অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৩ (২)
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইহসান চোখ বুজল। মনে হলো তার পায়ের তলায় যতটুকু মাটি অবশিষ্ট ছিল, সেটুকু কোনো এক মাঝরাত্রির জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে খুব দূরে কোথাও মিলিয়ে গেছে। তার গলা পর্যন্ত পানি, সে কূল খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই। কীভাবে সবটা সামলাবে?
হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাওয়ায় ইজহানের তখন মাথা ফাঁকা। অনভিলাষে সৃজার ফোনটা হাতে নিলো। ক্রমেই চোয়াল শক্ত হতে লাগল ওর৷ কে এতো বড়ো স্পর্ধা দেখাল? রাগে ইজহানের গা কাঁপতে লাগল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো কুৎসিত কিছু গালি। ইস্মি এসে জোর করে চেপে ধরল ওর মুখ। সম্বিৎ ফিরল ইজহানের। সে ইহসানের দিকে তাকাল। ইশারায় বোঝাল, সে কথা বলুক, যা বলার ইহসান বলুক। সৃজার করা প্রশ্নের জবাব সে দেবে। কারণ ইজহান শেখ জানে না, কীভাবে কাউকে বোঝাতে হয়, পরিস্থিতি সামলাতে হয়। সে তৎক্ষনাৎ ইস্মিকে টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে ইস্মি যেন ঘোরের মধ্যে আছে। এখনো তার কানে বাজছে সৃজার কথাগুলো। ইহসানকে সে যেমন চেনে, যেমন দেখে এসেছে এতগুলো বছর; তাতে সৃজার করা অভিযোগগুলো কোনোভাবেই ও মানতে পারছে না। মানতে না পারলেও, একটা নতুন ঝড়ের উদ্রেক যে হয়েছে, ঝড়টা যে অনেকদূর প্রসারিত হচ্ছে এটা বুঝতে তার কষ্ট হলো না। সে ভ্রান্ত চোখ মেলাল ইজহানের দিকে। আর ও তাকাতেই ইজহানের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। ইস্মি ওর মুখভঙ্গির পরিবর্তন দেখে কপালে ভাঁজ ফেলল। এভাবে মুখ লুকানোর মানে কি?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এদিকে ইহসান তখনো নিরুত্তর। জবাবে কিছুই বললো না, বললই না। ওর কথা না বলার অনুজ্ঞা যেন আরো রাগিয়ে দিলো সৃজাকে। বুক ভার হয়ে আসা দ্বিধা, সংকোচ, আত্মগ্লানি নিয়ে ইহসান ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল সন্তপর্ণে। এরপর এক ঝটকায় দু’হাতে আবেষ্টিত করে ফেলল ওর মেদহীন কোমড়টা। সৃজা অবিরাম কাঁদছে তখন। ওর ছোঁয়া পেয়ে ছটফটিয়ে উঠল মেয়েটা। বিক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলতে লাগল, “ওই লোকটাকে তুমি মারোনি, ইনজান শেখ আমার আম্মুকে মারেনি, এসবের কিছুই তুমি জানো না,
তাই না?”
নিজেকে ছাড়াতে চাওয়া অতিষ্ঠ সৃজাকে ফিরিয়ে অকপটে নিজের বক্ষপটে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। এলোপাথাড়ি চড়-থাপ্পড় বসালো ওর বুকে সৃজা, অনবরত চুল টানল। ইহসান একটুও
নড়ল না, না ধমকাল ওকে। ওর নির্লিপ্ততা সহ্য হলো না সৃজার। কৈফিয়ত চাইতে চাইতে কান্নায় ভেঙে পড়ল ও। ইহসানের মনে হলো আকাশ ভেঙে তুমুল বর্ষণ নেমেছে ধরায়, সব ভাসিয়ে নিতে। কিন্তু সবটা ভাসিয়ে দিলে কী হয়? সে আর মৌনতা অবলম্বন করে থাকতে পারল না। তীব্র কণ্ঠে বলল, “মারতে ইচ্ছে হলে আমাকে আরো মার, মেরেই ফেল একেবারে। তবুও চোখের জল ফেলিস না। তোর
কান্না খুব পোড়ায় ভেতরটা।”
তার ইন্দ্রিয় সংযম হারাচ্ছে। ক্রন্দনরত সৃজার ভেতরটা খচখচ করে উঠল। তাকাবে না তাকাবে না করেও অকস্মাৎ ওর মুখের দিকে তাকাল। এতো মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকা ভালোবাসাময় চোখদুটোতে আজ কেন এতো শঙ্কা? সে আবারও ফুঁপিয়ে উঠল। ইহসান নির্নিমেষ চোখে চেয়ে থাকে। এই মেয়ে সুখে কাঁদবে, দুঃখে কেন কাঁদবে? ওর জন্য দুঃখের কান্না বারণ! বোঝে না কেন মেয়েটা? ওর থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করে মেয়েটাকে। সে ধমকানো কণ্ঠে বলে উঠে, “বললাম না, কাঁদিস না? কেন কাঁদছিস? আমার জন্য চোখের পানি নষ্ট করবি? কুলাঙ্গার স্বামীর জন্য? করিস না। স্ত্রীর চোখে জল মানে স্বামীর ব্যর্থতা। ব্যর্থতা নিয়ে মরে গেলে নরকে পতিত হব আমি! জন্ম থেকেই এক নরক দেখে এসেছি, মরেও যদি নরকই দেখি…আ আমি, আমার সঙ্গে এটা ন্যায্য কিছু হবে, বল?”
শেষের কথাগুলো ফিসফিস করে বলল মানুষটা। বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল সৃজার। কান্না চাপা গলায় বলতে লাগল, “এই তোমাকে তো আমি চিনি না। আমি এই তোমাকে ভালোবাসিনি। যে তোমাকে আমি চিনি, এখনকার সে, তুমি নও।”
“কেমন আমি?”
উচাটন কণ্ঠে বলতেই লাগল মেয়েটা, “সব সওয়ার মতো এটাও আমি সয়ে নেব, বলো যে, এসব মিথ্যে, আমি সৃজা ভুল। দয়া কোরো, আমাকে ভুল প্রমাণ কোরো!”
ফিনফিনে হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছিল এলোমেলো মেয়েলি চুলগুলো। রোদের টুকরো মাখামাখি হচ্ছিলো কম্পনরত গোলাপি ঠোঁটজোড়ায়। এত সুন্দর ঠোঁট, মুখ পৃথিবীর আর কারো আছে? নেই। সমস্ত পৃথিবীতে এই একটা মেয়েই আছে, একটা সৃজা রেহমানই আছে যার রুপ – সৌন্দর্যের কখনো প্রশংসা করেনি ইহসান। আসলে কোথা থেকে, কী দিয়ে প্রশংসা শুরু করবে এটাই তার মাথায় ধরে না। কিন্তু আজ, এক্ষণ, এই মুহূর্তে মনে হলো, এই মেয়ের দৃষ্টির তীব্রতাই তার বুক শীতল করে দেওয়ার জন্য মিলি সেকেন্ডও সময় নেয় না! ইহসান মোহচ্ছন্ন হয়ে মেয়েটার ঠোঁটে নিজের আঙুল রাখল। আলতোভাবে স্পর্শ করে অপ্রসন্ন কণ্ঠে বলল, “তুই সৃজা ভুল না, আমি ইহসান শেখ ভুল। আমার জন্ম ভুল। আমার পুরো জীবনটা ভুল। একটা জীবন আমার ভুলে, ভুলেই কেটে গেছে রে। ভুলের বোঝা, পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আমি ক্লান্ত। আর পারছি না এতো পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকতে। এভাবে বেঁচে থাকাটা খুব কষ্টের। যদি সবকিছু মিথ্যে বলে প্রমাণ করতে পারতাম, তাহলে অনেক আগেই আমি সেটা করতাম। কেন পারিনি বল তো…”
সৃজা ক্ষিপ্রগতিতে ওর শার্টের কলারটা দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে টলমল চোখের দৃষ্টি মিলিয়ে অবাক কণ্ঠে বলল, “এসব মিথ্যে নয়?” উন্মাদ মনে হয় নিজেকে সৃজার। নিজেকে ধাতস্থ করে ইহসানের দু গালে হাত রাখল। হাতড়ে হাতড়ে অনুনয় করে বলল, “রাগ করে বলছ এসব, না? আমার তখন মাথার ঠিক ছিল না। উচিৎ ছিল, তোমার সাথে কথা বলা, ঠান্ডা মাথায় সবটা বিবেচনা করা। কিন্তু আম্মু-আব্বুর ব্যাপার তো, আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছিলাম না। ভেতরটা খুব অস্থির হয়ে গেছিল। তাই তোমায় আঘাত করে ফেলেছি। ইচ্ছে করে নয়, একটুও ইচ্ছে করে করিনি। আ..আমার তখন কী যে হয়ে গেল!”
সৃজা আবার নিজের চুল টেনে ধরল, ইহসান ছাড়িয়ে নিলো ওকে। একদম বুকে মিশিয়ে নিলো মেয়েটাকে।নিজেকে ধীর ও শান্ত করার চেষ্টায় ঘনঘন শ্বাস ফেলল সৃজা। অতিশয় শ্রান্ত কণ্ঠে বলল, “শোনো, আমি এবার ঠিক আছি। এই দেখো, আমি একটুও রাগ করে নেই। আমার মাথা একদম ঠান্ডা। এবার বলো, তুমি আমার ভুল নও, আমি ভুল করিনি তোমাকে জীবনে জড়িয়ে, তোমাকে ভালোবেসে, তোমার সন্তানের মা হয়ে। একবার বলো!”
অধীর হয়ে উঠল মেয়েটা। ইহসান ভাবল, পাগল হয়ে গেছে নাকি সৃজা? জোর করে ওর মুখ থেকে সব অস্বীকার করাতে চাইছে, যেখানে সবটা সত্যি! সে সহ্যের শেষ প্রান্তে গিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলল, “জঘন্য সত্যি এটাই যে, মিসের মৃত্যুর পেছনে আমার ছোটো ভাই, আরসালান ইনজান শেখ দায়ী। আর ওকে প্রশ্রয় দেওয়ার পেছনে দায়ী আমার বাপটা। অবশ্য আমিও দোষী, আমার জন্যই চিনেছিল ও মিসকে… আর এসব আমি প্রথম থেকেই জানতাম। জানতো তোর আব্বু, নীলুফুপিও। কিন্তু তখন বয়স কম তোর, ইমম্যাচিউর ছিলি। জানানো হয়নি তোকে! সৃজা, আমার জীবনে তুই যেমন সবচেয়ে সুন্দর সত্যি, তোর জীবনে তেমনি আমি এক বিশ্রি মিথ্যে।”
ভালোবাসার এই জঘন্য প্রতিদান সৃজার হৃদয় বিদীর্ণ করে তুলল, নিঃশেষ করে দিতে লাগল ওর ভেতরটা। দেহের বল হারাল ও, শরীর ছেড়ে দিলো। ইহসান বসে পড়ল ওকে নিয়ে মেঝেতে। হাত রাখতে চাইল সৃজার মাথায়। মেয়েটা দিলো না। ওর বুকে গুটিশুটি মেরে বসে রইল, একদম চুপ হয়ে!
বাগান পরিষ্কার করে এসে আজিজ শেখ সব শুনলেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়া জানালেন না। যেন খুব স্বাভাবিক বিষয়, একদিন সত্যটা জানতোই অনিতা রেহমানের মেয়ে সৃজা রেহমান! তিনি সহজ ভঙ্গিতে হাতমুখ ধুলেন, গোসল করলেন। চালের গুঁড়ার রুটি আর খাসির কষা মাংস দিয়ে সকালের নাস্তা সারলেন বেলা করে। এরপর একবার দোতলা থেকে ঘুরে এলেন। সৃজাকে বললেন, “দশ বছর আগের কাহিনী টাইনা আইনা সংসারে অশান্তি করার কোনো মানে নাই। আমার পোলা তোমাদের জন্য কম করে নাই! জান উজাড় করে দিসে। ও না থাকলে তোমাদের দুই বোনরে তো চিল-শকুনে খাইতো। তাই কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য হইলেও আমার ছেলেদের বিরুদ্ধে যেকোনো ফন্দিফিকির আঁটা থেইকা দূরে থাকো। ভাইবো না পুরানা কাহিনী নিয়া টানা-হেঁচড়া করবা, আর জেলের ঘানি টানাবা আমার বাচ্চাদের দিয়া। ওসব করে পার পাইবা না। তারচেয়ে বরং কৃতজ্ঞ হও মেয়ে,
কৃতজ্ঞ হও!”
আসলেই সৃজার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ। সে নিদ্বির্ধায় মেনে নিলো। ইহসান শেখ না থাকলে সত্যিই এতদিনে তাদের চিল-শকুনে ছিঁড়ে খেতো। বহু আগেই তাদের অস্তিত্ব বিদীর্ণ হয়ে যেতো। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কৃতজ্ঞতায় সৃজা তাই টু শব্দটিও করল না আর। একেবারে নিশ্চেষ্ট হয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে একেবারে চুপ হয়ে গেল। কারোও সঙ্গে কথা বলল না সৃজা। নীরবে সব কাজ সেরে বাকিটা সময় ব্যলকনিতে একা বসে থাকে। বিকেল পেরিয়ে রাত আসে, ও বসেই থাকে। ইচ্ছে হলে বাচ্চাদের একটু খাওয়ায়, কোলে নেয়। নিয়ে বসে থাকে। আগের মতো ওদের স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে তাল মেলায় না। রাতে এসে বিছানায় শোয়, চুপচাপ ঘুমোয়। মেয়েটার এই নির্লিপ্ত আচরণ ইহসানকে ভাবিয়ে তুলছে।
মাঝরাতে দু’দিন উঠে দেখেছে ঘুমের মধ্যেই মেয়েটা অবিরাম কাঁপছে। দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি পড়ছে মেয়েটার। কী পরিমাণ দুঃখ, অসহায়ত্ব বুকে চেপে দিন কাটাচ্ছে ভাবতেই ইহসানের মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। কী করবে সে ভেবে পায় না। পরদিন নিজে থেকেই সৃজার সঙ্গে কথা বলতে উদ্যত হয়েও ব্যর্থ হয় সে। অগত্যা মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বোকার মতো কাজ করে বসে। ফল কাটার ছুরি দিয়ে অগোচরে নিজের হাত কেটে ফেলে। মেঝে ভরে যায় লাল রক্তে। সৃজা এসব দেখে ভ্রু কুঁচকায়। কয়েক মুহূর্ত লাগে ওর ব্যাপারটা বুঝতে। থমকে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এরপর নিজেই গরম পানি আর অ্যান্টিসেপটিক নিয়ে আসে। ইহসান রুক্ষ চোখে তাকিয়ে থাকে। দেখে, মেয়েটা কেমন করে তার ক্ষততে ঔষধ লাগাচ্ছে।
এমন করে তার বুকের ভেতরের ঝড়টাকেও থামিয়ে দিক না, না দিয়ে নিজেকে কষ্ট দিয়ে কেন তাকে পিষে মারছে? দূরত্বের ব্যথা যে মৃত্যুর মতো, বোঝে না কেন মেয়েটা? ইহসান খপ করে সৃজার হাত ধরে ফেলে নরম চুমুতে ভিজিয়ে দেয়৷ সৃজা ভাবলেশহীন। পুরো সময়টাতে একটা কথাও বলে না মেয়েটা, না করে কোনো প্রশ্ন। বরংচ ধীরেসুস্থে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। ইহসান ভেতরে ভেতরে ছটফটায়। অপলক দৃষ্টিতে দেখে সৃজাকে। মলিনতার ছাপ স্পষ্ট মেয়েটার চোখেমুখে, চুলগুলোও জট পাকিয়ে আছে। কয়েকদিন ধরে চুলটাও আঁচড়ায়নি। স্বাভাবিক থাকার ভান করছে অথচ ওর সবটাই অস্বাভাবিক। নিতে পারে না ইহসান৷ একসময় না পেরে ধৈর্য হারায় সে। দুবাহু চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে বলে সৃজাকে, “তুই কেন কিছু বলছিস না? এভাবে চুপ করে গিয়ে কী বোঝাতে চাইছিস? মানে কী এমন আচরণের? আফসোস হচ্ছে নাকি রাগ?”
সৃজা থমকায়, তাকায়। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শীতল কণ্ঠে বলে, “আফসোস, রাগ? উহু! কিছুই টের পাচ্ছি না। পাব কীভাবে বলো? হুট করে ওভাবে আম্মু চলে যাওয়ার পর অসুস্থ আব্বু আর এলিজকে নিয়ে তেরো বছরের আমি, নীলুফুপি যখন অথৈ সাগরে পড়লাম, সেই সাগরে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে যে মানুষটা আমাদের রক্ষা করেছে, তাকে বিয়ে করে আফসোস করব, এতো অকৃতজ্ঞ আমি হতে পারছি না।” এটুকু বলে মুহূর্তের জন্য থামে সৃজা৷ উদাসীন দেখায় ওকে। চোখেমুখে ক্লিষ্টতা জেঁকে বসেছে। না খাওয়া ক্ষুধার্ত, নির্ঘুম চেহারা। ইহসান রাগান্বিত স্বরে বলে, “খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস কেন?”
কথা এড়ায়, দৃষ্টিও এড়ায় সৃজা। ম্লান হাসে, অথচ কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বলে, “তোমার সম্বন্ধে, তোমার পরিবারের সম্পর্কে বেশি কিছু না জানা স্বত্তেও কেন শেষ পর্যন্ত বিয়েটা কবুল করেছিলাম কিসের জোরে জানো, আস্থার! তুমি মানুষটা অন্য সবার মতো না, অন্যরকম। তোমাকে বিশ্বাস করা যায়। কারণ তুমি আমার ইহসান ভাইয়া। যে মা মরা, পঙ্গু বাবার তেরো বছরের কিশোরী সৃজাকে বাইশের তরুণীতে পরিণত হতে দেখেছ। কিন্তু কখনো বুঝতেই দাওনি, তুমি আমায় কোন নজরে দেখেছ! এতোটা সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ যার মধ্যে আছে, তাকে ভরসা না করে থাকা যায় বলো? আমিও করেছিলাম। তাতে কিন্তু আমি ঠকে যাইনি একটুও। বিশ্বস্ত তোমাকেই পেয়েছি। আমার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছ এরজন্য তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি।
সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই আমার সিদ্ধান্তটা তোমাকে জানাচ্ছি। তবে তোমার কোনো পরামর্শ জানতে চাইছি না। শুনো, আমার এ বাড়িতে দমবন্ধ লাগছে। মাথা ধরে যাচ্ছে। ঠিকঠাক ভাবে শ্বাস নিতে পারছি না। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে একদল খু নি, ঠক লোকের সঙ্গে আমার বাস! যারা আমার মা’কে মেরেছে, আব্বুকে রাতের অন্ধকারে পিটিয়ে, রক্তাক্ত করে রাস্তায় ফেলে রেখেছে! অথচ এতে দায়ী যারা? তোমার বাবা, তোমার ভাই তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করছি আমি। প্রতিনিয়ত এদের মুখদর্শন করতে হচ্ছে আমাকে। কেমন যে লাগছে বোঝাতে পারছি না তোমাকে! এ বাড়ির খাবার, পানি কিছুই গলা দিয়ে নামছে না। ঐযে, সকালে খাবার খেতে বসলাম না? মনে হলো, এক থালা বি ষ! আমি খেতে পারিনি, বমি পেয়ে যাচ্ছিল। বাচ্চাদের উপরও খুব অবহেলা করছি। এমন হলে শ্রীঘ্রই আমার কিছু
একটা হয়ে যাবে।”
“কী বলতে চাইছিস?”
সৃজা সুন্দর করে হাসলো, “অতি সজ্জনসুলভ না হলেও কট্টর ভ্রাতৃপ্রেমী ব্যক্তি তুমি। যতোই অস্বীকার কোরো, আমি তোমাকে চিনি। তোমার পক্ষে খুব কঠিন হবে তোমার স্বকীয়দের শাস্তি দেওয়া। এর বিনিময়ে তুমি তাদের সব অন্যায় মাথা পেতে গ্রহণ করে নিতে ভালোবাসবে। কিন্তু আমি তোমাকে সে সুযোগটা দিতে চাচ্ছি না। কারণ এবার আমিই তোমাকে খুব কঠিন শাস্তি দিতে চলেছি।”
চোখজোড়া ধূসর হয়ে এল। ইহসানের মনে হলো, এই সৃজাটা খুব দূরের, খুব অচেনা, খুব স্বার্থপর! কিন্তু যতো স্বার্থপরই হোক, স্বার্থপর সে-ও এই মেয়েকে ছেড়ে যেতে দেবে না। এতো মহান সে নয়। সে নিষ্পলক চোখে চেয়ে থাকল কেবল, অস্ফুটস্বরে কী একটা বলে জড়িয়ে ধরল সৃজাকে। যে বুকে প্রশান্তির মহাসাগর বয়ে যেতো, সেই বুকে আজ আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার উত্তাপ টের পেল সৃজা। ইহসানের ঈষৎ আন্দোলনশীল হয়ে উঠা বুকের বা-পাশটাতে হাত রেখে রক্তিম চোখে চেয়ে কোনো রকমে বলল, “আচ্ছা, আমার বছর দেড়েকের সংসার, আমাদের দুটো সন্তান, সব মিথ্যের মতো এসবও মিথ্যে, ছলনা ছিল? মিথ্যে হলে কেন বাধ্য করেছিলে আমায়, তোমায় ভালোবাসতে?”
জড়তা হীন, উগ্র কণ্ঠে বলতে লাগল ইহসান, “সামলাতে পারিনি নিজেকে। আর কেনই বা সামলাব বল, কম দিন তো হয়নি তোকে ভালোবেসেছি! সেই কবে, কোন বছর, কোন এক জানুয়ারীর বিকেলে পুরো আমিটাকে গচ্ছিত রেখেছিলাম তোর সমীপে। তুই সামলাতিস, অজান্তেই আমার সবটা নিয়ন্ত্রণ করতিস। বলতে পারতাম না, চাইতে পারতাম না, অথচ তোর জন্য বুক পুড়তো। কিন্তু সেদিন যখন সুযোগ এলো তোকে নিজের করার, সদ্ব্যবহার করে ফেলতে লোভী মনটা মস্তিষ্কের পাগলামো ভাবনায় সায় দিলো। এতকিছু ভাবিনি, বুঝিনি…কিন্তু আজ যা বুঝলাম, তখন বুঝলে, তবে তোকে বাধ্য করতাম না। কিন্তু একবার যখন জড়িয়েছি, তখন অনিবার্য যে, তোর সঙ্গ মৃত্যুর আগ অবধি ছাড়ছি না।”
নিঃশ্বাস আটকে ক্ষীণ স্বরে বলল মেয়েটা, “ঠক, প্রবঞ্চক, স্বার্থপর!”
তেজদীপ্ত, জেদী কণ্ঠে বলল ইহসান, “এই ঠক, প্রবঞ্চক, স্বার্থপর তোর স্বামী। স্বামীই থাকবে। দায় বয়ে বেড়াতে রাজি সে। কিন্তু যে ভুল, অন্যায় সে নিজে করিনি তার জন্য তোকে হারাতে পারবে না। এতো বড়ো শাস্তি সে কোনোভাবেই বরদাস্ত করব না।”
“আটকে রাখবে আমাকে? জোর করে ধরে রাখবে? আমাকে ইস্মিতা ভাবির মতো কেন ভাবছ? আমি সে নই, অতো মহান নই।”
খ্যাপা গলায় বলল ইহসান, “মহান হতে হবে তোকে। আমাকে ছেড়ে যাওয়া যাবে না। কথা দিয়েছিলি, একদম বরখেলাপ করবি না। অবশ্য করতে দেবও না আমি।”
“ওসবের মূল্য দেব তো আমি দেব না।”
তৎক্ষনাৎ ইহসানের চোখে ঝংকার দিল তীব্র তেজের আগুন। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওর গাল চেপে ধরে হুংকার ছেড়ে বলল, “অ্যাই কী সমস্যা তোর? দেওয়া কথার মূল্য দিবি না মানে? দিতে হবে তোকে। আর না দিলেও জোর করেই তোর থেকে ছিনিয়ে নেব আমি। এতে আমায় পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ, জঘন্য স্বামী ভাবলে ভাবতে পারিস। তবুও তোকে আমার সঙ্গেই থাকতে হবে। ছেড়ে যাবার কথা মুখে আনলেও শ্বাস বন্ধ করে দেব।”
উল্লসিত হবার কথা সৃজার, কিন্তু আজ একটুও হলো না। মনে হলো, মানুষটা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে তাকে। স্ত্রী লোককে জোর করে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া পুরুষকে আজন্ম ঘৃণা করে এসেছে সে, আজ তাই ইহসানের মুখে এরুপ কথা শুনে সে হতবিহ্বল! অস্পষ্ট স্বরে গোঙাতে লাগল সে, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পুরুষালি অসুর শক্তির সঙ্গে সে পেরেই উঠল না। অসহ্য ব্যথায় ছটফট করতে করতে ওর চোখে রক্ত জমল। টের পেল,
সে বাজেভাবে ঠকে গেছে। ইহসান শেখ ধূর্ত চাল চেলে, ফাঁদে আটকে ফেলেছে তাকে। কিন্তু এই ফাঁদে কেটে তাকে
বেরুতে হবে, বেরুতেই হবে। নয়তো তার সন্তানদেরও এরা বিকৃতমস্তিষ্কের বানিয়ে দেবে। খুব নারী মোহে ভোগে, বাপ-ভাই সব ক’টা এক! কী ভেবেছে এভাবে আটকে রাখা যায়? পেরেছে মন থেকে কাউকে আটকে রাখতে? পারেনি। কেউ পারেনি। ওর চোখ থেকে টুপটুপ করে জল পড়তে লাগল। কয়েকদিনের বুভুক্ষ ও তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির মতো একটা প্রগাঢ় ও ঊষ্ণ চুম্বনে লবণাক্ত সেই জল শুষে নিলো ইহসান। এরপর ঠোঁট থেকে নেমে এলো গলায়, বুকে। রাগের চিহ্ন বইয়ে দিতে লাগল প্রতিটা স্পর্শে। সৃজা প্রাণপণে ঠেলে সরিয়ে ওর গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো, “ভোগের বস্তু পেয়েছিস আমাকে? বাপ-ভাইয়ের সেই একী স্বভাব? আটকে রাখার? জোর খাটানোর…” রুদ্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে কান্নায় ভেঙে পড়ল সৃজা। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে মাটিতে বসে পড়ে বলল, “এটা তুমি ইহসান শেখ, আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। আসলেই তুমি আজিজ শেখের রক্ত।
যে নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে ভালোই তৎপর। অথচ আমি ভালোবেসেছি মাতৃবৎ মানুষটাকে, যার মা এমিলি ইয়াসমিন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা, যাকে তোমার বাবার বিকৃত চাহিদার বলি হতে হয়েছিল। অহঃ! তুমি তোমার নিজের মায়ের অপমান করছ ইহসান শেখ! আমি ভাবতে পারছি না তোমাকে সরুপটা এমন! এই তোমার সঙ্গে ঘর করলে আমার মায়ের শরীর থেকে ঝরা প্রতিটা রক্তবিন্দুর সঙ্গে বেঈমানি করা হবে, তারা আমাকে অভিশাপ দেবে। অভিশপ্ত একটা জীবন কাটাতে পারব না
আমি, পারবই না, আমার বাচ্চারাও পারবে না।”
ইহসান জ্বলন্ত চোখে চাইল। কী বলে এই মেয়ে? তার সঙ্গে জীবন কাটাতে পারবে না? বাচ্চারাও পারবে না? তাহলে সেটা অভিশপ্ত হবে? কতো বড়ো স্বার্থপর এই মেয়ে! মায়ের রক্তের দাম দিতে সব কেড়ে নিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করার পায়তারা করছে! অকস্মাৎ বাজ পড়ার মতো বিদ্যুৎ চমকে উঠল তার চোখে। হিসহিসে গলায়, একাগ্রচিত্তে তাকায় ইহসান, “কী বললি আবার বল তো?”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৩
সৃজার মুখে কাঠিন্যতা ঝিলিক খেয়ে গেল। হাতের মুঠোয় থাকা ওড়নাটা শক্ত করে ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি চাই না মানুষের প্রাণ নেওয়ায় যারা তৎপর, র ক্তে যাদের হাত ভেজানো, সেই হাত আমার সন্তানদের মাথার উপর থাকুক। ওদের উপর কুপ্রভাব পড়ুক। ওরা তোমাদের মতো নষ্ট চিত্তের হোক। আমি চাই আমার সন্তানেরা মানুষ হোক, অমানুষ না হোক।”