আছি তোমার পাশে পর্ব ১৪

আছি তোমার পাশে পর্ব ১৪
লেখায়- Anjum Tuli

সারারাত কেটে গেলো করিডোরে। রুমের ভেতরে ঢুকতেই আমার বাচ্চাটা আস্তে করে ডাকলো মাম্মা বলে। ধীরে ধীরে বাচ্চাটা আমার সুস্থ হতে লাগলো। আর তুতুলের সাথে আমার সম্পর্কের সাথে রায়ানের সাথে আমার সম্পর্কটাও গভীর হতে লাগলো। উপলব্ধি করতে পারলাম ভালোবাসার শক্ত এক অদৃশ্য বাধনে বাধা পরেছি আমি। কেমন সুখ সুখ অনুভূতিরা আমার সাথে খেলা করতে লাগলো।
তুতুলকে প্রায় আটদিন পরে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। এর মাঝে আমার দুটো পরীক্ষা মিস হয়েছে। রায়ান আমাকে বার বার বলেছে পরীক্ষাটা দিয়ে দাও রোদু৷ আমি শুনি নি। আমার কাছে মনে হয়েছে আমার বাচ্চার আগে আর কিছুই না। তবে এক বছরের জন্য পিছিয়ে গেলাম।

‘মাম্মা দুক্কু’
তুতুলের কথা শুনে ধ্যান ভংগ হলো। এই বাচ্চাটার জন্য জীবনের সব কিছু ছাড় দেয়া যায়। তুতুলকে কোলে নিয়ে আম্মার কাছে গেলাম। সেই ঘটনার পর আম্মার সাথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমার তেমন একটা কথা হয় নি। আমি আম্মার পাশে বসে বললাম, ‘আম্মা আপনার শরীরের অবস্থা কেমন?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আম্মা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলেন, ‘এইতো মা আলহামদুলিল্লাহ’
আম্মা আমাকে পছন্দ করেন। আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারি। আমার আর রায়ানের সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়ার জন্য উনি ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক চেষ্টা করেছেন। আমি আম্মাকে বললাম,
‘আম্মা সেদিনের জন্য আমি মন থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। আসলে আমার সেরকম কোনো ইনটেনশন ছিলো না। কেনো যেনো এ সংসার আর তুতুলের গভীর এক মায়ায় পরে গেছি আমি। আমার উপর কষ্ট রাখবেন না’

আম্মা আমার কথা শুনে মুচকি হাসেন। বলেন, ‘আমি না বুঝে তোমাকে এ সংসারে নিয়ে আসি নি মা। রায়ান এ বিয়েতে রাজি ছিলো না। এ বিয়ে না মোটকথা বিয়েই করতে চাইতো না। এর একটাই কারণ তুতুল। আমি যতই না করি না কেনো তুতুল আমার কাছে অনেক কিছু। আমি নিজের চোখে তুতুলের মায়ের কষ্ট দেখেছি মা। তারপর থেকে কেনো যেনো তুতুলকে কাছে আনতেই সব হারিয়ে ফেলার দুঃখ গুলো এসে আমাকে ছুয়ে ফেলতো। মনে হতো এই মেয়েটার জন্যই সব কিছু। কিন্তু আমি কখনোই চাই না তুতুলকে এ বাড়ি এ সংসার থেকে সরিয়ে ফেলতে। রোদুসির মা’কেও কেমন রাগ দেখিয়েছি দেখো নি?

তোমাকে বার বার পরীক্ষা করেছি। নানাভাবে। তুমি সব পরীক্ষায় পাশ’
বলেই মা হেসে দিলেন। হাসলাম আমিও। তুতুলও কি যেনো বুঝলো। হাত তালি দিয়ে হাসলো। মা তুতুলকে কাছে ডাকলে সে গেলো না। আমার কোমড় পেছিয়ে রাখলো। মা টেনে নিয়ে গেলে চিৎকার দিয়ে কেদে দিলো। এমনিতে সে মায়ের সাথে হাজার দুষ্টুমি করে। কিন্তু কখনো মায়ের কাছে যায় না। মায়ের থেকে তুতুলের ভয় সরাতে মায়ের হাতে একটা বারবি ডল দিয়ে বললাম,

‘মা এটা দেখান হয়তো বা ভয় কাটতে পারে। খুশি হবে’
হলোও তাই। মা পুতুলের লোভ দেখানো মাত্রই তুতুলের চেহারা পালটে গেলো। ডল টা হাতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সে দু নয়ন মেলে তাকিয়ে রইলো। মা বললো, ‘আগে দাদুর গালে একটা চুমু দাও দাদুভাই তারপর দিবো।’
তুতুল কিছু সময় চিন্তা করলো। আমার দিকে তাকালো আবার ডল টার দিকে। তারপর হুট করেই আম্মাকে একটা চুমু দিয়ে ছু মেরে পুতুলটা নিয়ে দৌড় দিলো। আমি আর আম্মা একসাথে হেসে দিলাম। যাক দাদী নাতনির সম্পর্কটা ঠিক হলো। তুতুলকে ভয় পেতে নয় লড়তে শিখাবো। জীবন কাকে কখন কোন মূড়ে নিয়ে দাড় করায় কেউ বলতে পারে না। আমার মেয়ের সাহস হবো আমি।

দেখতে দেখতে বিয়ের দেড় বছর পেরিয়ে গেলো। কিভাবে যেনো সংসার সামলাতে সামলাতে পাক্কা গৃহীনি হয়ে গেলাম। সারা বাড়িতে তুতুল টই টই করে ঘুরে বেড়ায়। মারাত্মক জেদী মেয়েটার সব কিছুই হাতের নাগালে পাওয়া লাগবে।
আজকে তার স্কুলের প্রথম দিন। সাদা শার্ট সাথে নেভেব্লু স্টার্ট পরিয়ে। দুদিকে দুটো ঝুটি করে দিলাম। বার বার আয়নায় গিয়ে সে নিজেকে দেখছে। আর একটু পর পর খিলখিলিয়ে হেসে বলছে,
‘মাম্মা সুন্দর’
আমি দুগালে চুমু খেয়ে বললাম, ‘উহু মাম্মার পরীটা সুন্দর’
তুতুলের রাগ হলো। সে বললো, ‘আমিতো এটাই বলেছি মাম্মা। আমি সুন্দর’
আমি হেসে দিলাম। পাগলিটা আমার। রায়ান অফিসের ড্রেসাপে এসে তারা দিলো। আমি রেডি হয়ে বেরুনোর সময় আমাকে কাছে টেনে গিয়ে কপালে গভীর চুমু একে দিয়ে বললো, ‘জীবনে হয়তো কখনো কোনো ভালো কাজ করেছিলাম রোদু। যে তোমার মত এমন একজন জীবন সঙ্গী পেয়েছি।’
আমি আলতো হেসে বললাম, ‘জীবনে তুমি অনেক পূণ্য করেছো রায়ান। আমি তোমার কাছে ঋনী। আমাকে তুমি সুন্দর স্বাভাবিক একটা জীবন দিয়েছো। যাতে ভালোবাসা কাণায় কাণায় পরিপূর্ণ’

রায়ান আলতো করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘চলো’
জীবন মানুষকে অনেক রকমের পরিস্থির সম্মুখীন করে। জীবনে সব কিছু হারিয়ে নতুন উদ্দমে শুরু করা কঠিন ভীষণ কঠিন। আমি জানি রায়ানের চাওয়া একটাই আমার কাছে যেনো তাকে ছেড়ে কখনো না যাই। মা হারা তুতুলটাকে কখনো বুঝতে না দেই তার মা নেই। মায়ের মত ঢাল হয়ে থাকি তার পাশে৷

রায়ান এখনো গম্ভীর। তবে শুধু অফিসে আর তার এমপ্লোয়িদের কাছে। বাড়িতে তার রাগ আর গম্ভীরতা এখন আর কাজে আসে না। আর তার সম্পূর্ণ ক্রেডিটটাই আমার তুতুলের।
আমরা মাঝে মাঝে জোছনা বিলাশ করি। সুখ দুঃখের গল্প বলি। আমার মনের দুঃখগুলো রায়ানকে বলতে পারলে যেনো তৎক্ষনাৎ শান্তিরা উড়ে এসে মন প্রাণ দখল করে নেয়। ভালো লাগে। ভালোবাসায় সিক্ত অনুভূতিরা পাখা মেলে উড়ে। আমি রায়ানের কাধে মাথা রেখে মাঝে মাঝে দুফোটা অশ্রু ফেলি। এইতো! রায়ান কেয়ারিং হাসব্যান্ড। ছোট থেকে ছোট জিনিশগুলাও খুব সুক্ষ ভাবে লক্ষ্য রেখে দায়িত্বের সহীত পালন করে।

একদিন আমি বলেছিলাম। আমার একবার বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিলো। পাত্রপক্ষ বিয়ের আসর থেকে উঠে চলে যায়। রায়ান আমাকে আর বলতে দেয় নি। কেবল বলেছে, ‘কিছু কথা স্মরণে না আনায় শ্রেয়।’
আমি মাথা নেড়ে সায় দেই। এইতো আমার রায়ান। আমি জানি রায়ান সব জানে। ভাইয়া তাকে সব বলেছে। কিন্তু আমি আমার নিজের মুখে বলতে চাচ্ছিলাম। রায়ানের এক কথা আমার মনে পেখম মেলেছে। শ্রদ্ধাবোধ বেড়েছে। আমি রায়ানকে যত দেখি অবাক হই। একটা মানুষ এত কিছু সহ্য করেও কিভাবে সব কিছু সামাল দেয়?

দেখতে দেখতে অনেক দিন, না না বছর পেরিয়ে গেলো। ভরা পেট আমার। তুতুলের সারাদিন এক প্রশ্ন, ‘মাম্মা বাবু কখন আসবে?’

আছি তোমার পাশে পর্ব ১৩

আমি হাসি। রায়ান উত্তর দেয়। এইতো মা আর কিছুদিন। তুতুলের প্রত্যেকটা কথা এখন স্পষ্ট। কিন্তু আমি আমার তুতুলের মাঝে আমার ছোট্ট বাচ্চাটাকেই খুজে পাই। তুতুল আমার প্রথম সন্তান। আমায় প্রথম মা ডাকার অনুভূতি দিয়েছে সে। এই সংসারে না পাওয়ার ভান্ডারি থেকে পূর্ণতা বেশি। আমি বা রায়ান কেউই বাচ্চা নিয়ে কোনোরকম পরিকল্পনা করি নি। তুতুল থাকতে দ্বিতীয় সন্তান নিব এরকমের কোনো চিন্তা মনে এসে উকি দেয়নি কখনো। তবে আমি যেদিন জানতে পারি যে আমি কনসিভ করি আমি একটু ভয়ে ছিলাম। রায়ান ঠিক কেমন রিয়েকশন দিবে তা নিয়ে। রায়ান সম্পূর্ণটাই বেশ নর্মাল ভাবে নিয়েছে। খুশি হয়েছে। একটা আবদার রেখেছে তার এবারে রাজপুত্র চাই। আমি জানিনা আল্লাহ ভাগ্যে কি রেখেছে। তবে আমি চাই খুব করে চাই রায়ানের চাওয়াটা পূর্ণ করতে।

আগামীকাল সায়ান ভাইয়ের বেল। ভালো ব্যাবহার আর শান্তশিষ্ট ভাবে থাকার কারণে দু-বছর মৌকুফ করা হয়। রায়ানও এ নিয়ে কম দৌড়াদৌড়ি করে নি। কাল সায়ান ভাইকে বাসায় নিয়ে আসা হবে।
রায়ান যখন সায়ান ভাইকে তুতুলের কথা জানায়। সায়ান ভাই কোনো রকমের কোনো প্রতিক্রিয়া করেন নি। রায়ান এ নিয়ে চিন্তায় আছে। সায়ান ভাই তুতুলকে গ্রহণ না করা নিয়ে নয়। যদি কোনো কারণে তুতুলকে এ বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে চায়? এ নিয়ে।

আম্মার শরীর ইদানিং বেশিরভাগই খারাপ যায়। সায়ান ভাই আসছে শুনে সে কি খুশি। টুনির মা’কে নিয়ে ধরে ধরে ড্ররিংরুমে এসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আখিযোগল ছেলেকে দেখার তৃষ্ণায় আছে।

সায়ান ভাই আসলো। মা এলোপাথারি সারামুখে চুমু খেয়ে চোখের পানি ছাড়লো। আমি দেখলাম মা ছেলের ভালবাসা। সায়ান ভাই চোখ তুলে তাকালো। তুতুলের দিকে। তুতুল আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘কে উনি মা?’

আমি কিছু বললাম না। রায়ান এগিয়ে এসে বললো, ‘একটা আংকেল’
আমাদের অবাক করে দিয়ে সায়ান ভাই বলে উঠলো, ‘আংকেল নয়। বাবা’
কথাটা শুনে আমার বুক ধ্বক করে উঠলো। বাবা! রায়ানের দিকে তাকালাম। তার মধ্যে কি চলছে এই মুহুর্তে বুঝার চেষ্টা করলাম।

আছি তোমার পাশে শেষ পর্ব