আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৬
অরাত্রিকা রহমান
রায়ান আবার একই ভাবে নিয়ে:
“হ্যাঁ এটাই করব। দশ বছর ধরে আমার বউয়ের খেতাব নিয়ে রেখেছে অথচ স্বামীর হক এখনো আদায় করা হয় নি আমার। বিষয়টা দৃষ্টি কটু।”
রায়ানের উত্তরে মাহিরের কাশি উঠে যায়। মাহির নিজেকে সামলিয়ে বলল-
-” ওই বেহায়া। দশ বছর ধরে তো তুই বাহিরে । বউ রে না দেখেছিস আর না স্বীকৃতি দিয়েছিস। তো কিসের স্বামীর হক, হ্যাঁ?”
রায়ান – “দেখেছিস কখনো আমার সাথে তোর সো কলড ভাবি কে?”
মাহির -” না, আমি কিভাবে দেখবো তুই তো নিজেই নিজের বউরে দেখস নাই।”
রায়ান রাগি মুখে উত্তর দিল,
-” তো দেখলাম না, ধরলাম না, ছুলাম না, খেলাম না আমার বউ কেমনে হলো ? তোর ভাবি কেমনে হলো? ”
মাহির চোখ টিপে হেঁসে বলল:
-“আচ্ছা আচ্ছা, রাগ করিস না ভাই। তা… দেশে ফিরলি কেন? আবার আমেরিকায় গিয়া বরফ খেতে পারতিস!”
রায়ান একটু চুপ থেকে, গভীর গলায়:
-“ফিরেছি… ওর জন্যই ফিরেছি।”
[মাহির হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়। গাড়ির ইঞ্জিনের হালকা শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। তারপর আবার মাহির মুখে বাঁকা হাসি।]
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাহির:
-“মানে… তুই সত্যিই… তোর ওই পিচ্চি বউটার জন্য মানে ভাবির জন্য দেশে ফিরেছিস?”
রায়ান চোখে একরাশ অভিমান নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল:
-“ও আর পিচ্চি নেই, মাহির। আমার মতোই বড় হয়েছে… আর আমি ঠিক করেছি, এবার নিজের জীবনের জিনিস নিজে ঠিক করব।”
তুই যেটা জোকস বানাস, সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জ্বালা ছিল।
[মাহির একটু লজ্জা পায়, গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়]
মাহির কোমল গলায় বলে:
-“ভাই, দুঃখিত। আমি তো ভাবছিলাম তুই এখনও আগের মতোই রিয়্যাক্ট করবি। বুঝিনি তুই সিরিয়াস। আচ্ছা তাহলে এখন কি করবি ভেবেছিল?”
রায়ান নির্দ্বিধায় উত্তর করে:
-“ডিভোর্স!”
রায়ান হঠাৎ এমন কথা, যেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত আর তিক্ত – সেই কথাটার অভিঘাতে যেন চারদিকের আবহাওয়াটাও বদলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে আকাশটা মেঘে ঢেকে গেল, সূর্যের আলো ঢেকে গিয়ে চারপাশে এক ধরণের চাপা অন্ধকার নেমে এলো।
বাতাস থমকে গেল, যেন প্রকৃতিও রায়ানের কথায় থমকে গেছে। মেঘলা আকাশটা শুধু বিষণ্ণ না, বরং রীতিমতো রূঢ়—যেন রায়ানের কথার প্রতিধ্বনি করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
আর মাহির? সে তো পুরো হতবাক। চোখ দুটো বিস্ফারিত, মুখটা কিছুটা খোলা, যেন ঠিক বুঝতেই পারছে না, রায়ান এটা বলল কী করে!
কিন্তু কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। চোখের কোণে সন্দেহ, বিস্ময় —সব একসাথে খেলা করছে। যেন নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছে না, এমন কিছু রায়ানের মুখে সে শুনবে।
চুপচাপ ড্রাইভ করতে থাকা মাহির আর আকাশের মেঘলা অবস্থা, দুটোই যেন রায়ানের কথার ওজন টেনে নিয়ে হঠাৎ ভারী হয়ে উঠেছে।
ঢাকা শহরের সকালটা আজ একটু অন্যরকম। আকাশটা কেমন যেন বিষণ্ণ, ঘন মেঘে ছেয়ে আছে পুরোটা। রোদের কোনো চিহ্ন নেই, বাতাসও থমথমে। এইরকম আবহাওয়ায় মানুষ একটু চুপচাপ থাকে, শহরের শব্দও কমে আসে। মিরায়া নিজের মনে হেঁটে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সকালটা থমথমে। ঘন মেঘের চাদরে সূর্যটা লুকিয়ে গেছে, বাতাসে এক ধরনের চাপা শূন্যতা। চারদিক কেমন যেন নিঃশব্দ—শুধু পাতা নড়ার শব্দ আর মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসা অচেনা কণ্ঠের টুকরো।
আজকে তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন- মিরায়া আজ একটু একা থাকতে চেয়েছিল। সকালে রেজাল্ট এসেছে—সে তার স্বপ্নের বিদ্যাপীঠে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। সে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।
৪৫ তম হয়েছে মিরায়া। লো-তে চান্স এসেছে। মনে এক অদ্ভুত আনন্দ আর ভেতরে একটা অদ্ভুত ঘোলাটে অনুভূতি। ক্যাম্পাসটা চোখে দেখতে এসেছিল সে—যেখানে হয়তো তার আগামী বছরগুলো কেটে যাবে।
হেঁটে হেঁটে সে যখন টিএসসির পাশের গাছপালায় ছায়া ঘেরা একটা ফাঁকা জায়গার দিকে আসে, হঠাৎ সে টের পায় কিছু একটা ঠিকঠাক নেই। সামনে একটা মেয়ে, তার মুখে আতঙ্ক। আর চারপাশে দুইজন ছেলে ঘিরে আছে মেয়েটিকে, চোখেমুখে হালকা বাজে হাসি, এবং কথাবার্তা শুনেই বোঝা যায়—তারা মজা করছে না, ভয় দেখাচ্ছে।
মেয়েটা বলার চেষ্টা করছে,
“Please, আমাকে যেতে দিন, আমি বলছি না—”
“এই যে সুন্দরী, ক্যাম্পাসে নতুন নাকি? চলো তোমাকে ক্যাম্পাস দেখাই।” —একজন বলে।
মিরায়া থেমে দাঁড়ায়। শরীরটা শক্ত হয়ে ওঠে, চোখ দুটো বড় হয়ে ওঠে।
সে এগিয়ে যায়—কোনো হম্বিতম্বি না, একদম স্বাভাবিক গলায় বলে,
“ওই, ভাই, একটু সরবেন? ও আমার ক্লাসমেট। আর আমি ক্যাম্পাস চিনি আমিই ওকে ঘুরে দেখাতে পারবো। আপনাদের কষ্ট করতে হবে না।”
ছেলেরা তাকায়, হালকা বিরক্ত গলায় বলে,
“তুই কে রে, তোর ক্লাসমেট হলেই কি, ভাইয়েরা কথা বলতেছে দেখিস না?”
মিরায়া এবার ঠান্ডা গলায় বলে,
“ভাইয়েরা আপনাদের কথা কেউ শুনতে চায় না । এখন কথা বন্ধ করুন।”
একজন এবার বেশ রেগে ওঠে,
“তুই কি বেশি চালাকি দেখাচ্ছিস, গায়ে হাত দেই?”
মিরায়া এবার ব্যাগ থেকে ধাতব পানির বোতলটা টেনে ধরে।
“দেন, ছুঁয়ে দেখেন তো পানিটা ঠান্ডা না গরম।”
ছেলেটা হেসে এগোতেই, মিরায়া হঠাৎ এমন এক ঘূর্ণি গতিতে বোতলটা ছেলেটার হাঁটুর পেছনে মারে, ছেলেটা ভারসাম্য হারিয়ে ধপাস করে পড়ে যায়। দ্বিতীয়জন ধাক্কা দিতে যায়, মিরায়া সাথে সাথেই মেয়েটাকে পেছনে ঠেলে দেয় এবং নিজে সামনের দিকে ডাইভ দিয়ে তার পা-র নিচে বাধা দিয়ে ফেলে দেয়।
ছেলেটা পড়ে যাওয়ার পরও মিরায়া শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
“আর কোনো বীরত্ব বাকি থাকলে এখনই দেখা। ক্যাম্পাসে মেয়ে দেখলেই বাজে কথা বলবি না । শিখিয়ে দিলে তোরা শিখবি না। তাই শিক্ষা দিতে হবে ভালো মতো।”
এই দৃশ্য দেখে আশেপাশে কিছু ছাত্র এগিয়ে আসে। ছেলেরা পরিস্থিতি খারাপ দেখে দ্রুত পালিয়ে যায়।
মেয়েটা ধীরে ধীরে মিরায়ার পিছনে লুকায়। তার চোখে কৃতজ্ঞতা, একটু কান্নার ধ্বংসাবশেষও আছে।
“ধন্যবাদ… আমি—আমি রিমি। তোমার নাম?”
মিরায়া একটু হেসে বলে,
“মিরায়া। আরে! তোমাকে তো— আমি পরীক্ষার দিন ও দেখে ছিলাম। আজই তো রেজাল্ট এলো, তুমি কততম হয়েছো?”
রিমির চোখ চকচক করে ওঠে।
“৫০! লো-তে পেয়েছি। প্রথমে মন খারাপ ছিল, এখন মনে হচ্ছে এটাই ঠিক ছিল। তুমি?”
মিরায়ার মুখে এবার সত্যিকারের হাসি ফুটে ওঠে।
“আমি ৪৫। মানে, আমরা একই অবস্থায়!”
দুজনেই হেসে ওঠে। রিমি বলে,
“ভেবেছিলাম নতুন জায়গায় এসে সবার সাথে মিশতে সময় লাগবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমার প্রথম ফ্রেন্ডটা পেয়েই গেছি।”
মিরায়া চোখ টিপে বলে,
“তাহলে শুরু করি? ক্যাম্পাসটা আমাদের দুইজনের জন্যই নতুন। চলো, চা খেতে যাই। গল্প অনেক জমবে। আচ্ছা তুমি টা বন্ধুত্বের সাথে যায় না তুই বললে কি কিছু মনে করবি তুই?”
রিমি- “আরে কি যে বলিস। তুমি ডাকে তো আমার এলার্জি আছে। তুই এ মজা আছে।”
রিমির কথা শুনে মিরায়া রিমির হাত ধরে হাসি মুখে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলে-
-“চল জান, চা খাই গিয়ে দুজনে।”
মেঘলা আকাশটা তখনো পুরোপুরি ফাঁক হয়নি, কিন্তু সূর্যের একটুকরো আলো ঠিকই মেঘের ফাঁক গলে এসে দুজন বন্ধুর ওপর নেমে আসে। ঢেউয়ের মতো জীবনের শুরু— দুজন হাত ধরে হেঁটে চলে গেল তা খেতে। সাহস আর বন্ধুত্ব থাকলে সব পথই হালকা হয়ে যায়।
সময় তখন দুপুর বারোটা পেরিয়ে গেছে। রিমির সঙ্গে টিএসসি-র পাশের চায়ের দোকানে চা খেয়ে একটা অদ্ভুত শান্তি তাকে ঘিরে রেখেছে। চা-টা যেন জীবনে প্রথমবার সত্যিই তৃপ্তির স্বাদ এনে দিয়েছে।
মনে একরাশ আনন্দ নিয়ে মিরায়া ধীরে ধীরে হাঁটছে নিজের বাসার পথ ধরে। রাস্তার পাশে থাকা গাছগুলো নীচু হয়ে বাতাসকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে ওর কপালে চুল উড়িয়ে দেয়। মিরায়া থেমে দাঁড়ায়।
চোখ তুলে দেখে—আকাশটা ধূসর হয়ে উঠেছে আরও। মিনিট পাঁচেক আগে যেটা ছিল শুধু মেঘলা, এখন সেখানে মেঘের ভেতর একধরনের ব্যাকুলতা। হঠাৎই নেমে আসে বৃষ্টি। ছোট ছোট ফোঁটা, তারপর দ্রুত বড় হয়ে নামে টিপটিপ ঝরে পড়া বৃষ্টির ঢেউ।
প্রথমে একটু অবাক হয় মিরায়া। হাতে থাকা ব্যাগটা বুকের কাছে ধরে সে দাঁড়িয়ে থাকে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপর…
তার ঠোঁটের কোণে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে এক অনিয়ন্ত্রিত হাসি।
সে চোখ বন্ধ করে দুই হাত ছড়িয়ে দেয় আকাশের দিকে। মুখটা তুলে দেয় ওপরে, যেন প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা তার মুখে এসে পড়ে । মিরায়া একটু কেঁপে ওঠে—শুধু ঠান্ডায় না, আবেগে।
তারপর সে নাচতে শুরু করে।
একদম মুক্তভাবে, কোনো ছকে বাঁধা না—নিজের মতো করে। দুহাত মেলে, ডান পা একটু ঘুরিয়ে, মাথা দুলিয়ে, সে যেন নিজেই এক রেনুতে ভরা ঘূর্ণির মতো ঘুরে ঘুরে নাচে। কাঁধের ব্যাগটা নাচতে নাচতে একটু পিছনে পড়ে যায়, কিন্তু তার কোনো হুঁশ নেই।
জুতো পেছন দিকে ছিটকে পড়ে, পা দুটো কাদায় মাখামাখি, চুলগুলো পানিতে ভিজে কপালে লেপ্টে গেছে, কিন্তু তার মুখে হাসি, চোখে জ্বলজ্বলে একধরনের আলো—
“আমি আজ খুব খুশি,” সে মনেই মনেই ফিসফিস করে।
আকাশ এখনো ভারী, বৃষ্টি পড়ছে একটানা। শহরের ভেজা রাস্তায় গাড়ির চাকা মাঝে মাঝে পানির ওপর দিয়ে ছুটে যায়, হালকা ছিটিয়ে দেয় পাশের ফুটপাথে।
রায়ান গাড়িতে বসে আছে আর মাহির চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। দুজনই একটু মনমরা। সারাদিন একটা অদৃশ্য অস্বস্তি বয়ে বেড়াচ্ছে গাড়ির ভিতরের পরিবেশে। সকালের—একটা কথোপকথন, একটা মন্তব্য, যেন এমন থমথমে করে তুলেছে পরিবেশটা।
গাড়িটা থেমে আছে রাস্তার পাশে,
রায়ান-” কিরে কি হলো বৃষ্টিতে গাড়ি থামিয়ে রেখেছিস কোনো সমস্যা?”
মাহির-“দেখতেছি তো। একটু ধৈর্য ধর। গাড়ির ইঞ্জিনে কিছু একটা হয়েছে।”
রায়ান বিরক্তি ভরা মুখে কপালে কুঁচকে বাইরে তাকায়।
আর ঠিক তখনই…
তার চোখ আটকে যায়। আর বাইরের দৃশ্য দেখে তার কপালে কুঁচকানো ভাব দূর হয়ে যায় আর মুখে ফুটে উঠে এক মৃদু হাসি যা লক্ষ্য করা কষ্টকর।
বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার ওপাশে একটা মেয়ে—পুরোপুরি ভিজে—নিজের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে নাচছে।
না, কোনো পারফরম্যান্স না। কোনো ক্যামেরার সামনে না। সে একদম নিজের মতো করে, নিজের জন্য নাচছে।
সে হাসছে, ঘুরছে, হাত ছুঁড়ে দিচ্ছে আকাশে। পা ছুঁয়ে দিচ্ছে ভিজে রাস্তায় কাদার মাঝে। তার চুল ভিজে গালে লেপ্টে গেছে, কাপড় বৃষ্টিতে সাদা হয়ে গা ঘেঁষে আছে, কিন্তু মুখের সেই তৃপ্তি—রায়ানের বুকের মধ্যে হালকা কাঁপুনি তুলে দেয়।
রায়ান গাড়ির উইন্ডো নামায়, যেন বৃষ্টির শব্দটা পরিষ্কার শোনা যায়।
মেয়ে তখন দুই হাত ছড়িয়ে পুরো শরীর দিয়ে নাচছে, ঘুরছে, বৃষ্টির নিচে চোখ বন্ধ করে এক অনির্বচনীয় মুক্তির মধ্যে ডুবে আছে। তার মুখে ছিল না কোনো ভয়, কোনো দ্বিধা, শুধু এক বিশুদ্ধ আনন্দ—যেটা কেবল তারা অনুভব করতে পারে যারা নিজের সঙ্গে সন্ধি করেছে।
রায়ানের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এই মুহূর্তটা কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়, কোনো সাজানো নাটক নয়—এটা বাস্তব, অথচ স্বপ্নের মতো।
রায়ান মিরায়ার দিকে একনজরে তাকিয়ে থেকে পরক করা শুরু করে –
গাড়ির জানালার কাঁচের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে রায়ান চেনে না। অথচ সেই অচেনা মেয়ে টা ভেতর আজ এক অচেনা মোহ জন্ম নিচ্ছে।
মেয়েটির মধ্যে এমন এক সৌন্দর্য আছে, যা চোখে পড়ার মতো নয়—চোখ আটকে রাখার মতো। একটা ভিজে, এলোমেলো পোর্ট্রেট যেন নিজেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সে সাজেনি, মেকআপ নেই, কিছুই নেই—কিন্তু তার প্রতিটি ভেজা রেখায়, প্রতিটি ভঙ্গিমায় আছে এক অনন্য দ্যুতি।
তার ত্বকটা ঠিক যেন দুধে-আলতা মেশানো—নরম, মোলায়েম আর ঝকঝকে। বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে, আর গালের লালাভ আভা সেই পানির রেখাকেও উজ্জ্বল করে তুলেছে। ডান গালে একটা ছোট টোল—মৃদু হাসির সময় পড়ে, কিন্তু রায়ান এখন এমনিতেই দেখতে পাচ্ছে সেটাকে, যেন তার চোখ ঠিক সেখানেই আটকে আছে।
চোখ—সেই চোখ দুটো বড়, গভীর আর তাতে অদ্ভুত এক মায়া। উষ্ণ ব্রাউন রঙের সেই চোখ জলের ছায়ায় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পাপড়িগুলো ঘন, ভিজে গাল ছুঁয়ে নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটা—রায়ানের মনে এক ধরণের কৌতূহলের জন্ম দেয়।
তার ঠোঁট—হালকা গোলাপি, একেবারে প্রাকৃতিক। মনে হয় যেন ভেজা পাঁপড়ির মতো, বৃষ্টির ফোঁটা এসে একটু পরশ দিলেই নড়ে ওঠে। ঠোঁটের নিচে ডান পাশে একটা তিল—অন্য কারো হলে হতো এক সাধারণ দাগ, কিন্তু তার মুখে সেটাই হয়ে উঠেছে ব্যক্তিত্বের সিলমোহর।
চুলগুলো কোমর ছোঁয়া, এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে তার ঘাড়, কাঁধ আর পিঠজুড়ে। ভেজা চুলগুলো গা ঘেঁষে নেমে আসছে, আর কখনো কপালে লেপ্টে থাকছে। হাওয়ার সঙ্গে হালকা দুলছে, আর সেই ভেজা চুলে আলো পড়ে এক ঝিকিমিকি সৃষ্টি করছে—রায়ান ঠিক বুঝতে পারছে না, বৃষ্টির আলোয় এমন করে কেউ কতটা স্বাভাবিক থেকে এতটা অন্যরকম হয়ে উঠতে পারে।
তার কাপড়—সাধারণ, কিন্তু বৃষ্টিতে পুরো ভিজে শরীরের গঠনের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট। সাদা ভেজা জামায় যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার আকৃতি, তার কোমরের শেপ তার। তবে সেখানে কোনো অশ্লীলতা নেই, বরং এক রকম সৌম্যতা, যা দেখেও চোখ নামানো যায় না, আবার তৃপ্তিও আসে না।
রায়হানের মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে ভিতরে একটা ঝড় উঠছে না শুধু রূপ দেখে তার ভেতর একটা জ্বলন্ত আনন্দ একটা গোপন আগুন জ্বলে উঠেছে।
সে বোঝে না, এই অনুভূতি প্রেম কিনা। তবে সে বোঝে, এই মেয়েটি সাধারণ নয়। তার আত্মবিশ্বাস, তার চোখে থাকা মায়া, আর এই বৃষ্টির ভেতরে নিজের জন্য নাচার সাহস—সব মিলিয়ে সে এমন এক আকর্ষণ তৈরি করছে, যা শুধু চোখ দিয়ে নয়, মনের গভীর স্তর থেকেও অনুভব করা যায়।
রায়ানের মুখে অদৃশ্য একটা হাসি ছিল তবে হঠাৎই তা মিলিয়ে গেল। রায়ান সঙ্গে সঙ্গে হকচকিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল- সে আসলে দেখছিল এই অপ্সরা কে কি সে ছাড়া অন্য কেউ দেখছে কি না!
তবে কারো উপস্থিতি না দেখে রায়ান যেন খুব স্বস্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুকের বাম পাশে হাত রেখে মনে মনে বলল-
-“এই মেয়ে কি পাগল! রাস্তায় দিনে দুপুরে মানুষ খুন করতে এই রূপ নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। উফ্! এমন করে কেউ হাসে! বুকে লাগছে আমার।”
আবার মিরায়ার দিকে এক শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো-
-” থেমে যাও প্রিয়সী! আমি যে মরে যাচ্ছি তুমি কি বুঝতে পারছ না? কে তুমি -‘raindrop’?”
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৫ (২)
হঠাৎ এই মিরাকে দেখার পথ বন্ধ করে একটি বড় ট্রাক রায়ানের চোখের সামনে চলে যায়। পরবর্তীতে ট্রাকটি চোখের সামনে থেকে সরে যাওয়ার পর রায়ান অপরদিকে খুঁজতে থাকে মিরায়াকে তবে সেখানে কেউ ছিল না।
রায়ানের মনে হতাশা ছড়িয়ে পরল মিরায়ার অনুপস্থিতিতে। কেন জানি তার বুকটা খালি খালি লাগছিল। মনে হচ্ছিল সে খুব করে তার মাত্র দেখা অপ্সরা কে আবার দেখতে চাইছে শুধু আজ বা কাল নয় অনন্ত কাল ধরে।