আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৮ (৩)
অরাত্রিকা রহমান
এভাবেই তিন দিন কাটলো। মিরায়া রায়ানের দিনে দুইজনের সময় মিলে কথা বলে কখনো অডিও কলে কখন ভিডিও কলে। শুরুতে মিরায়া একটু ইতস্তুত ও বিরক্ত বোধ করলেও সময়ের সাথে সাথে বিষয়টা তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এখন সে নিজেই মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কল করে রায়ানের খবর নেয়। সারাদিনে একবার কথা না বললে তারও ফাঁকা ফাঁকা লাগে। রায়ান ও মিরায়ার পরিবর্তনে বেশ খুশি। বাড়ির বড় গুরুজনরাও ছেলে আর বউমার মাঝে ভাব বিনিময়ের স্বাভাবিকতা দেখে সুন্তষ্ট।
সোরায়া এই তিনদিন মাহির কে একইভাবে এড়িয়ে চলেছে। একবারও তাকায়নি কথা বলে নি। বরং উল্টো হচ্ছে সব এখন মাহির ক্লাসে শুধু ওকে পড়া ধরে, ওর হোমওয়ার্ক চেক করে। বিষয়টা সোরায়া জুঁই এবং ক্লাসের সকলেই খেয়াল করেছে। সবাই এখন সোরায়াকে খেপায় মাহিরের তার প্রতি ব্যবহার দেখে। নিজের পরিবর্তন যে মাহির নিজে খেয়াল করেনি তা নয় কিন্তু যা হচ্ছে তার অজান্তেই। চেয়েও নিজেকে আটকাতে পারছে না। মনে একগুঁয়ে জেদ ধরে যেন সোরায়া সোরায়ার করছে। রিভার্স সাইকোলজি ধারণাটা মাহিরের ক্ষেত্রে বেশ লক্ষণীয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অন্যদিকে, রিমির গান আর সেই ক্যাফে রুদ্রর শান্তির নীড়ে পরিণত হয়েছে যেন। অফিস শেষে সেখানে যাওয়া রিমির সাথে দেখা হওয়া তার গলার গান উপভোগ করা আর দিন শেষে তাকে সুরক্ষিত তার বাড়ি পৌঁছে দেওয়া তার রুটিনে পরিনত হয়েছে। রিমিও এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা হলেই এক অধীর আগ্রহে সে রুদ্রর উপস্থিতি কামনা করে। কাজ শেষে রুদ্র তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করে থাকে।
এই তিন দিনে, তিন জোড়া পাখির, তিনটি আলাদা জগতের সৃষ্টি হয়েছে।
অক্টোবর ১ তারিখ~
চৌধুরী বাড়িতে মিরায়ার ঘরে রীতিমতো যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের কারণ তুচ্ছ হলেও প্রতিদ্বন্দ্বি দুজন বেশ কোট্টর। সোরায়ার নবীনবরণ আজ, জুঁইয়ের কথা মতো তাকে শাড়ি পড়তে হবে। এইদিকে না সে নিজে শাড়ি পড়তে পারে আর না মিরায়া। সোরায়া ভোর সকালে উঠেই একটা গোল্ডেন আর বেগুনি রংয়ের শাড়ি নিয়ে মিরায়ার ঘরে হাজির তাকে শাড়ি পড়িয়ে দেওয়ার আবদার নিয়ে। এইদিকে দুইজনের হাত একসাথে মাথায়। ইউটিউব থেকে ভিডিও দেখেও পারছে না দুইজন মিলে। মিরায়া যেভাবে পড়াচ্ছে তা সোরায়ার ভালো লাগছে না আবার সোরায়া যেভাবে বলছে মিরায়া ওইভাবে পড়াতে পারছে না।
ওদের চেঁচামেচি তে পুরো বাড়ি মাথায় উঠার উপক্রম। তখনি রায়ানের কল এলো মিরায়ার ফোনে। এই মাত্র অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে সে। রাতে মিরায়ার সাথে কথা না বলে সে ঘুমাতে পারে না তাই বাংলাদেশের সময়ে ভোর হলেও সে মিরায়াকে কল করে এইদিকে মিরায়াও অপেক্ষায় থাকে রায়ানের কলের।
রায়ানের কল দেখে সোরায়াকে মিরায়া ধমক দেয় হালকা-
“বনু চুপ থাক একটু আমি পড়িয়ে দিচ্ছি আগে কলটা রিসিভ করে কথা বলে নেই।”
সোরায়া রেগে মুখ ফুলিয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল-“এখন পিরিতি করবে দুইজনে মিলে। এই দিকে আমি ব্লাউজ, পেটিকোট এ বসে আছি তার খেয়াল নেই , ধুর বাল। জুঁই টারে গিয়ে আগে একটা ঘুসি মারবো। ওইটার জন্যই এই শাড়ি নিয়ে ঝামেলা।”
মিরায়া কল রিসিভ করতেই রায়ান কথা বলল-“হাই! মাই হার্ট-বার্ড। কি করো বেইবি?”
রায়ান মিরায়াকে এসব নামে ডেকেই কথা বলে তাই আর মিরায়া এগুলো পাত্তা দেয় না।
মিরায়া হাঁফ ছেড়ে বলল-“শাড়ি নিয়ে যুদ্ধ করছি।”
রায়ান হকচকিয়ে সোজা হয়ে গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে-
“শাড়ি? শাড়ি কেন? শাড়ি পড়ে কই যাবি তুই?”
মিরায়া কপাল কুঁচকে বলল-“আমি না বনু। সোরা পড়বে আজ নবীন বরণের জন্য। আমি তো শাড়ি পড়িনা। এখন অব্দি কখনো পড়ি নি।”
রায়ান নিঃশ্বাস ফেলে এবার শান্ত গলায় বলল-“গুড, বেইবি। এই জন্যই তো তোমায় এত…! যাক গে একবারে বলতে চড়ুই পাখি পড়বে তাহলেই হতো। আমার আত্মা বের হয়ে যাচ্ছিলো আর একটুর জন্য।”
মিরায়া বিরক্তিতে বলল-“নাটক কম করেন পিও। আত্মা চলে যাওয়ার কি আছে। সামান্য শাড়িই তো। আর বড় কথা আমি শাড়ি পড়তে পারি না আর না পড়াতে পারি। বনুকেও পড়াতে পারছি না।”
রায়ান-“আম্মুকে ডাকো। আম্মু পড়িয়ে দেবে। তোমার মাথায় প্রেশার নিও না ওই টুকু মাথা পড়ে নষ্ট হয়ে গেলে কি করবো।”
মিরায়া রায়ানের টিটকারী ঠিকই বুঝলো সাথে উত্তর ও তেমন দিলো-“ওমা কেন আপনার মাথা আছে কি করতে আমাকে নিজের মাথাটা গিফট করে দিয়েন।”
রায়ান মুচকি হেসে বলল -“ওকে ওকে। বাদ দেও এবার একটু প্রেম করি আসো।”
মিরায়া রেগে-“ওই মিয়া মজা করেন আপনার সাথে কি আমি প্রেম করি?”
সোরায়া চরম বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে মিরায়ার ফোঁটা টেনে নিয়ে রায়ানকে বলল-“ভাইয়া, যত পিরিতি আছে দেশে ফিরে দেখিও কেমন। আমি আপুকে ম্যানেজ করে দিবো নি এখন রাখো।”
মিরায়া সোরায়ার থেকে ফোনটা টেনে নিয়ে বলল-
“কোনো ম্যানেজ টেনেজ হবো না আমি। আপনি ফোন রাখুন।”
রায়ান বুঝতে পারলো আজকে আর তার বউকে সে পাচ্ছে না। শালিটা এইভাবে ব্যস্ত করে রেখেছে তার বউকে। রায়ান কেবল সোরায়ার চিন্তায় মিরায়াকে সাবধান করলো-
“আচ্ছা রাখছি। কিন্তু শুনো, ভালো করে শাড়ি পড়াবে। আর সাবধানে থাকতে বলবে। দিন কাল ভালো না আর মেয়ে মানুষ শাড়িতে আরো ভয়ংকর ব্যাপার সেপার। ওকে বুঝিয়ে বলে দিও।”
মিরায়া একবার সোরায়ার দিকে তাকালো রায়ানের কথা যথার্থ তা সে জানে তাই সম্মতি জানিয়ে বলল-“আচ্ছা বুঝিয়ে বলব।”
রায়ান হতাশায় শ্বাস ফেলে -“ওকে দেন ভাই বেইবি। সময় পেলে কল কোরো কেমন।”
মিরায়া “হুম” বলে উত্তর দিয়ে কলটা কেটে আবার শাড়ি পড়ানোর মিশনে লেগে পড়লো।
দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর শাড়ি পড়ানো শেষ হলে মিরায়া সোরায়াকে পা থেকে মাথা অব্দি একবার দেখে নিল সব ঠিক আছে কিনা। সোরায়া একবার ঘুরে মিরায়াকে দেখালো সাথে সাথে মিরায়ার চোখ গেল সোরায়ার ব্লাউজের পিছন দিকে এতোক্ষণ খেয়াল করেনি শাড়ি পড়ানোর চক্করে। মিরায়া সোরায়াকে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“এইটা কি?” (ব্লাউজ এর পিছন দিকের গলা একটু বড়ো)
সোরায়া ভাব নিয়ে ঘুরে মিরায়ার দিকে তাকিয়ে বলল কারিনা কাপুরের পু ক্যারেক্টার এর মতো করে-
“ইটস ব্যাক লেস।”
মিরায়া সাথে সাথে মাথায় গাট্টা মেরে বলল-
“ব্যাকলেস তোর ব্যাগে ঢুকা ছেমড়ি। এসব পড়ে আমি তোকে বাইরে যেতে দিব না। নবীন বরণে যাওয়া লাগবে না ঘরে থাক।”
সোরায়া আবার মুখ ফুলিয়ে বলল-
“আমি কি করবো আমার আর কোন ব্লাউজ নেই এইটা ছাড়া। আমার সোনা আপু প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ এমন করো না আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখবো। প্রমিস। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি যাই। টাটা।”
মিরায়া-“সোরা! বনু! শোন। আচ্ছা সাবধানে যা। খেয়াল রাখিস।”
সোরায়া দরজা দিয়ে বের হতে হতে-“ওকে আপু। খেয়াল রাখবো। টাটা।”
মিরায়া আর কি করবে , ছোট বোনটা বড় হয়ে গেছে চাইলেও কি আর সামলানো যায় বড় হয়ে গেলে। মিরায়া আর বেশি চিন্তা না করে শুধু মনে মনে বলল-“আল্লাহ আমার বোনটা ছোট, ওকে সামলে নিও।”
সোরায়ার কলেজ~
কলেজে নবীন বরণের আনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। জুঁই সোরায়ার জন্য অপেক্ষা করছে কলেজে কিন্তু সোরায়া এখনো আসে নি। মাহির স্টেজের উপর, যেহেতু তার ক্লাস নতুন একাদশ শ্রেণি তাই আজকে আনুষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব তারই। স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে সে আনমনে সোরায়ার কথাই ভাবছিল।
-“এখনো মেয়েটা এলো না কেন? আজকে কি আসবে না?”
কলেজ হেড এসে মাহির কে বলল-
“স্যার আনুষ্ঠান শুরু করুন এবার। সময় যাচ্ছে।”
মাহির মাথা নেড়ে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে মাইকে কয়েকবার টোকা দিয়ে মাইক চলছে কিনা তা দেখে নিল। তারপর সবাইকে আমন্ত্রণ জানালো কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে। এরই মাঝে হঠাৎ অডিটোরিয়াম এর দরজাটা খুলে সোরায়া প্রবেশ করলো। অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সকল ছাত্র-ছাত্রী টিচার্স আর স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকা মাহির সকলে একসাথে সোরায়ার দিকে তাকালো।
আজ প্রথমবার সে সোরায়াকে শাড়িতে দেখছে—হালকা লিপস্টিক, কাজল কালো চোখ, বেগুনি রঙের সিল্ক, পাড়ে সোনালি কাজ। চুলগুলো খোলা, বাতাসে আলতো দোল খাচ্ছে, কপালে ছোট্ট একটা টিপ, আর ঠোঁটে খুবই হালকা হাসি—যেন নিঃশব্দে বুকে ঝড় তুলছে। মাহিরের চোখ আটকে গেল ঠিক ওখানেই। সে যেন বুঝতেই পারছিল না, তাকাবে কি না—কিন্তু চোখের দৃষ্টি ফিরছে না কিছুতেই।
সোরায়া ধীরে পায়ে এগিয়ে জুঁই য়ের পাশে এসে দাঁড়াল।
জুঁই-“দোস্ত তোর দেরি হচ্ছিল দেখে এতো রেগে ছিলাম। কিন্তু এখন তোকে দেখে রাগ চলে গেছে। কি অপূর্ব লাগছে তোকে।”
সোরায়া মিষ্টি হেসে বলল-“যাহ্! কি যে বলিস। মোর শরম করে।(ঢং করে বলল)
জুঁই আর সে দুইজনেই হাসলো।
যখন পাশে জুঁইয়ের সঙ্গে সোরায়া কথা বলছে, তখন তার ঠোঁটের নরম বাঁক, চোখের কোণে আলতো হাসি—সবই মাহিরের চোখে ধরা পড়ছে স্পষ্টভাবে। তার মনে হলো, এই মেয়েটা যেন আজ পুরো আলোর ছায়ায় মিশে গেছে—মায়াবী, শান্ত, অথচ নিজের উপস্থিতিতেই সবার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য মাহিরের বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত কম্পন ছড়িয়ে পড়ল। সে বুঝল—এই মুগ্ধতা স্রেফ সাজগোজের জন্য নয়, কিছু গভীর, কিছু অচেনা অনুভূতির জন্ম হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। বুকে চিনচিন মৃদু ব্যাথার অনুভূতি।
মাহির মাইক অন রাখা অবস্থায় আওড়ালো নিজের অজান্তেই-“মারাত্মক।”
সবাই হেসে উঠলো। সোরায়া জুঁই বাকি সবাই মাহিরের দিকে তাকালো। মাহির লজ্জায় মাটি খুঁড়ে নিচে চলে যাবে এমন অবস্থা। অডিটোরিয়াম রুমের সবাই একসাথে প্রশ্ন করলো-
“কি মারাত্মক স্যার?”
মাহির লজ্জায় হেঁসে কথা কাটানোর জন্য বলল-
“তোমাদের উপস্থিতি.. মারাত্মক।”
সবাই আবার হেসে উঠলো। আর সোরায়া? সে হয়তো বুঝতেই পারছে না, তার প্রতিটি হাসির ছায়া, প্রতিটি চুলের হাওয়ায় দোল—একজনকে নিঃশব্দে কেমনভাবে বদলে দিচ্ছে। চাওয়া-না-চাওয়ার মাঝেই, ওই মুহূর্তটুকুতে মাহিরের কাছে সোরায়া যেন এক অনাবিল কবিতা হয়ে উঠল।
পুরো অনুষ্ঠান তখন নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে—হাসি, তালি, সঙ্গীত, আর নবীনদের চঞ্চল উচ্ছ্বাসে ভরা এক বিকেল। কিন্তু মাহির যেন সব শব্দের ভেতর থেকেও আলাদা একটা নীরবতায় বন্দি। মঞ্চে গান চলছে, বক্তারা কথা বলছে, সিনিয়ররা মজা করছে—তবু তার চোখ খুঁজে ফিরছে একটাই মুখ, সোরায়া।
সে নিজের অজান্তেই বারবার তাকিয়ে যাচ্ছে—কখনও সোরায়ার চুলে আলো পড়ছে, কখনও তার হাসির কোণে লাজুক একটা ঝিলিক। বুকের ভেতর কোথাও এক অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথা উঠছে, কিন্তু সে নিজেও জানে না এর মানে কী। মাথায় হাজারো ভাবনা, অথচ হৃদয়ে একটা অচেনা ঝড়।
প্রায় আধঘণ্টা পর অনুষ্ঠানটা শেষের পথে। উপস্থাপক মাইকে ঘোষণা দিলেন,
> “যে কোনো নবীন শিক্ষার্থী চাইলে এখন পারফর্ম করতে পারে—গান, নাচ বা কবিতা—যা ইচ্ছা!”
এমন সময়ে সোরায়ার পাশের সিট থেকে হঠাৎ জুঁই মজার ছলে সোরায়ার হাত তুলে ধরল,
—“এই যে, সোরায়া নাচবে!”
পুরো হলঘরে হাসির রোল পড়ল। সোরায়া মুহূর্তে থমকে গেল, চোখ বড় বড় করে বলল,
—“তুই পাগল নাকি জুঁই! এখানে এতজন মানুষ! আমার হাত তুললি কেন! আমি না করবো কিভাবে এখন।”
জুই ঠোঁটে দুষ্টু হাসি নিয়ে বলল,
—“তোকেই তো কেউ না করতে বলেনি! এখন গিয়ে স্টেজে পারফর্ম কর ! তোকে অনেক সুন্দর লাগছে যে তাই বলছি কর না তুই অনেক ভালো নাচিস”
এরপর একসাথে হলঘরে আওয়াজ উঠল—
“সোরা! সোরা! সোরা!”
তালির শব্দে যেন ছাদের ভেতর ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলল।
মাহির দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে, ভিড়ের মাঝখানে, কিন্তু চোখ শুধু সোরায়ার দিকেই। তার দুই হাত বুকের সামনে ক্রস করে বাঁধা, মুখে গম্ভীর শান্ত ভাব—তবুও চোখের গভীরে একটা অচেনা আলো জ্বলছে।
সোরায়া এক মুহূর্ত দ্বিধায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঠোঁটে শুকনো হাসি, বুক ধকধক করছে। অবশেষে গভীর শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে যায় স্টেজে।
কিছু সময়ের মাঝেই গান বাজতে শুরু করে—
> “মায়াবনো বিহারিণী হরিণী…
গহন স্বপনও সঞ্চারিনী…
কেন তার ধরিবারে করি পণ অকারণ..
মায়াবনো বিহারিনী..!”
গান শুরু হতেই সোরায়া যেন নিজের জগত বদলে ফেলল। তার নাচে এমন একটা স্বাভাবিক সৌন্দর্য, যেন বাতাসও থমকে গেছে। চোখে হালকা চাওনি, ঠোঁটে নরম হাসি, গানের তালে কোমরের দোল, হাতের মুভমেন্টে যেন অনাবিল লাবণ্য।
মাহির পলকহীন চোখে দেখছে—
প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি ঘূর্ণন যেন কোনো নিঃশব্দ মন্ত্র উচ্চারণ করছে। আলোয় ভেজা মঞ্চে তার নাচে এক অপার্থিব মায়া তৈরি হয়েছে।
তালির শব্দে হল কেঁপে উঠছে, কিন্তু মাহিরের মনে যেন শব্দ পৌঁছাচ্ছে না। তার ভেতর কেবল একটাই অনুভূতি বাজছে—
“এই মেয়েটাকে এভাবে আগে কখনও দেখিনি…
এ যেন এক জাদু। মাহির কি ভাবছিস এগুলো তোর ছাত্রী ও।”
গান শেষ হলে সোরায়া হালকা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো হল তালি দিয়ে ভরে যায়। আর মাহিরের বুকের ভিতর সেই অজানা ঝড়—এবার যেন আরও জোরে বইতে থাকে।
নাচ শেষ হওয়ার পর পুরো হলঘর যেন এক উচ্ছ্বাসে ভরে উঠল। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, কেউ কেউ শিস দিচ্ছে, আবার কেউ ভিডিও করছে। সোরায়া লজ্জায় মুখ নিচু করে মঞ্চ থেকে নেমে এলো—চুলের গোড়ায় ঘাম, গাল লাল হয়ে আছে, কিন্তু চোখে ঝিলিক এখনো টলটল করছে।
তারপর অনুষ্ঠান শেষের ঘোষণা এলো। হলঘরের একপাশে টেবিল সাজানো, সবার হাতে প্যাকেট করে নাস্তা বিলানো হচ্ছে—সিঙ্গারা, রোল, আর জুসের বোতল। হাসি-আড্ডায় ভরে উঠল চারদিক।
এই ফাঁকে দেখা গেল, সোরায়াকে ঘিরে একটা ছোট ভিড় জমে গেছে। কয়েকজন ছেলে এগিয়ে গিয়ে কথা বলছে—হাসছে, জোক করছে, কেউ কেউ ফোন বের করেছে। কারও মুখে শোনা যাচ্ছে,
— “একটু নাম্বারটা দাও না প্লিজ, দরকারে যোগাযোগ করব।”
— “তোমার আইডিটার নাম কী? ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাবো।”
— “তুমি তো দারুন নাচো! তোমার ভিডিওটা আপলোড করতে পারি?”
সোরায়া প্রথমে হেসে হেসে এড়িয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মুহূর্তে ভিড়টা বড় হয়ে গেল। সে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল, চোখে পড়ল — চারপাশে অনেকেই তাকিয়ে আছে, হাসছে, কেউ ছবি তুলছে। চোখেমুখে এখন স্পষ্ট লজ্জা আর অস্বস্তির ছাপ। সে মৃদু গলায় বলল,
— “না না, দরকার নেই… আমি নাম্বার দিই না কাউকে…”
এই পুরো ঘটনাটা দূর থেকে খেয়াল করছিল মাহির।
হাতে নাস্তার প্যাকেট, কিন্তু চোখ আটকে আছে সোরায়ার দিকে। সে পাশ ফিরে জুঁইকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
— “ওখানে কি হচ্ছে?”
জুই অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
— “স্যার আসলে। সবাই ওর নাম্বার চাইছে। বেচারী একদম কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।”
মাহিরের বুকের ভেতর কিছু একটা জ্বলে উঠল—একটা তীব্র, দহনময় অনুভূতি। রাগ? হ্যাঁ, কিন্তু শুধু রাগ নয়, আরও গভীর কিছু—একটা অদ্ভুত জেলাসি, অধিকারবোধ, আর ভিতরে জমে থাকা অস্থিরতা। অকারণেই জেগে উঠছে। তার চোখের দৃষ্টি মুহূর্তে কঠিন হয়ে গেল। সে লক্ষ্য করল—একটা ছেলেও আছে ভিড়ের মাঝে, অন্যদের থেকে একটু বেশি এগিয়ে।
চোখে একরকম বিকৃত দৃষ্টি—সেই দৃষ্টি কোনো শ্রদ্ধা নয়, একদমই নয়। তার চাওয়ায় ছিল একধরনের অসভ্য লালসা।
ছেলেটা হঠাৎ আড়চোখে তাকিয়ে, ভিড়ের ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা সোরায়ার পিঠের দিকে এগিয়ে এলো,তারপর “ভুলে” বলে ইচ্ছে করেই শরীর ঠেসে দিয়ে হালকা ধাক্কা দিল।
সোরায়া হতভম্ব হয়ে পেছনে ঘুরল—
— “এই! আপনি…”
ছেলেটা ঠোঁট বেকে বলল,
— “ওপস, ভুলে লেগে গেছে। সরি।”
ঠিক তখনই মাহিরের বুকের ভেতর যেন একটা আগুন জ্বলে উঠল। তার চোখে সেই মুহূর্তে আলো ঝলসে উঠল—
যেন কেউ তার মনের গভীর কোনো শিরা ছিঁড়ে দিয়েছে।
তার মুখের পেশিগুলো টান টান হয়ে গেল, নিঃশ্বাস ভারী।
রাগের তাপে তার চোখে এখন অন্ধকার জমে উঠেছে—
যেন আগ্নেয়গিরির ভিতরে লাভা ফুঁসে উঠছে, আর মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে ফেটে পড়বে। সে একদম হন্তদন্ত হয়ে ভিড়ের ভেতর ঢুকে গেল। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল—তার মুখের সেই রাগের তীব্রতা, যেন এক মুহূর্তেই পুরো পরিবেশ নিস্তব্ধ করে দিল।
ছেলেটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, মাহির তার গলা চেপে ধরে পেছনের দিকে টেনে নিল। এক ঝটকায় তার মুখের এক পাশে সজোরে থাপ্পর দিল—”ঠাস!”
শব্দটা যেন চারদিকে প্রতিধ্বনি তুলল। ছেলেটা মাটিতে পড়ে গেল, মুখে শক আর লজ্জা।
সবাই স্তব্ধ। আর মাহির নিচু হয়ে তার চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা, গম্ভীর গলায় বলল—
“ওপস… এটা একদম ভুলে লাগেনি। আর এটা নট সরি।”
তার কণ্ঠে এমন একটা দৃঢ়তা ছিল, যেন শব্দগুলো মাটি কাঁপিয়ে দিল।এক মুহূর্তের জন্য চারপাশের বাতাসও থেমে গেল—কেউ হাসছে না, কেউ তালি দিচ্ছে না, সবাই নিঃশব্দ।
সোরায়া এক পা এগিয়ে এল, মুখে আতঙ্ক আর বিস্ময় একসাথে। তার চোখে পড়ল মাহিরের মুখ—চোয়াল শক্ত, দৃষ্টি আগুনের মতো, তবুও ভিতরে কোথাও একটা নরম কম্পন লুকানো। সে বুঝল না হঠাৎ কি হলো।
জুই পেছন থেকে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “স্যারের মুখটা দেখেছিস? উনা চোখে রাগ না, অন্য কিছু জ্বলছে।”
মাহির একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, ছেলেটার দিকে আর তাকাল না। ধীরে ধীরে সরে গিয়ে সোরায়ার দিকে তাকাল,
চোখে কেবল একটাই কথা—
“কেন? কেন? কেন এতো অস্বাভাবিক সুন্দর হতে হবে তোমাকে?”
মাহির নিজের রাগ গিলে নিল সোরায়া দিকে তাকিয়ে শ্বাস নিয়ে। সোরায়ার শাড়ির আঁচল পিছন দিক থেকে ঘুরিয়ে এনে তার পিঠটা ঢেকে কাঁধ ঢেকে সামনে এনে ওর হাতে দিল আঁচলটা।
সোরায়া কিছু বলতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরোল না।
শুধু এক অচেনা কৃতজ্ঞতা আর কাঁপা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল—
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৮ (২)
যে দৃষ্টি বোঝাতে চায় হাজারো অব্যক্ত অনুভূতি।
আর সেই মুহূর্তে,মাহিরের ভিতরের ঝড়টা থেমে গেল না—
বরং আরও গভীর হয়ে বুকের ভেতর গেঁথে রইল এক নতুন অস্থিরতা…যার নাম হয়তো ভালো লাগা।