আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৯
অরাত্রিকা রহমান
মাহির একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, ছেলেটার দিকে আর তাকাল না। ধীরে ধীরে সরে গিয়ে সোরায়ার দিকে তাকাল,
চোখে কেবল একটাই কথা—
“কেন? কেন? কেন এতো অস্বাভাবিক সুন্দর হতে হবে তোমাকে?”
মাহির নিজের রাগ গিলে নিল সোরায়া দিকে তাকিয়ে শ্বাস নিয়ে। সোরায়ার শাড়ির আঁচল পিছন দিক থেকে ঘুরিয়ে এনে তার পিঠটা ঢেকে কাঁধ ঢেকে সামনে এনে ওর হাতে দিল আঁচলটা।
সোরায়া চোখ তুলে তাকানোর সাহস দেখালো না। দৌড়ে পালিয়ে গেল একটা ক্লাস রুমে। মাহির তাকে আটকাল না যেন চাই ছিল সোরায়া ওই স্থান ত্যাগ করুক দ্রুত। মাহির আবার গম্ভীর চাহুনিতে মাটিতে বসে থাকা ছেলে টার দিকে ঝুঁকে বলল-
“মিট মি এ্যাট দ্যা অফিস রুম টুমরো।”
সবাই মাহিরের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, এমনকি মাটিতে বসে থাকা ছেলে টাও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না একজন স্যার তার স্টুডেন্ট এর জন্য একটা অচেনা ছেলের গায়ে হাত তুলবে সবার সামনে। এইদিকে মাহির আশেপাশের কারো তোয়াক্কা করছে না। পরবর্তীতে ওই স্থান ত্যাগ করে সোরায়া যে ক্লাস রুমে গেছে সোজা সেই ক্লাস রুমে গেল মাহির সোরায়া কি করছে দেখতে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সোরায়া একদম একা সম্পূর্ণ খালি ক্লাস রুমে, থ মেরে বসে আছে একটা বেঞ্চের উপর। চোখ বড়বড় হয়ে আছে, একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা তার চোখের সামনে ভাসছে কিন্তু মনের বেকুলতা অন্য কিছু কে ঘিড়ে-“মাহির স্যার আমার জন্য এমন কেন করলেন? উনি তো কলেজে নিজের সুনাম ও ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তাহলে কেন আজকে এমন কিছু করলেন আমার জন্য যেটা কলেজে উনার সুনাম নষ্ট করবে। কেন?”
হঠাৎ ক্লাস রুমের দরজাটা জোরে খুলে মাহির ভিতরে প্রবেশ করল। সোরায়া চমকে গিয়ে বেঞ্চ থেকে নেমে পড়লো লাফ দিয়ে। মাহির এর দিকে সোরায়া মিটমিটিয়ে তাকিয়ে দেখলো মাহির গম্ভীরভাবে হেঁটে তার দিকে আসছে। সোরায়া কয়েক পা পিছিয়ে গেল তবে এইটুকু সময়েই মাহির তার সামনে এসে দাড়ালো। সোরায়ার সমস্ত শরীরে এক শীতল শিহরণ খেলে গেল। মাহির নিজের রাগে ফেটে পড়ছে যেটা সে সামলাতে পারছে না কোনো মতো অন্যদিকে রাগ হওয়ার অস্পষ্ট কারণ যেন তার মাথা আরো গরম করে দিচ্ছে।
মাহির সোরায়ার দিকে এক পা এগোতেই সোরায়া দুইপা পেছিয়ে যায় এমন ভাবে চলতে থাকায় সোরায়ার পিঠ ঠেকে যায় দেয়ালের সাথে আর মাহির ঠিক তার সামনে। মাহিরের উচ্চতার বিবেচনায় সোরায়ার মাথা ঠিক তার বুক বারাবর। সোরায়া মুখ উঁচু করে মাহির কে একপলক দেখে সাথে সাথে নিজের মুখ নামিয়ে নিল।
মাহির রেগে দেয়ালে সজোরে হাত মেরে সোরায়াকে জিজ্ঞেস করল-“এই মেয়ে, সমস্যা কি তোমার হ্যাঁ? কেন জ্বালাতন করছো এভাবে আমাকে?”
সোরায়া মাহিরের কথা বুঝতে অক্ষম। কি বলবে তাও বুঝতে পারছে না। তবু নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে আমতা আমতা করে পাল্টা প্রশ্ন করল-“আ..আমি কি করেছি স্যার?”
মাহির আবার দেয়ালে হাত বাড়ি দিল যেন অতিষ্ঠ লাগছে তার। সে বিড়বিড় করলো-“উফ্, কি জ্বালার মধ্যে আছি। একে তো এভাবে শাড়ি পড়ে নাচলো এখন আবার ভয় ভরা মুখে আমতা আমতা করে কথা বলছে। সহ্য করা যায় এইগুলো!” সোরায়া নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে অনবরত কাঁপছে ভয়ে। ওই দিন মাঠে মাহিরের এমন রাগ সে দেখেনি কিন্তু আজ কি হলো হঠাৎ তার বুঝার বাইরে।
মাহির এবার অধৈর্য গলায় প্রশ্ন করলো-“কেন আমাকে এভাবে জ্বালাচ্ছো? সমস্যা কি তোমার (চেঁচিয়ে)?”
ঐবার সোরায়াও আর সহ্য করলো না। একইভাবে চেঁচিয়ে উঠলো-“আজব তো তখন থেকে কেন কেন করে যাচ্ছেন। কি করেছি আমি? ওইদিন এতো গুলো কথা শোনালেন তাঁর পর ও কিছু না বলে চুপ চাপ যেভাবে থাকতে বলেছেন সেভাবেই থাকছি। আপনার সাথে একটা বার ও ক্লাসে বা ক্লাসের বাইরে কোনো প্রকার বাড়তি কথা বলি নি। কিভাবে জ্বালাতন করছি আপনাকে আমি?”
মাহির মনের কথা আটকে রাখতে পারলো না তবে যা বলবে তা দ্বিতীয় বার ভাবেও নি শুধু মনে এসেছে তাই সেটা মুখের বুলি হয়ে বের হলো-“এসবই আমাকে জ্বালাচ্ছে। কেন কিছু বলো নি তখন? কেন থেকেছো যেভাবে থাকতে বলেছি? কেন আমার সাথে বাড়তি কথা বলো নি? কেন?”
কথা গুলো একবারে বলে ফেলার পর মাহির দেয়ালের সাথে লেগে থাকা সোরায়ার থেকে দুই কদম পিছিয়ে গেল। এই মাত্র মাহির নিজে কি বললো সেটা যেমন তার মাথায় ঢুকছে না ঠিক তেমনি সোরায়া মাহিরের মুখে এইমাত্র কি শুনলো সেটা মাথায় নিতে পারছে না। মাহির নিজের চুল আঁকড়ে ধরলো নিজের মাথা শান্ত করতে- সে কি ভাবছে কি বলছে তার কোনো কিছুর ঠিক নেই। সোরায়া নিষ্পলক চেয়ে মাহির কে দেখে যাচ্ছে- দুইদিন আগের মাহির স্যারের সাথে এই মাহির স্যারের কোনো মিল নেই।
দীর্ঘ ১৫ মিনিট নিরবতা। সোরায়া এখনো দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আর মাহির মাথা নিচু করে বেঞ্চের উপর হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। সোরায়া ধীরে পায়ে মাহিরের সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের হাত বাড়িয়ে মাহির কে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই মাহির বলল-
“স্পর্শ করবে না একদম। নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে সোরায়া।”
সোরায়া শুকনো ঢোক গিলে নিজের হাত নামিয়ে নিয়ে বলার চেষ্টা করল -“স্যা..স্যার!”
মাহির শান্ত চোখে সোরায়ার দিকে তাকিয়ে বলল-“বাড়ি যাও।”
সোরায়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো-“কিহ্!”
মাহির আবার একই কথা বলল-“অনুষ্ঠান শেষ এখন বাড়ি যাও। বাড়তি কোনো কথা শুনতে চাই না আমি। যাও।”
সোরায়া কিছু বলল না চুপচাপ ক্লাসের দরজার দিকে ডাকলো বাড়ি ফিরার জন্য। মাহির সোরায়ার ফেরার পথে তাকাতেই দেখলো সোরায়ার ব্লাউজের পিছন দিকের গলাটা বেশ বড়। মাহির সোরায়ার পিঠের দিকে তাকায়- একটা ছোট্ট তিল তবে যেন অনেক বড় আকর্ষণ সৃষ্টি করার ক্ষমতার অধিকারী সেটা। মাহির আবার নিজের দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে চেঁচালো-“শাড়ির আঁচল দিয়ে পিঠ ডাকো আগে, বোকা মেয়ে।”
সোরায়া মাহিরের আওয়াজে পিছনে ফিরলো কিন্তু মাহির কথায় মনোযোগ না থাকায় সে কি বলেছে শুনতে পায় নি। সোরায়া আবার প্রশ্ন করলো-“কি বললেন? শুনতে পাইনি।”
মাহির হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে হেঁটে সোরায়ার কাছে গিয়ে শাড়ির আঁচলটা পিছন থেকে ঘুরিয়ে পিঠ ঢেকে সামনে আনতে আনতে বলল-“পিঠ ঢাকতে বলেছি আঁচল দিয়ে।”
সোরায়াকে কভার করার পর একটু শান্ত অথচ আদেশ মূলক কন্ঠে বলল -“নিজেকে আর নিজের সব কিছু যত্নে, হেফাজতে রাখো যতটা সম্ভব।”
সোরায়া তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইল। মাহির আবার বলল- “যাও এবার।”
সোরায়া আর দাঁড়ালো না ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে সোজা রিক্সায় উঠে বাড়িতে ফিরে গেল।
কিছু সময় পর মাহির ও নিজেকে সামলে নিয়ে বাড়ির পথে দাওনা দেয় গাড়ি একদম ধীর গতিতে যেন তার দ্বারা গাড়িটা ও চলছে না আর। শরীরের কোনো শক্তি কাজে দিচ্ছে না। না পারতে গাড়িটা চালাতে হচ্ছে তার।
এমন সময় রায়ান কল করে মাহির কে। মাহির রায়ানের কল দেখে এক নিঃশ্বাস ছেড়ে কলটা ধরে। কল ধরার পর বরাবর মাহিরই বেশি সক্রিয় ভঙ্গিতে কথা বলে রায়ানের সাথে কিন্তু আজ মাহির কিছু বলছে না দেখে রায়ান প্রথমে কথা বলল-
“হ্যালো! মাহির? দোস্ত তুই আছিস? না গেছিস?”
মাহির বিরক্ত খুব। সবই যেন উল্টো আজ রায়ানের জায়গায় মাহির বিরক্ত হয়ে বলল-“বাল! না থাকলে কল কি তোর বউ ধরেছে?”
মাহিরের কথায় রায়ান মুহূর্তে ফুসে উঠলো-“ওই শালা, আমার বউ তোর ভাবি হয়। মায়ের সমান হয় ভাবি তাই ভাবি মা ডাকবি। আর তোর ফোন ধরার সাথে আমার বউ এর সম্পর্ক কি?”
রায়ান যে বউ নিয়ে মজা সহ্য করে না সেটা মাহির ভালো করেই জানে তাই ইচ্ছা করে মিরায়ার কথা তুলে রায়ানকে মজার মুড থেকে সিরিয়াস মুডে নিয়ে এলো। মাহির এবার স্বাভাবিক ভাবে বলল-“আচ্ছা ভুল হয়েছে আমার ভাবি মার কথা তুলে। এবার কিসের জন্য কল দিলি তাই বল এমনি তে তো তোর দেখা মেলে না।”
রায়ান ও আর কথা বাড়ালো না সোজা কাজের কথায় গেল-
“আমি আমেরিকা চলে এসেছি।”
মাহির রায়ানের দেশের বাইরে যাওয়ার কথায় জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কিহ্! কোথায় গেছিস বললি? আমেরিকা? কবে? কখন? কেন?”
রায়ান জানতো মাহির এমন কিছুই বলবে। রায়ান মাহির কে শান্ত করতে বলল-“আরে এক এক করে বলছি। হঠাৎ কাজ পড়ে গেছে। এইখানে একটা বড় ডিল আঁটকে আছে শুধু আমার এখানে না থাকার জন্য। ডিলটা কম্পানির জন্য ইম্পরট্যান্ট, তাই কিছু দিনের জন্য এসেছি কাজ শেষ হলে চলে আসবো। এবার সব ক্লিয়ারলি বুঝেছিস?”
মাহিরের মাথা বাইক রেসের কথা আসে সাথে সাথে। বাইক রেস আর একদিন পরই। মাহির হকচকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো-“তাহলে বাইক রেস ? তুই যদি দেশেই না থাকিস তাহলে কিভাবে সম্ভব!”
রায়ান মাহির কে আশ্বস্ত করতে বলল-“সেটার জন্যই কল করেছি তোকে। ২ তারিখের রাতে মানে কাল রাতে আমার ডিল টার অফিসিয়াল ক্লোজিং হবে আমি রাতের ফ্লাইটেই দেশে ফিরবো। ওখানে পৌঁছতে আমার বিকেল বা সন্ধ্যা হবে বুঝেছিস?”
মাহির রায়ানের কথা সম্পূর্ণ মন দিয়ে শুনে নিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো-“আচ্ছা সেটা না হয় বুঝলাম এখন আমাকে কল করেছিস কেন? এর মাঝে আমি কি করব?”
রায়ান একটু মুচকি হেসে বলল -“তুই আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসবি। তারপর একসাথে আমার বাড়ি গিয়ে ব্যাগটা রেখেই রেডি হয়ে বাইক টা নিয়ে তোর বাড়ি যাবো। তারপর তুই রেডি হয়ে নিবি । তারপর সেখান থেকে সোজা রেসের জন্য বের হবো দুজনে। সব প্লেন ঠিক আছে তো নাকি?”
মাহির দম নিলো একটু তারপর সম্মতি দিল-“ওকে ডান। তুই আমাকে টাইম বলে দিস কখন লেন্ড করবি, আমি চলে আসবো। এবার রাখ। বাই।”
মাহির আজকে নিজের থেকে ফোনটা রেখে দিল। রায়ান এইদিকে অবাক হয়ে বিড়বিড় করলো আনমনে –
“এই নমুনার আবার কি হলো? আজকে একটুও মজা করলো না , এমনকি চড়ুই পাখির কথাও তুলল না, এতো ভালো মানুষ কবে হলো?”
রায়ান আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন দেখলো না এখন সব প্লেন কমপ্লিট শুধু এক্সিকিউশন করতে হবে। রায়ান নিজের কম্পানির এখন পর্যন্ত বড় ডিল এর ক্লোজিং করতে যাচ্ছে অনেক প্রস্তুতির দরকার সফল হওয়ার জন্য তাই রুমে নিজের ল্যাপটপে মন দিলো না ঘুমিয়ে।
মাহির নিজের ধীর গতিতে গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরল। মনে মনে ভাবছে-“এতক্ষনে তো সোরায়ার বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা। ঠিক মতো পৌঁছেছে তো নাকি? যে অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হয়েছে …” মাহিরের মাথায় একঝলক সোরায়ার হাঁসি, শাড়ি পড়ে নাচার দৃশ্য ভেসে উঠতেই মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল-“উফ্! না, না, না মাহির কাম ডাউন! ফোকাস কর ড্রাইভিংএ নইলে এখানেই মরে পড়ে থাকবি। ওইটা তোর স্টুডেন্ট হয় সামলা নিজেকে।”
মাহির শত চেষ্টার পরও অসন্তোষ মনে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরলো।
খান বাড়ি~
বাড়িতে ফিরে কাউকে না দেখে দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা ঘরে গিয়ে পড়োনের কাপড় খুলে টাওয়াল নিয়ে শাওয়ার নিতে গেল।
ঠান্ডা পানি ঝড়ছে আর তার নিচেই দাঁড়িয়ে মাহির এক মনে শুধু সোরায়ার কথা ভাবছে। ঠান্ডা পানিও শরীরের উষ্ণতা কমাতে ব্যর্থ যেখানে, সেখানে মাথার চিন্তার চেয়ে মনের আবেগের জোর কাজ করবে বেশি এটাই স্বাভাবিক। মাহির বিরক্ত হয়ে বলল- “ধুর শালা, ঠান্ডা পানিতেও কাজ হচ্ছে না। কিভাবে শান্ত হবো আমি!”
মাহির নিজের উপর দয়া করে চোখটা বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিতে থাকে এমন সময় হঠাৎ তার সোরায়ার পিঠের তিলটার কথা মাথায় আসতেই ভেজা শরীরে আগুন লেগেছে এমন অনুভূত হলো। মাহির আকুল আবেদন করতে থাকলো-
“হায় আল্লাহ এইটা কি হচ্ছে আমার সাথে? আমি এসব আবলতাবল কি ভাবছি! মেয়েটা আমার স্টুডেন্ট। মাহির শান্ত হো শান্ত হো। কিছু দিন আগেও যে মেয়েকে দেখতে পারতি না এত কথা শুনিয়েছিস, তাকে কিভাবে ভালো লাগছে তোর!”
ব্যাকুলতা বাড়ছে ধীরে ধীরে, কমার নাম গন্ধও নেই। মাহির গোসল শেষে নিজের ঘরে এসে পরিপাটি করে নিল নিজেকে আর তারপরই বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরলো চোখ বন্ধ করে।
চৌধুরী বাড়ি ~
চোধুরী বাড়ির বেল বাজল হঠাৎ ড্রয়িং রুমে রামিলা চৌধুরী ছাড়া অন্য কেউ না থাকায় তিনি দরজাটা খুললেন। দরজার অপর পাশে ছিল একজন অপরিচিত লোক হাতে ছোটো একটা বক্স। রামিলা চৌধুরীকে সামনে দেখতে পেয়ে লোকটা অতি ভদ্রতার সাথে বললেন-
“আসসালামুয়ালাইকুম। মিরায়া রহমান নামে এখানে কেউ থাকে? উনার একটা পার্সেল ছিল।”
আসলে মিরায়ার বাইক লাইসেন্স টাই আজকে চলে এসেছে তাই সেটা তার বাড়িতে ডেলিভারি করার কথা বলেছিল মিরায়া। কিন্তু সে সময় মিরায়া আশেপাশে না থাকায় রামিলা চৌধুরী মিরায়ার হয়ে পার্সেল টা রিসিভ করার কথা ভাবেন।
রামিলা চৌধুরী-“ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বি, মিরায়া তো এখন এখানে নেই নিজের ঘরে আমি ওর মামণি.. না মানে ওর শাশুড়ি হই সম্পর্কে। আপনি আমাকে দিন আমি ওকে দিয়ে দেব।”
মিরায়া হঠাৎ নিচে নামার সময় একটা লোককে রামিলা চৌধুরীর সাথে পার্সেল হাত কথা বলতে দেখে হকচকিয়ে নিচে নেমে চেঁচিয়ে বলল-“মামণি মামণি! এইটা আমার পার্সেল আমি নিচ্ছি।”
রামিলা চৌধুরী চমকে মিরায়ার দিকে তাকালেন। মিরায়া দৌড়ে এলো দরজার কাছে তারপর পার্সেল দিতে আসা লোকটায় হাত থেকে পার্সেলটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিজের হাতে নিয়ে লোকটাকে ডেলিভারি চার্জ দিয়ে বলল-” আপনি এখন আস্তে পারেন ভাইয়া, ধন্যবাদ।”
লোকটা ভদ্র ভাবে টাকা টা বুঝে নিয়ে চলে গেলে রামিলা চৌধুরী একটু কুটিল চোখে তাকালো মিরায়ার দিকে। মিরায়া সেটা বুঝতে পেরে একটু অদ্ভুত জোরপূর্বক হেঁসে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করতে চাইল-“ওই..আসলে মামণি.. হয়েছে কি..!”
সম্পূর্ণ বানোয়াট কিছু বলার আগেই সোরায়া বাড়ির দরজায় হাজির মুখ টা বাংলার পাঁচের মতো করে ঝুলিয়ে রেখেছে। রামিলা চৌধুরীর মন বদল ঘটে সকল মনযোগ সোরায়ার দিকে চলে যায় এই সুযোগে মিরায়াও সোরায়ার অযুহাত কাজে লাগায়।
মিরায়া সোরায়া কে জিজ্ঞেস করলো-“কি হলো নবীনবরণ শেষ? মুখ এমন লাগছে কেন? আজ আবার কি হয়েছে তোর সাথে?”
সোরায়া চুপ রইল। ভাবছে কি বলবে যা ঘটেছে তার কি কোনো ব্যাখ্যা হয় আদতেও? সোরায়া মনে মনে উত্তর সাজাচ্ছে – “যদি বলি স্যার আমার জন্য এক স্টুডেন্ট কে মেরেছে তাহলে কেমন শুনাবে? না না বিচ্ছিরি শুনাবে। কিছু না বলে হেঁসে ঘরে চলে যাই বরং তাই ভালো হবে।
সোরায়া একটু ফাঁকা হাসলো তার পর একটু বানিয়ে বানিয়ে বলল- “কি হবে আবার! অনেক ভালো গেছে প্রোগ্রাম। নাস্তা ও দিয়েছিলো খেয়ে চলে আসছি। আমার ক্লান্ত লাগছে। এই শাড়িতে আর থাকতে মন চাইছে না। আমি বরং ঘরে গিয়ে কাপড়টা বদলে নেই।”
এই বলে এক দৌড় দিল শাড়ি হাতে দিয়ে হাঁটুর উপরে তুলে। সোরায়া চলে যাওয়ায় রামিলা চৌধুরী আবার পার্সেল নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন ভেবে মিরায়া সোরায়াকে ধরার ভান করে সোরায়ার পিছনে ছুটলো।
-“বনু দাঁড়া আমি আসছি। নবীন বরণের কাহিনী শুনবো।”
মুহুর্তের মধ্যে ড্রয়িং রুম সম্পূর্ন খালি শুধু রামিলা চৌধুরী একাই দাঁড়িয়ে আছেন।
রামিলা চৌধুরী অবাক মুখে আওড়ালেন-“এটা কি হলো! দুইজন এমন পালালো কেন? মনে হচ্ছে যেন চুরি করেছে। মেয়ে দুটোর কি যে হয় মাঝে মাঝে খোলা জানেন।”
উনিও দরজাটা লাগিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। এদিকে মিরায়া দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে পার্সেল টা খুলেই নিজের লাইসেন্স টা একবার মন ভরে দেখলো। খুশিতে তার লাফাতে ইচ্ছা করছে পারশু রেস আর সে এখন অংশগ্রহণ করার জন্য একদম তৈরি এই ভেবে মাটিতে পা পড়ছে না খুশিতে।
অন্যদিকে সোরায়া ঘরে ঢুকেই শাড়ির আঁচল টা খুলে শাড়িটা ভাঁজ মতো খুলে ফেলল এক নিমেষে যেন অসহ্য লাগছে এখন এই শাড়ি। কাপড় খুলেই সোজা ওয়াস রুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
সোরায়া ফ্রেশ হয়ে বের হওয়ার পর আজকের সব কিছু ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত মুখে বিছানায় বসে পড়ে ফোনটা হাতে নিলো। ফোনটা খোলার সাথে সাথে নোটিফিকেশন এর ঝড় উঠলো। হঠাৎ এত নোটিফিকেশন একসাথে কিভাবে আসছে কেন আসছে কিছুই বুঝতে পারছে না সোরায়া। কিছু সময় পর নোটিফিকেশন আসার গতি একটু কমাতেই সোরায়া ফোনটা ঘাটতে শুরু করে। হঠাৎ অনবরত নোটিফিকেশন আসার কারণে ফোনটা রীতিমতো হ্যাং করছে তার।
সোরায়া তাও অনেক প্রচেষ্টার পর একটা নোটিফিকেশন এ ক্লিক করতেই তার সামনে এলো একটা ভিডিও যেটাতে তাকে নাচ করতে দেখা যাচ্ছে। কেউ নাচের ভিডিও করে অনলাইনে দেওয়ার পর ভিডিও টা শেয়ার করতে করতে এই কয়েক মিনিটের মধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে। সোরায়া ভিডিওর ভিউস মিলিয়নে চলে গেছে তা খেয়াল করতেই তার মাথায় হাত চলে গেলো। এই ভিডিও ভুলেও চাচা চাচি বা পরিবারের কেউ দেখলে আর রক্ষা থাকবে না।
(বাড়ির কেউ এসব পছন্দ করে না। মিরায়ার সাহস ছিল ছোট থেকেই বাইক রাইডিং করতে পারছে লুকিয়ে কিন্তু সোরায়া ছোট তাই নিজের নাচ করার একটা কখনো পূরণ হয়নি তবে সে যে খুব করে চেয়েছিল এমন নয়। নাচ তার শখই ছিল কিন্তু মিরায়ার বাইক রাইডিং করা সেটা আসক্তি। জীবনের এক পর্যায়ে গেলে হয়তো শখ নাও থাকতে পারে কোনো কিছুর প্রতি কিন্তু আসক্তি থাকলে তা মৃত্যু পর্যন্ত থেকে যায়।)
সোরায়া ভিডিওটার কমেন্ট বক্স ওপেন করে দেখলো সেখানে কলেজেরই কেউ তার ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম আইডি টা দিয়ে দিয়েছে। আর তার জন্যই সবার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানোতে এত নোটিফিকেশন। সোরায়া দাঁত দিয়ে নখ কাটছে আর ভাবছে এখন তার কি হবে। সোরায়া সব গুলো নোটিফিকেশন এক এক করে দেখলো যেগুলো নাচের ভিডিও নিয়ে ছিল।
সোরায়ার যেমন চিন্তা হচ্ছিল তেমন আনন্দও হচ্ছিল তার নাচ সবাই পছন্দ করেছে দেখেছে। নাচটা নিতান্তই ক্লাসিক্যাল ফার্মে ছিল, এই যুগে মানুষ এমন সংস্কৃতির সম্মান করে তা ভালো লাগারই বিষয়। সোরায়া ভিডিওর কমেন্ট বক্স গুলো চেক করছিল সবাই তার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সোরায়ার মুখে একটা মৃদু হাসি খেলে গেলো তা দেখে।
সোরায়া এবার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট গুলো দেখতে গিয়ে দেখলো সব ছেলে দের আইডি থেকে রিকুয়েস্ট এমনকি মেয়ের ছবি ওয়ালা আইডি গুলো ও যে ছেলেদের ফেক আইডি তা বুঝা যায় নাম দেখেই। এবার মেসেজ থেকে করে তো আরো অবাক সে- এক এক জনের মেসেজ যেন প্যারাগ্রাফ এর মতো। সোরায়া মেসেজ গুলো দেখে হেঁসে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে আয়নার সামনে গিয়ে চুল নিড়িয়ে ঢং করে গাইলো কিছু গানের লাইন-
“মে রে ইতনে আশিক মে কিয়া কারু?
কিসে হা কারু!, কিসে না কারু!
কিস কিস কি মে পারবা কারু..?
মে ইতনি সুনন্দার হুঁ মে কিয়া কারু..?”
হঠাৎ মিরায়া এসে ঘরের দরজা খুলে বলল-“আর কি করবি এবার চট্টগ্রামে ফেরত যা।”
সোরায়া চমকে মিরায়ার দিকে তাকাল। মিরায়া এই মাত্র তাকে কি বলল সেটা মাথায় ঢুকতেই জিজ্ঞেস করল–সবাই জেনে গেছে তাই না?”
মিরায়া উপর নিচে মাথা নাড়লো। সোরায়া শ্বাস ছেড়ে মাটিতে বসে পড়লো সাথে সাথে।
ড্রয়িং রুমে~
রামিলা চৌধুরী, রায়হান চৌধুরী, রুদ্র, পাশে মিরায়া, সবার মাঝে সোরায়া আর তার সামনে ভিডিও কলে চাচি রোকেয়া বেগম আর চাচা শফিক রহমান একসাথে। সবার চোখ যেন অন্য রকমের অনুভূতি ব্যক্ত করছে। রামিলা চৌধুরী ও রায়হান চৌধুরী সামান্য লজ্জিত তারা মেয়ে দুটোকে দেখে রাখবেন বলে ঢাকা আসার জন্য বলেছিলেন। যদিও তাদের কাছে নাচ করাটা খারাপ কোনো শখ না তবে পরিবারের নিষেধ করা জিনিস অন্য পরিবারে করা সম্ভব অনুভব হওয়া আর করা সেই পরিবারের জন্য লজ্জাজনক। অন্য দিকে রুদ্র আর মিরায়া ভদ্রভাবে হাত সামনে বেঁধে বসে আছে। সোরায়া তো পারছে না মাটির নিচে চলে যেতে তার চাচা চাচির বিরক্তির কারণ হয়ে। অপর দিকে থাকা রোকেয়া বেগম এবং শফিক রহমান দুজনেই সোরায়ার কাজে অত্যন্ত লজ্জিত ও বিরক্ত।
(হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে মা বাপ মরা মেয়ে দুটো চাচা-চাচির কাছে মানুষ হয়েছে। সমাজের কিছু তুচ্ছ লোক
এমন সুযোগেরই অপেক্ষায় থাকে যখন তারা কোন কাজের জন্য মেয়ের পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে শুরু করবে। সেখানে যদি মেয়ের বাবা মা না থাকে সেক্ষেত্রে যাদের কাছে মানুষ হয়েছে তাদের উপর দিয়ে কি যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।)
রোকেয়া বেগম ও শফিক রহমান একসাথে নিজেদের সিদ্ধান্ত জানালেন-“সোরায়া তুই কালকের মধ্যে চট্টগ্রামে ফিরে আসবি। এর কোনো নড়চড় হবে না। কাল মানে কালই।
সোরায়া মাথা নিচু করে আছে। চাচা-চাচির কথার অবাধ্য হওয়ার মেয়ে সে নয় তাই নিঃশব্দে মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়লো।
মিরায়া বুঝতে পারছে সোরায়া মন থেকে চট্টগ্রামে ফেরার কথায় সম্মতি জানাচ্ছে না। মিরায়া একটু কাছে এসে বলল-
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৮ (৩)
“চাচা-চাচি প্লিজ, এবারের মতো ক্ষমা করে দেও বাচ্চা মানুষ বুঝতে পারে নি। আর বনু তো ইচ্ছা কোরে করে নি এসব কেউ ভিডিও করে ছেড়েছে। ওর তো দোষ নেই। তার চেয়ে বড় কথা ওর কলেজ খোলা যদি কলেজে ঠিক মতো না যায় তাহলে রেজাল্ট কি করবে একটু ভাবো।”
রোকেয়া বেগম মিরায়ার কথা বুঝছেন কিন্তু শফিক রহমান বেশ আত্মসম্মান সম্পন্ন মানুষ বাড়ির মেয়ে বাড়িতে ফিরে যাবে এটাই তিনি আপাতত চান আর এটা উল্টানোর সাধ্য কারো নেই। রোকেয়া বেগম মুখে কুলুপ এটে রাখলেন। শফিক রহমান বললেন গম্ভীর গলায়-
“সোরায়া নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছানো শুরু করো আর রুদ্র তোমায় বলছি কাল সকালে সোরায়াকে বাড়িতে চাই আমি।”
এই বলে কল কেটে দিলেন। সবাই থ মেরে রইল কিছু সময়।