আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৪

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৪
অরাত্রিকা রহমান

রুদ্রর রুমে তখন হালকা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। জানালার বাইরে নরম বাতাসে পর্দা দুলছে। স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে সে বিছানার পাশে রাখা গিটারটা তুলে নিয়ে জানালার ধারে বসেছিল। কারণ তার মেজাজ খারাপ থাকলে এই গিটারই তার মেজাজ ভালো করার কাজ করে।
রুদ্র আঙুলগুলো দিয়ে গিটারের তার টানতে টানতে এলোমেলো কিছু সুর বাজাচ্ছিল, কিন্তু প্রতিটা কর্ড কেমন যেন অর্ধেকেই ভেঙে যাচ্ছিল।

তার মুখের ভেতর একরাশ চাপা রাগ, কপালের ভাঁজগুলো চিন্তায় ভরা। গিটারের স্ট্রিংগুলো চাপতে গিয়ে সে এক মুহূর্ত থেমে যায়—মনে পড়ে যায় রিমির বাড়িতে ঘটা সেই দৃশ্যটা।
রিমির বড় ভাইয়ের আচরণটা তার সামনে স্পষ্ট—শব্দগুলো যেন এখনো কানে বাজছে। কি নোংরা শব্দচয়ন, ছিঃ।
একটা মানুষকে ঠিক কতটা হেয় করলে এভাবে কথা শুনানো যায়? রুদ্রর বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
সে গিটারটা নামিয়ে রেখে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। নিচে অন্ধকার রাস্তায় একটা হালকা বাতি জ্বলছে। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার ভেতর যেন ঝড় বইছে।
রুদ্রর ঠোঁট থেকে অজান্তেই ফসকে যায়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“মিরা কে সেই কখন বলেছি আস্তে এখনো এলো…আর এই দিকে ও না এলে রিমির ব্যাপারে জানাও হচ্ছে না। আচ্ছা রিমি নামে মেয়েটা কি এখন ঠিক আছে?”
তার মাথায় একটার পর একটা প্রশ্ন ঘুরছিল—রিমি কি এখন ঠিক আছে? ওর ভাই আবার কিছু করছে না তো? ওর চোখে কান্না কি এখনো আটকে আছে?
এইসব চিন্তা করতে করতেই হঠাৎ মনে হলো, মিরায়ার সাথে তার কথা বলা দরকার এই ব্যাপারে। মিরায়া-ই একমাত্র মানুষ যাকে রিমির ব্যাপারে খোলাখুলি বলা যায়। আর যদি মিরায়ার থেকে রিমির অবস্থা ও জানতে পারে অন্তত কিছুটা হলেও হয়তো বোঝানো যাবে নিজের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনকে।
রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট করে নিজের কপালে হাত বুলিয়ে নিলো, যেন মাথার ভেতরকার অস্থিরতা মুছে ফেলতে চাইছে। তারপর ধীরে ধীরে নিজের ফোন হাতে নিলো মিরায়াকে একটা মেসেজ দিবে বলে তার রুমে যাওয়ার জন্য।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় টুপটাপ শব্দ হলো।

মিরায়া— “রুদ্র ভাইয়া… আছো?”
মিরায়ার নরম গলার ডাকে রুদ্র চমকে উঠলো।
সে দ্রুত দরজার দিকে তাকালো। চোখে যেন হকচকানো ভাব—কিছুক্ষণ আগে যে মুখের ভেতর অস্থিরতা ভর করে ছিল, হঠাৎ মীরার পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তার বুকের ভেতর একটু শান্তি নেমে এলো।
— “আসেছিস… আয়, ভেতরে আয়। সেই কখন আস্তে বলেছিলাম তোকে আর এখন এলি।”
রুদ্রর কণ্ঠে আগের মতো ভারী টান নেই, বরং একটা নিঃশ্বাস ফেলার মতো স্বস্তি মিশে আছে
মিরায়া ঘরের ভেতরে ঢুকলো। চোখ বুলিয়ে দেখলো রুদ্রর মুখে যেন চাপা দুশ্চিন্তা খোদাই করা, তবুও তাকে দেখে একটু হালকা হয়েছে।
মিরায়া আলতো হেসে বলল—

— “তুমি আমাকে ডাকছিলে সেটা তো জানি ভাইয়া। আমার আসলে মনে ছিল না, আমি অন্য কাজে আটকে গিয়েছিলাম। এখন বলো, কি বলতে চেয়েছিলে?”
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। মনে হচ্ছিল প্রশ্নগুলো ভেতরে জমে আছে, কিন্তু মুখে আনতে একটু সময় লাগছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে তারপর ধীরে ধীরে বললো—
— “মিরা… আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করবো। তুই রিমির সাথে কথা বলেছিস? ও কেমন আছে?”
মিরার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো।
— “রিমি? মানে… আজকের পর?”
রুদ্র – “হুঁ।”
মিরায়া একটু থমকালো। প্রশ্নটা হঠাৎ শুনে সে চোখ নামিয়ে নিলো। গম্ভীর সুরে মাথা নেড়ে বলল—

— “না ভাইয়া, এখনো হয়নি।”
রুদ্রর চোখে কেমন যেন হতাশা ঝলকে উঠলো। সে চুপচাপ কিছুক্ষণ মিরায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন গভীরভাবে কিছু বুঝতে চাইছে। তারপর গলা নিচু করে আবার প্রশ্ন করলো—
— “তুই রিমি নামের মেয়েটার সম্পর্কে কতটুকু জানিস, মিরা?”
মিরা এবার একটু অবাক হয়ে তাকাল। ঠোঁট কামড়ে হালকা হাসি দিয়ে বললো—
— “ও আমার বান্ধবী ভাইয়া। এটাই যথেষ্ট… ওর ব্যাপারে জানার আর কি আছে?”
রুদ্রর চোখ আরো গভীর হলো। তার মুখে একধরনের অস্থিরতা খেলা করছে। সে ধীরে ধীরে বললো—
— “বান্ধবী বলছিস, ঠিক আছে। কিন্তু তুই কি জানিস ওনার বাড়ি কোথায়? ওনার পরিবার কেমন? কে কে আছে ওদের?”

প্রশ্নগুলো একের পর এক আসতে থাকায় মিরায়া একটু চুপ হয়ে গেল। তার মুখে কোনো উত্তর নেই। কিছুক্ষণ পরে মাথা নাড়িয়ে আস্তে বললো—
— “না ভাইয়া… এসব আমি কখনো জিজ্ঞেস করিনি। আমাদের দেখা হয়েছে খুব কম, এর মধ্যেই আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছি। আমি আসলে বন্ধুত্ব করার আগে কারো পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে মাথা ঘামাই না। কে কোথায় থাকে, পরিবার কেমন—এসব আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর রিমিও কখনো আমাকে এসব বলেনি বা এসব নিয়ে আমাকে প্রশ্নও করে নি। তাই আমার জানা নেই।”
মিরায়ার কথায় রুদ্রর দৃষ্টি এক মুহূর্ত জানালার দিকে চলে গেল। বাইরে সূর্য ডুবতে ডুবতে আকাশটা লালচে হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার ভেতরে চিন্তার অন্ধকার যেন আরো গাঢ় হচ্ছে। তবুও মিরায়ার কথাগুলো শুনে তার ভেতরে একধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হলো—একদিকে মিরায়ার সরল উত্তর, অন্যদিকে রিমির অজানা পৃথিবী।
রুদ্র ধীরে ধীরে শ্বাস ছেড়ে আবার মিরায়ার দিকে তাকালো। তার চোখে এবার একটা নীরব কৃতজ্ঞতা, যেন মিরায়ার সরলতা তাকে কিছুটা ভরসা দিলো, যদিও অস্থিরতাটা এখনো রয়ে গেছে।
মিরায়ার দিকে তাকিয়ে রুদ্র গম্ভীর গলায় বললো—

— “মিরা, আমি চাই তুই রিমির সম্পর্কে কিছু তথ্য বের করিস। উনি কোথায় থাকে, পরিবারে কারা আছে, কেমন মানুষ… সবকিছু।”
মিরায়া অবাক হয়ে একদৃষ্টিতে রুদ্রর দিকে তাকাল। তার মুখে হালকা কৌতূহল ভরা হাসি ফুটে উঠল। তারপর একটু দুষ্টু ভঙ্গিতে চুলের গোছা কানে সরিয়ে দিয়ে কানের পাশে ঝুঁকে বললো—
— “আচ্ছা গো ভাইয়া… এত খোঁজখবর কেন? আমার বান্ধবীকে কি তোমার ভালো লেগেছে? খোলাখুলি বললে কি ক্ষতি ছিল?”
রুদ্রর চোখ কপালে উঠে গেল। সে এক মুহূর্ত চুপ করে মিরায়ার দিকে তাকাল, যেন প্রশ্নটা তার মাথায়ই ঢুকছে না। তারপর আবার মুখটা গম্ভীর করেই বললো—

— “তুই যা ভাবছিস, তেমন কিছু না। আমি শুধু চাই উনি ঠিকমতো আছে কিনা, বাড়িতে ফিরে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা, সেটা জানবি । তুই ওর এত ভালো বান্ধবী হয়েও কোনো খবর নিচ্ছিস না—এটা মোটেও ঠিক না।”
মিরায়া অবাক হয়ে –
“বাড়িতে ফিরে সমস্যা হচ্ছে কিনা মানে?”
রুদ্রর মনে একাধিকবার ইচ্ছে হচ্ছিল মিরায়াকে বলে ফেলে—আজ রিমির বাড়িতে কী ঘটেছে, কীভাবে তার ভাই রূঢ় আচরণ করেছে, কেমন খারাপ পরিবেশে ও বেঁচে আছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে নিজের জিহ্বা থামিয়ে নিল।
কারণ রুদ্র জানে, প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা ব্যক্তিগত দিক থাকে—যেটা সে ইচ্ছে করলেই সবার কাছে তুলে ধরতে চায় না। সেই ব্যক্তিগত জায়গা লঙ্ঘন করা মানে মানুষটাকে ছোট করে দেওয়া, তার মর্যাদায় আঘাত করা।
মিরায়ার মতো ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হয়েও রিমি তার পারিবারিক দিকটা শেয়ার করেনি। মানে সে নিজেই চায়নি তার বন্ধু এসব জানুক। তাই রুদ্র ভেবেছিল, যদি রিমি নিজে থেকে একদিন বলতে চায়—তবে মিরায়ার কাছেই বলবে। ওটাই স্বাভাবিক হবে তার নিজের বলার থেকে।

এই ভেবে রুদ্র আর কিছু না বলে চুপ করে গেল। শুধু মাথার ভেতর ঘুরতে থাকলো সেই দৃশ্যগুলো, কিন্তু মুখে একটাও শব্দ বের হলো না। মিরায়ার সামনে সে কোনোভাবেই রিমিকে ছোট করতে চায়নি।
রুদ্র কথা এড়াতে মিরায়ার প্রশ্নের জবাব দিল-
“আরে দেখলি না আমি দেরি করে ফিরলাম। আসলে অনেক জ্যাম থাকায় একটু রেস্ট হয়েছে উনার বাসায় পৌঁছাতে। এই নিয়ে যদি কোনো সমস্যা ড়য়ে থাকে তাই ভেবে বলছি তোকে খবর নিতে।”
মিরায়া মুচকি হেসে এবার আরেকটু খুনসুটি করে বললো—
— “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি সব বুঝি। আসল উদ্দেশ্যটা লুকাতে চাইছো। আমাকে বলছো খবর নিতে, কিন্তু আসলে নিজেই জানতে চাইছো ও কী করছে, কোথায় আছে। ঠিক বললাম তো ভাইয়া?”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে মৃদু বিরক্তি ঝরিয়ে বললো—

— “মিরা, তুই কিন্তু বেশি করছিস। তুই যেমনটা ভাবছিস, তেমন কিছুই না।”
কিন্তু মিরায়া এবার একদম থামার মুডে নেই। সে রুদ্রর গম্ভীরতা ভেদ করে দুষ্টু হাসিতে ঘর ভরিয়ে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে রুদ্রর বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার উপর ফোনটা রাখা ছিল। মিরায়া সেটা হাতে তুলে নিয়ে কলপ্যাড খুলতে খুলতে বললো—
— “আচ্ছা থাক, তোমার কথা আমি আর শুনব না। আমি জানি তুমি কী ভাবছো। তুমি না করলেও আমি বুঝি। আমি এখন ব্যস্ত—সোরায়া আমার জন্য অপেক্ষা করছে, কিছু অংকের সলিউশন দেখাতে হবে। আমার আসলে সময় নেই। তাই তোমার এত আগ্রহ দেখে একটা শর্টকাট দিলাম—এই নাও রিমির নাম্বার। কল করো, সরাসরি জিজ্ঞেস করো সে কেমন আছে। আমাকেও খবর দিয়ো পরে।”
রুদ্র একটু কষ্টমিশ্রিত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বললো—

— “মিরা, থাম! তুই ভুল বুঝছিস। তুই যা ভাবছিস তেমন কিছুই না…মিরা…”
কিন্তু মিরায়া শুনলোই না। দুষ্টু হাসি দিয়ে দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে হাত নেড়ে বললো—
— “আচ্ছা ভাইয়া, আমি যাই ভাবি সেটা বড় কথা না। আমার বান্ধবী কেমন আছে সেটা জানো—এটাই আসল কথা। তুমি খবর নিও, পরে আমাকেও জানিও। আমি যাচ্ছি… টাটা।”
এটুকু বলে সে হালকা ভঙ্গিতে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে গেল। ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
রুদ্র চুপচাপ বসে রইলো। একদিকে বিরক্তি, অন্যদিকে অদ্ভুত চাপা হাসি যেন ভেতরে তৈরি হলো। মিরায়ার দুষ্টুমি তার মাথায় গেঁথে গেলেও, আসল চিন্তাটা কিন্তু কোনোভাবেই কমলো না—রিমি আর তার অজানা পৃথিবী নিয়ে তার উদ্বেগ আগের মতোই রয়ে গেল। সে নিজের চাপা হাসি লুকিয়ে নিল মুহূর্তেই।

মিরায়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রুদ্রর ঘরে যেন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। জানালার বাইরে রাতের অন্ধকারে, মাঝে মাঝে হালকা বাতাসে পর্দা দুলে উঠছিল।
বিছানার উপরে পড়ে থাকা ফোনটা রুদ্রর দৃষ্টি কেড়ে নিল বারবার। ওখানেই খোলা অবস্থায় রয়ে গেছে কলপ্যাড, স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে রিমির নাম্বারটা।
রুদ্র হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিল, আঙুল নাম্বারের উপর গিয়ে থেমে রইল। কিন্তু চাপল না।
মনের ভেতর দ্বন্দ্ব শুরু হলো—

“এখন কল দিলে কি ঠিক হবে? উনি কি কিছু মনে করবেন আমি কি ওনার ব্যাপারে নাক গলাচ্ছি? নাকি ভাববে আমি জোর করে তার জীবনে ঢুকতে চাইছি?”
রুদ্র আবার ফোনটা নামিয়ে রাখল। কিছুক্ষণ পর অস্থির হয়ে আবার হাতে নিল।
“কিন্তু যদি সত্যিই উনার কোনো সমস্যা হয়? যদি আজকের সেই ঘটনা আরও খারাপ দিকে যায়? আমি চুপচাপ বসে থাকব?”
ফোনটা আবার রাখল সে। বিছানার কোণে হেলান দিয়ে বসে রুদ্র নিজের কপালে হাত বোলাতে লাগল। মনে হচ্ছিল এক অদ্ভুত চাপা দায়িত্ব তাকে গ্রাস করছে।

বারবার মনে পড়ছে রিমির চোখের ক্লান্ত দৃষ্টি, তার ভাইয়ের রূঢ় কথা। আবার মনে পড়ছে রিমির হাসিমাখা সরল চেহারাটা—যেটা হয়তো ফোনটা বাজলেই মিলিয়ে যেতে পারে।
ফোনটা আবার হাতে তুলে নিল রুদ্র। এবার নাম্বারের ওপরে আঙুল ছুঁয়ে রাখল অনেকক্ষণ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আবার স্ক্রিন বন্ধ করে দিল।
সে গভীর নিশ্বাস ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করল বটে, কিন্তু মনটা থেমে থাকল রিমির নাম্বারের গায়ে—যেন প্রতিটা মুহূর্তে ফোনটা তাকে ডাকছে।

সোরায়া তার রুমে বসে অঙ্কের নোট ঘেঁটে যাচ্ছিল। কিন্তু মন নেই, চোখে বারবার ঘুরে বেড়াচ্ছে মাহফিলের চিন্তা। অঙ্কের সমীকরণগুলো যেন একেবারেই মিলছে না। সে মনে মনে বলল, “আরে ধুর, কি করে মনের মনোযোগ রাখব। মিরা আপু আমি অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি এসে বুঝাও। আজ আমাকে চাহিদা যোগান সমীকরণ বুঝতেই হবে।”
ঠিক তখনই রুমের দরজার দিকে হঠাৎ আওয়াজ। সোরায়া হঠাৎ চমকে উঠে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রায়ানের কণ্ঠস্বর শোনায়:
“মে আই কাম ইন, মাই মিসেসেস লিটল ভার্শন?”
সোরায়া কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। চোখে বিস্ময়, তারপর মুখে হালকা হাসি। সে বলল,
“ইয়েস, মিস্টার আমেরিকা ফেরত, কাম ইন।”

রায়ান ধীরে ধীরে রুমের ভিতরে ঢোকে। চারপাশে চোখ বুলায়, খালি রুম, কোথাও মিরায়ার উপস্থিতি নেই। সে সামান্য মাথা হেলিয়ে, অঙ্গভঙ্গি দিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে:
“মাই মিসেসেস লিটল ভার্শন… হুয়ার ইস মাই মিসেস… আই মিন, ইয়োর বিগ ভার্সন?”
সোরায়া হঠাৎ হেসে, মুখে হাত দিয়ে হাসি লুকিয়ে, বলল:
“ভাইয়া, তুমি কি আমার আপুর প্রেমে পড়েছ?”
রায়ান কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায়। এত সরাসরি প্রশ্ন! কিন্তু তার মুখে হাসি ধরে রেখেই, গর্বের সুরে বলে:
“বাহ! আমার শালি দেখছি বেশ বুদ্ধিমান না—সরি, বুদ্ধিমতী। আফসোস চড়ুই পাখি, তোমার আপু এতো বুদ্ধিমতী না, আমাকে বুঝতেই চাইছে না।”

সোরায়া গম্ভীর নয়, একটু দুষ্টুমি নিয়ে কাঁধের একপাশের চুল হাতে তুলে হাওয়ায় উড়ায়-
“আপুর বুদ্ধি কেবল পরীক্ষার খাতায় খাটে, আর আমি তো স্পেশাল।”
রায়ান ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বলল –
“আচ্ছা তুমি বুঝলে কিভাবে যে আমি তোমার আপুর প্রেমে পড়েছি?”
সোরায়া মুখে একটু স্বাভাবিকতা এনে উত্তর দেয় –
“তুমি যখন আমাকে তোমার মিসেস এর লিটল ভার্শন বললে, জুলিয়েটকে মেয়ে বলায় রাগলে, আপুকে বিড়ালের সাথে পরকীয়া করার অপবাদ দিলে। যে কেউ বুঝবে।”
রায়ান ঠোঁট চেপে হেসে বলে:

“যে কেউই বুঝবে, শুধু তোমার আপুই বুঝছে না।”
সোরায়া উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,
“আপুকে আমি বুঝাই, ভাইয়া?”
রায়ান মাথা নেড়ে বলে:
“উঁহু, চড়ুই পাখি। যাই হোক, তাকে তুমি কিছু বলবে না, ওকে? আমি নিজ দায়িত্বে তাকে বুঝাবো।”
সোরায়া খুশি হয়ে হালকা মাথা নাড়ে হ্যাঁসূচক।
রায়ান হেসে জিজ্ঞেস করে,
“তা, এখন বোলো তো, চড়ুই পাখি, আমার হৃদপাখি কোথায়?”
সোরায়া ধীরে ধীরে বলে,
“ভাইয়া, মিরা আপু তো একটু আগে রুদ্র ভাইয়ার রুমে গিয়েছিল। রুদ্র ভাইয়া আপুকে কোনো একটা কারণে দেখা করতে বলেছিল তাই ।”
রায়ানের কপালে হঠাৎ চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। সে জিজ্ঞেস করে,
“রুদ্র কেন ডেকেছে?”

সোরায়া মাথা নেড়ে বলল,
“ভাইয়া সেটা তো আমি জানি না।”
রায়ান হেসে, খুশির সুরে, সোরায়ার মাথায় দুইবার হালকা ট্যাপ করে বলে,
“ঠিক আছে, চড়ুই পাখি, তুমি মন দিয়ে পড়ালেখা কর। আমি তোমার আপুর খবর নিয়ে আসি।”
সোরায়া টেবিলের পাশে বসে থাকে, তার মুখে হালকা হাসি, চোখে উজ্জ্বলতা। মনে মনে ভাবছে—
“যাক শেষ মেষ আমার আপুর এখন কিছু একটা হয়েই যাবে মনে হচ্ছে। রায়ান ভাইয়াকে দেখেই আমার কেমন যেন দুলাভাই দুলাভাই ফিল আসছে। কিন্তু আমার…আমার কিছু একটা কবে হবে আমি তো ওই কিছু একটা রাস্তায় দেখে রাস্তাতেই হারিয়ে এসেছি।”
সোরায়া নিজের দুহাতে চুল খামচে ধরে বলল-
“ছাতার মাথা ভাল্লাগে না কিছু। জীবনে প্রথম কাউকে ভালো লাগলো তাও অচেনা কাউকে উপর থেকে তাকে হাড়িয়েও ফেলেছি একই মুহূর্তে। দুই সেকেন্ড এর লটারির টিকিট এর মতো এলো আর উধাও হয়ে গেল।”
রায়ান রুম থেকে বের হয়ে ঊরুদ্রের রুমের দিকে এগোতে থাকে। তার চোখে, মাথায় চিন্তা, কিন্তু হাঁটায় গতি আছে, যেন সে নিজেই নিশ্চিত করতে চাইছে যে সব ঠিক টাক আছে।

রুদ্র বিছানায় এদিক-ওদিক গড়াগড়ি খেতে খেতে অবশেষে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অস্থিরতা, মনে হচ্ছিল দম আটকে আসছে।
সে ফোনটা হাতে তুলে নিল। আবারও স্ক্রিনে জ্বলছে সেই নাম্বারটা—সে ‘রিমি’ লিখে সেভ করে নিল। অনেকক্ষণ দ্বিধায় থেকে শেষমেশ কাঁপা আঙুল দিয়ে কল বাটনে চাপ দিল।
ফোনের অপরপ্রান্তে রিং বাজতে লাগল—
ট্রিং… ট্রিং…
ট্রিং… ট্রিং…

কিন্তু কেউ ধরল না। বেজে বেজে একসময় কলটা নিজে থেকেই কেটে গেল।
রুদ্রর বুকের ভেতরটা কেমন হালকা কেঁপে উঠল। চোখে ভেসে উঠল কান্না ভেজা রিমির মুখ, মনে হলো হয়তো কিছু একটা হয়ে গেছে। ঠোঁট কামড়ে আবার ফোন ডায়াল করল।
এবার রিং বাজতেই থাকল।
একবার… দু’বার… তিনবার…
প্রতিটা সেকেন্ড যেন রুদ্রর কাছে একেকটা যুগের মতো মনে হচ্ছিল। কপালে ঘাম জমতে লাগল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল আগের চেয়ে জোরে।
অবশেষে চতুর্থবার বাজতেই হঠাৎ ক্লিক করে অপর প্রান্তে কল রিসিভ হলো। রুদ্রর হাত যেন শক্ত হয়ে গেল ফোনের উপর। বুকের ভেতর শ্বাস আটকে গিয়ে মুহূর্তটা থেমে গেল তার কাছে।

রুদ্রর কল রিসিভ হতেই অপরপ্রান্ত থেকে মৃদু এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো—
রিমি (স্বাভাবিক ভদ্রতায়): “আসসালামু আলাইকুম… হ্যালো, কে বলছেন?”
শব্দটা কানে আসতেই রুদ্রর বুকের ভেতর জমে থাকা দুশ্চিন্তার পাহাড়ে যেন একফোঁটা শীতল বাতাস বয়ে গেল। এতক্ষণ যে অস্থিরতা আর টেনশন তার মাথায় ঘুরছিল, সেই মুহূর্তে যেন গলতে শুরু করল। রিমির কণ্ঠটা শুনেই তার মন কেমন হালকা হয়ে এলো। কিন্তু মুখে কিছু বের হলো না। ফোন কানে ধরে চুপ করেই রইল।
অপর প্রান্তে রিমি আবার ডাক দিল—

রিমি: “হ্যালো? কে বলছেন? শুনতে পাচ্ছেন?”
এবার যেন হঠাৎ ধ্যান ভাঙল রুদ্রর। কিছুটা আমতা আমতা করে, গলা শুকিয়ে আসা ভঙ্গিতে উত্তর দিল—
রুদ্র: “ওয়ালাইকুম আসসালাম… আমি রুদ্র বলছি, মিরার ভাই। আজকে… মানে… আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম।”
রিমি হঠাৎ চমকে উঠল। সে অবাক হয়ে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে একবার স্ক্রিনের দিকে তাকাল, নাম্বার অচেনা। তারপর আবার তাড়াতাড়ি ফোন কানে নিল।
রিমি (আশ্চর্য ভঙ্গিতে): “আরে… আপনি? কিন্তু… আমার নাম্বার আপনার কাছে এল কিভাবে?”
প্রশ্নটা শুনে রুদ্র আবারও একটু গলায় কাঁপুনি নিয়ে বলল—

রুদ্র: “আসলে… তখনকার পরিস্থিতিটা একটু অন্যরকম ছিল। তাই আপনার কাছ থেকে নাম্বারটা নেওয়া হয়নি। জানতেও পারছিলাম না… না মানে… আমি চলে আসার পর আপনার কি অবস্থা হয়েছে। আপনি ঠিক আছেন তো? কোন সমস্যা হয়নি তো?… এজন্যই আসলে মিরাকে আপনার খবর নিতে বলেছিলাম। কিন্তু সে উল্টো আমাকে আপনার নাম্বার দিয়ে দিলো আর বলল—নিজে সরাসরি ফোন করে জেনে নিতে।”
অপরপ্রান্তে রিমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। কণ্ঠে যেন সামান্য ক্লান্তি মিশে ছিল।
রিমি (হালকা স্বরে): “ও আচ্ছা… তাই ব্যাপার।”

দু’জনেই চুপ করে গেল। মিনিটখানেক কেটে গেল, কিন্তু কেউ মুখ খুলল না। শুধু দুই প্রান্ত থেকে দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছিল। সেই নীরবতা যেন আরো ভারী লাগছিল দুজনের কাছেই।
অবশেষে রুদ্র নীরবতা ভেঙে দ্রুত বলে উঠল—
রুদ্র (উদ্বেগ নিয়ে): “আচ্ছা… আসল যেটা জিজ্ঞেস করার জন্য কল দিয়েছিলাম—আপনি ঠিক আছেন তো? আমি চলে আসার পর আর কোন সমস্যা হয়নি তো? হলে আমাকে বলতে পারেন।”
রিমি এবার গলায় স্বাভাবিক ভঙ্গি এনে উত্তর দিল—
রিমি: “না, না। আর কোন সমস্যা হয়নি। জিজ্ঞেস করার জন্য ধন্যবাদ। আর আমার খোঁজ নেওয়ার জন্যও ধন্যবাদ।”

রিমির কথায় রুদ্র একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল—
রুদ্র: “ধন্যবাদ কেন দিচ্ছেন? আপনি মিরার বান্ধবী… স্রেফ দায়িত্ববোধ থেকেই জিজ্ঞেস করলাম।”
রুদ্রর গলায় সরল ভঙ্গি শুনে রিমি হালকা হেসে ফেলল। ফোনের ওপাশ থেকে সেই হাসির শব্দটা রুদ্রর কানে পৌঁছাতেই তার বুকের ভেতরটা কেমন আলোয় ভরে গেল। মনে হচ্ছিল তার অস্থিরতার জায়গায় প্রশান্তির একটা স্রোত বইছে।
রিমি (হাসি চেপে): “সমস্যা নেই, চিন্তা করবেন না। আমি একদম ভালো আছি। কোন সমস্যা হয়নি।”
রুদ্র (নরম স্বরে): “সমস্যা না হলে ভালো।”
একটু নীরবতার পর হঠাৎ রিমি যেন একটু দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করল—
রিমি (সামান্য চিন্তিত স্বরে): “আচ্ছা… আপনি আজকের ব্যাপারে মিরাকে কিছু বলেননি তো?”
প্রশ্নটা শুনেই রুদ্র হকচকিয়ে উঠল। তাড়াহুড়ো করে দ্রুত জবাব দিল—
রুদ্র: “আরে না না! কিছুই বলিনি। বিষয়টা… মানে… আপনার যা বলার আপনারই বলা উচিত। আমার নয়।”
আবারও কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ হয়ে গেল। সময় যেন থেমে গেল দুপাশের জন্যই।
অবশেষে রিমিই নীরবতা ভাঙল—

রিমি (সামান্য ইতস্তত বোধ করে): “আজকের জন্য ধন্যবাদ আর অনেক বেশি সরি। আমার জন্য আপনাকে এমন কির মুখমুখি হতে হলো।”
রুদ্র (স্বাভাবিক ভাবেই): ” এমন কিছুই না আপনার জন্য কিছু হয়নি। দোষটা আপনার ছিল না আর না আমার ছিল।”
কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রিমি (স্বাভাবিক ভঙ্গিতে): “ঠিক আছে… আর যদি কিছু বলার না থাকে, আর যদি আপনার দায়িত্ববোধ আপাতত একটু কমে থাকে আজ, তাহলে রাখি।”
রুদ্র যেন কিছুটা হতাশ গলায় উত্তর দিল—
রুদ্র: “জি… আচ্ছা।”

সাথেসাথেই রিমি ফোন কেটে দিল। তার যেন খুব ভাবে বুক ধরফর করছিল।
রুদ্র কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে ফোনটা বুকের বাম পাশে চেপে ধরে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল—যেন এইমাত্র বুক থেকে একটা ভারি পাথর নেমে গেছে।
অন্যদিকে, রিমিও ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে ফোনটা নিজের মুখের সামনে আনল। ঠোঁটের কোণে হালকা এক মৃদু হাসি খেলে গেল। মনে মনে ভাবল—

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৩ (২)

“এতদিনে হঠাৎ একজন অচেনা কেউ তাকে নিয়েও এমনভাবে চিন্তা করল… এভাবে খোঁজ নিল। এ তো সত্যিই অপ্রত্যাশিত। অথচ অদ্ভুতভাবে তার ভেতরটা খুশিতে ভরে উঠছে।”
দু’জনেই নিজ নিজ জায়গায় থম মেরে বসে থাকল, কিন্তু দু’জনের ভেতরেই অদৃশ্য এক সুতার টান তৈরি হয়ে গেল।
মিরায়া রুদ্রর রুম থেকে বের হয়ে সোরায়ার রুমেই আসছিল এমন সময় রুদ্রের রুমের দিকে আসতে থাকা রায়ানের সাথে মুখোমুখি….

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here