অশ্রুবন্দি পর্ব ৮২

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮২
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ঘুটঘুটে অন্ধকার নিয়ে রাত নেমে এসেছে পৃথিবীতে। মৃদু শীতল বাতাসে ভেসে আসছে অজানা ফুলের সুবাস। নিশাচর পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর পুকুরে লাফালাফি করা মাছের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। তেমনি বুকের বা-পাশে লুকোনো হৃদপিন্ডটার তীব্র গতিতে ছুটে চলার ধুকপুক শব্দটাও টের পাচ্ছে ইহসান। রক্তিম চোখ, গালভর্তি অবহেলিত দাঁড়িতে তাকে অন্যরকম লাগছে। চুলগুলোও বেখাপ্পা হয়ে কপালজুড়ে বিছিয়ে আছে। পরণের পোশাক আলুথালু। ইহসানের খুব ইচ্ছে হয়, সৃজাটা তাকে একটু আগের মতো বকাঝকা করুক। অযত্নে বেড়ে উঠা দাঁড়িগুলো দেখে তাকে বনমানুষ ডাকুক, তার চুলগুলো গুছিয়ে দিক।

কিন্তু কিছুই করে না মেয়েটা। আপনমনে ঘর গোছানো আর বাচ্চাদের কাজই করে যায়। তার দিকে নজর দেয় না। ইহসানের হাত নিশপিশ করে ওকে একটা থাপ্পড় দিতে। ধমকে একসার করতে। মেয়েটাকে একটা গন্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলতে। কিন্তু সে পারে না। কারণ সে ইজহান শেখ না। এক বোতল পানি ঢকঢক করে খেয়ে ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সৃজা গোসল করছে। এতো রাতে কেন গোসল করতে হবে? ঠান্ডা লাগিয়ে তার বাচ্চাদের অসুস্থ করার ধান্ধা! ইহসানের হঠাৎই রাগ হয় প্রচন্ড। দেয়ালে ঘুষি বসায় সে। হাত কেটে র ক্ত বেরুয়।
সে মাথা চেপে ধরে। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এতদিন ধরে গোপন রাখা নারকীয় সব সত্যি যেন নিজে থেকেই উন্মোচিত হতে চাইছে। ইনজান ফিরে আসার পর থেকেই সবকিছু আরো কেমন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। ওর চাহিদা, খেয়ালিপনার দৌলতে জীবনে কতকিছু হারিয়েছে, এরপরেও ওর শিক্ষা হয় না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হিংসার বশবর্তী হয়ে নিজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের জীবনগুলো জড়িয়ে সে খেলছে। সৃজার থেকে নজর সরিয়ে এবার এলিজাকে নিজের শিকার বানাতে চাইছে। আবার রিদ্বানের সত্যিটা জানতে পেরে ওর উপর প্রতিশোধ নিতে, আজিজ শেখকে শিক্ষা দিতে তাকে নির্বংশ করার বাসনায় সৈয়দরা মুখিয়ে আছে। আজকাল ইহসানের মনে হয়, ওর সবচেয়ে বড়ো ভুল তার এই অভিশপ্ত জীবনে সৃজাকে জড়ানো। কিন্তু জড়িয়ে তো ফেলেছে, ছাড়বে কেমন করে সে?

ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে নিতেই সৃজা থমকে দাঁড়াল। দরজার দু’পাশে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ইহসান। চোয়াল শক্ত, দৃষ্টিতে প্রচন্ড ক্ষোভ মিশে আছে। পোশাক আর ওর চেহারার অবস্থা দেখে সৃজা চোখ সরিয়ে নিলো। ওর এই বেশ দেখে কি বলবে বুঝতে পারল না। চোখদুটো জ্বলতে লাগল আচানক। নির্ঘুম কিছু রাতের ফল। সৃজার বুক থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। ইহসানকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে গেলে ইহসান নিজেই তার লম্বা-চওড়া শরীরটা দিয়ে আবারো ওর পথরোধ করে দাঁড়াল। সৃজা এবার ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বিরক্ত গলায় বলল, “কী সমস্যা? যেতে দাও।”
পূর্ণ চোখ মেলে আগাগোড়া ওকে পর্যবেক্ষণ করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল ইহসান, “এতো রাতে গোসল নিলি কেন? আমার বাচ্চাদের অসুস্থ করার ধান্ধা?”

সৃজা হতবিহ্বল হলো। পরমুহূর্তে নিজেকে ধাতস্থ করে ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকাল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “ঝগড়ার টপিক পাচ্ছ না তাই এটাকে ইস্যু করতে এসেছ? সরে দাঁড়াও, আমার এসব নাটক ভালো লাগছে না।”
বলার সময় দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই সৃজা টের পায় বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখে এক সমুদ্র ব্যাকুলতা। নিজের অনুভূতি কীভাবে সামলাতে হয় তা এতদিনে শিখে গেছে সৃজা, তবুও সে চোখ সরিয়ে চলে আসতে নেয়। ইহসান দেয় না, আগের মতোই আটকায়। অস্থিরতা ভরা কণ্ঠে বলে, “এতো রাতে গোসল দেওয়া ঠিক হয়নি। আর কখনো এভাবে, অসময়ে গোসল নিবি না। শরীর খারাপ করবে।”

কথাগুলো কেন জানি মেকি মনে হয় না সৃজার। সে মেলাতে পারে না কিছুদিন আগে পরিচিত হওয়া এই মানুষটার অন্য রুপের সঙ্গে এই রুপের। সৃজার তাই রাগ বাড়ে, জেদ হয়। মুখ ফসকে বলে ফেলে, “তাতে তোমার কিছু যায় আসা উচিৎ না। অহেতুক এতো চিন্তা দেখিও না। আছি তো তোমার বউয়ের মতো। একেবারে অবলা নারী হয়ে। অন্ধের ন্যায় সংসার, বাচ্চা সামলাচ্ছি। এরবেশি কিছু তো তোমার চাওয়ার থাকতে পারে না।”
কী বলল এটা? তার কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না সৃজার কাছ থেকে? কেন? কী করেছে ইহসান ওকে? কোন অপরাধে দোষী সে? ইহসানের মাথায় আগুন জ্বলে উঠে। আকস্মিক সৃজাকে নিজের সঙ্গে শক্ত করে মিশিয়ে নেয়। অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকা সৃজার হাত থেকে ধোয়া কাপড়গুলো মেঝেতে পড়ে যায়। সেগুলোকে পায়ে মাড়িয়েই ইহসান ওকে ঠেলে ওয়াশরুমের দেয়ালে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে, “আর আমাকে, আমাকে সামলাচ্ছিস কোথায়? আমি কেউ না তোর?”

সৃজার হাত লাল হয়ে গেছে। রাগে কেঁপে উঠছে পুরো শরীর। মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করতে করতে তেজী কণ্ঠে বলে, “ছাড়ো আমাকে, দূরে সরো।’’
“ছাড়ব মানে? কীসের ছাড়াছাড়ি? তুই আমার সৃজা, তোকে তো আমি মরে গেলেও ছাড়ব না। নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখব।”

ইহসানের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে সৃজার তাচ্ছিল্যসরুপ ব্যবহার দেখে। উন্মাদের মতো করতে থাকে সে। সৃজার দুই হাত মুঠোবন্দী করে দেয়ালে আটকে অন্যহাতে ওর চুলে প্যাঁচানো তোয়ালেটা খুলে ছুঁড়ে মারে। ওর ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে অসহায়ের মতো বলতে থাকে, “সৃজা, তুই আমার সঙ্গে কেন কথা বলিস না, কেন তাকাস না? তুই কথা না বললে আমার বুকটা বড্ড পোড়ে, অদ্ভুত যন্ত্রণা হয়। আমি শ্বাস নিতে পারি না, খেতে পারি না, কাজ করতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। ইচ্ছে করে তোকে খুব খুব মারি। মেরে মমি করে চোখের সামনে বসিয়ে রাখি। শুধু তুই আর আমি থাকি। কিন্তু আমি তো সবার মতো পাগল নই। সুস্থ মানুষ। সুন্দর পুরুষ, তোর স্বামী। এমন সুন্দর বর আমি তোর, পাগলের মতো ভালোবাসি। চোখে পড়ে না এসব তোর? অন্ধ তুই? সৃজা, আমি তো তোর কাছে বেশিকিছু চাই না। শুধু চাই তুই আমাকে আগের মতো আদর কর, শাসন কর, বকাঝকা কর। অগোছালো আমাকে গুছিয়ে দে। আমাকে খুব খুব ভালোবাস!”

“ভালোবাসার বেড়াজালে আটকে ফেলতে চাও আমায়? যাতে তোমাতে আবদ্ধ থেকে জগৎ ভুলে যাই…”
সৃজা সম্পূর্ণ করতে পারে না কথাটা। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়। ইহসান ওর ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে নিজের কপাল ঠেকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “এতো অভিমানী কথা বলিস কেন? একটু চুপ কর না। কেন বুঝিস না তুই, তোকে ছাড়া আমি বড্ড অসহায়? একটা কাঙাল!”
সৃজার ভুরু জোড়া কুঁচকে আসে। মুখের আদল পাল্টায়। আদ্যপান্ত বুঝেই এই পুরুষকে সে মন দিয়েছে, ভালোবেসেছে। অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে।

বদৌলতে কি পেয়েছে? মুখোশের আড়ালে থাকা
অন্য একটা ইহসান শেখ? যে তাকে একটা মরীচিকার পৃথিবী তৈরী করে দিয়েছে? ভীষণ রাগে সৃজার গা কাঁপতে থাকে, “আমাকে যেতে দাও। বাচ্চারা ভাইয়ার ঘরে। ওদের আনতে হবে। গায়ের জোর দেখাবে না একদম।”
প্রতুত্তরে ইহসান কিছু বলে না। অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে সৃজার দিকে। মেয়েটা এভাবে কথা বলল ওর সাথে? আকস্মিক ধাক্কায় ওর মস্তিষ্ক থমকে থাকে। বাধ্য লোকের মতো ওর পথ থেকে সরে দাঁড়াল। সৃজা চোখ তুলে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না ওকে। সোজা ঘরে চলে আসে। চুলে প্যাঁচানো ভেজা তোয়ালেটা খুলে সোফার উপর ছুঁড়ে মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ইহসান ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে দরজার পাশে। দাঁড়িয়েই থাকে। নড়তে ভুলে যায়। কিছুক্ষণ পর সৃজা বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে আসে। ওদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দুটো বাচ্চাকে সুন্দর করে সামলে, খাইয়েদাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আরাম করে শুইয়ে দেয়। এরপর নিজেও আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বাচ্চা দুটো মায়ের উষ্ণতা টেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ইহসান তৃষিত নজরে দেখে সবটা। সে দেখে, তার অর্ধাঙ্গিনী সৃজা রেহমান একা একা কী সুন্দর সামলে ফেলল ওদেরকে। ইহসানকে প্রয়োজনই পড়ল না ওর!

সেদিন দু-ভাইয়ের কথোপকথনের খুব সামান্য অংশ কর্ণগোচর হওয়ার পর থেকেই সৃজার মনে একটা দেয়াল তৈরি হয়ে গেছিল। চাইলেও পারেনি এই দেয়াল ডিঙ্গিয়ে স্বামী নামক পুরুষটার বক্ষপটে লুটিয়ে পড়তে৷ চেষ্টা করতে গেলেও কানে একটু পরপর একটা ক্রোধিত কণ্ঠস্বর বেজে উঠত, ‘তোমার শয্যাসঙ্গীর দিকে ইচ্ছেকৃত মনোযোগ দিতে পারিনি। নয়তো সে তোমার নয়, আমার বেডেই থাকতো….’

অসভ্য যুবকের অশ্লীল কথা যতবার মনে হয়েছে ততবারই বিষিয়ে উঠেছে মন। আরসালান ইনজান শেখ যতবার ওর সামনে পড়েছে ততবার গা শিউরে উঠেছে। অথচ এই যুবকের শত ভুল, অন্যায় আর বিকৃত আচরণের পরেও সহমর্মিতার চোখে দেখেছে সে, ভাইয়ের মতো ট্রিট করেছে। ঘাড়ত্যাড়া ইহসানকে মানিয়েছে, ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছে তার ছোটো, বেপরোয়া ভাইটাকে যথাযথ চিকিৎসা ও যত্ন দ্বারা সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে। সৃজা এতদিন ভেবেছে, ট্রমাটিক শৈশবের কারণেই লোকটার এ দশা। কিন্তু চরিত্রের এই ঘৃণ্য অবমাননা কি আসলেই ট্রমাটিক শৈশবের সঙ্গে যুক্ত? চাইলেই কি কেউ বড়ো ভাইয়ের স্ত্রীকে নিজের বেড পার্টনার হিসেবে ভাবতে পারে? মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে আরো গভীরে গিয়ে ভাবতেই এক লহমায় সৃজা বুঝে যায়, ল্যাভেন্ডার বলে তাকেই সম্বোধন করতো ইনজান শেখ। অনেকদিন আগে শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে যে পার্সেলটা এসেছিল, সেটাও ইনজান শেখেরই পাঠানো। মানে লোকটা আগে থেকেই চিনতো তাকে। যদি চিনেই থাকে তাহলে এসবের মানে কী? ইনজান শেখ তাকে পছন্দ করতো বা ভালোবাসতো, এমন কিছু? ইহসান যে বলে ওর সঙ্গে একটা গোপন বিরোধ আছে, সেই বিরোধের কারণও কি সৃজা নিজে?

তিন মিনিট দৈর্ঘ্যের একটা ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, ইহসান শেখ লিকলিকে গড়নের এক যুবককে পেটাচ্ছে। বেধড়ক মার। হাত দিয়ে, পা দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে। যেভাবে একজন মানুষকে মেরে ক্ষতবিক্ষত করা যায়, সেভাবেই যুবককে পেটাচ্ছে ইহসান। যুবকের আর্তচিৎকার, বাঁচার জন্য কাকুতিমিনতি কিছুই কানে তুলেনি সে। হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে যুবকের গলা টিপে ধরেছে। রক্তে ভেসে যাওয়া, ছটফট করতে থাকা যুবকটাকে কোন অপরাধে ইহসান শেখ অমানুষের ন্যায় আঘাত করেছে। জানা নেই সৃজার, যুবকটা আদৌ বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। রিদ্বান নামক চার বছরের বাচ্চা হারিয়ে যাওয়ার পেছনেই বা ওর কী যোগসূত্র!

এসমস্ত তথ্য, অডিও ক্লিপ আর ভিডিয়োই বা কে পাঠাচ্ছে তাকে। কিচ্ছু জানা নেই সৃজার, কিচ্ছু না। গতরাতে ইনবক্সে আসা এতসব তথ্যাদির সঙ্গে আসা একটা পুরোনো, ধামাচাপা দেওয়া কেইস রিপোর্টের অর্থোদ্বার যখন করতে পারল, সৃজা টের পেল— ওর পৃথিবীতে ধরা সূক্ষ্ম চিড়টা এক সেকেন্ডে ওর পুরো পৃথিবীটাকে বীভৎস ভাবে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে। সে, তার বিশ্বাস সবকিছু মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। সৃজার শ্বাস আটকে আসে। শরীর কাঁপতে থাকে। বুকের ভেতরটা ভারী ভারী লাগে ঠেকে। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুতগতিতে উঠানামা করে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে ওর। আকস্মিক ও লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। খাটের কোণায় বারি লেগে মাথার একপাশ কেটে ততক্ষণে রক্ত ঝরতে শুরু করে।

বেরুনোর জন্য তৈরি হচ্ছিল ইহসান। গায়ে শার্টটা মাত্র চাপিয়েছে ঠিক তখনি পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে ফিরে তাকায় সে। মেঝেতে পড়ে থাকা সৃজাকে দেখে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। মাথাটা দপদপ করতে শুরু করে ওর। টর্নেডোর বেগে ছুটে এসে পুরুষালি হাতজোড়া নিজের বাহুডোরে বন্দী করে নেয় সৃজাকে। কম্পিত হাতে বেডসাইড টেবিল থেকে পানি নিয়ে মেয়েটার চোখেমুখে ছিঁটা দিতে দিতে ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকতে থাকে। আযরান-আজওয়া বিছানায় হামাগুড়ি দিতে দিতে পাপার গমগমে কণ্ঠ শুনে কেঁদে উঠে। ইহসানের সেদিকে হুঁশ নেই। সে ব্যস্ত সৃজার কপালের রক্ত বন্ধ করতে।

সৃজার জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে স্বামীর ঊষ্ণ বুকে। নাক ঠেকিয়ে চুপচাপ ইহসানকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে সৃজা। ব্যাকুলচিত্তে ওকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতেই থাকে ইহসান, সৃজা কিছুই শোনে না। বরং ক্ষীণ স্বরে ওকে বলে, “জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তোমার।”
ইহসান একটু চমকায়। নিজের হাল বেহাল, এদিকে তার জ্বর নিয়ে মাথাব্যথা দেখাচ্ছে মেয়েটা। সে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো করে বলে, “ব্যাপার না।”
“ঔষধ খেয়েছ?”
“হু।”
“কখন এলো এতো জ্বর?”
“যেদিন থেকে তুই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিস আমার থেকে।”

ভালোবাসার মানুষের থেকে অকারণে, স্বেচ্ছায় কেউ কখনো মুখ ফিরিয়ে নেয় না। একমাত্র বিশ্বাসভঙ্গ হলেই নেয়। যার হাত ধরে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল সৃজা; সেই মানুষটা, তার পরিবারটা যে এতোটা জঘন্য, ঘৃণ্য, সৃজার কল্পনারও বাইরে এসব। অথচ এই দিন দেখার জন্য, এসবের জন্য সে তার জীবনটা এই পুরুষের নামে লিখে দেয়নি। এতো হেলায় জীবন ধ্বংস করার জন্য সে পুরুষটার হাত ধরে এ বাড়িতে আসেনি। সৃজার শ্বাস আটকে আসতে চায়। নিজেকে প্রাণপণে সামলে সে এতক্ষণ পর ধিমি স্বরে বলে, “ভাইয়ের নজরে দেখা পুরুষ নামক কাপুরুষ লোকটি আমাকে বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে সম্মানের চোখে না দেখে বেড পার্টনার রুপে আমাকে ভাবছে, সেটা আবার আমার স্বামীর সামনে বুক ফুলিয়েই স্বীকার করছে।

দৃশ্যটা দেখার পর, কথাগুলো শোনার পরও আমি সৃজা, আমি অনিতা রেহমানের মেয়ে সৃজা রেহমান একটা উচ্চবাক্যও করিনি; কারণ আত্মা, মস্তিষ্কে, রক্তে যার বিকৃতি, তার থেকে এসব ছাড়া অন্য আর কীই-বা আশা করা যায়? কিন্তু… কিন্তু আমি তো তোমার থেকে এসব আশা করিনি, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি তুমি, তুমি… ইহসান শেখ জেনেবুঝে আমাকে নিজের জীবনে জড়িয়ে, আমার জীবনটাকে অভিশাপের বিষাক্ত বিষ পান করিয়েছ, আমাকে আমার মায়ের র ক্তের সাথে বেঈমানি করার জন্য?”

ইহসান বিদ্যুৎ গতিতে চোখ তুলে চায় ওর দিকে। বুকের ভেতর কিছু একটা বিস্ফোরিত হয়। হাতদুটো শিথিল হয়ে আসে ওর। মাথাটা খানিক উঁচু করে স্থির দৃষ্টিতে তাকায় সৃজার দিকে। শুনে নিয়েছে সৃজা, শুনেই নিয়েছে? সব কি শুনেছে? এলিজার ব্যাপারটা? ওটাও কি শুনেছে? এক্ষুনি কি ঘৃণাচোখে দেখবে ওকে মেয়েটা? মরে যাবে সে, একদম মরে যাবে। ইহসানের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি ধীর হয়। সৃজা
ওর চোখে চোখ রাখে। বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে বলে, “কিন্তু জানো তো, সব বিষে একেবারে মৃত্যু হয় না। কিছু কিছু বিষ আছে, যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। এমনিতে মারে না, কিন্তু রক্তে, শ্বাসে, প্রতিটা মুহূর্তে জ্বালিয়ে মারে৷ শরীরকে, আত্মাকে ক্ষয়ে দেয়। আর তুমি আমাকে সেই পথে টেনে এনেছ। আনার আগে পরিণতি তুমি একবারও ভাবলে না। না ভেবে আমার চোখে সংসার নামক আস্ত একটা মরীচিকার মরুভূমি সাজিয়ে দিলে…”

তীক্ষ্ণ, প্রশ্নবোধক চাহনি ছুঁড়ে তাকিয়েই থাকে ইহসান৷ যেন সবটা সে বুঝতে চাইছে৷ সৃজা কতটুকু, কী জানে। কোথা থেকে জানে। সব জানতে, বুঝতে চায় সে। কিন্তু তাকে বুঝতে না দিয়েই সৃজা এ পর্যায়ে থেমে যায়। আর কথা না বাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করে না। জ্বর গায়ে তার সঙ্গে লেপ্টে থাকা পুরুষের কপাল থেকে চুল সরিয়ে চুপ করে পড়ে থাকে। ফর্সা, পেলব গাল বেয়ে মুক্তোর দানার মতো জমছে অশ্রুধারা। তীক্ষ্ণ নাকের ডগা লাল। ইহসান ঘোরগ্রস্তের মতো চেয়ে রইল। বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখার মতো অনুভূতি হচ্ছে ওর। নিঃশ্বাস আটকে কপালে ভাঁজ ফেলে সে প্রশ্ন করল, “তোর এসব কথার মর্মার্থ কী?”

সৃজা ওর উত্তপ্ত গালে একটা হাত রাখে। চোখে চোখ মেলায়। তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটজোড়া দিয়ে আঁকড়ে ধরে জ্বরাগ্রস্ত, উত্তপ্ত পুরুষালি ঠোঁট। আবেশে চোখ বুজে আসে ইহসানের। তার বুকের অস্থিরতা কমে, শান্ত হয় সে। মনে হয় এতো লম্বা, আদর জড়ানো চুমু সৃজা আগে কখনো দেয়নি ওকে। ইহসান নিজেও সব দোটানা ভুলে শান্ত হয়ে শুষে নিতে থাকে মেয়েটাকে। অনেকটা সময় পর, সৃজা ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর চোয়ালে দু-হাত রেখে মুখটা আজলায় নিয়ে অনেকটা ক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকাই ওকে ঝট করে ছেড়ে দূরে সরে যায়। গুটিশুটি মেরে দরজার এক কোণে বসে পড়ে মিহিসুরে কেঁদে উঠে। ইহসান হতবিহ্বল হয়ে পরে ওর আচরণ দেখে। ধমক দিয়ে উঠে গিয়ে ওর কাছে বসতেই আরো পিছিয়ে গেল সৃজা। ইহসান এবার রেগে ওর হাত ধরার চেষ্টা করতেই ক্ষেপে উঠা কণ্ঠে বলে বসে মেয়েটা, “না না, আমাকে ছুঁবে না। তোমার ওই র ক্ত লাগা, নোংরা হাতে আমাকে ছুঁবে না। আবার ছুঁতে আসলে কিছু একটা করে বসব আমি…”

ইহসানের গলা শুকিয়ে আসলো ওর অবস্থা দেখে, “কেন এমন করছিস জান? কী করেছি আমি?”
আচমকাই গগনবিদারী চিৎকার তুলে কেঁদে উঠে সৃজা। দু’হাতে নিজের মাথার চুলগুলো খামচে ধরে কাঠের দরজায় নিজের মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলে, “পাপ করেছি, পাপ। এতো এতো পাপ নিয়ে আমি বাঁচব কীভাবে? আমার মরে যাওয়া উচিৎ।”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮১

ইহসান খপ করে ওকে টেনে এনে না চাইতেও থাপ্পড় দিয়ে বসল ওর গালে। সৃজা প্রচন্ড এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পাশে থাকা কাচের ফুলদানিটা ছুঁড়ে মারল ওর উপর। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে সেটা পড়ল ইহসানের মাথায়। সৃজা সেসব কিছু দেখল না। উন্মাদের মতো প্রলাপ বকতে লাগল একনাগাড়ে, “প্রতারক, খু নি, জা নো য়ার! অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি তোকে, ভালোবেসেছি। সব ভুল, অন্যায়, অপমান ক্ষমা করে দিয়েছি। তার প্রতিদান এই? আমাকে ঠকানো? ইহসান শেখ? কেন? কেন? কেন? আমার আম্মুকে কেন মেরে ফেলা হলো? আমার আব্বুকে কেন এতো অসহায় করে দেওয়া হয়েছিল? কী ক্ষতি করেছিল ওরা তোদের?”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৩