আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৩

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৩
অরাত্রিকা রহমান

— “ওর আবার কি হলো হঠাৎ?” (মনে মনে)
মাথা নাড়তে নাড়তে সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। ড্রইংরুমে এসে দেখে, সোফায় বসে আছেন রামিলা চৌধুরী, আর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিরায়া। দুজনেই যেন অস্বস্তিতে ছিল, রুদ্রর আচরণে স্পষ্টই ওরাও অবাক হয়েছে।
রায়ান কাছে গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
— “আম্মু, রুদ্রর কি হয়েছে? এমন কটকটে হয়ে উপরে চলে গেল কেন?”

রামিলা চৌধুরী গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়লেন। চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। আর পাশে দাঁড়ানো মিরায়ার মুখেও বিস্ময়ের ছাপ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল—সে-ও বুঝতে পারছিল না ঠিক কী ঘটল যে রুদ্র এতটা অস্বাভাবিক আচরণ করছে।
ঘরের পরিবেশে তখন এক ধরনের ভারী নীরবতা নেমে এল, সবাই যেন অজানা প্রশ্নে আটকে গেল।
রামিলা চৌধুরী রায়ানের প্রশ্ন শুনেও কোনো উত্তর দিলেন না। চোখ নামিয়ে নিজের হাতের আঙুল ঘষতে লাগলেন, যেন অস্বস্তি লুকোচ্ছেন।
রায়ান একটু বিরক্ত হয়ে আবার বলল, এবার কণ্ঠে চাপা উঁচু স্বর,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “আম্মু, আমি জিজ্ঞেস করছি রুদ্রর কি হয়েছে? তুমি কিছুই বলছো না কেন?”
এবার রামিলা চৌধুরী চোখ তুলে তাকালেন। গলায় স্পষ্ট রাগ আর অভিমান মিশে ছিল,
— “রায়ান, তোকে আমি কতবার বলেছি আমার সাথে কথা বলার সময় তোর গলার স্বরটা ঠিক রাখতে। আমি তোর মা। আমার সাথে এইভাবে কথা বলবি না।”
রায়ান হতভম্ব হয়ে কিছু বলার আগেই তিনি আবার বলতে শুরু করলেন—
— “তোদের দুই ভাইয়ের আচরণে আমি কিচ্ছুই বুঝি না। রুদ্রর কি হয়েছে সেটা আমায় কে বলবে? তোরা কেউ আমাকে কিছু জানানো প্রয়োজন মনে করিস ? বড় ভাই যখন ইচ্ছে দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে যায়, কিছু না বলেই। আর ছোট ভাই খেতে বললে খাবে না, মুখ ভার করে ঘরে চলে যাবে। আমি কি শুধু বসে আছি তোদের এসব রংবেরং এর কাহিনী সহ্য করার জন্য?”

কথাগুলো বলার সময় তার কণ্ঠে আঘাত, অভিমান আর ক্লান্তি মিশে যাচ্ছিল। যেন ভেতরে জমে থাকা অতীতের ছেলে না বলে বিদেশ চলে যাওয়ার কষ্ট এক মুহূর্তে বেরিয়ে এলো।
এবার আর দাঁড়ালেন না তিনি। শেষ কথাগুলো বলে হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ালেন আর নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। পদক্ষেপগুলো ভারী হলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল—তিনি রেগে আছেন, কষ্ট পেয়েছেন।
রায়ান এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখে বিস্ময়, মুখে অবাক অভিব্যক্তি। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এতটুকু প্রশ্নের জবাবে আম্মু হঠাৎ আমেরিকা চলে যাওয়ার পুরনো প্রসঙ্গ তুলে দিলেন। রুদ্রর উপর তার ক্ষোভ ছিল, কিন্তু সেই ক্ষোভ যেন আচমকাই তার উপর এসে পড়ল।
চোখ নামিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল রায়ান। কেবল এক দৃষ্টিতে মায়ের চলে যাওয়া পিঠের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মনে হচ্ছিল, এই বাড়ির প্রতিটা সম্পর্ক যেন ধীরে ধীরে জট পাকিয়ে যাচ্ছে, আর সে দাঁড়িয়ে কিছুই করতে পারছে না।

একদিকে বউ থেকেও নেই , বাবা বাড়িতে নেই যে সব সমাধানের জন্য কথা বলবে, ভাইটা যাও একটু ঠিকঠাক ছিল এখন সেও অন্য রকম আচরণ করছে আর এখন মাও রেগে গেলো। তার যেন আর শান্তি হচ্ছে না।
রামিলা চৌধুরী রাগী ভঙ্গিতে নিজের রুমে চলে যাওয়ার পর ড্রইংরুমটা হঠাৎ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রায়ান এক জায়গায় দাঁড়িয়েই রইল, মায়ের চলে যাওয়া পিঠের দিকে তাকিয়ে। তার মুখে তখনো অবাক ভাবটা লেগে ছিল। কয়েক মুহূর্ত এমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ তার চোখ পড়ল সামনেই দাঁড়ানো মিরায়ার দিকে।
মিরায়াও তখন পুরো ঘটনাটা চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। রায়ানের দৃষ্টি নিজের দিকে পড়তেই সে হঠাৎ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কারণ রায়ানের চোখে যে ক্লান্তি, যে অস্থিরতা ছিল তা যেন মুহূর্তেই মুছে গিয়ে অন্যরকম এক শান্তি ভেসে উঠল—আর সেই শান্তির কেন্দ্রবিন্দুই যেন সে নিজে।

রায়ান কিছু বলল না, শুধু স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল মিরায়ার দিকে। একরাশ অশান্তির ভেতর থেকেও এই মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো মাত্র তার ভেতরটা যেন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছিল। যেন সমস্ত ঝড় থেমে গিয়ে একটু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে।
কিন্তু মিরায়ার জন্য ব্যাপারটা সহজ ছিল না। হঠাৎ এমন গভীর দৃষ্টিতে রায়ান তাকে দেখছে, এটা তার অভ্যস্ত নয়। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধড়ফড় করে উঠল। নিজের হাতদুটো পরিহিত ওড়নায় গুটিয়ে আনল, মাথা সামান্য নিচু করল, যেন দৃষ্টি এড়াতে চাইছে—কিন্তু তবুও নিজের ভেতরে অদ্ভুত একটা আলোড়ন টের পাচ্ছিল।
এইভাবে কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল—ড্রইংরুমে আর কোনো শব্দ নেই, শুধু নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মানুষ, একজনের চোখে প্রশান্তি খোঁজার দৃঢ়তা, আরেকজনের ভেতরে লুকোনো কেঁপে ওঠা অনুভূতি।
ড্রইংরুমে কিছুক্ষণ নীরবতা ভেসে বেড়াচ্ছিল। রায়ান তখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল মিরায়ার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু অবশেষে সে নিজেই নীরবতা ভাঙল, কণ্ঠস্বরটা ছিল শান্ত, একেবারে নরম—

— “কিছু খেয়েছো?”
হঠাৎ প্রশ্নটা শুনে মিরায়া যেন চমকে উঠল। চোখ কুঁচকে তাকালো রায়ানের দিকে, তারপর আচমকা নিজের ভঙ্গিটা সামলাতে গিয়ে একটু আমতা আমতা করে উত্তর দিল—
— “না… মানে… এখনো খাইনি। খাবার নিতে এসেছিলাম।”
তার কণ্ঠে যেন লজ্জা আর অপ্রস্তুত ভাব মিশে গিয়েছিল। রায়ান ঠোঁটের কোণে হালকা একটা মৃদু হাসি টেনে বলল—
— “আমারও তো কিছু খাওয়া হয়নি। চলো তাহলে, হৃদপাখি, একসাথে খেয়ে নিই।”
“হৃদপাখি” শব্দটা রায়ানের ঠোঁট থেকে বেরোনোর পর মুহূর্তেই বাতাসে একটা অদ্ভুত মিষ্টি অনুভূতি জমাট বাঁধল। মিরায়ার বুকের ভেতরটা কেমন যেন হালকা দোলা খেল। গাল লাল হয়ে উঠল, সে সামান্য নিচু গলায় বলল—
— “না… আমার পেট ভরে গেছে। আমি খাব না।”

কথাগুলো বলে মিরায়া চোখ নামিয়ে নিল, তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল সিঁড়ির দিকে। হাঁটার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছিল, সে লজ্জা লুকাতে চাইছে।
মিরায়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল। তার ভঙ্গিটা কেমন যেন লজ্জায় ভরা—মুখটা নিচু, চোখ মাটিতে স্থির, বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি কাজ করছে। ঠিক তখনই রায়ানের গলা শোনা গেল, নরম অথচ দৃঢ় সুরে—
— “মিরা… থামো।”
কথাগুলো শুনে মিরায়ার পা আচমকা থেমে গেল। যেন অজান্তেই থামতে বাধ্য হলো। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে শ্বাস নিল, তারপর ধীরে মাথা তুলল।
রায়ান এবার নিচু গলায়, কিন্তু গভীর একটা টান নিয়ে বলল
— “আমার দিকে ঘুরে তাকাও।”
মিরায়া দ্বিধা করছিল। বুকের ভেতর কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল, তবুও ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখ নামানো, ঠোঁট কাঁপছে সামান্য।
রায়ান তখন দুই-একটা ধাপ এগিয়ে এল, আরেকটু কাছে এসে দাঁড়াল। তার চোখ দুটো তীক্ষ্ণ অথচ নরম, এক অদ্ভুত মিশ্রণ। সে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল—

— “লুক অ্যাট মি, হৃদপাখি।”
মিরায়ার বুক হঠাৎ জোরে ধক করে উঠল। সে চোখ তুলতে পারছিল না, ভেতরের লজ্জা তাকে গ্রাস করে ফেলছিল। ঠোঁট কামড়ে সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল পাশে।
রায়ানের কণ্ঠ এবার আগের চেয়ে গাঢ়, প্রায় নির্দেশের মতো কিন্তু ভালোবাসায় মোড়ানো অধিকার খাটিয়ে বলল
— “হার্টবার্ড… আই সেইড, লুক অ্যাট মি।”
কথাগুলোয় এমন এক অদৃশ্য টান ছিল যে মিরায়ার বুকের ভেতর আরও জোরে কেঁপে উঠল। ধীরে ধীরে, অনেক দ্বিধার পর সে অবশেষে চোখ তুলল। আর তখনই তাদের দৃষ্টি এক হলো—
মিরায়া চোখ তুলতেই মুহূর্তের জন্য সবকিছু যেন থমকে গেল। দু’জনের দৃষ্টি আটকে গেল একে অপরের চোখে। মীরার বুক জোরে ধকধক করছে, যেন হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে চারপাশে।
রায়ান সামনের দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো। রায়ানের মিরায়ার কাছে আস্তে আস্তে এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। মিরায়ার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। চোখের পাতা কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে যেন।
রায়ানের চোখ দুটো গভীর— নরম, এক চূড়ান্ত মুহূর্তে দাবিদার। সে নিচু স্বরে, একদম গম্ভীর কিন্তু টানভরা সুরে বলল—

— “ আই ডোন্ট লাইক রিজেকশন, হার্ট-বার্ড। আমি কিছু বললে সেটার প্রতি উত্তর কখনো ‘না’ যেন না হয়। বলার পরও এভাবে আমার থেকে চোখ সরানো খুব বিপজ্জনক, হৃদপাখি।
You are not allowed to do that”
মিরায়ার ঠোঁট সামান্য কেঁপে উঠল। কিছু বলতে গিয়েও গলার স্বর আটকে গেল। শুধু চোখ নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু রায়ানের চাহনির টান থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব হচ্ছিল।
রায়ানের হাত অজান্তেই একটু উঠল, প্রায় ছুঁয়ে ফেলতে যাচ্ছিল মিরায়ার গালটা। কিন্তু মাঝপথে থেমে গেল। আঙুলের ডগা যেন কয়েক ইঞ্চি দূরে কাঁপছে।
মিরায়ার নিঃশ্বাস গরম হয়ে কানে লাগছিল রায়ানের। রায়ান সামান্য ঝুঁকে এলো, তার কানের পাশে মুখ নিয়ে গিয়ে শ্বাস ফেলে বলল—

— “তুমি বুঝতে পারছো না আমি কতোটা কষ্টে কন্ট্রোল করছি নিজেকে?”
মিরায়ার পুরো শরীর কেঁপে উঠল। ঠোঁট হালকা ফাঁক হলো, চোখ বন্ধ হয়ে এল অজান্তেই। মুহূর্তটা এতটা টানটান যে, মনে হচ্ছিল সামান্য ভুল হলেই সব বাঁধ ভেঙে যাবে।
রায়ানের চোখ আটকে গেছে মিরায়ার দিকে। মিরায়া সামান্য নিচে তাকিয়ে আছে, কিন্তু তার ঠোঁট কাঁপছে, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হয়ে উঠছে। বুকটা ওঠানামা করছে যেন সে নিজের ভেতরের ঝড় লুকাতে পারছে না।
রায়ান তাকিয়েই বুঝতে পারছে—এই মুহূর্তে তার স্ত্রীর দেহ ভেতর থেকে কাঁপছে, আর সেই কাঁপন যেন তার বুকের ভেতরেও বাজছে।

রায়ানের চোখ স্থির হয়ে রইল মিরায়ার ঠোঁটে। স্নিগ্ধ, নরম, গোলাপি ঠোঁট, সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। বুকের ভেতর অদম্য আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল। মনে হলো, এখনই যদি এগিয়ে গিয়ে সেই ঠোঁটের মিষ্টতা নিজের ঠোঁটের মাঝে বন্দী করতে পারত… যদি একবার ডুবে যেতে পারত সেই অচেনা স্বাদের গভীরে…
মুহূর্তে শরীর কেঁপে উঠল রায়ানের। এক পা এগিয়ে গেল। মিরায়া নিঃশ্বাস আটকে তার দিকে তাকাতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। দৃষ্টি নিচু করল, অথচ দেহ যেন অজান্তেই রায়ানের কাছে টেনে নিচ্ছে তাকে।
দুইজনের মাঝে ফাঁকা দূরত্বটা তখন আর থাকছে না, যেন দমের টানে ঘনিয়ে আসছে। রায়ান এতটা কাছে চলে এলো যে তার নিশ্বাস মিরায়ার কানের পাশে লাগছে। মিরায়ার হঠাৎ শরীর শিউরে উঠল। ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে সামান্য নড়ল, দেয়ালে পিঠ ঠেকলো, আর তার বুকের কাঁপন যেন আরও জোরালো হয়ে গেল।
রায়ানের ভেতরে তখন ঝড়। হাত বাড়ালেও ঠোঁট ছুঁয়ে ফেলতে পারত। কিন্তু ঠিক তখনই বুকের ভেতর একটা বোধ তাকে আটকালো।

“না… এটা সঠিক সময় নয়। আমি যদি এখন নিজের ইচ্ছের কাছে হেরে যাই, তাহলে ওর চোখে আমি ছোট হয়ে যাবো। ও ভয় পাবে। না… আমি পারবো না।”
রায়ান চোখ শক্ত করে এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিল। তারপর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এনে ধীরে গলায় বলল—
— “যেহেতু তোমার খিদে নেই, আমারও খিদে নেই। আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে আমার রুমে নিয়ে এসো।”
এই হঠাৎ কথাটা যেন মুহূর্তেই বাতাস চিরে অন্য দিকে ঘুরে গেল।
রায়ান সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজের রুমে চলে গেল।
মিরায়া কেঁপে উঠল আবার। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে ধীরে মাথা নাড়ল হ্যাঁসূচক। তারপর রায়ান হালকা পদক্ষেপে সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগল। তার বুক তখনো দমে দমে কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে আসছে।
সে ঠোঁট কামড়ে নিয়ে হঠাৎ তার বুকের ভেমিরায়া কেঁপে উঠল আবার। এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করল। নিজের হাতের তালুতে চাপ দিল, নিজেকে সামলাতে মনে ভাবতে লাগল—

“কি হলো একটু আগে আমার? আমি কেন এভাবে কাঁপছিলাম? কেন নিজেকে সামলাতে পারলাম না? ইস্! রায়ান ভাইয়া কি ভাববে এখন আমাকে নিয়ে।”
মুখে হাত রাখল, ঠোঁট এখনো কাঁপছে। তারপর নিজেই মাথায় একটা ঠুক্কা মেরে ফিসফিস করে বলল—
— “মিরা তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? এভাবে কাঁপতে শুরু করলি কেন? কিসের ভয়? একটা মানুষকে দেখলেই বুক কাঁপে উঠতে হবে? , ঠোঁট শুকিয়ে আসবে! উফফ… এভাবে চললে তো তুই একদিন নিজের পাগলামিতেই লজ্জিত হয়ে মরে যাবি।”

বলেই হালকা লজ্জায় মুখ ঢাকল, যেন নিজের শরীরের প্রতিক্রিয়াতেই অবাক হয়ে গেছে। হাসি আর লজ্জার মিশেলে তার গাল লাল হয়ে উঠল।
নিচে meanwhile রায়ান সোফায় বসে গভীর নিঃশ্বাস ফেলছে। ভেতরে ভেতরে ভাবছে—
“আমি তো কখনো এভাবে রিয়েক্ট করিনি… কেন ওর সামনে হলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে কষ্ট হয়? কেন এই শরীর অন্যরকম আচরণ করে?”
ঠোঁটের কোণে একটুখানি ক্লান্ত অথচ অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি।
রায়ান ভাবতে পারেনি মিরায়া তার ইশারায় সাড়া দেবে। সে মাথার চুল গুলোকে উপরের দিকে পড়িয়ে বলল-
“বউ জান আমার, তুমি এভাবে সাড়া দিলে নিজেকে আটকে রাখতে পারবো না আমি । প্লিজ ডোন্ট টেইক মাই টেস্ট।”
তারপর রায়ানের মাথায় হঠাৎই আসলো- “মিরা কি ঠিক এমন ভাবেই আমার হবে একদিন। আমি তার স্বামী জানার পর কি সে আমাকে মানবে? আমার তাকে দশ বছর আগে অস্বীকার করার বিষয়টা কি সে মানবে?
রায়ানের শরীর অন্য রকম জ্বালা করতে থাকে। নিজের শরীর এর জ্বালা ভাব মিটাতে রায়ান একটা কোল্ড শাওয়ার নিয়ে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।

মিরায়া ধীরে ধীরে বন্ধ করে নিজের আবেগ সামলাতে লাগল। ঠোঁটের কোণে হালকা লজ্জা, বুকের ভেতর উত্তেজনার এক অদ্ভুত কেঁপন—সব মিলেমিশে তার হৃদস্পন্দন আরও দ্রুত। রায়ানের কথার অনুসারে, সে রায়ানের জন্য এক মগ কফি বানিয়ে সে নিজেকে একটু শান্ত করে রায়ানের রুমের দিকে এগোল। হাতে কফির মগটা, যা সে নিজের জন্য নয়, রায়ানের জন্য বানিয়েছে।
রুমের সামনে এসে মিরা দরজায় হালকা নক করল।
“রায়ান ভাইয়া… আমি কফি নিয়ে এসেছি।”
কোনো সাড়া নেই। দরজার পাশে একটু থেমে সে ভ্রু কুঁচকালো, তারপর নিজের সাহস বাড়িয়ে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে খুলল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে পা বাড়াল ভিতরে। প্রথমবার রায়ানের রুমে ঢুকতে এসে মিরা খানিকটা অবাক। সাধারণত ছেলেদের ঘর একটু অগোছালো, বইপত্র ছড়ানো, জামা কাপড় ছিটিয়ে থাকে—কিন্তু রায়ানের ঘর একেবারে ভিন্ন।

সবকিছু পরিপাটি, প্রতিটি জিনিস নিজের স্থান পেয়েছে। ডেস্কের উপরে ল্যাপটপ, নোটবুক, কলমপেন্সিল—সবকিছু সুশৃঙ্খল। শেলফে বইগুলো সাজানো, চারপাশে কোনো অগোছালো জিনিস নেই। ফ্লোরে একটি মোটা কার্পেট, সোফার উপর ছোট কয়েকটা কুশন। এমন পরিপাটি পরিবেশ দেখে মিরায়া নিজেও অবাক হয়ে মুখে হালকা হাসি ফেলল।
কফির মগটি হাতে ধরে সে ধীরে ধীরে সাইড টেবিলের উপরে রাখল। তারপর চারপাশে চোখ বুলিয়ে রুমটাকে নিজের চোখে ধরতে লাগল। হঠাৎ তার কান শুনল—ওয়াশ রুম থেকে ঝরনার জল পড়ার আওয়াজ। মিরায়া মুহূর্তে বুঝতে পারল, রায়ান সম্ভবত সাওয়ার নিচ্ছে।

সাইলেন্ট রুমে ঝরনার আওয়াজের সাথে মিরায়ার হৃদস্পন্দন মিলেমিশে এক অদ্ভুত উত্তেজনা তৈরি করল। সে ধীরে ধীরে কফির মগটার দিকে তাকিয়ে, এক হাত দিয়ে সামান্য চুল বেধে, চারপাশ ঘুরে দেখল। ডেস্ক, শেলফ, জানলার দিকে চোখ বুলল, যেন রায়ানের ব্যাক্তিত্ব এবং যত্নশীলতা প্রত্যেক জায়গায় ফুটে উেছে।
মিরায়া মনে মনে ভাবলো,

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১২

—“এভাবে, রায়ানের ঘরে থাকা, এই শান্ত পরিবেশে… সত্যিই অদ্ভুতভাবে শান্তি মেলে।”
মিরায়া হালকা নিঃশ্বাস ফেলে রুমের কোণ দিয়ে ধীরে ধীরে তাকিয়ে রুমের প্রতিটি জায়গায় চোখ বুলাল। এই প্রথমবার, রায়ানের ব্যক্তিগত জায়গায় প্রবেশ করে সে একটি ছোট্ট কিন্তু গভীর অনুভূতি অনুভব করছে—এক ধরণের নীরব, শান্ত অথচ উত্তেজনাপূর্ণ সংযোগ।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৩ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here