আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২২ (২)

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২২ (২)
অরাত্রিকা রহমান

রায়ানের কণ্ঠে ভেসে আসা সেই মগ্ন সুরে মিরায়া শ্বাস আটকে ফেলল। গাড়ির ভেতরে গরম আর ভ্যাপসা হাওয়ায় তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, তবুও সে উত্তর দিতে পারল না। শুধু বুকের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে ধুকপুক করতে লাগল।
রায়ান তার দিকে আরও ঝুঁকে এলো। খুব কাছে, এতটাই কাছে যে মিরায়ার মনে হলো—একটু নড়লেই তাদের দু’জনের ঠোঁট ছুঁয়ে যাবে। গরমে মিরায়ার কপালে কয়েক ফোঁটা ঘাম জমে উঠেছিল, রায়ান হাত বাড়িয়ে সেই ঘাম মুছে দিল আঙুলের ডগায়।
মিরায়া কেঁপে উঠল, চোখ নামিয়ে নিল। কিন্তু রায়ানের গভীর দৃষ্টি তাকে আবার বাধ্য করল তাকাতে। সেই চোখে একসাথে আগুন আর কোমলতা—দু’টোই ঝলকাচ্ছে।

—“রায়ান ভাইয়া…” মিরায়ার কণ্ঠ কাঁপছিল, “প্লিজ, দূরে থাকুন একটু…”
রায়ান রাগি গলায় চেঁচিয়ে গাড়ির ডেস্কে হাত দিয়ে ঘুসি মেরে বলল-
“ওই বেডি, ভাইয়া কারে ডাকিস? ভাতার লাগি আমি তোর। বুঝছিস?”
মিরায়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে রায়ানের দিকে তাকাতেই রায়ান হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলো। যেন নিজেকে মানিয়ে নিলো এই বলে যে তার ছোট্ট বউটা তো তার ব্যাপরে জানে না এই ভেবে।
রায়ান শান্ত হয়ে মৃদু হেসে বলল—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—“দূরে থাকা এখন আর সম্ভব নয়, হৃদপাখি। তুমি কি টের পাচ্ছো না… চারপাশের গরম, এই নিঃশ্বাসের ভেতর মিলেমিশে যাচ্ছে? যতই চেষ্টা করি, তোমাকে থেকে একটুও সরতে পারি না।”
মিরায়া হঠাৎ জানালার বাইরে চোখ নিল, যেন নিজেকে সামলানোর জন্য একটু ফাঁক খুঁজছে। বাইরে শহরের আলো ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরের গরম আবহ আর রায়ানের টান তার সমস্ত স্নায়ুকে অবশ করে তুলছে।
রায়ান আবারও তার হাত চেপে ধরল। এবার মিরায়া হাতটা সরাল না, শুধু নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল। তার ঠোঁট সামান্য কাঁপছিল।
রায়ান মৃদুস্বরে ফিসফিস করে বলল—

—“শোনো… তুমি যতই বলো ভয় পাচ্ছো, আমি ততই দেখি তুমি আমার দিকেই এগিয়ে আসছো। এটা ভয় না, এটা সেই টান—যা থেকে তুমি পালাতে পারছো না।”
গাড়ির ভেতরের বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। ইঞ্জিনের শব্দ যেন অনেক দূরের কিছু। শুধু দু’জনের দম নেওয়ার শব্দ, ঘামের ফোঁটা আর হৃদস্পন্দনের গরম ঢেউ মিলেমিশে এক অদৃশ্য কামনা তৈরি করছিল।
মিরায়া হঠাৎ খুব আস্তে ফিসফিস করে বলল—
—“আমি জানি না… আমি কেন এমন হয়ে যাচ্ছি। এমনটা হওয়া ঠিক নয়।”
রায়ান তার চিবুকে হাত রেখে মুখটা উঁচু করাল। চোখে চোখ রেখে বলল—

—”কজ ইউ আর মাইন, মাই হার্ট-বার্ড। এ্যান্ড ইট’স ফাইন।”
তারপর গাড়ির ভেতরের আলো যেন আরও ম্লান হয়ে গেল, আর তাদের মাঝের দূরত্ব প্রায় শূন্য হয়ে এলো…
গাড়ির ভেতরটা তখনও ঘন গরমে ভরে আছে। বাইরের বাতাস জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে ঠিকই, কিন্তু তার থেকে বের হওয়া উত্তাপ যেন তাদের দু’জনের দেহ থেকে উঠে আসা তাপের সামনে কিছুই না।
রায়ান মিরায়ার হাতের মুঠোটা আরও শক্ত করে ধরল। তার কণ্ঠে নরম অথচ হিংস্র এক সুর—
—“ হৃদপাখি… আমি যতবার তোমার দিকে তাকাই, মনে হয় এই পৃথিবীটা ছোট হয়ে গেছে। তুমি আছো, আমি আছি—বাকি সবকিছু শুধু বিরক্তিকর বাড়তি বোঝা।”
মিরায়া কেঁপে উঠল। সে চোখ নামিয়ে বলল—

—“রায়ান ভাইয়া… দয়া করে… এমন কথা বলবেন না। আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। আমার থেকে দূরে যান প্লিজ।”
রায়ান হেসে তার চিবুক আঙুল দিয়ে উঁচু করল, চোখের দিকে তাকিয়ে বলল—
—“স্বাভাবিক? আমি চাই-ই না তুমি স্বাভাবিক থাকো। আমি চাই তুমি কেঁপে ওঠো, লজ্জা পাও, নিঃশ্বাস আটকে রাখো… ঠিক এইভাবে।”
তার চোখদুটোয় ঝড়ের মতো কামনা। মিরায়ার ঠোঁট সামান্য কাঁপল। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রায়ান ঠোঁটের কোণে এক শয়তানি হাসি টেনে বলল—

—“তুমি জানো, আমার সবথেকে প্রিয় দৃশ্য কী? যখন তোমার গাল লাল হয়ে ওঠে, আর তোমার চোখে একসাথে ভয় আর ইচ্ছে খেলা করে। সেটা দেখলে মনে হয়—আমি তোমাকে জয় করে ফেলেছি। অথচ… তুমি এখনো ভাবছো তুমি পালাতে পারবে।”
মিরায়ার বুক কেঁপে উঠল। সে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু রায়ান আরও কাছে টেনে নিল। তার গলা ঝুঁকে এল মিরায়ার কানে, গরম নিঃশ্বাসে মিরায়ার শরীর শিহরিত হয়ে উঠল।
—“বলো তো… তোমার ঠোঁট কাঁপছে কেন? ভয়ে, না ইচ্ছে করে?”
মিরায়া চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে কোনো উত্তর দিল না। তার নীরবতায় রায়ান আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলো।
—“চুপ থাকলেই কিন্তু প্রমাণ হয়… তুমি আমাকে চাইছো। আর আমি যদি একবার চাই, তবে কেউ আমার থেকে তোমাকে আলাদা করতে পারবে না।”

তারপর হঠাৎই রায়ান এক ঝটকায় মিরায়াকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে নিল। মিরায়া হঠাৎ আক্রমণে মৃদু আওয়াজ করল- “আহ্!”
মিরায়ার শরীর তার বুকের সঙ্গে মিশে গেল, তাদের নিঃশ্বাস এক হয়ে গেল। রায়ানের ঠোঁট ছুঁয়ে গেল মিরায়ার কপালের কোণায়, ধীরে ধীরে নেমে এলো গালের দিকে…
মিরায়া ফিসফিস করে বলল—
—“প্লিজ… রায়ান ভাইয়া… এমন করবেন না…”
রায়ান থামল না। তার ঠোঁটে আরও এক বাঁকা হাসি—

—“তুমি যতবার ‘না’ বলো, ততবার আমার মনে হয় তুমি আসলে আমাকে ‘আরো কাছে এসো’ বলছো।”
তার কণ্ঠে এমন এক দম্ভ, এমন এক আবেগ—যা শুনে মিরায়ার বুকের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে কাঁপতে লাগল।
গাড়ির ভেতরে নীরবতা আরও ঘন হয়ে উঠল। জানালা দিয়ে ঢুকছে গরম বাতাস, কিন্তু তবুও মিরায়ার শরীরে ছড়িয়ে পড়া কাঁপনটা কেবলমাত্র রায়ানের কাছাকাছি থাকার জন্যই।
রায়ান তার চিবুকের নিচে আঙুল রেখে আলতো করে মাথাটা ঘুরিয়ে নিজের দিকে তাকাতে বাধ্য করল। চোখে চোখ পড়তেই মিরায়ার নিঃশ্বাস যেন গলা আটকে গেল।
রায়ান নরম গলায় ফিসফিস করে বলল—
—“ তোমার ব্রাউন চোখদুটো আমার জন্য সবচেয়ে বড় ফাঁদ? যতবার তাকাই, ততবার ডুবে যাই। আর ডুবলে… বের হতে ইচ্ছেই করে না।”

মিরায়া গলা শুকিয়ে হালকা স্বরে বলল—
—“আপনি… এভাবে তাকাবেন না প্লিজ…ছেড়ে দিন আমাকে।”
রায়ান ঠোঁটের কোণে সেই দুষ্টু হাসিটা টেনে আনল—
—“আমি তাকাচ্ছি না হৃদপাখি… তোমাকে ছিঁড়ে খাচ্ছি চোখ দিয়ে। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, এখন তোমার কাছাকাছি বসে আমি কীভাবে নিজেকে ধরে রেখেছি।”
তার হাত ধীরে ধীরে মিরায়ার আঙুলের গায়ে বুলিয়ে গেল। মিরায়া শিরশির করে উঠল, হাত সরাতে চাইল, কিন্তু রায়ান শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।

—“তুমি কাঁপছো কেন, হুঁ? আমি তো কিছুই করিনি এখনো।”
মিরায়া মুখ নামিয়ে ফেলল। ঠোঁট কাঁপছে, চোখে জল জমে উঠছে।
রায়ান আরও কাছে ঝুঁকল। গরম নিঃশ্বাস সরাসরি মিরায়ার গালে লাগল। সে প্রায় ফিসফিস করে বলল—
—“বলো তো… যদি আমি এখনই তোমার ঠোঁট ছুঁই… তুমি কি থামাতে পারবে আমাকে?”
মিরায়ার বুক ধুকপুক করে উঠল। তার ঠোঁট সামান্য খুলে গেল, কিন্তু কথা বেরোল না। তার হাত আলতো করে মিরায়ার গালের পাশে উঠে গেল, তারপর কানের পেছন দিয়ে চুল সরিয়ে দিল। মিরায়ার শরীর শিহরিত হয়ে উঠল।
সে চোখ বন্ধ করল, যেন নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। কিন্তু রায়ান আবার ফিসফিস করল—

—“চোখ খোলো হৃদপাখি… আমি চাই তুমি আমার প্রতিটা দৃষ্টি অনুভব করো। আমি চাই তুমি জানো, আমি তোমাকে শুধু চাই না… আমি তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাস দখল করতে চাই।”
মিরায়া আস্তে আস্তে চোখ তুলল। চোখ ভরা ভয়, লজ্জা আর অদ্ভুত এক টান। রায়ানের ঠোঁট তখন তার ঠোঁট থেকে কয়েক ইঞ্চির দূরত্বে…
রায়ানের ঠোঁট যখন মিরায়ার ঠোঁটের এতটা কাছে, তখন পুরো গাড়িটার বাতাস যেন ঘন হয়ে এলো। বাইরের গরম বাতাস, ভেতরের দমবন্ধ করা উত্তেজনা—সবকিছু একসাথে মিলেমিশে এক অদ্ভুত কামনাময় আবহ তৈরি করল।
মিরায়ার হাত তখনো রায়ানের কোর্ট আঁকড়ে আছে, যেন নিজেকে সামলানোর একমাত্র ভরসা। রায়ান তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল—

—“হৃদপাখি… আমি এই দূরত্বটা সহ্য করতে পারছি না। তুমি এক নিঃশ্বাস দূরে, অথচ আমার মনে হচ্ছে হাজার মাইল।”
মিরায়া কাঁপা গলায় উত্তর দিল—
—“আপনি… আপনি প্লিজ এমন করবেন না…”
রায়ান হাসল। ঠোঁটের কোণে এক দুষ্টু খেলা—
—” করলে? হুঁ? এমন না করলে এই আগুন কে নিভাবে বলো তো? আমি না তুমি?”
মিরায়া চোখ নামিয়ে ফেলল। ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে গেল, কিন্তু কথা বেরোল না।
রায়ান আবার তার কানে ঝুঁকে বলল—

—“আমি তোমার চোখে সেই উত্তর দেখেছি, যা মুখে বলার সাহস পাচ্ছো না। তুমি না চাইলে আমার হাতটা সরিয়ে দিতে পারো। কিন্তু তুমি দিচ্ছো না… বরং আমার আগুনে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছো।”
তার আঙুল মিরায়ার থুতনির নিচে গিয়ে নরমভাবে মুখটা আবার নিজের দিকে তুলল।
এবার তাদের চোখে চোখ আটকাল।
মিরায়ার চোখে ভয়, লজ্জা, আর এক অজানা স্বীকারোক্তি।
রায়ানের চোখে শুধু একটাই শব্দ—“অধিকার।”
তারপর রায়ান ঠোঁট প্রায় ছুঁয়ে দেওয়ার মতো ঝুঁকলো…

রায়ান একপ্রকার মগ্ন, উন্মত্ত দৃষ্টিতে মিরায়ার চোখে চোখ রেখেছে। তার হাত নরমভাবে মিরায়ার গাল, চুল, ঘাড়- স্পর্শ করছে। নিঃশ্বাসে ভরা গরম বাতাসে মিরায়ার বুকও যেন আরও দ্রুত ধুকপুক করতে লাগল।
রায়ান হঠাৎ আরও কাছে ঝুঁকে আসে, তার ঠোঁট প্রায় মিরায়ার ঠোঁটের সাথে ছুঁই ছুঁই। মিরায়ার চোখ বন্ধ, শরীর কেঁপে উঠছে, নিঃশ্বাস বাঁধা। সে মনে মনে ভাবছে—
“না… না… না… এটা ঠিক নয়… আমি এমন কিছু করতে পারি না… এটা ভুল… আমি… আমি ঠিক করছি না…”
তার ভেতরের দ্বন্দ্ব তার গলায় শব্দ হয়ে বের হচ্ছিল। সে হালকা কণ্ঠে বলল—
—“না… না… না… এটা ঠিক নয়… আমি এমন কিছু করবো না… এটা ঠিক নয়…”
কিন্তু রায়ান, নির্বোধভাবে মৃদু হাসি টেনে ফিসফিস করে বলল—

—“হৃদপাখি… শুধু চোখ বন্ধ করো… আর সব আমার উপর ছেড়ে দাও।”
মিরায়ার মন ভাঙছে, শরীর কাঁপছে, কিন্তু হঠাৎই সে নিজের ভেতরের শক্তি খুঁজে পায়। মিরায়া নিজের আবেগ সামলে চোখ খুলে রায়ানের দিকে তাকিয়ে সে হালকা কিন্তু দৃঢ়ভাবে তার হাত রায়ানের ঠোঁট দুটোর উপর রেখে রায়ানকে থামিয়ে দেয়।
রায়ান মিরায়ার স্পর্শে চোখ খুলে হকচকিয়ে বলে-
“এনি প্রবলেম হার্ট-বার্ড? আর ইউ ফিলিং আনকমফোর্টেবল? লেট’স গো টু দ্যা বেক সিট।”
মিরায়া দৃঢ় কন্ঠে বলল-

—“না… রায়ান ভাইয়া… আপনি… এটা করতে পারেন না… এইভাবে… থামুন… আমি চাই না…”
রায়ান কিছুটা স্তম্ভিত, কিন্তু এখনও তার চোখে আগুন জ্বলছে। সে তার হাত ধীরে সরিয়ে রাখে, কিন্তু স্পর্শের আভা এখনও বাকি। মিরায়া নিজের শ্বাস সামলানোর চেষ্টা করছে। তার চোখে ভয়, লজ্জা, কিন্তু সেই সঙ্গে এক অদ্ভুত শক্তি—নিজেকে রক্ষা করার সাহস।
রায়ানের পক্ষে এই মুহূর্তে নিজেকে সামলানো একদম কষ্টকর হয়ে উঠল। তার হাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিরায়ার দিকে বাড়ছিল, যেন নিজের ইচ্ছা নয়, হৃদয়ই তাকে টেনে আনছিল।রায়ান আবার মিরায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে মিরায়াকে নিজের কাছে আনতে যাবে। এমন সময় মিরায়া জোরে বলে উঠল-
“আমি একজন বিবাহিতা মেয়ে, রায়ান ভাইয়া।”

চৌধুরী বাড়ি~
সন্ধ্যার আলো মৃদু হলুদাভে ছড়িয়ে পড়ছে চৌধুরী বাড়ির চওড়া প্রাঙ্গণে। মূল দরজা দিয়ে হঠাৎ এক বিশাল, চকচকে কালো মার্সিডিজ ঢুকল, ইঞ্জিনের হালকা গুঞ্জন আর হেডলাইটের উষ্ণ আভা পুরো প্রবেশদ্বারকে আলোকিত করল। গাড়িতে ছিলেন “চৌধুরী গ্রুপ অফ কোম্পানির” মালিক, রায়হান চৌধুরী (রায়ানের বাবা)।
গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গেই রায়হান সাহেবের ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে তার দরজা খুলে দিলেন। রায়হান চৌধুরী দায়ী থেকে নামতেই হাত দিয়ে স্যুটের কাঠামো ঠিকঠাক করে নিলেন। তার পোশাক নিখুঁত, কটন এবং উল মিশ্রিত স্যুটে সূক্ষ্ম ভাঁজ, নরম নীল শার্ট, হাতের কব্জিতে চকচকে ঘড়ি—সবকিছুই তার ব্যক্তিত্বকে আরও প্রভাবশালীভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তার চুল নিখুঁতভাবে সেট করা, গায়ের ভঙ্গিমা স্বাভাবিক অথচ অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। বলা বাহুল্য রায়ানের ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ তার বাবার ধাঁচে গড়া।

প্রবেশদ্বারের দিকে হেঁটে রায়হান চৌধুরী এগিয়ে এলেন, তখন চৌধুরী বাড়ির মূল দরজা ইতিমধ্যেই খোলা ছিল এবং রামিলা চৌধুরী ও দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন যেন স্বামীর উপস্থিতি তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন।
চৌধুরী বাড়ির দরজা বড়, লালচে কাঠের, সূক্ষ্ম কারুকার্যে অলঙ্কৃত। ফ্লোরে চকচকে মার্বেলের প্রতিফলন রায়হানের স্যুটে ধরা পড়ছে। দরজার পাশে লাগানো ল্যাম্পগুলো নরম সোনালী আলো ছড়াচ্ছে, যেন প্রতিটি পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছে।

রায়হান চৌধুরী ধীরে ধীরে প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশ করলেন বাড়ির ভেতর। তার কাঁধে ভাঁজ করা স্যুটের লাইন এবং তার আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিমা একত্রে প্রকাশ করছে—একজন শক্তিশালী ব্যবসায়ী, যার উপস্থিতি নিজেই চারপাশকে আকর্ষণ করছে। তার চোখে এক ক্ষুদ্র উজ্জ্বলতা, যা মনে করিয়ে দিচ্ছে—দেশের ব্যস্ততার পরও এখন সে বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি অনুভব করছে।—সব মিলিয়ে এক প্রকার রাজকীয় স্বাগতম তৈরি হয়েছে।
দরজার পাশে রামিলা চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিলেন। রায়হান চৌধুরী ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন।
রামিলা দরজার পাশে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রায়হানের দিকে তাকালেন।

—“দু’দিন পর মহারাজের বাড়ি ফেরা হলো তবে।”
রায়হান চৌধুরী মুচকি হেঁসে রামিলা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন-
-“কাজ ছিল মহারানি। চাইলেই কি আর কাজকে না বলা যায়?”
রামিলা চৌধুরী তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন-
-“এক জীবন পার হয়ে যাচ্ছে আপনার কাজের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে।”
রামিলা চৌধুরী রায়হান চৌধুরীর কাছে এসে তার কোর্ট টা খুলে দিতে দিতে বলল-
-“যাই হোক , এবার বলুন সব কাজ ঠিক মতো সম্পন্ন হয়েছে তো?”
রায়হান চৌধুরী ও রামিলা চৌধুরীকে কোর্ট টা খুলতে সাহায্য করতে করতে হেঁসে বললেন –
-“তোমার মহারাজের কাজ কখনো অসম্পন্ন রয়েছে মহারানি?”
রামিলা চৌধুরী কোর্ট টা হাতের মাঝে রেখে,
-“তা অবশ্য হয়নি কখনো। আপনার শরীর কেমন আছে? কিছু খেয়েছেন কি?”—শান্ত, মার্জিত স্বরে রামিলা জিজ্ঞেস করলেন।
রায়হান হালকা হেসে উত্তর দিলেন—

—“খাবার? না গো মহারানি, তুমি না থাকায় খাওয়ার তেমন মনই হয়নি। দুই দিন কাজের মধ্যে ব্যস্ত থেকেও শুধু তোমার কথা মনে পড়েছে।”
রামিলা হালকা হেসে বললেন—
—“আহা, সেই অর্থে আপনি আমার দু’দিনের অভাব অনুভব করে বুঝি ফিরে এলেন?”
রায়হান খানিকটা হেঁয়ালি স্বরে বুকে হাত রেখে বললেন—
—“হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছো। তোমার সঙ্গে থাকার জন্যই আমার আজকের দিনের কাজ শেষে ফিরে আসার আগ্রহ ছিল। দু’দিন তোমাকে না পেয়ে এই মনের বাড়ি কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।”
রামিলা তার হাতে কোর্ট রেখে অন্য হাতে রায়হান চৌধুরীর হাতে ব্যাগটা নিয়ে হাত বাড়িয়ে-

—“তা এখন তো বাড়ি ফিরেছেন, এখন কেমন লাগছে? ক্লান্ত লাগছে তো? একটু বসেন আমি শরবত করে আনি।”
রায়হান ব্যাগ ঝুলতে থাকা হাত টা রামিলা চৌধুরীর হাতের নাগালে থেকে সড়িয়ে হালকা হেসে বললেন—
—“বসার আগে একটু তোমার হাসি দেখে নিই। এটা আমার দিনের ক্লান্তি দূর করে দেয়, আর তোমার চোখে সেই কোমলতা—দু’দিনের দূরত্বের সব কষ্ট যেন মুছে যায়। ওইসব শরবতের আমার কোনো দরকার নেই।”
রামিলা হালকা হাসি দিয়ে বললেন—
—“দূরত্ব দূর হলো, কিন্তু তোমার এই ছোট্ট মিষ্টি মন্তব্যগুলোই আমাকে সব সময় আনন্দ দেয়।”
রায়হান ধীরে ধীরে রামিলার দিকে তাকালেন, চোখে স্নেহ আর ভালোবাসার ঝলক—
—“এই দু’দিন তোমাকে খুব মিস করেছি আমার মহারানি। এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে ও শান্তি লাগছে। শুধু তোমার সঙ্গে এই শান্ত মুহূর্তই যথেষ্ট।”
রামিলা হালকা হেসে বললেন,

—“ইস্! এতো বড়ো বড়ো দুই ছেলের বাপ হয়েছেন সামান্য মার্জিত হন। লোকে শুনলে কি বলবে। আর কিছু দিন পর ছেলেদের বউ বাড়িতে আসবে।”
রায়হান চৌধুরী রামিলা চৌধুরীর কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দিয়ে বললেন-
“লোকে মন্দ বলবে কেন শুনি, আমি আমার বউকে যা ইচ্ছা বলব। তবে সত্যি খিদে পেয়েছে গো মহারানি।”
রামিলা চৌধুরী হেঁসে বললেন –
“আপনি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি খেতে দিচ্ছি।”
এর পর দুজনেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।

গাড়ির ভেতর~
রায়ানের চারপাশের সময় যেন এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। তার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকারে ডুবে গেলো। মিরায়ার সেই কথা—‘বিবাহিতা’—তার মনের সমস্ত পরিকল্পনা, প্রত্যাশা, আবেগ এক মুহূর্তে ভেঙে পড়ল। তার শরীর স্থির, হৃদয় গাঢ় হতাশায় নড়াচড়া করতে পারছিল না। সবকিছু যেন বোঝার বাইরে চলে গেছে।
মিরায়া হালকা কাঁপা গলায় আর কিছু বলার চেষ্টা বা প্রয়োজন বোধ করল না। তার চোখে জল জমে উঠল, এবং নিঃশব্দে সে রায়ানের কোল থেকে নেমে নিজে নিজের সিটে ফিরে গেল, বাইরে তাকিয়ে বসলো পরিহিত পোশাক ঠিক করে।

জানালার বাইরে শহরের আলো ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মিরায়ার চোখ থেকে নেমে আসা অঝরে কান্নার স্রোত যেন তার অন্তরের অশান্তি ফুটিয়ে তুলছে। প্রতিটি ফোঁটা যেন তার বিবাহিত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দুশ্চিন্তা, অদৃশ্য আবেগ আর লুকানো গল্পের কথা খুলে বলছে।
রায়ানের মন তখন নীরব—কিন্তু তার ভেতরে হাজারটা প্রশ্ন জাগছে। বিবাহিত? তাহলে কি আমার কথা সে আমার কথা জানে? নাকি আমার ব্যাপারে কিছু জানে না বরং অন্য কাউকে বিয়ে করেছে? আমার স্ত্রী অজান্তেই কি অন্য কাউকে বিয়ে করেছে? এই পরিস্থিতি এতই অপ্রত্যাশিত, এতই অবিশ্বাস্য যে রায়ানের চোখে এক অদ্ভুত ভয় ও হতবাক অবস্থা ভেসে উঠল।

সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু শব্দ যেন তার গলার গহ্বরেই আটকে রয়ে গেল। শুধু তার চোখ, মুখের অভিব্যক্তি এবং শান্ত-অশান্ত ভাবের মাঝে মিলেমিশে থাকা হতাশা, বিস্ময় আর কষ্ট—সবই মিরায়ার পাশে স্থির হয়ে রয়ে গেল।
বাহিরের বাতাস হালকা, কিন্তু রায়ানের ভেতরের তুফান থামছে না। মিরায়ার কান্না, তার নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা, আর সেই অপ্রত্যাশিত সত্য—সব মিলিয়ে রায়ানের মনকে জর্জরিত করে তুলল।
রায়ানের চোখে অদ্ভুত উত্তেজনা মিশ্রিত রাগের ঝলক। মিরায়ার “আমি বিবাহিতা” কথাটা তার কানে পড়তেই মনে হলো- তার বউ হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। যেসব মুহূর্ত তারা একসাথে ভাগ করেছিল, সেই সব স্মৃতি হঠাৎ যেন ধোঁয়াশায় মিলিয়ে গেল। রায়ান কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল, নিঃশ্বাস ঝরে পড়ছে, চোখে রাগ আর অপ্রকাশিত হতাশা।

হঠাৎ সে গাড়ির স্টেয়ারিং ধরলো রাগে। গাড়ি চালানো শুরু করলো—গাড়ি জীবনধারার মতো সজীব হয়ে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। হেডলাইটের আলো রাস্তার দিক দিয়ে ঝলমল করছে, কিন্তু রায়ানের চোখে সব অন্ধকার। মিরায়া পাশে বসে চমকে তাকালো।
—“রায়ান ভাইয়া… প্লিজ… আস্তে চালান… আমার ভয় হচ্ছে…”—মিরায়ার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, চোখে অঝরে জল।
কিন্তু রায়ান কোনো কথা শুনল না। তার চোখে রাগের অগ্নি, হাতের প্রত্যেকটি মুভমেন্ট—হ্যান্ড ব্রেক, স্টিয়ারিং, গিয়ার চেঞ্জ—সবই প্রকাশ করছে তার উত্তেজনা। গাড়ি দ্রুত বয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় হালকা বাতাস, হেডলাইটের প্রতিফলন, আর বাইরের অন্ধকার যেন তার রাগের প্রতিচ্ছবি।

মিরায়া আরও জোরে কেঁদে উঠল। তার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে, হাতগুলো হালকা কম্পিত। কিন্তু রায়ান কোনো পাত্তা দিচ্ছে না, তার মন শুধু এই রাগে এবং হতাশায় আটকে। মনে হচ্ছে, পৃথিবী যেন তার উপর ভেঙে পড়ছে—নিজের বউ, যার জন্য সে জীবন উৎসর্গ করতে রাজি, তাকে কোনো পুরুষ পেয়েছে।
রায়ানের চোখে রক্তাভ উজ্জ্বলতা, মুভমেন্টে শক্তি আর ক্রোধের ছাপ। সে নিজের হৃদপাখি সম্পর্কে শত শত প্রশ্নের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে—বিবাহিত? অন্য কারও সঙ্গে? কেন আমাকে বলল না? কেন লুকিয়ে রাখল? প্রতিটি প্রশ্ন তার রাগকে আরও উস্কে দিচ্ছে।

মিরায়া ছোট্ট কণ্ঠে চিৎকার করছে—“রায়ান ভাইয়া, প্লিজ! আস্তে!—আমার ভয় করছে।”
কিন্তু রায়ানের হৃদয় যেন পাথর হয়ে গেছে। তার প্রতিটি নড়াচড়া, প্রতিটি ব্রেকের শব্দ, প্রতিটি হ্যান্ড শিফট—সবই রাগের এক অদ্ভুত প্রকাশ।
গাড়ি রাস্তার বাঁকে হঠাৎ মোড় নিল, বাতাসের সঙ্গে মিরায়ার চিৎকার মিলিত হলো। রায়ানের চোখে রাগ আর আবেগের এমন এক মিশ্রণ, যা কেবল তার হৃদপাখি ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না। মনে হচ্ছে, পৃথিবী থেমে গেছে, শুধু দুজন এবং একটি ঝড়—রায়ানের হৃদয়ের ঝড়।
মিরায়া নিজের হাত দুটো দিয়ে তার পোশাক খামচে ধরে আছে, চোখ বন্ধ, কিন্তু অন্তর গভীরে রায়ানের রাগের তেজে কেঁপে উঠছে। সে বুঝছে, রায়ানের রাগের কারণ শুধু তার বিবাহিত হওয়া নয়, তার মধ্যে আছে ভালোবাসা, টান, হতাশা—সব মিলিয়ে এক বিস্ফোরণ।

রায়ান, চোখে রক্তাভ জ্বলন, নিজের অস্তিত্বকে রাস্তায় ছুড়ে দিচ্ছে। হাতগুলো যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেছে—স্টিয়ারিং ধরে শক্ত করে টানছে, গিয়ার বদলাচ্ছে হঠাৎ, ব্রেক চাপছে ঝকঝক করে। মনে হচ্ছে, তার রাগ, তার যন্ত্রণার শব্দ, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি নড়াচড়া, সবই মিরায়ার কাছে পৌঁছাচ্ছে, যেন তার হৃদয়কে চূর্ণ করে দিচ্ছে।
মিরায়া আবার কাঁদতে কাঁদতে ফিসফিস করে বলল—“রায়ান ভাইয়া…দয়া করে আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন…আমি আর আপনার কাছে আসবো না…কিন্তু প্লিজ… আস্তে চালান…আমার ভয় করছে…”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২২

কিন্তু রায়ান শুধুই সামনে তাকিয়ে আছে। তার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু একই সঙ্গে মিরায়ার প্রতি টান আর ভালোবাসা তাকে আরও রোমহর্ষকভাবে এই মুহূর্তে আটকে রেখেছে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here