আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৫
অরাত্রিকা রহমান
রায়ান মিরায়ার অনবরত কাঁপতে থাকা গোলাপী ঠোঁট গুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের বোধগম্যতা আর নিয়ন্ত্রণ হাড়ালো। রায়ান মিরায়ার কাঁপতে থাকা ঠোঁটের দিকে ঝুঁকে এসেছিল। তার ভেতরে যেন এক সুনামি চলছে—চোখের সামনে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ছুঁয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার ধমনীতে রক্তের মতো বইছে। তার চোখে এক ধরণের তৃষ্ণা, এক ধরণের জেদ—আজ আর কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারবে না। রায়ান আগু পিছু চিন্তা না করে মিরায়ার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাবে এমন সময় দরজায় জোরে শব্দ হয়- “ঠাস ঠাস!” দরজার বাইরে যেন কেউ বেশ জোরে ধাক্কাচ্ছে। মুহূর্তেই ঘরের ভেতর জমে ওঠা আবহাওয়া ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
দরজার শব্দে দু’জনেই হঠাৎ চমকে উঠল। মিরায়ার মুখে অস্বস্তি আর ভয়ের মিশ্র ছাপ, সে ঠোঁট কামড়ে নিল যেন সামনের ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজছে। মিরায়ার বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো, চোখ বড় বড় হয়ে গেল, আর মুখে এক অজানা ভয়ের ছাপ ছড়িয়ে পড়ল, মুহূর্তেই সবকিছু ভেঙে পড়ল। মিরায়ার বুক কেঁপে উঠছে, ঠোঁট কাঁপছে, গাল টকটকে লাল হয়ে উঠেছে।
রায়ান দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ালো। রাগে তার চোখ লালচে, নিঃশ্বাস ভারী। রায়ান রাগে ফুঁসে উঠলো। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, চোখে জ্বালা, আর ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো গর্জনমিশ্রিত অভিমানী কথা—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—“শালা! একটা মুহূর্তও আমার নিজের হয় না!
সবকিছু ঠিক মুহূর্তে নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ
আজ এতটা কাছে এসে— কি এমন চেয়েছি।
তাও ভাগ্য কেন আমার সঙ্গে প্রতিদিন প্রতারণা করে?”
তার কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছিল, যেন ভেতরে জমে থাকা আগুন হঠাৎ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে।
মিরায়া এক মুহূর্তের জন্য তার চোখের দিকে তাকাতেও পারল না। মাথা নত করে, বুক কাঁপতে কাঁপতে ভাবছে—
“আমি কী করতে যাচ্ছিলাম? এটা ভুল… আমি তো এমন নই.. কি হয়ে গেছে আমার! ”
তার গাল জ্বলছে লজ্জায়, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে অপরাধবোধে।
মিরায়া ভয় আর লজ্জার মিশ্র অনুভূতিতে হঠাৎ রায়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
চোখ বুজে ফিসফিস করে উঠল—
—“না… না! এটা ঠিক না। আমাদের… আমাদের এমন করা উচিত না।”
কথাটা বলেই দৌড়ে দরজার দিকে ছুটল। দরজা খুলে যেতেই সামনে রিমিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। —সামনেই দাঁড়িয়ে আছে রিমি।
রিমি ভুরু কুঁচকে অবাক দৃষ্টিতে বলল,
—“কিরে? দরজা লাগিয়ে কী করছিলি? ছাদে এলি না কেন, তোকে খুঁজে এলাম ছাদে…”
মিরায়া এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ, তারপর বুক ধড়ফড় করতে করতে আড়চোখে ঘরের ভেতর তাকাল। রায়ান এখনো ঠাক দাঁড়িয়ে আছে—চোখ জ্বলে উঠছে রাগে, ঠোঁট শক্ত করে চেপে রাখা। তার চোখের সেই দৃষ্টি যেন মিরায়াকে বিদ্ধ করছে—”কেন?” প্রশ্নে।
রিমি রায়ানের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলল—সে হয়তো ভুল সময়ে এসেছে। তার মুখে অনুশোচনার ছাপ ফুটে উঠল, মৃদু স্বরে বলল,
—“ সরি, আমি বুঝিনি। আমি বোধহয় ভুল সময়ে এসে পড়েছি …”
কিন্তু মিরায়া রিমিকে আর কিছু বলতে দিল না। দ্রুত রিমির হাত ধরে টেনে নিল—
—“চল এখান থেকে… নিচে যাবো।”
সে যেন পালাচ্ছে, যেন ঘরের সেই আবহাওয়া আর রায়ানের চোখ থেকে বাঁচতে চাইছে।
পেছনে মিরায়ার ঘরের দরজা আধখোলা রয়ে গেল।
রায়ান নিঃশ্বাস ভারী করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ল। তার মুঠো শক্ত, চোখ লালচে। নিজেকেই উদ্দেশ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
—“আমার জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটা এত কাছে ছিল… তবুও পেলাম না। সবকিছু হাতছাড়া হয়ে গেল আবারও। আমি শুধু চাইছিলাম আমার বউটাকে আমার করে নিতে, একটুখানি ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু না… আমার রব, চারপাশের মানুষ, পরিস্থিতি, সময় সব.. সব আমার বিরুদ্ধে। কেননননন…?”
সে দু’হাত মাথার চুলে চেপে ধরল, মাথা নিচু করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। তার বুক জ্বলছে অপ্রাপ্তি আর তৃষ্ণায়, আর চোখে জমে আছে রাগে ভেজা আকাঙ্ক্ষা। সে বিছানায় বসে , চোয়াল শক্ত করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল।
ডাইনিং টেবিল সাজানো। টেবিলের চারপাশে বসেছেন রামিলা চৌধুরী, রায়হান চৌধুরী, রুদ্র, মিরায়া আর রিমি। খাবার পরিবেশন করা হয়েছে, কিন্তু কারও মন ঠিক নেই। হঠাৎ সব নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। টেবিলে মিরায়ার পাশে রায়ানের আসনটা ফাঁকা। বারবার সবার চোখ সেদিকেই চলে যাচ্ছে।
মিরায়া মাথা নিচু করে বসে আছে, আঙুল দিয়ে তার ওড়না কচলাচ্ছে। চোখ তুলতে পারছে না কারও দিকে যদিও একটু আগের ঘটনার সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা নেই তবুও তার ভিতরের অপরাধবোধ তাকে লজ্জিত করছে নিজের চোখে। ভেতরে ভেতরে তার বুক ধকধক করছে—
“এখনো নামছেন না কেন উনি? খাবে না? আমার দোষেই কি এমন হলো…”
রামিলা চৌধুরী চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মিরায়ার অস্বস্তি বুঝতে পারেন কিন্তু কারণ অজানা। ছেলে কি কি করতে পারে সেটা তার জানা-অজানার সীমা লঙ্ঘিত। রামিলা চৌধুরী হঠাৎ মৃদু স্বরে বললেন—
—“মিরা, রায়ানকে দেখেছিস? ও নামছে না কেন?”
মিরায়ার বুক কেঁপে উঠল। সে সামান্য মাথা তুলল, চোখের কোণ রামিলার দিকে গিয়ে থেমে গেল, তারপর আবার নিচু হয়ে গেল দৃষ্টি। ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল।
ঠিক তখনই—
“ঠক ঠক ঠক…”
সিঁড়ি বেয়ে নামার শব্দ।
সবার দৃষ্টি একসাথে সেদিকে ঘুরল।
রায়ান ধীরে ধীরে নামছে, কিন্তু এখন তার গায়ে আর একটু আগেও পড়ে থাকা সেই আরামদায়ক পাঞ্জাবি নেই। পরিপাটি ফরমাল ড্রেস—সাদা শার্ট, কালো ব্লেজার, প্যান্ট, নিখুঁতভাবে বাঁধা টাই। একেবারে দৃঢ় আর পরিপূর্ণ কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব।
রুদ্র চোখ কুঁচকে অবাক হলো। রামিলা চৌধুরীর ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল। রায়হান চৌধুরীও তাকালেন তবে মিরায়া নিঃশ্বাস আটকে রাখল, সাহস করে তাকাল না তার দিকে।
রায়ান এক ঝলক সবার দিকে তাকাল—কিন্তু মিরায়াকে বাদ দিয়ে। তারপর হঠাৎ থেমে, গম্ভীর দৃষ্টিতে এক সেকেন্ডের জন্য মিরায়ার দিকে তাকাল যেন চেয়েও এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু। সেই চোখে অগ্নি, অভিমান আর অজানা যন্ত্রণা একসাথে। কিন্তু মিরায়া সেদিকে না তাকিয়ে মাথা নামিয়ে রাখল। রায়ানের বুকের ভেতর যেন আরও আগুন জ্বলে উঠল।
রায়ান সোজা টেবিলের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল—
—“আম্মু, আমি কনস্ট্রাকশন সাইটে যাচ্ছি। একটু আগে কল এসেছিল, আমার সেখানে থাকতে হবে।”
রামিলা চৌধুরী অবাক হয়ে চিন্তিত স্বরে বললেন—
—“শুক্রবারের দিনও ওখানে যাওয়া লাগবে নাকি?”
রায়ানের কণ্ঠ ভরাট, দৃঢ়—
—“হ্যাঁ আম্মু। প্রয়োজন পড়েছে। এ্যাপ্লায়িরা বিশেষভাবে ডেকেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা আছে। শুক্রবার তো আর তাদের কাজ আটকে রাখে নি তাই না, প্রয়োজন পড়েছে তাই যেতে হবে।”
রামিলা চৌধুরী আর কথা না বাড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলে রায়ানের প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে বললেন—
—“তাহলে অন্তত একটু খেয়ে যা। একটু আগেও তো বললি খিদে পেয়েছে। আয় তাড়াতাড়ি বস।?”
রায়ান গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল এক মুহূর্ত। চোখ সরাসরি মিরায়ার উপর না গিয়ে তার চারপাশে ঘুরল, তারপর ঠাণ্ডা স্বরে বলল—
—“খাব না। খিদে মরে গেছে। আবার খিদে পেলে বাইরে থেকেই খেয়ে নেবো। তোমরা খেয়ে নাও।”
কথাটা বলে সে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল।
রায়হান চৌধুরী বললেন -” আচ্ছা যাক না ছেড়ে দেও এই সব ব্যাপারে অনেক পেচ লেগে থাকে প্রয়োজন পড়তেই পারে।”
ঘরে এক মুহূর্তের জন্য ভারী নীরবতা নেমে এলো। মিরায়ার বুক ধকধক করছে, তার চোখ ভিজে উঠেছে অজান্তে। মনে মনে সে শুধু ভাবছে—
“সব আমার কারণে… আমার জন্যই না খেয়ে চলে গেলেন উনি। আমার দূরত্ব বজায় রাখা উচিত ছিল।”
রুদ্র একবার মিরায়ার দিকে, একবার রিমির দিকে তাকাল। রিমিও মাথা নিচু করে আনমনে কিছু ভেবে যাচ্ছে। তারপর হাত দিয়ে রুদ্র ইশারা করল রিমিকে। রিমি খানিকটা দ্বিধা নিয়ে রুদ্রর দিকে ঝুঁকল।
রুদ্র নিচু স্বরে দ্রুত প্রশ্ন ছুঁড়ল—
—“রিমি, ভাইয়া আর ভাবির মধ্যে আসলে কী হয়েছে? জানেন?”
রিমি হকচকিয়ে গেল। মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জায়।
কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তার জন্যই এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে কিনা, রায়ান মিরায়া ঘরে কি করছিল সব তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রিমি মাথা নামিয়ে আস্তে বলল—
—“আমি ঠিক বলতে পারবো না। তবে মনে হচ্ছে… রায়ান ভাইয়া খুব রাগে আছেন। কার ওপর রাগ সেটা বোঝা যাচ্ছে না।”
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল।
এদিকে রামিলা চৌধুরী নীরবতা ভাঙলেন। গলাটা স্থির, কিন্তু চোখে একটা অস্বস্তি—
—“আচ্ছা, যার কাজ সে চলে গেছে। তোমরা আর দেরি করো না। সবাই খাওয়া শুরু করো।”
তিনি সবার প্লেটে আরো খাবার দিতে লাগলেন। মিরায়া হঠাৎ মৃদু কণ্ঠে বলল—
—”মামণি, আমার আর কিছু লাগবে না। এতো টুকুই শেষ হবে না। দিও না আর।”
রামিলা ভুরু তুললেন—
—“কেন? খাবি না? তোর না খিদে পেয়েছিল?”
মিরায়া লজ্জিত মুখে আস্তে বলল—
—“না, মানে… খিদে পেয়েছিল। তবে বেশি খাব না। এতোটুকু যথেষ্ট।”
রামিলা কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে তাকালেন, কিন্তু কিছু বললেন না। কিছু যে হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই চুপচাপ খেতে লাগল। মিরায়ার খাওয়ার শব্দও যেন অস্বস্তিকরভাবে ধীর।
খাওয়া প্রায় শেষের দিকে, হঠাৎ রায়হান চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—
—“আচ্ছা, শুক্রবারের দিন তো সবাই একসাথে খেলাম। কিন্তু আমার সোরায়া মা কোথায়? সকাল থেকে দেখছি না।”
সবাই মাথা তুলল। মিরায়ার রায়হান চৌধুরীর কথায় তার দিকে তাকালো। সে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল জিভ দিয়ে, তারপর আস্তে উত্তর দিল—
—“বাবা, সোরায়া ওর এক বান্ধবীর সাথে লাইব্রেরিতে গেছে। কিছু বই নেবে বলেছিল। বলেছে বাইরেই খাবে, পরে চলে আসবে।”
রায়হান চৌধুরী মাথা নাড়লেন।
—“ওহ, আচ্ছা! ফোন করে একবার খবর নিয়ে নিও ওর।”
মিরায়া হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লো। টেবিলে আবার নীরবতা। কেউ সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করল না, কিন্তু সবার দৃষ্টি মাঝে মাঝে মিরায়খর দিকে চলে যাচ্ছিল।
মিরায়া মনে মনে বলছিল—
“ওরা কি বুঝতে পারছে কিছু? আমার চেহারায় কি সব পড়তে পাচ্ছে? এইভাবে দেখছে কেন?”
তার হাত কাঁপছিল, বুক ভারী হচ্ছিল অপরাধবোধে। আর সবাই এক এক করে অবাক, দমবন্ধ করা নীরবতার ভেতর দিয়ে খাবার শেষ করছিল। খাওয়া শেষে সবাই নিজ নিজ রুমে চলে যায়।
বুক শোপ/ লাইব্রেরী~
সোরায়া আর জুঁই দুপুরে একটা রেস্টুরেন্টে একসাথে খেয়ে নিজেদের কলেজের পাশের ছোট্ট কিন্তু সাজানো বুকশপের ভিতরে প্রবেশ করেছে। বুকশপটা ছোট তবে সুসজ্জিত, কাঠের শেলফগুলো একটার পর একটা সারি দিয়ে সাজানো, প্রতিটি তাক ভরা নতুন আর পুরোনো বইয়ে। ঘরে হালকা কাঠের গন্ধ আর বইয়ের পাতা ও মলাটের মিশ্র ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। শান্ত পরিবেশ, মাঝে মাঝে কেবল পাতা ওল্টানোর মৃদু শব্দ আর নিচু গলায় দোকানদারের কথা শোনা যাচ্ছে।
সোরায়া ধীরে ধীরে শেলফের সামনে হাঁটছে। চোখ বারবার শিরোনামগুলো পড়ছে—“সমরেশ মজুমদার”, “সেলিনা হোসেন”, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়”, “হুমায়ূন আহমেদ”—তার ঠোঁটে হালকা হাসি।
জুঁইও পাশাপাশি দেখছে নানান বই। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে একটা উপন্যাস তুলে নিল, মলাটের ছবি দেখে বলল—
—“সোরা, দেখ, এটা আমি অনেকদিন ধরে পড়তে চাইছিলাম ‘পদ্মজা’। এতো রিভিউ শুনেছি এটার, কিন্তু পড়াই হয়নি। চল এইবার এইটা পড়ি প্লিজ।”
সোরায়া জুঁইয়ের হাতের বইটা নিজের হাতে নিয়ে আবার তাকে রেখে দিয়ে জুঁইয়ের হাত ধরে অনেক গম্ভীর ভাবে বলল-
“দেখ জুঁই, আমি দুমাস হলো অনলাইনে ‘অবরুদ্ধ নিশীথ’ গল্পটা পড়েছি গল্পের রিভিউ দেখেই নিয়েছিলাম। ভেবেছি স্যাড এন্ডিং এমনকি আর কষ্টের হবে। পড়ার পর এমন ট্রমা পেয়েছি, ভাই বিশ্বাস কর আমি এখনো ঠিক মতো পানি খেতে পারি না মনে পড়লে। এখন স্যাড এন্ডিং নিতে পারি না জেনেও পদ্মজা পড়ে আমি জ্যান্ত লাশ হতে পারবো না। মাফ কর।”
জুঁই হাঁ হয়ে রইল শুনে। আসলে সে কখনো ভেবে দেখেনি একটা গল্প কখনো মানুষের মনে এমন ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। জুঁই তাও সোরায়ার হাত ধরে থেকে জোর করে বলল-
“সোরা, তোকে একা তো আর ট্রমা নিতে বলছি না আমিও ট্রমা নিব। তাও চল না পড়ি একবার, প্লিজ।”
সোরায়া এবার নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল-
“এতো শখ যখন নিজে পড়। আমার হ্যাপি এ্যান্ডিং পছন্দ আমি ওমনি গল্প পড়ব। আমার মেন্টাল হেলথ অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।”
এই বলে জুঁইয়ের থেকে দূরে সড়ে যাবে তখনি তার পিঠের সাথে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা কারোর সাথে ধাক্কা লাগে। সোরায়া হকচকিয়ে পিছনে ফেরে- “সরি সরি সরি.. আমি আসলে খেয়াল করি নি।”
অন্যদিকে অপর ব্যক্তিও একই ভাবে- “সরি সরি, আই ডিন্ট নাটিস।” মানুষটা পিছনে ফিরতেই সোরায়া আর জুঁই সোজা দাঁড়িয়ে যায় চমকে। তারা একসাথে – ” মাহির স্যার আপনি…!”
আসলে মাহির কিছু ইংলিশ উপন্যাস কিনতে গেছিল নামাজ শেষে। পড়নে সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা হাতে কয়েকটা বই। মাহিরও জুঁই আর সোরায়াকে খেয়াল করেনি। হঠাৎ এভাবে দেখা হয়ে যাওয়ায় সেও বেশ অবাক।
সোরায়া মাহির কে দেখছে পা থেকে মাথা অব্দি। পাঞ্জাবিতে কি অসম্ভব সুন্দর লাগছে তার প্রিয় মানুষটাকে সেটা পরোখ করতে ব্যস্ত সে। জুঁই সোরায়া কে ধাক্কা দিয়ে বাস্তবে ফেরায়। জুঁই পরিবেশ স্বাভাবিক করতে কথা বলতে শুরু করল-
“আরে স্যার আপনি? জুম্মা মোবারক স্যার, কেমন আছেন?”
মাহির জুঁইয়ের প্রশ্নের উত্তরে বলল- “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমরা এখানে..!”
সোরায়া জুঁইকে থামিয়ে দিয়ে বলল- “কিছু বই নিতে এসেছিলাম। আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি। যাক ভালোই হলো..।”
মাহির চোখের পলক ফেলে- “কিহ্!”
জুঁই সোরায়ার মুখ ফসকে বের হয়ে যাওয়া কথা কে ঢাকতে-
“কিছু না স্যার, কিছু না। আপনিও কি বই নিতেই এসেছেন?”
মাহির সোরায়ার কথায় আর মন না দিয়ে- “হ্যাঁ।”
জুঁই-“আচ্ছা স্যার তাহলে আপনি বই নিন। আমরা তবে আসি।” জুঁই এর কথায় মাহির ভদ্র ভাবে মাথা নাড়ালো।
জুঁই সোরায়ার হাত ধরে পিছনের দিকে টানতেই সোরায়া বলল-
“কি হয়েছে কোথায় টানছিস? বই নিতে এসেছি বই নিবো না নাকি।”
জুঁই একটু অস্বস্তিতে সোরায়ার কানের কাছে এসে বলল-
“স্যার দেখছেন সোরা। আজকে চল অন্য দিন নিব।”
সোরায়া জুঁইয়ের হাত ছাড়িয়ে-
“তুই যা আমি বই নিয়েই যাবো। বই না পড়লে রাতে ঘুম হয় না আমার আগের সব পড়া শেষ। আমার আজকেই লাগবে। আর স্যার দেখছেন তো কি? স্যার নিজেও তো বই ই নিতে এসেছেন।”
মাহির সোরায়ার কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেল সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুঁই আর সোরায়ার উদ্দেশ্যে বলল-
“আমার উপস্থিতিতে এতো অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। তোমরা তোমাদের কাজ করো।”
এই বলে মাহির নিজের হাতের বইগুলো নিয়ে অন্যদিকে যেতে লাগলো। মাহির কে চলে যেতে দেখে সোরায়াও মাহিরের পিছন পিছন গেল। জুঁই এই দিকে লজ্জায় শেষ। সোরায়াকে সামলাবে কিভাবে তাও বুঝতে পারছে না।
সোরায়া মাহিরের পিছন পিছন হাঁটতে থাকে সম্পূর্ণ টা বুকশপে জুড়ে। মাহির বিরক্ত হয়ে সোরায়ার দিকে ফিরে বলল-” তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?”
সোরায়া ভয় না পেয়ে উল্টো দু কদম মাহিরের দিকে এগিয়ে এসে বলল-“হুম।”
মাহির জিজ্ঞেস করল-“কি?”
সোরায়া হাসি মুখে অতি গর্বের সাথে বলল-“কালকে আপনি বলার পর আমি সাথে সাথে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম একটুও রাত জাগি নি।”
মাহির সোরায়ার কথায় আরো বিরক্ত হলো। রাতের কথা এখন তুলছে তাও বার এটা বলতে যে সে মাহিরের কথা মতো ঘুমিয়ে গিয়েছিল। তবে শিক্ষক হিসেবে নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে শান্ত মস্তিষ্কে মাহির বলল-
“বাহ্! বেশ ভালো করেছ। এখন থেকে এমনি করবে।”
সোরায়া মাথা নাড়লো। মাহির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার পিছন দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করল আর বইয়ের সেলফ গুলো ভালো করে দেখে পছন্দ অনুযায়ী বই নিতে থাকল। সোরায়া এখনো তার পিছন পিছন হাঁটছে যেটা বিরক্তিকর ঠেকছে মাহির এর কাছে।
মাহির হাতের বইগুলোর উপর জোরে হাত মেরে সোরায়ার দিকে ফিরে সোরায়াকে জিজ্ঞেস করল-
“তুমি না বই নেবে? কিছু দেখছো না কেন? কেমন বই পড়ো তুমি বলো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি সুবিধা হবে।” (তাড়াতাড়ি সোরায়ার পিছু ছুটানোর জন্য)।
সোরায়া চমকে গেল মনে মনে ভাবছে- “আমি তো রোমান্টিক গল্প আর ডার্ক রোমান্স পড়ি। এইটা কিভাবে বলবো।”
সোরায়া কথা এড়াতে বলল -” সমস্যা নেই স্যার আমি নিজে খুঁজে নিচ্ছি।”
এই বলে অভিনয় করলো সেলফের বইগুলো হাতিয়ে দেখার।
তারপর ” God of warmth” নামের বই টা হাতে তুলে নিল যেটার সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই যে এই বইটা একটা ১৮+ বই অত্যন্ত ডার্ক রোমান্সে ভরপুর।
মাহির এই বই আগেই পড়েছে। রায়ানের পাশাপাশি সেও ডার্ক রোমান্স বই পড়তো একসময়। ঠিক যেমন সোরায়া আর জুঁই একসাথে পড়ে। মাহির অবাক হয়ে একবার বইটার দিকে আর একবার সোরায়ার দিকে তাকালো। তারপর অবাক হয়ে বলল-
” তুমি সিওর তুমি এই বইটাই চাইছো?”
সোরায়া আর কোনো উপায় না দেখে মাথা নাড়িয়ে একটু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলল-
“হ্যাঁ এইটাই খুঁজছিলাম আমি। এই বইটার সম্পর্কে অনেক শুনেছি। এইটার রিভিউ দেখেই পড়ার ইচ্ছা হয়েছিল।”
আসলে সোরায়া ভেবেছিল নামে ‘god’ শব্দ আছে হয়তো ভালো কিছুই হবে এইটা কিনতে এসেছে বলা সেফ হবে। কিন্তু অজান্তেই হয়ে গেছে তার উল্টোটা। মাহির সোরায়ার উৎসাহ আর রিভিউ পড়ে এই বই কিনতে দেখে আরো অবাক হয়ে ভাবে-” কি পরিমান নির্লজ্জ মেয়ে। টিচারের সামনে ডার্ক রোমান্স এর বই কিনছে। আবার বলে রিভিউও দেখেছে এই বইয়ের। আর এমন বয়সে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি এসব বই।”
মাহির কি বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু বলল- “গুড, হ্যাপি রিডিং।” এই বলে নিজের বই নিয়ে কাউন্টারে চলে গেল।
সোরায়াও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু হাতের বইটার দিকে তাকিয়ে বইটার উদ্দেশ্যে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল-
“তোকে না বুঝেই হাতে নিয়েছি। এবার না কিনেও উপায় নেই স্যার দেখে ফেলেছে নিতে তো হবেই। আমার সব টাকা জলে গেল। তোর যে দাম বাংলা গল্প আরো ৫টা পেতাম। you better be good, ok!”
এই বলে সেও কাউন্টারে গেল। বই বিক্রেতাও সোরায়া কে দেখছে হয়তো মনে মনে ভাবছে-“আজ কালের বাচ্চা কত অ্যাডভান্স।”
মাহির আর সোরায়া নিজেদের বই এর বিল পে করে সেগুলো প্যাক করা হয়ে গেলে হাতে নিয়ে দরজার কাছে যায় সেখানে জুঁই দাঁড়িয়ে ছিল আগের ন্যায় মুখে অস্বস্তি। মাহির বড় গুরুজনের দায়িত্ব থেকে দুজনকে জিজ্ঞেস করল-
“এখন তো বাড়ি যাবে তোমরা তাই না?”
দুজনে একসাথে মাথা নাড়লো হ্যাঁসূচক। মাহির পরবর্তীতে আবার জিজ্ঞেস করল- “তোমরা কোথায় থাকো?”
মাহিরের প্রশ্নের জুঁই উত্তরে নিজের বাসা ঠিকানা আর সোরায়া উত্তর করল-“আমি চৌধুরী বাড়িতে থাকি। এখান থেকে একটু সামনেই।”
মায়ের চোখ পুচকে সোরায়াকে আবার প্রশ্ন করলো- “কোন চৌধুরী বাড়ি?” মনে মনে- “এখানে চৌধুরী বাড়ি একটাই আছে। সেটাতো রায়ানদের।”
সোরায়া মাহিরের প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যা দিতে যাবে এ সময় হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। সে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করেই দেখল মিরায়া কল করেছে। সোরায়া ফোনের উপরে ভেসে থাকা সময় দেখল। প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি সময় ধরে সে বাড়ির বাইরে আছি হয়তো তাই বাড়ির সকলে চিন্তা করছে। সোরায়া মাহিরের দিকে তাকিয়ে একটু দ্রুততার সাথে বলল-
“স্যার অনেকক্ষণ হলো বাড়ি থেকে বের হয়েছি তো বাড়িতে সবাই হয়তো চিন্তা করছে। আমাদের বাড়ি ফেরা উচিত। কলেজে দেখা হবে। আসসালামুয়ালাইকুম। ভালো থাকবেন।”
মাহিরো আর কিছু বলল না। সেটাই চাইছিল কখন সোরায়ার পিছু ছুটবে। সোরায়া ফোনটা ধরে মিরায়ার সাথে কথা বলতে বলতে জুঁইয়ের সাথে একটা রিক্সায় উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
সন্ধ্যার পর~
চৌধুরী বাড়ি একটু চুপচাপ। সোরায়া বাড়ি ছিড়েই মিরায়াকে একটু বুঝিয়ে বলে মানিয়ে নিয়েছে দেরি হওয়ার ব্যাপারে। সন্ধ্যা কেটে গেছে, আকাশে এখন অন্ধকার নেমে এসেছে। চারপাশে শুধু বাতাসের শব্দ—মৃদু, ঠান্ডা, কাঁপন ধরানো। ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে মিরায়া। দূরে শহরের আলো ফিকে হয়ে ঝিকমিক করছে, কিন্তু তার চোখ যেন কোথাও আটকে নেই।
চুলগুলো বাতাসে উড়ে এসে বারবার মুখ ঢেকে দিচ্ছে। মিরায়া একবার হাত দিয়ে সেগুলো সরিয়ে আবার ফাঁকা আকাশের দিকে তাকাল। তার বুকের ভেতর আজও দুপুরের সেই মুহূর্তটা অদ্ভুতভাবে বাজছে—রায়ানের চোখ, তার কাছে টেনে নেওয়া, তার ঠোঁটের স্পর্শের দাবি—আর হঠাৎ নিজেকে হাড়ানো।
মিরায়ার বুকের ভেতর কেমন চাপা ধাক্কা লাগে। নিজে দোষারোপ করতে লাগলো-
“এটা কি সত্যিই হওয়া উচিত ছিল? আমি কেন তাকে ঠেকালাম না, আবার কেন ভেতরে ভেতরে মন চাইছিল থামতে না? আমার ভেতরে আমি সত্যিই হারিয়ে যাচ্ছি তার টানে।”
চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্তে শ্বাস নিলো সে। ঠান্ডা হাওয়া গালে লাগতেই মনে হলো বুকের ভেতরের জটলা আরও তীব্র হচ্ছে।
তার ঠোঁট ফিসফিস করে উঠল—
—“না… এটা ঠিক না। একদমই না… অথচ কেন মনে হচ্ছে আমি থামতে পারব না?”
তার আঙুল শক্ত করে ধরে আছে ছাদের কিনারার সিমেন্টের প্রান্ত। যেন নিজেকে টেনে রাখছে—বুকের ভেতরের ঝড়কে বাইরে বেরোতে না দেওয়ার জন্য। কিন্তু যতই চেপে রাখতে চাইছে, রায়ানের মুখটা আবার চোখে ভেসে উঠছে। সেই হতাশা, সেই রাগ, তার গলায় চাপা কষ্ট—
“উনি আমার জন্য না খেয়ে চলে গেলেন। এখনো কি খেয়েছেন কিছু কে জানে?”
ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে এক মৃদু স্পর্শ—মিরায়ার কাঁধে কারও হাত। রিমি আজ বাড়ি ফেরেনি মিরায়ার আর বাকি সবার জোরাজুরিতেই। মিরায়া হঠাৎ চমকে উঠে ফিরে তাকাল।
— “মিরা?” রিমি নরম গলায় ডাকল, চোখে চিন্তার ছাপ।
— “তুই এখানে একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তুই ঠিক আছিস তো? দুপুরের পর থেকে এমন হয়ে আছিস।”
মিরায়া একটু থমকালো। তারপর হালকা একটা কৃত্রিম হাসি এনে মুখ ফিরিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকাল।
— “হ্যাঁ… আমি ঠিক আছি। কিছু হয়নি রে।”
কিন্তু গলার স্বরটা ভীষণ কাঁচা, সহজেই বোঝা যায় ভিতরে কিছু একটা চাপা পড়ে আছে। রিমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর ধীরে ধীরে তার পাশে এসে দাঁড়াল।
— “মিরা…তুই ঠিক আছিস বললি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তোর ভেতরে কিছু না কিছু হচ্ছে। রায়ান ভাইয়ার সাথে…”
মিরায়া হঠাৎ রিমির দিকে তাকিয়ে কথাটা আটকে দিল।
— “না রিমি, তেমন কিছু না… তুই যেমন ভাবছিস তেমন না।”
কথাটা বললেও চোখের ভেতর যে ঝড় বইছে তা স্পষ্ট। মিরায়া মুখ ঘুরিয়ে নিল।
রিমি এবার আরও কাছে এসে আস্তে গলায় বলল—
— “মিরা, কখনো কখনো মস্তিষ্কের কথা না শুনে শুধু লুকিয়ে রাখলে কষ্ট আরও বাড়ে। মানুষ সবসময় ঠিকভাবে বুঝতে পারে না সে কী চায়… কিন্তু মনের গভীরে যে টানটা থাকে, সেটাই আসল। সব সময় বেশি ভেবে থেমে যাওয়া উচিত না। মন কি বলছে তা শুনে দেখ একবার।”
মিরায়া হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠোঁট নড়ল, কিন্তু শব্দ বের হলো না। শুধু মনে হলো বুকের ভেতরে হাজারটা প্রশ্ন একসাথে ধাক্কা মারছে। রিমি একটু মৃদু হাসল, যেন মিরায়াকে ভরসা দিতে চাইছে।
— “তুই যদি সবকিছু নিয়েই শুধু ভয় আর দ্বিধায় থাকিস, তবে হয়তো তোর নিজের চাওয়াটাই হারিয়ে যাবে। মন যে বাড়ন মানে না। নিজেকে কোনো কিছুর জন্য বাধ্য করিস না।”
মিরায়ার চোখ এক মুহূর্তের জন্য ভিজে উঠল। সে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিল যাতে রিমি না দেখে। গলায় আটকে থাকা স্বরটা কষ্টের সঙ্গে বের হলো—
— “রিমি… আমি জানি না… আমি কী চাই, কী করা উচিত। সবকিছু এত জটিল মনে হচ্ছে।”
রিমি তার হাতটা মিরায়ার হাতের ওপর রেখে বলল—
— “জীবন জটিল, মিরা। কিন্তু একটা কথা মনে রাখ—মানুষের ব্রেইন যতই ভয় পাক, তোর সত্যিটা তুই নিজেই জানবি। সেই সত্যিটাকেই মেনে নে। তবেই তুই শান্তি পাবি।”
মিরায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে তার ওড়না উড়ছে, চোখে অশান্তির ছায়া, অথচ বুকের গভীরে রিমির কথাগুলো ধীরে ধীরে জমা হতে শুরু করল। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো—হয়তো উত্তরটা এখনো আসেনি।
সন্ধ্যার পরে রাতের সময়টা এভাবেই কেটে গেল। সব না বুঝা না জানার দ্বিধা দ্বন্দ্বে।
রায়ানের অফিস~
সাইটের সব কাজ দেখে এসে রায়ান ভারী পায়ে নিজের কেবিনে ঢুকল। জুতার নিচে জমে থাকা ধুলো টেবিলের পাশে এসে থেমে গেলেও যেন মাথার ভেতর অস্থিরতা থামছে না।
সে চেয়ারে বসে দু’হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরল।
দুপুরের সেই মুহূর্ত আবার চোখে ভেসে উঠল—
মিরার কাঁপতে থাকা ঠোঁট, থেমে যাওয়া নিশ্বাস, আর হঠাৎ সব শেষ।
রায়ান দাঁতে দাঁত চেপে নিচু স্বরে বলল—
— “জাস্ট ওয়ান সেকেন্ড… একটা সেকেন্ড যদি আর পেতাম, সবকিছু বদলে যেত… ধুরর! এতো কিছুর মাঝেও বারবার ওই মূহুর্ত কেন মাথায় আসছে!”
সে টেবিলে মুঠি আঘাত করল।
— “আমার নিজের বউ… অথচ ও জানেই না আমি তার বর! কী অধিকার নিয়ে দোষ দেব ওকে আমি? নিজের অধিকার দাবি করার জায়গাটুকুও তো রাখি নি। কোন অধিকারে ওকে দোষ দেব আমার থেকে দূরে যাওয়ার।”
এমন সময় হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।
ট্রিং ট্রিং…
স্ক্রিনে ভেসে উঠল—“মেইন ব্রাঞ্চ অফিস”।
রায়ান বিরক্ত মুখে ফোন তুলল।
— “হ্যালো, রায়ান স্পিকিং।”
ওপাশ থেকে ভেসে এল ভদ্র গলা।
— “গুড ইভনিং, স্যার। আই অ্যাম মার্ক ফ্রম ইউ এস মেইন ব্রাঞ্চ। আই অ্যাম সো সোরি টু ডিস্টার্ব, বাট ইটস আর্জেন্ট।”
রায়ান ভ্রু কুঁচকালো।
— “গো এহেড, মার্ক।”
— “স্যার, টুমরো উই হ্যাভ অ্যান ইমার্জেন্সি মিটিং উইথ দ্যা মেজর শেয়ারহোল্ডারস। দে ওয়ান্ট ইউ ইন পার্সন। অনলাইনে পসিবল না। ইয়োর প্রেজেন্স ইজ ম্যান্ডেটরি।”
রায়ান মাথা নাড়ল বিরক্ত হয়ে।
— “মার্ক, ইউ নো আই অ্যাম ইন বাংলাদেশ। আই ক্যান্ট জাস্ট ফ্লাই ব্যাক ওভারনাইট। ইটস নট পসিবল।”
— “আই আন্ডারস্ট্যান্ড, স্যার। বাট ওয়াল স্ট্রিট অ্যান্ড দুবাই দে থেকে জে ইনভেস্টরস আসছে, দে ইনসিস্ট করতেছে দ্যাট দে নিড ইউ ফেস টু ফেস। ইটস অ্যাবাউট দ্যা মার্জার প্রজেক্ট। উইদাউট ইউ, ডিলটা ফেইল হইতে পারে।”
রায়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
— “ডু ইউ রিয়েলাইজ হোয়াট ইউ আর আস্কিং ফর? আমার এখানে পার্সোনাল কমিটমেন্টস আছে। লাইফ অলরেডি…”
সে থেমে গেল, মনে পড়ল মিরারয়া কথা।
ওপাশ থেকে আবার দৃঢ় স্বরে—
— “স্যার, আই এম রিয়েলি সোরি। বাট টিকেট অলরেডি বুকড। ডিটেইলস আপনার ইমেইলে পাঠানো হয়েছে। ফ্লাইট ইজ টুমরো মর্নিং, ফাইভ এ এম, ঢাকা টু নিউ ইয়র্ক ভায়া দোহা। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড স্যার, ইটস ক্রুশিয়াল।”
রায়ান কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর ভারী গলায় বলল—
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৪
— “…ফাইন। আই উইল বি দেয়ার।”
— “থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। উইল সি ইউ টুমরো।”
কল কেটে গেল।
রায়ান ফোনটা রাগে টেবিলে ছুঁড়ে মারল।
— “ড্যাম ইট! সব সময়… সব সময় আমার লাইফ থেকে শান্তি কেড়ে নেয় এই বিজনেস, এই রেসপনসিবিলিটি! বউ সামলাবো না এটা, বাল! মিরা সারাদিন কি করেছে, কি ভেবেছে কিছুই জানি না। ওকে সব এক্সপ্লেইন না করে কিভাবে যাই! সব ঘেঁটে যাবে।”
সে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিল।
আগামীকাল ভোরে ফ্লাইট—
আর এই রাতটা শুধু রাগ আর অপূর্ণতার যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হবে।