আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৭

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৭
অরাত্রিকা রহমান

হসপিটাল~
রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে বেশ অনেকটা সময় আগে। মাহির রায়ানকে নিয়ে এসে সেন্ট্রাল একটা হসপিটালে ভর্তি করেছে। রায়ানের অবস্থা দেখার সাথে সাথেই স্ট্রেচারে করে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। ডাক্তাররা রায়ানের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যে রুদ্রও হসপিটালে এসে পৌঁছায়। মাহির হসপিটালের এক কোণে মাথা নিচু করে বসে ছিল। রুদ্র দৌড়ে মাহিরের কাছে গিয়ে অশান্ত গলায় মাহির কে জিজ্ঞেস করলো-

“মাহির ভাই, ভাইয়া কোথায়? ঠিক আছে তো? এভাবে বসে আছো কেন?”
মাহির রুদ্রর আওয়াজে মাথা তুলে রুদ্রর দিকে তাকালো। রুদ্রর চিন্তিত শুকনো মুখ দেখে একটু হাঁফ ছেড়ে বলল-
“জানি না কেমন আছে। ভিতরে নিয়ে গেছে ওকে।”
রুদ্র অবজারভেশন রুমের দিকে তাকিয়ে একবার ঢোক গিলে মাহির কে আবার জিজ্ঞেস করল-
“ডাক্তাররা কি বলেছে মাহির ভাই? ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে তো, তাই না?”
মাহির নিজেও খুব চিন্তায় ছিল। কিন্তু রুদ্রর চেয়ে বয়সে বড় হওয়ায় একটু স্ট্রং থাকতেই হতো। মাহির উঠে রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে বলল-

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ডাক্তাররা দেখছেন, তুই প্রেশার নিস না, রায়ান অনেক স্ট্রং দেখলি না কেমন হেঁসে কথা বলল তখন! ও ঠিক হয়ে যাবে।”
রুদ্রর বুক টা ধক করে উঠলো রায়ানের হাঁসি মাখা মুখটার কথা মনে করে। রুদ্র তৎক্ষণাৎ মাহির কে জিজ্ঞেস করল-
“আচ্ছা মাহির ভাই শেষবার ভাইয়া কখন কথা বলেছে? ভাইয়ার কি জ্ঞান ছিল এইখানে আসার পথে?”
মাহির কিছু বলার আগেই। অবজারভেশন রুম থেকে একজন ডাক্তার আর তার সাথে একজন নার্স বাইরে বেরিয়ে এলেন। নার্স রোগীর তথ্য বোর্ড দেখে একটু জোরে বললেন-
“প্যাশেন্ট রায়ান চৌধুরীর বাড়ির লোক কারা আছেন? একটু এদিকে আসুন প্লিজ।”
মাহির রুদ্র সেদিকে ঘুরে তাকিয়ে দৌড়ে গেল। মাহির ডাক্তারের সামনে দাঁড়িয়ে একটু উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলো-

“ডক্টর ইজ হি ফাইন? ও ঠিক আছে তো! কোনো সমস্যা হলে বলুন।”
রুদ্রও মাহিরের পরপর বলল-
“ডক্টর প্লিজ সে সামথিং। আমার ভাইয়া কেমন আছে?”
ডাক্তার সাহেব বেশ বিরক্তিকর ভাব নিয়ে বললেন-
“আপনাদের কারো মাথায় কি কোনো সেন্স নেই নাকি? একটা মানুষের মাথা ফেটে এতো রক্ত পড়ছিল তাও কাটা জায়গাটা কিছু দিয়ে বাঁধেন নি কেন?”
রুদ্র আর মাহির ডাক্তার সাহেবের কথায় হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। সত্যি বলতে দুইজনের কারোর মাথাতেই তখন এই কথাটা আসে নি। মাহির ডাক্তার সাহেবকে টেনশনের সুরে জিজ্ঞেস করলো-
“ডক্টর ইজ দ্যায়ার সামথিং রং? আসলে ওই টাইমে আমাদের মাথাতেই আসে নি এই বিষয়টা। প্যাসেন্ট ঠিক আছে তো?”

ডাক্তার সাহেব কি আর বলবেন যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ডাক্তার মাহির কে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন-
“প্যাসেন্ট শেষ কখন কথা বলেছেন? আর জ্ঞান হারিয়েছেন কখন?”
রুদ্রও মাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে এখন, সে একটু আগে এই প্রশ্নই করেছিল মাহির কে উত্তর পায় নি। মাহির ডাক্তারের কথার জবাবে বলল-
“আমরা যখন ওকে এই অবস্থায় পাই তখনই কথা বলে ছিলো কিছু সময়ের জন্য। গাড়িতে তোলার পরও সামান্য জ্ঞান ছিল। কিন্তু কিছু সময় পরই জ্ঞান হারিয়েছে।”
রুদ্র মাহিরের কথাটা শুনে আরো কেমন মিলিয়ে গেল। বুঝতেও পারছেনা কি হচ্ছে। রুদ্র ডাক্তার সাহেবকে অতিরিক্ত চিন্তা থেকে প্রশ্ন করলো-

“ডক্টর প্লিজ বলুন আমার ভাইয়ার কি হয়েছে? কোনো সমস্যা হলে বলুন আমাদের…যদি এখানে আমার ভাইয়ার চিকিৎসা সম্ভব না হয় তাহলে বলুন অন্য কোথায় যাই। সময় নষ্ট করবেন না এখন।”
মাহির রুদ্রর অশান্ত অবস্থা দেখে ওর কাঁধে হাত দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো তাকে-
“রুদ্র শান্ত হ। বলতে দে ডক্টর কে।”
ডাক্তার সাহেব রুদ্রর ব্যবহারে কিছু মনে করেননি যদিও, কারণ পরিবারের কারো ক্ষতি হলে এভাবে রিয়েক্ট করা খুবই স্বাভাবিক। তবে একটু ক্ষোভ নিয়েই বললেন তিনি-

“সময় যা নষ্ট করার তা করে ফেলেছেন। প্যাসেন্টের ইন্টেন্স ব্লাড লোস হয়ে গেছে। জ্ঞান নেই প্রায় ১ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে, হার্টবিট এতো ক্ষীণ বলার বাইরে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা মাইনোর অপারেশন করতে হবে। রক্তের প্রয়োজন উনার শরীরে, AB+ ব্লাড গ্রুপের রক্ত লাগবে। পারলে তাড়াতাড়ি যোগার করুন।”
রায়ানের রক্ত লাগবে শুনে রুদ্র তীব্র আগ্রহ দেখিয়ে নিজের দুই হাত আগে করে দিয়ে বলল-
“আমি দেব রক্ত। আমার সেইম ব্লাড, যত রক্ত লাগবে আমার শরীর থেকে নিন।”
ডাক্তার সাহেব রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন-
“রক্ত দেব বললেই আমরা নিয়ে নিতে পারি না। আপনার রক্ত প্যাসেন্ট এর জন্য এ্যাপ্রোপিয়েট কিনা তা যাচাই করতে হবে আগে।”

রুদ্র ডাক্তার সাহেবের সকল কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল-
“ঠিক আছে, যা চেকাপ করার করুন তাড়াতাড়ি প্লিজ।আপনারা টাকা নিয়ে ভাববেন না। যা করতে হয় করুন। জাস্ট মেক সিয়র মাই ব্রাদার ইজ ওকে।”
ডাক্তার সাহেব নার্সকে বলে রুদ্রকে সব বেসিক চেকাপ গুলো করিয়ে নিল। রুদ্র তরুণ প্রজন্মের ছেলে, শরীর স্বাস্থ্যও পারফেক্ট। রায়ানের এ্যাকসিডেন্টের ঘটনায় প্রেশার লেবেলটা একটু উপর নিচ যেটা রুদ্র চাইলেই কন্ট্রোল করে নিতে পারবে। সব কিছু ঠিক ঠাক থাকায় ডাক্তার সাহেব রুদ্রর রক্ত রায়ানের জন্য নিতে রাজি হয়।
রুদ্রর শরীর থেকে প্রায় দুই তিন ব্যাগ রক্ত নেওয়া হয় রায়ানের জন্য। রুদ্রর মাথায় তখন নিজের বড় ভাইকে বাঁচানো ছাড়া কিছুই মাথায় ছিল না অথচ ছোট থেকেই ইনজেকশন বা সুঁই খুব ভয় পায় সে। মাহির পুরোটা সময় রুদ্র পাশে দাঁড়িয়ে ছিল রুদ্রর কোনো প্রয়োজন পড়তে পারে তার এই ভেবে। রক্ত নেওয়ার পর রুদ্র কেও একটা ব্যাডে সিফ্ট করা হয় যদিও রুদ্র বলেছিল তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মাহির এক প্রকার জোর করেই রুদ্র কে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে বলে।

ডাক্তাররা কিছু সময়ের মধ্যেই রায়ানের অপারেশন শুরু করেন। মাহির রুদ্রর কাছেই ছিল। রুদ্র বেডে শুয়া অবস্থায় মাহিরকে জিজ্ঞেস করলো আশ্বস্ত হতে-
“মাহির ভাই.. ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে তো?”
মাহির রুদ্র কে সাহস দিয়ে বলল-
“আরে কি যে বলিস না তুই। চৌধুরী বাড়ির রক্ত তোরা। এতো সহজে কিছু হবে নাকি। আর এই মাত্র যে ভাইকে বাঁচানো তাজা তাজা রক্ত দিয়ে এলি তার ফল কি বিফলে যাবে নাকি। তুই নিশ্চিত থাক। দেখবি অপারেশন শেষে রায়ান উল্টো তোকে নিয়ে লাফাচ্ছে।”

রুদ্র ভালোই বুঝতে পারছে রায়ানের জন্য মাহিরের টেনশন। চোখে মুখে ক্লান্তি আর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রুদ্র আর কিছু বলল না শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে রায়ানের জন্য দোয়া করলো-
“হে আল্লাহ! তুমি আমার ভাইয়া কে সুস্থ করে দাও। আমাদের সবার মাঝে আবার আগের মতো ফিরিয়ে দেও। সব যেন খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায়।”
মাহির রুদ্রর দোয়ায় সামিল হয়ে বলল-“আমিন।”

মাহির রুদ্রর শারীরিক দুর্বলতা টের পাচ্ছিল। চোখ মুখ ছোট হয়ে আছে ছেলেটার। মাহির রুদ্র কে রেস্ট নিতে বলল-
“রুদ্র তুই একটু ঘুমিয়ে নে ছোট ভাই, অনেক ধকল গেছে। আমি আছি এখানে তোর চিন্তা করতে হবে না। রায়ানের কিছুর প্রয়োজন হলে আমি ব্যবস্থা করে নেব। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেলা হয়ে যাবে। সবাই টেনশন করার আগেই জানিয়ে দেওয়া উচিত বাড়িতে। অপারেশন টা ছোট খাটো হলেও বাড়িতে জানানো দরকার। তুই রেস্ট নে আমি কল করে আসছি।”
রুদ্র মাহিরের কথার বিপরীতে হয়তো যেতো যদি সাধ্য থাকতো তার। কিন্তু শরীর সত্যি সত্যি বেশ দূর্বল লাগছিল তার। রুদ্র মাহিরের সিদ্ধান্তে সায় দিল। চোখটা বন্ধ করলো ঘুমাতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়লো। মাহির বাইরে বের হলো, অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন টা বের করে চৌধুরী বাড়ির ল্যান লাইনে কল করল।

সকাল এখন প্রায় ৭টার কাছাকাছি তবে বাজেনি। রামিলা চৌধুরী বরাবরই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে অভ্যস্থ। ফজরের সময়ই ঘুম থেকে উঠে যান তিনি। বাড়ির আর কেউ এতো সকালে উঠে না বলে তিনি কাউকে ডাকেন না। আজও কোনো ব্যতিক্রম হয়নি, প্রতিদিনের মতো সকাল সকাল উঠেই ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিয়ে তিনি রান্নাঘরে যান সবার জন্য নাস্তা রেডি করতে। এইদিকে বাড়িতে যে কেউই নেই সেই খবর এখনো তিনি জানেন না। মাহির যখন চৌধুরী বাড়িতে কল করে তখন রামিলা চৌধুরী রান্নাঘরেই কাজ করছিলেন। রুটি বানানোর কারনে হাতে আটা ছিল বলে বাধ্য হয়ে রায়হান চৌধুরীকে ডেকে বললেন-

“শুনছেন? রায়ানের আব্বু..! ফোনটা বাজছে একটু ধরবেন? মহারানির হাতে আটা।”
রায়হান চৌধুরী রায়ানের আব্বু ডাকটা খুব পছন্দ করেন। সকাল সকাল এই ডাকটা শুনে তার মনটাই জুড়িয়ে গেলো। বড় ছেলের নামে তার বাবা হিসেবে পাওয়া ডাক ও পরিচয় এক অন্য আনন্দ। অথচ দুইজনের কেউ জানেনা বড় ছেলের অবস্থা এতোটা খারাপ যে হসপিটালে ভর্তি এখন। রায়হান চৌধুরী হাঁসি মুখে ড্রয়িং রুমে গিয়ে ল্যান লাইনের টেলিফোন উঠিয়ে কানে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
“হ্যালো, কে বলছেন?”
মাহির রায়হান চৌধুরীর গলা অপর পাশ থেকে শুনে স্তব্ধ হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। কি বলবে কিছুই আগা মাথা খুজে পাচ্ছে না। এই দিকে রায়হান চৌধুরী অন্যদিকে থেকে কোনো রেসপন্স না দেখে আবারও জিজ্ঞেস করলেন কিছু টা গম্ভীর গলায়-

“কে বলছেন? কথা না বললে কল করেছেন কেন?”
রামিলা চৌধুরী রান্নাঘর থেকে রায়হান চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলেন- “কে কল করেছে? চেঁচাচ্ছেন কেন?”
রায়হান চৌধুরী উত্তরে বললেন-“কে জানে কে কল করেছে! কথা বলছে না।”
মাহির ফোনে দুইজনের কথাই শুনছে চুপচাপ। চৌধুরী বাড়ির পরিবেশ এখন কত শান্ত কিন্তু তার এই খবরটা পাওয়ার সাথে সাথে সবটা এলোমেলো হয়ে যাবে। কিন্তু সত্যিটা বলার প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি আর না বলেও উপায় নেই তাই একটা দীর্ঘশ্বাস নিঃশ্বাস নিয়ে মাহির কাঁপা কাঁপা গলায় বলল-
“হ্যা.. হ্যালো আংকেল! আ..আমি মাহির বলছিলাম।”
রায়হান চৌধুরী প্রথমে ঠিক মাহির কে চিনতে পারলেন না-
“মাহির? কোন মাহির?”
রামিলা চৌধুরী রান্নাঘর থেকে মাহিরের নাম শুনতে পেয়ে রায়হান চৌধুরীকে বললেন-
“আরে রায়ানের ছোট বেলার বেস্ট ফ্রেন্ড মাহির হয়তো। কি বলছে ও? এতো সকালে! রায়ান কি ওর কল ধরছে না নাকি?”

রামিলা চৌধুরীর কথায় রায়হান চৌধুরী মাহিরকে চিনতে পেড়ে একটু মজা করে হেসে বললেন-
“ওহ, ইয়াং ম্যান! হাউ আর ইউ মাই বয়? অনেক দিন পর কথা হচ্ছে। কি হয়েছে? বন্ধুর সাথে সমস্যা হয়েছে বলে কি বাড়ির নাম্বারে কল করেছ?”
রামিলা চৌধুরী রায়হান চৌধুরীর কথায় হাসছেন রান্না ঘরে।
মাহির ঠিক কিভাবে কথা শুরু করবে আর কিভাবে শেষ করবে বুঝতে না পেরে ভাবলো একটু শান্ত হয়ে ধীরে সবটা বলতে। মাহির ভদ্র তা রেখে রায়হান চৌধুরীকে বলল-
“আংকেল আসলে আমি একটা খবর দিতে কল করেছি। আপনি প্লিজ আমার কথা গুলো একটু মনো যোগ দিয়ে শুনুন এবং বুঝতে চেষ্টা করুন প্লিজ।”
রায়হান চৌধুরী এখনো বেশ মজার এলেই বললেন-
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বল না কি খবর!! সিরিয়াস কিছু নাকি?”
মাহির একটু দম নিয়ে বলল-

“আংকেল আসলে…আসলে সত্যি বিষয়টা সিরিয়াস। আপনি প্লিজ এখনি কিছু আন্টি কে বলবেন না। আমি সম্পূর্ণ ঘটনা আপনাকে বুঝিয়ে বলছি।”
রায়হান চৌধুরী এবার কিছু টা স্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। মাহির পরমুহূর্তেই আবার বলল-
“আংকেল কাল রাতে….!”
মাহির যথা সম্ভব রায়হান চৌধুরীকে কাল রাতের পুরো ঘটনাটা বর্ণণা করার চেষ্টা করলো। বাড়িতে যে রায়ান, রুদ্র, বা মিরায়া কেউই নেই সেইসব কিছুর ব্যাখ্যা দিয়ে যখন মাহির রায়ানের এ্যাক্সিডেন্টের কথাটা বলে তখনি আশ্চর্যতায় রায়হান চৌধুরীর হাত থেকে টেলিফোন টা ফস্কে পড়ে যায়। ফোনটা ফ্লোরে পড়ে ঝুলছে। রামিলা চৌধুরী রান্নাঘর থেকে ফোন পড়ার আওয়াজে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-

“কি হলো? কি ফোন পড়লো কি করে। তুলুন তাড়াতাড়ি।”
মাহির অপর পাশ থেকে ভালোই বুঝতে পারছে চৌধুরী বাড়িতে শোকের ছায়া এই নামলো বলে। রায়হান চৌধুরী ঠায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন কোনো নড়াচাড়া নেই। মাহির ও কল কেটে দিয়ে হসপিটালের বেঞ্চে বসে রইল মাথা নিচু করে দুই হাত দিয়ে ধরে থেকে।
রায়হান চৌধুরী ধপ করে সোফার উপর বসে পড়লেন। রান্না ঘর থেকে রামিলা চৌধুরী হাত ধুয়ে এসে অনেকবার জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে তার। কিন্তু প্রতি উত্তরে রায়হান চৌধুরী কেবল রামিলা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রইলেন আর মনে মনে শুধু ভাবছেন ঠিক কিভাবে রায়ানের এ্যাকসিডেন্টের কথাটা বললে রামিলা চৌধুরীর কষ্ট কম হবে। রামিলা চৌধুরী রায়হান চৌধুরীর নীরবতায় খানিকটা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

“কি বলল মাহির? এভাবে বসে আছেন কেন? কি হয়েছে?”
রায়হান চৌধুরী কিভাবে সামাল দেবেন ভেবে উঠতে না পেরে বললেন-
“রা..রামিলা আমাদের যেতে হবে। চলো।”
রামিলা চৌধুরী আরো অবাক হলেন-
“কোথায় যেতে হবে আমাদের? হয়েছে টা কি বলবেন তো নাকি? মাহিরের কিছু হয়েছে? রায়ান কে ডাকবো? দাঁড়ান..।”
রায়হান চৌধুরীকে কথাটা বলেই রামিলা চৌধুরী রায়ানকে ডাকলেন-
“রায়ান…এই রায়ান… ঘুম থেকে উঠ। মাহিরের কি হয়েছে? রায়ান? ধুর এখান থেকে শুনবে না আপনি বসুন আমি রায়ানকে ডেকে দিচ্ছি।”

রামিলা চৌধুরী এই বলে রায়ানের ঘরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় তখনি রায়হান চৌধুরী সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটু গম্ভীরতা ভরা কম্পিত কন্ঠে বললেন-
“রায়ান বাড়িতে নেই। ইন ফ্যাক্ট বাড়িতে আমরা ছাড়া আর কেউই নেই।”
রামিলা চৌধুরী অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন-
“বাড়িতে কেউ নেই মানে? কি সব বলছেন! রুদ্র, রায়ান, মিরা তিন জনই তো উপরে নিজেদের রুমে।”
রায়হান চৌধুরী নিজের ভিতরে যুদ্ধ চালাচ্ছেন আবেগ সামলাতে। নিজের বড় ছেলে যে কিনা তার চোখের মণি সে হসপিটালে ভর্তি সাথে ছোট ছেলেটাকে রক্ত দিতে হয়েছে বলে দুর্বল এই অবস্থায় তিনি নিজেকেই খুব সহয় সম্বলহীন মনে করছিলেন ভেতর ভেতর। এই দিকে স্ত্রী কে এই খবর এখন দিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে সময় লাগবে না সেটা তিনি আন্দাজ করতে পারেন।

রামিলা চৌধুরীর প্রশ্নের সহজ উত্তরে রায়হান চৌধুরী বলেন-
“ওরা কেউ বাড়ি নেই। মাড়ির ফোন করে তাই বলল। আমাদের যেতে হবে আমি ড্রাইভার কে বলছি গাড়ি বের করতে তুমি এসো।”
কথাটা বলে রায়হান চৌধুরী বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। রামিলা চৌধুরীর মন ওমনি ধক করে উঠলো। এক নজর সিঁড়ির উপরের দিকে তাকিয়ে আনমনে বললেন-
“ওরা কেউ বাড়ি নেই! তো কোথায় গেছে? আর বাচ্চারা যেখানে গেছে সেখানে বড়দের কেন ডাকবে? আল্লাহ..সব ঠিক আছে তো?”

একপ্রকার তাড়াহুড়ো তে সব কাজ ফেলে রামিলা চৌধুরী বাড়ির বাইরে পা রাখলেন। গাড়ি বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করছিল। গাড়িতে উঠে পড়লেন দুজন দ্রুত। রায়হান চৌধুরী ড্রাইভার কে হসপিটালের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিলেন যেন রামিলা চৌধুরীর সামনে আবার হসপিটালের কথা তুলতে না হয়। মার মন তো সন্তানের এমন খবরে বিচলিত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। রামিলা চৌধুরী একটু অদ্ভুত অজানা ভয় মিশ্রিত গলায় রায়হান চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলেন-
“আমরা কোথায় যাচ্ছি? আর কেন যাচ্ছি? কি হয়েছে? আচ্ছা বাদ দিন এতো কিছু বলতে হবে না শুধু এতো টুকু বলুন আমার বাচ্চা গুলো ঠিক আছে তো? ওদের কিছু হয়নি তাই না!”
রায়হান চৌধুরী নিজেকে বহু কষ্টে সামলাচ্ছেন শুরু থেকে এখনো কিছু না জেনেই রামিলা চৌধুরীকে বলা বোকামি হবে তাই তিনি চুপ থাকলেন। আর রায়হান চৌধুরীর নীরবতা স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দিচ্ছে আর যাই হোক ভালো কিছু হয়নি।

প্রায় ৩০মিনিটের মধ্যেই তারা হসপিটালে পৌঁছান। রায়হান চৌধুরী তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে মাহিরের বলা ফ্লোরে পৌঁছান। রামিলা চৌধুরী হসপিটালে পা রাখার পর থেকে অনবরত রায়হান চৌধুরীকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন-
“আপনি দয়া করে বলবেন আমায় আমরা এই হসপিটালে কেন এসেছি? কার কি হয়েছে? কথা বলছেন না কেন?”
এইদিকে রায়হান চৌধুরী মাহিরকে খুঁজতে ব্যস্ত। রামিলা চৌধুরীর কোনো প্রশ্নের উত্তর তিনি দিচ্ছেন না। কিছুক্ষণ পর মাহির রায়হান চৌধুরী ও রামিলা চৌধুরীকে দেখতে পেয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে থেকে জোরে আওয়াজ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো-
“আংকেল আন্টি…? এই দিকে।”
রায়হান চৌধুরী ও রামিলা চৌধুরী একসাথে মাহিরের দিকে তাকালেন। রায়হান চৌধুরী দ্রুত মাহিরের কাছে গেলে সাথে রামিলা চৌধুরীও গেলেন। রায়হান চৌধুরী মাহিরের কাছে গিয়ে সোজা জিজ্ঞেস করলেন-
“রায়ান কেমন আছে? কোথায় ও?”
রায়হান চৌধুরীর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে রামিলা চৌধুরীর পায়ের জমিন যেন হঠাৎ সড়ে গেল। তিনি কম্পিত শরীরের ভাঙা গলায় বললেন-
“রায়ান কেমন আছে মানে? রায়ানের কি হয়েছে? আমার ছেলে কোথায়? কি হয়েছে ওর? কি বলছেন আপনি এসব হ্যাঁ?”

রায়হান চৌধুরী এখনো মাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন উৎসুক নজরে রায়ান ঠিক আছে তা নিশ্চিত হতে। মাহির রায়ানের বাবা মা কে কিভাবে ফেস করবে বুঝে পাচ্ছিল না কিন্তু এখন প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ-
“রায়ান ভেতরে আংকেল (অপারেশন থিয়েটারের দিকে হাত দেখিয়ে মাহির বলল)।”
বাকি আর কিছু বলার আগেই রামিলা চৌধুরী ছেলের চিন্তায় অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন-
“রায়ান ভেতরে মানে? আমার ছেলে অপারেশন থিয়েটারের ভেতর কেন?”
রামিলা চৌধুরীর চোখে অশ্রু টলমল করছে। কি হচ্ছে তার কিছুই মাথায় ঢুকছে না আর না বিশ্বাস করতে পারছেন তিনি। মাহিরের কাছে গিয়ে অশ্রু ভরা চোখে মাহিরের শার্টের কলার আকড়ে ধরে তিনি বলেন-
“মাহির বাবা আমার বল আমাকে, আমার রায়ানের কি হয়েছে? ও অপারেশন থিয়েটারের কেন?”
মাহির কি বলবে বুঝতে পারলো না। স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা ব্যবহার করলেও ঠিক কি বললে খারাপ লাগে কমতে পারে তার ধারণা নেই। মাহির চুপ রইল মাথা নিচু করে। রায়হান চৌধুরী রামিলা চৌধুরীর কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্ত করতে চাইলে রামিলা চৌধুরী আরো অশান্ত হয়ে ঝটকায় রায়হান চৌধুরীর হাত তার কাঁধ থেকে সড়িয়ে দিয়ে মাহিরের শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বললেন-

“আমি রায়ানের মা। ওর কি হয়েছে সেটা জানার অধিকার কি আমার নেই? আমি একটা মানুষ তখন থেকে কিছু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি আমাকে কেউ কিছু বলছে না কেন?”
রায়হান চৌধুরী ঠিক এই ভয় পাই পাচ্ছিলেন। একজন মায়ের নারী ছেঁড়া ধনের এমন অবস্থা কখনোই সে মানতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। মাহির রামিলা চৌধুরীকে কিছু বলতে চাইলো ঠিক তার আগেই ডাক্তার সাহেব অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলেন তার এ্যাসিস্ট্যান্ট এর সাথে-
“এইটা হসপিটালে আপনাদের ব্যক্তিগত বাগান বাড়ি নয়। এখানে আরো অনেক প্যাসেন্ট আছে আপনাদের চেঁচামেচিতে তাদের অসুবিধা হবে তা ছাড়া কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন খেয়াল আছে? সামনে অপারেশন থিয়েটার, এমন জায়গায় সিনক্রিয়েট কেন করছেন!”
মাহির ব্যস্ত পদক্ষেপে ডাক্তারের কাছে গিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করল-

“আমরা দুঃখিত ডক্টর। এখন প্লিজ কাইন্ডলি বলুন প্যাসেন্ট কেমন আছে? বিপদের কিছু নেই তো?”
রায়হান চৌধুরী এগিয়ে এসে একই চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন-
“ডক্টর আমি প্যাসেন্টের বাবা। আমার ছেলে ঠিক আছে তো! ওর কোনো বিপদ হয় নি তো?”
এইদিকে মাহির আর রায়হান চৌধুরীকে ডক্টরের কাছে এতো গুরুতর ভাবে রায়ানের অবস্থা জিজ্ঞেস করতে দেখে রামিলা চৌধুরী নিজের কান্না ধরে রাখতে পারলেন না। পা শিথিল হয়ে আসতেই তিনি ঠাস করে মাটিতে বসে পরলেন। আর ঐ অবস্থাতেই কান্না করতে লাগলেন। ডক্টর রায়হান চৌধুরী মাহির তিন জনই রামিলা চৌধুরীর দিকে তাকিলেন।মাহির সাথে সাথে হাঁটু মুড়ে বসে রামিলা চৌধুরী কে সামলানোর চেষ্টা করলো-
“আন্টি আমি সরি। আমাকে মাফ করে দিও। আমি রায়ানকে আটকাতে পারি নি। কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়ো না প্লিজ। রায়ান ঠিক আছে। তাই না ডক্টর?”

এক আকাশ সমান আশা ভরা চোখে মাহির ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকালো। রায়হান চৌধুরী ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা হয়ে ছেলের এমন অবস্থা দেখছেন অন্য দিকে স্ত্রী এভাবে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছে। ডাক্তারের ওয়ার্ডিক এখন একমাত্র স্বান্তনা হতে পারে তাদের জন্য।
ডাক্তার সাহেব রামিলা চৌধুরীর হাল দেখে আশ্বস্ত করে বললেন –
“উনাকে সামলান। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। প্যাসেন্ট একদম ঠিক আছে। বিপদের সম্ভাবনাও নেই। তিনি এখন সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত।”

মাহির, রায়হান চৌধুরী দুইজনেই একসাথে শ্বাস ফেলল, যেন এতোটা সময় শ্বাস আটকে ছিল তাদের। কিন্তু রামিল আর চৌধুরী শান্ত হতে পারলেন না। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ডাক্তার সাহেবকে অধৈর্য গলায় বলল-
“আমি দেখবো আমার ছেলে কে। আমি কি দেখা করতে পারবো একবার? ডক্টর প্লিজ, আই ইনসিস্ট। একবার বাস একবার আমি আমার ছেলেটাকে দেখতে চাই।”
মাহিরও ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল উত্তর শুনতে। ডাক্তার শান্ত গলায় বললেন-
“প্যাসেন্টের বিপদ মুক্ত তবে জ্ঞান ফেরেনি। স্বাভাবিক ভাবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে এলে ভালো। নাহলে জ্ঞান কখন ফিরবে সে সম্পর্কে আমরা কিছু বলতে পারবো না। সেক্ষেত্রে তাকে যতদিন না জ্ঞান ফিরছে হসপিটালে রাখারই নিয়ম আছে। ২৪ ঘন্টা তাকে অবজারভেশনে রাখা হবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করুন। এর পর উনাকে কেবিনে শিফ্ট করা হলে আপনারা দেখা করতে পারবেন।”

ডাক্তার সাহেব নিজের কথা বলে চলে গেলেন। রামিলা চৌধুরী দৌড়ে অপারেশন থিয়েটারের দরজার কাছে গেলেন। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। কিন্তু ছেলে সুস্থ আছে বলে মনে একটু শান্তি অনুভব করছেন। মাহির পিছন থেকে বলল-
“আংকেল আন্টি একবার রুদ্রর সাথে দেখা করবেন চলুন।”
রায়হান চৌধুরী রুদ্রর রক্ত দেওয়ার বিষয়ে জানলেও রামিলা চৌধুরী জানতেন না। রায়ানের পর এবার রুদ্রর নাম শুনতেই তিনি কান্নার মাত্র তীব্র করে বললেন-
“রুদ্র? আমার রুদ্র আবার কি হয়েছে? ওহ্ আল্লাহ, আমার ছেলে গুলোর সাথে কি হয়েছে এসব।”
মাহির তৎক্ষণাৎ বলল-“না না আন্টি।”

রায়হান চৌধুরী মাহিরের কথা কেঁটে রামিলা চৌধুরীর কাছে গিয়ে সাহস দিয়ে বললেন-
“কাঁদছো কেন গর্ব করো ছেলেকে নিয়ে। ভাইয়ের জন্য রক্ত দিয়েছে। চৌধুরী বাড়ির রত্ন আমার ছেলেরা। ওদের কিছু হবে ভাবলে কিভাবে। চোখের পানি মুছো।”
রায়হান চৌধুরী রামিলা চৌধুরীর অশ্রু নিজ হাতে মুছে দিলেন
রামিলা চৌধুরী কথা বুঝতে পেরে উৎকন্ঠা হয়ে মাহির কে জিজ্ঞেস করলেন-
“কোথায় রুদ্র? নিয়ে চল আমাকে আমার ছেলের কাছে। মনে হচ্ছে যেন জান বের হয়ে যাচ্ছে।”
মাহির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাদের রুদ্রর কাছে নিয়ে গেলো।

চট্টগ্রাম~
বিকেল হতে চলল। সময় প্রায় ৩টার কাছাকাছি। মিরায়া নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে খুব শান্তিতে, ঠিক যেন রায়ানের আবিষ্কার করা ঘুম পরী। মিরায়ার মুখে আগলা একটা মিষ্টি হাসি যা ঘুমের মধ্যেও দৃশ্যমান। বৃষ্টিতে কাক ভেজা ভিজে দুই বোন যার যার ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় চলে গেছে বাধ্য মেয়ের মতো। মিরায়া অতীতের রহস্য উন্মোচন, রেসের ধারাবাহিকতা, আলাদা করে উগ্র ঝামেলায় পড়া আর তার উপর এতো সব কাহিনীর পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত লম্বা একটা জার্নি মিরায়ার জন্য খুবই হ্যাটট্রিক ছিল। আরো বৃষ্টিতে গোসল করায় মাথাটা ভীষণ ভাল হয়ে যাওয়ায় এমন গভীর ঘুম। চাচি- রোকেয়া বেগম দুপুরের খাবার খেতে ডাকতে এসে দুই বোনকেই ঘুমে দেখে আর ডাকেন নি। কেউই কাল রাতে ঘুমায় নি তাই ঘুমাতে দিয়েছেন।
ঘুমন্ত মিরায়ার ভ্রু হঠাৎ কুচাকালো। ঘুমের মধ্যেই একটু অস্বস্তিতে মাথাটা বারবার না সূচক নাড়িয়ে বিড়বিড় করছে-
“রা..রায়ান.. রায়ান..যাবেন না প্লিজ। না না..না প্লিজ যাবেন না আ..মাকে ছেড়ে। যাবেন না প্লিজ.. রায়ান..রায়ান.. নাআআআ..!”

হঠাৎ একটা চিৎকার দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে উঠে বসলো। আঁতকা ঘুম থেকে উঠায় মিরায়ার মাথাটা খানিকটা ঝাঁকিয়ে উঠলো। কি হলো এক সেকেন্ডের জন্য বুঝতে পারলো না। এদিক ওদিক মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে নিজের ঘরে আবিষ্কার করতেই আনমনে বলল-
“স্বপ্ন ছিল? এটা কি ধরনের স্বপ্ন দেখলাম আমি?”
বুঝতে বাকি নেই হয়তো মিরায়া রায়ানকে নিয়ে খারাপ কোনো স্বপ্ন দেখেছে যেটা নিয়ে সে এখন বিচলিত। মিরায়া বিছানায় নিজের ফোনটা খুঁজতে লাগলো দেখতে তার ফোনে কোনো কল এসেছে কিনা। ফোনটা হাতে পেতেই মিরায়া তাড়াতাড়ি লোক খুলে কল লগ চেক করলো, অনলাইন চেক করলো, কিন্তু কিছুই পেল না। হালকা অভিমানী তবে চিন্তিত গলায় সে আওড়ালো-

“এমনিতে আমাকে ছাড়া নাকি এক মিনিট টিকতে পারে না। আর এই দিকে আমি তার চোখের সামনে নাই প্রায় একদিন হতে চললো। আমার কথা কি উনার মনে পড়ছে না?”
হঠাৎ মিরায়ার বাড়ির সামনে গাড়ির হর্নের আওয়াজ হলো। মিরায়া হর্নের আওয়াজ শুনতে পেয়ে একটু মুচকি হেসে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো। কিন্তু মুহূর্তেই সেই মুচকি হাসি মিলিয়ে গেল। মুখ দিয়ে আনমনে বেরিয়ে এলো কিছু অব্যক্ত বাক্য-

“অশ্লীল বরটা এখনো কেন আসছে না আমাকে নিতে! দশ বছরের বেশি অপেক্ষা করিয়েছে এটাই কি যথেষ্ট ছিলো না? এখন শুধু বউ করে ঘরে তুলবে সেটাতেও অপেক্ষা করাচ্ছে। ধুর ভালো লাগে না।”
মিরায়া হয়তো গাড়িটা রায়ানের গাড়ি ভেবেই বারান্দায় দৌড়ে গেছিল কিন্তু আশানুরূপ ফল না দেখতে পেয়ে উল্টো অভিমানী হয়ে গেছে। মিরায়া বারান্দা থেকে নিজের ঘরে চলে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পরলো। তখনি ফোনটা বাজলো, সাথে মিরায়াও খুব উৎসাহিত মনে ফোনটা হাতে নিলো এই ভেবে হয়তো রায়ান কল করেছে। কিন্তু তেমন কিছু নয়, বাইক রাইডিং কমিউনিটি থেকে কল এসেছে। মিরায়া একটু হতাশায় তার মুখটা পানশে করে নিয়ে বাধ্য হয়ে কলটা রিসিভ করে কথা বলে। সবাই তাকে বাহবা দিচ্ছিল কালকের রেসের জন্য। মিরায়াও সবাইকে ধন্যবাদ জানালো। তবে বাড়তি কথা আগালো না তার মন চাইছিল না বলে। কমিউনিটির সবাই তাকে একবার আড্ডা দিতে দেখা করতে বললে মিরায়া সেটাতেও না করলো। যদি ওই সময়টা রায়ান আসে আর তাকে বাড়িতে না দেখতে পায় বিষয়টা পুরো বিগড়ে যাবে তাই।

কথা বলা শেষ করে মিরায়া তার ফোন টা বিছানায় ছুড়ে ফেলল। তার রায়ানের কথা খুব মনে পড়ছে। প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি এতো অদ্ভুত রকমের সুন্দর হয় সে আন্দাজ ও করতে পারেনি। একটা মানুষের অস্তিত্ব এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হবে তার জীবন কে জানতো। মিরায়া শুধু শুধু খিলখিলিয়ে হেসে বিছানায় ঠাস করে শুয়ে পড়ে দুইহাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রায়ানের কথা মনে করে নিজে নিজেই হাসছিল। হঠাৎ তার রায়ানের পুরোনো কথা গুলো মনে পড়তে থাকলো। মিরায়া সেসব কিছুই বেশ উপভোগ করে রায়ানের কথার মজা উড়াচ্ছিল-
“লোকটা আসলেই অশ্লীল কি অদ্ভুত বাজে বাজে কথা বলতো শুরু থেকে ছিঃ। আর ক্যাম্পাসে..! ক্যাম্পাস কিভাবে সবার সামনে আমাকে চুমু খাওয়ার ভয় দেখিয়ে কোলে করে নিয়ে গেল রেস্টুরেন্টে। আর তারপর.. বলে কিনা চেয়ার টেবিল ছাড়া কিছু নেই, খাট ছাড়া আমার কষ্ট হবে। কি অসভ্য লোক। কেন রে চেয়ার টেবিলে কি করা যায় না নাকি?”

মিরায়া কি বলছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কি মনে করে নিজের কথাতেই দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে বলল-
“ইসস্ ছিঃ! মিরা এসব কি বলছিস, কি ভাবছিস। এতো নেকা কবে হলি তুই।”
পুরুষের অতিরিক্ত ভালোবাসা আর যত্ন হয়তো এভাবেই প্রতিটা মেয়েকে নেকা বানিয়ে ছাড়ে। মিরায়া দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা অবস্থায় হঠাৎ খেয়াল করলো তার বাম হাত টা ফাঁকা যেটাতে রায়ান তাকে ব্রেসলেট পড়িয়েছিল।
মিরায়া ধরফরিয়ে উঠে নিজের হাত দিয়ে অন্য হাত ধরে অবাক হয়ে বলল-
“আমার হাত খালি কেন? ব্রেসলেট টা কোথায়? আমি তো একটু আগেও…!”

মিরায়ার হঠাৎ সব খেয়াল হতে শুরু করলো। চট্টগ্রামে এসে গোসলের সময় থেকে সে যতবারই নিজের হাত খেয়াল করেছে হাত খালিই ছিল। যেহেতু হাতে কিছু পড়ে থাকার অভ্যাস নেই সেসময় খেয়াল হয়নি। মিরায়ার বুকটা হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেলো। হন্নে হয়ে খুঁজতে লাগলো সে ব্রেসলেট টা। ঘরের একটা কোণাও বাদ নেই যা খোঁজা হয়নি। তারপর গেল ওয়াস রুমে খুঁজে, সেখান থেকে দৌড়ে গেল ড্রয়িং রুমে তন্নতন্ন করে খুঁজছে পুরোটা বসার ঘর কিন্তু কোথাও নেই। রোকেয়া বেগম রান্না ঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন-

“মিরা..কি খুঁজছিস এভাবে? আমাকে বল আমি খুঁজে দিচ্ছি। ঘর থেকে কি কিছু মিসিং?”
মিরায়া একদন্ড দাঁড়িয়ে ভাবলো কোথায় পড়তে পারে ব্রেসলেট টা। ছাদে যে তখন বৃষ্টি ভিজেছে হয়তো ওখানে পড়তে পারে এই ভেবে আবার ছাদে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চাচি কে বলল-
“ঘরের কিছু না চাচি। আমার খুব প্রয়োজনীয় একটা জিনিস পাচ্ছি না ওইটাই খুঁজছি। তুমি চিনবে না। আমিই খুঁজে নেব।”

মিরায়া নিজের মনে বিড়বিড় করলো-
“খুব প্রয়োজনীয় জিনিস চাচি। আমার বরের দেওয়া প্রথম উপহার। খুলতে না করেছে আমাকে এমনিতেই। হাড়িয়ে গেছে শুনলে নির্ঘাত মেরে ফেলবে। সে ছাড়া আর ওই ব্রেসলেট এমনি খুলা হয়েছে জানলে আমাকে ভুলও তো বুঝতে পারেন।”
মিরায়া উপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে ই বলল-

“ওহ্ আল্লাহ পাওয়াই দেও। এইবার হাতে পরলে আর কখনো খুলে পড়বে এর অবকাশ ই রাখবো না।”
মিরায়া এক দৌড়ে ছাদে উঠে সম্পূর্ণ ছাদটা খুঁজলো। ছাদের কোথাও ও নেই জিনিস টা। সম্পূর্ণ বাড়িই মিরায়া সম্ভাব্য জায়গা গুলোতে কয়েকবার করে খুঁজেছে কিন্তু ব্রেসলেট টার হদিস পেল না। খোঁজ খুঁজি শেষে হতাশায় নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো। অন্য সকল গহনা বা তার পছন্দের কিছু হাড়ালেও হয়তো এতো কষ্ট হতো না কিন্তু রায়ান খুব যত্ন করে ব্রেসলেট টা এনে পড়িয়েছিল মিরায়াকে, বরের দেওয়া প্রথম উপহার হাড়িয়ে ফেলেছে রায়ানের হাজার বার ব্রেসলেট টা হাত থেকে না খুলতে বলার পরও; সেই জন্য আরো বেশি খারাপ লাগে তার। আর সেই খারাপ লাগা থেকেই কাঁদছে। মিরায়া নিজের মনে হাজারো বাক্য তৈরি করতে ব্যস্ত ঠিক কিভাবে বুঝালেও রায়ান ব্রেসলেট টা হাড়ানো নিয়ে তাকে ভুল বুঝবে না বা রাগ করবে না।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। এখনো মিরায়া নিজের ঘর থেকে বের হয়নি। এর মাঝে সোরায়া আর রোকেয়া বেগম অনেক বার মিরায়াকে ডাকতে এসেছেন কিন্তু তাদের কথার স্পষ্ট কোনো জবাবও দেয়নি।

প্রাপ্তবয়সী মেয়ে নিজের থেকে ঘর থেকে না বের হলে জোর করে কি আর তাকে বের হতে বাধ্য করা সম্ভব!
রাতের বেলায় সোরায়া রাতে খাওয়ার ডাকতে এলে বাধ্য হয়ে রাতের খাবার খেতে নিচে নামলেও খাবার না খেয়ে শুধু একটু হাত ঘুরিয়ে এঁটো করে শরীর ভালো লাগছেনা বলে নিজের ঘরে চলে আসে। সোরায়া চাচা চাচি মিরায়ার অদ্ভুত ব্যবহার লক্ষ্য করেছেন কিন্তু কারণ না জানায় হয়তো মিরায়ার সত্যিই শরীর ভালো লাগছে না এই ভেবে মনকে আশ্বস্ত করলেন।

ঘরে অবস্থানরত সময় টুকুতে মিরায়া ঘর থেকে বাইরে থেকে যখনি কোনো গাড়ি বা বাইকের আওয়াজ শুনছিল তখনি দৌড়ে বারান্দায় দেখতে যাচ্ছিল সেটা রায়ান কি না। অপেক্ষা – এক এমন অপেক্ষা যার শেষ হচ্ছে না। মিরায়ার চোখে অশ্রু জমেছে কিন্তু সেটা তার প্রবাহ গতি পাচ্ছে না। মিরায়া নিজের মনে আত্মবিশ্বাস রেখে বলল-
“আসবে, তোর বর ঠিক আসবে মিরা। এতো গুলো বছর অপেক্ষা করেছিস না হয় আর একটা রাত অপেক্ষা করলি।”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৬

মন যদিও মানছে না তার। বারংবার নিজের ফোনটা দেখছে। একটা কলের অপেক্ষায়। কিন্তু ফোন টাও বাজছে না। মিরায়ার মনে রায়ানের চিন্তা এতো বেশি চলছিল যে নিজের অজান্তেই পুরোটা রাত নিজের বন্ধ ঘরে বারান্দায় বসে বিভিন্ন গাড়ি আর বাইক পরোখ করতে করতে পার করলো। কিন্তু এর মধ্যে একটাতেও রায়ানের অস্তিত্ব নেই। তবুও মনের কোণে সেই এক আশা জেগে রইল-“রায়ান ঠিক আসবে তাকে নিতে।”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here