।
এদিকে উপস্থিত সকলে হতভম্ব! মানে কী?
নিজেই বাচ্চাটাকে অপহরণ করিয়ে এনে নিজেই বলছে বাচ্চার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পেল কই! বিভ্রান্ত একজন বলে, “চাচাজান, মনে কিছু নিয়েন না। আপনার মতিগতি আমরা বুঝবার পারতেসি না। এরে তো মারতেই আনছি আমরা, তাই না? দুইটা চটকানা দিলেও যা, জানডা নিলেও তা। পাপ লঘু হইব না।”

আজিজ শেখ তার পানে রক্তচক্ষু ছুঁড়লেও কথার জবাব দেন না। এগিয়ে যায় বাচ্চাটার দিকে। যে এখন তাকে দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে! আজিজ শেখ বাচ্চাটার সামনে বসে পড়ে খুব নরম হাতে ওর গাল ছুঁয়ে বলেন, “না, পাখি হইবার আগে ওরে এতো কষ্ট দিব না। আরে বাচ্চারা হইল ফেরেশতা তুল্য মানুষ! তাদের এত কষ্ট দেওয়া যায় না, বুঝলি হারামখোরেরা?”
একজন বলে, “আপনি মনে হয় ভুইলা যাইতেছেন এইডা এমপির কলিজার টুকরা পোলা? মোজতবা খা* বাচ্চার কলিজার নাতি। তার বংশের প্রথম প্রদীপ?”

আজিজ শেখের কোমল চেহারা মুহূর্তেই কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেল। তিনি হুঙ্কার ছাড়েন এ পর্যায়ে। বিকৃত কণ্ঠে হিসহিসিয়ে বলেন, “অথচ তার জন্যই তার বংশ প্রদীপের আজ এই অবস্থা। শু* বাচ্চা আমায় এমন জায়গায় পৌঁছায় দিসে যে একটা বাচ্চার প্রাণও নিতে হইবো আমার। ব্যাপার না, নিব আমি। আমার বাচ্চাদের উপর হাত বাড়াইছে না? আবার বড় গলা করে বলে, আমার বংশ নির্বংশ করবে? দেখ এখন, কে কার বংশ নির্বংশ করে।”
হঠাৎ খুব জোরে হেসে উঠেন তিনি। দু-আঙুলে ছুঁয়ে দেন বিভ্রান্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা সৈয়দ মোজতবার মনোজের প্রিয় নাতি এবং বর্তমান এমপি সৈয়দ মুজতাসিম মনোজের বড়ো সন্তানের সুন্দর মুখটা। কী মায়াভরা মুখ, জলে ভরা চোখ!

দেখে নিজের নাতি-নাতনিদের কথা মনে পড়ে তার। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সংযত করে ফেলেন আজিজ শেখ। শত্রুকে দুর্বল করতে গেলে শত্রুর বীজটাই উপড়ে ফেলে দিতে হয়। নিজেকে দুর্বল করতে হয় না। আজিজ শেখ হাত বাড়িয়ে পাশে
থাকা কাচের বাটি থেকে খাবার তুলে বাচ্চাটার মুখের সামনে ধরে বলেন, “খেয়ে নাও বাবু, খেয়েদেয়ে তৈরি হও। পৃথিবী ত্যাগ করলে এই খাবার আর খাইতে পারবা না।”
আধো স্বরে বলে বাচ্চাটা, “আ আমি খাব না।”

“কেন খাবা না? তোমার কথামতো তোমার পছন্দের খাবারই তো আনা হইছে।”
“না, মাম্মা খাইয়ে দেবে। আমি খাব না।”
আজিজ শেখ আগের চেয়ে অত্যধিক নরম অথচ জেদী গলায় বলেন, “উহু, খাইতে হবে। না খাইলে মায়ের কাছে যাবা কেমনে সোনা?”
পাশ থেকে ষণ্ডামার্কা একজন বাগড়া দেয় আজিজ শেখকে, “চাচা, আপনি কী কইতেছেন? ওরে তুইলা আনতে আমাগো জান শেষ! কী পরিমাণ রিস্ক নিয়া কাজ করছি জানেন আপনি? এমপির পোলা…মুখের কথা না। এখন আপনি ওরে মায়ের কাছে পাঠাইলে তো আমরা ফাঁইসা যামু।”
আজিজ শেখ আগুন চোখে ষণ্ডামার্কা চেহারার লোকটার দিকে তাকিয়ে গালি দেন, “তোর কথা শুইনা ঠিক করমু কারে কই পাঠামু, না মারমু? খা* বা*
চোপা বন্ধ রাখ নয়তো জবান বন্ধ কইরা দিমু আজীবনের মতো।”

ভড়কে গেল ষন্ডা চেহারার লোকটি। বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে আমতাআমতা করতে থাকে, “ক কিন্তু?”
“কোনো কিন্তু না। ওরে ওর জায়গামতোই পাঠাব আমি। তোদের বলি নাই মাথা ঘামাইতে।”
এমপি পুত্র সবই শুনছিল। সে হঠাৎ আশা জাগানিয়া সুরে বলে, “মাম্মার কাছে নিয়ে যাবে?”
আজিজ শেখ তার দিকে ফিরে হাসেন, “হ বাচ্চা।”
“কখন যাব?”
“যখন খাবার খাইয়া শেষ করবা!”

এতক্ষণ যাবৎ কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলা বাচ্চাটির কাছে মনে হয়, এ লোকটা তাকে এখান থেকে বাঁচিয়ে নিতে এসেছে। এই খারাপ লোকগুলো থেকে উদ্ধার করে মাম্মার কাছে নিয়ে যাবে তাকে। একবার মাম্মার কাছে গেলে আর কখনো সে স্কুল ছুটির পর গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে একা একা বেরিয়ে আসবে না। মাম্মা-পাপা, চাচ্চু, দাদুর জন্য অপেক্ষা করবে। অপরিচিত কেউ চকলেট দিলে সে খাবে না। ভীষণ অনাগ্রহ থাকা স্বত্তেও সে মুখ হা করে খাবার খেতে চায়। আজিজ শেখ বাঁকা হেসে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেন, “এতো ভদ্র বাচ্চাটা, আহারে! বাপ-দাদার জন্য অকালে প্রাণটা খোয়াইব।”

শুদ্ধ-অশুদ্ধ ভাষার ব্যবহার করেন আজিজ শেখ। শুনতে কেমন যেন লাগে! চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আজিজ শেখের পোষা দোসররা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পাপকাজে জড়িতে থাকলেও এমন নয় যে তারা পাথর, অনুভূতি নেই। কখনো কখনো তাদের বিবেকও জাগ্রত হয়, দংশন করে। কিন্তু অর্থের কাছে সেসব নিতান্তই ফিকে। তারা সব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আজিজ শেখের কান্ড দেখতে থাকে। কাচের বাটিতে থাকা দুধ, কলা এবং পেস্টিসাইড দিয়ে মাখা ভাতটুকু নিজ হাতে খাওয়াচ্ছেন তিনি এমপি পুত্র সৈয়দ সামাহান রিদ্বানকে, যার মাড়িতে ঠিক ঠিক আঠারোটি দাঁত আছে, সৈয়দ মোজতবার মনোজ প্রতিরাতে গল্প শুনিয়ে যাকে ঘুম পাড়ায়!

দাদুর মতো দেখতে লোকটার হাতে খেতে খেতে এমপি পুত্র নাক টানে, চোখ ছলছল করে উঠে তার মাম্মাকে মনে করে। খাওয়ার সময় কতো বায়না করে মাকে জ্বালাতো, ঘরময় ছুটোছুটি করতো! বিরক্ত হয়ে মাম্মা বকা দিলে সে আর খেতো না, পাপা রাতে ফিরলে অভিযোগ করতো। তখন মাম্মাকে বকা দিয়ে এরপর পাপা তাকে খাইয়ে দিতো। কিন্তু আজকের পর থেকে সে আর কখনো মাম্মাকে জ্বালাতন করবে, অভিযোগ করবে না। ভদ্র বাচ্চার মতো খেয়ে নেবে। গালের ভেতর থাকা ভাতটুকু চিবুতে চিবুতেই সে গলায় জ্বলুনি অনুভন করল খানিক। তৎক্ষনাৎ খাওয়া থামিয়ে সে অনাগ্রহী এবং আধো আধো স্বরে বলল, “আমার পেটে জ্বলু জ্বলু করছে। আর খাব না।”
আজিজ শেখ অস্পষ্ট উচ্চারণ করে বলেন, “আচ্ছা, খাইও না।”

“আমার বেশি বেশি জ্বলু করছে, ব্যথা লাগছে। আমার নাকে কষ্ট হচ্চে। মাম্মা বকবে আমায়, ।”
হাত-পা ঘেমে উঠছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হয়ে আসছে বাচ্চাটার। একনাগাড়ে নিজের কষ্টের কথা বলতে বলতে একটা সময় বমি করে দিলো সে আজিজ শেখের পায়ের কাছে। পরক্ষণেই নেতিয়ে পড়ল চেয়ার থেকে। পেট দু’হাতে চেপে মাটিতে গড়াগড়ি করতে করতে অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করল সে, “দাদু, আমি কি মরে যাব?”

আজিজ শেখ উপর নিচ মাথা নাড়েন। তা হ্যাঁ’ নাকি ‘না’ বোধক পরিষ্কার বোঝা যায় না। তিনি একদৃষ্টে চেয়ে দেখছেন চার বছর বয়সের বাচ্চাটার ছটফটানি। কোনো অনুভূতি হচ্ছিল না হলেও একটুখানি জ্বলুনি টের পেলেন ক্ষণিকের জন্য। বাচ্চাদের মেরে ফেলার মধ্যে কোনো মহত্ত্ব নেই। তবুও কাজটা করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। মৃতপ্রায় শিশুটির মুখে ‘দাদু’ ডাকটি শুনে তাই অবিশ্বাস্য ভাব ফুটে উঠে তার চোখের তারায়!

বিকেলের শেষ সময় তখন। সন্ধ্যা নামি নামি। আলো জ্বলে উঠেছে শেখ বাড়ির প্রত্যেকটা কোণায় কোণায়। দুই দিন, দুই রাত পর বাড়ি ফিরেছে ইনজান শেখ।
এ দু’দিন কোথায় ছিল বাড়ির কেউ অবশ্য জানে না। কেউ আগ্রহও দেখায় না। আজিজ শেখ তো অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে তাকে। তবে গোপনে ছেলের জন্য দেহরক্ষীও নিয়োগ দিয়েছেন। যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। আরসালান ইনজান শেখও না। কারণ সে এসব পছন্দ করে না। জানতে পারলে তুলকালাম কান্ড ঘটাবে। কিন্তু মোজতবার মনোজ এবং তার এমপি পুত্র কখন, কী ঘটিয়ে দেয় সেই আশঙ্কা থেকেই এই কাজ করা!

সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে চকচকে কালো ডার্বি জুতো পরিহিত ইনজান শেখের পা জোড়া থমকে দাঁড়ায় বসার ঘরের সামনে। খানিকটা সময় ওখানে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখে তার ভাইকে। যে কিছু একটার ফর্দ লিখছে সেখানে বসে। যে তার কোনো কিছুতেই মাথা ঘামায় না আজকাল৷ মারধর তো দূর, বকেও না, কথাও বলে না তার সঙ্গে। সামনে পড়লেও তার মুখের দিকে তাকায় না। যেন সে কোনো কীট! এমনভাবে গা বাঁচিয়ে চলে।
কিন্তু আরসালান ইনজান শেখ তো কোনো কীট নয়, সে জ্বলজ্যান্ত মানুষ। আজিজ শেখের জান!

তার মতো সুদর্শন যুবক পুরো শহরে কেন এই দেশেও বোধহয় নেই। দিনে-রাতে যেখানেই সে একটু সময়ের জন্য স্টে করুক না কেন, সব মানুষের নজর তার দিকে থাকে। নাইট ক্লাবে যখন একটু ড্রিংকস করতে যায় তখন মেয়েরা তার থেকে নজর সরাতে পারে না, কাছে ঘেঁষতে চায়। মোহগ্রস্তের ন্যায় আচরণ করে। কিন্তু কয়েক মাস যাবৎ এসব সস্তা মেয়েমানুষের প্রতি তার আকর্ষণ কাজ করছে না, তাদেরকে টাচ করতে ইচ্ছে করছে না। তার শুধু টাচ করতে ইচ্ছে করে ঐ বড়ো বাচ্চাটাকে, যাকে অনেকগুলো বছর আগে হসপিটালে সে চকলেট দিয়েছিল! এক দুপুরে ছাদে একা পেয়ে তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার বিনিময়ে থাপ্পড় খেয়েছিল!

সেই থাপ্পড়ে তার গাল কী ভীষণ ব্যথা করছিল, আবার একটু ছুঁয়ে দিতেই ব্যথাটা নিমিষেই মিলিয়ে গেছিল। জাদু জাদু এই হাতদুটোতে মন ভরে চুমু খেতে চায় সে আজকাল। খুব গভীর করে ছুঁয়ে দেওয়ার অদম্য বাসনা জাগে তার মনে। অথচ তাকে টাচ করা, তার আদর পাওয়াটা এতো সহজ নয়। ঐ মেয়েটা তাকে পছন্দ করে না, ঘৃণা করে। সে কখনোই কাছে আসবে না তার। আর না আদর দেবে। তাছাড়া তার ভাই, ইহসান শেখ! সে কখনোই এটা মেনে নেবে না। এসব ভেবে ইনজান শেখ ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবে। এরপর পা বাড়ায়। দোতলায় নিজের ঘরের না গিয়ে চলে আসে বসার ঘরে। বোধহয় অনেকগুলো দিন পর!

অদ্ভুত মিষ্টি একটা পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে লাগতেই ইহসান বোঝে কে এসেছে, তাই সে মুখ তুলে আর তাকায় না। দেখেও না কে এসে দাঁড়িয়েছে তার নিকটে। ফর্দ লিখাটা শেষ করে চুপচাপ উঠে যেতে চায় সেখান থেকে। কিন্তু পেছন থেকে দুটো হাত তাকে আটকে ধরে। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ইহসানের ভ্রু কুঁচকে আসে, বাধা দেওয়া যুবককে দেখেও তার কপালে ভাঁজ পড়ে। কয়েক মাসের ব্যবধানে আরসালান ইনজান শেখ আবারও নিজের পুরোনো রুপে ফিরে গেছে। লম্বা চুল, গালভর্তি দাঁড়ি, রক্তিম চাহনি…

সেই পুরোনো বিষাক্ত সৌন্দর্য! ইহসান শেখের হাঁসফাস লাগে তাকে দেখে। কী চায়? তার কাছে কী চায়? সব লেনদেন তো বহু আগেই শেষ। মাথা ঘামায় না সে এর কোনো বিষয়ে, না বাধা দেয় কিছু করতে! ইহসান এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে ঘৃণাভরা দৃষ্টি ছুঁড়ে পা বাড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পারে না। তার আগেই ঝট করে এসে তাকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে ইনজান শেখ। দু’হাতে তার পেট আঁকড়ে ধরে পিঠে মুখ গুঁজে বলে, “কথা বলো না কেন আমার সাথে? আমার অনেক কথা আছে তোমার সাথে।”

নিঃশ্বাস আটকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ইহসান। কিন্তু যত ছাড়ানোর চেষ্টা করে ততই তাকে জড়িয়ে ধরে ইনজান। ইহসানের ধৈর্যের বাঁধ ফুরিয়ে আসতে থাকে। হতাশ কণ্ঠে সে বলে, “তোকে তো শান্তিতে থাকতে দিলাম। আমাকেও দে। এতো অকৃতজ্ঞ হোস না। ভার বইতে পারবি না।”
ইনজান শেখ তির্যক কণ্ঠে বলল, “আমার তো শান্তি কোনো কালেই ছিল না, তাই জানি না সেটার অনুভূতি কেমন! তবে ইদানীং যেটা বুঝতে পারছি একটা মেয়ে, খুব জোরে থাপ্পড় দেয়, আবার ছুঁলে ব্যথা ভালো হয়ে যায়।”
“আমি কি করব?”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৮ (২)

“আই ওয়ান্ট হার টু গিভ অ্যাফেকশন অন হার ওন, আই নিড হার অ্যাফেকশন। যদিও সামান্যই হোক, তবু যেন আমি তোমার সেই ‘শান্তি’ নামের অনুভূতির ছিঁটেফোঁটা পেতে পারি। তুমি জানতে চাও না সে কে?”
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা উপহার দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বিদঘুটে, বিকৃত চাওয়াটা জাহির করল সে।
ইহসান জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে দেখল ওকে! থেমে থেমে শুধাল, “কে?”
“একটা জেদী মেয়ে।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮০