আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৮

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৮
অরাত্রিকা রহমান

মহাসড়কের সকালটা তখন বেশ শান্ত। চারপাশে সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে, রাস্তায় দু’একটা গাড়ি ছুটছে। মাহিরের সাদা গাড়ি সোজা রাস্তা কেটে এগিয়ে চলেছে। ড্রাইভিং সিটে মাহির, পাশে জানালার দিকে তাকিয়ে বসে আছে রায়ান।
গাড়ির ভেতরে প্রথমে নীরবতা, শুধু ইঞ্জিনের গুনগুন শব্দ। কিছুক্ষণ পর মাহির কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল—
“কিরে , কিছু বলছিস না যে?
রায়ান শান্ত মুখে ,
– “কি বলবো? আমার কি কিছু বলার কথা তোকে?”
মাহির হাঁফ ছেড়ে বলল-
” তুই যেহেতু কিছু বলবি না আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
রায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকাল—
“কি কথা?”
মাহির এক চিলতে হাসি দিয়ে চোখ সড়কেই রাখল, তবে ঠোঁটের কোণে কৌতূহল খেলে গেল।

“শুনলাম তুই নাকি প্রেমে পড়েছিস?”
এই কথাটা শুনে রায়ান এক ঝটকায় মাহিরের দিকে তাকাল। চোখে অবাক ভাব, ঠোঁটে অনিচ্ছুক ভাঁজ।
“তোকে কে বললো এসব?”
মাহির এবার বড়সড় হাসি হেসে উত্তর দিল—
“আরে ভাই, ওই বাড়িতে আমার ছোটভাই রুদ্র আছে কিসের জন্য? যদি আমার বন্ধুর খবরটাই আমাকে না দিতে পারে, তবে সে ভাই কিসের?”
রায়ান মাথা নাড়ল বিরক্ত মুখে, তারপর আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিজের মনে বিড়বিড় করল—
“হায়রে! ঘর শত্রু বিভীষণ। নিজের বাড়িতেই গুপ্তচর রেখে দিয়েছি । আমার ভাই না তোর ভাই ও? ওই পেট পাতলার কাছে কোনো কথা থাকে না… আসলে তোদের দুইজনের
কাছেই কোন কথা টিকেই না।”
মাহির একটু গম্ভীর ভঙ্গিতে গলার স্বর নামিয়ে বলল—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“শোন, আমাদের ব্যপারে আবোলতাবোল না বকে চুপচাপ এবার বল, আসলেই যা শুনছি সেটা কি সত্যি? মানে… তুই কি সত্যিই প্রেমে পড়েছিস?”
রায়ান জানালা থেকে চোখ ফেরাল, ঠোঁটে খেলে গেল বাঁকা হাসি। একটুও লুকোলো না। আস্তে করে মাথা নাড়ল—
“হুম।”
মাহির চমকে গিয়ে প্রায় চিৎকার দিয়ে ফেলল—
“কি বলিস! এত্ত সোজাসাপটা হ্যাঁ…! কার প্রেমে রে?”
রায়ান এবার সরাসরি ঘুরে তাকাল মাহিরের দিকে। চোখে সেই দুষ্টু ঝিলিক, ঠোঁটে চাপা স্বীকারোক্তি—
“তোর একমাত্র পিচ্চি ভাবীর প্রেমে পড়েছি।”
এই উত্তর শুনে মাহিরের চোখ প্রায় কপালে উঠে গেল। হাতে তখনও স্টিয়ারিং—হাত কেঁপে গিয়ে হঠাৎই ব্রেক কষে দিল জোরে!

গাড়ি ধপ করে থেমে গেল রাস্তার মাঝখানে। দুজনেই হালকা ঝাঁকুনি খেয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। রায়ান তড়াক করে সিটে ভর দিয়ে উঠে বসল, ভ্রু কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠল—
“ওই শালা! মারবি নাকি? হঠাৎ করে এরকম ব্রেক মারে কেউ?”
মাহির তখন হাঁ করে তাকিয়ে আছে, মুখে অবিশ্বাসের ছাপ।
“মানে তুই… তুই আসলেই… তোর নিজের বউয়ের প্রেমে পড়েছিস?”
রায়ান চোখ উল্টাল বিরক্ত ভঙ্গিতে।
“আজব তো , এত বড় বড় চোখ করিস কেন? হ্যাঁ, পড়ছি। নিজের বউয়ের প্রেমে পড়েছি অন্যের না। এখন কি আবার ডাক্তারের সার্টিফিকেটও আনতে হবে ?”
মাহির মাথায় হাত দিয়ে হাহাকার ভঙ্গিতে বলল—
“হায় আল্লাহ! বন্ধুরে চিনতাম এতদিন সন্ন্যাসী, আজ দেখি প্রেমবাজ! এটা কীভাবে হলো?”
রায়ান ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল—

“শোন, এটা আমারও মাথায় ঢুকছে না। কিন্তু প্রেমে পড়ে আফসোস নেই- আমার বুকটা যে সুন্দর! (হাঁটা বিরবির করে)। এখন তোকে বলার পর মনে হইতেছে আমার ইন্টারভিউ দিচ্ছি প্রেমে পড়েছি বলে।”
দুজনের চোখাচোখি হতেই মুহূর্তে হো হো করে হেসে উঠল তারা। গাড়ির ভেতর ভরে উঠল খিলখিল হাসির শব্দে।
রায়ান হাসতে হাসতে ঠাট্টা করল—
“শোন, পরের বার এভাবে ব্রেক মারবি না, আমি কিন্তু সিট ছেড়ে তোর গায়ে উঠে বসব।”
মাহির চোখ টিপে উত্তর দিল—
“তা বস, কিন্তু মনে রাখবেন মিস্টার আমেরিকা ফেরত, তুই বিবাহিত। আমার সেই পিচ্চি ভাবী আমাকে গুলি করলে কিন্তু দায় তোর নেওয়া লাগবে।”

গাড়ির জানালা দিয়ে সকালের হাওয়া ভেতরে ঢুকছে। সড়কের দুপাশে গাছপালা দুলছে, মাঝে মাঝে রাস্তার ধুলো উড়ে গিয়ে তাদের মুখে লাগছে। মাহির এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে, অন্য হাতে হালকা টোকা দিচ্ছিল ড্যাশবোর্ডে। তার চোখে কৌতূহলের ঝিলিক, ঠোঁটে একরাশ দুষ্টু হাসি।
সে হঠাৎ ভুরু উঁচিয়ে বন্ধুর দিকে তাকাল, কণ্ঠে কৌতুক মেশানো ভঙ্গি।

মাহির:
– “দিন শেষে বউয়ের প্রেমে পড়বি তো এতদিন আমাকে ঘোল খাওয়ালি কেন? সবসময় বলতি, ‘আমার বিয়ের কথা বলবি না’, ‘বউ নিয়ে কিছু শুনতে চাই না’। আজ হঠাৎ এমন নাটক?”
রায়ান আস্তে হেসে মাথা কাত করল। তার চোখে যেন একটা গোপন রহস্যের ছায়া খেলা করছে। সিটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে সে হাত দুটো জড়িয়ে রাখল।
রায়ান:
– “কারণ তুই জানিস না আসল গল্প।”
মাহির বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। ঠোঁট খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল, যেন এখনই একটা রহস্য বের করে আনবে।
মাহির:
– কীসের গল্প?

রায়ান জানালার বাইরে তাকাল। কাঁচের ওপাশে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্য, কিন্তু তার চোখ যেন অতীতের বৃষ্টির দিনটায় গিয়ে আটকে আছে। ঠোঁটে হালকা হাসি খেলে গেল।
রায়ান:
– “মনে আছে, সেই বৃষ্টির দিনের কথা? যখন তোকে বলছিলাম, এক মেয়েকে দেখেই মাথা ঘুরে গেছিল? পুরো ভিজে, কাকভেজা অবস্থায় নাচছিল রাস্তায়। আমি তখনই বুঝেছিলাম, জীবনে একটা ধরা খেলাম। তবে এমন ভালো রকমের ধরা খাব কে জানতো।”
মাহির এক লাফে সোজা হয়ে বসল, যেন সামনে থাকা গাড়িটাই ভুলে গেছে। তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, মুখে অবিশ্বাস।
মাহির:
– “দাঁড়া দাঁড়া… মানে যেই মেয়েকে প্রথম দেখাতেই তুই পাগল হয়েছিলি… সেই মেয়েটাই এখন তোর বউ?”
রায়ান মাথা নাড়ল ধীর ভঙ্গিতে। চোখে এক অদ্ভুত শান্তি।
রায়ান:
– “হ্যাঁ , ওই মেয়েটাই আমার বউ তোর একমাত্র ভাবি। ভাগ্য যদি কারো হাত ধরে আনে, তাহলে তাকে ঠেকানো যায় না।”
মাহির দুই হাত হাওয়ায় ছুঁড়ে উল্লাস করল আর হাতাতালি দিতে থাকলো, যেন এইমাত্র একটা দারুণ গোল হয়েছে ফুটবল মাঠে।

মাহির:
– “বাহ! বাহ! এই কাহিনী তো সিনেমার প্লটের চেয়েও আকর্ষণীয়। মানে প্রথম দেখা, বৃষ্টির দিন— দ্বিতীয় দেখাতেই সোজা বিয়ে করা বউ!”
রায়ান ঠোঁট কামড়ে মজা করে গম্ভীর সুরে তাকাল বন্ধুর দিকে।
রায়ান:
–” হুম, তবে এসবের কিছুই তোর ভাবি জানে না। রুদ্র, আর এখন তুই ছাড়া এখনো কেউ জানে না । বলবোই ডা কিভাবে আম্মুকে ডিভোর্সের পেপার ধরিয়ে দিয়ে ছিলাম সাইন করিয়ে আনতে। এখন কি বলা যায় , বউয়ের প্রেমে পড়ে গেছি, ছাড়বো না ওকে।”

রায়ানকে এমন দোটানায় দেখি মাহির হেসে উঠল, কিন্তু হাসির আড়ালে লুকিয়ে রইল রায়ানের একরাশ লজ্জা।
কিছুক্ষণ পর মাহির ঠোঁটে শয়তানি হাসি নিয়ে সিটের দিকে হেলান দিয়ে ফিসফিস করে বলল—
মাহির:
– “আচ্ছা ভাই, এক গম্ভীর প্রশ্ন করি?”
রায়ান সন্দেহভরা চোখে তাকাল।
রায়ান:
– “আবার কি প্রশ্ন করবি?”
মাহির ঠোঁট টেনে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিল।
মাহির:
– “ভাবির কি কোনো ছোট বোন-টোন আছে?”
রায়ান মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকাল, ঠোঁটের কোণ শক্ত হয়ে উঠল। কণ্ঠে হালকা বিরক্তি।
রায়ান:
– “আছে। ওরা দুই বোন। ছোট বোন আছে । কেন?”
মাহির চোখে হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল, মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল শিশুর মতো কৌতূহলে।
মাহির:
– “মানে তোর শালিও আছে নাকি!”
রায়ান গলায় গর্ব মিশিয়ে, কিন্তু মুখে শান্ত ভঙ্গিতে বলল—
রায়ান:
– ” হুঁ আছে তো। আহ্ ! চড়ুই পাখিটা। আমি সিওর ও আগের জন্মে আমার বোন ছিল।”
মাহির অবাক ভঙ্গিতে চোখের পলক ফেলল।
মাহির:
– “চড়ুই পাখি? এ আবার কোন নাম রে?”
রায়ান এবার হেসে ফেলল। চোখে মায়া, ঠোঁটে স্নেহ।
রায়ান:
– “নাম না, ডাকনাম। ছোট্ট মেয়ে তো… একদম চড়ুই পাখির মতো।”
মাহির হাত কপালে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গি করল।
মাহির:
– “ছোট হলে কি হইছে! আই কেন ম্যান্যাজ।”
রায়ান- “তুই কি ম্যান্যাজ করবি?”
মাহির সাহসে কুলাতে না পেরে বলল-“কিছু না। ”
রায়ান এবার আর ধরে রাখতে পারল না, চোখে মুখে গর্ব যেন ঝলমল করছে। বুক একটু ফুলে উঠল, ঠোঁটে হেসে বলল—

রায়ান:
– “একদম তাই। লাখে একটা শালী পেয়েছি আমি। খাসা, ভিন্নরকম, বুদ্ধিমতী। আমার ধামরা ভাইটার চেয়েও তার মাথায় বেশি বুদ্ধি , বুঝতে হবে মেয়েটা খাসা। যেন আমারই বোন।”
মাহির চোখ চিকচিক করে উঠল, মুখে আবার শয়তানি হাসি।
মাহির:
–” বাহ! বুদ্ধিমতী মেয়ে, দেখতে কেমন রে?”
রায়ানের মুখ মুহূর্তেই কঠিন হয়ে গেল। ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গিয়ে চোখ কুঁচকে গেল।
রায়ান:
– “আমার শালি দেখতে কেমন, তোর জানার দরকার কি তুই জেনে কি করবি?”
মাহির অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হেসে মাথা চুলকাল।
মাহির:
– “মানে… তোর বউয়ের বোন, মানে তোর শালি…, মানে… আমার দিক থেকেও তো কিছু একটা হতে পারে, তাই না?”

রায়ান সিটে সামান্য ঝুঁকে একদম চোখে চোখ রেখে শাসানো সুরে বলল—
রায়ান:
– “ওই শালা, মাথায় তোর কি চলে। একদম মাথা থেকে বের কর এই চিন্তা। তোর কাছে আমি আমার শালিরে জীবনেও দিব না। বুঝছিস?
মাহির দুহাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করল। মুখে নিরীহ ভাব ফুটিয়ে বলল—
মাহির:
– “আচ্ছা বাবা, রাগ করিস না। আমি কিছু করছি না। শুধু জানতে চেয়েছিলাম।”
রায়ান মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল। কণ্ঠে ঠান্ডা কিন্তু কঠিন সুর।

রায়ান:
– “কিছু না করলেই ভালো। নিজের লাভ লাইফের গর্তে পড়ে আছে, আর সে আসছে নিজের লাভ লাইফ স্যাটেল করতে।আগে নিজের টা সামলাই নেই। তারপর না হয় মাথা ঘামাব তোর জন্য।”
মাহির ঠোঁট টেনে হাসি দিল, তার চোখে আবার সেই পুরনো দুষ্টুমি।
মাহির:
– “ঠিক আছে বাবা। তবে মনে রাখিস, আমার জন্য দেখলে নিজের শালিকেই আগে দেখবি। তোর এই চড়ুই পাখি নিয়ে আমার কৌতূহল এখানেই শেষ নয়।”
রায়ান এক চোখ টিপে হুঁশিয়ারির ভঙ্গিতে তাকাল।
রায়ান:
– “আবার নাম নিলি আমার শালির? মনে রাখ ও আমার ছোট বোনের মতো, একটু বুঝে শুনে। গাড়ি থেকে নামায়া হাঁটিয়ে দেব দেব তোকে। নিউ স্টাইলে।”

এর পর গাড়ির চলণ
যে লাগলো আপন গতিতে গাড়ির ভেতরে মুহূর্তেই ভরে উঠল বন্ধুত্বের সেই দুষ্টু হইচই, যেটা কখনো সিরিয়াস আলোচনাতেও পরিণত করে ফেলে প্রাণখোলা মজায়।
মহাসড়ক ধরে গাড়ি চলছিল একটানা। কিছুক্ষণ বাদেই এক বিশাল বিল্ডিং এর সামনে এসে দাঁড়াল—রায়ানের বিজনেস সাইট। কংক্রিটের বিশাল কাঠামো, চারপাশে ব্যস্ততা—শ্রমিকরা কাজ করছে, ক্রেন চলছে, মেশিনের গর্জনে বাতাস কাঁপাচ্ছে।
মাহির ধীরে ব্রেক চেপে গাড়ি থামাল। গাড়ি থামতেই রায়ান সিটের পাশে রাখা ব্যাগটা তুলে নিল। গাড়ির দরজা খুলে নামার সময় সে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল—

রায়ান:
– “আচ্ছা তাহলে মাহির খান, আজ একটু শান্ত থাকিয়েন। কলেজে আজ প্রথম দিন, গিয়ে প্রথম দিনেই কোনো ছাত্রীর সাথে ফ্লার্ট শুরু করিস, তবে খবর আছে! মানসম্মান রাখিস আমার। ”
মাহির হেসে মাথা নাড়ল, গম্ভীর ভঙ্গিতে হাত তুলে স্যালুট দিল।
মাহির:
– ” থাক কি আর বলবো তোকে। এখন মুড নেই , এমনিতেই টেনশনে আছি।”
রায়ান আবার হেঁসে বলল- “আরে প্যারা নিস কেন। সব ঠিক হবে ইনশাআল্লাহ। সাবধানে যাস।”
মাহির- “জি স্যার! আপনার আদেশ মাথা পেতে নিলাম।”
দু’জনের মুখেই হাসি ফুটল। রায়ান ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে গেল, আর মাহির আবার স্টিয়ারিং ধরল।

গাড়ি এবার আবার মহাসড়কে গড়াতে লাগল। তবে এবার মাহিরের ভেতরটা অন্যরকম। জানালার বাইরে সকালের রোদ নেমে আসছে, রাস্তার ধুলো বাতাসে নাচছে। ব্যস্ত রাস্তায় হর্ন আর পাখির ডাক মিশে আছে বাতাসে।
মাহিরের মনে হচ্ছিল—আজকের দিনটা কেবল একটা দিন নয়, বরং এক নতুন জীবনের শুরু। ছোটবেলা থেকে শিক্ষকতার স্বপ্ন ছিল তার। সেই স্বপ্নের জন্য কত রাত জেগেছে, কত বই গিলেছে, কত পরীক্ষা দিয়ে হোঁচট খেয়েও আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।
স্টিয়ারিং ধরে তার চোখ ঝলঝল করে উঠল গর্বে। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।
– “আজ আমি শুধু চাকরি করতে যাচ্ছি না, আজ আমি সেই স্বপ্নকে ছুঁতে যাচ্ছি, যার জন্য এত বছর লড়েছি।”
মাথায় ভেসে উঠল সেই দিনগুলো—
ঘরে বসে রাতের পর রাত লাইট নিভে গেলে একা পড়াশোনা করা, মাথায় অবসাদ নেমে এলেও আবার নতুন করে বই খুলে বসা। পরিবারকে হাসিমুখে বোঝানো—“আমি পারব, আমি একদিন ক্যাডার হবো।”
আজ সত্যিই সে সেই লড়াইয়ের ফল হাতে পেয়েছে। বিসিএস ক্যাডার হিসেবে কলেজে প্রফেসর পদে যোগ দিতে যাচ্ছে।

গাড়ি কলেজের এলাকার ভেতরে ঢুকতে থাকল। সড়কের দুপাশে স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরা ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে। রিকশা, সাইকেল, প্রাইভেট কার—সবকিছু মিলে শহরের সকালটা যেন এক উৎসবমুখর দৃশ্য।
এই সব কিছুর মাঝেই মাহিরের বুকটা হালকা ধড়ফড় করছে। উত্তেজনা, নার্ভাসনেস আর আনন্দ—সব একসাথে মিশে যাচ্ছে তার ভেতরে।
– “আজই সেই দিন… আজ থেকে আমি শুধু মাহির নই, আমি একজন প্রফেসর।”

সকালের বাতাসে ছিল অন্যরকম সতেজতা। শহরের কোলাহল তখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি, রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা বাড়ছিল ধীরে ধীরে। সোরায়া গোসল শেষে প্রস্তুত হলো নতুন দিনের জন্য। সাদা আর হালকা নীল মিশ্রিত কলেজ ইউনিফর্ম পরে বের হলো সে, ভেজা চুলগুলো এখনো আলগা আলগা ভাজে বাধা অবস্থায় ঝুলে আছে কাঁধে। আয়নার সামনে শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল—মুখে হালকা সাবলীল হাসি, চোখে একরাশ আত্মবিশ্বাস আর ভিতরে অজানা এক কৌতূহল।
রিকশায় বসতেই তার মনে হলো আজকের সকালটা কেমন যেন অন্যরকম। রিকশার চাকাগুলো ধীরে ধীরে ঘুরছিল, চারপাশে দোকানিরা তখনও শাটার তুলছে, কিছু স্কুলগামী বাচ্চা ইউনিফর্ম পরে দৌড়ঝাঁপ করছে, পথের ধারে ভাজা গরম সিঙারার গন্ধ আসছে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া সোরায়ার ভেজা চুলে এসে লাগতেই সে একটু শিহরন খেল। মনে মনে ভাবল— “আজ একটা নতুন দিন, হয়তো ভালো কিছু ঘটবে। কতই না ভালো হতো যদি আজ আবার রাস্তায় তার সাথে দেখা হতো।”

কলেজের প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সোরায়ার মনে হলো সে যেন ভিন্ন জগতে পা রাখল, এতোক্ষণ কল্পনার জগৎ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। বিস্তৃত মাঠ, মাথার উপরে ছায়া দিচ্ছে কদম আর শিরীষ গাছ, পাখির কিচিরমিচিরে ভরে গেছে চারদিক। ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট দলে দলে হাসি-ঠাট্টা, কারও হাতে বই, কারও হাতে নোট—সব মিলিয়ে প্রাণবন্ত এক পরিবেশ।

সোরায়া ব্যাগটা কাঁধে ঠিক করে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ক্লাসের দিকে। তার ক্লাসে পৌঁছাতে হলে টিচার্স রুমের পাশ দিয়ে যেতে হয়। সে যখন ওই পথ ধরে হাঁটছিল, তখনই তার চোখে পড়ল কিছু অদ্ভুত দৃশ্য।
টিচার্স রুমের কাঁচের দরজার ভেতর দিয়ে দেখা গেল বড় টেবিলটা যেন পুরো ফুলের বাগানে পরিণত হয়েছে। একটার পর একটা ফুলের তোড়া সাজানো—লাল গোলাপ, সাদা লিলি, হলুদ গাঁদা, রঙিন টিউলিপ, গ্ল্যাডিওলাস। পুরো ঘরটা যেন রঙে আর সুগন্ধে ভরে গেছে। টেবিলের একপাশে খাবারের সারি—প্লেটে সাজানো সন্দেশ, লাড্ডু, কেক, ফল আর নানা রকম নোনতা। যেন একটা উৎসব বা অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে।
সোরায়া খানিকটা থমকে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে ভেতরে তাকাল।

– “আজ কি কোনো বিশেষ দিন নাকি? শিক্ষকদের জন্মদিন বা বিদায় সংবর্ধনা কিছু?”
সে মুহূর্তেই মনে ভেসে উঠল প্রশ্ন, তবে আবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে মনে করল—শিক্ষকরা হয়তো তাদের নিজের মতো কোনো অনুষ্ঠান করছে।
ঠিক তখনই ভেতর থেকে হালকা ফিসফিসানি তার কানে এলো।
একজন শিক্ষক হেসে বললেন,
– ” কলেজে অনেকদিন পর আবার নতুন কেউ আসতে চলেছে।”
অন্যজন বললেন,
– “হ্যাঁ, এই প্রথম দিনটাই যে কতটা আলোড়ন তুলবে, তা ভেবেছিস?”
তৃতীয়জনের গলায় উত্তেজনা,
– “শুধু ছাত্রছাত্রীরাই নয়, আমরাও অপেক্ষা করছি। সবার মুখে একই আলোচনা।”

সোরায়া কানে টুকরো টুকরো শব্দগুলো পেলেও পুরো কথাটা বুঝতে পারল না। শুধু অনুভব করল—আজ কলেজে কিছু ভিন্ন কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তবে কি, নতুন কোনো শিক্ষক আসছেন? নাকি বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান?
এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল সে। কৌতূহলী চোখে ভেতরের দৃশ্য আর শিক্ষকদের অস্বাভাবিক উত্তেজনা লক্ষ্য করল। কিন্তু বেশিক্ষণ দেরি না করে আবার নিজের পথে এগিয়ে গেল।
তার মনে প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে লাগল—“এত ফুল, এত খাবার, এত উৎসাহ—এর মানে কী হতে পারে?”
সেদিনের সকালের মতো, তার জীবনেও যেন আস্তে আস্তে নতুন কিছুর সূচনা হতে চলেছে, যদিও সোরায়া তখনও সেটা আঁচ করতে পারেনি।

কলেজের করিডোরে তখনও সকালবেলার কচি আলো, জানালা দিয়ে ঢুকে মেঝেতে ছায়ার খেলা করছিল। বাইরে থেকে হাওয়া আসছিল কেমন একটা সতেজতা নিয়ে, মনে হচ্ছিল দিনের শুরুতে কলেজটা যেন আলাদা প্রাণ পেয়েছে। সোরায়া ধীর পায়ে ক্লাসরুমের দরজার দিকে এগোচ্ছিল। ব্যাগের স্ট্র্যাপটা একটু ঠিক করতে গিয়ে হঠাৎই দুটো হাত পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরল—
– “ভাউ!”
সোরায়ার বুক কেঁপে উঠল, পুরো শরীর চমকে উঠল।
– “ওমা..! কে রে?”
সে গলা ঘুরাতেই চোখে পড়ল পরিচিত মুখ—তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী জুঁই। মুখে দুষ্টু হাসি, চোখে খিলখিলিয়ে মজা করার আনন্দ।
জুঁই গলা নামিয়ে বলল—

– “এই মেয়েটার সাথে এতদিন ঘুরাফেরা করছি, তবু এখনো আমার স্টাইল চিনলো না!”
সোরায়া বুক চাপড়ে গভীর শ্বাস নিল, তারপর ঠোঁট ফুলিয়ে উত্তর দিল—
– “তুই না, একদিন না একদিন সত্যিই আমাকে হার্ট অ্যাটাক করাবি।”
জুঁই ভান করে নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল—
– “আহারে! আমার পবিত্র ভালোবাসার আলিঙ্গনকেও হার্ট অ্যাটাক ভাবছিস? নাহ, এখন বুঝলাম তোর সত্যিই কাউকে দরকার।”
এই কথা শুনে সোরায়ার মুখে হালকা লজ্জা ফুটে উঠল, কিন্তু হাসি চেপে রাখতে পারল না।
– “পাগলি! এসব নাটক বাদ দে। কালকের কাহিনীর দ্যি এন্ড হয়ে গেছে।”
জুঁই দুষ্টু হাসি দিয়ে –
“দ্যি এন্ড, না দ্যা স্টার্ট পড়ে বুঝা যাবে।”
দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে করিডোরে দাঁড়াল। হঠাৎ সোরায়া গলা নামিয়ে গম্ভীর সুরে বলল—
– “শোন, তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি… আজকে কলেজে কি কোনো অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠান হচ্ছে নাকি? আমি টিচার্স রুমের সামনে দিয়ে আসার সময় দেখলাম, টেবিল ভর্তি ফুল-ফল-মিষ্টি। মনে হলো যেন কোনো বিশেষ আয়োজন।”
জুঁই তখন ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে নাটকীয় ভাবে চোখ বড় বড় করল—
– “ওহ্ হ্যাঁ! ওটার খবর তো আমিও শুনছি। কি এক নতুন প্রফেসর আসছেন! শুনেছি তিনি নাকি একেবারে বিসিএস ক্যাডার!”
তারপর জুঁই হঠাৎ মুচকি হেসে কণ্ঠে খোঁচা মিশিয়ে যোগ করল—

– “ভাব তো! তোর রাস্তায় দেখে ক্রাশ খাওয়া ছেলেটার মতো যদি দেখতে হয় প্রফেসরটা, কেমন হবে?”
সোরায়ার চোখ হঠাৎ বড় হয়ে গেল। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ফেলল আর কনুই দিয়ে জুঁইয়ের পেটে খোঁচা দিল।
– “চুপ কর! এসব আজে বাজে কথা বলিস না। আর কাউকে বললে মাথায় পড়বে তোর।”
জুঁই হাত তুলে ভান করে গম্ভীর হলো—
– “আরে না না, আমি তো কারো নাম নিই নি! তবে হ্যাঁ, রাস্তায় প্রথম দেখাতেই তোকে এভাবে কারো উপর ক্রাস খেতে দেখে মজাই লাগছে..”
কথা শেষ করার আগেই সোরায়া ব্যাগ দিয়ে জুঁইয়ের হাতে হালকা ধাক্কা মারল।
– “চুপ কর জুঁই! সত্যিই একদিন তোরে মেরে ফেলব।”
জুঁই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, চোখে দুষ্টুমি ঝিলিক—
– “ওরে বাবা! তাইলে মানতেই হবে… আগুন যেখানে আছে, ধোঁয়া তো ওখানেই উড়বে!”
সোরায়ার মুখ লাল হয়ে গেল। লজ্জা নয়, বিরক্তি মেশানো অস্বস্তি।
– “দেখ, আমি কিন্তু একদমই পাত্তা দিই নি ওসব। আর তুই না, সব কথার মধ্যে খোঁচা দিবি না এক জিনিস এর।”
জুঁই ভান করে হাত ছড়িয়ে নাটকীয়ভাবে বলল—

– “ঠিক আছে রাণীমা, আর কিছু বলব না। চল, আগে ক্লাসে ঢুকে পড়ি। না হলে প্রফেসর সাহেব আসবেন, আবার প্রথম দিনেই পিছনের বেঞ্চে পাঠিয়ে দিবেন।”
দু’জনে হেসে হেসে ক্লাসরুমের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
কিন্তু সোরায়া মুখে হাসি ধরে রাখলেও মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল জুঁইয়ের কথাগুলো—“নতুন প্রফেসর, বিসিএস ক্যাডার… দেখতে হবে কে ইনি…”
অদ্ভুত একটা কৌতূহল কাজ করছিল তার মধ্যে।

গাড়ি ধীরে ধীরে তার কলেজের মূল ফটকের সামনে এসে থামল। সাদা রঙের বড় বিল্ডিং, উপরে জাতীয় পতাকা উড়ছে। ফটকের সামনে ছাত্রছাত্রীদের কোলাহল, আর গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে নিরাপত্তারক্ষী।
মাহির কিছুক্ষণ গাড়ির ভেতরে বসে রইল। হাত দিয়ে স্টিয়ারিং চাপড়াল আস্তে, যেন নিজের মনকে সাহস দিচ্ছে। তারপর গভীর শ্বাস নিয়ে গাড়ির দরজা খুলল। সূর্যের আলো তার মুখে পড়তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।
এখন সে জানে—তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো এই মুহূর্তেই।
টিচার্স রুম তখন যেন ছোটখাটো অনুষ্ঠানস্থল। টেবিল ভর্তি ফুলের তোড়া, প্যাকেট করা মিষ্টি, কেউ লাচ্ছি নিয়ে ব্যস্ত, কেউ চা-স্ন্যাক্স গুছাচ্ছে। একেকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা পরিপাটি পোশাকে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন, কারো মুখে গর্বের হাসি—

– “আজ আমাদের কলেজে অবশেষে নতুন প্রফেসর জয়েন করছেন।”
– “হ্যাঁ, এমন কোয়ালিফাইড শিক্ষক পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য!”
ফিসফিসানি আর উত্তেজনার ভেতরেই হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল মাহির।
সাদা শার্ট, নেভি-ব্লু ব্লেজার, গলায় কলেজ আইডি কার্ড ঝুলছে। চুলগুলো একদম সোজা করে আঁচড়ানো, চোখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। বুক সোজা করে যখন ভেতরে ঢুকল, তখন যেন পুরো রুমের আলো এক মুহূর্তে ওর দিকে আটকে গেল।
কিছুক্ষণের জন্য রুমে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তারপরই গুঞ্জন ছড়াল—

– “এই তো উনিই, আমাদের নতুন প্রফেসর!”
মাহির ভদ্রভাবে সবার দিকে তাকিয়ে নম্র হাসি দিল, তারপর হাত জোড় করে সালাম জানাল।
– “আসসালামু আলাইকুম। আমি স্নিগ্ধ খান মাহির, ইংলিশ ইন্সট্রাক্টর।”
সবাই একসাথে সাড়া দিল—
– “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
প্রিন্সিপাল স্যার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, মুখে গর্বের ছাপ—
– “এই যে, আমাদের কলেজের নতুন প্রফেসর। বিসিএস ক্যাডার হয়েও তিনি শিক্ষকতা বেছে নিয়েছেন—এটা আমাদের জন্য অনেক সম্মানের।”
একজন সিনিয়র স্যার এগিয়ে এসে হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিলেন মাহিরের হাতে।
– “স্বাগতম, স্যার। আপনাকে পেয়ে আমরা সত্যিই আনন্দিত।”
মাহির মাথা নত করে ভদ্র কণ্ঠে বলল—

– “ধন্যবাদ স্যার, ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে। আসলে শিক্ষকতা আমার স্বপ্নের পেশা। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হলো—এই আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।”
টিচার্স রুমে হালকা করতালির শব্দ বেজে উঠল।
ঠিক তখনই বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল সোরায়া। বান্ধবী জুঁই তার কানে ফিসফিস করে বলল—
– “ওই দেখ, নতুন প্রফেসর ঢুকেছে। কেমন স্মার্ট, না?”
সোরায়ার চোখ বারবার ভেতরের সেই একজনের উপর আটকে যাচ্ছে। লোকটা টেবিলের পাশে দাঁড়ানো—সাদা শার্ট, গাঢ় নীল ব্লেজার, একেবারে পরিপাটি ভঙ্গি।
কিন্তু যতবারই সোরায়া মুখটা দেখার চেষ্টা করছে, প্রতিবারই তার চোখে ধরা দিচ্ছে শুধু চওড়া কাঁধ আর পিছন দিক।
তার বুকের ভেতর কেমন অস্থিরতা জমে উঠল।

“কে হতে পারে? কেন যেন মনে হচ্ছে… কোথাও আগে দেখেছি? কিন্তু মুখটা না দেখলে নিশ্চিত হবো কীভাবে?”
সে বারবার গলা লম্বা করে, ডানে-বাঁয়ে সরতে সরতে মুখটা দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু আশেপাশে শিক্ষক-শিক্ষিকারা এমন ভিড় করে দাঁড়িয়ে যে তার আশা প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছে।
জুঁই হেসে ফিসফিস করে বলল—
– “এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝুলে যাচ্ছিস কেন রে? নাকি নতুন স্যারকেই এখন থেকে ভালো লাগতে শুরু করেছে?”
সোরায়া গম্ভীর মুখে চোখ নামিয়ে ফেলল।
– “চুপ কর…ওইসব কিছু না।”
ঠিক তখনই পেছন থেকে এক গলা ভেসে এলো। কলেজের দপ্তরী, হাতে চাবির রিং আর ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গলাটা খানিকটা কর্কশ—
– “এই মেয়েরা! এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো? যাও, ক্লাসে যাও। টিচার্স রুমের সামনে দাঁড়ানো যাবে না।”
চমকে উঠল দু’জনেই। একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন।
– “আচ্ছা আচ্ছা, যাচ্ছি!” – বলে জুঁই হাত ধরে সোরায়াকে টেনে নিল টিচার্স রুম থেকে দূরে।
দুজনেই দৌড়ে করিডোর পার হয়ে নিজেদের ক্লাসরুমের দিকে ঢুকে পড়ল।
সোরায়ার বুক তখনও ধুকপুক করছে। “মুখটা একটুও দেখতে পেলাম না… কে ছিল সে?”—এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরছিল।

টিচার্স রুমের ভেতর এখনো কোলাহল চলছে। একে একে কলেজের প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকা নতুন প্রফেসরকে ফুলের তোড়া আর আন্তরিক শুভেচ্ছায় বরণ করে নিচ্ছেন। টেবিলের উপর সাজানো খাবার আর ফুল যেন পুরো পরিবেশটাকে উৎসবের আবহে ভরিয়ে তুলেছে।
মাহির সবার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—চোখেমুখে বিনয়ী অথচ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি। তার মুখে লাজুক অথচ আন্তরিক এক হাসি লেগে আছে। যেন সে নিজের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছে—গর্ব, উত্তেজনা আর একটু নার্ভাসনেস।
প্রিন্সিপাল স্যার, পঞ্চাশোর্ধ্ব এক গম্ভীর অথচ স্নেহশীল মানুষ, সামনে এগিয়ে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন—

– “আপনারা সকলে জানেন, আজ আমাদের কলেজে একটি বিশেষ দিন। বহু প্রতীক্ষার পর আমরা একজন মেধাবী বিসিএস ক্যাডার কে প্রফেসর হিসেবে আমাদের দলে পেয়েছি। তিনি আজ থেকে আমাদের কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিচ্ছেন। আমি আশা করি তার জ্ঞান, নিষ্ঠা আর উদ্যম আমাদের শিক্ষার্থীদের এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।”
সবাই হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালেন।
মাহির তখন দু’হাত জোড় করে বিনয়ের সাথে মাথা নত করে বলল—
– “আপনাদের সবার ভালোবাসা আর দোয়ার জন্য ধন্যবাদ। এই দায়িত্ব আমার জন্য অনেক বড় গৌরবের, আমি চেষ্টা করব আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে।”
প্রিন্সিপাল স্যার আবার হাসিমুখে বললেন—

– “ভালো কথা। তবে আজকের কাজ এখানেই শেষ নয়, মাহির সাহেব। নতুন শিক্ষক হিসেবে আপনাকে আমরা শুধু স্বাগতই জানাতে চাই না, বরং আপনাকে এখনই আপনার শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। এই বছর একাদশ শ্রেণীর নবীন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েছে। এখনো তাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠান হয়নি, তবে তারা আপনার ক্লাসের শিক্ষার্থী হবে। আমি চাই তুমি এখনই তাদের সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিন।”
প্রিন্সিপালের কণ্ঠে দৃঢ়তা, কিন্তু চোখেমুখে আন্তরিকতা ঝরে পড়ছে।
মাহির প্রথমে এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়াল, তারপর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে মাথা নাড়ল।

– “জ্বী স্যার, নিশ্চয়ই। আজকের দিনটা আমার কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আমি চাই আমার শিক্ষার্থীদের সাথে এই যাত্রার শুরুটা হোক সুন্দরভাবে। চলুন।”
প্রিন্সিপাল সন্তুষ্টি ভরে মাথা নাড়লেন।
তিনি বললেন—
– “ঠিক আছে, তাহলে আমি-ই আপনাকে তাদের ক্লাসে পৌঁছে দিই। আপনি আজ থেকেই একাদশ শ্রেণীর দায়িত্ব নেবে।”
চারপাশে থাকা শিক্ষক-শিক্ষিকারা তখনো হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন। কেউ কেউ মৃদুস্বরে মন্তব্য করছে—
– “দেখেছো, কী আত্মবিশ্বাসী।”
– “হ্যাঁ, আর খুব ভদ্রও বটে।”

মাহির এইসব কথা শুনে সামান্য লজ্জা পেলেও, ভেতরে ভেতরে বুকটা ভরে উঠল গর্বে। তারপর প্রিন্সিপাল স্যার হাতের ইশারায় তাকে ডাকলেন। দুজনেই ধীরে ধীরে টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে হাঁটা শুরু করলেন।
করিডোর তখনো ভরা হাওয়ায়, জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ভেতরে ঢুকছে। ছাত্রছাত্রীরা এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে, কেউ ক্লাসে যাচ্ছে, কেউবা সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তবে সবার চোখেই কৌতূহল—“নতুন স্যার”কে ঘিরে একটা কানাঘুষো চলছে।
মাহির হাঁটছে প্রিন্সিপালের পাশে, মনটা তার ভীষণ উচ্ছ্বসিত। তার চোখে যেন ভবিষ্যতের স্বপ্নেরা ভাসছে। “আজ থেকেই আমার শিক্ষকতার পথচলা শুরু… আজ থেকেই আমি আমার ছাত্রদের কাছে এক নতুন নাম—একজন শিক্ষক।”
কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা থামল এক দরজার সামনে। দরজার উপরে সাদা বোর্ডে লেখা— “একাদশ শ্রেণি – সেকশন A”।
এটাই সেই ক্লাসরুম, যেখানে বসে আছে সোরায়া আর জুঁইসহ একঝাঁক নতুন ছাত্রছাত্রী।
প্রিন্সিপাল দরজার হাতল স্পর্শ করলেন, মুখে এক আত্মবিশ্বাসী হাসি।

– “চলো মাহির, এখন তোমার নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে প্রথম সাক্ষাৎকার।”
মাহির মাথা নাড়ল, বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ আরও জোরে বাজতে লাগল। সে জানেই না, ভেতরে বসা মেয়েটির চোখ একদিন তাকে রাস্তায় দেখে দিশেহারা হয়েছিল।
আজ সেই মেয়েরই সামনে শিক্ষক হিসেবে প্রবেশ করতে যাচ্ছে সে।
ক্লাসরুমটা ছিল হালকা আলো-অন্ধকারে মোড়ানো। জানালার পর্দা দিয়ে সকালের নরম রোদটা斜কোণে ঢুকে এসে বেঞ্চের উপর সোনালি ছায়া ফেলছিল। ক্লাসের ভেতর একধরনের নতুনত্বের গন্ধ—সবাই একাদশ শ্রেণির নবীন, তাই তাদের চোখেমুখে অজানা উত্তেজনা আর কিছুটা নার্ভাসনেস। কেউ বই খুলে বসে আছে, কেউ সাথীর সাথে ফিসফিস করছে, আবার কেউ নিঃশব্দে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।
সোরায়া সামনে থেকে মাঝামাঝি বেঞ্চে বসে ছিল। তার চুল হালকা খোলা, চোখে সেই স্বাভাবিক কৌতূহল ভরা দৃষ্টি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে এখনো অস্থির—কারণ কিছুক্ষণ আগে টিচার্স রুমের বাইরে যে নতুন মানুষটিকে দেখেছিল পিছন দিক থেকে, তাকে নিয়ে তার মনটা কেমন জানি ধকধক করছে। “কে হতে পারে উনি? কেমন চেহারা? আর কেন জানি মনে হচ্ছে… কোথাও যেন আগে দেখেছি…”

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার বাইরে থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এলো। এক মুহূর্তের মধ্যে পুরো ক্লাস থেমে গেল। কোলাহল স্তব্ধ হয়ে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
দরজা খোলার শব্দ—
ক্যাঁচক্যাঁচ…
প্রথমে ভেতরে ঢুকলেন প্রিন্সিপাল স্যার। তার পাশে, গম্ভীর অথচ প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন মাহির।
সেকেন্ডের ভেতরে সোরায়ার শ্বাস আটকে গেল। চোখ বড় বড় হয়ে স্থির হয়ে রইল দরজার দিকেই। “এ… এ তো সেই মানুষ… সেই ছেলেটা… রাস্তায় প্রথম যাকে দেখেছিলাম… যে আমার চোখে মুহূর্তেই এক মহানায়ক হয়ে উঠেছিল…!”

হৃদপিণ্ডের ধকধক শব্দ যেন বেঞ্চের উপর বাজতে লাগল। হাতে ধরা কলম হঠাৎ করে কাঁপতে লাগল। ঠোঁট শুকিয়ে এলো, আর বুকের ভেতর এক অজানা আলোড়ন উঠল।
তার কানে যেন আর কিছু পৌঁছাচ্ছে না। প্রিন্সিপালের কথা, ক্লাসের নিস্তব্ধতা—সব মিলিয়ে যেন দূরে সরে গেল। শুধু সেই মানুষটার মুখ—অতিস্পষ্ট, জীবন্ত, আর নিখুঁত।
মাহির প্রবেশ করল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, চোখেমুখে মৃদু লাজুক হাসি। প্রিন্সিপাল তাকে পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন—
– “ছাত্রছাত্রীরা, তোমাদের জন্য আজকের দিনটা বিশেষ। তোমাদের নতুন ক্লাস শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে আজ থেকে যোগ দিচ্ছেন মহির স্যার। তিনি একজন বিসিএস ক্যাডার এবং আজ থেকেই তোমাদের শিক্ষা দান করবেন। তোমরা সবাই তাঁকে স্বাগত জানাও।”
একসাথে পুরো ক্লাস হাততালি দিয়ে উঠল।
কিন্তু সোরায়া তখনো শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাততালি দিচ্ছে না, শুধু নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

“এ কীভাবে সম্ভব? উনি… উনিই আমার দেখা সেই জন? আর উনিই আমার নতুন শিক্ষক…!”
তার গাল লাল হয়ে উঠল, বুকের ভেতর হালকা কম্পন। মাথার ভেতর হাজারটা প্রশ্ন— “উনি কি আমায় চিনবেন? আমি কি কেবল ভিড়ের একজন হয়েই থাকব উনার কাছে? নাকি…”
হঠাৎ জুঁই কনুই দিয়ে খোঁচা দিল।

– “এই সোরায়া, কী দেখছিস এভাবে? নতুন স্যার তো হ্যান্ডসাম বটে, তাই না?”
সোরায়া হকচকিয়ে গিয়ে মুখ নিচু করে ফেলল। বুক ধুকপুক করছে, কিন্তু ঠোঁটে আনতে পারল না কোনো কথা।
এদিকে মাহির ক্লাসের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল—
– “আসসালামু আলাইকুম। আমার সম্পূর্ণ নাম স্নিগ্ধ খান মাহির। আজ থেকে তোমাদের ইংরেজি ক্লাস নেব। আশা করি আমরা একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখব।”
তার কণ্ঠস্বর দৃঢ়, অথচ মিষ্টি। প্রতিটি শব্দ যেন সোরায়ার কানে আলাদা করে বাজল। সে অনুভব করল, এই মুহূর্তটা তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের শুরু।
কিন্তু সোরায়ার শরীর তখন ভেতরে ভেতরে কাঁপছে। কলমটা আঙুলে ঘুরছে অস্থিরভাবে, বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে। যাকে রাস্তার পাশে হঠাৎ দেখে আমার হৃদয়টা কেঁপে উঠেছিল… আজ সে-ই আমার শিক্ষক?”
মাথার ভেতর প্রশ্নের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। “আমি কি চোখে চোখ রাখতে পারব? যদি উনি আমার দিকে তাকান?”
মাহিরের হাতে মার্কার, হুয়াইট বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমেই লিখলেন—

“Introduction”
তারপর ছাত্রছাত্রীদের দিকে ফিরে মৃদু হাসি দিয়ে বললেন—
– “তোমরা সবাই নতুন। আমি-ও নতুন। আজকের দিনটা কেবল পড়াশোনা নয়, একে অপরকে জানার জন্যও হবে। সবাই নিজেদের নাম বলবে, কেমন?”
একে একে সবাই দাঁড়িয়ে নাম বলতে শুরু করল।
ঠিক তখন মাহিরের কণ্ঠস্বর বাজল—
– “চলো এবার এই সারি থেকে কে বলবে নাম?”
কাকতালীয়ভাবে তার দৃষ্টি পড়ল সোরায়ার বেঞ্চের দিকে।
সোরায়া হঠাৎ চমকে উঠল। বুকের ভেতর কেঁপে উঠল ঢেউ। সে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
– “ম… আমার নাম জান্নাতুল রহমান সোরায়া।”
কণ্ঠস্বরটা কেঁপে উঠল সামান্য। আশেপাশের বান্ধবীরা হালকা হাসাহাসি করল, আর জুঁই খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বলল—

– “হায়রে, নতুন স্যারের সামনে কেমন কাঁপলি রে! স্যারকে দেখার পর থেকে তোর গলা শুকিয়ে গেছে। কি হয়েছে বলবি?”
সোরায়া মুখটা নিচু করে লজ্জা লুকাতে চেষ্টা করল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানে—এটা লজ্জা নয়, বরং এক অদ্ভুত অস্থিরতা।
সোরায়া আমতা আমতা করে- “তোর মজা সত্যি হয়ে গেছে রে। উনিই আমার রাস্তায় দেখা মানুষ টা।”
জুঁইও সোরায়ার কথায় আশ্চর্য হলো। তার বলা কথা তো মজা ছিল সত্য কিভাবে হলো।
মাহির ভ্রু কুঁচকে খাতায় নাম নোট করলেন, খুব সাধারণ ভঙ্গিতে। কিন্তু সোরায়ার কাছে সেটা যেন এক বিশাল ঘটনা। “উনি আমার নাম লিখলেন…!” এই ভাবনায় তার গাল গরম হয়ে উঠল।
মাহির পরিচয় পর্ব শেষ করে ছাত্রছাত্রীদের বললেন—

– “ঠিক আছে, এবার চলো আমরা পড়ার মাঝে ফিরে যাই।”
সোরায়া নিজের বেঞ্চে বসে চোখে ধীরে ধীরে মাহিরের দিকে তাকাল। স্যার বোর্ডের দিকে হাত ধরে ইংলিশের কিছু বেসিক টার্ম বোঝাচ্ছেন। শব্দগুলো ধ্বনি হয়ে ছড়াচ্ছিল, কিন্তু সোরায়ার কানে যেন আর কিছু ঢুকছে না। টার্মগুলো কি বোঝানো হচ্ছে, সে কিছুই বুঝল না।
ক্লাস চলতে লাগল ধীরে ধীরে। মাহির পড়াচ্ছে সহজ, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে। ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করছেন, উদাহরণ দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে হাসাচ্ছেনও। পুরো ক্লাস উচ্ছ্বসিত।
কিন্তু সোরায়া?
তার চোখ মাঝে মাঝে বোর্ডে, মাঝে মাঝে মাহিরের দিকে। কলম বইয়ে চলে ঠিকই, কিন্তু মনটা অন্যদিকে আটকে আছে।
সে ভেতরে ভেতরে নিজেকে বোঝাতে চাইছে—

“না, এভাবে ভাবা উচিত নয়। উনি আমার শিক্ষক। আমাকে শুধু ছাত্রীর মতো আচরণ করতে হবে। কিন্তু… কেন জানি উনাকে দেখলেই বুকটা কেঁপে ওঠছে?”
জুঁই পাশে বসে খিলখিল করে হাসল, ফিসফিস করে বলল—
– “এই, কানে তুলো দিবি নাকি? নাহলে আজ স্যারের কণ্ঠস্বরেই তুই গলে যাবি।”
সোরায়া চুপ করে শুধু জুঁইকে কনুই দিয়ে ঠেসে দিল। কিন্তু মুখ লাল হয়ে উঠল আরও বেশি।
ক্লাস চলতে চলতে একসময় সোরায়ার চোখ আটকে গেল মাহিরের হাসিতে। বোর্ডে লিখতে লিখতে হঠাৎ করে তিনি শিক্ষার্থীদের একটা ছোট্ট জোক বললেন, আর পুরো ক্লাস হেসে উঠল। সেই মুহূর্তে সোরায়া যেন হারিয়ে গেল—“এই হাসিটাই তো আমাকে প্রথমবার টেনেছিল…”

তার মনে হচ্ছিল, সময় থেমে গেছে। চারপাশে শতজন থাকলেও সে যেন একা—শুধু সে আর মাহির।
কিন্তু সে ফুরফুরে আনন্দে হারিয়ে গেল। চোখে চোখ রেখে স্যারকে দেখছিল—তার চোখের মৃদু হাসি, কানের কাছে হালকা আওয়াজ, কথা বলার ভঙ্গি—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, যেন পুরো দুনিয়ার সব শব্দগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু মাহিরের উপস্থিতি তার চারপাশে ঘুরছে।
সোরায়ার মনে ভেসে উঠল সেই রাস্তার মারামারি, যখন মাহির হঠাৎই প্রতিবাদ করেছিলেন, তীব্র, সাহসী, আর দুঃসাহসিক। সেই দৃশ্যের সঙ্গে মিলিত হলো ক্লাসের হাসিমাখা মাহিরের চেহারা। “এই মানুষটা… তার সাহস, তার শক্তি, আর… তার উপস্থিতি…” ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে তার গালে হালকা লাজের ছোঁয়া।

কিন্তু সেই লাজ এক অদ্ভুত আনন্দের সঙ্গে মিশে গেছে। মনে হলো যেন কেউ তাকে এক অদ্ভুত লটারি টিকিট দিয়েছে। সেই টিকিটে সে জিতেছে, আর জয়ের আনন্দে বুকের ভিতর ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ধুকপুকানি এতটা উচ্ছ্বাসে পরিণত হলো যে মনে হলো, হৃদয়টা বেঞ্চের উপরে নাচছে।
সোরায়ার হাত বেঞ্চের ওপর অচেতনভাবে মেলে, মনে একরকম মুক্তি, একরকম উল্লাস। সে নিজের ধমকানো নিঃশ্বাস শোনতে পেল, এবং সেই নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে ধুকপুকানি আরও উচ্ছ্বাসিত হলো। “এ কি আনন্দ… কি অনুভূতি! কি দারুণ!” মনে হলো এই মুহূর্তেই পৃথিবী শুধু তার জন্য তৈরি হয়েছে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৭

সোরায়ার বুকের ধুকপুকানি আরও তীব্র হলো। মনে হলো, তার হৃদয় বেঞ্চের ওপর এক ছন্দে নাচছে। একরকম উত্তেজনা, আনন্দ, আর মুক্তির মিশ্রণে সে যেন পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করলে, আবার রাস্তার সেই দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে, মাহিরের সাহসী চেহারা, তার শক্তিশালী উপস্থিতি, আর তার হালকা হেসে দেওয়ার মুহূর্তগুলো—সব মিলিয়ে সোরায়ার মনকে এমনভাবে স্পর্শ করল যা আগে কখনো অনুভব হয়নি।
ক্লাস চলতে থাকল, কিন্তু সোরায়ার মন সেই ফুরফুরে আনন্দে ডুবে রইল। মনে হলো, আজকের দিনটা, আজকের মুহূর্তটা, আজকের ক্লাস—সব মিলিয়ে যেন এক অলৌকিক অনুভূতি, যা শুধু তার জন্য তৈরি।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here