অশ্রুবন্দি পর্ব ৮০

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮০
ইসরাত জাহান ফারিয়া

“এই জেদী মেয়েটাই প্রথম যে আমার আঘাতের দিকে ফিরে তাকিয়েছে। জানো কি নিয়ে? মায়া নিয়ে। একবার না, বহুবার। ও-ই প্রথম! যাকে একটু ছুঁয়েছি বলে…”একটু থেমে বিভ্রান্তভাবে মাথা নেড়ে বলল আরসালান ইনজান শেখ, চোখে তার এক পৌষের কুয়াশা, “না, না—ছুঁইওনি। আমার নাক ডুবে গিয়েছিল ওর ভেজা চুলের ভাঁজে। সেই ঘ্রাণে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখনই সপাটে আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল। হাতে মাংস নেই, শুধু হাড়। কিন্তু আমার গালটা জ্বলে যাচ্ছিল, ব্যথায় চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। অথচ মুহূর্তেই যখন ওর হাতটা টেনে নিয়ে গালে রাখলাম… ব্যথা উধাও! অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে গেল। এর জন্য অবশ্য সেই জেদী রমণী আমাকে ধিক্কার দিয়েছিল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে তখন সেলিন ডিওনের একটা গান মনে হচ্ছিল বারবার,

‘ইন ইয়োর আইজ
আই সি রিবনস অফ কালার
আই সি আস ইনসাইড অফ ইচ আদার
এন্ড হোয়েন উই টাচ
দ্যাট ফিলিংস সো হট
ইট মেইকস মি ওয়ান্ট টু বি ক্লোজার!’
ইটস ফলিং, ফলিং ইনটু ইউ
দিস ড্রিম কুড কাম ট্রু
সো স্মুথ এন্ড সো ট্রু
আই অ্যাম ফলিং, ফলিং ইনটু ইউ
সুর করে গেয়ে উঠল জান। পরক্ষণে সুন্দর করে হেসে ফেলল। সেই হাসি সুন্দর তবে ভীতিকর। হাসির আড়ালে অশুভ ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। হেসে হেসেই বলল সে, “কীভাবে যে তাকিয়েছিল ও আমার দিকে! এভাবে কোনো মেয়ে কখনো তাকায়নি। স্লেভগুলো তাকাতো, শরীরের লোভে, নোংরা ইঙ্গিতে। কিন্তু ওর চোখে না ছিল কামনা, না ছিল প্রলোভন! কী ছিল, আই ডোন্ট নো। তবে যা ছিল সেটা আমাকে সিডিউস করার জন্য যথেষ্ট!”
একটু থেমে, নিচু স্বরে আবার ফিসফিস করে বলল সে, “আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় শুনো, নিজে থেকে আমাকে সিডিউস করে আমায় বলে, সে তার বোন এবং তার ভাইয়া মানে তোমার কাছে আমার নামে নালিশ জানাবে। আচ্ছা, আমি কি ভয় পাই নাকি তাদেরকে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গর্বিত ভঙ্গিতে হাসলো আরসালান ইনজান শেখ। ইহসানের মনে হলো, এত ভয়ংকরভাবে কখনো হাসতে দেখেনি ওকে। ভেতরটা হিম হয়ে এলো ওর। নাম না উল্লেখ করাতেও সে বুঝতে পারল, কাকে নিয়ে এ সমস্ত কথা বলছে জান! এদিকে, সচকিত চোখে ওকে লক্ষ্য করছিল জান। কিন্তু ইহসানের স্থির হয়ে আসা দৃষ্টির কোথাও নিজের জন্য কোনো প্রশ্ন খুঁজে পেল না সে। একপ্রকার জাপ্টে ধরে সোফায় বসিয়ে দিলো সে ইহসানকে। এরপর নিজেও হেলান দিয়ে শরীর টানটান করে বসলো।

গলা থেকে টা-ই খুলে হাতে নিয়ে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে আবার বলতে শুরু করল, “বহু আগে দেখেছিলাম জেদী মেয়েটাকে। নয়-দশ বছর আগে। ছোট্ট বাচ্চা তখন। ফ্রক পরতো, কাঁধ সমান চুলে সিঁথি করে একপাশে ফ্লোরাল ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখতো। দু-একবার ওকে ওর মায়ের সঙ্গে দেখেছিলাম। তেমন কিছু মনে নেই। পুরোপুরি দেখেছিলাম তখন, যখন আমার দেওয়া ব্যথায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছিল। আমি গিয়ে যখন ওর সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, ও ব্যথাভরা চোখে আমায় দেখছিল… অদ্ভুত মজা লেগেছিল, কিন্তু আকর্ষণ জাগেনি আমার। দ্বিতীয়বার দেখার তৃষ্ণাও জাগেনি। অথচ… বড় হয়ে যখন আবার সামনে এলো, প্রথম দেখাতেই ও আমার সমস্ত আকর্ষণ কেড়ে নিল। জলজ্যান্ত ল্যাভেন্ডারকেও পরোয়া করল না আমার চোখ।”
ইনজানের চোখ ঝলসে উঠল।

“সেই রাতে ঘুমাতে গিয়ে দেখলাম, আমার মাথার পাশে বসে আছে সে। লাল জামা পরা, গায়ে কোনো ওড়না নেই। খুব ‘আমার’ আমার লাগছিল তখন ওকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন এসেছ? জেদী মেয়ে কিছু বলল না, শুধু হাসল। হেসে হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, কাটা হাতে ব্যান্ডেজ করল, তারপর চুমু খেল। এতোটা যত্ন তোমরা কেউ কখনো নিয়েছ আমার? নাওনি। আধো অন্ধকার ঘরে আমি ওকে বুকে নিয়ে আদর করলাম। জেদী মেয়েটাও আমাকে আদর ফিরিয়ে দিলো, ওর পেটে মাথা রেখে ঘুমাতে দিলো। সেই রাতে বহুদিন পর আমি শান্তিতে ঘুমালাম। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙল, দেখলাম ও নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে খুঁজতে এসে দেখি তোমাদের আন্ডা বাচ্চদের নিয়ে আনন্দ করছে, কেক কাটাকাটি করছে।

আমি দোতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কিন্তু ও তাকালই না। আমাকে রেখে কেমিকে নিয়ে শারাফের সঙ্গে মাতামাতি। এতো রাগ হয়েছিল আমার! এরপর যখন বসার ঘরটা ফাঁকা হলো, আমি যখন নিচে নেমে এলাম, ও আমাকে দেখে এমন একটা ভান করল যেন আমাকে চেনেই না। সারারাত বুকে নিয়ে যাকে আদর দিলাম, সে আমার কাছেই ঘেঁষছে না, অপরিচিতের মতো ব্যবহার। আমার শরীর ব্যথা করছিল ওকে দেখে। অবশ্য খুব হতবাকও হয়েছিলাম। এতোটা বছর যেটা হয়নি, যে ল্যাভেন্ডারের জায়গাটা এতো বছরেও কোনো মেয়ে নিতে পারেনি সেটা হাসপাতালে শুয়ে কাতরাতে থাকা ঐ ছোট্ট মেয়েটা এক রাতে কীভাবে পারল! নিশ্চয় জাদু জানে, তাই না ব্রো? তো, ঐ জাদু জানা মেয়েটাকে আমার ওকে লাগবে। বিলিভ মি, ল্যাভেন্ডারকে একটুও জ্বালাব না, তোমার কাছেও কিছু চাইব না। শুধু এখানে, এই কাগজটাতে একটা সাইন করে দাও…তাহলে তাহলে আমি…”

আরসালান শেখ ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাগজ বের করতে। কোন পকেটে যে রাখল, খুঁজে পেতে ব্লেজারটা খুলে ফেলতে হলো তাকে। ইহসান ঘাড় সোজা করে এতোক্ষণ ওর দিকেই তাকিয়েছিল। ওর বলা প্রতিটা শব্দ, বাক্য আলাদা আলাদা করে শুনছিল। ওর বিশ্বাস জান যা যা বলছে, সেগুলো সে বলছে না। ইহসান দুঃস্বপ্ন দেখছে, ভুল শুনছে। তাই যখন জান তার পকেট থেকে দুমড়ানো মোচড়ানো একটা কাগজ আর কলম বের করে ওর সামনে রাখলো, ইহসানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। হতবিহ্বল দৃষ্টিজোড়া কাগজের উপর স্থির হলো। একটা ষ্ট্যাম্প পেপার। হাবিজাবি কিছু লেখা, আঁকা। সে পড়ল না। জিজ্ঞাসু চোখে জানের দিকে তাকাল, যেন সে বুঝতে চাইছে কীসের কাগজ আর কীসের জন্যই বা সইসাবুদ করবে সে!

ইনজান শেখ তার দিকে চেয়ে কেমন করে যেন হাসলো, পরক্ষণেই বলল, “জেদী মেয়েটার অভিভাবক হিসেবে এটা এনশিওর করছ যে, ওকে কখনো আমার কাছ থেকে দূরে সরানোর কথা চিন্তাও করবে না। আমি, আমি যখন ইচ্ছে ওর কাছে যেতে পারব, ওকে আদর দিতে পারব, ওর রান্না করা গরুর মাংস খেতে পারব, ওর সঙ্গ চাইতে পারব…আমি যা যা চাই তার সব করতে পারব। মোটকথা, আরসালান ইনজান শেখকে তুমি ইহসান শেখ কখনোই বাঁধা দিতে পারবে না জেদী মেয়েটার কাছে যেতে। বিনিময়ে, সে তোমার ল্যাভেন্ডারের কাছ থেকে চির জন্মের মতো দূরে সরে যাবে। ওকে কখনো জ্বালাবেও না। তোমার সঙ্গে সুখে সংসার করতে দেবে। বিলিভ মি, সত্যিই দেবে।”
কীসব যে বলছে, মাথাটা হ্যাং হয়ে যাচ্ছিল ইহসানের। জেদী মেয়ে, অভিভাবক, ল্যাভেন্ডার… শব্দগুলো তার মস্তিষ্কে কাঠঠোকরা পাখির মতো ঠোক্কর দিচ্ছিল। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগের তীব্রতা নাকি হতাশা বয়ে যাচ্ছিল ইহসান জানে না। অনেকক্ষণ পর সে উঠে দাঁড়াল। এরপর সেন্টার টেবিলের উপরে থাকা ষ্ট্যাম্প পেপারটা কয়েক টুকরো করে ছিঁড়ে পায়ের তলায় পিষে বলল, “সম্ভব না।”

একটা সাইন করলেই জেদী মেয়েটা, যার কোমড়ের কাছে, কাঁধে কুচকুচে একটা কালো তিল আছে, সেই মেয়েটার উপর দখল নিতে এক মুহূর্তও লাগতো না তার। অথচ সই না করে কাগজটা এভাবে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে? ঠিক যেমন তার জীবনটা নিয়ে হেলাফেলা করে সেভাবে? ইনজান শেখের কেমন কেমন লাগছিল! সে ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে ইহসানকে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “হোয়াই ড্যুড?”
“জেদী মেয়েটা আমার বোন। আর আমার বোনকে আমি যার-তার হাতে তুলে দেব না।”
“দেবে না?”
“না।”
আরসালানের জেদী কণ্ঠস্বর, “দেবেই না?”
“দেবই না।”

দৃঢ় কণ্ঠে বলা কথাটা শুনে গভীর অন্ধকার থেকে আগুনের শিখা ঝলসে উঠলে যেমন দেখায়, ঠিক তেমন দেখাল ইনজান শেখের চোখগুলো। আচমকা উঠে অস্থিরচিত্তে সে সোফার চারপাশে হাঁটতে লাগল। হাত ঘুরিয়ে বাতাস কেটে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “জেদী মেয়েটা… ও শুধু আমার, আর কেউ তাতে বাঁধা দিতে পারবে না। তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে, খুব।”
ইহসান নির্লিপ্ত চোখে ওকে দেখল, শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বলল, “ও কেন? পৃথিবীর যেকোনো মেয়ে, হোক তা সাড়ে চারশো কোটি মেয়ে…তাদের মধ্যে যে কেউ একজন, তোর মতো জা নো য়ারের খপ্পরে পড়ুক, তোর জীবনে জুড়ুক আমি তা চাইব না। নো নেভার।”
ইনজান এক লাফে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঝুঁকে এসে বলল, “পৃথিবীর কোনো মেয়েকে তো আমি চাইনি, ওকেই চেয়েছি, ওকেই নেব। তুমি জানো, ওর কোমড়ের কাছে কুচকুচে কালো তিলটা…”
ইহসান ওর মুখ চেপে ধরে ঘৃণাভরা কণ্ঠে বলল, “এখন এসব ধৃষ্টতা সহ্য করতে হবে আমাকে? আর কতো আমাকে নিচু করবি?”

ইনজান শেখ ওর চোখে চোখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, “যার স্নেহ, ভালোবাসা একসময় কাঙালের মতো চেয়ে এসেছি তারটা পাইনি, দেয়নি সে আমাকে, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে। এরপর নয়টা বছর যাবৎ একজনকে চেয়ে এসেছিলাম, তাকেও তুমি নিয়ে গেছ। আমি ভালো ছেলে তাই ঝামেলা করিনি, তোমাকে ওর বাচ্চার বাবা হতে দিয়েছি। এবার তুমিও কোনো ঝামেলা করবে না, আমাকে আমার জিনিসটা বুঝে নিতে দাও।”

অগ্নিদৃষ্টিতে দেখল ওকে ইহসান। পরক্ষণেই ওর দু’ কাঁধ খপ করে ধরল। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ওর কাঁধে ধাক্কা দিতে দিতে বিড়বিড়ালো, “কী বুঝে নিবি তুই? আমার বোনটাকে? যার সবকিছু কেড়ে নিয়েছিস তুই? শৈশব, কৈশোর, মা-বাবার ছায়া, তাদের ভালোবাসা, সুস্থ-সুন্দর জীবন? এসবকিছু? তোর জন্য হারিয়েছে ও এসব!” একটু থেমে শ্বাস ফেলে বল ইহসান, “তোর বাপের অবৈধ টাকায় কিনে দেওয়া কোনো খেলনা না ও, যে চাইলেই পেয়ে যাবি। এতো সহজ না জান।”

সে কী দেখতে অসুন্দর? তার টাকা নেই? সব আছে। তাহলে কেন পাবে না? ঐ দু, একটা ভুলের জন্য? সেসব তো কবেকার কথা! অনিচ্ছাবশত তার দ্বারা হয়ে গেছিল। এসব ধরে বসে থাকলে হবে? না, হবে না। তবুও ভাইয়ের কথায় গায়ে অদ্ভুত জ্বালা ধরে গেল আরসালানের। জেদী, একরোখা কণ্ঠে বলল, “তো, তুমি এপ্রুভাল দেবে না?”
“পৃথিবী ধ্বংস হয়ে আবার সৃষ্টি হলেও না।”
“আমি তোমার ভাই তো!”
“তার আগে এলিজ আমার বোন।”
“আমার চেয়েও আপন?”
“হ্যাঁ।”

ক্রোধে জ্বলে উঠা চোখে তাকিয়ে পরক্ষণেই বিকৃত হেসে ফেলল ইনজান, “তো, জানা নেই, তোমার আপন জিনিসগুলোর প্রতি আমার বিশেষ লোভ আছে? না-কি ল্যাভেন্ডারকে ছাড় দিয়েছি বলে ধরেই নিয়েছ, আমি খুব সাধু পুরুষ হয়ে গেছি? অথচ তুমি এটাই জানো না, এলিজা দোয়া রেহমানের প্রতি খেয়াল দিতে গিয়েই আমি তোমার শয্যাসঙ্গীর দিকে ইচ্ছেকৃত মনোযোগ দিতে পারিনি। নয়তো সে তোমার নয়, আমার বেডেই থাকতো!”
হুট করে কীসের যেন একটা শব্দ হলো, ইনজানের সঙ্গে সঙ্গে ইহসানও তাকিয়ে দেখল সৃজা দরজার কাছে দাঁড়ানো। ওর কোলে আজওয়া। ছোট্ট নীলরঙা ফ্রক পরণে তার বাচ্চা মেয়েটা; নিষ্পাপ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে। ভাইকে বড়ো আব্বার কাছে রেখে মাম্মা-পাপার সাথে বাইরে যাবে বলে অপেক্ষায় আছে সে। ইহসান কিছুদিন যাবৎ ব্যবসার কাজে ব্যস্ত, বাচ্চাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করা হয়ে উঠছে না। আজকে একটু সময় বের করে সৃজাকে নিয়ে বেরুবে বলেই এতোক্ষণ বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ফর্দ তৈরি করছিল সে। এরমধ্যেই ইনজানের আগমন!

“তৈরি?”
ফর্দটা কোথায় ফেলেছে, সেটা এদিকওদিক খুঁজতে খুঁজতে রুদ্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ইহসান। তার বুকের ভেতর আশঙ্কার তুফান, জানের সঙ্গে এসব নোংরা বাক্যলাপের কিছু কি সৃজা শুনে নিয়েছে? চোখে চোখ মেলানোর সাহস হলো না তার।
অস্থিরতা লুকানোর চেষ্টা করতে থাকা ইহসান শেখকে দেখল সৃজা, দেখল ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকা ইনজান শেখকেও। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ওর। স্তব্ধ নজরে দু’ভাইকে দেখে সম্বিৎ যখন ফিরল, তার কিছুপল বাদে সে জবাব দিলো ছোট্ট করে, “তৈরি।”

বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা ফর্দটা খুঁজে পেল না ইহসান। তাই বেরিয়ে এলো ওদের দু’জনকে নিয়ে। বাড়ির সামনে থেকে রিকশা নিলেও চৌরাস্তার মোড় পৌঁছাতেই টায়ার পাংচার হয়ে গেল সেটার। অগত্যা তাদের নামতে হলো। ভাড়া মিটিয়ে ইহসান ফোন বের করতে করতে বলল, “উবার ডাকছি। দাঁড়া।”
সুদূর উচ্চতায় গাঢ় নীলে লাল তুলির আঁচড় কাঁটা। সাদাকালো মেঘ খানিক পরপরই আড়াল করে দিচ্ছে তাদের। অদ্ভুত সুন্দর, চন্দ্র মোহনায় ডুবে থাকা আকাশ। উঁচু-নীচু ভবনের ফাঁকে ফাঁকে লাল-নীল বাতির ঝলকানি খাপছাড়া হয়ে আকাশের সঙ্গে মিলছে। দোকানগুলো আলোয় ঝলমল করছে। অথচ অন্যমনস্ক সৃজা দেখলই না সেসব। না কিছু বলল।

আজওয়া তার পাপার কাঁধে মাথা ফেলে রেখে মাম্মাকে দেখছিল। তার মুখে দুটো আঙুল। এ পর্যায়ে মেয়েটা বোধহয় মাকে ওমন চুপচাপ দেখে আচমকা ঘাড় তুলে মায়ের দিকে হাত বাড়াল কোলে নেওয়ার জন্য। সৃজা নিলো না। এক পলক দেখে নিয়ে চুপচাপ অন্যদিকে ফিরে তাকাল। ইহসান স্থবির দৃষ্টিতে ওকে দেখল, প্রশ্ন করতে গিয়ে সে আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল, তার গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না। ওভাবেই সে তার মেয়ের ছটফটানি কমাতে দু’গালে চুমু খেয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে সৃজার একটা হাত মুঠোয় নিতেই সৃজা ওর থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াল। বলল, “বাড়ি যাব।”
“শরীর খারাপ?”
“না।”
ইহসান আর প্রশ্ন করল না। মূলত প্রশ্ন করার সাহসই পেল না সে। নিজেকে অর্থব, অকৃতজ্ঞ, অকর্মণ্য মনে হলো তার। পীড়া দিতে লাগল বক্ষপটে। সেদিন কেনাকাটা না করেই মাঝপথ থেকে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এলো তারা। এরপর একদিন, দু’দিন, তিনদিন…স্বাভাবিক কথাবার্তা, আদুরে ঠাট্টা, আযরান-আজওয়ার মাম্মা, পাপা হিসেবে
কাছাকাছি আসা কিছুই হয়ে উঠল না তাদের!

এমপি পুত্র সৈয়দ সামাহান রিদ্বান গায়েব। চার দিন ধরে তার কোনো খোঁজ নেই। শহরের প্রতিটি প্রান্তে তাকে খুঁজে দেখা হয়েছে এমনকি স্কুলের আশপাশেও তল্লাশি চালানো হয়েছে; তবুও রিদ্বানের কোনো চিহ্নই পাওয়া যায়নি। যেন হঠাৎ করে সে উবে গেছে।

শহরের স্বনামধন্য একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অধীনে থাকা প্রি-স্কুলের সামনে থেকে হঠাৎ চার বছরের বাচ্চা গায়েব হয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে রীতিমতো আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। অভিভাবকরা স্কুলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করছে ঘটনাটি, ফলে শহরবাসীর মধ্যে খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।অথচ কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও রিদ্বানের কোনো খোঁজ না পাওয়ায় মানুষ আতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ। স্বাভাবিকভাবেই তারা ভাবছে, যদি সৈয়দ মুজতাসিম মনোজের মতো ক্ষমতাশালী মানুষের সন্তানেরই এমন অবস্থায় হয়, তাহলে সাধারণ মানুষদের কী হবে?

এদিকে সৈয়দ পরিবার হাত গুটিয়ে বসে নেই। তারা নিজেদের প্রভাব এবং ক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে। সৈয়দ মোজতবার মনোজ ও তার ছেলে মুনতাসিম মনোজ রীতিমতো উঠেপড়ে লেগেছেন তাদের বাড়ির ছেলেকে ফিরে পেতে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। ঘুষটুষ দিতে কার্পণ্য করছেন না। যে, যা চাচ্ছে নিমিষেই তাদের একাউন্টে ট্রান্সফার করে দিচ্ছেন। গোপনে সোর্সও লাগানো হয়েছে, কিন্তু তবুও কোনো ফল নেই। যেন হঠাৎ করে রিদ্বান নামক ছোট্ট ছেলেটি উবে গেছে।

নিউজে গত কয়েকদিন ধরেই রিদ্বানের নিঁখোজ সংবাদ ঘুরছে। টেলিভিশনের প্রতিটি চ্যানেলে তার হাসিমাখা ছবি, পরিচিতি এবং ফোন নম্বর দেওয়া আছে। দেখা মাত্রই ওই নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়েছে। আবার, বিশ লক্ষ টাকা পুরষ্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। কিডন্যাপড হয়ে থাকলে তারজন্যও তারা টাকা দিতে রাজি। মোট কথা, সৈয়দ পরিবার কোনো কিছুই বাদ রাখছে না তাদের সন্তানকে ফিরে পাবার জন্য মরিয়া। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
এতকিছুর পরেও যখন রিদ্বানের খোঁজ পাওয়া গেল না তখন মোজতবার মনোজের মনে হলো ব্যাপারটা আসলে অপহরণই না।

অপহৃত হয়ে থাকলে এতোদিনে তাদের নিকট একটা ফোনকল অন্তত আসতো। যেহেতু আসেনি, তাই সৈয়দ মোজতবার মনোজ ও তার ছেলে মুনতাসিম মনোজের দৃঢ় বিশ্বাস, রিদ্বানকে গায়েব করার পেছনে নিশ্চয় তাদের কোনো শত্রুরই হাত আছে। আর সেই শত্রু নিশ্চয় ক্ষমতাশালী। হুট করে কী ভাবতেই তাদের বাপ-ছেলের সন্দেহের তীর একজনের উপরেই বিদ্ধ হলো। সপ্তাহখানিক আগে সৈয়দ বাড়িতে এসে হাসতে হাসতে হুমকি দিয়ে যাওয়া আজিজ শেখই কিছু করে থাকতে পারে এটা তাদের দৃঢ় বিশ্বাসে রুপান্তরিত হলো। তবে নিজেদের কুকর্ম ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকায় সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারল না আজিজ শেখের বিরুদ্ধে। যা করার গোপনেই করার প্রস্তুতি নিলো।

কয়েকদিন পিতার কাজকর্মের উপর নজর রাখার পর ইহসানের ধারণা করতে পারল, রিদ্বানের নিঁখোজ হওয়ার পেছনে তার জন্মদাতারই কোনো কূটচাল আছে। এবং এটা সে বিশ্বাসও করে। কারণ তার পরপরই মনোজদের সঙ্গে আজিজ শেখের দেখা করা এবং তার কয়েকদিনের মধ্যে রিদ্বানের হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে তার সন্দেহকে সত্যি করে তুলেছে। কিন্তু সত্যিই কি লোকটা একটা বাচ্চাকে অপহরণ করেছে? করলেও বাঁচিয়ে রেখেছে নাকি মেরে ফেলেছে? এই বয়সে এসেও এমন জা নো য়ারের মতো কাজ করবে কি লোকটা? ইহসানের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ইজহানের মনেও ভীষণ সন্দেহ জাগাল ব্যাপারটা। আজিজ শেখকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই, তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “তোমাদের জন্মদাতা অধম, সে এমন কিছু তো করতেই পারে আব্বাজানেরা। নতুন কী?”
ইহসান কী করবে, ইজহানই এ প্রথম আজিজ শেখের ফতুয়ার কলার ধরে ফেলল, “একটা ছোটো বাচ্চা, তাকে
মে রে ফেললে তুমি? হাত কাঁপেনি?”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৭৯

ইহসানের বেয়াদবি মেনে নেন আজিজ শেখ, কিন্তু ইজহান কখনোই তার সঙ্গে এ ধরণের ব্যবহার করেনি। স্বাভাবিকভাবেই তার মস্তিষ্ক খেই হারাল। মেজাজ হারিয়ে বলে ফেললেন, “তোমার হাতও কাঁপে নাই আব্বাজান, আমার প্রথম বংশধর, তোমার নিজের বাচ্চারে তুমি মাইরা ফেলছ! আসতে দাও নাই দুনিয়াতে! সেক্ষেত্রে আমি তো মহান লোকই বটে, যে দু’হাতে শুধু তোমাদেরই আগলে রাখছি। তোমাদের জন্য সব করছি। অন্য কারো সন্তানের প্রাণ নিছি। আমার চেয়ে ভালো বাপ আর একটা খুঁইজা পাবা তোমরা দুই ভাই? আবার আমার কলার ধরার স্পর্ধা দেখাও!”
হতবিহ্বল হয়ে গেল ইজহান। তার মনে হলো, সে ভুল কিছু শুনছে তার নিকৃষ্ট পিতার কাছ থেকে!

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮১