অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৫

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৫
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ইহসান শেখের পাপ আছে। পাপের দায় আছে। সবচেয়ে বড়ো পাপ আজিজ শেখের রক্ত ধারণ করে তার সন্তান হিসেবে জন্মানোতে, আরসালান ইনজান শেখের বড়ো ভাই হয়ে। ঐ দুটো মানুষের জন্য তার জীবনটা আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তার সুন্দর, সাজানো সংসারটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। বিশ্বাস আর ভালোবাসার জোরে শক্ত করে বাঁধা সম্পর্কের সুতোটা আজ খুইয়ে যাওয়ার পথে। যে সৃজার চোখে সে এতদিন ভালোবাসার নীল মহাসমুদ্র দেখতো, এখন দেখে শুধুই বিতৃষ্ণা, অবিশ্বাস! অবিশ্বাসের জোর এতোটাই যে তার অনুপস্থিতিতে, না বলেকয়ে বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেছে।

এর ঘন্টাখানেক পরেই ইহসান বাড়ি ফিরে আসে। এসেই দেখে মেয়েটা তাকে একা করে দিয়ে সব ছেড়েছুঁড়ে চলে গেছে। এমনকি বাড়ির কাউকেও কিছু বলেও যায়নি। তাদের কেউ জানেও না সৃজা কখন বাড়ি থেকে ওদের নিয়ে বেরিয়ে গেছে। ইস্মিতা, সালেহা বেগম, মিতু এমনকি চাকর-বাকরদের কেউও দেখেনি। দারোয়ান চাচার থেকেই ইহসান জানতে পেরেছিল, সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে একপ্রকার হন্তদন্ত হয়েই একা একা বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তখন ওকে বেশ শঙ্কিত, চিন্তিত ও ভীতগ্রস্থ দেখাচ্ছিল। দারোয়ান চাচা বারবার জিজ্ঞেস করেও ওর থেকে কিছু জানতে পারেনি। যাওয়ার সময় গেছে একেবারে খালি হাতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, জামাকাপড়, বাচ্চাদের সুজি, ল্যাকটোজেন কিছুই নিয়ে যায়নি। এমনকি ফোনটাও না। ঘর অগোছালো ছিল। জামাকাপড়, চিরুনি, ভেজা তোয়ালে সব বিছানায় অবহেলিতভাবে পড়েছিল। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য তাকে সময় দিয়েছিল সৃজা, কিন্তু তারপরেও এভাবে হুট করে চলে যাওয়ার মানেটাই ইহসান বুঝে উঠতে পারেনি। তার বুক ফাঁকা হয়ে গেছিল৷ তৎক্ষনাৎ সে নীলু ফুপিকে ফোন করেছিল, বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোনটা যখন সুইচড অফ দেখায় তখন এলিজার নাম্বারে ফোন দিতে দিতে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় সে খালি পায়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

এলিজাও প্রথমে ফোন ধরেনি, অনেকক্ষণ চেষ্টার পর কলটা রিসিভ করে শুধু জানাতে পেরেছিল, সৃজা সেখানেই আছে। ইহসান যখন ওদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায়, সৃজা কিছুতেই ওর সামনে আসেনি। বাচ্চাদের নিয়ে একঘরে দরজা আটকে বসেছিল। বারবার বলছিল তাকে চলে যেতে, সৃজা তাকে দেখতে চায় না, তার কোনো কথা শুনতে চায় না। ইহসান ওসব পরোয়া করেনি। সে নত হয়েছিল। হাতজোড় করে বলছিল একটা বার তার সঙ্গে কথা বলতে, কী কারণে এমন করেছে সেটা জানাতে; কিন্তু সৃজা আসেনি। তার শত অনুরোধ, ব্যাকুলতা, কাতরতাকে উপেক্ষা করে নিষ্ঠুরতম আচরণ করেছিল ওর সঙ্গে। ইহসান স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। মাথায় শব্দ খেলছিল না ওর।

বাচ্চারা পাপার কণ্ঠ শুনে গলা ফাটিয়ে কাঁদছিল তার কাছে আসতে, কিন্তু সৃজা দেয়নি। ইহসানের মনে হচ্ছিল এটা তার সৃজা নয়৷ অন্য একটা অচেনা, নিষ্ঠুর, বর্বর মেয়ে। যে তার বাচ্চাদের তার কাছে আসতে দিচ্ছে না। জেদ করে সেও বন্ধ দরজার সামনে বসেছিল মাঝরাত পর্যন্ত৷ একটুখানি আশা নিয়ে। কিন্তু সৃজা তাকে শেষ পর্যন্ত ভুলই প্রমাণ করল। একটা বারের জন্যও বেরুয়নি। এমনকি একফোঁটা পানি পান করতেও বেরুয়নি। কষ্টেসৃষ্টে ইহসানের বুক ভেঙ্গে আসছিল, সবকিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিল। বহুকষ্টে সে নিজেকে দমিয়ে রেখেছিল। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল ও বাড়ি থেকে।

এরপরের চারটাদিন সে একবার নয়, বহুবার গিয়েছে। একবার কথা বলার জন্য, তাকে কিছু বলতে সুযোগ দেওয়ার জন্য, তার দুটো প্রাণকে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু নিষ্ঠুর সৃজা নিজে যেমন খুলেনি, তেমনি এলিজাকেও মূল দরজাটা পর্যন্ত খুলতে দেয়নি। এমনকি ইজহান গেলে তাকেও দেখতে দেয়নি। আজ তো রাগের মাথায় উত্তেজিত অবস্থায় বেশ কিছু কথা শুনিয়ে এসেছে ইজহান সৃজাকে, বাড়ি ফিরে এসেছে হাই প্রেশার নিয়ে। কিন্তু সে তার ঔষধ পর্যন্ত নিচ্ছে না। তার এক জেদ, টনা-মনাকে একবার না দেখা অবধি সে ওষুধফষুদ দূর কিছুই খাবে না। ইস্মিতার থেকে এসব শুনে কী করবে ইহসান, সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আজ কয়েকটা দিন সে বাড়িতে যাচ্ছে না। রেস্তোরাঁতেই থাকছে। তাই ওদিকে কী হচ্ছে তা ওর জানা নেই৷ রাত বাজে সাড়ে দশটা। ইহসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যেতে নেবে তখনই রশিদ এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। ইহসান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চোখ জ্বলে উঠে ওর। রশিদ আমতাআমতা করে বলে, “কোথায় যান স্যার?”

নতমুখে বলে রশিদ। ইহসানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, “জেনে কী করবে? খবর পাচার করবে?
গেট লস্ট রশিদ…”
ইহসান ওকে তোয়াক্কা না করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেল। গম্ভীর, শক্ত কণ্ঠে বলল, “কাল থেকে তুমি আর এসো না। আমি চাই না তুমি আর আমার হয়ে কাজ করে আমারই পেছন লাগো। তবে হ্যাঁ, অন্য কাজের ব্যবস্থা আমি করে দেব।”

ইহসান তাকাতে ইচ্ছে করে না রশিদের দিকে। অসহ্য! অসহ্য! সবকিছু অসহ্য হয়ে উঠছে ওর নিকট। আজ ব্যাপারটা জানার পর থেকে রশিদকে দেখলেই ঠাটিয়ে চড় মারতে হাত নিশপিশ করছে ওর। অথচ ওকে কতো বিশ্বাস করতো, ভাইয়ের নজরে দেখতো। অথচ সে কী না এভাবে বিশ্বাস নষ্ট করল ওর? যদিও চাপে পড়ে, বাধ্য হয়েই কাজটা করেছে তবে একবার কী ওকে জানাতে পারতো না যে, ইনজান ওকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বাধ্য করেছে সেদিন গুদামঘরের সিসিটিভি ফুটেজটা দিতে? নাহ, জানায়নি রশিদ! একেবারে অন্ধকারে রেখে দিয়েছিল ওকে, জেনেও চুপ করে ছিল। ওর চুপ থাকায় যে ইহসানের ঘর ভেঙে যাওয়ার উপক্রম সেটা কীভাবে জোড়া লাগাবে ভেবেছে একবার রশিদ? ইহসান বেরিয়ে আসে রেস্তোরাঁ থেকে। শেখ বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটা রিকশা নেয়। ঐ বাড়ির ত্রিসীমানায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। তবুও তাকে যেতে হচ্ছে ইস্মিতার অনুরোধ রক্ষার্থে, ইজহান শেখের জন্য।

ছটফটে স্বভাব দুটো বাচ্চা শান্ত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে। একজনের পেটের উপর আরেকজনের হাত রাখা। এক হাতের দুটো আঙুল মুখে পুরে ঘুমের মধ্যেই চুষছে আজওয়া। নতুন অভ্যাস হয়েছে তার। গোলাপি ঠোঁটদুটো অল্প অল্প নড়ছে। আর পাশে শুয়ে থাকা তার মিনিট কয়েকের বড়ো ভাই আযরান হা করে ঘুমাচ্ছে। চোখ খুলে ঘুমায় সে। দেখতে কী মায়াময় লাগছে! ইজহানের ইচ্ছে করে চুমুতে চুমুতে দুটো বাচ্চাকে ভরিয়ে দিতে, কিন্তু ফোনস্ক্রিনে কি সেটা সম্ভব? তবুও দু’চোখ ভরে সে তার টনা-মনাকে দেখে, ইজহানজাদীকেও দেখায়। আজওয়াকে দেখিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, “এই দেখুন, এটা
আমার বড়ো মা, আপনার বড়ো বোন। আর ওটা, চোখ খুলে ঘুমাচ্ছে যে, ওটা আমার মেয়েজামাই। এখনও বিছানায় হাগুমুতু করে দেয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখেনি। কিন্তু দেখতে-শুনতে তো খারাপ না। খুবই পুরুষালি। বাড়ন্ত বয়সে আমার মতোই শক্ত-সামর্থ্য হবে। আমার মেয়েকে মাথায় করে রাখবে। রান্না করে খাওয়াবে। গড়েপিঠে নিচ্ছি সেভাবেই। ভালো করছি না?”

পাপার কথা শুনে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে আইরাহ! আচমকা চোখ পড়তেই ইজহান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ইশ! সে এসব কী বলছে? ইস্মিতা শুনতে পেলে ভালো চোখে দেখবে না ওকে। ইজহান চোখ সরিয়ে নিয়ে আবারও ফোনস্ক্রিনে মনোযোগ দেয়। মন ভরে দেখে ওদের। এলিজাকে কতশত কথা বলে, রাগান্বিত স্বরে সৃজার উদ্দেশ্যে কয়েকটা কথাও বলে সে। তবে ভিডিয়ো কলে এলিজের কাছে ঠিকঠাক রাগটা সে প্রকাশ করতে পারে না৷ তবুও শান্তি, অন্তত সে তার বাচ্চাগুলোকে তো দেখতে পেরেছে! এলিজা দয়াময়ী বলেই ইহসানের কথা শুনেছে। এতকিছুর পরেও ফোন করে ওদের দেখিয়েছে। অথচ অহংকারী সৃজা রেহমানকে এতো ধর্ণা দিয়েও চোখের দেখাটা দেখতে পারেনি!
ফোন রাখার আগে এলিজা অনাড়ম্বর স্বরে বলল, “ওদের দেখা তো পেয়েছেন। ঔষধ খেয়ে নিন ভাইয়া।”
ইজহান অপ্রস্তুত হলেও রেগে যায়, “তোমাকে এগুলোও বলে দিয়েছে ভেড়াটা?”

“আপনার জন্য চিন্তিত ভাইয়া।”
ইজহানকে অধৈর্য দেখায়, “তোমার বোন একটা চীজ! একটা সুযোগ তো অন্তত দেবে ইহসান শেখকে! ও আমার শত্রু, তারপরেও দেখো আমি নিজে বলছি ও এসবে জড়িত ছিল না। শুধু অবগত ছিল ব্যাপারগুলোয়। এমনকি লুকায়ওনি। নিজে থানাপুলিশের দারস্থ হয়েছিল। তোমার বাবাকে, ফুপিকে জানিয়েছিল। আমার ভাই যদি দোষী হয়ে থাকে, তাহলে তো তোমার বাবা, ফুপিও এ ব্যাপারগুলো গোপন করার জন্য দোষী হবেন, তাই না? তুমি বুঝেছ তো আমি কী বোঝাতে চাইছি? কোনো বিষয়ে অবগত থাকা মানে তো জড়িত থাকা নয়।”

“জি, বুঝতে পারছি।”
“তুমি সত্যিই অনেক বুঝদার, সবার কথা মন দিয়ে শোনো। তোমার মতো বুঝদার মেয়ে খুব কম পাওয়া যায়। একটু বোঝাও তোমার আপুকে…”
“আপু মানসিকভাবে ঠিক নেই। ওর একটু সময় প্রয়োজন।”
ইজহান এবার অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল, “শুনো, ইস্মিতা মহিলাটাও আমার সঙ্গে কেমন কেমন, ভার ভার হয়ে আছে। আমি আসলে বুঝতে পারছি না ওর মনে কী চলছে! তুমি একটু কথা বলবে ওর সঙ্গে?”
“আমি কথা বলব।”

ইজহানের অস্থির লাগে। সে শুকনো ঢোক গিলে শুধায়, “তুমি আমার কথাগুলো বিশ্বাস কর তো? নাকি ভাবছ সব মিথ্যে? সাধু সাজছি তোমার কাছে? বিলিভ মি, একবর্ণও মিথ্যা না। অনিতা মিসকে নিয়ে আমি ঝামেলা করতাম, ভাবতাম সে শুধু আমার ভাইকেই ভালো বলে, তাকেই নিজের ছেলের মতো দেখে। আমাকে না। এরজন্য রাগ ছিল তাঁর প্রতি, কিন্তু আমি কখনো তার ক্ষতি চাইনি, আমার ভাইও চায়নি। আমার ভাই, আমি ইহসান শেখের কথা বলছি! আরসালানকে না, ওর পক্ষ নিচ্ছি না। ওর কাজকে জাস্টিফাই করব না, ওর সাপোর্টে কথাও বলব না। কারণ ও আসলেই দোষী, একটা মার্ডারার…কিন্তু ইহসান শেখ না, ও নির্দোষ। বিশ্বাস করছ তো আমাকে এলিজ?”
“যাকে অবিশ্বাস করি তার সঙ্গে কথা বলা দূর, ফোনও কর‍তাম না৷ আপনাদের সঙ্গে যেহেতু যোগাযোগ রাখছি, তার মানে অবিশ্বাস করছি না। আমি বিশ্বাস করছি আপনাদের। ভাইয়া পরিস্থিতির গ্যাড়কলে পড়ে গেছে সেটাও আমার কাছে পরিষ্কার। কিন্তু একেবারে নির্দোষ বলতে পারছি না। কিছু ভুল, দোষত্রুটি ভাইয়ারও ছিল।

যার দরুণ সে আজ এই পরিস্থিতিতে। উচিৎ ছিল আরো কঠোরভাবে ব্যাপারটা সামলানো। আরসালান শেখ আর আপনার বাবা যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। শাস্তি পেতে হবে ওদের এটা নিশ্চিত। এর থেকে কোনো মাফ নেই, ছাড়ও নেই।” শেষের কথাগুলো ঝংকার তুলে বলে এলিজা। গোছানো কথার ছন্দ হারিয়ে ফেলে ইজহান। এতোটা তীব্রতা নিয়ে এলিজা কথাগুলো বলেছে যে তাতে চরম ঘৃণার ভাবটা স্পষ্ট। ফোন রাখার পরেও কানে বারবার বাজতে থাকে ইজহানের। সে একটু তফাৎে বসে
থাকা ইহসানের দিকে তাকায়। তার চোয়াল শক্ত মুখাবয়ব গম্ভীর, রক্ত বর্ণ হয়ে আছে। এতক্ষণ লাউডস্পিকারে থাকায় সবই শুনেছে সে!

আজ কয়েকদিন যাবৎ ঘরছাড়া ইহসান। রেস্তোরাঁর লাউঞ্জরুমে থেকেছে। ছটফট করে রাত কাটিয়েছে। বালিশে মুখে গুঁজে আর্তচিৎকার দমিয়েছে। কেউ শোনেনি তাকে। আজ কয়েকদিন পর শূন্য ঘরটাতে এসে নিঃশ্বাসবন্ধ হয়ে এলো ওর। বহুকষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে একদৃষ্টিতে বিছানার দিকে তাকিয়ে রইল। ওখানে কেউ নেই। অথচ ক’দিন আগে এই ঘরটা সৃজার হাসিতে, বাচ্চাদের কান্নায় মুখরিত হয়ে থাকতো। চারপাশের বাতাসে তার বাচ্চাদের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াতো, সেই ঘ্রাণ বুক ভরে টেনে নিতো সে! প্রশান্তিতে বিলীন হতো তার সমগ্র সত্তা। কিন্তু তার সত্তার সেই প্রশান্তিটুকু ছোটো, বড়ো অনেক ভুলে সে হারিয়ে ফেলেছে। আজ আর কেউ তার বিছানা দখল করে নেই। কেউ শুয়ে হাত-পা মুখে নিয়ে খেলছে না। তার ডাক শুনে তাকাচ্ছে না। দাঁতহীন মাড়ি নিয়ে হাসছে না।

আজওয়া বাচ্চাটা মেয়েটা এতো ছিঁচকাদুনে! ঠোঁট উলটে কান্না করলে ভেতরটা ছিঁড়ে যেতো তার। আযরান তো ছটফটে, ইদানীং তার মুখে বুলি ফুটেছে। অস্পষ্ট শব্দ করে নিজের জেদ প্রকাশ করতো। সে কোলে নিতেই কেমন শান্ত হয়ে যেত। সলিড খাবার দেওয়া শুরু করার পর থেকে খাওয়ানোর সময় তাকে ছাড়া খেতে কতই না বায়না করতো। পাপার হাত ছাড়া মুখেই তুলতো না কিছু। এখন কীভাবে মুখে তুলে? ঠিকঠাক খায় ওরা? একা সৃজা সামলায় কেমন করে ওদের? ইহসানের বুক ভার হয়ে আসে। এতটা কঠোর হয়ে গেল সৃজাটা? সে এতবার গেল অথচ একটা বারও দেখতে দিলো না, কোলে নিতেও দিলো না ওদেরকে! অবশ্য দেবেই বা কেন? সে তো ধ র্ষ কের ছেলে, খুনীর ভাই। সত্য গোপন করে বাপ-ভাইকে প্রশ্রয় দেওয়া এক কলুষিত লোক।

কোন মা চায়, তার সন্তানের গায়ে কলুষিত পুরুষের ছোঁয়া লাগুক? আচ্ছা, সন্তানদের একপলক দেখার জন্য, একটুখানি ছোঁয়ার জন্য সে যে প্রতি সেকেন্ডে একবার করে মরে যাচ্ছে, সৃজাকে বললে বিশ্বাস করবে? বুঝবে ওকে? হাঁসফাঁস লাগে ইহসানের। সে বিছানায় শোয়। আজওয়ার একটা ফ্রক নিয়ে সে বুকভরে ঘ্রাণ নেয়। আযরানের টয়’সগুলোতে আদর দেয়। সৃজার ওড়না বুকে চেপে দু’চোখের পাতা এক করার চেষ্টা করে। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। তার দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় নিঃসঙ্গতায় সে মারাই যাবে। ঝটকা মেরে উঠে বসে, দরজা খুলে সে বেরিয়ে যায়। আলুথালু অবস্থায় অন্ধকার করিডোরটা পেরিয়ে ইজহানের ঘরের সামনে দাঁড়ায়। আধখোলা জানালাটা দিয়ে দেখে ইজহানজাদীকে নিয়ে ঘরময় পায়চারি করছে ইজহান। ছোট্ট মেয়েটা ড্যাবড্যাব করে তার পাপার অহেতুক পাঁচালি শুনছে। ইহসান অপলক চোখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে তা।

এতদিন সেও এভাবে রাত জাগতো। বিরক্তি, ক্লান্তি কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারতো৷ বরং উচ্ছ্বাসে, আনন্দে তার বুক ভরে উঠতো। কিন্তু এখন তার বুকের কাছের মানুষজন বিহীন তার জীবনটা অবসন্নতার আঁধারে নিঃশেষ হওয়ার পথে! তার কাছে ওরা কেউ নেই, কিছু নেই। সে শূন্য, একদম শূন্য! টের পায় ইহসান। পরক্ষণেই চমকে উঠে সে। শূন্যতা, হাহাকার ভরা চোখে কাউকে দেখতে নেই। নজর লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বহুকাল পরে ইজহান শেখকে একটুখানি সুখ এসে ধরা দিয়েছে, ওর সুবুদ্ধি হয়েছে। ইহসান চায় না ইজহানের ঐ একরত্তি সুখ দেখে সে প্রলুব্ধ হোক, তার কলুষিত মনে হিংসা জন্মাক। সে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায় না। ছাদে চলে আসে। কালো চাদরে আচ্ছাদিত চারিপাশ। ফিনফিনে হাওয়ায় বাগানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গোলাপের সুঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। গোলগাল চাঁদকে ঘিরে অসংখ্য তারার মেলা বসেছে। মিটিমিটি হাসছে তারা ইহসানকে দেখে। উপহাসের হাসি বোধহয়!

হাসবে না-ই বা কেন? যে পুরুষকে তার স্ত্রী-সন্তান ফেলে রেখে চলে যায়, সে তো কাপুরুষই। ইটের গাঁথুনিতে সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া বসার আসনটাতে সে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে। শেষরাতের উত্তাল হাওয়ায় দোদুল্যমান প্রকৃতি। নারকেল গাছের মাথায় ঠিকরে পড়া চাঁদের আলোতে চারপাশটা বিভ্রমের মতো সুন্দর হয়ে উঠে ইহসানের নিকটে। গোলাপের সুঘ্রাণে তার চোখ বুঁজে আসে৷ ইহসান টের পায়, জন্মদাতার পাপের দায় সে যেমন বয়ে বেড়াচ্ছে, তেমনি তার সন্তানেরাও বয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ সে চায় না, তার সন্তানেরা ছিঁটেফোঁটাও এসবের ভাগীদার হোক। তার বুকভরা ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক।

আচ্ছা, তার পাপ কী জান আর আজিজ শেখের থেকেও খুব বেশি? তেমন হলে দিক বা সৃজা ওর বুকে চাকু বসিয়ে, রক্তাক্ত করে ফেলুক না ওর দেহাংশ! যে শাস্তি দিতে চায় দিক না, শুধু ওর থেকে দূরে না গিয়ে! ঘুমঘুম, ঝিম ধরা কণ্ঠস্বরে ইহসান বিড়বিড় করে, “তোরা আমার অভ্যাস, আমার আত্মার দখলদার। তোদের ছাড়া কেমন করে থাকি? তুই আমার প্রাণগুলোকে আমার থেকে আলাদা করে দিয়ে ভালো কাজ করিসনি। বুঝিস না কেন? তোদের ছাড়া মরে যাব আমি। একেবারে মরে যাব। আমাকে এতো নিষ্ঠুরভাবে না মারলেই কী নয়? তবে এবার আমি আর ভুল হতে দেব না। তোকে অভিযোগ করার কোনো সুযোগই দেব না। দেখিস, আমি যেমন পাচ্ছি, সবাই সবার প্রাপ্য শাস্তি এবার ঠিকই পাবে৷ তুই শুধু আমার উপর একটু ভরসা রাখ!”

ধরণী ঘুমিয়ে আছে। ঘুমায়নি গোলগাল চাঁদ আর কোটি কোটি তারা আর সৃজা। মেয়েটা অন্ধকার বারান্দার এককোণে বসে আছে। অর্ধাহার কেড়ে নিয়েছে তার জৌলুস, চাকচিক্যতা। চোখের নিচ ঢাকা পড়েছে কালো কালিতে, বিষন্নতায়। তাকে যেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে তেমনি আচার-আচরণও অদ্ভুত। নীলু ফুপির ফোন নিয়ে কানে ঠেকিয়ে বসে আছে সৃজা। ডায়াল করেনি, ফোন সুইচড অফ৷ সে নিজেই করে রেখেছে। তবুও সে নীচু স্বরে কথা বলছে ইহসানের সাথে, “তোমাকে বিশ্বাস করে ও বাড়িতে রয়ে গেছিলাম, কিন্তু তোমার বাবা… লোকটা আমাকে খু ন করতে এসেছিল, জানো? বাচ্চাদের সামনে আমার গ লা চেপে ধরেছিল। ওরা ভয়ে কাঁদছিল, খু নীটার মায়া হয়নি।

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৪

আমাকে মেরে ফেলতে চায়। বাচ্চাদের কেড়ে নিতে চায়। আমাকে বলে ওরা মা ছাড়া বাঁচতে পারবে, বাবা ছাড়া না। কিন্তু আমি তো ওদের ছাড়া বাঁচব না। তুমি শুনছ? আমি ওদের ছাড়া বাঁচব না। তোমাকে ছাড়াও না, ভালোবাসি তো তোমাকে, কিন্তু তুমি আর এ বাড়ি এসো না, ঐ লোকটাও এসে পড়বে। এরপর মেরে ফেলবে সবাইকে…”
রাত তিনটায় বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে এলিজা রেহমান শুনল সৃজার সাথে ঘটে যাওয়া কাহিনী, যা তার আপু কাউকে বলেনি; সে বিবশ চোখে দেখল তার বোনের বিধস্ত অবস্থা!

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here