আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৮ (২)

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৮ (২)
অরাত্রিকা রহমান

শহরের নামকরা একটি স্পোর্টস বাইক শোরুম। কাচের দেয়াল ভেদ করে ভেতরে তাকালেই সারি সারি দাঁড়ানো ঝকঝকে বাইকগুলো যেন চোখে ঝলসে দেয়। আলো-ঝলমলে শোরুমটা একদমই অন্যরকম আভিজাত্য ছড়াচ্ছিল।
রায়ান আর মাহির শোরুমে ঢুকতেই পাশে বসে থাকা রিসেপশনিস্ট হালকা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রিসেপশনিস্ট:

“হ্যালো স্যার, কীভাবে হেল্প করতে পারি?”
রায়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। মাহির এগিয়ে গেল সামনে। মাহির রিসেপশনিস্ট এর প্রশ্নের উত্তরে –
“আপনাদের ম্যানেজার কোথায়? উনাকে ডাকা যাবে?আমাদের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে হবে আমরা যা চাইছি তার জন্য। পসিবল হলে উনাকে ডাকবেন, প্লিজ?”
রিসেপশনিস্ট বিনয়ের সঙ্গে মাথা নাড়ল, ফোনে কল করে জানিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঝবয়সী, সুদর্শন একজন মানুষ এগিয়ে এলেন—শোরুম ম্যানেজার। তার পোশাক-আশাকে ভদ্রতা, চোখেমুখে বিনয়।
ম্যানেজার:
“ওয়েলকাম স্যার। বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি।”
মাহির ম্যানেজার এর মুখোমুখি দাড়ায়-
“আমরা আসলে স্পোর্টস বাইকের খোঁজ করছি। অভিজ্ঞ কেউ ডিল করলে ভালো হয় তাই আপনাকে ডাকা।”
ম্যানেজার মাথা নেড়ে হেসে বললেন-
“ওহ আচ্ছা স্পোর্টস বাইকের জন্য।”
মাহির (হালকা হাসি দিয়ে):

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জি হ্যাঁ। আমরা এমন একটা বাইক খুঁজছি যা রেসের উপযোগী হবে। এক্সট্রা অর্ডিনারি মডেল চাইছি।”
ম্যানেজার বুঝতে পারল এরা সাধারণ ক্রেতা নয়। সে হাত ইশারা করতেই দুই স্টাফ শোরুমের লাইটিং আরও উজ্জ্বল করে দিল। একে একে তারা বিভিন্ন মডেল দেখাতে লাগল—লাল, নীল, সিলভার, এমনকি বিশেষ এডিশনের বাইকগুলো। ম্যানেজার প্রতিটা বাইকের নাম, ইঞ্জিন, স্পিড, আর ফিচার বর্ণনা করছিলেন আগ্রহভরে।
মাহির প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনে হালকা হেসে মাথা নাড়ছিল। যেন বাইকগুলোর দুনিয়ায় ঢুকে গেছে। কিন্তু রায়ান? সে একেবারেই নির্বিকার—শুধু চোখ দিয়ে শোরুম ঘুরে দেখছিল।

রায়ান নিজের মতো করে সব বাইক দেখতে থাকার মুহূর্তেই হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে গেল শোরুমের মেইন কর্নারে।
এক কোণায় রাখা একদম কালো—টোটালি ব্ল্যাক স্পোর্টস বাইক। শরীরের প্রতিটি বাঁক যেন শিল্পীর হাতে গড়া, ঝকঝকে কালো বডি আর মেটালিক গ্লস ফিনিশে পুরো বাইকটা যেন রহস্যময় অথচ তীব্র আকর্ষণীয়। রায়ানের অজান্তেই তার চোখে শোরুমের সবচেয়ে দামি আর লাক্সারিয়াস বাইকটাই পড়লো। মডেলটির নামও সবার কাছে পরিচিত—Ducati Panigale V4 R।
রায়ান হাত তুলে ম্যানেজারকে থামিয়ে দিল তার অন্য সকল বাইকের বর্ণণা দেওয়া থেকে। মাহিরও অবাক হয়ে রায়ানের দিকে তাকিয়ে রায়ানের চোখের চাহনি অনুসরন করে সেই বাইকটার দিকে দেখলো। রায়ান ধীরে ধীরে কালো বাইকের সামনে এগিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে বলল—
“I like this one.”

ম্যানেজার তৎক্ষণাৎ পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, চোখে মুগ্ধতার ঝিলিক। যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়েছেন। মনে মনে-
“খোদা , অনেক শুকরিয়া। এমন কাস্টমারই তো দরকার।”
ম্যানেজার রায়ানের উদ্দেশ্যে হেঁসে বলতে শুরু করেন:
“স্যার, আপনার রুচি আছে বলতে হবে । কি দারুণ পছন্দ করেছেন। এই বাইকটা আমাদের শোরুমের সবচেয়ে দামি, এমনকি বাংলাদেশের বাজারেও এটাই সবচেয়ে প্রিমিয়াম মডেল।”
রায়ান ঠান্ডা চোখে ম্যানেজারের দিকে তাকাল। ঠোঁট বাঁকিয়ে শুধু বলল—
“Stop. দামি কি না সেটা আমি জানতে চাইনি। আমি শুধু বলেছি, I like it. So, I’m buying it in any ways. Papers ready করুন।”

ম্যানেজার একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল আর তড়িঘড়ি পেপারস রেডি করতে ভেতরে চলে গেলেন।
ম্যানেজার চলে যেতেই মাহির অবাক চোখে রায়ানের দিকে তাকাল। যেন রায়ানের এই এক মুহূর্তে বাইক কিনে ফেলার বিষয়টা তার বধোগম্য হয়নি।
মাহির:
“রায়ান… আগে অন্তত একটু শুনে নিতি বাইকের কোয়ালিটির সম্পর্কে। এটা রেসে নামার জন্য এটা কতটা সাহায্য করতে পারবে, স্পিড আর পারফরম্যান্সে কেমন…”

রায়ান মাহির কে থামিয়ে দিল। কণ্ঠে দৃঢ়তা, চোখে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাহিরের উদ্দেশ্যে বলল—
“মাহির, টু উইন দ্য রেস, বাইকের কোয়ালিটি নয়… রাইডারের কোয়ালিটি থাকা দরকার।
I can win with any bike, on any track.
It’s not about the bike, it’s about the man who rides it.”
মাহির চুপ করে গেল। রায়ানের চোখেমুখে যে দৃঢ়তা, সেখানে প্রশ্নের কোনো সুযোগই ছিল না। কারণ রায়ানের বলা কথাও যথার্থ। মাহির কেবল দুহাত পাশে তুলে সম্মতি জানিয়ে দিল আর রায়ান মুচকি হাসলো মাহিরের তার সিদ্ধান্তে সায় দেওয়া দেখে।

কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার ফিরে এলেন প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টস, গ্যারান্টি কার্ড, ওয়ারেন্টি কার্ড, মালিকানা কাগজ নিয়ে। রায়ান একে একে সব সই করে দিল। মুহূর্তটা যেন আরও একবার প্রমাণ করল—সে যা চায়, তা পেতেই হবে।
ম্যানেজার রায়ানকে সব কাগজ বুঝিয়ে দিয়ে তার সাথে হাত মিলিয়ে বললেন-
“স্যার, এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাইকটা আপনার।”
ম্যানেজার এক স্টাফকে ইশারা করল বাইকটা বের করার জন্য। স্টাফ এগিয়ে এলেও রায়ান এগিয়ে গিয়ে চাবিটা সরাসরি ম্যানেজারের হাত থেকে নিয়ে নিল।
রায়ান (কঠিন কণ্ঠে):

“রায়ান চৌধুরীর বাইকে রায়ান চৌধুরী ছাড়া আর কেউ বসে না। Just tell me how to get it out.”
ম্যানেজার সম্মান মিশ্রিত ভয়ে মাথা নাড়ল। রায়ানের নিজের জিনিসের প্রতি এমন পজিটিভনেস অনেক ছোট থেকেই। সে তার কিছু অন্য কাউকে কখনো দেয় না এবং অন্যেরটা নেয় না। এইটা তার লাইফ রুলস এর একটা।
ম্যানেজার:
“স্যার, এদিকের স্লাইডিং ডোর খুললেই আপনি বাইক চালিয়ে বের করতে পারবেন।”
রায়ান মাথা নাড়তেই বাইকের কালো বডিতে আলো ঝলসে উঠল। ঠিক সেই সময় সে প্রশ্ন করল-

“এখানে কি হেলমেট পাওয়া যাবে?”
ম্যানেজার:
“জি স্যার, অবশ্যই।”
রায়ান আর মাহিরকে হেলমেটের সেকশনে নিয়ে যাওয়া হলো। সারি সারি হেলমেট সাজানো—কিছু স্পোর্টস, কিছু প্রিমিয়াম কালেকশন। রায়ানের চোখ থেমে গেল এক ঝকঝকে কালো হেলমেটের উপর, যেটা শোরুমের মধ্য মণির মতো মাঝে ছিলো। রায়ান একবার বাইক টা দেখে হেলমেটার দিকে তাকালো। রায়ানের মনে হলো দুটো জিনিস খুব সুন্দর ভাবে দুটোকে কমপ্লিমেন্ট করছে।
রায়ান (হালকা হাসি দিয়ে) হেলমেটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল:
“This one. I am taking this one.”
ম্যানেজার সেটি নামিয়ে দিলেন। কিন্তু ঠিক তখনই রায়ানের চোখ আটকালো আরেকটা হেলমেটে—কালো রঙের, তার হেলমেটটার ধাঁচেরই ছোট্ট বিড়ালের কানযুক্ত।
রায়ান (কৌতূহলী ভঙ্গিতে) সেটার দিকে আঙুল তুলে:
“ওটা কী?”
ম্যানেজার হেসে উত্তর দিলেন—
“স্যার, এটা মূলত লেডি বাইকারদের জন্য। একটু স্টাইল আর ফাঙ্কি লুকের জন্য ডিজাইন করা। Surprisingly, এটা আমাদের ওয়ান অফ দ্য বেস্ট সেলিং প্রোডাক্ট। মেয়েরা পছন্দ করে।”
রায়ানের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক মুচকি হাসি ফুটল। চোখে ভেসে উঠল কারও চেনা মুখ। চেনা মুখটা যে তার বউ মিরায়ার সেটা বুঝতে বাকি থাকে না।
রায়ান মিরায়ার মুখ ওই হেলমেটের ভিতর কল্পনা করে ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল-
“Give me that too.”

ম্যানেজার আর দেরি না করে দুইটা হেলমেটই নামিয়ে দিলেন। তারপর বিল হিসেব করে জানালেন মোট মূল্য। একবারও টাকার পরিমাণ জিজ্ঞেস না করে, রায়ান বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছাড়া নিজের কার্ডটা এগিয়ে দিল। এক মুহূর্তেই সব পেমেন্ট শেষ। ম্যানেজার বিলের স্লিপ টা রায়ানের হাতে দিয়ে দিলেন সব কাগজের সাথে।
সব ফর্মালিটি শেষে রায়ান বাইকের চাবি, হেলমেট আর ডকুমেন্ট নিয়ে দাঁড়াল। পুরো শোরুমের ভেতর হঠাৎ যেন চাপা নিস্তব্ধতা নেমে এল—কারণ সবাই বুঝে গিয়েছে, এই মানুষটা অন্যদের মতো নয়।
শরীর জুড়ে এক তীব্র আভিজাত্য, চোখেমুখে কঠোর আত্মবিশ্বাস—রায়ান চৌধুরী তার নতুন কালো দানব (Ducati Panigale V4 R) নিয়ে শোরুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল।

শোরুমের ভারী গ্লাস দরজা খুলে দিল স্টাফরা। চারপাশে ক্রেতা-দর্শকরা থেমে গেল নতুন মালিককে দেখতে। কালো Ducati Panigale V4 R বাইকটা ধীরে ধীরে গ্ল্যামার লাইট থেকে বেরিয়ে আসছিল, যেন এক দানব তার খাঁচা ছেড়ে মুক্তি পাচ্ছে।
রায়ান নিজের কালো গ্লাভস পরে নিল সেটা শোরুম থেকেই প্রভাইড করা হয়েছে। প্রতিটা মুভমেন্ট যেন সিনেমার স্লো-মোশন দৃশ্যের মতো—আত্মবিশ্বাসী, নির্ভীক, একদম অন্য লেভেলের।
রায়ান হ্যান্ডেলে হাত রেখে ইঞ্জিন চালু করতেই শোরুমের সামনে চারপাশ কেঁপে উঠল। তীব্র গর্জনে মনে হচ্ছিল এই দানব বাইক যেকোনো মুহূর্তে রাস্তাকে শাসন করবে। মাহির পাশেই দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্যটা চোখ বড় বড় করে দেখছিল।

রায়ান বাইকটা শোরুম থেকে বার করে বাইকের উপর থেকে
নেমে দাঁড়ায়। আর মাহির এখনো রায়ানকে দেখে যাচ্ছে।
মাহির (উচ্ছ্বাসে):
“দোস্ত, একদম জোস একটা বাইক! তোকে হিরো লাগছে পুরো। আমারই তো চালাতে ইচ্ছে করছে। একটা রাইড দিস প্লিজ।”
রায়ান মাহিরের হাত থেকে নিজের হেলমেটটা নিয়ে মাথায় পড়তে পড়তে হালকা ঠেলা দিল মাহিরের কাঁধে।
রায়ান (ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে):
“ধুর শালা! বউ থাকতে তোকে কেন রাইড দিতে যাবো? আমার এত সুন্দরী বউ থাকতে, তোকে বসাবো নাকি পিছনে?”
মাহির হো হো করে হেসে উঠল। তার রায়ানের এই ব্যঙ্গ গুলো নিজের এনার্জি সোর্সের মতো লাগে।
মাহির:

“তাহলে ওই বিড়াল কানওয়ালা হেলমেটটা তুই তোর বউয়ের জন্যই কিনলি, তাই না?”
রায়ান সানগ্লাস চোখে দিয়ে একপাশ থেকে তাকাল, ঠোঁটে মুচকি হাসি। আবার মাহিরকে ব্যঙ্গ করে বলল-
“না রে, তোর জন্য কিনেছি—বলদ!
বউয়ের জন্য না কিনলে আর কার জন্য কিনব?”
মাহির খিলখিল করে হেসে উঠল, মাথা নেড়ে বলল—
“তোকে না, সত্যি বলছি, কখনও সিরিয়াসলি ধরা যায় না।”
রায়ান এবার সিরিয়াস মুখে তার হাতে বাইকের সব অফিসিয়াল কাগজপত্র আর ব্যাগ ধরিয়ে দিল। আর মিরায়ার জন্য কেনা হেলমেটটা নিয়ে বাইকের হেন্ডেলে রাখল।
রায়ান:

“এগুলো ধর। এগুলো নিয়ে বাড়ি চলে যা। পরে সময় করে তোর কাছ থেকে নিয়ে নেব।”
মাহির অবাক হয়ে কাগজপত্রের ব্যাগ নিল। তার মুখে কিছুই না বুঝতে পারার ছাপ। মাহির অবাক হয়ে-
“তুই কোথায় যাবি?!”
রায়ান তখন বাইকে উঠছে। স্টার্ট বাটনে আঙুল রাখতেই আবার গর্জন করে উঠল কালো দানব। হেলমেটের গ্লাস নামিয়ে দিয়ে রায়ান (সানগ্লাস ঠিক করতে করতে):
“নতুন বাইক কিনেছি। বউকে পিছনে না বসালে, আর বউ যদি ব্যাকপ্যাক হয়ে জড়িয়ে না ধরে, তাহলে ফিলটা পাব কিভাবে? গাধা, তুই বাড়ি যা। আমি বউ নিয়ে বাড়ি ফিরব। বাই!”
কথাটা শেষ করেই সে গিয়ার চেঞ্জ করল। বাইকের একটানে শোরুম থেকে বেরিয়ে গেল। কালো ঝড়ের মতো বাইকটা রাস্তায় ছুটে গেল, চোখের আড়াল হতে এক মুহূর্তও লাগল না। চারপাশের মানুষজন তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে।

রায়ান চলে যেতেই মাহির দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে বাইকের ধোঁয়ার রেখার দিকে তাকাল। তারপর নিজের গাড়ির দরজা খুলে কাগজপত্রের ব্যাগটা পিছনের সিটে ছুড়ে ফেলল। ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বিরক্ত হয়ে নিজের মনে বলল—
“শালার , আজকে একটা বউ নাই বলে বাইকের পিছনে উঠাইতেও পারলাম না । পিছন থেকে বউ জড়িয়েও ধরল না… শালার জিন্দেগি!”
তারপর মাথা নেড়ে বিরবির করতে করতে গাড়ি স্টার্ট দিল।

প্র্যাকটিক্যাল টেস্ট দেওয়ার পর মিরায়া সরাসরি বাসায় ফিরে যাবে ভাবলেও, হঠাৎ মাথার ভেতর এক চিন্তা এলো—
“এখনো তো ক্লাস টাইম আছে, তাহলে বাড়ি কেন ফিরব? বরং আবার ক্যাম্পাসে যাই।”
তারই পরি প্রেক্ষিতে~
রিকশা ঢাবির মূল গেটের দিকে এগোতে থাকল। রাস্তার দুইপাশে সজীব সবুজ গাছ, ছায়াঘেরা পথের ফাঁক দিয়ে দুপুরের মোলায়েম রোদ গায়ে পড়ছে। ক্যাম্পাসের কাছাকাছি এলে মিরায়ার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক স্বস্তি তৈরি হয়। যেন এ জায়গাটা তার দ্বিতীয় বাড়ি।
রিকশা গেটে এসে থামতেই মিরায়া ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল। রিমিকে কল করার জন্য। স্ক্রিনে রিমির নামটা টিপে দিল।

প্রথমবার… বাজলো।
দ্বিতীয়বার… বাজলো।
তৃতীয়বারেও কেউ ধরলো না।
চতুর্থবারের মাথায় অবশেষে কলটা রিসিভ হলো।
ওপাশ থেকে রিমির আমতা আমতা করা কণ্ঠ—
“মিরা… হ্যাঁ, বল।”
মিরায়ার ঠোঁটে অস্থিরতা, একটু বিরক্তিও।
“ তুই কোথায়? আমি তো ক্যাম্পাসে চলে এসেছি। কাজ শেষ হয়ে গেছে।”
প্রায় আধ মিনিট নীরবতা। শুধু ফোনের শ্বাসপ্রশ্বাস ভেসে আসছে। মিরায়া আবার ডাক দিল—
“হ্যালো রিমি? তুই কোথায়? আমি ক্যাম্পাসে চলে এসেছি।”
ওপাশে এবার কণ্ঠটা ভাঙা ভাঙা শোনালো, একটু ক্লান্ত, খানিকটা দম বন্ধ হওয়া সুর—
“মিরা জান… আসলে আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল। তুই তো বললি তোর কাজ আছে, এই বলে চলে গেলি। তোকে ছাড়া ক্যাম্পাসটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। তাই আমিও বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছিলাম। আমি এখন আর ক্যাম্পাসে নেই।”

মিরায়া অবাক। কপালে ভাঁজ পড়লো।
“শরীর খারাপ? কিরে, কী হলো?”
রিমি মৃদু হেসে যেন আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো।
“আরে, তেমন কিছু না। শুধু একটু মাথাব্যথা ছিল। তারপর তুই না থাকায় ক্যাম্পাসটাও মরা মরা লাগছিল। তাই ভাবলাম, বাড়ি চলে যাই।”
মিরায়া এবার একটু হালকা হেসে ফেলল।
“আচ্ছা থাক, কাল তো শুক্রবার। দেখা হবে না। শনিবারেও না। মানে রবিবার পর্যন্ত দেখা নাই।”
তারপর থেমে বলল,
“ঠিক আছে, আমি কারো কাছ থেকে নোটগুলো নিয়ে তোকে পাঠিয়ে দিবো। দোস্ত, তুই সাবধানে বাড়ি ফিরিস।”
রিমি ফোনের ওপাশ থেকে হাসিমুখে বলল,
“ঠিক আছে, দোস্ত। তুইও , বাই।”
ফোনটা কেটে গেল।

ক্যাম্পাসের নীরবতা
মিরায়া একা একা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করল। পথজুড়ে ঝরে পড়া শুকনো পাতার মচমচে শব্দ, ছায়াঘেরা লাল-ইটের বিল্ডিংগুলোর নির্জন রূপ, আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের ছাপোষা ব্যস্ততা—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিবেশ। কিন্তু রিমির অনুপস্থিতি যেন পুরো দৃশ্যটাকে ফাঁকা ফাঁকা করে তুলল।
মিরায়া হেঁটে যাচ্ছিল, কিন্তু তার ভেতরে খালি খালি অনুভূতি কাজ করছিল।
মনে হলো—“আজ আর ক্লাস করব না। বাড়ি ফিরি।”
সেই ভেবেই আবার ক্যাম্পাসের গেটের দিকে পা বাড়ালো।
ঢাবির গেটের বাইরে সাধারণত প্রতিদিনই ফুটপাতজুড়ে বসে ছোট ছোট ফুলের দোকান। লাল, গোলাপি, সাদা, হলুদ নানারঙা ফুলে ভরে থাকে দোকানের সামনে সাজানো টেবিলগুলো। কারো কারো হাতে তৈরি মালা, আবার কোথাও টাটকা গোলাপ গুচ্ছ বাঁধা। একটা মৃদু ফুলের সুবাস বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
মিরায়ার পা হঠাৎই থেমে গেল। চোখ আটকে গেল এক ফুলের দোকানের সামনে। সাজানো সারি সারি গোলাপ যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

সে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালো। আঙুলের ডগায় হালকা ছোঁয়া, নাকে ভরে নিল টাটকা লাল গোলাপের ঘ্রাণ।
চোখ বুজে মুহূর্তটা অনুভব করলো।
তার মুখে প্রশান্তির ছায়া নেমে এলো।
(মিরায়ার ফুলের প্রতি দুর্বলতা কোনো সাধারণ ভালো লাগা না। এটা যেন জন্মগত এক টান। সে তখনও বুঝতো না ফুল আসলে কী—কিন্তু রঙ, গন্ধ, আকার সবকিছুর ভেতরে অদ্ভুত এক আনন্দ খুঁজে পেত)
চট্টগ্রামে নিজের বাড়িতে তার ঘরের বারান্দা ভর্তি ফুলের টব। বাগানে নানা প্রজাতির ফুল গাছ সে নিজে লাগিয়েছিল।

ঢাকায় আসার পর থেকে সেই ফুলগুলোর কথা প্রায়ই মনে পড়ে। তবুও ঢাবির গেটের সামনে প্রতিদিনকার এই ফুলের দোকানগুলো তাকে সামান্য হলেও সান্ত্বনা দেয়।
আজও তাই হলো।
সে ফুলের গন্ধ নিতে নিতে মুচকি হেসে উঠলো।
মনে হলো, যেন ব্যস্ত নগরজীবনের কোলাহল থেকে কিছুক্ষণের জন্য দূরে, অন্যরকম এক প্রশান্তির জগতে এসে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকায় এসে সেই ফুলবন্ধুদের মিস করে, আর সেই কারণেই হয়তো আজ গেটের পাশে দাঁড়িয়ে ফুলের দোকানের সামনে ঝুঁকে টাটকা গোলাপের গন্ধ নিতে নিতে মনের ভেতর শান্তি খুঁজে নিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাইরে এক বিকেলের মৃদু আলো। মিরায়া থেমে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। গোলাপের কাছে ঝুঁকে, নাকে টেনে নিচ্ছিল সুবাস।

তার মুখে প্রশান্তির আভা।
চোখে এক অদ্ভুত কোমলতা।
অন্যদিকে দূর থেকে কালো রঙের সেই দামি, লাক্সারিয়াস স্পোর্টস বাইকটা আস্তে আস্তে ক্যাম্পাসের দিকে এগোচ্ছিল।
বাইকটা চালাচ্ছিল রায়ান।
রাতের খাবারের পর থেকে রায়ান মিরায়াকে দেখেনি। রায়ানের মনে হচ্ছিল বুকের শ্বাস আটকে আছে, একরকম খালি খালি অনুভূতি। বাইকে দূর থেকে ফুলের দোকানের পাশে দাঁড়ানো মিরায়ার লাল কুর্তি, খোলা কালো কোমর পর্যন্ত চুল, আর ঝুঁকে গোলাপের ঘ্রাণ নেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়তেই তার বুকের ভেতর যেন হঠাৎ শান্ত হাওয়ার ঝাপটা লাগলো।
হেলমেটের ভেতর লুকানো মুখে এক প্রশান্ত হাসি খেলে গেল।
রায়ান-

“এটা আমার বউ, না আমার অক্সিজেন কে জানে। এতক্ষণ পর মনে হলো সত্যি শ্বাস নিতে পারছি,” মনে মনে বলল রায়ান।
বাইক ধীরে ধীরে মিরায়ার দিকে এগিয়ে এলো। চোখ আটকে রইল কেবল মিরায়ার উপরেই। তার ঠোঁটে অল্প হেসে ওঠা, বাতাসে চুল উড়ে গিয়ে মুখে এসে লাগা, আর তারপর কানের পিছনে আলতো করে গুঁজে রাখা যায় ফলে দুলছে তার কানের ছোট্ট ঝুমকোটা—সবকিছুই রায়ানের কাছে একেবারে মায়ার মত লাগছিল।
সে মুহূর্তে বাইকের শব্দ পর্যন্ত ধীরে বেজে উঠছিল যেনো।

রায়ানের চোখে কেবল একটাই দৃশ্য—তার হৃদপাখি।
মিরায়া অবশ্য খেয়াল করলো বাইকের আওয়াজ।মাথা তুলে একঝলক তাকাল। কালো হেলমেট পরা রাইডার। চেনা যায় না কে। মিরায়া ভেবেছিল হয়তো কোনো সাধারণ বাইক রাইডার যাচ্ছে।
মিরায়া সকালে রায়ান কি পরে বের হয়েছে সেটা দেখেনি আর এর আগে রায়ানকে কখনো বাইক চালাতেও দেখেনি স্বাভাবিকভাবেই রায়হান বাইকের উপর বসে আছে সেটা তার জন্য অনুমান করা দুঃসাধ্য
কিন্তু মিরায়ার চোখ আটকে গেল বাইকটার উপর। কালো চকচকে বডি, ভারী ইঞ্জিন, অসাধারণ ডিজাইন—এটা ঠিক সেই বাইক যেটার স্বপ্ন মিরায়া বহুদিন ধরে দেখে এসেছে।
মেয়ে হয়েও তার বাইকের প্রতি আলাদা এক টান আছে, কিন্তু নিজেকেই মাঝে মাঝে অবাক লাগে—”এ আসক্তি কেনো?”

আর আজ তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সেই স্বপ্নের বাইক। এক মুহূর্তের জন্য সে বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে রইল বাইক টার দিকে।
মিরায়ার ঠোঁট থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে বেরিয়ে এলো একটা ফিসফিস—
“উফ আল্লাহ… কবে যে আমারও এরকম একটা বাইক হবে…”

রায়ান খুব স্পষ্টই বুঝতে পারছিল মিরায়া তার বাইকের দিকেই তাকাচ্ছে। তবুও মনের ভেতর খুনসুটি খেলে গেল।
সে বাইক একেবারে মিরায়ার কাছে এনে থামালো।
তারপর গভীর, কিন্তু ইচ্ছে করে চেনা না যায় এমন ভঙ্গিতে বলল—
“হেই, বিউটিফুল!”
মিরায়া চমকে তাকালো। সামনে সেই বাইকটা—আর তার উপরে বসা হেলমেট-পরা এক রাইডার।
মিরায়ার মুখে বিরক্তি ভেসে উঠলো।
“আরে ধুর… ফালতু কোনো ছেলে ভেবেছে আমি বাইকের দিকে তাকাচ্ছি, তাই এসে লাইন মারছে।” কি একদিন পড়লো।
সে পাত্তা দিল না। মুখ ঘুরিয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করলো রাস্তার দিকে। কিন্তু রায়ানও ছাড়ার পাত্র না।
আবার বাইক স্টার্ট দিয়ে সামনে গিয়ে মিরার পথ আটকালো।

“এই যে সুন্দরী… তোমার সাথেই কথা বলছি। ওয়ানা গো অন আ রাইড উইথ মি। প্লিজ?”
মিরায়া এবার বিরক্ত হয়ে বাইকের সামনে এসে দাঁড়ালো।
বুকে দুই হাত ক্রস করে ভ্রু কুঁচকে তাকালো হেলমেট-পরা রাইডারের দিকে।
গম্ভীর গলায় বলল—
“এ যে মিস্টার! রাস্তায় যাকে তাকে দেখলেই ‘হেই বিউটিফুল’ ডেকে রাইড শোয়ার করার কথা বলতে ইচ্ছে করে নাকি?”
রায়ান নির্লজ্জের মত হেসে উত্তর দিল—

“যাকে তাকে না… তোমাকেই বলেছি। কজ ইউ আর সো ফাকিং বিউটিফুল।”
মিরায়ার মনে হলো—“নিশ্চয়ই কোনো লাফাঙ্গা ছেলে। এড়িয়ে যাওয়াই ঠিক হবে।”
তাই মিরায়া দৃঢ় গলায় বলল—
“শুনেন মিস্টার, সুন্দরী মেয়েরা বেশি দিন সিঙ্গেল থাকে না। আমিও তার ব্যতিক্রম না। আই এম ম্যারেড। শুদ্ধ বাংলায়—বিবাহিত মেয়ে।”
রায়ান এবার একদম নাটকীয় ভঙ্গি করলো। স্টাইল মেরে হেলমেটের বেল্ট খুলতে খুলতে হেসে উঠল।তারপর গুনগুন করে ধরল ভোজপুরি গান—

“আপনে লাভার কো ধোঁকা দো,
অর মুঝে ভি ডার্লিং মোকা দো…” 🎵
রায়ান হেলমেটটা খুলতেই, মিরায়া একদম হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার চিরচেনা মুখটার দিকে। যেন নিজ চোখে বিশ্বাস হচ্ছে না সে কি দেখতে। মিরায়া আনমনে বলে উঠলো-
“রায়ান ভাইয়া… আপনি!”
মিরায়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। রায়ানের মাথা থেকে বাইকের টায়ার পর্যন্ত পুরো দৃশ্য এক ঝলকে দেখে নিল।
বুকে গেঁথে রাখা হাত দুটো অবচেতনেই খুলে গেল অবাক হয়ে।
ঠোঁট হা হয়ে গেল, চোখ কেবল তাকিয়ে রইল—

“এটা রায়ান…ভাইয়া। বাইক রাইড করছে?” মনে মনে ভাবলো।
রায়ান বাইকে বসেই বুকে হাত বেঁধে হেঁসে মিরায়াকে প্রশ্ন করল-
“কি গো ডার্লিং, মোকা দেবে আমায়?”
মিরায়া যেন প্রশ্নটা শুনলোই না সে সাথে সাথে বাইকে রায়ানের কাছে চলে দিয়ে রায়ান আর বাইক দুটোই পরখ করে দেখতে লাগলো। রায়ান সামান্য অবাক- যেই মেয়ে তার আশেপাশে আসে না। উল্টো সে নিজের থেকে কাছে গেলে দূরে সরে যায়। ওই মেয়েই নিজের থেকে কাছে এসে তাকে দেখছে!”
রায়ান হেঁসে বিড়বিড় করল- “স্ট্রেন্জ! বাট আই লাইক ইট।”
মিরায়া হঠাৎ রায়ানের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলল-
“বাড়িতে তো কখনোই এই বাইক দেখিনি। বাড়িতে তো একটাই বাইক আছে, সেটা তো রুদ্র ভাইয়ার। এটা কোত্থেকে এলো?”

রায়ান বুঝতে পারল মিরায়ার কৌতূহলের জায়গাটা এই বাইক। রায়ান এই সুযোগ নিতে ছাড়বে না বলেই বলল-
“হুম, ছিলো না, তবে এখন থাকবে বেইব। আজই কিনেছি দরকার ছিল তাই।”
মিরায়া রায়ানের দিকে তাকালো না বরং বাইক টাই দেখলো। আর রায়ান একনাগাড়ে মিরায়ার হাসি মুখ দেখে যাচ্ছে। সারাটা সকাল এই মুখটা না দেখে যেন বিষাদের মতো কেটেছে তার। রায়ান মিরায়া হাসি মুখ দেখার পাশাপাশি নিজেও হেঁসে উঠলো।

মিরায়া প্রশ্ন করলো-” এই বাইকটার দাম কত। পারফোরমেন্স, আর স্পিড কেমন?”
রায়ান মিরায়ার কৌতূহলের বিষয়টা বুঝে বলল-
“শোরুমে যাওয়ার পর পছন্দ হয়েছিল তাই কিনে নিয়েছি দাম তো আমি দেখিনি। তবে চালিয়ে যেটা মনে হলো পারফরম্যান্স আর স্পিড দুইটাই ঠিক আছে।”
মিরায়া অবাক হয়ে রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল-
“দাম না যেনে বাইক কিনেছেন?”
রায়ান মাথা নাড়লো-“হুম, ভালো লেগেছিল। আমার ভালো লাগা জিনিস এর দাম হয় না সেগুলো অমূল্য, ঠিক যেমনটা আমার তুমি , আমার প্রিয় হার্ট-বার্ড।”
মিরায়া এবার বাইকের বিষয়টা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বুঝতে পারলো সে খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে রায়ানের। সে দুই পা পিছনে চলে যাবে এমন সময় রায়ান মিরায়ার কোমর আঁকড়ে ধরে আবার নিজের কাছে বাইকের সাথে লাগিয়ে নেয়।
মিরায়া কোমরের উপর থাকা রায়ানের হাতের উপর নিজের হাত রেখে ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
মিরায়া:

“ভাইয়া ছাড়ুন না প্লিজ। আমি ছোঁয়া নিতে পারি না কোমরে। অসহ্য লাগে।”
রায়ান বাঁকা হেঁসে আরো জোরে মিরায়ার কোমর আঁকড়ে ধরলো-
“সহ্য করতে শিখে নেও হৃদপাখি। কারণ আমি সহ্য করতে জানি না।”
মিরায়া চোখ চারপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে একটু কাতর গলায় বলল-
“রায়ান ভাইয়া প্লীজ । এটা ক্যাম্পাস মানুষ দেখছে। ছেড়ে দিন।”
মিরায়ার ঠোঁট কাঁপছে সাথে শরীরও হয়তো সত্যিই বলছে- মিরায়ার শরীর একটু সেনসিটিভ।
রায়ানকে মিরায়ার বন্ধ চোখ, কাঁপতে থাকা ঠোঁট ও শরীর, ভয়ে ভরা চেহারা অনেক বাজে ভাবে আকর্ষণ করছে। রায়ান নিজেকে শান্ত করে মিরায়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল-

“ওকে ছেড়ে দিয়েছি এবার শান্ত হও। আর আমার তিনটা কথা মানো। তাহলে শান্ত থাকতে পারবে না হলে আমি যেমন অশান্ত হয়ে আছি তুমিও তেমনি অশান্ত হবে আমার জন্য।”
মিরায়া ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলল-
“কি সেই তিনটা কথা?”
রায়ান হেঁসে মিরায়ার মাথায় ট্যাপ করলো-
“That’s like my gd girl.”
তারপর নিজের মতো বলল-
“প্রথম- বলো তুমি হলে সিফ্ট করবে না।”

মিরায়া রেগে তাকাতে যাবে তার আগেই রায়ান একটু নড়লো মিরায়াকে বোঝাতে এখন তার কথা না মানলে অপ্রত্যাশিত কিছু হবে। মিরায়াকে সকাল থেকে সবার তাকে এড়িয়ে চলার বিষয়টা কুরে কুরে খাচ্ছিল। নিজেও চাইছিল না বাড়ি ছাড়তে সবার থেকে দূরে তার নিজেরই ভালো লাগতো না। তবু মিরায়া নিচু গলায় প্রশ্ন করল-
“আর যদি বাড়িতে না থাকি, হলে থাকলে কি হবে?”
রায়ান মিরায়ার কানের কাছে ঝুঁকে বলল-
“বাড়িতে তোমার সাথে যা যা হয়নি, সেই সব কিছু হবে। ভেবে দেখ। রাস্তা মানছে না যে লোক সে হলের পরিবেশ মানবে। ব্যাপারটা বেশি কাল্পনিক হয়ে যায় না?”
মিরায়া আতংকে রায়ানের বুকে হাত দিয়ে তাকে পিছনে সরিয়ে দিয়ে বলল-
“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে হলে সিফ্ট করব না।”
রায়ান হেঁসে বলল-

“ফাইন, দ্বিতীয় – নিজের কানের ঝুমকো গুলো খুলে আমাকে দেও। এখনি।”
মিরায়া রায়ানের আবদারে অবাক হলো তবে একজোড়া ঝুমকো তেমন আহামরি কোন ব্যাপার না তাই সে নির্দ্বিধায় কান থেকে ঝুমকো দুটো খুলে রায়ানের হাতে দিয়ে দিল।
মিরায়ার ঝুমকো দুটো হাতে পেয়ে রায়ান কানের পিন থেকে ঝুমকো গুলোকে আলাদা করে নিজের কি-রিং এ ঢুকিয়ে নিল। এই সম্পূর্ণ দৃশ্যটা মিরায়া চোখ বড় বড় করে পর্যবেক্ষণ করলো । রায়ানের মাথায় এমন কিছু আসবে বা করবে সে ভেবে উঠতে পারেনি।

রায়ান নিজের কি রিং এ ঝুমকোদুটো ঢুকিয়ে চাবিটা চোখের সামনে তুলে নিজের আর মিরায়ার মুখের মাঝ বরাবর চাবিটা কয়েক সেকেন্ড ঝাঁকালো। রায়ান মিষ্টি হেঁসে মিয়ারা কে জিজ্ঞেস করল-
“দেখ হৃদপাখি। শব্দটা সুন্দর না? উফ্! বুকে লাগার মতো।”
মিরায়া রায়ানের কথা হা করে শুনে ঢোক গিললো তার মাথায় ধরছে না একটা মানুষ এমন পাগল কিভাবে হয়। বিবাহিত একটা মেয়ের জন্য এমন করছে।
রায়ান মিরায়ার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে মিরায়ার মনোযোগ তার দিকে ফিরে বলল-
“তৃতীয় কথাটা বাকি বেইবি।”
মিরায়া চমকে উঠে বাস্তবে ফিরে এলো। এখন যেন রায়ানের এমন অদ্ভুত ডাক শোনা অভ্যাস হয়ে গেছে তাই আর পাত্তা না দিয়ে বলল-

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৮

“হুঁ, বলুন।”
রায়ান বাইকের হ্যান্ডেল থেকে বিড়াল কানওয়ালা হেলমেটটা মিরায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
“তৃতীয় – কাছে এসো এটা পড়ি দিচ্ছি। আজ আমার সাথে বাইকে বাড়ি ফিরবে। আমার নতুন বাইকের প্রথম উদ্বোধন। পিছনের সিটে তোমার থেকে ভালো ব্যাকপ্যাক আর কাউকে মনে হচ্ছে না। তোমার শরীর অনুযায়ী একদম পারফেক্ট- লাইট ওয়েট।”
মিরায়া আচমকা এমন কথা শুনে-
“কিহ্! আ.. আমি? আপনার সাথে? বাইকে? তাও আবার এই হেলমেট পড়ে?”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here