আড়ালে তুমি পর্ব ২৭

আড়ালে তুমি পর্ব ২৭
সারা সামিয়া

ইনায়ার নানু বাড়ির সবাই ই একে একে আনানের কাছে এসেছে। ওর অবস্থারও এখন উন্নতি ঘটেছে। তবে দেওয়ান বাড়ির কাউকেই কিছু জানানো হয়নি। নীলের কড়া আদেশ ছিল বিষয়টা নিয়ে। ইনায়াও আর সাহস করেনি তাই কাউকে জানাতে। আকবর দেওয়ান এর মাঝে কয়েকবার কল দিলে নীল জানায়,

-খুব বেশি তো আসা হয় না,আমারও ছুটি আছে। অনু আর ইনুও থাকতে চাচ্ছে। আর দুএক দিন পরে আসছি।
নীল সাধারণত বাইরে থাকতে চায় না নিজ ইচ্ছায়। আকবর দেওয়ান ছেলের এমন কথা শুনে খুশি হলেও উল্টো ভয় কাজ করতে থাকে মনে। খুব সমস্যা না হলে তো নীল বাইরে থাকার মানুষ না!
হসপিটাল থেকে জানিয়েছে আনান সম্পূর্ণ সুস্থ আছে এখন। একটু বেড রেস্টে থাকলেই হবে। যখন ইচ্ছে নিয়ে যেতে পারবে।
নীলের এখন অনেক সময় পরে চাপ মুক্ত লাগছে। হসপিটালের সব ফর্মালিটিস পূরণ করে রিফাতদের বাড়িতে চলে আসেন তারা সকলে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নীল বাড়িতে ঢুকেই আগে ফ্রেশ হতে যায়। শরীর ভারী লাগছে তার। এদিকে ইনায়া,আনায়া ,রিফাত, সানজিদা অপেক্ষা করছে সিরিয়ালে। অন্য বাথরুমে আনান গিয়েছে,আর আরেকটাতে গিয়েছে শীলা। বাকিরা উঠানে অপেক্ষা করতে করতে এরই মাঝে শুরু হয়ে যায় ঝুম বৃষ্টি। সবাই সরে গেলেও ইনায়া সেখানেই বসে থাকে। বৃষ্টির পানি ইনায়া শরীরের সব জায়গায় ছুঁয়ে যায়। দুই হাত মেলে ইনায়া উঠে দাঁড়ালো। মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকায়। বৃষ্টির পানি চোখের কোণে জমা হলে চোখ বন্ধ করে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক এমন সময় নীলও বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। পরনে কালো রঙের ভি গলার টি শার্ট আর কালো ট্রাউজার । চোখের সামনে তার ইনায়ার ভিজতে থাকার দৃশ্য। আর বারান্দায় সকলকে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করতে দেখে চকিত হয় নীল। শান্ত ভাবে এগিয়ে রিফাতের হাতে টাওয়েল দিয়ে বলল,

– ওদের সবাইকে ভেতরে নিয়ে যা।
রিফাত মাথা নিচু করে সবাইকে ভেতরে যেতে বলে। আর নীল এগিয়ে যায় ইনায়ার দিকে।ইনায়ার পেছনে খুব সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। আশে পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ইনায়া মাথা নামায়। মুখ মুছে চোখ টিপটিপ করে তাকিয়ে পেছনে ঘুরে। নীলকে এতো কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন হার্টবিট থেমে যায় ইনায়ার। সাথে নীলের ঘ্রাণ তাকে মাতাল করছে।কোনো রকমে বুকে হাত দিল ইনায়া। জামা হালকা করে টেনে দু তিনবার থু থু থু আওয়াজ করলো। শান্ত কন্ঠে শুধালো,

-নীল ভাই… ভিজছেন কেন?
-আপনি কেন ভিজছেন ম্যাম?
ইনায়া চমকে উঠে। বিড়বিড় করে বলে,
-ম্যাম?
নীল এবার ধমক দিয়ে বলল,
-ভিজলে যে তোর জ্বর আসে তার কি ভুলে যাস?
-এবার আসবে না…
-কেন? কোন দুঃখে?
-সুখে.. কারণ আপনি আছেন সাথে।

নীল কোনো জবাব দেয় না। কিছুক্ষণ ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে তারা দুজন দাঁড়িয়ে,আশে পাশে আর কেই নেই । নিজের চুল ঠিক করতে করতে নীল ইনায়ার হাতের কব্জির একটু উপরে ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।কপালের থেকে চুল সরিয়ে বলল,
-সাদা জামা পড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে হয় নাকি জানিস না?
ইনায়া নিজের শরীরের দিকে দ্রুত তাকায়। জামাটা একেবারে শরীরের সাথে মিশে রয়েছে। তখনই বারান্দা থেকে আনানের ডাক শুনে সেদিকে তাকায় নীল। আনান একটানা ডাকছে,
-ইনু…জ্বর আসবে! বড় ভাইয়া ওকে নিয়ে এসো।
নীল বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকায়।
হাত মুঠো করে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-এরপর থেকে বৃষ্টিতে ভিজতে হলে আগে দেখবি কী পড়ে রয়েছিস। সাথে কোথায় আছিস,তাও দেখবি।
কথা গুলো বলে আনানের থেকে তোয়ালে এনে ইনায়ার গায়ে জড়িয়ে দেয় নীল। ইনায়ার এখন লজ্জা লাগছে। আসলেই কেমন লাগছে! তোয়ালে পেঁচিয়ে দ্রুত ভেতরে চলে যায় সে।

নীল পুনরায় ভিজে চুপ চুপ অবস্থায় ঘরে ঢুকলো। বরিশালে এসে একদিন থাকার কথা ছিল। লাস্ট যেই একটা টি-শার্ট ছিল,তাও ভিজিয়ে ফেললো।
রিফাত নীলের অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে বলল,
-এখন কী করবে ভাইয়া?
-আনানের কাছে শোন তো ,ওর এক্সট্রা আছে নাকি কিছু।
-ওর কাছেও নেই। এই জন্যে বৃষ্টি তে ভিজলো না। ইনুকে দেখে ও যেতে চাচ্ছিল। পরে আবার বলল যে পড়ার মতো কিছু নেই আর।
নীলের কেমন অসহ্য রাগ হচ্ছে। বিরক্ত বোধ করে বলল,

-উফ!
-আমার একটা পান্জাবী উঠানো আছে। পার্টির থেকে দিয়েছিল,ওভার সাইজড বলে আর পড়া হয়নি। কিছু না মনে করলে তুমি পড়?
নীল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-ঠিক আছে ,এনে দে।
রিফাত একেবারে ধবধবে সাদা একটা পান্জাবি এনে দেয় নীলের কাছে। কোনো কাজ করা নেই পান্জাবি টাতে। একেবারে প্লেইন।
নীল শরীর মুছে পান্জাবি টা পড়ে নিল। তারপর রিফাতের সামনে গিয়ে একটু ভাব নিয়ে বলল,
-কিরে নেতা নেতা লাগছে তো!
-বিশ্বাস করো ভাইয়া! তোমার চেহারা দেখে তোমাকে এমপি বানিয়ে দিবে সবাই।
-কিরে শা*লা! এই লেভেলে চাপা মারিস!
-রেসপেক্ট ব্রাদার! শালা না আমি,সমন্ধী তোমার। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ছোট বোনের সাথে বিয়ে ক্যানসেল করে দিব।

-ঐ সাহস নিয়ে কেউ এখনো জন্ম নেয়নি। তবে তুই সম্পর্কের দিক দিয়ে আবার আমার বড়,তাই রেসপেক্ট করলাম,যাহ্।
-সিরিয়াসলি ভাইয়া। নির্বাচনে দাঁড়াও। তোমাকে কেউ হারাতে পারবে না।
-দেখছি বিষয় টা। আজ বিকালে তোর ভার্সিটিতে নিয়ে যাবি।
-ঠিক আছে।
-বহিরাগত অ্যালাউড?
-তোমাকে দেখলে কেউ আটকানোর সাহস পাবে না। এমন বডি,চেহারার মধ্যেই ক্ষমতাবান একটা ব্যাপার আছে।
নীল হাসে। জবাবে বলে,
-তাহলে আজ বিকালে ফাইনাল।

সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে বসেছে একসাথে। শীলা, সানজিদা, সম্পূর্ণা, রিফাত,ইনায়া,আনায়া,আনান,নীল সকলেই উপস্থিত ইনায়ার নানুবাড়ির পুরান বড় টিনের ঘরটাতে। বাইরে এখনো ঝুম বৃষ্টি। অনেক মানুষ হলে,আর আড্ডা দেওয়ার সময় সকলে এই ঘরটাতেই আসে।গল্প করতে করতে শীলা প্রস্তাব রাখে কোনো একটা গেম খেলা যাক। প্রথমে ট্রুথ ডেয়ার খেলার কথা বললেও নীল রাজি না হওয়াতে গানের কলি খেলার কথা বলে।
নীলও অবশেষে বলে,
-আচ্ছা,আপু বলছো বলে… তাছাড়া গেম ভালো লাগে না…
-এতো ভয় পেলে হবে না নীল! ট্রুথ ডেয়ার টা তোলা থাকলো। খেলতে তো হবেই।
নীল মাথা ঝুঁকিয়ে হাসে। শীলা রিফাতকে বলে,
-যা তোর গিটার টা নিয়ে আয়।
রিফাত বড় বোনের কথা মতো সাথে সাথে গিটার টা এনে শীলার হাতে দিল। শীলা রিফাতের হাত থেকে নিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,

-আমি শুরু করছি,যেখানে থামবো তার পরের অক্ষর দিয়ে আমার পরের জন শুরু করবে। আর না পারলে পাস বলবে, সেক্ষেত্রে তার পয়েন্ট মাইনাস হবে।শুরু করছি,
Kabhi jo baadal barse
Main dekhoon tujhe aankhein bharke
Tu lage mujhe pahli baarish ki duaa
Tere pahloo mein reh loon
Main khudko paagal keh loon
Tu gham de ya khushiyaan
Seh loon saathiya…

যদিও গানটা আমাদের নায়কের গাওয়ার কথা ছিল । তবে সে যেমন লাজুক,আমাকেই গাইতে হলো। বৃষ্টিতে ভিজে এই গান না গাইলে প্রেম বিষয় জমে?
রিফাত কপালে হাত দিয়ে শীলার দিকে তাকায়। ওদের দুই ভাই বোনের ভাব কায়দা দেখে আনান জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
-এখানে আবার নায়ক কে?
-ও তুমি বুঝবে না। কিন্তু নায়কের উদ্দেশ্য বলছি,সে যেন লজ্জা না পায়। ভয়ও না পায়। নায়িকা কিন্তু হাতের ফাঁকা দিয়ে বেরিয়ে যাবে।
রিফাত শীলাকে থামিয়ে দেয়।বলল,
-থামো আপু! কী সব বলছো!
-দোতালায় দাঁড়িয়ে আমিও বৃষ্টি বিলাস করছিলাম ভাগ্যক্রমে। নাহলে মিস হয়ে যেত অনেক কিছু। তোরা তো আর জানাবি না কিছু! তাই এভাবেই বুঝতে হবে। কিন্তু বেশি দেরি করলে আবার ফাঁকতালে বেরিয়ে যাবে।
নীল শীলার হাত থেকে গিটার নেয়। তারে হাত রেখে বলল,

-কী অক্ষর?
সকলে জোরে চেচিয়ে বলল,
-আাাাাাাাাাা…
নীল শুরু করে,
আমার স্বপ্ন জুড়ে তুই, আর তোর চিন্তারা শুধুই
ঘুরে ফিরে যাচ্ছে বারেবার
আর কোনো রাস্তা নেই আমার
বলনা তোর দোহাই প্রেম ভাসাই কোন জলে…
O My Love……. আদুরে আলাপ…..
ছুঁয়ে তোরই আঁচলে এলাম বলে
Be My Love …..একটা গোলাপ….
চুপিসারে রেখে গেলাম তোর কোলে
গান শেষ করে শীলার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপু সেই নায়ক নিশ্চয়ই হাত মুঠো করে রেখেছে। যাতে তার নায়িকা চাইলেও বেরিয়ে যেতে না পারে।
নীলের গাওয়া গান শুনে ইনায়া মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। আস্তে আস্তে আনায়াকে ডেকে বলল,

-তুই জানতি অনু?
-কী?
-নীল ভাই এতো সুন্দর গান গায়।
আনায়া মাথা ঘুরিয়ে ইনায়ার দিকে তাকায়। হতাশ কন্ঠে বলে,
-এমন পা*গলামি করে কথা বলো মাঝে মাঝে,আমার হাসি পায়।
ইনায়া মুখ ভার করে আনায়াকে দেখে

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে নীল আর রিফাত।
রিফাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই নীলকে বলল,
-ভাই তুমি দেখতে থাকো,আমি একটু কথা বলে আসি ওদের সাথে।সেদিনের ঝামেলা নিয়ে।
-কী বলবি?
-কেন এমন করলো তাই। বড় ভাইদের ডেকেছি।
-চল আমিও যাব।
রিফাত আর নীলকে মানা করে না। সাথে করে নিয়ে যায় তাকে। রিফাতের পেছনে নীল প্রবেশ করতেই সিনিয়র জুনিয়র সকলে উঠে দাঁড়ায়। রিফাত হকচকিয়ে যায় এমন ঘটনায়। সাথে সাথে হাতে ইশারায় সবাইকে বসতে বলল সে। পরক্ষনেই বুঝতে পারে আসলে সবাই নীলের জন্য দাঁড়িয়েছে। রিফাত এক দৃষ্টিতে হা করে নীলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নীল সেদিকে না দেখে রিফাতের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,

-চল বসি।
নীল আর রিফাত গিয়ে দুটো চেয়ার নিয়ে বসে। রিফাতদের ইমিডিয়েট সিনিয়র পা নীলকে বলতে শুরু করল,
-ভাই আপনি আসতে গেলেন কেন এতো কষ্ট করে?
আমরাই সব মিটমাট করতাম।
-নিজের হাতে না করলে আসলে শান্তি লাগবে না।
-ভাই ছেলেগুলোর দিকে তাকান, দাঁত ভেঙে ফেলছি মা*রতে মা*রতে। আরান ভাই কল দিয়ে জানানোর পরপরই সব ব্যবস্থা নিয়েছি। আর মা*রলে ম*রে যাবে।
নীল উঠে দাঁড়ালো।

কোনায় থাকা বড় একটা টুকরো রড হাতে তুলে ঐ ছেলেদের দিকে এগিয়ে যায় নীল। বাম হাতে রড ধরে,ডান হাতের ঘড়ি উপরে তুলে নেয়। জোড়ে জোড়ে বলতে থাকে,
-যে জিনিসে নজর দিয়েছে,ওদের নিজের হাতে র*ক্তাক্ত না করলে আমি শান্তি পাবো না।
কথাটা বলেই নীল এলোমেলো ভাবে শক্ত হাতে মারতে থাকে ওদের। হাতের পাশাপাশি পা দিয়েও মারে। বেশ অনেক্ষণ ধরে মা*রার পরে রড ফেলে দেয় নীল। ওদের থেকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে বলল,
-এই সাদা পাঞ্জাবি তে দাগ লাগলে আমার ইনু ভয় পাবে। তাই তোদের ছেড়ে দিচ্ছি এবারের মতো।
রিফাত নীলকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। ক্যাম্পাস ছাড়তেই নীলকে সালাম করে রিফাত,

আড়ালে তুমি পর্ব ২৬

-আসসালামু আলাইকুম ভাই!
-ঢং করছিস কেন?
-ওদের কে তো ছেড়ে দিয়ে খুব উপকার করলেন। মিনিট দশেক এর মধ্যে হসপিটালে না নিলে একটাও বাঁচবে না।
-জানি।
-কাদেরকে বললে তাহলে যে এবারের মতো ছেড়ে দিলাম? একটারও তো হুশ নেই।
-ওটা মনের সান্তনা ছিল।
-তোমাকে আমার সালাম ভাই!
রিফাত স্যালুট করে নীলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

আড়ালে তুমি পর্ব ২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here