আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৫
অরাত্রিকা রহমান
মাস্টার বেডরুম~
রায়হান চৌধুরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছেলের মুখে দৃষ্টি রাখলেন। রায়ানের চোখে অবিচল এক আগুন, শান্ত অথচ তীব্র।
রামিলা চৌধুরী পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, মুখে অবিশ্বাস আর বিরক্তি মেশানো কঠোরতা। ছেলে এমন নির্লজ্জ হয়ে গেছে যে বাবা মা তোয়াক্কা করে না- এইটা ভেবেই তিনি অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছেন।
রায়হান চৌধুরী কঠোর গলায় রায়ানকে প্রশ্ন করেন-
“মিরাকে নিয়ে এখন পর্যন্ত বাইরে কেন ছিলে তুমি? নিজ ইচ্ছায় তোমার সাথে যাবে এমন মেয়ে মিরা নয়। তাহলে?
রায়ান হালকা নরম তবে দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিল-
“আমার বউকে নিয়ে আমি বাইরে থাকতেই পারি। এর জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন মনে করছি না, বউয়েরও না। তাই জোর করেই নিয়ে গেছি।”
রায়হান চৌধুরী চেঁচিয়ে উঠলেন রায়ানের উপর-
“রায়ান তুমি চাইছো টা কি? এগুলো কি ধরনের কথা? মিরাকে তুমি নিজে ডিভোর্স দিতে চেয়েছো। তোমার আম্মু তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলে তাকে নিজেই বরাবর চুপ করিয়েছ। এখন এসবের মানে কি?”
রায়ান প্রশ্নের বিরক্তিতে নিজের চুল ঝাঁকড়াল যেন আগের নিজের বলা সব কথা আজ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে।
রামিলা চৌধুরী ভাঙা কণ্ঠে বললেন—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“রায়ান এখন উল্টো কথা বললে তোর খালামণি-খালুর কাছে আমরা কি মুখ দেখাবো? আমরা তো বলেছি সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। শফিক ভাই আর রোকেয়াও রাজি হয়েছেন। কি বলবো তাদের, যে ছেলের মনের বদল ঘটেছে এখন বউ লাগবে তার?”
রায়ান গম্ভীর মুখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল—
“আম্মু, খালামণি-খালুর সাথে তোমাদের আর কোনো কথা বলতে হবে না। আমার বউয়ের দায়িত্ব, আর এই সম্পর্কের দায়িত্ব—সব আমার। আমার বউকে পেতে যা করার আমিই করব। তোমরা সরে যেতে পারো। আমি একাই সামলে নেব আমার বউকেও, পরিস্থিতিকেও। খালামণি আর খালুর সাথে আমি দেখা করব। তবে কিছু দিন পরে আগে এই দিকটা সামলে নেই।”
রামিলা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
“মানে? তুই বুঝছিস কি বলছিস, রায়ান? এত বড় সিদ্ধান্ত…যেই তুই কিনা মিরাকে বউ হিসেবে কখনো স্বীকৃতিই দিস নি এখন বলছিস ওকে পেতে সব করবি। এমন মন পরিবর্তন কারী ছেলের কাছে কেউ মেয়ে দিতে চাইবে না!”
রায়ান কথা কেটে দিল দৃঢ় স্বরে—
“আম্মু, সিদ্ধান্ত একটাই। আমি মিরাকে ছাড়ছি না। কেউ চাইলো বা না চাইলো আমার তাতে কিছু যায় আসে না। ওকে আমার হয়েই থাকতে হবে ওর মৃত্যু পর্যন্ত। আমার বউকে নিয়ে আর কারো বিচার বা অনুমতির প্রয়োজন নেই। আমি যা চাই, সেটাই হবে।”
রায়হান চৌধুরী গভীর দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। তার মাথায় ধোরছে না তার কি বলা উচিত। রায়হান চৌধুরী নিজের স্ত্রীর উদ্দ্যেশে বললেন-
“রামিলা তোমার ছেলে নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে । ওকে মনে করিয়ে দাউ এই রুমে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দুটো তার বাবা-মা। নূন্যতম লজ্জা থাকলে এইভাবে কথা বলতে না করো। তখন থেকে আমার বউ, আমার বউ করছে।”
রায়ান তার বাবার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করে-
“তুমি আম্মু কে কি বলতে বলছো আবার, নিজেও তো বিজনেস সাইটের কাজ শেষ হলে আম্মুর কাছে আসো প্রথমে। আমি বউ, বউ করলেই নির্লজ্জ হয়ে গেলাম? আমার ও কাজ থাকে, হাজারো টেনশন থাকে আমারও তাই বউ লাগবে। এটাই শেষ কথা।”
রায়হান চৌধুরীর চোয়াল ফাঁকা হয়ে হা হয়ে রইল আর অন্যদিকে মা-রামিলা চৌধুরী কি ভাবে এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামলাবেন তার আগা মাথা খুজে পাচ্ছেন না।
তবুও বাবা-ছেলের এসব কাহিনী দেখে তিনি বলতে লাগলেন –
“কি হচ্ছে টা কি রায়ান। নিজের আবেগ আর মুখ সামলাও। সবকিছুর একটা সীমা থাকে। তোমার আব্বুর সাথে কথা বলছো তুমি ভুলে যেও না।”
রায়ান হঠাৎই যেন ফিরে এলো এক অন্য জগৎ থেকে। কি বলছে, কাকে বলছে কোনো জ্ঞানই যেন তার কাজ করছে না। তাই রায়ান একদম চুপ করে গিয়ে নজর এড়ালো।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর হালকা শান্ত হয়ে মাথা নাড়লেন রায়হান চৌধুরী-
“তুমি অনেক বদলেছ, রায়ান। আগের সেই পালিয়ে বেড়ানো ছেলেটা আজকে নিজের বউয়ের জন্য যুদ্ধ করতে দাঁড়িয়েছে। ঠিক আছে… যদি সত্যিই এ সিদ্ধান্তে অটল থাকো, তবে দায়িত্বটাও তোমাকে একাই নিতে হবে। আমি আর তোমার আম্মু শুরু থেকেই মিরাকে বাড়ির বউমা না মেনে মেয়ে মেনে এসেছি। সুতরাং, ওর জন্য কোনো প্রকার দ্বিধা আমাদের মনে নেই তবে। তোমার খালা মণি আর খালু হয়তো মানবেন না। তাদের তোমার উপর অনেক রাগ এখনো রয়েছে। থাকাটা স্বাভাবিকও।”
রায়ান দৃঢ় গলায় উত্তর দিল—
“দায়িত্ব আমি নিতে পারব। যে কোনো মূল্যে আমার হৃদপাখি আমার পাশে থাকলেই যথেষ্ট। আর না থাকলেও কিছু যায় আসে না জোর করে রাখবো । আর খালামনি আর খালুর ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও।”
রামিলা চৌধুরীর বুকের ভেতর ঝড় উঠলেও, ছেলের চোখে এমন দৃঢ়তা দেখে তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না।
রায়হান ধীরে ধীরে জানালার পাশে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে রাতের অন্ধকার, আর ভেতরে রায়ানের কণ্ঠের দৃঢ়তা যেন ঘরটা ভরে দিল।
“ঠিক আছে, তবে মনে রাখো রায়ান… একবার যদি মিরার হাত ধরো, তাহলে ছাড়তে পারবে না। এই সিদ্ধান্তের পর কোনো মন বদলের ব্যবস্থা থাকবে না। তাকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে সারা জীবনের জন্য।”
রায়ান শান্ত গলায় উত্তর দিল—
“ওর হাত ছাড়ে দেওয়া একটু বেশি বেশি, আব্বু। আমি ওর একটা চুলও নিজের আয়ত্তের বাইরে রাখবো না, ও পুরোটই আমার হয়ে থাকবে। ও আমার, আমার জীবনের অংশ। ওর সঙ্গ এই পৃথিবীতে আমার কবর পর্যন্ত আর আখিরাতে চিরকালের হবে।”
রায়ান চোখে অদম্য দৃঢ়তা দেখিয়ে কথা বলতে থাকলো-
“আমার বউ যেভাবে হোক, আমার বউই থাকবে। নিজের শেষ নিঃশ্বাস থাকা অব্দি ওকে নিজের করে রাখার দায়িত্ব আমার। তোমরা শুধু রাজি হয়ে যাও।”
ঘরে মুহূর্তের জন্য এক ধরনের ভারী নীরবতা নেমে এল। যেন পুরো ঘরটাই নতুন করে সাক্ষী হচ্ছে এক সম্পর্কের গভীরতার—যা আগে ছিল শুধু অনস্বীকার্য নাম, আর এখন হলো দৃঢ় ঘোষণার সত্য।
তবে রায়ান তার বাবা-মায়ের দিক থেকে সম্মতি পেয়ে আনন্দিত ছিল এবার তার ভাবনা কেবল – তার বউ আর খালা-খালু কে নিয়ে। তবে তার চোখে মুখে সেই অদৃশ্য আত্মচেতনা আছে যা তার লক্ষ্যকে তার কাছে ঠিক এনে দেবে বলে তার বিশ্বাস।
ড্রয়িং রুমে ~
রুমের দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিরায়া, রুদ্র এবং সোরায়া কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রুমের বাতাস নীরব, কিন্তু সেই নীরবতার ভেতর যেন উত্তেজনার ঢেউ বয়ে চলছিল।
সোরায়া, বসে থাকা অবস্থায় হঠাৎ চোয়ালে হাত দিয়ে রুদ্ধশ্বাস হাসি লুকিয়ে, চোখে কৌতূহল জ্বালিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল—
“আপু… আজকে… তুমি আর রায়ান ভাইয়া… কি… কি করছিলে এতক্ষণ? একসাথে কি কোথাও গিয়েছিলে? তুমি ক্যাম্পাস থেকে একবারে চলে গিয়েছিলে বুঝি? রায়ান ভাইয়া তোমাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিল? তুমি ঠিক আছো?”
মিরায়া চোখে সামান্য অবাকির ঝলক নিয়ে মাথা নাড়ল। তার গলা কিছুটা কেঁপে উঠল, আর মুখে হালকা লালচে রঙ ভেসে এল। সে হালকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল—
“হ্যাঁ… ঠিক আছি, গিয়েছিলাম কোথাও একটা… কিন্তু সেটা… আর বলতে চাই না। আজকের দিনটা… সকাল থেকে শুরু করে সবকিছুই… খুব… নাটকীয় ছিল।”
সোরায়া কপাল একটু কুঁচকে হেসে বলল,
“হাহ! এতগুলো প্রশ্ন করলাম আর সবগুলোর উত্তর শুধু হ্যাঁ!”
মাঝখান থেকে রুদ্র, দাঁড়িয়ে সামান্য হেসে চোখে শান্তি রেখে, সোফায় বসা সোরায়ার দিকে তাকাল।
“আহ্, সোরা, সারাদিনে অনেক ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরল, আর তুই এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করছিস কেন? সারাদিন যা হওয়ার হয়ে গেছে আর বলে লাভ নাই। একটু সময় দে, নিঃশ্বাস নিক। পরে সব জিজ্ঞেস করিস, তখন ও সব বলে দেবে।”
সোরায়া রুদ্রর অদ্ভুত কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য মিরায়ার দিকে তাকিয়ে ভাবল—”কিছু কি হয়েছে যা আমি বুঝতে পারছি না?”
তার চোখে হালকা সন্দেহ, ঠোঁটে অল্প হাসি। কিন্তু তারপর সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“ঠিক আছে… যা হয়েছে, পরে শুনব। এবার… ঠিক আছে তো?”
রুদ্র হালকা হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল, আর চোখে শান্তি, গলার স্বরে মৃদু উষ্ণতা—“ঠিক আছে, এবার চুপচাপ থাক। সব ঠিক আছে।”
সোরায়া আবার একবার মৃদু হেসে মিরায়াকে জিজ্ঞেস করল—
“আপু… কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”
মিরায়া চোখ নামিয়ে, সামান্য মাথা নাড়ল, চুপচাপ। কণ্ঠে কিছু নেই, শুধু মুখে হালকা অস্বস্তি, লজ্জা এবং নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত—“না, কিছু হয়নি, তোরা চিন্তা করিস না তো।”
রুদ্র তার পাশে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, “ভালো… সব ঠিক থাকলেই ভালো। মিরা তুই রুমে গিয়ে বিশ্রাম নে।”
রুদ্র কথা শেষ করতে না করতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। রুদ্র বাজতে থাকে ফোনটা সামনে নিতেই দেখলো রিমির নাম ভাসছে। এখন এই অসময়ে রিমির কল আশা করেনি রুদ্র।
মনে মনে সে ভাবলো-“এই সময় কল করলেন রিমি কোনো বিপদ হয়নি তো? তার ওই বদজাত ভাইয়া আবার কিছু করল নাকি!”
নিজের মনের এমন কুডাকে সে দ্রুত কল টা রিসিভ করে কানে নিয়েই বলল-
“হ্যালো রিমি? আপনি ঠিক আছেন? কিছু হয়েছে?”
রুদ্রর হঠাৎ প্রশ্ন দ্বারা আক্রমণের কারণ বুঝতে না পেরে রিমি হালকা আশ্চর্য ভাবী নিয়ে বলল-
“আমার কি কিছু হওয়ার কথা ছিল?”
রুদ্র চুপ করে গিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল;
“না না, কিছু হতে কেন যাবে। এমন সময় হঠাৎ কল করলেন তাই আর কি। ডোন্ট মাইন্ড!”
রিমি লজ্জা পেয়ে একটু হেঁসে বলল-
“আমি মাইন্ড করি নি। আসলে মিরাকে তখন থেকে কল দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু ওর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। টেনশন হচ্ছিল ওর জন্য। পরে মনে হলো আপনাকে কল দিলে হয়তো ওর ব্যাপারে জানতে পারব। আচ্ছা ওকে বাড়ি ফিরেছে?”
রুদ্র স্বাভাবিক গলায় বলল-
“ওহ এই ব্যাপার! হ্যাঁ ফিরেছে কিছুক্ষন আগেই।”
রিমি স্বস্তির শ্বাস নিয়ে বলল-
“ওর সাথে কি একটু কথা বলা যাবে?”
মিরায়ার দিকে তাকিয়ে রুদ্র ইশারায় বললো- “রিমি! কথা বলবেন।”
মিরায়া হাত বাড়িয়ে ফোনটা চাইতেই রুদ্র মিরার হাতে ফোনটা দিতে দিতে বলল- “এই নিন কথা বলুন।”
মিরায়া ফোনটা কানে ধরতেই রিমি উচ্ছ্বসিত হয়ে-
“ওই কিরে শাকচুন্নী! কত গুলো কল দিয়েছি একটাও ধোরলি না, এখন কল দিচ্ছি কলই ঢুকে না। কই ছিলি তুই? ঠিক আছিস?”
মিরায়া রিমির চিন্তার কারণ বুঝতে পারলো। চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক তার সামনেই তো রায়ান মিরায়াকে তুলে নিয়ে গেছিল। মিরায়া রিমিকে শান্ত করতে মজা করে হেসে বলতে লাগলো-
“সরি জান, ফোনটা অফ হয়ে গেছে চার্জ ছিল না। তবে আমি একদম ঠিক আছি। কালকে ক্যাম্পাসে দেখা হলে সব বলবো ওকে?”
রিমি শান্ত হয় মিরায়ার অবস্থা জানতে পেরে।
“আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস। গুড নাইট।”
মিরায়াও হেসে জবাব দিল-“তুই ও ঘুমিয়ে পর আয় চিন্তা করতে হবে না আমাকে নিয়ে। গুড নাইট।”
এরপর রিমি নিজের দিকে থেকে ফোনটা কেটে দেয় আর মিরায়াও রুদ্র কে ফোনটা ফিরত দেয়। তবে তখন রিমি আর কলে ছিলনা বলে রুদ্র সামান্য বেজার মুখ বানালো যেন তার কথা ছিল রিমির সাথে তবে তা আর বলার হলো না। সে মন খারাপ করেই ফোনটার দিকে একবার তাকিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। মিরায়ার চোখে সামান্য প্রশান্তি দেখা গেল। অনেক সময় পর একটু পরিবেশটা স্বাভাবিক লাগছে তার । কিন্তু তা বেশি সময় স্থায়ীত্ব পেলে না।
রায়ান তার বাবা-মায়ের রুম থেকে বের হল। চোখে অদম্য দৃঢ়তা, মুখে স্বাভাবিকতা আর এক ধরনের শান্তি। মিরায়া, রুদ্র এবং সোরায়া হা করে তাকিয়ে রইল।
রায়ান ধীরে ধীরে মিরায়ার দিকে এগিয়ে এসে মিরায়ার থেকে ইশারায় তার দেওয়া কোর্ট টা চাইলো। আর মিরায়াও কোর্ট টা সোফার উপর থেকে উঠিয়ে দিলো।
রায়ান মিরায়ার হাত থেকে কোর্ট টা নিয়ে মিরায়ার মাথায় কোমল ভাবে হাত রেখে বলল,
“আজকে আমাকে যথেষ্ট সহ্য করেছ, হৃদপাখি। এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে আসবে, ওকে?”
মিরায়ার গালে হালকা লালচে রঙ, চোখে অস্বস্তি। ঠোঁট সামান্য কেঁপে উঠল। রায়ানের মুখের স্বাভাবিকতা আর আত্মবিশ্বাস দেখে সে আরও লজ্জা পেল।মনে মনে ভাবলো-
“এত রাতে রায়ান তাকে কেন রুমে যেতে বলছে?” সে সামান্য অবাক।
রুদ্র আর সোরায়াও হা করে তাকিয়ে রইল। রুদ্র হালকা হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল, চোখে বিস্ময় আর মৃদু কৌতূহল। সোরায়া চোখ কপালে তুলে, ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রাখল, মনে মনে ভাবছে—“উফ্! ভাইয়া কতো রোমান্টিক। এত স্বাভাবিকভাবে এমন কথা বলতে পারল?”
রায়ান ধীরে ধীরে মিরায়ার মাথায় দুইবার হালকা হাত বুলিয়ে বলল—
“নিজের রুমে যাও, হৃদপাখি। আর হ্যাঁ, ফ্রেস হয়ে আমার রুমে আসবে মনে থাকবে?”
মিরায়ি ভয়ে সামান্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। দৌড়ে নয় তবে চলারগতি দ্রুত করে হাঁটা দিল সিঁড়ির দিকে যেন সিঁড়িতে পৌঁছেই দৌড়াবে। রায়ান সেটা বুঝতে পেরে মিরায়া সিঁড়ির সামনে যাওয়ার পর একটা বাড়িয়ে দৌড়ানোর আগেই বলে উঠলো-
“সাবধানে! ধীরে উঠো, তা না হলো কোলে করে উঠাবো।”
পিছন থেকে রায়ানের কথা শুনেই মিরায়া নিজের চলার গতি সঙ্গে সঙ্গে কমিয়ে দেয় আর একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।
এদিকে রায়ানের চোখ রুদ্র আর সোরায়ার সাথে মিলিয়েই সে দুইজনের উদ্দেশ্যে বলল-
“কি হলো তোদের? হা করে কি দেখিস? একদম নজর দিবি না, কুফা লাগলে খবর আছে দুই জনের ।”
রুদ্র রায়হানের কথায় চুপ হয়ে গেলেও , সোরায়া দুষ্টু হেসে রায়ান কেউ উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল –
“ভাইয়া? তোমরা আজ কোথায় গিয়ে ছিলে? তুমি কি আপুকে প্রপোজ করেছ?”
রায়ান সোরায়ার কথায় তাল দিতে হালকা ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল –
“সেটা বাদে আরো অনেক কিছু করেছি রে চড়ুই পাখি।”
সোরায়া প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল-
“আর কি কি ভাইয়া?”
রায়ান সোরায়ার কপালে আঙুলের টোকা দিয়ে বলে-
“চড়ুই পাখি, আগে আরো বড় হ। তার পর বুঝতে পারবি।”
এই বলে রায়ানও উপরে উঠে গেল নিজের রুমে। সোরায়া নিজের কপাল ঘোষতে লাগলো টোকার ব্যাথায়। এবার রুদ্র পিছন থেকে সোরায়ার মাথায় ঠোক্কা মেরে দৌড়ালো পিছন পিছন সোরায়াও রুদ্র কে ধোরতে দৌড়ালো তবে পেরে উঠলো না রুদ্রর সাথে। রুদ্র আগেই নিজের ঘরে গিয়ে দরজার অপর পাশে গিয়ে জোরে হাসতে হাসতে সোরায়া কে বলল-
“আরো বড়ো হ চড়ুই পাখি, তাহলে আমাকে জোরে পারবি।”
আর নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিল।
সোরায়া বিরক্তি মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো-
“আমি কি এতোই ছোট নাকি। যে পাচ্ছে স্কুলের ঘন্টার মতো বাজিয়ে চলে যাচ্ছে । আর কারো সাথে কথাই বলবো না, ধুর।”
এরপর সোরায়াও নিজের রুমে চলে গেল।
মাস্টার বেডরুম ~
রামিলা চৌধুরী ও রায়হান চৌধুরী রায়ানের রুম থেকে বের হওয়ার পরই দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে ফেললেন।
ফ্যাসব্যাক~
সন্ধ্যার শেষ প্রহরে, বাড়িতে ফিরেই রায়হান চৌধুরী খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। ওমনি ঘরে রামিলা চৌধুরী এসে ওনার পাশে বসলেন। আর মাথায় হাত দিয়ে চুল গুলা হালকা টেনে দিতে দিতে বললেন –
“আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?”
রায়হান চৌধুরী ঘুম ঘুম কন্ঠে -” না, বলো।”
রামিলা চৌধুরী একটু আমতা আমতা করে বললেন –
“আমার আপনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে রায়ান আর মিরার বিয়ের বিষয়টা নিয়ে।”
রায়হান চৌধুরী কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বললেন –
“আবার কি তোমার গুনধর ছেলে ডিভোর্স পেপারে সাইন করানোর কথা বলেছে?”
রামিলা চৌধুরী-“না, তেমন কিছু তো নয়ই। বরং এর উল্টো।”
রায়হান চৌধুরী অবাক হয়ে চোখ খুলে তাকালেন-
“উল্টো মানে?”
রামিলা চৌধুরী এই দুই দিনে রায়ানের মিরায়ার প্রতি আচরণ খেয়াল করেছেন আর যথেষ্ঠ বুঝতেও পেরেছেন রায়ানের মনের ভাবনা। তাই তিনি এই ব্যাপারে রায়হান চৌধুরীকে জানান।
“রায়ান ফিরে মিরাকে দেখার প্রথম দিন থেকে ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে জানেন। ও আমার থেকে ডিভোর্সের পেপারটা নিয়ে নিয়েছে আর তারপর সেই ব্যাপারে কিছু বলেও নি। কথা নেই বার্তা নেই, যখন তখন মিরার পিছনে লাগে। ওকে ক্যাম্পাসে দিয়ে আসে, নিয়ে আসে। আমার মনে হচ্ছে ও মিরার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে।”
রায়হান চৌধুরী শোয়ার থেকে উঠে বসে বলেন-
“কি সব বলছো। যে ছেলে বউয়ের নাম শুনতে পারে না প্রথম দেখায় দুর্বল হয়ে পরবে বউয়ের প্রতি?”
রামিলা চৌধুরী স্বাভাবিক ভাবেই বলেন-
“অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিয়ে এটা পবিত্র বন্ধন সহজে এর মায়া এড়ানো যায় না। আল্লাহ তায়ালার রহমত আছে এই সম্পর্কে মন নরম হতে কতক্ষন। তাছাড়া আমাদের মিরা দেখতে মাশাআল্লাহ। দিন শেষে মিরার প্রতি দুর্বলতা তৈরি হওয়া আমার মনে হয় রায়ানের জন্য স্বাভাবিক।”
রায়হান চৌধুরী মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ কথা শুনে জিজ্ঞেস করলেন-
“তুমি যে কথা বলছো রায়ান কি তা স্বীকার করেছে? ওকি মিরার সাথে সংসার করতে চায়?”
রামিলা চৌধুরী হতাশা নিয়ে বললেন –
“সেটাই তো বুঝছি না। দুই দিন চলে গেল কিছু বলতেও না। ও কি চাইছে না বললে তো বুঝতেও পারছি না।”
রায়হান চৌধুরী রামিলা চৌধুরীর হাতে হাত রেখে তাকে সান্তনা দিতে বললেন –
“আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না আমি দেখছি কি করা যায়। ও না বললে আমরাই না হয় বলতে বাধ্য করব।”
কথাটা বলেই রায়হান চৌধুরী একটা হেঁয়ালি হাসি দেন।
বর্তমান~
রামিলা চৌধুরী আর রায়হান চৌধুরী বিছানায় হাসতে হাসতে বসে কথা বলতে লাগলেন।
রামিলা চৌধুরী-“দেখেছেন মা কখোনো ছেলের মন বুঝতে ভুল করে না।”
রায়হান চৌধুরী-“ওরে বাবা, আর আমি যে এত ভালো অভিনয় করে ওর মনের কথা মুখে নিয়ে এলাম সেটা কিছু না?”
রামিলা চৌধুরী- ” হ্যাঁ, সেটার জন্য ধন্যবাদ। তবে দেখেছেন আপনার বেপোরোয়া ভাব ছেলেকে কি পরিমান নির্লজ্জ বানিয়েছে?”
রায়হান চৌধুরী-” আমি কি করলাম তোমার ছেলে বিদেশ থেকে শিখেছে এসব। ওকে ভালো একটা শিক্ষা দিতে হবে বুঝেছ। বলে কি না আমার তোমাকে যে কাজে লাগে ওর ও ওই কাজে বউ লাগবে । কি পরিমান নির্লজ্জ।”
রামিলা চৌধুরী-“মোটেও বিদেশে গিয়ে শিখেনি। আপনার
ছেলে আপনার মতোই হয়েছে। বাপ কা বেটা। আপনিও এমনি ছিলেন।”
রায়হান চৌধুরী-“বেশ করেছে আমার ছেলে নির্লজ্জ হয়েছে। তোমার কি ? বউয়ের জন্য যে পুরুষ লজ্জা লাগে সে আবার কেমন পুরুষ হলো। ও প্রমাণ করেছে, ও চৌধুরী বাড়ির বড়ো ছেলে। আই এম সো প্রাউড অফ মাই সান।”
রামিল চৌধুরী-“এখন মাই সান হয়ে গেলো।”
কথা শেষ করেই রামিলা চৌধুরী রাতের খাবার তৈরি করতে চলে গেলেন। আর রায়হান চৌধুরী তৃপ্তির হাসি নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। বাড়িতে বড়ো বউয়ের বউ রূপে পদার্পণের দৃশ্য যেন তার চোখের সামনে ভাসছে।
মিরায়ার রুম~
রুমের দরজা লাগিয়েই মিরায়া এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে পিঠ ঠেকিয়ে দরজায়। বুক ভরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে- যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো এতোক্ষণ শ্বাস গলায় আটকে ছিল তার রায়ানের উপস্থিতিতে। মনে মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি -“এই মানুষটার উপস্থিতি কেন আমাকে এত বিচলিত করে দেয়? কেন আমি কেঁপে উঠি ? কেন সামলাতে পারি না নিজেকে? আমি তো বিবাহিত আমার এমন অনুভূতি একজন পর পুরুষের জন্য আসা কোনো ভাবেই ডাক নয় তাহলে কেন? উফ্!” । মনে একটুও শান্তি নেই মিরায়ার মাথাও ঘুরছে। আজকের দিনটা যেন অদ্ভুত এক ঘূর্ণিঝড়ের মতো কেটে গেল তার জন্য।
হাতের বন্ধ হয়ে থাকা ফোনটা চার্জে দিয়ে। আলমারি খুলে তাড়াহুড়ো করে জামাকাপড় হাতে নিল। পা এক প্রকার টেনে শাওয়ারে ঢুকল। ঠান্ডা পানির ধারা শরীরে পড়তেই তার ভেতরটা কেঁপে উঠল। মনে ভেসে উঠল রায়ানের চোখের দৃঢ়তা, মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, সেই লজ্জাদায়ক অথচ যত্নভরা কথাগুলো—সবকিছু।
শরীর কাঁপল হালকা, মনে হলো শাওয়ারের পানি নয়, বরং আজকের স্মৃতিগুলোই তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে ভেতর থেকে। নিজেকে সামলাতে ঠোঁট কামড়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিল সে।
অবশেষে শাওয়ার শেষ করে বাইরে বেরিয়ে এলো। ভেজা চুল এলোমেলোভাবে কাঁধে ঝরে পড়ছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল। চোখে যেন লাজুক অস্থিরতা আর এক অদ্ভুত টান লুকিয়ে আছে—যা তার জীবনটা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। প্রথমবারের মতো সে নিজের অতীত কাউকে বলেছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করার সময় হঠাৎ তার মাথায় রায়ানের বলা শেষ কথাটা শোনার গেল-
“নিজের রুমে যাও, হৃদপাখি। আর হ্যাঁ, ফ্রেস হয়ে আমার রুমে আসবে মনে থাকবে?”
মিরায়ার কথাটা মনে আসতেই সে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বিরবির করলো-
“না না , আমি যাচ্ছি না উনার ঘরে। উনার মাথার ঠিক নেই । আমি বিবাহিত জেনে কিনা বলে-“অন্যের বউ হিট’স ডিফারেন্ট” না না কোনো ভাবেই আমি আর যাচ্ছি না উনার কাছে।”
মিরায়া আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলে-
“মিরা শান্ত হ। আর ভাব কি করা যায় ওই পাগল মানুষটাকে এড়িয়ে চালার জন্য। তুই বিবাহিত নিজেকে সামলা।”
মিরায়া নিজের মনেই কথা বলছিল এমন সময় একটা কল আসে তার ফোনে। মিরায়ার ধ্যান ভঙ্গ হতেই সে চার্জে থাকা ফোনটা খুলে ফোনে দেখলো একটা ল্যানলাইন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে মনে হচ্ছে অফিসিয়াল কিছু।
মিরায়া কল টা রিসিভ করে কানে ধরে। অপরদিক থেকে একজন লোক কথা বলতে শুরু করেন-
-“হ্যালো, আমি কি মিস. মেহেরিন রহমান মিরায়ার সাথে কথা বলছি?”
মিরায়া-“জ্বি। আমি কি জানতে পারি আপনি কে?”
-“আমি বিআরটিএ অফিস থেকে বলছি। আপনার লাইসেন্স প্রসেসিং শেষ হয়েছে। এখন ফুল লাইসেন্সের জন্য আপনাকে প্র্যাকটিক্যাল টেস্ট দিতে হবে। আগামীকাল সকাল ৯টায় অফিসে হাজির হবেন।
প্র্যাকটিক্যাল টেস্টে আপনাকে মোটরসাইকেল চালিয়ে দেখাতে হবে—ব্যালান্স, ব্রেক, সিগন্যাল সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করা হবে। টেস্টে পাশ করলে সরাসরি আপনার ফুল লাইসেন্স ইস্যু করা হবে।”
মিরায়া-“ওহ! আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি চলে আসবো।”
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৪
-তাহলে দয়া করে সময়মতো চলে আসবেন, কাগজপত্র ও প্রয়োজনীয় কপি সংগ্রহ করা হয়েছে আগেই সেগুলো একটু চেটে করে নিতে হবে আপনার সব ঠিক আছে কিনা।”
মিরায়া-“জ্বি , ঠিক আছে।”
ওপর পাশ থেকে কলটা কাট হয়ে যায়। আর মিরায়াও অন্য চিন্তা ভুলে গিয়ে নিজের লাইসেন্স পাওয়ার খুশিতে ডুবে যায়।
রায়ানের রুম ~