আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৮ (২)

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৮ (২)
অরাত্রিকা রহমান

সময় নিজ গতি তে গড়িয়ে চললো, আর রায়ান মিরায়ার দুই প্রাণ আলাদা দুই পৃথিবী হয়ে ধরা দিলো সকলের কাছে। পাশাপাশি আরো কিছু জীবনও এক জায়গায় থেমে রইল।
মিরায়া নিজের অস্তিত্বের সন্ধান করতে ব্যস্ত যা সে অচিরেই হাড়িয়ে ফেলেছে, রায়ান হসপিটালের বেডে নিজের সাথে লড়াই করছে তার হৃদপাখিকে ফিরে পাওয়ার। মাহির ইদানিং ক্লাস বাদে সম্পূর্ণ সময়টা অন্য মনস্ক থাকে তার ষোড়শীর ভাবনায় খাওয়া দাওয়ার ও ঠিক নেই, সোরায়া নিজের পারিবারিক পরিস্থিতিতে আবদ্ধ যেখানে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ তার হয় না সচরাচর এখন। রুদ্র বড় ভাইয়ের পরিবর্তে মা-বাবা আর কম্পানির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে; ভাইয়ের অসমাপ্ত অফিসিয়াল কাজগুলো ও তাকে দেখতে হচ্ছে যেখানে রিমির প্রতি তার অজানা অনুভূতি তাকে অবসর সময়ে বেশ জ্বালাতন করে, এইদিকে রিমির পরিস্থিতি ঠিক ব্যাখ্যা যোগ্য হয়ে উঠছে না। এক অদ্ভুত দোটানায় পড়ে আছে তাদের জীবন গুলো।
কিন্তু কে জানতো- যেখানে, যে যার যার পরিস্থিতি সবাই এক পর্যায়ে মেনে নিতে শুরু করেছিল, সেখানেই হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দেবে এক মাস পর। দীর্ঘ একমাস পর, বাস্তব জীবন এই আশাহত প্রাণগুলোর স্বার্থেই হয়তো নতুন মোড়ে, নতুন গতিতে বাঁক নিলো।

(এক মাস পর)
হসপিটালে~
নভেম্বর মাসের আজ ১৩ তারিখ। শীতকাল পড়েছে কিনা বলা দ্বায় তবে শীতের আভাস কোনো কমতি রাখছেনা শীতকালের আগমনের ঘোষণা দিতে। সকাল ৮ টার দিকে হঠাৎই হসপিটালের এক কেবিনে চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেলো-

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“রুদ্র… রুদ্র..!” রামিলা চৌধুরী রুদ্র কে ফোন করার পর রুদ্র ফোন রিসিভ করতেই অস্থির ভাবে ডাকতে শুরু করলেন রুদ্রকে। রুদ্র তখন গাড়ি চালাচ্ছিল হসপিটালের রাস্তার দিকেই। প্রতিদিন ভাইয়ের আর মায়ের সাথে দেখা করে নিজের কাজে যায়। রামিলা চৌধুরী ও হসপিটাল থেকে বাড়িতে যান নি, গৃহকর্মী ই বাড়ির আর জুলিয়েটের দেখা শোনা করে। মায়ের অস্থির গলা শুনেই রুদ্র সাথে সাথে প্রতি উত্তর করলো-
“হ্যাঁ আম্মু, বলো। কি হয়েছে! এতো অস্থির কেন শোনাচ্ছে তোমার গলা কিছু হয়েছে?”
রামিলা চৌধুরী কান্না মিশ্রিত একটা হাঁসি দিয়ে রুদ্র কে বললেন –
“রা… রায়ানের জ্ঞান ফিরেছে। তুই কোথায় তাড়াতাড়ি হসপিটালে আয়। রায়ানের জ্ঞান ফিরেছে।”
রুদ্র প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না নিজের খানকে, তাই দ্বিতীয় বার আবার জিজ্ঞেস করলো-
“কি বললে!? ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে?”
রামিলা চৌধুরী খুশিতে কাঁদতে কাঁদতেই আওয়াজ করলেন-

“হুম হুম।”
রুদ্র মায়ের কাছে রায়ানের জ্ঞান ফেরার কথা নিশ্চিত হতেই আবেগে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো –
“ভাইয়া এখন কেমন আছে আম্মু? চোখ খুলেছে? কথা বলেছে তোমার সাথে?”
রামিলা চৌধুরী রুদ্রর প্রশ্নের উত্তরে শুধু বললেন -“না, এখনো চোখ খোলে নি, কথাও বলেনি।”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে নিয়ে আবার প্রশ্ন করলো-
“চোখ খোলে নি! তাহলে যে বললে জ্ঞান ফিরেছে ভাইয়ার?”
রামিলা চৌধুরী ভাঙা ভাঙা কথায় রুদ্র কে সব খুলে বললেন-

“আ..আজ সকালে.. না..নার্স স্যালাইন ব্যাগ চেঞ্জ করে যাওয়ার পর…আ..আমি একটু ওয়াস রুমে গিয়েছিলাম। তারপর ওয়াস রুম থেকে আসার পর দেখলাম… রায়ান নিজের একহাত তোলার চেষ্টা করছে। য..যদিও চোখ বন্ধ ছিল। আ..আমি ডক্টর দের গিয়ে সাথে সাথে এই কথা বলতেই উ..উনি এসে রায়ান কে চেক করেন।”
রুদ্র নিজের ধৈর্য রাখতে পারছিল না‌ গাড়ির স্পিড কখন বেড়ে ১৫০ হয়ে গেছে খেয়াল নেই। এই দিকে কামিলা চৌধুরী নিজের আনন্দ অশ্রু সামলে কথা বলতে হিমসিম খাচ্ছেন দেখে রুদ্র অধৈর্য হয়ে বলল-
“তারপর..! তারপর কি? ডক্টর কি বলেছেন আম্মু? ভাইয়া ঠিক আছে তো!?”
রামিলা চৌধুরী রুদ্রর অনুভূতি টাও বুঝতে পারছিলেন তাই নিজের একটু শান্ত করতে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রুদ্র কে বললেন –

“ডঃ… ডক্টর বলেছেন, রায়ানের পাল্স রেট এখন ঠিক আছে। খুব তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে আসাবে ওর। মানসিক ভাবেও এখন স্ট্যাবল আছে। রায়ান কে একটু আগেই অবজারভেশনে নিয়েছেন। কিন্তু এখনো কোনো খবর পাচ্ছি না। তুই তাড়াতাড়ি আয় না। আমার এখানে একা টেনশন হচ্ছে।”
রুদ্র রায়ানের জ্ঞান ফিরার সম্ভাবনা আছে জেনে বেশ খুশি মনে মাকে আশ্বাস দিল-
“আসছি আমি। রাস্তায় আছি আম্মু। তুমি টেনশন করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে। একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি যত দ্রুত সম্ভব।”
রামিলা চৌধুরী সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে শব্দ করলেন-“হুঁ..!”

রুদ্র হয়তো বহু সময় পর এতো দ্রুত গাড়ি চালিয়েছে আজ। বাড়ি থেকে হসপিটালের দূরত্ব যেখানে ৩০ মিনিটের সেখানে ১৫ মিনিটের কম সময়ে পৌঁছেছে সে। হসপিটালে পৌঁছানোর পর গাড়িটা সাথে সাথে হসপিটালের পার্কিং লটে পার্ক করে দ্রুত হসপিটালের ভিতরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় রুদ্র। তবে তাড়াহুড়ো তে অসতর্কতায় হঠাৎই কারো সাথে রুদ্রর ধাক্কা লাগলো খুব জোরে। অপর দিকের মানুষটি একজন মেয়ে এবং নেহাতই দূর্বল শরীর- এমন বলিষ্ঠ শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে সাথে সাথে ছিটকে পড়লো হসপিটালের ফ্লোরে। রুদ্র এবং মেয়েটা দুজনেই এমন আকস্মিক ঘটনায় আশ্চর্য হলো। মেয়েটা ফ্লোরে পড়ার সাথে এক মৃদু আর্তনাদ করল-

“আআহহহ্…সস!”
রুদ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল-এখন কি করবে সে? ইচ্ছে করে তো হয়নি। অসাবধানতাবশত লেগে গেছে। রুদ্র দ্রুততার সাথে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরতে ধরতে বলল-
“I am so sorry miss. Extremely sorry..আমি খেয়াল করি নি। আমি সাহায্য করছি, উঠুন প্লিজ।”
রুদ্র খেয়াল করলো মেয়েটার হাতে ব্যান্ডেজ করা ভাবলো হয়তো কোনো ভাবে লেগেছিল তাই, আবার পায়ের দিকে নজর জেতেই দেখলো পায়েও বেশ খানিকটা জায়গায় ব্যান্ডেজ করা যেখান থেকে এখন রক্ত পড়ছে। রুদ্র নিজের জিভ কেটে একটু বিড়বিড় করে নিজেকে বকলো-
“ইসস্, এইভাবে কষ্ট দিলাম মেয়েটাকে। আল্লাহ মাফ করো। এখন কি করবো!? এই ভুলের জন্য সরি বলা কি সাজে!”

রুদ্র মেয়েটার দিকে খুবই করুণার দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। ঠিক একই মূহুর্তে মেয়েটা নিজের চেহারার সামনে চলে আসা অতিরিক্ত চুলগুলো সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে দিয়ে নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল-
“It’s ok, it’s ok. আমি জানি ইচ্ছা করে করেন নি আপনি। হয় তো কোনো তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন।”
মেয়েটা রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আরো কিছু বলতে চাইলো-
“আপনি আপনার কাজে যেতে পারেন আমা…!”
মেয়ে টার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার আগেই সে চুপ করে গেল। সামনে থেকে এক জোড়া মায়া ভরা চোখ খুবই আশ্চর্য তার সাথে তাকে পোরোখ করছে। এইদিকে সে নিজেও চোখ বড় বড় করে দৈখছে সামনের মানুষ টাকে। রুদ্র কয়েক সেকেন্ড বরফের ন্যায় থাকার পর অচিরেই অস্পষ্ট তবে দৃঢ় গলায় উচ্চারণে করলো-
“রি…রিমি..!”

রিমি! হ্যাঁ সামনের মেয়েটা রিমি। এক মাস কেন বছরের পর বছর পার হলেও এই চির চেনা চেহারা রুদ্র কখনো ভুলবে না। রিমি রুদ্র কে এতো দিন পর আবার কখনো সামনে দেখবে ভাবতে পারেনি। নিজের অজান্তেই তার চোখগুলো ভিজে গেল। রুদ্র রিমির চোখে অশ্রু আভাস দেখে হঠাৎ বিচলিত হয়ে উঠলো রিমির কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে। রুদ্র রিমিকে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো-
“রি..রিমি! কি হয়েছে কাঁদছেন কেন? লেগেছে খুব? চলুন, ডাক্তার কাছে যাবেন চলুন। পা থেকে রক্ত পড়ছে আনবড়ত। আবার ব্যান্ডেজ করতে হবে নতুন করে।”
রুদ্রর অনুমান হয়তো ভুল ছিল, রিমি হয়তো শারীরিক কোনো যন্ত্রণাতে কাতরাচ্ছে না। রুদ্র রিমিকে আঘাতের কথা বলার পর হঠাৎ কোনো কিছু না ভেবেই রিমি রুদ্র কে জড়িয়ে ধরে বসে। নিজের আঘাত প্রাপ্ত হাত দিয়েই সর্বশক্তি যে রুদ্র কে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরল। রুদ্র আশ্চর্যতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলো কি হচ্ছে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। নিজে নিজেকে বলল-

“হচ্ছে কি? রাতে স্বপ্ন দেখতাম এসব তাই কি যথেষ্ট নয়? এখন দিনে দুপুরে না ঘুমিয়েও এমন স্বপ্ন দেখতে হবে? রুদ্র, get a grip on your self.”
রুদ্র ওভাবেই কিছুটা সময় থাকলো। রিমি রুদ্র কে ছাড়ার নাম নিচ্ছে না, ফল স্বরূপ রুদ্র এক পর্যায়ে বুঝতে পারলো সে স্বপ্ন দেখছে না এখন। তবে রিমির এমন আচরণে আশ্চর্যতা কমছে না। রুদ্র না চাইতেও হয়তো কেবল লুকায়িত অনুভুতির খাতিরে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে রিমিকে আগলে ধরলো নিজের বাহুর মাঝে। হালকা করে রিমির মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলল-
“অনেক লেগেছে তাই না? এইভাবে কাঁদবেন না প্লিজ। আমার বুকে ব্যাথা করছে এখন। শান্ত হন, আর আমার সাথে ডক্টরের কাছে চলুন।”
রিমি কিছু না বলেই রুদ্রর বুকে মাথা রেখে একটু সময় কাঁদল। এই দিকে রুদ্রর নাজেহাল অবস্থা। জীবনে প্রথম কোনো নারীর সংস্পর্শে এসেছে সে। মনের মধ্যে অদ্ভুত সব অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে যার ব্যাখ্যা নেই। রুদ্র নিজেকে এক প্রকার হুমকি দিচ্ছে-

“মেয়েটা কাঁদছে রুদ্র! কি ভেবে যাচ্ছিস আবল-তাবল এগুলো। What’s wrong with you? got damn. সব ওই কালা বই পড়ার ফল। আর পড়বোই না বাল।”
রুদ্র আবারো রিমিকে শান্ত গলায় বলার চেষ্টা করলো-
“রি.. রিমি! আমি দুঃখিত। এভাবে কাঁদবেন না প্লিজ। আমার বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে।”
রিমি রুদ্র বুকে ব্যাথা করছে শুনে ধপ করে রুদ্র কে ছেড়ে দিলো। আর এখন সাথে রুদ্ররও না চাইতেই রিমিকে ছাড়তে হলো। রিমি রুদ্রর দিকে ভেজা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“বুকে কোথায় ব্যাথা করছে আপনার? বুকের ব্যাথার জন্যই কি হসপিটালে এসেছেন?”
রুদ্র রিমির মাসুম চেহারা দেখে একটু ঠোঁট প্রসারিত করে হেঁসে মনে মনে বলল-
“এতো অবুঝ না হলে হতো না? কিভাবে বোঝাবো বুকে কোথায় ব্যাথা করে আর কেন করে আপনার উপস্থিতি আর অনুপুস্থিতিতে।”
রিমি আবারো প্রশ্ন করলো-

“কি হলো? ডক্টর দেখানো হয়ে গেছে? না এলেন মাত্র?”
রুদ্র রিমিকে প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই হঠাৎ করে কোলে তুলে নিলো। কম সময়ের ব্যবধানে নিজেকে রুদ্রর কোলে আবিষ্কার করতেই রিমি রুদ্র কে বলল‍-
“একি! কি করছেন? নামান আমাকে। পড়ে যাবো আমি। লোকে দেখলে কি বলবে? আমি হাঁটতে পারি।”
রুদ্র আদেশ মূলক কন্ঠে বলল-
“সসসুউউসস! চুপ করে থাকুন। আপনার পা থেকে রক্ত পড়ছে এই দিকে যদি লোকের চোখ না গিয়ে কার কোলে আছেন সেই দিকে চোখ যায় তাহলে সে সকল লোকেদের ইগনোর করতে শিখুন। I don’t care what people think neither should you.”

রিমি আর কিছু বলতে পারলো না চুপটি করে রুদ্রর কোলেই থাকলো। রুদ্র রিমিকে নিয়ে গিয়ে আবারো নতুন করে পায়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে নেয়। রিমি এখন বেড়ে শুয়ে আছে। রুদ্র রিমিকে এক নজরে দেখে যাচ্ছে এই দিকে রিমির গলা শুকিয়ে কাঠ- একটু আগে সে রুদ্র কে জড়িয়ে ধরেছে বলে নিজেকে ইচ্ছে মতো দোষ দিচ্ছে। হঠাৎ রুদ্রর ফোনটা বাজলো। রুদ্র ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো রামিলা চৌধুরী কল করেছেন। তৎক্ষণাৎ রুদ্রর মাথায় বাড়ি খেল সকালই রায়ানের জ্ঞান ফিরেছে বলে অবজারবেশনে নেওয়া হয়েছে। হঠাৎ রিমির সাথে ধাক্কা লাগার এ্যাকসিডেন্ট হওয়ার ভুলেই গেছিল হসপিটালে কেন এসেছে। নিজের মাথার চুল খামচে ধরে বলল-“অঅহহ..সিট। আম্মু ভাইয়া!”

রুদ্রর কথা শুনে রিমি জিজ্ঞেস করলো – “জ্বি? কি বললেন?”
রুদ্র রিমির কাছে গিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বলল-
“রিমি আমার একটু কাজ আছে এখানে, আপনাকে না হয় সব পড়ে খুলে বলবো। আমাকে এখন যেতে হবে খুব আর্জেন্টলি। আপনি এখানে থাকুন আমি আসছি।”
রিমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো। রুদ্র হেটে দরজা পর্যন্ত গিয়ে কি যেন একটা ভেবে রিমির কাছে আড়ালে ফিরে এসে হুমকির সুরে বলল-
“এখানে থাকতে বলেছি মানে এখানেই থাকবেন। আজকে ফাঁকি দিলে খুব রাগ করবো। মনে থাকবে? এক পা ও নোড়বেন না।”

রিমি সাথে সাথে বলল-“দেব না ফাঁকি। আর হারাবো না। এখানেই আছি। আপনি যান।”
রুদ্র রিমির মাথায় একবার হাত বুলিয়ে ওই জায়গা থেকে বের হয়ে রায়ানের কেবিনে না গিয়ে সোজা অবজারভেশন রুমের সামনে যায়। রামিলা চৌধুরী একটা কোণায় বসে ছিলেন সামনেই সাথে রায়হান চৌধুরী ও ছিলেন। রামিলা চৌধুরী খবর দেওয়ার পর উনি হসপিটালে চলে এসেছিলেন রুদ্রর আগেই। রুদ্র দৌড়ে মা বাবার সামনে গিয়ে ব্যাস্ত কন্ঠে বলল-

” ভাইয়া কোথায়! ডক্টর কি ছু বলেছেন? এখন কি অবস্থা?”
রামিলা চৌধুরী রুদ্র কে দেখতে পেয়ে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন-
“আমার ছেলেটা ঠিক হয়ে যাবে তাই না বল? একটা মাস আমার ছেলে আমার সাথে কথা বলে নি। আমি আর মানতে পারছি না এই অপেক্ষা।”
রুদ্র রামিলা চৌধুরীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল-“সব ঠিক হয়ে যাবে আম্মু। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।”
রায়হান চৌধুরী রুদ্র কাঁধে হাত রেখে দাড়াতেই অবজারভেশন রুমের দরজা খুলে ডাক্তার সাহেব খুবই ব্যস্ততার মধ্যে বেড়িয়ে বললেন-

“মিস্টার এন্ড মিসেস চৌধুরী, গুড নিউজ! প্যাসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা এবার তার সাথে দেখা করতে পারেন।”
সবাই খুব উৎসুক মনে একসাথে কেবিনে ঢুকতেই দেখলেন রায়ান বেডে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় পানি খাচ্ছে। বাড়ির সবাইকে একসাথে দেখে রায়ান হালকা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। রামিলা চৌধুরী এতদিন পর ছেলেকে সজ্ঞানে দেখে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। দ্রুত রায়ানের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। রায়ান শরীর যথেষ্ট দূর্বল তাই রুদ্র রামিলা চৌধুরীকে সরতে বলতে নেওয়ার আগেই রুদ্র কে রায়ান ইশারা করে থামিয়ে দিল। রায়ান মায়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারছিল সেও মাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
“আরে এভাবে শোকাহত হয়ে গেছ কেন মরে গেছি নাকি আমি?”
রামিলা চৌধুরী রায়ান কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বললেন –
“মা..মার খাবি বলে দিচ্ছি। চুপ থাক। এখনো বাঁদরামি করছিস।”

রুদ্র তুচ্ছ ভাব দেখালো মুখে যেন অনেক দিন পর রায়ান যে এখন তাদের মাঝে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। রায়হান চৌধুরী একদিকে দাঁড়িয়ে থেকে মা ছেলেকে দেখে যাচ্ছেন। আবেগ বোঝাতে তিনি বরাবরই একটু চাপা স্বভাবের রায়ান ঠিক বাবার মতোই। রুদ্র কেও রায়ান ইশারা করে কাছে ডাকলো। রুদ্র ও ছুটে গেলো রায়ানকে জড়িয়ে ধরতে। অবশেষে যখন রামিলা চৌধুরীকে একটু শান্ত করতে পারলো রায়ান তখন নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল-

“মরতে বসেছিলাম দেখে সবাই হুমড়ি খেয়ে আমার উপরে পড়ছে তুমি দূরে দাঁড়িয়ে কেন আব্বু? আমাকে নিয়ে কি তোমার চিন্তা হয়নি?”
রায়ান ইচ্ছে করেই বাবার সাথে মজা করছিল। রায়হান চৌধুরী ও দমার মানুষ নন। ছেলেকে বোকতে এক ফোঁটাও ছাড় তিনি দেবেন না বলে জোরে গম্ভীর গলায় বললেন-
“তোর মতো কুলাঙ্গার সন্তানের চিন্তা কেন হবে আমার হ্যাঁ? এমন বেপরোয়া ছেলে আমার চাই না। যে কিনা বাপ মার কথা চিন্তা করে না। কত কোটি টাকার লস হলো আমার এই কয় দিনে। ব্যবসার যাতা অবস্থা হয়ে গেছে। আমি অফিসে চলে যাবো এখন। জ্ঞান ফিরেছে মা ভাইয়ের সাথে বাড়ি চলে যাস।”
রায়ান হাসতে না চেয়েও হেঁসে ফেললো সাথে রুদ্র আর রামিলা চৌধুরী ও হাসছেন। রায়হান চৌধুরী যে পুরোটাই বানোয়াট বললেন তা বোঝা গেল। রামিলা চৌধুরী হেঁয়ালি করে বললেন-
“ছেলের চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছিল। বলে কিনা কেন চিন্তা করবে।”
সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বললেও রায়ানের চোখ অন্য কিছু খুঁজছে। কেবিনে ডাক্তার সাহেব ঢুকে রায়ান কে জিজ্ঞেস করলেন-

“Hello young man… কেমন লাগছে শরীর এখন?”
রায়ান ডাক্তার সাহেবের কথায় উত্তর করল-“I am fine doctor. Thank you. আপনাকে আমার পরিবারের অনেক কথা সহ্য করতে হয়েছে হয়তো তার জন্য সরি।”
রামিলা চৌধুরী রায়ানকে পিঠে হালকা চর দিলেন সাথে রায়ান ও নাটকিয় আর্তনাদ করল-“আহহ্..!”
ডাক্তার সাহেব হসলেন। রায়ান নিজের ধৈর্য রাখতে না পেরে অবশেষে মাকে জিজ্ঞেস করলো-
“আম্মু তোমরা সবাই ভিতরে এলে- আমার হৃদপাখি কোথায়? ও কি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ? আমার উপর রাগ কমে নি ওর? একটু ডাকো না মিরাকে।”
ডাক্তার সাহেব রায়ানের মুখে মিরায়ার নাম শুনে আরো হেঁয়ালি করে রামিলা চৌধুরীকে বললেন-
“মিসেস চৌধুরী..প্লিজ আপনার ছেলেকে তার হৃদপাখি এনে দিন। মিরা নাম তাই না? ভারি মিষ্টি নাম। অজ্ঞান অবস্থায় এমন ভাবে বেঘোরে এই নাম এতোবার উচ্চারণ করেছে যেন মনে হচ্ছিল কোনো দোয়া পড়ছে। মিরাকে এনি দিন দেখবেন এখনি বেড থেকে উঠে লাফাচ্ছে।”

রায়ান বেশ লজ্জায় পড়ে গেল মনে হলো ডাক্তার সাহেবের সত্যি ফাঁস করে দেওয়ায়। রায়ান নিজের ঘাড়ে হাত দিয়ে একটু ঘোসলো নিজের লজ্জা লুকাতে। তবে রামিলা চৌধুরীর মুখের হাসি উড়ে গেল। ছেলে জ্ঞান ফেরার আগে অব্দি মিরায়ার নাম উচ্চারণ করেছে বিষয়টা তার কাছে ভালো লাগলো না খারাপ তিনি নিজেই বুঝে উঠতে পারলেন না। একটা সময় কত করে চাইতেন ছেলে যদি মিরায়াকে বউ হিসেবে মেনে নিতো। অথচ এখন তিনি ভাবছেন তার ছেলে বউ মেনে নিলেও মিরায়া বর হিসেবে রায়ানকে মানে নি। এইদিকে রুদ্র আর রায়হান চৌধুরী সম্পূর্ণ চুপ করে রইলেন। রুদ্র তো মাথাও উঁচু করছে না- সে ভালো করেই জানে রায়ানের মিরায়ার জন্য পাগলামি স্বাভাবিক নয়। মিরায়া এখনো চট্টগ্রামে এটা রায়ান জানলে কেলেঙ্কারি হতে আর রক্ষা থাকবে না।
রায়ান সবাইকে চুপ দেখে আবারো জিজ্ঞেস করলো মিরায়ার কথা-

“আচ্ছা তোমারা কি ওকে এখনো সামলাতে পারো নি? রাগ করে আছে আমার উপর ঠিক সময়ে ওকে আনতে যেতে পারিনি বলে তাই না?”
কারো মুখে তখনও কোনো কথা নেই। রামিলা চৌধুরী ছেলের কথাগুলো শুনে ভিতরে ভিতরে কেমন যেন অদ্ভুত দোটানায় পড়ে গেলেন-“ঠিক সময়ে নিতে যায় নি মানে?”
রায়ান সবাইকে চুপ দেখে এবার নিজের থেকেই বলল-
“আচ্ছা বাদ দেও। আমার হয়ে আমার বউকে এনেছো এটাই অনেক। ওকে ডাকো বাকিটা আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো। আমি জানি আমার হৃদপাখি অনেক অপেক্ষা করেছে আমার। আর কখনো কষ্ট দেবে না ওকে প্রমিস। সবটাই তো হলো ওই ফা**কিং গাড়ির জন্য।”
-“যাই হোক, ডাকো না ওকে। আমি আর পারছি না ওকে না দেখে থাকতে। তাড়াতাড়ি ডাকো। রুদ্র তুই যা নাহলে আম্মু তুমি যাও। তুমি বললে মিরা শুনবে। যাও না।”
রুদ্র রায়ানের আদেশে শুকনো ঢোক গিললো আর রামিলা চৌধুরীর দিকে তাকালো। একটা বড় রকমের ঝড় উঠবে এখন তা বলা বাহুল্য। রামিলা চৌধুরী রায়ানের কথায় থতমত খেয়ে রায়ান কে নিজের মনের জটিলতা মেটাতে জিজ্ঞেস করলেন –

“মিরা, তুই নিতে গেলেই আসবে কেন?”
রায়ান তার মায়ের প্রশ্নের মানে বুঝলো না। উল্টো উত্তর করলো প্রশ্নের-
“ও মা আমাকেই তো আনতে যেতে বলেছিল। আর এই সব হয়েছে। তোমরা যে ওকে ঠিক আমার জন্য ফিরিয়ে আনবে তা তো আমি জানি। এবার আর আমাকে কষ্ট দিও না। জান বেরিয়ে যাচ্ছে ওকে দেখার জন্য। ভিতরে আসতে বলো না ওকে।”
রামিলা চৌধুরী রায়ানের মুখে মিরায়ার চৌধুরী বাড়িতে নিজ ইচ্ছায় ফিরার কথাটা শুনে একটা বড় ধাক্কা খেলেন। হঠাৎ পায়ের স্থিরতা ভঙ্গ হলে তিনি কিছু টা পিছিয়ে যান। রায়ানের এবার সবার দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো। রুদ্র চোখ তুলে তাকালো রায়ানের দিকে। রায়ান চিলের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রুদ্র দিকে নিক্ষেপ করে শান্ত ভাবেই জিজ্ঞেস করল-

“মিরা কোথায় রুদ্র?”
রুদ্রর গলা শুকিয়ে এলো। ঠিক কি বলবে এখন ভেবে না পেয়ে সত্যি টাই বলল আমতা আমতা করে-
“ভা… ভাইয়া, মি..মিরা.. মিরা ভাবি বাইরে নেই।”
রায়ান একটু নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল-
“রাগ করে হসপিটালে আমাকে দেখতেও এলো না? ওকে… ব্যাপার না জ্ঞান ফিরেছে এখন বাড়ি চল। বাড়ি গিয়ে দেখছি কি করে রাগ ভাঙানো যায়।”
রায়ান কথা টা বলেই নিজে নিজে হাতের ক্যানোলা খুলতে নিলে রুদ্র আর নিজের মধ্যে সত্যি টা রাখতে পারলো না। তাড়াতাড়ি রায়ানের কাছে গিয়ে রায়ান হাত ধরে বলল-
“ভাইয়া..মিরা..নেই! না মানে মিরা ভাবি ঢাকায় নেই। তোমার এ্যাকসিডেন্টের পর থেকে এখন অব্দি চট্টগ্রামেই আছে।”

রায়ান ভ্রু কুঁচকে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো-
“এখনো চট্টগ্রামে কি করছে ও? আমি যাইনি বলে কি শশুর বাড়িতে আসা বাড়োন নাকি? আম্মু? তুমি গিয়েছিলে ওকে আনতে না রুদ্র? মিরা ফিরিয়ে দিয়েছে কেন তোমাদের?”
রায়ানের বিশ্বাস ছিল তার অবর্তমানে তার বউয়ের অবহেলা হবে না তার পরিবার থাকতে। সেই বিশ্বাস থেকেই এমন প্রশ্ন করছে বারবার।

রামিলা চৌধুরী ছেলের প্রশ্নের কি উত্তর দেবেন! তিনি নিজেই আচম্বিত হয়ে আছেন মিরায়ার বউ হয়ে চৌধুরী বাড়িতে উঠার সিদ্ধান্ত নিয়ে। রামিলা চৌধুরী মনে মনে নিজেকে চরম পর্যায়ে কথা শোনাচ্ছেন-
“একদিকে মেয়েটা নিজের সংসার গুছানোর স্বপ্ন দেখছিল আর আমি…আমি কিনা ভুল বুঝে সামান্য যোগাযোগের ব্যবস্থা টুকুও রাখি নি?! এ কি করলাম আমি! কি হয়ে গেছে এটা আমার দ্বারা?”
রামিলা চৌধুরী আনমনে নিজের পদক্ষেপ পিছাতে থাকলে হঠাৎ রায়হান চৌধুরীর সাথে ধাক্কা খান। রায়ান রুদ্র কে জিজ্ঞেস করলো-

“কিরে জবাব দিচ্ছিস না কেন? কিভাবে ভাবিকে আনতে গেছিলি যে এলোই না। আমার খবর পেয়েও আমার হৃদপাখি আমাকে দেখতে এলো না! এটা কিভাবে সম্ভব?”
রুদ্র রায়ানকে সম্পূর্ণ কথা বর্ণনা করবে তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না কিন্তু উপায়ান্তর নেই বলে যা মন থেকে বের হচ্ছিল তাই বলল-
“মিরা ভাবিকে আনতে যাওয়া হয়নি ভাইয়া। আমরা কেউই যাই নি। তাই মিরা ভাবি আসেও নি।”
রায়ান রুদ্রর কথা যেন একটুও বিশ্বাস করলো না। একপ্রকার হেঁসে উড়িয়ে দিয়ে রামিলা চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল-

“তোমরা আমার সাথে ভালো প্রেংক করছো। নাইস ট্রায়। তবে কাজ হবে না। এখন এসব বাদ দিয়ে আমাকে আমার বউ এনে দাও প্লিজ। (দরজার দিকে মুখ করে চেঁচিয়ে) মিরা? ভেতরে এসো না।”
রামিলা চৌধুরীর চোখ ছলছল করে উঠলো। রায়হান চৌধুরী এসব আর নিতে পেরে রায়ান কে সোজা ভাষায় সব বলে দিলেন কোনো প্রকার হেঁয়ালি ছাড়াই –
“রায়ান তোমাকে বলা হয়েছে মিরা এখানে নেই মানে নেই। আর রুদ্র সত্যিই বলছে। মিরা এখান থেকে যাওয়ার পর ওর সাথে আর কোনো প্রকার যোগাযোগ করা হয়নি। আমরা ভেবে ছিলাম মিরায়া বিয়েটা মেনে নিয় নি তাই চলে গেছে তাই আর তাকে জোর করা হয়নি।”
রামিলা চৌধুরী গলা উঁচু করে রায়হান চৌধুরীকে দেখলেন এটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়- হয়তো আসল সত্য আড়াল করার চেষ্টা করছেন তিনি তা বুঝতে পারলেন রামিলা চৌধুরী। রায়ান বেশ বিরক্ত হলো এবার। এমন কথা কখন শুনবে ভাবেও নি-

“What! কি বললে তুমি আব্বু? যোগাযোগ হয়নি মানে কি? মিরা কোথায় আছে কেমন আছে তা তোমরা জানো না এটা বলতে চাইছো? আর এটা আমাকে বিশ্বাস ও করতে হবে?”
রুদ্র ভালোই বুঝতে পারছে এখন খুব খারাপ কিছু হবে। রায়হান চৌধুরী রায়ান কে আরো কিছু বলতে জানবেন ঠিক তার আগেই রামিলা চৌধুরী নিজেই বললেন –
“থাক..! অনেক হয়েছে। যা বলার আমি বলছি।”
রায়হান চৌধুরী অবাক হলেন সাথে রায়ান আর রুদ্র ও। রায়ান বুঝতে পারছিল না এখানে এতো বলাবলির কি আছে। রামিলা চৌধুরী রায়ানের কাছে এগিয়ে গিয়ে রায়ানের মুখ বরাবর বসে রায়ানের এক হাত নিজের হাতে নিয়ে মুখে হালকা ভয় ও অনুশোচনা বললেন-

“সব দোষ আমার। আমাকে মাফ করে দে বাবা। আমার জেদের জন্য হয়েছে সব।”
রামিলা চৌধুরীর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই রায়ান এবার নিশ্চিত হলো বিষয়টা আর মজায় আটকে নেই। রায়ান মায়ের হাতে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো-
“হয়েছে কি আম্মু? কি করেছ তুমি? কি সমস্যা হয়েছে আমাকে বলো আমি ঠিক করে দেব।”
রামিলা চৌধুরী অনুশোচনা করেই বললেন-
“ঠিক তো করতেই হবে। আমিও নিজের ভুল ঠিক করে নেব‌। আমাকে ভুল বুঝিস না বাবা।”
রায়ান অধৈর্য হয়ে রামিলা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলো –
“আম্মু আমাকে বলবে কি হয়েছে? মিরা কোথায়? কি হয়েছে? কেমন আছে?”
রামিলা চৌধুরী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন-
“আমি..আমি মিরার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছি‌। আমি ভেবেছিলাম মিরা তোদের বিয়েটা অস্বীকার করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে যার জন্য তোর এমন এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে ওকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে। আমি মানতে পারি নি…এক মাসে একবার ও ওর খবর নেই নি আমি। আমি জানতাম না মিরা বিয়েটা মেনে নিয়েছে। আমি..এই সব কিছুর জন্য আমি দায়ী।”

রায়ানের হাত আপনা আপনি রামিলা চৌধুরীর হাতের উপর থেকে সরে গেল। রায়ানের মাথায় তাৎক্ষণিক যে ভাবনারা বাসা বাঁধলো তার সবই মিরায়াকে নিয়ে-“মিরা ঠিক আছে তো? কিছু হয়নি তো?”
রামিলা চৌধুরী কাঁদতে কাঁদতে আবারো বলল-“তোর আম্মু কে ক্ষমা করে দে বাবা প্লিজ। মিরা কে ফিরিয়ে আন। আমি আমার বউমাকে আবার ঘরে তুলবো।”
রায়ান মায়ের দিকে তাকালো- এভাবে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হবে তার ধারণার বাইরে ছিল। রায়ান এই মুহূর্তে মাকে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। শুধু একবার বলল-
“মিরার কথা না ভেবে একবার তোমার ছেলের কথা ভাবতে আম্মু। তোমার ছেলে যে নিজের জন্য বাঁচা ভুলে গেছে। তার অস্তিত্ব এখন সম্পূর্ণ তার হৃদপাখিকে ঘিরে‌। নিজের জীবন নির্জীব, ব্যর্থ লাগে ওকে ছাড়া।”
রামিলা চৌধুরী হা করে তাকিয়ে দেখছেন রায়ানকে-এই সেই ছেলে যে নাকি বিয়ে মানতো না বউ মানতো না। রায়ান আবারো মাকে বলল-

“তো কি হয়েছে যদি মিরা বিয়ে অস্বীকার করে চলে যায় তো? আমি ওর বর এটা চিরন্তন সত্য ও মানুক বা না মানুক। প্রয়োজনে আমি ওর ইচ্ছে ছাড়াই ওর সাথে সংসার করবো। ওর করতে হবে না সংসার আমার সাথে, বাসতে হবে না ভালো, মানতে হবে না বিয়ে। তোমার ছেলে তবু তার হৃদপাখিকে চায়। চোখের সামনে শুধু বসে থাকবে আমি তাতেও সন্তুষ্ট আম্মু। কেন বুঝলে না তুমি? কেন আনলে না ওকে?”
-“আমার ভরসা ছিল তোমার উপর আম্মু যে আমি না থাকলেও আমার বউয়ের কোনো অযত্ন তুমি থাকতে হবে না। কেন আমার এই অহংকার ভাঙলে? আমার হৃদপাখি এখন কোথায় কেমন আছে কিছু জানা নেই আমার। স্বামী হিসেবে বউ কে একদিনের শান্তি দিতে পারি নি। একজন ব্যর্থ স্বামী তোমার ছেলে হতে চায়নি আম্মু।”
রামিলা চৌধুরী অবাক হয়ে ছেলে কে দেখে চোখের জল ফেলছেন। রুদ্র আর রায়হান চৌধুরী মা ছেলের মাঝে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। রুদ্র রায়ান কে সাহস করে জিজ্ঞেস করলো-

“ভাইয়া একবার মিরা ভাবিকে কল করবে?”
রায়ান রুদ্রর দিকে অগ্নী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-
“আমার ফোন দে। তোর আর কল করতে হবে না। এক মাসে নিজের ভাবি কল না করলেও নিজের বোনকে কল করতে পারতি। তোকে বড় ভাইয়ের মতো মনে করে অথচ বড় ভাইয়ের দায়িত্বের কত টুকু পালন করেছিস তুই?
রায়ানের কথা গুলো রুদ্রর অন্তরে লাগছিল কিন্তু যেখানে মায়ের কসম আছে তা করার সহাস কেন জানি রুদ্রর হয়নি। মিরায়ার দেবর হিসেবে নিজেকে কখনোই গণ্য করেনি রুদ্র বরাবরই ভাই হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছে যেখানে ভাই শব্দের মন সে রাখতে পারেনি- রুদ্র ভেতরে ভেতরে খুবই মনস্তাপে ভুগছিল। রুদ্র রায়ানের ফোনটা রায়ানকে দিলো এত দিন কাজের সুত্রে ফোনটা তার কাছেই ছিল। রায়ান নিজের ফোনটা দ্রুত হাতে নেওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই চেঁচিয়ে উঠলো-

“মিরার নাম্বার কোথায়? কারোর নাম্বারই তো নেই।”
রুদ্র আমতা আমতা করে বলল-“ডি…ডিলিট হয়ে গেছে।”
রায়ানের চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। হাতের ক্যানোলা অসাবধানতায় জোর করে টেনে খুলে বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেয়ি কেবিনে সবার উদ্দেশ্যে হুমকি স্বরূপ বলল-
“আমি যদি আমার হৃদপাখিকে সুস্থসবল সুরক্ষিত না পাই, আমার আশা বেদ দিয়ে দিও তোমরা। যে বাড়িতে কারো আমার বউয়ের পরোয়া নেই আমি সেই বাড়িতে পাও রাখবো না কখন। আল্লাহর কাছে দোয়া করো, আমার বউ যেন ঠিকঠাক থাকে, যেন আমার খারাপ রূপ তোমাদের দেখতে না হয়- ছেলে আর শত্রুর মাঝে পার্থক্য খুঁজে পাবে না নয়তো।”

রামিলা চৌধুরী রায়ানের কথায় ভয় পেয়ে গেলেন কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে সহজ স্বীকারোক্তি ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তিনি রায়ান কে উদ্দেশ্য করেই দৃঢ় গলায় বললেন-
“আমি নিজের কাজের জন্য দরকার পড়লে মিরার কাছে ক্ষমা চাইবো তাও ওকে তুই যেভাবে পারিস ফিরিয়ে নিয়ে আয়। চৌধুরী বাড়ির লক্ষ্মী কে ঘরে তুলবো আমি নিজ হাতে। নিজের ভুল শুধরে নেবে তোর মা। এমন কথা বলে আমাকে কষ্ট দিস না দয়া করে।”
রায়ান মায়ের কথা ঠিক শুনতে পেলো কি পেলো না বোঝা দায়। হসপিটালের ড্রেস খুলে নিজের একটা সাদা শার্ট পড়তে পড়তে রুদ্র কে বলল-

“আমার মিরার আর সোরার নাম্বার চাই এখনি। রাইট নাউ। যেখান থেকে পারিস এনে দে।”
রুদ্র কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে রইল তার পরই মাথায় রিমির নাম এলো। রিমির কাছে নাম্বার গুলো পাওয়া যাবে বলে তার ধারণা হতেই রুদ্র ওই জায়গা ত্যাগ করে সোজা যে
রিমির কাছে যায়। কিন্তু রিমিকে কিছু না বলেই আচমকাই পাঁজাকোলা করে সোজা রায়ানের কেবিনে আনে। রিমি হাজার বার জিজ্ঞেস করার পর ও কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে নিয়ে যাচ্ছে কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেয় নি রুদ্র। রিমির উপস্থিতিতে সবাই বেশ অবাক। রুদ্রর এমন কাজে রিমিও খুব লজ্জায় পড়ে গেছে, সবার সামনে অস্বস্তি ও কম হচ্ছে না। রিমি রুদ্রর কোলেই শিটিয়ে গিয়ে বিড়বিড় করলো রুদ্র কানে-
“রুদ্র কি করছেন সবাই দেখছে। নামান আমাকে কোলে থেকে। এভাবে সবার সামনে আনার মানে কি?”
রুদ্র রিমিকে বসিয়ে দেয় কেবিনে থাকা সোফায়। রামিলা চৌধুরী একটু অবাক হয়ে রিমির কাছে বসে চিন্তায় জিজ্ঞেস করলেন-

“রিমি মা..তুমি হসপিটালে? হাতে পায়ে কি হয়েছে তোমার? এখানে কিভাবে এলে?”
রিমি কি যে বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। বাকি সবাই রিমির উপস্থিতির কারণ না বুঝলেও রায়ান ঠিকই বুঝতে পেরেছে। রায়ান সোজা রিমির কাছে গিয়ে বলল-
“শালি সাহেবা, হাই হ্যালো করার সময় নেই। সেসব ধীরে সুস্থে করবো অন্য সময়। আপাতত আমাকে নিজের বান্ধবীর নাম্বারটা দিন।”
রিমি আশ্চর্য হয়ে দেখছে। মিরায়ার নাম্বার কেন লাগবে,রায়ান হসপিটালে কেন কিছু মাথায় ঢুকছে না। রুদ্র রিমির কানের কাছে গিয়ে বলল-
“রিমি আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবো এখন প্লিজ কোঅপারেট করুন। যা বলা হচ্ছে তাই করুন। মিরা আর সোরার নাম্বার টা থাকলে দিয়ে দিন। আপনার কাছে আছে তো তাই না?”
রিমি চুপ থেকে মাথা জাঁকালো। রায়ান অধৈর্য হয়ে বলল-

“Do it fast. সময় নষ্ট করার সময় নেই আমার।”
রিমি আর কোনো প্রশ্ন না করে মিরায়ার নাম্বার আর সোরায়ার নাম্বারটা দিয়ে দিলো রায়ান কে। নাম্বার গুলো সেভ করে নিলো রায়ান। তার পর পর কয়েক বার ডায়েল করার পরও কারো নাম্বারে কল না ঢুকলে বুঝতে পারলো হয়তো রায়ানের নাম্বার ব্লক করা। রায়ান রিমি কে কল করতে বলল মিরায়াকে। রিমি সাথে সাথেই কল করলো। প্রায় দেড় মাসের মতো যোগাযোগ নেই রিমির ও মিরায়ার সাথে সেসব কারণ এখনো রহস্য। রিমির কল ঢুকলো কিন্তু রিসিভ হলো না। রিমি পরবর্তীতে সোরায়া কে কল করতেই কল ঢুকলো কিন্তু রিসিভ হলো না। ফোনের আশে পাশে কেউ নেই হয়তো।

রায়ানের হাতে নষ্ট করার মতো সময় ছিল না। রায়ান রুদ্র আর রিমিকে উদ্দেশ্যে করে বলল-
“রুদ্র, মাহির কে খবর দে। বল আমি ওর কলেজের সামনে যাচ্ছি গাড়ি নিয়ে যেন রেডি থাকে টাইম নেই আমার। আর তুই..রিমিকে নিয়ে বান্দরবানের আমাদের বাগান বাড়িতে
যা। ওখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা কর। আমি তোর ভাবিকে নিয়ে আসছি। আমি যেভাবে বলবো সব যেন রেডি থাকে তার খেয়াল রাখবি। কি করতে হবে আমি বলে দেব পড়ে। এখন রওনা দে। দেরি হয়ে যাবে পৌঁছাতে নয় তো।”
রিমি অবাক হলো সে বান্দরবান কেন যাবে? কিন্তু মুখের উপর প্রশ্ন করবে তখন এতো সাহস হচ্ছিল না। রায়ান রিমি কে বলল-

“Keep calling, okay? And let me know if you get some information.”
রিমি ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো। এরপর রায়ান একটা গাড়ি নিয়ে চলে গেল হয়তো চট্টগ্রামে যাবে। আর রুদ্র মাহির কে কল করে সবটা জানিয়ে দিয়েছে রায়ানের বেরনোর পরপরই। প্রথম দিকে মাহির রুদ্রর কথায় বিশ্বাস ইং করতে পাড়ছিল না। কিন্তু রুদ্র পুরোটা বলার পর যখন বুঝতে পেরেছে সবটা সত্যি তখন রায়ানের জ্ঞান ফিরেছে বলে খুশি হবে নাকি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে টেনশন করবে বুঝে উঠতে পারলো না। মাহির রায়ানের কথা মতো নিজের গাড়ি বের করলো। আর রুদ্র রিমিকে নিয়ে সোজা বাগান বাড়ির দিকে।

চট্টগ্রামে~
বিকেল ৪টা । রহমান বাড়ি একটা নীরব উৎসবের আমেজ। হয়তো কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে তবে তা খুবই নমনীয় ভাবে। মিরায়া নিজের ঘরে সাথে সোরায়া ও। এক মাসে অনেক কিছু বদলেছে। মিরায়া এখন আর তেমন কথা বলে না, তবে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেছে। অপেক্ষা তার শেষ হয়েও হয়নি, মনকে বুঝিয়ে ও বোঝাতে পারেনি, পথ চেয়ে থেকেও সেই পথের সমাপ্তি খুঁজে পায়নি। সোরায়া এখন বেশ বুঝদার হয়েছে। মিরায়ার মনভাব ও ভালো বুঝতে পারে। বাড়ির বাইরে চলছে তুমুল আয়োজন। একের পর এক বাইক এসে থামছে বাড়ির সামনে, সবাইকে দেখে খুব খুশি মনে হচ্ছে। শুধু বাড়ির ভেতরেই কারো মুখে হাঁসি নেই। রোকেয়া বেগম চুপটি করে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছেন আর এইদিকে শফিক রহমান মেহমান দের স্বাগতম জানাচ্ছেন হাসি মুখে। সবাই রোকেয়া বেগমের খোঁজ করাতে তিনি রোকেয়া বেগম কে ডাকতে এলে দেখেন ঘর বন্দি করে রেখেছেন রোকেয়া বেগম নিজেকে।
শফিক রহমান দরজা নোক করলেন-

“রোকেয়া.. রোকেয়া..! দরজা খোলো… সবাই তোমাকে খুঁজছে। মিরার মার সমতুল্য তুমি…মেয়ের আজ বাদে কাল বিয়ে। আজ আংটি বদল হবে এসময় তুমি উপস্থিত না থাকলে কেমন দেখাবে ভেবে দেখেছো? বের হও। বাড়ির মানসম্মানের ব্যাপার।”
হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, আজ মিরায়ার এ্যানগেজমেন্ট। হয়তো দুই দিন বাদেই বিয়ে। এই সম্পর্কে মিরায়ার কোনো ধারণা নেই। তবে সোরায়া সবটা জানে। মিরায়া এই জগতে থেকেও ছন্নছাড়া তার আশেপাশে কি হচ্ছে এই দিকে তার কোনো কে আর নেই আর এই সিদ্ধান্তে শফিক রহমান মিরায়ার সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন নি। যা তিনি মেয়ের জন্য ঠিক মনে করেছেন তাই করছেন। এটা স্পষ্ট যে রোকেয়া বেগম মোটেও শফিক রহমানের সিদ্ধান্তে খুশি নন বরং খুবই বিরক্ত। সোরায়া অসম্মতি জানালেই তা গ্রাহ্য হবে এমন বয়স তার হয়নি। বলা চলে শফিক রহমান একাই সম্পূর্ণ আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। রোকেয়া বেগম দরজা খুলে শফিক রহমানের হাত ধরে টেনে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেলেন।

শফিক রহমান অবাক কর ভাব নিয়ে জিজ্ঞাস করলেন –
“হচ্ছে টা কি রোকেয়া। বাইরে মেহমান কাউকে তো থাকতে হবে উনাদের স্বাগতম জানানোর জন্য।”
রোকেয়া বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন –
“তোমার মাথা ঠিক নেই। কি করছো এসব? বিয়ে দেব বললেই বিয়ে দেওয়া যায়? মিরা বিবাহিত মেয়ে। এভাবে বিয়ে দিয়ে তুমি তিনটা জীবন নষ্ট করছো।”
শফিক রহমান ও এবার চেঁচিয়ে উঠলেন –
“মাথা ঠিকই আছে আমার। আমার মেয়ে বিবাহিত কেন হবে, ওর স্বামী কোথায়? ওকি স্বামীর ঘর করেছে? বিয়ে কি শুধু সই করে দিলেই হয়ে যায়? কবুল করতে হয় স্বামী স্ত্রী কে। আমার মেয়ে কাউকে স্বামী হিসেবে কবুল করেনি।”
রোকেয়া বেগম শফিক রহমানের যুক্তি খন্ডন করলেন-
“যদি কবুল করাতে বিয়ে সম্পন্ন হয় তাহলে যার সাথে সাক্ষরে বিয়ে হয়েছে তাকেই কবুল করবে প্রয়োজনে। অন্য কাউকে নয়। বিয়ে কি ছেলে খেলা?”
শফিক রহমান -“ছেলে খেলাই ছিল, এবার ঠিক বিয়ে হবে। আমার মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র পেয়েছি আমি। আমার মেয়ে সুখে থাকবে।”
রোকেয়া বেগম তিরিক্ষি মেজাজে বললেন-

“কে সেই যোগ্য পাত্র? আসিফ? মিরা ছোট থেকে আসিফ কে ভাই বলে মেনে এসেছে আর তুমি আসিফের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছো। মিরা কখনো মানবে না এই সম্বন্ধ।”
শফিক রহমান আত্মবিশ্বাসী হয়ে বললেন-
“আসিফ ভালো ছেলে রোকেয়া। সবচেয়ে বড় কথা ও মিরাকে ভালোবাসে। আমার মেয়েটাকে সুখি রাখবে, এর বাইরে আমি কিছু চাই না আমার মেয়ের জন্য। তা ছাড়া আসিফকে মিরা ভাই মানে আসিফ মিরার ভাই নয়।”
রোকেয়া বেগম আরো উত্তেজিত হয়ে বললেন-

“তুমি পাগল হয়ে গেছো নিজের জেদ বোঝায় রাখার জন্য। আসিফকে কি মিরার ছোট বেলার বিয়ের সম্পর্কে জানিয়েছ? যদি জানতে আর সব জেনে আসিফ যদি মিরাকে গ্রহণ করত তাও হয়তো তোমার বলার জায়গা থাকতো। কিন্তু তুমি কিছুই জানাও নি। এটা ঠকানো হচ্ছে না আসিফ কে? এমনকি মিরাও এই ব্যাপারে কিছু জানে না। মেয়েটার শরীরের অবস্থা দেখেছো? এইসব যখন জানতে পারবে ঠিক কতোটা ঘৃণা করবে?”
শফিক রহমান নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন-

“করলে করবে। মেয়ের সুখের জন্য মেয়ের আর পৃথিবীর চোখে দুনিয়ার সব চেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ হতেও আমার সমস্যা নেই। তু্মি না চাইলে এসো না। কিন্তু এই বিয়ে হবে।”
শফিক রহমান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রোকেয়া বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ভুলবোঝাবুঝি আর জেদের মধ্যে পড়ে নিষ্পাপ জীবন গুলো তছনছ হয়ে যাবে তা তিনি ঠাওর করতে পারছিলেন। মিরায়ার মুখমুখি হয়ে কথা বলার সাহস ও তিনি করতে পারছেন না তাই সোরায়া কেই বলেছেন মিরায়ার সাথে কথা বলতে। শফিক রহমান আজ অনেক দিন পর মিরায়ায ঘরে যান। মিরায়া বিছানায় শুয়ে আছে। সোরায়া পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। চাচাকে ঘরে দেখে সোরায়া একটু অবাক হয়। শফিক রহমান চুপচাপ মিরায়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে বললেন-

“মিরা মা..! কেমন আছিস তুই?”
মিরায়া কোনো টু শব্দ ও করলো না। শফিক রহমান মিরায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-
“তোর চাচা সব ঠিক করে দেবে দেখিস। তুই খুব সুখী হবি মা। তোরা দুই বোন যখন ছোট্ট তোদের মুখের মায়া জালে এভাবে জড়িয়ে গেছিলাম যে কখনো নিজের সন্তান সুখ অনুভব করার ইচ্ছা জাগে নি। তোর চাচি কখনো মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে নি,এই ভেবে, যদি তোদের আদর কমে যায় নিজের সন্তান দুনিয়াতে এলে। এমন নিঃস্বার্থ ভাবে ভালো কেবল এক মা ই বাসতে পারে অথচ আজ তোর চাচি, যে কিনা নিজের সব চেয়ে দামি সম্পদ বিসর্জন দিয়েছে, সে তোর সুখের জন্য অতীতের করা ভুল ভুলে যেতে পারছে না।”

এই প্রথম শফিক রহমান মিরায়া আর সোরায়ার সামনে নিজেদের সন্তানের অস্তিত্ব না থাকা নিয়ে কথা বললেন। সোরায়ার চোখে পানি টলমল করছে, আজ সে জানতে পারলো তাদের চাচা চাচি তাদের আদরের ভাই নিজেদের সন্তানদের ও দিতে চান নি। কেবল তাদের মানুষ করতে এত বড় ত্যাগ শিকার করেছেন তারা। যেখানে প্রতিটি দম্পতির স্বপ্ন থাকে নিজেদের পরিবারের সেখানে ভাইয়ের মেয়েদের নিজের পরিবারের সম্পূর্ণ জায়গা দেওয়া মহান কাজ। শফিক রহমান ঘুমন্ত মিরায়ার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন-
“আমার উপর বিশ্বাস রাখিস মা। তোর চাচা কখনো তোর খারাপ চাইবে না। যা করছে তোর ভালোর জন্য করছে।”
অতঃপর শফিক রহমান মিরায়ার কপালে আদরের পরশ এঁকে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আর যাওয়ার আগে সোরায়া কে বললেন-

“সোরা মা..মিরাকে ভালোভাবে তৈরি করে নিতে নিয়ে আসিস সময় হলে কেমন?”
সোরায়া না পারতে মাথা নাড়ালো। শফিক রহমান ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মিরায়ার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি বেরিয়ে এলো। এতোক্ষণ পুরোটা সময়ই জেগেছিল সে সব কথাই শুনতে পেয়েছে। মিরায়া হঠাৎ উঠে বসে চোখের পানি মুছে সোরায়া কে বলল-
“বনু…কি পড়তে হবে নিয়ে আয়।”
সোরায়া অবাক হয়ে মিরায়ার দিকে তাকালো আজ বহুদিন পর মিরায়া তাকে বনু ডেকেছে। কিন্তু মিরায়া এতো স্বাভাবিক কথা বলছে দেখে অনেক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“আপু..তুমি ঠিক আছো? ”

মিরায়া সোরায়ার দিকে তাকিয়ে কান্না গিলে নিয়ে হালকা হেঁসে বলল-
“হুম, ঠিক আছি। কি পড়তে হবে গিয়ে নিয়ে আয়।”
সোরায়া বুঝতে পারছিল মিরায়ার কষ্ট হচ্ছে। সোরায়ার ও খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না সোরায়া। মিরায়াকে জাপ্টে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল-
“কেন কষ্ট পাচ্ছ আপু? কেন এতো চাপ নিচ্ছ নিজের উপর? এতো গুলো দিন কিভাবে কাটালে এভাবে? আমার অনেক কষ্ট হয়েছে জানো।”
মিরায়াও নিজেকে আর ধরে রাখলো না। একটা মাস কয়েক যুগের মতো কেটেছে তার। চোখের পানি আর বাঁধ মানলো না। মিরায়া ও সোরায়া কে জাপ্টে ধরে মনের সব কথা বলতে লাগলো-
“আর কষ্ট দেবো না তোদের, আর না। অনেক হয়েছে আমি আর পারবো না। যা বলবি তোরা তাই করবো। চাচা চাচি কেও আর কষ্ট দেবো না। আমার জন্য তোরা কেন কষ্ট ভোগ করবি।”
সোরায়া মিরায়াকে ধরে বলল-

“আমরা কষ্ট পাচ্ছি না আপু। কিন্তু তোমাকে এমন অবস্থায় দেখে কিভাবে ঠিক থাকা সম্ভব!”
মিরায়া সোরায়াকে শান্ত করতে বলল-
“সব আমার কারণেই হয়েছে রে। আমার মনে হতো যদি ঘুম থেকে উঠি আবারো এক সমাপ্তি হীন অপেক্ষার শুরু হবে আমার। তাই যতটা সম্ভব নিজেকে ঘুমন্ত রেখেছি তবে একফোঁটাও ঘুম হয়নি জানিস? যখন খুব খিদে পেত তাকে মনে করে কল্পনা সাজিয়ে খেতাম। মানুষ টাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হতো তাই মনের মতো করে কল্পনা সাজিয়েছি। সত্যি না জেনেও বারবার তাকে আগলে ধরতে চেয়েছি। কল্পনা এতো ভয়ঙ্কর জানলে এর মধ্যে পা রাখতাম না জানিস। বাস্তবতা রেখে যখন কল্পনা ভালো লাগে মানুষের আবেগ ঠিক সেখানেই মরে যায়। কল্পনার মানুষ কল্পনাতেই সুন্দর।”

-“আমিও মরে গেছি। আর কিছুর আশা নেই। কিন্তু আমার জন্য চাচা চাচি আর তোর কষ্ট আমি দেখতে পারবো না।”
মিরায়া সোরায়া কে ধরে কাঁদতে কাঁদতে নিজের সব মনের কথা বলল। সোরায়া নির্বাক, মিরায়া মানসিক ভাবে এতোটা দূর্বল হয়ে পড়েছে তা সে আন্দাজ ও করতে পারে নি। কিছু টা সময় বাদে মিরায়া নিজেকে শান্ত করে উঠে দাঁড়িয়ে। সোজা ওয়াস রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলে সোরায়া মিরায়ার জন্য আসিফের আনা এ্যানগেজমেন্ট গাউন টা পড়িয়ে দিয়ে তৈরি করে আজকের সন্ধ্যার জন্য। মিরায়া এরপর আর কোনো কথাই বলে নি। না অতীত নিয়ে আর না রায়ানকে নিয়ে।

রায়ান মাহির দুইজন দুই গাড়িতে ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। সকালে রওনা দিয়েছে, রাস্তার জ্যাম ঠেলে এতোটা সময় পর চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পেরে অবশেষে। তবে রিমির থেকে এখনো কোনো খবর আসেনি, অর্থাৎ কেউই ফোন ধরেনি এখনো। মাহিরের সাথে দেখা হওয়ার পর রায়ান একদফা মাহিরের সাথে যুদ্ধ চালিয়েছে, সে থাকতেও এতো বড় ভুল বোঝাবুঝি হলো কিভাবে এই নিয়ে। এই দিকে মাহির এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। রুদ্র কিছু বলেই নি তাকে। করার কিছু ছিল না বলে রায়ান সময় নষ্ট করে নি। এই যুদ্ধ করার এক মুহুর্তে রায়ান মাহিরকে নিজের ফোন ছুঁড়ে মারার পর মাহির সেটা ধরে ফেলে। অতঃপর তাড়াহুড়ো যে রায়ান আর নিজের ফোনটা নেয়নি। মাহিরের কাছেই রয়ে গেছে তার ফোন। রায়ানের নাম্বার যেহেতু ব্লক করা ছিল তাই রায়ান মাহির এর উদ্দেশ্যে গাড়ি থেকে চেচিয়ে বলল-

“মাহির..! আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। একবার মিরাকে কল করবি প্লিজ তোর নাম্বার থেকে? আমার ফোন তোর কাছেই ওইটা থেকে নাম্বার টা নে।”
মাহির রায়ানের কথা তেই বলল-
“ওকে, ওয়েট দেখছি। ভাবির নাম্বার কি দিয়ে সেভ করা?”
রায়ান যেন আবার কি মনে করে মাহির কে বলল-
“না না থাক মিরাকে না। ওর নাম্বার নিবি না।”
মাহির অবাক হলো-“কেন কি হয়েছে? তো কার নাম্বারে কল করবো?”
রায়ান মিরায়ার নাম্বার দিতে চাইছে না এইটা নিয়ে মাহির আবার কি ভাববে ঠিক বুঝতে না পেরে মাহিরের সাথে মজা করছি বলল-

“এক কাজ কর আমার শালির নাম্বার নে। তুই তো এমনিতেও ওর নাম্বার চেয়ে চেয়ে মাথা খেয়ে ফেলতি। এখন সুযোগ আছে নিয়ে নে।”
মাহির বেশ অহংকারী ভাব নিয়ে বলল-
“লাগবে না আমার তোর শালির নাম্বার। I have no interest.”
রায়ানের গাঁয়ে লাগলো তবে প্রকাশ না করে গম্ভীর ভাবে বলল-
“মাহির, চড়ুই পাখি কে কল কর।”
মাহির রায়ানের ফোন ঘাটতে ঘাটতে বলল-
“তোর ফোনে চড়ুই পাখি নামে তো কোনো সেভ নাম্বার নেই।”
রায়ান গাড়ি চালাতে চালাতে বলল-

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৮

“ওহহহ, ওর নাম দিয়ে সেভ করা দেখ- সোরায়া লিখা।”
মাহির নাম টা হয়তো প্রথমে খেয়াল করে নি তাই স্বাভাবিক ভাবে বললো-
“ওহ আচ্ছা, সোরায়াআআআআআ (মাথায় নামটা পড়তেই ঘন্টা বাজলো) সোরায়া…!”
রায়ান মাহির কে উদ্দেশ্য করে বলল-
“হ্যাঁ, সোরায়া। আমার শালির নাম। পেয়েছিস নাম্বার? কল কর তাড়াতাড়ি।”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here