আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪১
অরাত্রিকা রহমান
চেঞ্জিং রুমের উজ্জ্বল আলোয় দাঁড়িয়ে রায়ান আর মাহির নিজেদের রেসিং ড্রেস পরে নিচ্ছে। দু’জনের গায়ে এখন ঝলমলে ফুল বডি রেসিং স্যুট, কালো, লাল আর সিলভার রঙের নিখুঁত মিশ্রণে তৈরি—দেখলেই বোঝা যায় পেশাদার রাইডারদের জন্য বানানো। পোশাকটা সম্পূর্ণ টাইট ফিটিং, যেন শরীরের প্রতিটি পেশিকে শক্ত করে গেঁথে রেখেছে। কাঁধ, কনুই, হাঁটু আর কোমরের অংশে বসানো কার্বন ফাইবার প্রটেকশন প্যাড তাদের সুরক্ষা দেবে রেসের গতির ঝুঁকিতে।
রায়ানের স্যুটের বুকের ওপর উজ্জ্বলভাবে লেখা “Rayan 07”, পাশে তার লোগো—FireLine Racers; আর মাহিরের স্যুটে লেখা “Mahir 19”, কাঁধ জুড়ে রক্তিম স্ট্রাইপ, যেন গতির প্রতীক। দু’জনেরই হাতে কালো লেদার গ্লাভস, আঙুলের ডগায় ধাতব আবরণ, যাতে বাইকের হ্যান্ডলে শক্ত গ্রিপ থাকে। পায়ে পরেছে হাই-অ্যান্কল রেসিং বুট, কালো বেসে লাল স্ট্রিপ টানা—দেখতে যেমন রাফ, তেমনি আরামদায়ক। আর শেষ স্পর্শ হিসেবে হেলমেট—রায়ানের ম্যাট ব্ল্যাক, সামান্য সিলভার শেডে ঝলমলে; মাহিরের মেটালিক রেড, সামনে ভিসরটায় মিরর ফিনিশ, ভেতরের চোখ কেউ দেখতে পায় না।
মাহির রেডি হতে হতে রাগ মেশানো স্বরে রায়ানের উদ্দেশ্যে বলল:
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “তোর জন্যই দেরি হয়ে গেল! বাকি সবাই ট্র্যাকে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমরা এখনো তৈরি হচ্ছি! বউয়ের সাথে এত কি কথা বললি তুই?”
রায়ান মাহিরের কথা শুনে বিরক্ত গলায় হেলমেটের বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে:
— “বেশি কথা বলিস না, মাহির। খুব আহামরি দেরি হয়নি, এখনো অনেক সময় বাকি। রেস শুরু হবে ৯টায়, এখন বাজে মাত্র সাড়ে আটটা। আধা ঘণ্টা তো হাতে আছে! তুই কি মেকআপ করবি আরো?”
মাহির হেঁসে, কিন্তু মৃদু খোঁচা দিয়ে রায়ানকে বলল:
— “ভাগ্য ভালো যে রাস্তায় জ্যাম পড়ে নাই, না হলে তো ডকুমেন্টস জমা দিতে ঠিক সময় পৌঁছাতে পারতাম না! এত কি কথা বলতে হয় বউয়ের সাথে? শুধু বিদায়ই তো নিতে গিয়েছিলি! তার জন্য পনেরো মিনিট আমি গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছি!
রায়ান চুপ করে কয়েক সেকেন্ড, তারপর গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। মিরায়ার মুখটা হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে ওঠে—ওর অপ্রস্তুত চেহারা, কাঁপা কণ্ঠ, আর সেই বিদায় মুহূর্তটা। এক মুহূর্তের জন্য মনটা কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল তার।
তারপর নিজের মাথা একটু ঝাঁকিয়ে মাহিরের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে গম্ভীর গলায় বলল—
— “বউয়ের কথা তুলে মাথা উল্টাপাল্টা করে দিস না। একটু পরেই রেস শুরু, মনোযোগ হারালে পারফরম্যান্সে এফেক্ট পড়বে।”
মাহির চুপ করে তাকিয়ে থাকলো রায়ানের কথা শুনে, তারপর হালকা হাসে বলল:
— “ঠিক আছে ভাই, এখন ফোকাস করি। আজ ট্র্যাকটা আমাদের ময়দান।”
মাহির নিজের হাতটা মুঠো পাকিয়ে রায়ানের দিকে এগিয়ে দিতেই রায়ান নিজের হাত মুঠো পাকিয়ে মাহিরের হাতের মুঠোতে বাম্প করে নিলো। দূইজনের চোখে মুখে এক অন্যরকম আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তার প্রতিফল ঘটছে। অতঃপর পর দুজনেই হেলমেট পরে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
অন্যদিকে,
লেডিস চেঞ্জিং রুমটা তখন প্রায় নিস্তব্ধ। বাইরে থেকে হালকা ইঞ্জিনের গর্জন, মাইকের শব্দ ভেসে আসছে—কিন্তু ভেতরে এখন শুধু একটাই মানুষ, মিরায়া। সব মেয়েরা রেডি হয়ে ট্র্যাকে চলে গেছে, রুমে এখন শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ আর ধাতব বেল্ট বাঁধার টুংটাং আওয়াজ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিরায়া তাড়াহুড়ো করে নিজের রেসিং ড্রেসে প্রস্তুত হচ্ছে।
তার গায়ে এখন ডার্ক ব্লু আর ব্ল্যাক রঙের ফুল বডি রেসিং স্যুট—চামড়ার মতো চকচকে, কিন্তু ভেতরে নরম ও আরামদায়ক। পোশাকটা পুরো শরীরটাকে শক্তভাবে জড়িয়ে রেখেছে, যেন প্রতিটি নড়াচড়া গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারে। কাঁধ, কনুই, কোমর আর হাঁটুর জায়গায় রয়েছে সিলভার গ্রে প্রটেকশন প্যাড, যেখানে হালকা আলো পড়লেই ঝিলিক দেয়।
স্যুটের বুকের ওপর ছোট করে লেখা—“raya R. 12”, পাশে লগো: SkyRiders। হাতে পরেছে কালো ফিটিং গ্লাভস, পাতলা কিন্তু শক্ত, আঙুলের ডগায় রাবার গ্রিপ টানা যাতে স্টিয়ারিং ছুটে না যায়। পায়ে কালো বুট, গোড়ালি পর্যন্ত টাইট—চুলগুলো পুরোপুরি বেঁধে রেখেছে হিজাবের নিচে। সচরাচর হিজাব না পড়লেও মিরায়া রেসের সময় হিজাবের ব্যবহার করে নিজের পরিচয় গোপনে। মূলত লম্বা চুল হেলমেটের ভেতর ঢোকানোর জন্য।
সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেল্ট টেনে, বুকে স্যুটের জিপটা ওপরে টেনে নিল, তারপর নিঃশ্বাস ফেলে হেলমেটটা হাতে তুলে নেয়। তার মুখে মৃদু হাসি—উত্তেজনা আর স্নায়ুচাপের মিশ্র ছায়া।
মিরায়া নিচু গলায় নিজের প্রতিচ্ছবিকে বলল,
-“উফ… কত দেরি হয়ে গেল মিরা! আর একটু হলে ঢুকতেই পারতি না… কাগজপত্র জমা দিতে দেরি হলো আবার… আহ্! ভাগ্য ভালো সব মিটে গেছে।”
তার চোখে তখন এক অদ্ভুত ঝিলিক—উত্তেজনা, ভয় আর সাহস একসাথে নাচছে। সে খুব কম সময়ে নিজেকে তৈরি করে ফেলেছে, কিন্তু সেই প্রস্তুতির ভেতরেও তার আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট। মিরায়া যেহেতু জানে রায়ান আর মাহির এই রেসে আছে সে চাইছিল না নিজের বাইক রাইডার পরিচিতিটা এই মুহূর্তে সবাইকে জানাতে।
সে বরাবরের মতোই গোপনে রেসে অংশ নিচ্ছে—কেউ জানে না যে সেই “অচেনা রাইডার” আসলে কে। তাই ড্রেসের সঙ্গে সে মুখে তুলে নেয় একটা কালো মাস্ক, যা মুখটা পুরোপুরি ঢেকে দেয়—শুধু দুই চোখ দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটোর চহুনি তীক্ষ্ণ, আর দৃঢ়।
এরপর হেলমেটটা মাথায় পড়তেই সেই চোখও আড়ালে চলে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি তখন আর মিরায়া নয়—সে এখন বাইক রাইডার রায়াতে পরিণত হয়েছে। নিজেকে এমন বেশে দেখে মিরায়া হালকা আত্মবিশ্বাসী হয়ে হাসলো।
নিজের মধ্যে এক উত্তেজনা- নামহীন থেকেও রাতের রেসটাকে আলোকিত করতে যাচ্ছে নিজের গতিতে।
মিরায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে উৎসাহ দিল-
“ইউ ক্যান ডু ইট রায়া। উইন দ্যা রেস।”
মিরায়া ড্রেসিং রুম থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ তার নজর গেল তার হাতে রায়ানের দেওয়া ব্রেসলেট টার উপর। মিরায়া ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাঁসি ফুটে উঠল ব্রেসলেট টার দেখার সাথে সাথে। মিরায়া ব্রেসলেটের উপর হালকা হাতে আঙুল বুলিয়ে নিয়ে খুলতে নিলো সেটা। কারণ এটা এখন হাতে থাকলে রায়ানের নজরে এটা ধরা পড়বেই। তবে মিরায়া ব্রেসলেট টা হাত থেকে খুলতে উদ্যত হতেই রায়ানের বলা কথাটা তার মনে পড়ে গেলো-
“ওটা হাত থেকে খুলবে না। আমি ছাড়া ওটা খুলার অধিকার কারো নেই। মাইন্ড ইট।”
মিরায়া ব্রেসলেট টা খুলতে গিয়েও খুলল না। শুধু মুচকি হেঁসে ব্রেসলেট টার দিকে তাকিয়ে বলল-
“চিন্তা নেই খুলবো না তোকে। যে পরিয়েছে তার কারণে, আর তার হাতেই আমার হাত থেকে খোলা হবে তোকে।”
এই বলে ব্রেসলেট টা সে জ্যাকেটের মধ্যে গুঁজে ভিতরে লুকিয়ে রেখে দিল। যেহেতু বডি সুট ভীষণ টাইট তাই ব্রেসলেট টা নিজ জায়গা থেকে নড়বে না আশা করা যায়। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিরায়া কিছু সময়ের মধ্যেই বাকি সব চেক করে নিয়ে মেইন স্টেজের দিকে অগ্রসর হয়।
গ্যালারি~
এদিকে রেস প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। রাতের আকাশটা যেন আগুনের নীচে পুড়ছে—উপরের তারকারাজি, নিচে আলোয় ঝলমল রেস ট্র্যাক। চারদিক থেকে ধোঁয়া উঠছে হালকা নীল লাইটে, ট্র্যাকের প্রান্তে দাঁড়ানো বিশাল স্পটলাইটগুলো একের পর এক জ্বলে উঠছে। দর্শকসারি পূর্ণ, স্ট্যান্ডে কেউ পতাকা নাড়ছে, কেউ মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে শিস দিচ্ছে—সবার চোখ স্থির বিশাল রেস ময়দানের দিকে।
মঞ্চের পাশে ঘুরে ঘুরে ভেসে আসছে বাইকের ইঞ্জিন গরম করার শব্দ-“ভ্রুমমম… ভ্রুমমমমম…” বাতাসে মিশে আছে পেট্রোল আর অ্যাড্রেনালিনের গন্ধ। প্রতিটি রাইডার নিজের বাইকের সিটে বসে মনোযোগী মুখে সামনে তাকিয়ে আছে,
কারও গায়ে কালো, কারও লাল, কারও সিলভার রেসিং স্যুট—সবাই যেন একে অপরকে হারানোর জন্য জন্ম নিয়েছে।
রায়ান মাহির দুইজনেই তাদের বাইককের উপর আরো কম করে ৪৮ জনের মতো আছে। রায়ান স্থির মুখে বাইকে বসা। না কোনো উত্তেজনা আছে আর না চিন্তার ছাপ। এই দিকে মাহির খুব উত্তেজিত হয়ে চারপাশটা খেয়াল করছে- কার কোন বাইক, বসার স্টাইল ইত্যাদি। মাহিরের নজর একটা বাইকের উপর পরলো বাইকটা দেখার পরই সে রায়ানের দিকে ঝুঁকে বলল-
“দোস্ত ওই বাইকটা মনে হয় ভালো করবে। বেশ লাগছে কিন্তু।”
রায়ান মাহিরের দিকে তাকালো কিন্তু উল্লেখিত বাইকের দিকে নয়। সে মাহিরের কথার মজা উড়িয়ে বলল-
“বাইক রেস করবে, না বাইক রাইডার বল তো?”
মাহির বুঝে গেল রায়ান কি বলতে চাইছে। তাই নিজের বাইকে সোজা হয়ে বসলো। ছেলেদের অপজিটেই ছিল মেয়েদের সারি। এক একজন মেয়ে স্টাইল নিয়ে কেউ নিজেদের বাইকের উপর, কেউ পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, আবার কেউ ভিডিও করছে, কেউ ছবি তুলছে। মাহির এইসব দেখে মনে মনে বলল-
“এই মেয়ে গুলো রেস করতে এসেছে না শোঅফ করতে?”
রায়ান মাহিরের কথা শুনতে পেয়ে বাঁকা হেঁসে বলল-
“ওরা যাই করতে আসুক না কেন তুই অন্তত ওরা এখানে কি করতে এসেছে তা নিয়ে গবেষণা করতে আসিস নি। নিজের কথা ভাব মন স্থির কর।”
মাহির আর কি বলবে, রায়ানের সাথে তর্কে হাড়া এখন তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাহির বিড়বিড় করলো-
“এই শালার মাথায় এমন এ্যাকুরেট উত্তর কিভাবে আসে?আমার তো কথাকাটাকাটির সময় ভালো ভালো পয়েন্ট গুলো মনেই থাকে না।”
হঠাৎ মঞ্চে আলো পড়ল। সেখানেই দাঁড়িয়ে দুই হোস্ট—একজন ছেলে, এক মেয়ে।ছেলেটার নাম আদ্রিয়ান, কালো জ্যাকেট, হাতে মাইক। মেয়েটা লারা, উজ্জ্বল নীল পোশাকে হাসিমুখে দর্শকদের দিকে হাত নাড়ছে।
লারা উচ্ছ্বসিত হেসে-
“ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ! স্বাগতম আপনাদের এই বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত মুহূর্তে— আজকের রাতের তুফান রেস, ‘স্পিড ওয়ার্স নাইট’!”
দর্শক গর্জে উঠল, ভেসে এল করতালির ঢেউ সবাই চেঁচাতে লাগলো -“ইয়য়য়ে…!”
আদ্রিয়ান উত্তেজিত কণ্ঠে-
“আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি—
কেউ আজ মাঠেতে নামবে বিজয়ী হতে, আর কেউ হারবে, কিন্তু গতি ও সাহসের ইতিহাসে নাম লিখে যাবে তা নিশ্চিত!”
লারা চতুর হাসি দিয়ে আদ্রিয়ানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো-
“তবে একটা প্রশ্ন… আজ কারা বাজিমাত করবে?”
“ছেলেরা? নাকি মেয়েরা? উইনার কোন দল থেকে পাবো? কি মনে হয়?”
আদ্রিয়ান উত্তর দেওয়ার আগেই গ্যালারিতে থাকা একদল দর্শক চেঁচিয়ে উঠল—“বয়েজ! বয়েজ!”
অন্যদল সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা স্লোগান—“গার্লস! গার্লস!”
আদ্রিয়ান হালকা হেঁসে লারার কথার জবাবে নিজের কমিউনিটির হয়ে বলল-
“আমি বলছি, আজ ছেলেরা মাঠ কাঁপাবে!”
লারা হাসি চেপে আদ্রিয়ান এর কথার প্রেক্ষিতে বলল-
“দেখা যাক, যখন মেয়েরা বাইকে উঠবে তখন কে কার গতি দেখে ঘাম ঝরায়!”
গ্যালারিতে এবারো শোরগোল পড়ে গেল চিৎকার চেঁচামেচিতে। মঞ্চের আলো একবার নিভে গেল- বাতাস কেঁপে উঠল, দর্শক গর্জে উঠল উল্লাসে। রেস ট্র্যাকের চারপাশে নীল ও কমলা লাইট ঝলমল করছে,বড় স্ক্রিনে ভেসে উঠছে অক্ষরে অক্ষরে—
“Storm Riders — The Battle of Speed Begins!”
লারা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল- “কি বলো আদ্রিয়ান? তাহলে শুরু করা যাক?”
আদ্রিয়ান উত্তর দিতে মাইক মুখের কাছে নিয়ে বলল-
“ডেফিনেটলি। লেট’স স্টার্ট।”
তাদের হাসি, কণ্ঠ, আর হাতে মাইক যেন পুরো স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে তুলছে।
লারা উত্তেজিত ভঙ্গিতে-
“আজকের এই রাতে নামবে মোট ৫০ জন রাইডার, যারা দেশের বাইক দুনিয়াকে করেছে গর্বিত, আর আজ রাতে তারা মুখোমুখি হবে ইতিহাস গড়ার লড়াইয়ে!”
আদ্রিয়ান: “তাহলে প্রস্তুত হোন, কারণ এরা গতি নয় বজ্রকেও ছাপিয়ে যাবে।”
লারা:
“প্রথমেই আসছে সেই রাইডার, যার বাইকের সাথে বন্ধুত্ব ১০ বছর পুরনো—দেশের ‘রোড কিং’ নামে পরিচিত,
তার বিশেষ টেকনিক—‘ডাবল লিন স্পিন!’
সবাই স্বাগত জানান রাইডার—রোহান আহমেদ!”
রোহান বাইক নিয়ে ট্র্যাকে ঢুকল। চাকার নিচে ধোঁয়া উড়ে উঠল, সে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে হালকা ড্রিফট দিল,দর্শক চেঁচিয়ে উঠল, পতাকা নাড়াচ্ছে স্ট্যান্ডে।
লারা-“উউউ.. ওকে। নেক্সট স্টাফ। আদ্রিয়ান ইউ কল।”
আদ্রিয়ান:
“পরের রাইডার, যার প্রতিটি টার্নে বাজ পড়ার মতো স্পার্ক উঠে—তার গতি ৩০০ কিমি ছুঁয়ে যায় সহজেই!
বিশেষ ট্রিক—‘এয়ার-কার্ভ ড্রিফট!’
অডিয়েন্স গর্জে উঠুন—আদনান হোসেন!”
আদনান এক পায়ে বাইক ঘুরিয়ে বাতাসে হাত তুলে দর্শকদের দিকে থাম্বস আপ দিল। ভক্তরা তার নাম ধরে চিৎকার করছে, কেউ পোস্টার নাড়ছে—” Go Adnan Go!”
লারা:
“তৃতীয় রাইডার—অন্ধকারে যার চোখই তার দিশা!
প্রতিপক্ষ তার সামনে গেলে ছায়ার মতো হারিয়ে যায়!
বিশেষ স্টাইল—‘ঘোস্ট টার্ন মুভ!’
চিয়ার আপ ফর—তানভীর ইসলাম!”
তানভীর ট্র্যাকে ঢুকতেই কালো বাইকের নিচে নীল আলো জ্বলে উঠল, দর্শকসারিতে ছোট ছেলেরা মুখ হাঁ করে তাকিয়ে আছে। কারো হাত এখন থামেনি তালি বাজাচ্ছে সবাই।
আদ্রিয়ান হাসতে হাসতে-
“এই নামটা শুনলেই অন্যরা গতি বাড়ায়—
কারণ সে নাম মানেই বিপদ! বাইকে আগুন জ্বালানো, টায়ারে স্পার্ক ছড়ানো—সবই ওর স্বাভাবিক স্টাইল!
মেইন মুভ—‘হুইলবার্ন ব্লাস্ট!’
এখানে আসছে, দ্য ফ্লেম স্ট্রাইক, গিভ ইট আপ ফর—মাহির খান!”
মাহির রায়ানের দিকে এক নজর তাকিয়ে মুচকি হেঁসে হেলমেটের গ্লাসটা নামিয়ে বাইকে উঠে দুইবার এক্সিলারেট দিল, বাইক থেকে লাল আগুনের রেখা বের হলো,
আর সে হেলমেট খুলে হালকা হাসি দিল দর্শকদের দিকে—
তালির শব্দে গভিবাতাস কেঁপে উঠল। মাহির রায়ানের দিকে তাকালো যেন বলতে চাইছে-“এবার তোর পালা।”
মিরায়া একপ্রকার দৌড়ে পৌঁছালো নিজের বাইকের কাছে। বাকি মেয়েরা মিরায়ার এমন মুখ ঢাকা গেট আপ দেখে চোখ ছোট করে তাকিয়ে দেখলো। তারা নিজেরাই সমালোচনা করছে-
“দেখ দেখ কিভাবে মুখ ঢেকেছে।”
-“সিরিয়াসলি খেত মনে হয়। এভাবে কে রাইড করে ভাই।”
মিরায়া তাদের কথার পাত্তা দিল না এইগুলো সে আগেও শুনেছে অনেক কিন্তু দিন শেষে তার জিৎ তার সাক্ষ্য ছিল।মিরায়ার মনে তখন এক ভাবনা ঘুরছে-
-“শুরু হয়ে গেছে। উফ্! আমার হাবির এন্ট্রি কি মিস করে ফেললাম নাকি? না না খোদা প্লিজ উনার টার্ন যেন এর পরই আসে। আমি উনাকে দেখতে চাই। এতো ভীরে তো চেনাও যাচ্ছে না।”
(স্টেডিয়ামের আলো এক মুহূর্তের জন্য নিভে গেল)
দর্শক হঠাৎ চুপ—তারপরই দূর থেকে একটানা শব্দ—
“ভ্র্র্রুমমমমমমমমম!!!”
দেখা গেল ধোঁয়ায় ভরা করিডর থেকে এক বাইক বেরিয়ে আসছে, ধীরে ধীরে ট্র্যাকে প্রবেশ করছে—চাকার নিচে ঝলমলে নীল আগুনের রেখা।
লারা রোমাঞ্চিত গলায়-
“লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন…আজকের স্পেশাল রাইডার—তিনি বাংলাদেশের নন! তিনি এসেছেন আমেরিকার রাইডিং কমিউনিটি থেকে, দেশের বাইক কমিউনিটির ওয়ান অফ দ্য বেস্ট প্রো রাইডার! আন্তর্জাতিক টাইটেল ‘রোড ফ্লেম ২০২৪’ জয় করেছেন, আরো একাধিক আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী—আজকের মাঠে যার উপস্থিতি মানেই অন্যদের জন্য চ্যালেঞ্জ!”
তার স্পেশাল ট্রিক—‘ঘোস্ট স্পিন টার্বো!’
স্ক্রিম ফর দ্যা ওয়ান এ্যান্ড অনলি—রায়ান চৌধুরী!!!”
স্টেডিয়াম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই তাকিয়ে আছে একদিকে।
হঠাৎ অন্ধকার। তারপর—একটা কালো-রুপালি বাইক বজ্রের মতো ছুটে এলো ট্র্যাকের শেষ প্রান্ত থেকে! চাকার নিচে ঘর্ষণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ উড়ল। ধোঁয়া আর বাতাসে তার চারপাশ ঝাপসা হয়ে গেল।
রায়ান বাইকটাকে হঠাৎ একদম উল্টো দিকে ঘুরিয়ে একই জায়গায় তিনবার ঘূর্ণন করল—চাকা মাটি ছুঁয়ে স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে, ধোঁয়ায় তার চারপাশটা ঢেকে গেল, দর্শকরা চিৎকারে ফেটে পড়ল— “ওওওওওওফফফফফ!!! কী স্পিন রে ভাই!!!”
ধোঁয়া পরিষ্কার হতেই দেখা গেল—
রায়ান বাইকের সিটে হেলান দিয়ে একহাতে হেলমেট খুলছে,
আরেক হাতে বাইকের হ্যান্ডেলে হালকা ট্যাপ দিচ্ছে, যেন এক ধরনের শাবাশী তার বাইকের জন্য। তার চোখে দৃঢ়তার, নিচে হালকা হাসি— একটা আত্মবিশ্বাসী মুখ।
রায়ান বাইকটা সামান্য সামনে নিয়ে গিয়ে উইলি করল,
চাকা বাতাসে উঠে গেল, তারপর সোজা নেমে এসে বাইকটা থামাল নিখুঁত ভারসাম্যে, যেন পুরো ট্র্যাক তার নিয়ন্ত্রণে।
দর্শকসারি থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠল- “রায়ান..! ইউ আর সো হেন্ডসাম!”
রায়ান ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসলো। ঠিক তার পর ই স্টেডিয়ামের সবার উদ্দেশ্যে নিজের বা হাতের রিং ফিঙ্গার টা দেখিয়ে সেটাতে তার বাইকের মিরায়ার কানের ঝুমকো ওয়ালা চাবি পড়ে বোঝাতে চাইলো সে কমিটেড। গ্যালারিতে সবাই আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠলো-“নো নো প্লিজ। ডোন্ট সে দ্যাট।”
রায়ান মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়ালো। এই দিকে মিরায়া সম্পূর্ণ দৃশ্যটা দেখে মনে মনে নাচতে শুরু করে দিয়েছে-
“আহ্! হুয়াট আর মোমেন্ট। যাহ্! এমন কেউ করে লজ্জা লাগছে আমার।”
মিরায়ার শরীর আপনা আপনি বেঁকে আসছে যেন। মিরায়া নিজেকে বুঝে উঠে সাবধান করলো-“মিরা চলে যা, চলে যা। রায়া তোর এতো নেকামি করা মানায় না। বি টাফ, বি হার্ড।”
রায়ানের বাইকের চারপাশে এখন ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘুরছে,
লাইটগুলো তার শরীরের উপর রূপালি প্রতিফলন ফেলছে,
আর পুরো রেস ট্র্যাক জুড়ে বাজছে একটাই আওয়াজ—
“রায়ান! রায়ান!”
মেয়েরা চেঁচিয়ে উঠছে, আর ছেলেরা দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে, রায়ান ধীরে ধীরে হেলমেট আবার মাথায় পরল,
ইঞ্জিনে গতি তুলল, চোখে জ্বলল সেই আগুন— যে আগুনে শুরু হবে আজকের রেসের ইতিহাস।
মিরায়া উৎসুক নজরে ট্রেকে তাকালো-“উফ্! কি টাইমিং আমার।” মিরায়া তালি দিতে গিয়েও দিল না নিজের ইগো বজায় রাখতে তবে মনে মনে সে ভীষণ খুশি।
লারা মজার সুরে হেসে বলল—“দেখে মনে হচ্ছে শুধু রেস নয়, কিছু হৃদয়ও জিতবে আজ এই রাইডার!”
আদ্রিয়ান হেসে উত্তর দিল— “তবু ভুলে যেও না, এই মাঠে ভালোবাসা নয়, গতিই জেতে!”
মিরায়া হেলমেটের গ্লাসটা তুলে নিয়ে রায়ানকে দেখছিল। নিজের মনে রায়ানকে ওইভাবে দেখে খুব শান্তি পাচ্ছে। পাশের দুইটা মেয়ে কিছু বলাবলি করছিল যা মিরায়ার কানে আসতেই চোখ হিংসামীতে ফেটে পড়ল-
“ওয়াও, হাউ হেন্ডসাম হি লুকস! হায়, মে তো মার গেয়ি।”
অন্য আরেকটা মেয়েও সাথে তাল দিল-“ইয়াহ আই নো। হি ইজ সো ফাঁ*কিং হেন্ডসাম।”
মিরায়া তুচ্ছার্থে হেঁসে রেগে বিড়বিড় করল-
“শালির চেংরি গুলা আমার হাবির দিকে নজর দিতেছে কেন? মনটা চাইতেছে হেলমেট টা খুলে মাথায় বাড়ি দেই শাকচুন্নী গুলার। ফকিন্নির দল কোনো দিন বেডা মানুষ দেখে নাই লাগে।”
-“আহা! রায়া মিরাকে কন্ট্রোল করে নে। কুল ডাউন রায়ানের হৃদপাখি। রায়াকে রেসটা জিততে দে সুন্দর মতো। পড়ে সব দেখে নেব।”
মিরায়া নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে সামলালো।
আবার সবার নজর ট্রেকে। মঞ্চের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। এক এক করে ৪৯ জনের আগমন হতেই দূর থেকে এক গম্ভীর ইঞ্জিনের আওয়াজ— “ভ্র্র্র্র্রুমমমম!” কালো বাইকে আসছে এক বিশাল দেহী রাইডার, কাঁধে কাটা লেদার জ্যাকেট।
আদ্রিয়ান গভীর কণ্ঠে-
“আর শেষে… আজকের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বী,
যার নাম শুনে অন্য রাইডাররা এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়—
দ্য ক্র্যাশ কিং—জ্যাক ওয়াহিদ!”
জ্যাক ট্র্যাকে ঢুকে হঠাৎ বাইকটা ঘুরিয়ে ব্রেক করল ট্র্যাকের ধুলো উড়ে মঞ্চ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। সবাই একসাথে চিয়ার করলো-“জ্যাক, জ্যাক, জ্যাক!”
জ্যাক ঠিক রায়ানের পাশেই বাইক দাঁড়া করালো। রায়ানের চোখ তার দিকে ঘুরল—দুজনের মাঝে নীরবতা, শুধু ইঞ্জিনের গর্জন বাজছে। দর্শক নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে—
আজকের রাতের আসল দ্বন্দ্ব যেন শুরু হয়ে গেল আগেই।
হঠাৎ আকাশ জুড়ে ভেসে উঠল গোলাপি ও বেগুনি লাইটের ঢেউ। বড় স্ক্রিনে আগুনের অক্ষরে লেখা উঠল—
“Queens of Speed — The Real Thunder Begins!”
লারা উত্তেজিত ভঙ্গিতে-
“ছেলেরা ট্র্যাক কাঁপিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখন আসছে সেই দল—যারা শুধু গতি নয়, স্টাইল, স্মার্টনেস আর নিখুঁত নিয়ন্ত্রণের জন্য বিখ্যাত!”
আদ্রিয়ান হাসি দিয়ে-
“এবার মাঠ মাতাবে ৫০ জন লেডি রাইডার, যাদের জন্য এই ট্র্যাক তৈরি আজ আগুন ছড়াতে! ওয়েল কাম দ্যা কুইন্স।”
লারা-” তাহলে আর অপেক্ষা কিসের! চলো শুরু করা যাক।”
“প্রথমেই আসছে সেই মেয়ে, যার নামেই আছে আগুন!
‘ফায়ারব্লেড গার্ল’ নামে পরিচিত,
তার স্পেশাল ট্রিক—‘ব্লেজ-লুপ স্টান্ট!’
যে গতিতে সে বাইক ঘোরায়, তাতে ট্র্যাক কেঁপে ওঠে!
গিভ আ বিগ হেন্ড ফর- “অনামিকা দত্ত”
অনামিকা বাইক নিয়ে ঢুকলো, সামনে এসে হালকা ড্রিফট করল, বাইক থেকে হালকা আগুনের রেখা বেরোল।
দর্শকরা হাততালি দিয়ে উঠল—“ওয়াও!”
আদ্রিয়ান:
“এই রাইডারের কৌশল রাতের চাঁদের মতো শান্ত, কিন্তু নিখুঁত! তার ট্রিক—‘মুনস্পিন ফ্লিপ’,
যেখানে সে বাইক একবার ঘুরিয়ে বাতাসে সামান্য উঠিয়ে ভারসাম্য ধরে রাখে!
প্লিজ ওয়েল কাম- “মেহের আফরিন”
মেহের ট্র্যাকে ঢুকে হালকা ঘূর্ণন দিয়ে এক চোখ টিপে দর্শকদের দিকে হাত নাড়ল, তার হেলমেটের ভেতর থেকে চুলের এক ফোঁটা বাতাসে নাচল— ছেলেরা হালকা সিটি বাজাতে শুরু করল!
লারা:
“পরের রাইডার—একদম বিপরীত জুটি! সে রোজের মতো সুন্দর, কিন্তু ট্র্যাকে নামলেই বজ্রপাতের মতো ভয়ংকর!
তার কৌশল—‘ইলেকট্রিক ড্রিফট কাট!
চিয়ার ফর-“জান্নাতুল ফেরদৌস”
জান্নাত বাইক চালিয়ে একদম বাঁদিকের কর্নারে ঘুরে স্পার্ক ছড়ালো— আলো যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিল, আর দর্শকরা দাঁড়িয়ে গেল উল্লাসে।
আদ্রিয়ান রোমাঞ্চিত গলায়-
“এই রাইডারকে সবাই বলে ছায়া! কারণ তার বাইক দেখা যায়, কিন্তু তাকে নয়!
স্পেশাল ট্রিক—‘শ্যাডো স্লাইড!’
যেখানে সে এক সেকেন্ডে ট্র্যাকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়!
ওয়েলকাম-“নূর হানিফা।”
আলো হঠাৎ নিভে যায়, আর পরের মুহূর্তেই নূর বাইক নিয়ে ঠিক স্টার্টিং লাইনে এসে দাঁড়ায়— দর্শক চমকে ওঠে, “ওফফফ!”
দৃশ্য ধীরে ধীরে গাঢ় হয়, লাইট এক পয়েন্টে থেমে যায়)ষ
লারা গভীর স্বরে বলতে শুরু করল-
“এবং এখন আসছে সেই নাম, যার জন্য চট্টগ্রামের রেস কমিউনিটি আজ গর্বে ভরে আছে! যিনি গতবছর ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল স্ট্রিট রেসিং চ্যাম্পিয়ন’ হয়েছিলেন, যার বাইক কন্ট্রোল এত নিখুঁত যে অনেকে তাকে বলে—‘দ্য রাইডিং ম্যাজিশিয়ান!’
তার ট্রিক—‘সোলার স্টর্ম স্পিন!’
সবাই প্রস্তুত তো?!আসছে—রায়া রহমান! চিয়ার হার্ড পর হার!”
মিরায়া নিজের নাম শুনার সাথে সাথে উৎসাহ নিয়ে বাঁকা হেঁসে হেলমেটটার গ্লাস নামিয়ে বাইকে উঠলো। পাশের বড় স্পিকার থেকে ইঞ্জিনের ভয়ংকর গর্জন শোনা যায়—”ভ্র্র্র্র্রুমমমমমমমমমমম!!!”
রায়ান অতিরিক্ত আওয়াজে নাম খানিকটা ভুল শুনে চোখ বড় বড় করে আওড়াল-“কিহ্ নাম? মিরায়া?”
মাহির হেঁসে রায়ানের মজা উড়িয়ে বলল-“এত বউ পাগলা হোস না ভাই। এখন রাইডারের নামেও বউয়ের নাম শুনলি? রায়া বলেছে, মিরায়া না।”
রায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল-“ওহ্ আচ্ছা।”
মাহির রায়ানকে আরো একটু জ্বালাতে বলল-
“নামের মিল দেখেছিস? রায়ান, রায়া!”
রায়ান কুটিল হেঁসে মাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল-
“হিহিহি! ভেরি বেড অবজারভেশন।”
মাহির নিজের হাসি থামিয়ে দিল সাথে সাথে। রায়ান মাহির হঠাৎ শব্দে সোজা তাকায়।
দূর থেকে উড়ে আসছে এক কালো বাইক,
ট্র্যাকে ঢোকার মুহূর্তেই রায়া এক জায়গায় তিনবার স্পিন করল, চাকা থেকে ধোঁয়া আর ধুলো উড়ে গেল চারদিকে।
স্ট্যান্ডের মেয়েরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে, আর ছেলেরা… চুপ শুরু রিয়েকশন স্বরূপ মুখ থেকে আবেগপ্রবণ আওয়াজ বের হচ্ছে -“উউউ.. ওয়াওওও…!”
সব রাইডার এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তারপর ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তেই দেখা গেল—রায়া ধীরে হেলমেট খুলছে।
হিজাব ও মাস্ক পড়ে থাকার কারণে চোখে ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—
গ্যালারিতে সবাই ফিসফিস করছে-“ও মাস্ক পড়ে আছে কেন? চেহারা তো দেখতে পারছি না।”
কেউ একজন বলে উঠলো-“গেট রিড অফ ইউর মাস্ক।”
মিরায়া শুনলো তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। স্বাভাবিক ভাবেই সবাই কৌতুহল দেখায় তার চেহারা দেখার কিছু সে কখনো নিজের ফেস রিভিল করে নি।
অন্য মেয়েরা যেন একটু পিছিয়ে গেল…কেউ চুপ করে বলল,
“দিস গার্ল ক্যান বি আ থ্রেট।”
রায়ান মাহির সহ বাকি সব ছেলে রাইডার মিরায়ার উপস্থিতিতে থমকে গেল। রায়ান মিরায়ার বাইক স্পিনিং দেখে একটু মুচকি হেঁসে মাহির কে বলল-“মাহির বেট ধরবি?”
মাহির মিরায়ার থেকে চোখ সড়িয়ে অবাক হয়ে রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল-
“কিহ্? কিসের বেট?”
রায়ান মাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল- “মেয়েদের দল থেকে এই মেয়েটা জিতবে আমি বলছি। ডু ইউ ওয়ানা বেট অন দিস?”
মাহির মিরায়ার দিকে তাকিয়ে আবার রায়ান কে বলল-
“তুই এতো সিয়র কিভাবে রায়া জিতবে?”
রায়ান স্বাভাবিক ভাব নিয়ে বলল-“গাট ফিলিং। তুই বল বেট করবি কি না।”
মাহির অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল-“রায়ান চৌধুরী জাস্ট গাট ফিলিং এর জন্য বেট ধরছে। বাহ্! ঠিক আছে ধরলাম। কি নিয়ে বেট?”
রায়ান হেঁসে বলল-“কিছু না শুধু তোর ভাবি মা কে সব সত্যিটা বলার পর কিভাবে মানাবো সেটার প্লেন দিবি। তোর কি চাই?”
মাহির হালকা হেঁসে বলল-“তুই তাহলে আমাকে আমার স্টুডেন্ট ক্রাশ কে ম্যানেজ করার প্লেন দিবি। ডিল ডান?”
রায়ানও হেঁসে বলল-“ওকে ডান। যদিও স্যার মামলা অনেক অসামাজিক মনে হচ্ছে তবে সমস্যা নেই আমি জানি আমি হারবো না। সো ইট’স আ ইয়েস।”
মাহির মুখ বাঁকা করে ফেলল-“চুপ করে যা তো। অসামাজিকই সই। আমার ওই নিষিদ্ধ পূর্ণতাই লাগবে। নিজে ৭ বছরের মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছিল তার কিছু না খালি আমার টাই অসামাজিক লাগে তার। দূরে গিয়া মর তুই। আমি দেখবো ওই মেয়ে জেতে কি না।”
রায়ান হেঁসে আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলল- “দ্যাট গার্ল ইজ গোয়িং টু উইন। জাস্ট ওয়াচ হার।”
মাহির আর কিছু বলল না। শুধু রায়ানের কথায় সায় দিল।
এরপর একে একে বাকি সবার নাম এ্যানাউন্স করা হলো।
সব পরিচিতি পর্ব শেষে ছেলেরা এক দিকে আর বিপরীতে স্ট্যান্ডের দিকে মেয়েরা। এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই, এক মুহূর্তে —একটা হালকা নীরবতা তৈরি হলো। ঠিক সেই সময়,রেসের স্টার্টিং লাইন পেরিয়ে, দুই দিক থেকে দুটি চোখ একে অপরের সাথে ধাক্কা খেল।
একজোড়া চোখ—হেলমেটের কাঁচের ভেতর থেকে জ্বলজ্বলে, দৃঢ়, কিন্তু শান্ত আগুনের মতো।
আর অন্যজোড়া—ঠান্ডা, গভীর, কিন্তু তীক্ষ্ণ…।
মিরায়া ঠিক রায়ানের সোজাসুজি অবস্থানে। রায়ান একবারের জন্য তাকালো মিরায়ার দিকে—মিরায়াও খেয়াল করলো রায়ান তার দিকে তাকিয়ে আছে। মিরায়া ভাবনার মধ্যে পড়ে গেল-
-“উনি এভাবে কেন তাকিয়ে আছেন আমার দিকে? আমাকে কি চেনা যাচ্ছে?”
রায়ান চৌধুরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মিরায়ার দিকে-
“মেয়েটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি? (মিরায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে) ঐ চোখগুলো… কোথায় যেন দেখেছি। লাইটের জন্য স্পষ্ট দেখতেও পারছি না। ধুর।”
মিরায়া নিজের চোখ ছোট ছোট করে নিল- “তার চোখে কৌতূহল, মৃদু প্রশংসা, আর একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুন জলজল করছে এবার। মিরায়া নিজের হেলমেটের গ্লাস ঠাস করে নামিয়ে দিতেই রায়ানের ধ্যান ভাঙলো। সেও নিজের চোখ সড়িয়ে নিল।
সেই মুহূর্তে চারপাশের আওয়াজ ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেল।
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪০
রায়ান এক সেকেন্ডের জন্য নিজের ভেতরে কিছু টান অনুভব করল, কিন্তু মাথা সামান্য ঝাঁকিয়ে নিজের মনোযোগ ফিরিয়ে আনল বাইকের দিকে। অন্যদিকে মিরায়া, হেলমেটের ভেতরে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে নিল—
একটা এমন হাসি, যা কেউ দেখে না, কিন্তু সে নিজেই জানে—”আজকের দিনটা তার।”