আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৭

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৭
অরাত্রিকা রহমান

পরের দিন সকালে~
সকালটা নরম আলোর ঘ্রাণে ভরা। আকাশটা শ্বেতসাদা ও পরিষ্কার, সূর্যের কিরণগুলো যেন ধীরে ধীরে ঘরের কোণে ছড়িয়ে পড়ছে। জানালার কাঁচের ওপর পড়া রোদ ঝিকিমিকি করে খেলছে, আর মৃদু হাওয়া হালকা গরম।
মিরায়া বিছানায় শুয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলে জানালার দিকে তাকাল। রোদ ও হালকা বাতাসের মিশ্রণে মনে হলো যেন পুরো সকালই তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। মিরায়া মনে মনে বলল, “আজকে সব ভালো হবে, ইনশাআল্লাহ। উঠে পড় মিরা।”

নিজের কণ্ঠে সাড়া দিয়েই উঠে সে নিজের বিছানাটা সুশৃঙ্খলভাবে ঠিক করল। তারপর ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমের দিকে এগোল। ঠাণ্ডা পানি তার মুখে লাগতেই চোখ খুলে গেল আর মুখে হালকা জেগে থাকার আনন্দ ফুটে উঠল।
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে মিরায়া আলমারি থেকে তার প্রিয় লাল কুর্তিটা নিয়ে পড়ে ফেলল। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে মিষ্টি হাসি দিল, তারপর নিজেকেই, “Good morning।” উইশ করে রুমে ছেড়ে বেরলো নিচে যেতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হাসি মুখে সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে নামতে সে খেয়াল করলো বাড়িটা আজ বেশ খালি খালি। মিরায়া নিচে নেমে একটু থেমে দাঁড়িয়ে ড্রয়িং রুমে চারপাশটা একটু পরোখ করে দেখলো। কিন্তু কারোর উপস্থিতি টের পেল না।
একটু হেঁটে রান্না ঘরের সামনে আসতেই রামিলা চৌধুরীর দেখা মিলতেই মিরায়া দৌড়ে রামিলা চৌধুরীর কাছে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল-
“Good morning, মামণি। কি করো?”
রামিলা চৌধুরী একটু চমকে যান মিরায়ার হঠাৎ স্পর্শে। অতঃপর তিনি মিরায়ার হাত ধরে ঘুরে বলেন-
“Good morning, মা। নাস্তা রেডি করছিলাম আর তুই এলি।”
মিরায়া-“নাস্তা রেডি মামণি? আমি তবে সবাইকে ডাকি টেবিলে?”
রামিলা চৌধুরী আবার রান্নার কাজে মন দিয়ে বলেন-

“কাদের ডাকবি? বাড়িতে কেউ নেই। সবাই তো যার যার কাজে চলে গেছে। ”
মিরায়া অবাক হয়ে নিজের ঘড়ি দেখলো- ৮টা বাজছে। ঘড়ি দেখে মিরায়া বলে উঠলো-
“কেবল ৮ বাজে, এখনি সবাই কাজে চলে গেল?”
রামিলা চৌধুরী মাথা হ্যাঁসূচক নেড়ে উত্তর দিলেন-
“হ্যাঁ, চলে গেছে তাদের কি যেন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। তুই টেবিলে বোস আমি খেতে দিচ্ছি। পরে আবার দেরি হয়ে যাবে।”
মিরায়ার সবার ব্যবহারই কেমন যেন অবাক করা ঠেকছিল তবে সে কিছু না বলেই খাবার টেবিলে গিয়ে বসতে গিয়ে ভাবলো-

“আচ্ছা, বাবা আর রুদ্র ভাইয়া নাহয় তাদের কাজে গেছেন মিটিং আছে বলে। বনু তো ঘুমাচ্ছে। তাহলে উনি (রায়ান) কোথায়? এখনো কি ঘুম থেকে উঠেন নি?”
রামিলা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ভাবলো-
“একবার কি মামণিকে জিজ্ঞেস করবো?”
তার পরপরই আবার নিজের মাথা নেড়ে মনকে বুঝালো-
“না না, আমার কি সে ঘুম থেকে উঠেছে না উঠেনি জেনে। ভালোই হয়েছে সকালে আর তার মুখোমুখি হতে হলো না। উফ্! কি আরাম।” (মনে মনে হেঁসে)
রামিলা চৌধুরী মিরায়ার সকালের নাস্তা মিরায়ার সামনে দিয়ে বললেন –

“মিরা মা তোর আরো কিছু লাগলে চুমকিকে বলিস। চুমকি ছাদে কাপড় দিতে গেছে চলে আসবে। আমি ঘরে যাচ্ছি। আর আজ কেউ তোকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিতে যাবে না। নিজে সাবধানে যাস কেমন।”
মিরায়া আশ্চর্য হয়ে রামিলা চৌধুরীর সব কথা শুনল তবে কিছুই বুঝতে পারলো না হঠাৎ এমন কেন করছে সবাই। আর মনে মনে ভাবলো- “কেউ পৌঁছে দিতে যাবে না বলতে কি মামণি রায়ান ভাইয়া বাড়িতে নেই তাই বুঝালো।”
মিরায়া শান্ত ভাবে শুধু মাথা নাড়িয়ে বলল-
“ঠিক আছে মামণি। কিন্তু তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
রামিলা চৌধুরী- “না, শরীর খারাপ নয়। এমনি।”
এই বলে তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন। মিরায়ার হাসি হঠাৎ মিলিয়ে গেল আজ কেউ তার আশে পাশে নেই রায়ানও তাকে বিরক্ত করছে না সব সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিকতা তার ভালো লাগছে না। একা একা বিষন্ন মন নিয়ে মিরায়া কিছুটা খাবার খেয়ে বাকিটা টেবিলের উপর রেখেই ক্যাম্পাসে চলে গেল।

রায়ান আজ সকাল ৭টার দিকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এমন নয় তার কাজ ছিল কারণটা অন্য । রায়ান মিরায়ার হলে সিফ্ট করার জেদটা ভালোই বুঝতে পেরেছে। একজন ভালো বিজনেসম্যান হওয়ার দরুন কোন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হয় তা সে খুব ভালো ভাবেই জানে।
বলা চলে, মিরায়ার চোখ এড়াতে আর তার চলে যাওয়ার কথাতে কেউ খুশি নয় এটা বুঝাতেই রায়ান বাড়ির সবাইকে সেই ব্যাপারে কথা বলতে আর স্বাভাবিক ভাবে আচরণ করতে না বলেছে। সবাইকে একটু দূরত্ব রেখে চলার কথা বলার পর বাড়ির সবাই নিজেদের কাজে নিজেদের ব্যস্ত করে নিয়েছে।
সকাল-৮.৩০মিনিট~

রায়ান তার বিজনেস সাইটের কনস্ট্রাকশনের কাজ ঠিক মতো হচ্ছে কিনা, সেটা স্টাফদের কাছ থেকে জেনে কম্পানির মেইন বিল্ডিং এর কনফারেন্স রুমে বসে আছে। কিছু সময়ের মধ্যেই একটা মিটিং শুরু হওয়ার কথা।
রায়ানের ম্যানেজার কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করেই রায়ানকে সকল ডকুমেন্টস আর ফাইল হস্তান্তর করল। রায়ান সূক্ষ্ম চোখে সব ডকুমেন্টস আর ফাইল একবার চেক করে নিয়ে বলল-
“অলরাইট, লেট’স বিগিন দ্যা মিটিং। কল দ্যা রেস্ট শেয়ারহোল্ডারস।”
ম্যানেজার- “সিয়োর, স্যার।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিটিং শুরু হলো। মিটিং এ সবাই নিজেদের মতামত প্রদান করছে আর রায়ান তার নিজস্ব কারণ গুলো বিশ্লেষণ করতে থাকে। রায়ানের উত্তরের কাছে যেন সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকেই রায়ানের বিজনেস মাইন্ডের প্রশংশা করতে থাকলেন।

মিটিং শেষে~
-“মিস্টার. চৌধুরী, আপনার চিন্তাধারা আর কাজ দুটোই বেশ পাকা। আমরা আমাদের ডাউট গুলোর সমাধান পেয়ে নিশ্চিন্ত। উই আর টোটালি ইন। গো আহেড উইথ দ্যা গুড ওয়ার্ক।”
রায়ান একগাল হেঁসে সবার উদ্দেশ্যে বলল-
“সিয়োর। থ্যাংক ইউ সো মাচ অল অফ উইং। দ্যা মিটিং ইজ ওভার। উই গাইজ ক্যান গো অন ইউর ওয়েস।”
তারপর সবাই কনফারেন্স রুম ত্যাগ করার পর রায়ান নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে মা- রামিলা চৌধুরীকে কল করে।
-“হ্যালো, আম্মু?”
-“হুঁ, বল। কি হয়েছে?”
-“তোমার বউমা কোথায়?”
-“বউমা তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। তা বলছিলাম, বউমাকে কল করে খবর নিলে ভালো হয় না? মেয়েটা একা গেল।” একটু হেঁয়ালি করে।

-“তোমার বউমা বাচ্চা না। এটা বলো, ও খেয়েছে কিছু?” চিন্তার ছাপ দৃশ্যমান রায়ানের প্রশ্নে।
-“হ্যাঁ, খেয়েছে অল্প। একা হয়তো বেশি খেতে ইচ্ছে করেনি তাই খাবার শেষ করেনি।”
-“তুমি কোথায় ছিলে পুরোটা শেষ করেনি কেন?” একটু উঁচু আওয়াজে।
-“আমি কিভাবে থাকবো তুই না বললি মিরার সামনে না থাকতে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে?” রামিলা চৌধুরী বাঁকা চোখ করে রায়ানকে প্রশ্ন করেন।
-” তুমি ছিলে না তাতে কি , তোমার বউমা কি অবুঝ খাবার ঠিক মতো খায় না কেন!” রায়ান তার মায়ের কথার যৌক্তিকতা খুঁজে পেয়ে মিরায়ার খাবার শেষ না করার উপর বিরক্তি দেখিয়ে কথাটা বলেই ফোন রেখে টেবিলের উপর ফোনটা স্লাইড করে রাখলো।

চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে মাথায় হাত রাখে রায়ান। মনে যেন শান্তি পাচ্ছে না মিরায়াকে এড়িয়ে চলে। তবে হলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পরিবর্তনের জন্য আপাতত এটাই করা উচিত হবে বলে সে এমনটা করছে। যাতে মিরায়া সবার মন বুঝতে পারে আর নিজের একা থাকার বিষয়টা কঠিন হবে সেটা বুঝতে পেরে নিজের থেকেই আর হলে যাওয়ার কথা না মাথায় আনে।
রায়ান নিজের চুল গুলা হালকা টেনে বলল-
“উফ্! কি সমস্যা তোর হৃদপাখি? শান্ত থাকতে চাইলে থাকতে দিবি না আর অশান্ত‌ হলে সামলাতেও পারবি না। আমি কি করে কন্ট্রোল করবো নিজেকে।”

চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে এপাশ ওপাশ হাঁটতে হাঁটতে নিজেই কথা বলতে লাগলো-
“একে তো একা ছেড়েছি। যদিও রিক্সা তো বাড়ির সামনে ঠিক করেই রেখে এসেছিলাম। ওইটা তেই যাওয়ার কথা। তবে বুঝবো কিভাবে যে পৌঁছেছে ও।”
-“শয়তান বউ খাবার ও খায় না। শরীরে নেই কিছুই, ধরতে গেলে শুরুর আগেই শেষ। আদরটা করবো কোথায় আমি। ঐ শরীরে আমাকে কিভাবে সহ্য করবে। না খেলে কিভাবে বড়ো করবো বউটাকে। কি এক জ্বালার মধ্যে ফেলছো আমাকে আল্লাহ।”

ঢাবি ক্যাম্পাস~
মিরায়া রিক্সায় আনমনে বসে ছিল। ক্যাম্পাসে এসার পরই মিরায়ার রিমির সাথে দেখা হয় গেটে। রিমি মিরায়ার দিকে হাত নেড়ে-
“ওই মিরার বাচ্চা!”
মিরায়ার মনোযোগ ফেরে। সে রিমির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে রিক্সা থামিয়ে নামার সাথে সাথে রিমি এসে মিরায়াকে জড়িয়ে ধরে।
-“দাঁড়া ভাড়াটা দিয়ে নেই।” মিরায়া রিমিকে ছাড়িয়ে তাকে বলল।
মিরায়া ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে পিছনে ঘুরে দেখে সে রিক্সায় এসেছে সেই রিক্সা আর ওই জায়গায় নেই।

-“কিরে কিসের ভাড়া?” রিমি মিরায়াকে প্রশ্ন করলো।
-“আরে রিক্সাওয়ালা মামার ভাড়া। না নিয়েই চলে গেলেন।”
মিরায়া অবাক সুরে উত্তর দিলো।
-“ভাড়া না নিয়ে যাবে কেন মনে করে দেখ হয়তো আসার সময় দিয়েছিস তোর খেয়াল নেই।”
-“আরে তা কিভাবে হয়। বাড়ি থেকে বের হয়েই দেখি এই রিক্সাওয়ালা মামা দাঁড়িয়ে ছিলেন বলার সাথে সাথে রাজিও হলেন এখানে আসতে। ভাড়া কত দেব তাও জিজ্ঞেস করে নি আজব।” মিরায়া রাস্তায় তাকিয়ে থেকেই উত্তর করে।

-“আচ্ছা বাদ দে চলে গেছে যেহেতু গেছে। তুই তো ইচ্ছে করে উনাকে টাকা না নিয়ে যেতে বলিস নি। দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেতরে চল।”
মিরায়া একটু মাথা চুলকে রিমার হাতের টানে ক্যাম্পাসের ভিতরে চলে গেল। আর এই বিষয়ে ভাবে নি।
মিরায়া রিমির সাথে ক্লাস রুমে বসে আছে। মিরায়ার মন এখনো বিষন্ন। ক্লাসের পড়ায় তার মনোযোগও নেই। রিমি মিরায়ার মনোভাব বুঝতে পেরে ক্লাস শেষে মিরায়াকে জিজ্ঞেস করল-
“ওই কিই হয়েছে তোর? সাপে কেটেছে নাকি, এমন শান্ত হয়ে আছিস কেন?”
মিরায়া পাত্তা না দিয়ে-
“কই ঠিকই তো আছি।”

রিমি-” সে তো দেখতেই পাচ্ছি । ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাড়াটা সকাল চুপচাপ রোবটের মতো বসে রইলি, ক্লাসে একটা নোটও নিলি না। এটা কেমন ঠিক থাকা হলো শুনি?”
মিরায়া রিমির দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে –
“জানি না রে, কি হয়েছে। সকাল থেকে কিছু ভালো লাগছে না। কি যেন নেই নেই মনে হচ্ছে। খালি খালি লাগছে খুব।”
রিমি মিরায়ার কাঁধে হাত রেখে একটু ট্যাপ করে বলল-

“এটা কোনো কথা হলো। চিয়ার আপ, জান! আমি আছি না।”
মিরায়া রিমির দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে রিমিকে জড়িয়ে ধরলো। এইটুকু সান্ত্বনায় তার এখন একটু হালকা লাগছে। সকলের তাকে সকালবেলা এইভাবে ইগনোর করাটাই মূলত তার মন খারাপের কারণ। মিরায়া রিমির সাথে কিছুক্ষন কথা বলতে থাকার পরই অন্য একজন প্রফেসর ক্লাসে প্রবেশ করেন। তারপর ক্লাসের সকলেই আবার মনোযোগী হয়ে ক্লাসে মন দেয়।

সোরায়ার কলেজ~
মাহির ক্লাসে পড়াচ্ছে আর সোরায়া এক দৃষ্টিতে মাহিরকে দেখে যাচ্ছে। মাহির বুঝতে পারছিল এক জোড়া চোখ তাকে লাগাতার দেখে যাচ্ছে। বুঝতে পারাটা স্বাভাবিকও, যেকোনো মানুষ বুঝতে পারবে তাকে কেউ একটানা এইভাবে দেখতে থাকলে।
সোরায়ার পাশেই বসে ছিল জুঁই। সোরায়াকে এমন করে পুরো ক্লাসের সামনে মাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জুঁই বলল-

“ওই ছেমড়ি! চোখ সামলা। চোখ দিয়েই তো খেয়ে ফেলবি। পড়াচ্ছেন স্যার এখন পড়ায় মন দে।”
সোরায়া বিরক্তি নিয়ে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
“তোর পড়া তুই পড়। আমি তোকে কিছু করেছি? আমাকে আমার কাজ করতে দে।”
-“কালকে যে এত বড় একটা হেল্প করলাম তার এই প্রতিদান দিলি তুই। যাহ্ তোর সাথে কথা নাই।” জুঁই একটু নাটুকে ভাব নিয়ে বলল।
-“আরে কি যে বলিস! সেটার জন্য তোকে তো আমি চুম্মা দিয়ে ভরাই দিবো ক্লাসটা শেষ হক।” সোরায়া জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলল।

-“থাক থাক আমার লাগবে না তোর চুম্মা। বাচাই রাখ ওইগুলো তার জন্য।” জুঁই সোরায়ার কথায় মজা নিয়ে।
-“দোস্ত কি করি বলতো স্যার তো রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে নি।”
-“এখন এটাও কি আমি বলবো? তাহলে তোর জায়গায় তো আমি ই স্যারকে পটাইতে পারি।”
-“খবরদার স্যারের দিকে নজর দিবি না। চুপচাপ আইডিয়া দে কি করা যায়।”
এর মধ্যেই ঘন্টা পড়ে গেল। মাহির পুরো ক্লাসের উদ্দেশ্যে হোমওয়ার্ক দিয়ে বিদায় নিয়ে ক্লাস থেকে বের হতেই সোরায়া জুঁইকে ধাক্কা দিয়ে বলে-
“ওই বের হো বের হো। স্যার চলে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি।”
জুঁই সোরায়াকে বেঞ্চ থেকে বের হতে দিয়ে বলে- “যা।”
তখন সোরায়া জুঁইয়ের হাত ধরে টানতে টানতে বলে-
“আমি একা যাব নাকি তুইও চল।”

এই বলে জুঁইয়ের হাত টেনে সোরায়া ক্লাসের বাইরে যায়। সামনেই মাহির অফিস রুমের দিকে যাচ্ছে। সোরায়া এক দৌড়ে মাহিরের সামনে গিয়ে থামে। অতিরিক্ত গতিতে দৌড়ানোর কারণে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়তে যাবে এমন সময় মাহির সোরায়ার কোমর জড়িয়ে ধরে ফেলে।
জুঁই হাঁ হয়ে দেখছে। পাশাপাশি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই দেখছে। মাহির সোরায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে- কি নিষ্পাপ আর চঞ্চল একটা মুখ। সোরায়া হঠাৎ পড়ে যাওয়ার ভয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখ খিচিয়ে বন্ধ করে আছে।মাহির না চাইতেও মুচকি হেঁসে ফেলে সোরায়ার ভয়ে ভরা মুখটা দেখে।
সোরায়া ধীরে ধীরে চোখ খুলে মাহিরের দিকে তাকাতেই মিষ্টি হাসলো। মাহির আশেপাশের সবাই দেখছে এটা মাথায় আসার সাথে সাথেই সোরায়ার কোমর ছেড়ে দিল। আর সোরায়া মাটিতে পড়ে গেল।
-“ওহ্ মা গো… মরে গেলাম!” সোরায়া চিৎকার করে উঠতেই পিছন থেকে জুঁই দৌড়ে সোরায়াকে ধরতে আসতে যাবে তখনি সোরায়া জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে মাথা নেড়ে –

“গাধি তুই আসিস না।”
আবার চেচালো-“আহ্! আল্লাহ ব্যাথা।”
এবার মাহির আর দাঁড়িয়ে না থেকে সোরায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে উঠাতে চাইলে সোরায়া নিজের হাত মাহিরের হাতে রাখে তবে উঠার কোনো চেষ্টা না কোরেই-
“ওহ্! অনেক ব্যাথা লাগছে।”
মাহির একটু চিন্তিত হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সোরায়ার সামনে-
“নিজে হাঁটতে পারবে?”
সোরায়া মাথা নাড়ায় -“উঁহু, পারবো না।”
এক কাজ করো আমার কাঁধে ভার দিয়ে হাঁটতে পারো চাইলে। সোরায়া একটু উৎসাহ নিয়ে-
“আপনি চাইলে আমাকে কোলে নিয়ে পারেন। আমার ওজন বেশি না ৪৫ কেজি। আপনি পারবেন। আমি কিছু মনে করবো না।”

মাহির শুকনো ঢোক গিলে চুপ করে গেল। তার পর সে চারপাশে দেখলো সবাই তাকিয়ে আছে। মাহির বুঝতে পারলো এত একটাও লাগেনি সোরায়ার হয়তো নাটক করছে। মাহির মজা হিসেবে নিয়ে মনে মনে একটু হেঁসে জুঁইকে আর ওই জায়গায় আরো একজন কে ডাকলো। তারা সামনে আসতেই সোরায়ার দিকে আঙুল রেখে মাহির বলল-
“ওর ওজন বেশি না, ৪৫ কেজি মাত্র তোমাদের কষ্ট হবে না। একজন হাত আর একজন পা ধরে ওকে ক্লাসে নিয়ে যাও।”
এইটা বলেই মাহির অফিস রুমের দিকে হাঁটতে লাগলো। সোরায়া এখনো ফ্লোরে বসে মাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পর জুঁই আর অন্য মেয়েটা সোরায়াকে ধরতে আসার সাথে সাথেই সোরায়া এক ঝটকায় ফ্লোর থেকে উঠে দ্রুত হেঁটে ক্লাসে চলে গেল।
মাহির অফিস রুমের দরজার সামনে গিয়ে একটু দাঁড়িয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে সোরায়া স্বাভাবিক ভাবেই হেঁটে যাচ্ছে। মাহির এই দৃশ্যটা দেখে আর হাঁসি ধরে রাখতে না পেরে শব্দ করে হেসে ফেলে বলল-
“আজকালকার বাচ্চা গুলোর যে কি হবে!”

রায়ান নিজের অফিস রুমে পাইচারি করে তখনো ভাবছে কিভাবে বউয়ের একটু খবর নেয়া যায় । সে নিজে কল করতে চাইছে না আর বাড়ির কাউকেও করতে না করেছে। হঠাৎ তার মনে পরলো রুদ্রর কাছে মিরায়ার বান্ধবী রিমির নাম্বার আছে চাইলে তার কাছ থেকে জানা জেতে পারে।
রায়ান দ্রুত টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে রুদ্র কে কল করে। আর রুদ্র সাথে সাথে কল রিসিভো করে। রুদ্র চৌধুরী কম্পানিতে তার অফিস রুমে বসে ফাইল চেক করছিল।
-“হ্যাঁ ভাইয়া বলো।”
-“রুদ্র তোর কাছে তোর ভাবির বান্ধবীর নাম্বার আছে না।?”
-“কার রিমির?”
-“হ্যাঁ, রিমির।”
-“আছে তো। কেন?”
-” রিমিকে কল করে তোর ভাবির খবর নে কোথায় আছে, কি করছে, সব। আর হ্যাঁ তোর ভাবি যেন টের না পায়। এখনি কল করে জেনে আমাকে জানা। বাই। কুইক।”
রায়ান কথা শেষ করেই রুদ্রর মুখের উপরই ফোনটা রেখে দেয়। রুদ্র হা করে রইলো । সে রায়ানের কথা অনুযায়ী রিমিকে কল করে।

রিমি মিরায়ার সাথেই আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠলো। মিরায়া অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল তখন।
রিমি রুদ্রর ফোন দেখে একটু দূরে গেল ফোন ধরতে। মিরায়া বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই নিলো।
-“হ্যালো, রিমি? কেমন আছেন?”
-“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
-“জ্বি ভালো। আপনি কি মিরার সাথে?”
-“হুঁ, আমার সাথেই আছে। ওকে দেব?”
-“না না আমি কল করেছি ওকে বলবেন না প্লিজ। ও কি করছে ? ঠিক আছে তো?”
-“জ্বি আচ্ছা বলবো না। ও ঠিক আছে। তবে মনটা বেজার সকাল থেকে কেমন যেন গা ছাড়া ভাব। জিজ্ঞেস করেছিলাম কিছু বলল না। কিছু কি হয়েছে?”
-“না তেমন কিছু হয়নি। ভালো থাকবেন । রাখি। বাই।”
রুদ্র ফোনটা রেখে দিয়েই রায়ানকে কল করল। আর রিমিও ফোনটা নিয়ে আবার মিরায়ার কাছে গিয়ে বসে গল্প করতে লাগলো।
রুদ্র রায়ানকে কল করতে করতে বিরবির করলো-

“এদের জামাই বউয়ের জেদের মধ্যে পরে আমি পিষে যাচ্ছি। ধুর ভাল্লাগে না।”
রায়ান রুদ্রর কল দেখেই ফোন টা দ্রুত ধরে।
-“কিরে তোর ভাবি ঠিক আছে?”
-“না রিমি বললেন তোমার বউ কোন ছেলের সাথে যেন বাইকে করে ঘুরতে গেছে।” রুদ্র মজা করে বলল।
-“রুদ্র আমি বাড়ি ফিরে সব ডার্ক রোমান্সের বই নিয়ে নিব বলে দিলাম । যা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর দে। যাতা কথা বলবি না একদম।” রুদ্র কথায় রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল রায়ান।
-“তোমার বউ ঠিক আছে। রিমির সাথেই আছে। সকাল থেকে নাকি কেমন মন খারাপ তবে রিমিকে কিছু বলে নি তাই উনি আমাকে বলতে পারলেন না। এখন আড্ডা দিচ্ছেন উনারা।”
রায়ান যেন শান্তি পেল বউয়ের খবর পেয়ে। আর তার আইডিয়াতে মিরায়াকে সবার ইগনোর করার বিষয়টা কাজে দিচ্ছে ভেবে একটু বাঁকা হেঁসে রুদ্র কে বলল-
“আচ্ছা ঠিক আছে রাখ। ধন্যবাদ স্বরুপ তোকে ‘Hunting Adeline ‘ বইটা দিব যাহ। বাই।”
রায়ান রুদ্রের ফোনটা কেটে শান্তিতে চেয়ারে বসে মিরায়ার কথা ভাবতে থাকলো আর বললো-
“হৃদপাখি মন খারাপ কোরো না বেইবি। তোমার বাড়ি ছাড়ার ভুতটা মাথা থেকে নামলে সব ঠিক করে দেব।”

ঢাবি ক্যাম্পাস~
রিমির সাথে আড্ডা দিতে দিতে মিরায়ার হঠাৎ মাথায় এলো আজ ওর লাইসেন্স এর প্র্যাকটিক্যাল টেস্ট দিতে যেতে হবে ।
মিরায়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল-
“শোন না রিমি! আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। আমি পরের ক্লাস গুলো করতে পারব না তুই আমাকে নোটসগুলো দিয়ে দিস। আমি চলে যাচ্ছি। বাই।”
এই বলে মিরায়া উঠে যেতে নিলে রিমি মিরায়ার হাত ধরে বলে-
“ওমা এটা কেমন। বাই কি ? কই যাস?”
মিরায়া রিমির হাত ছাড়িয়ে বলে-

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৬

“সরি জান, এখন বলতে পারছি না অন্য দিন বলবো এখন যেতে হবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। টাটা।”
এই বলে মিরায়া দৌড়ে ক্যাম্পাসের মূল দরজার দিকে যেতে থাকলে রিমি জোরে বলে-
“আচ্ছা সাবধানে যাস। ”
মিরায়া হাত নেড়ে-
“ঠিক আছে।”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here