আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩০

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩০
অরাত্রিকা রহমান

বিকাল~৪টা
বিকেলের সময়। চারপাশে রোদ ম্লান হয়ে আসছে। আকাশের হালকা কমলা আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে গলে গলে পড়ছে। রাস্তার দু’পাশে ছায়া লম্বা হয়ে গেছে। বাতাসে একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ছোঁয়া আছে, যা বাইকের গতির সাথে মিশে মুখে এসে লাগছে। রায়ান নিজের হাতের ঘড়িতে দেখলো ৪টা বাজছে।
রায়ান স্বাভাবিক গতিতে বাইক চালাচ্ছে—না খুব দ্রুত, না খুব ধীরে। তার হাত দৃঢ়ভাবে হ্যান্ডেলে রাখা, চোখ সামনে। কিন্তু মনোযোগের অর্ধেকই পিছনের সিটে বসা মেয়েটার দিকে। মিরায়া নিঃশব্দে বসে আছে, রায়ানের কাঁধে হালকা হাত রেখে। যেন এই নীরবতা দুইজনের মাঝে অনেক কিছু বলে দিচ্ছে।

রায়ান এমন নীরবতা আর নিতে না পেরে হঠাৎ বাইকের আয়নায় তাকাল পিছনের পরিবেশ বুঝতে। আয়নার ভেতর মিরায়াকে দেখা যাচ্ছে। মিরায়া গলার একটু বাঁ দিক উঁচু করে মাথা কাত করেছে, চোখ যেন দূরের কোনো দৃশ্যে আটকে গেছে। ঠোঁটে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে আছে—একেবারে অবচেতন হাসি, যে হাসি মানুষ তখনই দেয় যখন সত্যিই মুগ্ধ হয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রায়ানের চোখ কৌতূহলী হয়ে উঠল। সে ভাবলো—মিরা কী দেখছে? সেও চোখ ঘুরিয়ে মিরায়ার দৃষ্টিপথ অনুসরণ করল। রাস্তার বামদিকে একটা বাড়ির আঙিনায় লাল রঙের রঙ্গন ফুলে ভরা একটা গাছ দুলছে বিকেলের হাওয়ায়। ফুলগুলো যেন আগুনের ছোট ছোট প্রদীপের মতো ঝলমল করছে।
রায়ান মিরায়ার দৃষ্টি আকর্ষণের কারণে বুঝতে পারলো। সে বিন্দুমাত্র দেরি না করে বাইকের ব্রেক চেপে ধরল। হঠাৎ থেমে যাওয়া বাইকে চমকে গিয়ে মিরায়া সামনের দিকে হেলে রায়ানের কাঁধ শক্ত করে ধরে নিল আর তার বুক হালকা ধাক্কা খেল রায়ানের পিঠে।

—“কি হলো? এভাবে থামলেন কেন? রাইড করতে খারাপ লাগছে?” – মিরায়া চমকে উঠল।
রায়ান একদম গম্ভীর গলায় বলল—“নামো।”
—“কি?” – মিরায়ার অবাক দৃষ্টি।
—“নামতে বলছি। বাইক থেকে নামো।” রায়ান মিরায়াকে স্পষ্ট করে বলল।
মিরায়া অভিমানী মুখে চুপচাপ বাইক থেকে নেমে গেল। রায়ানও বাইক স্ট্যান্ড করে নামল। কয়েক মুহূর্তের জন্য দুজনেই নীরব। তারপর হঠাৎ রায়ান মিরায়ার দিকে ফিরে মুচকি হেসে বলল—“জাস্ট এ মিনিট, হার্টবার্ড।”
এতটুকু বলেই দৌড় দিল সে ওই বাড়ির গেটের দিকে। মিরায়া দূর থেকে বিস্মিত হয়ে দেখতে লাগল। মনে মনে বিড়বিড় করল— “উনি কোথায় যাচ্ছেন ওই দিকে? ওই বাড়ির কাউকে চেনেন নাকি?” আবার নিজেই ভ্রু কুঁচকে বলল— “আমার কি, যেখানে মন চায় যাক।” মিরায়া তারপর নিজের দৃষ্টি বাইকের উপর আনলো। আর বাইক টাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।
রায়ান ততক্ষণে গেটের বয়স্ক দারোয়ানের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

—“আসসালামু আলাইকুম চাচা, ভালো আছেন?” রায়ান ভদ্রতার সাথে বলল।
দারোয়ান চাচা ভালো মতো হেঁসে জবাব দিল-
—“ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভালো আছি। আপনি কে?”
—“আপনি আমাকে চিনবেন না চাচা, আসলে একটু সাহায্য লাগবে।” রায়ান একটু নরম ভাবে বলল।
দারোয়ান কৌতূহলী হয়ে বলল—“কি সাহায্য?”
রায়ান হেসে মিরার দিকে আঙুল দেখাল—“ওই যে আমার বউ। ওর ফুল খুব পছন্দ। এই বাড়ির ওই রঙ্গন ফুলগুলো (মিরায়ার থেকে আঙ্গুল সড়িয়ে ফুলের দিকে আঙুল তুলে) ওর ভালো লেগেছে। যদি কিছু মনে না করেন, আমি কি একটা ফুল নিতে পারি?”

দারোয়ান প্রথমে মুচকি হাসল—“ফুল তো কিনেও দিতে পারেন বাবা।”
রায়ান হালকা মজার ভঙ্গিতে উত্তর দিল——“চাচা, বউয়ের চোখে পড়া ফুলটা আলাদা। সেই ফুলই লাগবে। ভাবুন তো, ফুলটার ভাগ্য—আমার বউয়ের চোখ পড়েছে সেটার উপর যেখানে তার চোখ আমার উপরই পড়ে না!”
দারোয়ান হেসে উঠল—“আচ্ছা, দাঁড়াও বাবা। আমি ফুলটা ছিঁড়ে দিচ্ছি।”
রায়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল—“না চাচা, বউয়ের জন্য ফুল আমি নিজেই ছিঁড়ব।”
দারোয়ান খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বললেন—“যাও বাবা, ছিঁড়ো। তোমাদের দুজনের জন্য দোয়া রইল। মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী তোমার মতো বর পেয়েছে। এভাবেই ভালোবেসো তাকে সবসময়।”
রায়ান প্রতিবাদের সুরে বলল- “কি যে বলেন চাচা। ভাগ্যবান তো আমি যে তাকে পেয়েছি। এইটা দোয়া করেন যেন সে আমাকে মেনে নেয়, এই অনেক হবে আমার জন্য।”

দারোয়ান আবারো হেঁসে উঠলেন। রায়ান দ্রুত ফুল ছিঁড়ে নিলো, তারপর দারোয়ান চাচাকে ধন্যবাদ বাদ জানিয়ে, ফুল হাতে নিয়ে দৌড়ে এল মিরায়ার সামনে। মিরায়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। একবার রায়ান আর একবার ফুলটা দেখল। আর মনে মনে বলল—“আমি তো কেবল ফুলটা দেখছিলাম, উনি কিভাবে বুঝলেন?”
রায়ান হাত বাড়িয়ে দিলো মিরায়ার দিকে—“নাও।”
মিরায়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করল—“এটা…এটা আমার জন্য?”
রায়ান হালকা গলায় উত্তর দিলো—“না, আমার বউয়ের জন্য।”
মিরায়া স্পষ্ট শুনতে পেল না—“কিছু বললেন?”
রায়ান গোপন হাসি চাপতে চাপতে বলল—“কিছু না। হ্যাঁ, তোমার জন্যই। তুমিই তো ফুলটা দেখছিলে, তাহলে আর কার জন্য আনব?”

মিরায়া ফুলটা হাতে নিয়ে মিষ্টি হেসে একটু না চাইতেই শুনানোর জন্য বলল—“দেখেছি তো কি হয়েছে, তাই বলে কি সেটা এনে দিতে হবে?”
রায়ান বাঁকা হেসে মিরায়ার কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল—
“বেইব, জাস্ট লুক এট সামথিং ইউ ওয়ান্ট। আই উইল মেক সিওর দ্যাট থিং উইল বি ইয়োরস উইথ ইন আ সেকেন্ড।”
তারপর মৃদু ঠোঁট ছুঁয়ে দিল মিরায়ার কানের পাশে। মিরায়া এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেলল রায়ানের স্পর্শ তার শরীরে কাঁটার মতো শিহরণ দিচ্ছে। আবার চোখ মেলে বড় বড় করে তাকাল। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ঝড় বয়ে গেল।
মিরায়ার মনে কথাগুলো ঝড় তুলল—“কেন আমি এই মানুষটার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি? কেন এই অদ্ভুত মোহ কাজ করছে? এটা কি ঠিক?”

রায়ান আবার ঝুঁকে এসে হাসি দিয়ে বলল—“আমাকে এত দেখতে হবে না, ম্যাডাম। আই এম অলরেডি ইয়োরস ফ্রম দ্যা ভেরি বিগিনিং, মাই লিটল হার্টবার্ড।”
মিরায়ার বুক কেঁপে উঠল। সে কথাটা এড়িয়ে দ্রুত বলল—“আপনার চুলে ফুল পড়েছে।”
আসলেই, যখন রায়ান ফুল ছিঁড়ছিল, তখন একটা ছোট রঙ্গন ফুল চুলে আটকে গিয়েছিল। রায়ান মাথা একটু সামনে এগিয়ে দিল। যেন বুঝালো মিরায়াকে ফুলটা তার চুল থেকে সরাতে। মিরায়া বুঝতে পেরে কাঁপা কাঁপা আঙুলে ফুলটা সরিয়ে দিল।

রায়ান সোজা হয়ে সেই ছোট ফুলটা মিরায়ার হাত থেকে নিয়ে মিরায়ার হেলমেটে গুঁজে দিল। মিরায়া নির্বাক হয়ে রইল। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। রায়ানের এমন যত্ন তার শখের পুরুষের প্রতিচ্ছবি তবে সে মানতে নারাজ।
রায়ান একটু দূরে সরে মিরায়াকে পা থেকে মাথা অব্দি একবার চোখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল—“পারফেক্ট ফুল।”
মিরায়া মৃদু স্বরে তার হাতের ফুল টা ধরে বলল—“হুঁ, খুব সুন্দর ফুলটা।”

রায়ান হেঁসে আবার মিরায়ার দিকে এক পা এগিয়ে এসে চোখ টিপে বলল—“আমি তোমার ফুলের কথা বলিনি, হৃদপাখি। আমি আমার ফুলের কথা বলেছি। আমার পার্সোনাল ফুল তোমার ফুলটার থেকে আরো সুন্দর।”
মিরায়ার মুখ শুকনো হয়ে গেল—“এই লোকটার সাথে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো।”
রায়ান হঠাৎ আঙুল ছিটকে একটা তুরি বাজিয়ে বলল—“এত কি ভাবছেন ম্যাডাম? চলুন।”
—“কোথায়?”
—“অজানাতে।” রায়ান হেঁয়ালি করে বলল।
রায়ান বাইকে উঠে পড়ল। ইগনিশনে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল—“বসবে না, চলে যাবো?”
মিরায়া হকচকিয়ে এসে বাইকে বসল। রায়ান হেসে গতি বাড়িয়ে দিলো। বিকেলের হাওয়ার সাথে তাদের যাত্রা আবার শুরু হলো অজানা গন্তব্যের পথে…

একই সময়~ অন্যদিকে
কলেজ শেষে বাড়ি ফিরেই সোরায়া নিজের রুমে উঠে যায়। ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রুমের এক কোণে রেখে। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে, দ্রুত ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছিল। ঠান্ডা পানিতে মুখ ধোয়ার সাথে সাথে সারাদিনের ধুলো আর ক্লান্তি কিছুটা কেটে যায়।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েই সে সোজা খাটের পাশে রাখা ফোনটা হাতে তুলে নিল। ফোনটা খোলার সাথে সাথে চোখ সোজা চলে গেল ফেসবুক নোটিফিকেশনের দিকে। তার বুকের ভেতর হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করতে লাগল।

“মাহির স্যার কি আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে …?”
তার চোখে একফোঁটা প্রত্যাশার আলো—কিন্তু স্ক্রল করে দেখতেই বোঝা গেল এখনো অ্যাকসেপ্ট হয়নি। সাথে সাথেই তার ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগতে শুরু করল। সে খাটে বসে ধপ করে ফোনটা কোলে ফেলে দিল। ঠোঁট কামড়ে নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল—
“উফফ… এখনো করেনি। কেমন করে দেখবে রিকোয়েস্টটা? হয়তো অনেক নিচে চলে গেছে। দিনে কত মেয়েই তো হয়তো ওনাকে রিকোয়েস্ট পাঠায়… আমি তাদের মাঝে কোথায় চোখে পড়ব?”

তার চোখে হালকা নিরাশার রেখা ভাসল, কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে মুখটা উজ্জ্বল করল। আবার ফোন হাতে তুলে নিল। এবার সে দৃঢ়ভাবে বলল—
“না… আমি আরেকবার পাঠাই রিকুয়েস্ট। আগেরটা কেটে দিয়ে আবার পাঠাই, তাহলেই হয়তো খেয়াল করবে।”
সোরায়া তাড়াহুড়ো করে পুরনো রিকোয়েস্টটা ডিলিট করল। এক মুহূর্তের জন্য বুক কেঁপে উঠল—যদি এবারো না করে? তবু সাহস করে আবার মাহিরের প্রোফাইল ওপেন করল, সেই পরিচিত ছবিটা দেখে নিঃশ্বাস আটকে এলো। আবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল।

খান বাড়ি~
অন্যদিকে মাহির ঠিক তখন বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে। বিকেলের শেষ ঘনিয়ে এসেছে, আকাশে লালচে আঁধার মিশছে। সে জুতা খুলে বসার ঘরে ঢুকল, ব্যাগটা একপাশে ছুঁড়ে রাখল। সারাদিনের ক্লান্তি মুখে স্পষ্ট। মাথা ধরে আছে, চোখ আধবোজা।
সে সোফায় শরীর এলিয়ে দিল, একপাশে কাত হয়ে হাতটা কপালে রাখল। মুখ থেকে ক্লান্ত কণ্ঠে বের হল—
“আহ্… মাথাটা কেমন ঘুরছে।”
এমন সময় তার মা সীমা খান ভেতর থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত নিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ালেন। স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন—
“কিরে শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
মাহির গ্লাসটা নিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিল। ঠান্ডা শরবতের টক-মিষ্টি স্বাদ জিভে ছড়িয়ে গেল। তারপর মৃদু গলায় উত্তর দিল—

“না তেমন না… একটু মাথা ধরেছে। কলেজের পর আবার রায়ানের সাথে বাইকের শোরুমে গিয়েছিলাম তো… অনেক শব্দ ছিল… হয়তো এজন্য মাথাটা ব্যথা করছে।”
সীমা খান ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপরে সোফার টেবিলের উপরে রাখা ফোনটায় চোখ পড়ল। ঠিক তখনই ফোনের স্ক্রিনে একটা নোটিফিকেশন ভেসে উঠল।
“Friend request from ‘Jannatul Rahman Soraya”
সীমা খান ভুরু কুঁচকে ফোনটা হাতে তুলে নিলেন। নামটা পড়ে মুখে কৌতূহলী হাসি ফুটল। তিনি মজা করে বললেন

“কিরে, কে কি পাঠাচ্ছে তোকে? কোনো পরিচিত মেয়ে নাকি? নামটা আমার শোনা মনে হচ্ছে”
মাহির চোখ খুলে বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোনটা মায়ের হাত থেকে নিল। মুখ বাঁকিয়ে বলল—
“উফফ আম্মু! সবসময় শুধু মেয়ে, মেয়ে, মেয়ে…তোমার অন্য কিছু নিয়ে ভাবার নেই?”
সে ফোন আনলক করল, নোটিফিকেশন চেক করতেই আবার সোরায়ার নাম দেখল। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হলো। “উফ্! এই মেয়েটা আবারও?” ভেতরে ভেতরে এমন ভাবল।
কিন্তু সীমা খান একদম চুপ করলেন না। হঠাৎ করেই হাত বাড়িয়ে ফোনটা আবার নিয়ে নিলেন। স্ক্রিনে Accept বাটনে চাপ দিলেন।

“Friend Request Accepted.”
মাহির বিস্ময়ে চমকে উঠল। হাত বাড়িয়ে ফোনটা আবার কেড়ে নিয়ে চোখ বড় বড় করে মায়ের দিকে তাকাল।
“আম্মু! এটা কি হলো? তুমি আমার ফোনে না জেনে না শুনে কাউকে কেন ফ্রেন্ডলিস্টে এড করলে?”
সীমা খান হেসে উত্তর দিলেন—
“না জেনে না শুনে কোথায়! ওটা একটা মেয়ের আইডি ছিল। একটা ছেলের আইডিতে মেয়ে ফ্রেন্ড থাকবে না তো কি ছেলে ফ্রেন্ড থাকবে?”
মাহির হকচকিয়ে গেল। বিরক্ত স্বরে বলল—

“আম্মু! তুমিই তো ছোটবেলায় আমার ফোন চেক করতে—কোন মেয়ের নাম্বার আছে কিনা, বা কোন মেয়ে ফ্রেন্ড লিস্টে আছে কিনা সেটা খুঁজতে। আর আজ তুমি নিজেই মেয়ের আইডি দেখে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে এড করছো?”
সীমা খান রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন—
“মেয়েদের থেকে বাঁচানোর বয়স নেই তোর এখন আর। এখন পারলে কোন মেয়ের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পর, গাধা! তাহলে আমি বেঁচে যাই। মাঝে মাঝে নিজেরই আফসোস হয়, কেন যে তোকে অতিরিক্ত শাসনে বেঁধে রেখেছিলাম। ওরকম না করলে আজকে আমারও ছেলের বউ থাকতো। ধুর ধুর!”
মাহির দাঁড়িয়ে রইল হতবাকের মতো। ফোনের স্ক্রিনে সোরায়ার নাম জ্বলজ্বল করছে। তার বুকের ভেতরে লজ্জা, রাগ আর অদ্ভুত কৌতূহল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

সোরায়ার রুমে~
এদিকে সোরায়ার রুমে অন্য এক চিত্র। শব্দ শুনে হোরায়রা যখন ফোনটা হাতে নিল, দেখল “Friend Request Accepted” নোটিফিকেশন!
তার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে উঠল আনন্দে। মুহূর্তেই খুশির চিৎকার চাপা দিল মুখে হাত দিয়ে। তারপর খাটের ওপর লাফিয়ে উঠল। হাত-পা ছুড়ে ছুড়ে নাচতে লাগল, চুল ছিটকে পড়ছে মুখে, তবু খেয়াল নেই।
সে বিছানার ওপরে উঠে ঘুরতে লাগল, যেন ছোট্ট বাচ্চা। মুখে হাসি, চোখে পানি জমে উঠেছে আনন্দে। ফিসফিস করে নিজের মনে বলল—

“আল্লাহ! অ্যাকসেপ্ট হয়েছে! সত্যি হয়েছে! মাহির স্যার… আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন এখন !”
সে ফোনটা বুকে চেপে ধরল। আবার স্ক্রিনে মাহিরের প্রোফাইল খুলে দেখল। প্রতিটা ছবি একে একে খুলছে, মুখে এক অদ্ভুত লাজুক হাসি। হঠাৎ আবার খাটের ওপর দাঁড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। তার আনন্দে পুরো ঘর কেঁপে উঠল।
সোরায়ার আর কোনৌ হুস নেই , তখন নিজের খুশির দুনিয়ায় ডুবে গেছে সে—শুধু খাটের ওপর দাঁড়িয়ে হাত পা ছুড়ে ছুড়ে ছোট্ট নাচে মেতে উঠেছে।
এদিকে মাহির বুঝে পাচ্ছে না সে কি আবার আন-ফ্রেন্ড করে দেবে সোরায়াকে? সেটা করলে কি বেশি খারাপ হয়ে যাবে।”

মাহির কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বিরক্তিতে নিজের রুমে চলে যায় আর বিছানার উপর ফোনটা ছুড়ে ফেলে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
সোরায়া নিজের খুশি সামলে খাটে বসে পড়ে আর মনে মনে ভাবতে থাকে-“রিকুয়েস্ট যেহেতু একসেপ্ট করেছেন তার মানে যদি মেসেজ দেই সেটারও রিপ্লাই আসার সম্ভাবনা আছে। আমি কি একটা মেসেজ দিয়ে দেখব!”
সোরায়া নিজের সাথে কথা বলে হাজারো দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ার পর শেষমেষ মাহির কে একটা ম্যাসেজ পাঠায়-
“আসসালামুয়ালাইকুম স্যার, আমি সোরায়া।কলেজে আজকের কথা হয়ে ছিল সে।”
সোরায়া বার বার একটু পর পর থেকে করছে মেসেজ সিন হয়েছে কিনা কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। সোরায়া নিজের ম্যাসেজটা আন-সেন্ড করে। আর আবার অন্য ম্যাসেজ লিখে।

-“স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে আবার আন-সেন্ড করে। তার মাথায় আসছিল না কিভাবে কথা বলা শুরু করবে। জীবনে প্রথম কাউকে ভালো লেগেছে তাও আবার স্যারকে। তবে তার এইভাবে সব কথা ম্যাসেজের মাধ্যমে বলে আবার ডিলিট করতে মজা লাগছিল তার মনে হচ্ছে সে মাহির কে তার মনের সব কথা বলতে পারছে তবে সেটা মাহির জানতে পারছে না।

সোরায়ার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি ঘুরতে থাকে হঠাৎ সে ঠিক করে মাহির কে সে তার মনের কথাও বলে এইভাবে আন-সেন্ড করে দিলে আরো মজা লাগবে। যেই ভাবা সেই কাজ- সোরায়া মাহির এর উদ্দেশ্যে লিখতে শুরু করে-
“প্রথম দেখাতে আমি প্রেমে পরেছি আপনার। আপনাকে ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না এখন। কলেজ দুইদিন বন্ধ যাবে কিভাবে থাকবো এই দুইদিন কে জানে। আমি জানি আপনি ম্যাসেজটা দেখছেন না হয়তো দেখবেনও না। তাই বলছি। আমি সত্যিই খুব করে প্রেমে পড়ে গিয়েছি স্যার।”

সোরায়া মেসেজটা সেন্ড করে। তারপরও মুহূর্তেই যখন মেসেজটাকে আনসেন্ড করতে যাবে তখন অতিরিক্ত উৎসাহিত হয়ে ডিলিট ফর এভরিওয়ান এর জায়গায় ডিলিট ফর ইউ তে চাপ লেগে যায়। আর মেসেজটা শুধু সোরায়ার দিকে থেকেই ডিলিট হয়ে মাহির এর দিকে ম্যাসেজটা দৃশ্যমান। তবে সোরায়া সেটা বুঝতে পারি নি যে তার আঙুল ভুলে অন্য জায়গায় লেগেছে।
সোরায়া ভাবলো ম্যাসেজটা আর নেই। সে মাহির কে চুপিচুপি নিজের মনের কথাটা বলতে পেরে বেশ খুশি অনুভব করতে থাকে। আর পরে ফোনটা রেখে নিজের বালিশটাতে মুখ চেপে লজ্জায় হাসতে থাকে।

মাহির ফ্রেশ হয়ে এলো। সে জামাকাপড় পড়ে নিয়েই বিছানায় ধেয়ে ফোনটা ঘাটতে লাগলো। তবে ম্যাসেঞ্জার এ আর ঢুকলো না। সচরাচর সে ম্যাসেজ দেখে না। কারণ অনেকে শুধু শুধু ম্যাসেজ দিয়ে বিরক্ত করে। মাহির ফোনের সব নোটিফিকেশন ক্লিয়ার করে বিছানা থেকে উঠে ল্যাপটপে কাজ করতে বসে। শিক্ষকতা তার নিজস্ব পরিচয় তবে সে পাশাপাশি বাবার বিজনেস ও সামলায়। এরপর সে নিজের কাছেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর সোরায়ার নিজের মনের কথা প্রকাশ করার ম্যাসেজটা ওইভাবেই পরে রইলো মাহিরের রিপ্লায়ের আশায় থাকা হাজারো ম্যাসেজের সাথে।

বিকেলের নরম আলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গিয়ে চারপাশে সন্ধ্যার আবেশ নেমে এসেছে। আকাশটা আধো অন্ধকার আধো আলোতে এক অদ্ভুত রঙে রঙিন, হাওয়ার মাঝে হালকা ঠান্ডা ভাব। রাস্তার বাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠছে, চারপাশে শহরের ব্যস্ততা জমে উঠছে। এর মাঝেই রায়ানের বাইক ছুটছে মসৃণ রাস্তায়—হেলমেটের ভেতর দিয়ে তার চোখে যেন খেলা করছে দুষ্টুমির ঝিলিক।
মিরায়া চুপচাপ বসে বাইকের পেছনে। প্রথমে মনে হচ্ছিল ওরা বাড়ির দিকেই ফিরছে, কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই খেয়াল করল রাস্তা একেবারেই আলাদা। চারপাশের পরিবেশ চেনা নয়। অস্থির হয়ে সে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বলল—

মিরায়া (চমকে): “এমা… আপনি এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? বাড়ির রাস্তা তো পিছনে ফেলে এলাম।”
রায়ান ঠোঁটের কোণে এক দুষ্টু হাসি টেনে দিল।
রায়ান (ঠাট্টার ছলে): “তুমি এখন বাড়ি ফিরছ না।”
মিরায়ার চোখ কপালে উঠল।
মিরায়া (হকচকিয়ে): “মানে? বাড়ি ফিরছি না… তাহলে কোথায় যাচ্ছি?”
রায়ান হালকা হেসে বাইকটা আরও স্পিডে দিল।
রায়ান: “কেন, আমি যেখানে যাচ্ছি, সেখানে যাচ্ছো।”
মিরায়ার বুকের ভেতর কেমন যেন ধকধক করতে লাগল। সে অস্থির কণ্ঠে বলল—
মিরায়া: “আপনি… আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
রায়ান মিরায়ার ভয় দেখে মজা পেল। কণ্ঠে ঠাট্টার রঙ মিশিয়ে বলল—
রায়ান: “বিউটিফুল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছি সেটা না হয় গেলে দেখবে। এত ভয় যখন মনে কাজ করে, তখন চেনা নেই জানা নেই এমন কারো বাইকে উঠতে গেলে কেন? আমি একটা ছেলেমানুষ—কখন মন বদলে যাবে, কী করে বসবো—সেটার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?”

রায়ানের কথা শুনে মিরায়া হতভম্ব। বুক শুকিয়ে এলো, মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ বসে রইল। ভয় আর অস্থিরতায় আচমকাই তার হাত রায়ানের কাঁধে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
রায়ান সেই স্পর্শের চাপ টের পেয়ে জোরে হেসে ফেলল—
মিরায়া রায়ানকে হাসতে দেখে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো-
“আপনি হাসছেন কেন?”
রায়ান (হাসতে হাসতে): “তোমার কাজেই হাসছি আমার বোকা হার্ট-বার্ড। এইযে, আমাকেই ভয় পাচ্ছো, আবার ভয় কাটানোর জন্য আমাকেই শক্ত করে ধরছো। হাউ কিউট!”
রায়ানের কথা শুনে মিরায়া লজ্জা আর অভিমানে তার হাত সরিয়ে নিল কাঁধ থেকে। মুখটা গম্ভীর। রায়ান ওটা সহ্য করতে পারল না। মুহূর্তেই গিয়ার চেঞ্জ করে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিল। হঠাৎ ধাক্কায় ব্যালেন্স রাখতে না পেরে আবারও মিরায়া তাড়াহুড়ো করে আবার রায়ানের কাঁধ আঁকড়ে ধরল। এবার ভেতরে ভেতরে রাগে মনে মনে গালি দিল—

মিরায়া (মনে মনে): “অসভ্য লোক একটা!”
রায়ান তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি চেপে রাখল। চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক খেলে গেল। বাইক ছুটে চলল শহরের ভিড়ের দিকে।
কিছুক্ষণ পর এসে দাঁড়াল এক বিশাল শপিং কমপ্লেক্সের সামনে। চারদিকে মানুষের ভিড়, উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে চারতলা বিল্ডিংটা।
রায়ান ব্রেক কষে বাইক থামাল। হেলমেট খুলে মিরায়ার দিকে ঘার ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল—
রায়ান: “নামো এবার।”
মিরায়া চারপাশ দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলল।
মিরায়া (অবাক হয়ে): “এটা… আমরা কোথায় এলাম?”
রায়ান চোখ টিপে হেসে উত্তর দিল—
রায়ান: “আগে বাইক থেকে তো নামো বলছি।”
মিরায়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাইক থেকে নেমে এলো। তার ভেতরে এখনো কৌতূহল আর হালকা ভয় মিশে আছে। রায়ান এবার গম্ভীর ভঙ্গিতে মিরায়ার দিকে তাকালো-
রায়ান: “হার্ট-বার্ড, তুমি এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াও। আমি বাইকটা পার্ক করে আসছি। ওয়েট ফর মি হিয়ার। একটুও নড়বে না, ওকে?”

মিরায়া মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে হ্যাঁ সূচক ভঙ্গি করল।
রায়ান সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, তারপর বাইক নিয়ে পার্কিং লটে ঢুকে গেল। আর মিরায়া দাঁড়িয়ে রইল বিশাল শপিং কমপ্লেক্সের সামনে, চারপাশে মানুষের ভিড়, আলো-ঝলমল পরিবেশের মাঝে বুকের ভেতর ধুকপুকানি নিয়ে—”রায়ান ভাইয়া এটা আমাকে কোথায় নিয়ে এলো? মানুষের হাতে এত শপিং ব্যাগ দেখে তো শপিং কমপ্লেক্স মনে হচ্ছে। হয়তো তাই হবে।”
মিরায়া চুপ চাপ ভঙ্গিতে একটু হেঁটে এগিয়ে গিয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলো। শপিং কমপ্লেক্স এর পরিবেশ টা সন্ধ্যার পর বেশ আকর্ষণীয় লাগছিল। চারদিকে লাইটস জ্বলছে। বাচ্চারা খেলা করছিল মিরায়া সেই দৃশ্য দেখেই মজা নিচ্ছিল।

হঠাৎ মিরায়ার চোখ পড়লো মার্কেটপ্লেসের ভিতরে একটা কফি শপ ও আছে। সেখানে বেশ নিরিবিলি পরিবেশ। মিরায়া চোখ ঘোরাতেই দেখলো রিমির মতো দেখতে কাউকে। মিরায়া নিজের মনে মনেই বলে উঠলো-
“ওটা রিমি না? আমি কি ভুল দেখছি? রিমির মতোই তো লাগছে। কিন্তু ও যে বলল বাড়ি চলে গেছে।”
মিরায়া আরো একটু সামনে গিয়ে চোখ পরিষ্কার করার জন্য একটু গলে নিয়ে আবার তাকায় রিমির দিকে। রিমি আর রুদ্র একসাথে খাচ্ছিল। রিমিকে খেতে দেখে মিরায়া একটু শব্দ করেই বলল-
“আরে রিমিই তো ওটা‌। কিন্তু সাথে কে? কার সাথে বসে খাচ্ছে।”

একটা ফুলের টব এর জন্য রিমির বিপরীতে কে বসে আছে সেটা দেখতে পাচ্ছিল না। অনেক ভাবে দেখার চেষ্টা করল তবে পারলো না। মিরায়া অভিমানী গলায় বলল-
“রিমি কি তাহলে প্রেম করছে করো সাথে? অথচ আমাকে কিছুই বলে নি। একবার দেখা হক খালি বুঝাবো আমাকে মিথ্যা বলার ফল কি। আরে বাবা, তোর বয় ফ্রেন্ড আছে আমাকে বললে কি এমন হতো। আমি কি তোকে ব্রেক-আপ করাতাম নাকি।”
মিরায়া বেশ রেগে রিমি আর রুদ্র কে দেখছিল কিন্তু রুদ্রর চেহারা সামনে আসছে না কোনোভাবেই।

রায়ান বাইক পার্ক করতে পার্কিং লটে গেলে সে বাইক পার্ক করে বের হওয়ার সময় তার পরিচিত একটা গাড়ি দেখতে পায়। রায়ান বিরবির করলো মনে-
“গাড়িটা দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে।”
রায়ান গাড়িটা কাছে গিয়ে দেখতেই বলে উঠলো-
“এইটা তো রুদ্রর গাড়ি মনে হচ্ছে। হ্যাঁ এটা তো রুদ্রর গাড়িই এই তো রুদ্রর আগের বেন্ড এর স্টিকার। তার মানে রুদ্র এইখানে এসেছে।”
রায়ান নিজের ফোনটা বের করতে করতে বলল-
“একটা ফোন করে দেখি।”

এই বলে রায়ান রুদ্রর ফোনে কল লাগায় আর বাইরে মিরায়ার কাছে যাওয়ার জন্য বের হয়।
রুদ্র আর রিমি পাস্তা খাচ্ছিল কথা বলতে বলতে। দুইজনের ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। রুদ্রর ফোনটা বেজে উঠলো সামনে রায়ানের নাম্বার টা- ভাইয়া সেভ করা।
রুদ্র রিমির উদ্দেশ্যে –
“excuse me, please.”
রিমি মাথা নাড়ালো আর সাথে সাথে বসা থেকে উঠে একটু দূরে গেল মিরায়া দূর থেকে দেখতে পেল রিমির সাথে বসা ছেলেটার ফোন কানে ধরে একটু দূরে যাচ্ছে। কিন্তু রুদ্র পিছন ফিরে চলায় মিরায়া চেহারা দেখতে পেল না।
রুদ্র-“হ্যাঁ, ভাইয়া বলো।”

রায়ান- “তুই কোথায় রুদ্র?”
রুদ্র একটু আমতা আমতা করলেও স্বাভাবিক উত্তর দিল-
“কোথায় আবার অফিসে আমি।”
রায়ান রুদ্র
রুদ্রর মিথ্যা বলা দেখে বুঝতে পারলো রুদ্র কিছু লুকাচ্ছে রায়ান মিরায়ার বেশ কাছাকাছি চলে আসায় আর কিছু না বলে কেবল বলল-
“আচ্ছা কাজ কর। আমি তোর ভাবিকে নিয়ে ওদের ক্যাম্পাসের কাছের মার্কেটপ্লেসে এসেছি। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে আম্মুকে বুঝিয়ে বলিস।”
রুদ্র রায়ান আর মিরায়া একই জায়গায় শুনে থতমত খেয়ে গেল। রায়ান এতক্ষণে ফোনটা রেখে বাঁকা হেঁসে বলল-
“বাহ্! ভাই আমার এখন মিথ্যাও বলে। আমি নিশ্চিত কোনো মেয়ের মামলা।”
তারপর হাসতে হাসতে মিরায়াকে যেখানে দাড়া করিয়ে রেখেছিল সেখানে পৌঁছায় তবে মিরায়াকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। সাথে সাথে চারপাশটা চোখ ঘুরিয়ে মিরায়াকে খুঁজতে থাকে। আর দেখতে পার মিরায়া একটু দূরে কফি শপটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। রায়ান দৌড়ে মিরায়া পিছনে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে-

-“ওই ছেমড়ি, এখানে কি। বলেছিলাম না- না নড়তে। পা এক জায়গায় টিকে না নাকি।”
ঠিক তখনি রুদ্র রিমির কাছে এসে তাড়াহুড়ো করতে শুরু করে-
“রিমি আমাদের যেতে হবে।”
রিমি চিন্তিত কন্ঠে-“কেন কি হয়েছে কোনো সমস্যা?”
রুদ্র নিজের কোর্ট হাতে নিতে নিতে-
“অনেক বড়ো সমস্যা। আমার ভাইয়া আর ভাবি। মানে মিরা এইখানে।”
রিমি হকচকিয়ে -“কি? মিরা এখানে।” তারপর হঠা্ৎ রুদ্রর সম্পূর্ণ কথা মাথায় ঢুকতেই বলল- “মিরা আপনার ভাবি? মিরা বিবাহিত? কই আমি তো জানি না।”
রুদ্র রিমির হাত ধরে টানতে টানতে বলল- “আপনি কিভাবে জানবেন, মিরা নিজেও জানে না।”
রিমি অবাক হয়ে-“নিজেও জানে না, মানে কি।”
রুদ্র রিমির দিকে তাকিয়ে বলল-“আসলে আমি নিজেও জানি না মানে কি। সবাই বলে মিরা আমার ভাবি তাই ভাবি ও আমায় ভাবি।”

রিমি রুদ্রর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। রিমি আবার অবাক হয়ে-“কি বলেন এসব, ভাবেন ভাবি।”
রুদ্র রিমির দিকে ফিরে হাত জোড় করে বলল-
“আপাতত চলুন এই জায়গা থেকে বের হই ওরা দেখলে আর রক্ষা নাই।”
রিমি আর কিছু বলল না রুদ্র সাথে চলে গেল।

রায়ান-“এইযে আপনাকে বলছি ম্যাডাম এইখানে কি?”
মিরায়া বিরক্ত হয়ে বলল-
“আপনি একটু চুপ করবেন। একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য দেখছিলাম।”
রায়ানও একই বিরক্তি নিয়ে-
“কি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য দেখছো আমাকেও দেখাও।”
মিরায়া ওই জায়গা থেকে সরে এসে বুকে হাত বেঁধে অভিমান নিয়ে বলল-
“দৃশ্য দেখা শেষ। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমাকে বলল বাড়ি চলে গেছে আর এখানে এসে একটা ছেলের সাথে ঘুরছে। বললে কি ওকে আটকে রাখতাম নাকি।”
রায়ান কিছু বুঝতে না পেরে বলল-
“কিসব বলছো? কার বেস্ট ফ্রেন্ড কোন ছেলে? কে কি করলো আবার?”
মিরায়া রায়ানকে ব্যাখ্যা দিল-

“রিমির কথা বলছি। আমি কল দিয়ে ছিলাম বলল মাথা ব্যাথা বাড়ি চলে গেছে। এখন এই ক্যাফে তে বসে একটা ছেলের সাথে খাচ্ছিল দেখলাম। মাঝে ছেলেটার একটা কল এলো তাই সে উঠে গেল। আর ফিরেই হন্তদন্ত হয়ে রিমির হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল।”
রায়ানের সব কড়ি যোগ করতে সময় লাগলো না। রায়ান মনে মনে-“ছেলেটা আমার ভাই ছাড়া আর কেউ না আমি সিওর। একটু আগে তো আমি ওকে কল করলাম আর ওর মিথ্যা শোনার পর যে কথা বলেছি সেটা শুনে ওর এই জায়গাতে থাকা ইমপসিবল।”
রায়ান নিশ্চিত হতে মিরায়াকে জিজ্ঞেস করল-“ছেলেটা কে দেখনি?”
মিরায়া বিরক্ত হয়ে বলল-“কিভাবে দেখবো। দেখছেন না ওতো বড় একটা ফুলের টব দিয়ে রাখেছে। কিছু দেখা যায় নাকি।”

রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিরায়ার বিরক্তি মাখা চেহারাটা দেখে একটু ফু দিলো মিরায়ার মুখে। মিরায়া হঠাৎ রায়ানের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো –
“কি হয়েছে হ্যাঁ? রসিকতা করেন! ফু দিচ্ছেন কেন বলেছি দিতে?”
রায়ান বুঝতে পারলো মিরায়া বেশ বিরক্ত তাই সে মিরায়াকে শান্ত করতে বাচ্চাদের মানানোর জন্য যেমন করে তাই করল-

“থাক, রাগ করে না সোনা বাচ্চা। ভিতরে চলো আইস্ক্রিম কিনে দিবো। নতুন আইসক্রিম এসেছে না একটা সেভয় এর ওইটা খাই চলো।” মিরায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে।
মিরায়া একটু রাগ নিয়ে রায়ানের দিকে তাকিয়ে মার্কেটের প্রবেশ দ্বারের দিকে ঘুরে বলল-
“আমি দুইটা খাব।”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৯

আর সামনে হাঁটতে থাকলো। রায়ান মিরায়ার কথা শুনে একটু হাসলো আর নিজের মনে বলল-
“সত্যিই বাচ্চা। কেউ বলবে ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে।”
তারপর মিরায়ার পিছন পিছন বডি গার্ডের মতো চলতে লাগলো।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here