আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৭

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৭
অরাত্রিকা রহমান

গাড়ির জানালার কাঁচে একবার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় রায়ান। তীব্র বৃষ্টিতে সেই প্রতিচ্ছবিও যেন ধুয়ে মুছে যাচ্ছে—যেমনটা ভেতরের রায়ান এখন ধুয়ে যাচ্ছে এক অনামা আবেগে।
ঠিক তখনই দরজা খুলে গাড়িতে উঠে পড়ে মাহির।
মাহির চুল থেকে বৃষ্টি ঝেড়ে, গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে —
“বৃষ্টির কারণে ইঞ্জিনে পানি ঢুকে গেছিল। এখন গাড়ি চলবে।”
রায়ান তাকিয়ে থাকে গাড়ির জানালার ওপাশে, চোখ এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই অনাবৃত, অপার্থিব মেয়েটিকে। যেন তার অস্তিত্ব একবার ধরা দিয়েই আবার বাতাসে মিশে গেছে।
রায়ান হঠাৎ জিজ্ঞেস করে —

“তুই… সামনের ফুটপাথটা দেখছিস?”
মাহির অবাক হয়ে তার দিকেই চেয়ে বলে —
“দেখছি তো, কিন্তু তুই কি খুঁজছিস? কি হয়েছে”
রায়ান গলা একটু নিচু করে, ধীরে ধীরে প্রশ্ন করে—
“সামনে একটা মেয়ে ছিল। ভিজছিল। নাচছিল। তুই কিছু দেখলি না?”
মাহির একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে —
“তোর মাথায় ঠিক আছে তো? তোর বউ এখনো আইনত তোর। সেটাই সামলাতে পারছিস না, আবার অন্য মেয়েকে দেখছিস?”
রায়ান মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে এখন বউয়ের কথা শুনে রাগ করলো না। কিন্তু চুপ করে না থাকে। গলার স্বরটা কেমন যেন অচেনা রকম কোমল করে বলল—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি মেয়ে দেখছিলাম না মাহির? হয়তো ,আমি দেখছিলাম একটা অনুভব, একটা হাওয়া, এক ফোঁটা জল, একটা ছায়া,
যা বুকের ভেতর ঝড় তুলে দিয়ে চলে গেল—
আর রেখে গেল সেই ঝড়ের শব্দ।”
মাহির এবার একটু থমকে যায়। গাড়ির গতি বাড়ায়, কিন্তু মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি —
“তোর কবিতা লেখার স্বভাব তো ছিল না। এখন হঠাৎ এত ভাবুক কবে হইলি রে?”
রায়ান তাকায় না, শুধু জানালার বাইরে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তার চোখে তখনও সেই নাচের প্রতিচ্ছবি ভেসে চলেছে।

গাড়ি চলতে থাকে…
রায়ানকে অন্যমনস্ক দেখে মাহির প্রশ্ন করে-
“এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা? কিছু তো বলছিস না।”
রায়ান নিজের থেকে স্পষ্ট করে বলল-
“ডিভোর্স ফাইল করেছি আমেরিকায় থাকা কালীন। এখন পেপারস আনতে আমার লিগ্যাল এডভাইজারের কাছে যাচ্ছি আমরা। যদিও শুরুরটা আমার হাতে হয়নি তবে সম্পর্কের শেষ আমার হাতেই হবে।”

মাহির রায়ানের দৃঢ় চেতা মনোভাব দেখে অন্য কিছু বলার সাহস পেল না। সে চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকে ।
গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর পর রায়নার হাতে ডিভোর্সের পেপারস বুঝিয়ে দেওয়া হয় । সে ডিভোর্স ফাইল করে রেখেছিল আগেই তাই কাজটা আরো সহজ হয়ে গেছে। রায়ানের লিগ্যাল এডভাইজার এর পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রায়ানের হাতে ডিভোর্স ফাইলটা ধরিয়ে দেয়। এবং তাকে সকল কাগজপত্র চেক করে নিতে বলে।
কিন্তু রায়ানের ভেতর চলতে থাকে একটা ভিন্ন যাত্রা।
কাজের ফাইল খোলে রায়ান, কাগজে চোখ রাখে, কলম তোলে…
কিন্তু কলম যেন অচেনা কিছু লিখে ফেলতে চায়—
“ভিজে চুল, ঘূর্ণি নৃত্য, মায়াবী চোখ…”
নিজেই নিজেকে ধমক দেয় সে।

“ফোকাস কর রায়ান, তুই তো এসেছিস ডিভোর্স পেপারস নিতে। আর এখনি মনে আরেকটা মেয়ে ঘুরছে, ছ্যা।
এখানে এসেছিস তোর অতীতকে শেষ করতে,
তাহলে অন্য জীবন নিয়ে ভাবছিস কেন?”
রায়ান ডিভোর্স এর সব পেপারস চকে করে নেয় এবং ঠিক করে বাড়িতে গিয়েই মার হাতে পেপারস দিয়ে মিরায়ার থেকে সাইন করিয়ে আনতে বলবে। ঠিক যেমন ভাবে না বলে বিয়েটা হয়েছে।
নিজের ডেস্কে বসে একটা খোলা উইন্ডোর দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
আকাশ তখনও মেঘলা।
কিন্তু তার হৃদয়ের আকাশ যেন একদম ভিন্ন—
একটা চঞ্চল পাখি সেখানে উড়ছে,
যার পাখায় লেগে আছে কিছু জল, আর একটা মুখ—
একটা অপার্থিব মুখ, যে মুখ কোনো সাজে গড়া না,
তবু সমস্ত সাজকে হার মানিয়ে দিয়েছে।

-“তার হৃদপখি!”
রায়ান আনমনে বলে ওঠে-
“সে কে ছিল?
“তাকে দেখেছি আমি, যেন কবিতার প্রথম চরণ।
কিন্তু বাকিটা কে লিখবে?”

বৃষ্টিতে নাচার সময় মিরায়ার ফোন হঠাৎ বেজে ওঠে। মিরায়ার আস্তে দেরি হচ্ছিল বলে মিরায়ার ফোনে কল আসতে থাকে। তাই বৃষ্টিতে ভেজা শেষ করে মিরা হাঁটতে থাকে বাসার দিকে। বুকটা তখনও ভরে আছে একরাশ আনন্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া— এ এক স্বপ্নের মতই। মাথার ওপর মেঘ, পায়ের নিচে কাদা, তবু তার মনে সেই অনুভূতি— যেন সে মাটিতে হাঁটছে না, ভাসছে।
বাসায় পৌঁছেই দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক দেয় —
“মামণি! আমি এসে গেছি…!”

ওর কণ্ঠে এমন এক উচ্ছ্বাস, যেন শব্দগুলোও নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে।
ভেতর থেকে দ্রুত পায়ের শব্দ আসে। দরজা খুলে যায়। রামিলা চৌধুরী তাকিয়ে দেখেন ভেজা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে সেই চিরপরিচিত দুষ্টু হাসি।
রামিলা চৌধুরী একটু গম্ভীর গলায় বলে—
“একি মিরা! এভাবে ভিজে এলি কেন! ঠান্ডা লেগে যাবে তো!”
মিরায়া ঘাড় কাত করে বলে—
“আরে মামণি, জানো! আমি চান্স পেয়ে গেছি! ৪৫ তম! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! আইন বিভাগ! Wohhohh!”
রামিলা চৌধুরী বিস্ময় আর আনন্দে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
“আলহামদুলিল্লাহ!”
“তুই তো পারবিই! চল, আগে ফ্রেশ হ, তারপর খেয়ে নিস, গায়ে তো কাঁপুনি দিচ্ছে!”
মিরা ঝটপট মাথা নাড়ে—
“ওকে।”

মিরায়া ঘরে ঢুকতেই ছোট্ট একটা ছায়া দৌড়ে এসে ওর পায়ে লেপটে যায়।
“আহারে জুলিয়েট তুই তো তোর মতোই! আমি তো ভিজে-ভিজে এসেছি, তাও তুই আদর করতে এসেছিস?”
মিরায়া জুলিয়েটকে কোলে তুলে নেয়।
একটা নরম সাদা বিড়াল, গা ছুঁয়ে থাকা লোম যেন তুলো দিয়ে গড়া। গলায় ছোট একটা ঘণ্টা, হালকা টিং টিং শব্দ হয় যখন নড়ে।
“জুলিয়েট তুই জানিস? আজ তোর মা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পায়েছে! ঢাকা ইউনিভার্সিটি! হাহা! এখন থেকে আর কেউ আমায় পাত্তা না দিলে বলবো, ‘আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী!’”
জুলিয়েট কেমন যেন বুঝতে পেরে চোখ টিপে দেয়।
মিরা হেসে বিড়ালের কপালে একটা চুমু দেয়—

“তুই অনেক কিউট। আমার কুট্টুস টা, আমার বাচ্চা টা, আমার মাম্মা, উম্মাহ!”
জুলিয়েটকে আদর করে মিরায়া ওকে নিচে নামিয়ে দেয় পরক্ষণেই সোরায়া রুমে প্রবেশ করে-
“আপু! একা একা ভিজে এলে আমাকে নিলে কি এমন হতো?
সোরায়া মুখটা সামান্য ভার করে কথা টা বলতেই-
মিরায়া সামান্য হেসে সোরায়ার হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে বলল-
“সোরা বনুরে? শুন শুন! আমি চান্স পেয়ে গেছি ! ঢাকা ইউনিভার্সিটি!”
সোরায়া খুশিতে চিৎকার—
“সত্যি!? ঢাবি!? Wow! এখন নতুন কলেজে ভর্তি হলে আমি সবাইকে বলতে পারব আমার আপু ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।”

“হাহা, আমি তো বলছিলাম! তোর আপু গরিব হতে পারে, স্টাইল কম হতে পারে, কিন্তু ব্রেনের আছে।”
“আমি তো বলি, “বাইক রাইড করতে করতে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স!” খবর ছাপানোর মত শিরোনাম।”
“তোর মুখে ঝাল লাগুক। আমি কত কষ্ট করেছি তুই জানিস?”
সোরায়া দুষ্টু হাসি হেসে মিরার কাছে আসতে গেলে-
“আরে আরে কি করিস! আমার সম্পূর্ণ শরীর ভেজা এখন তুইও ভিজে যাবি। সর এখন, ফ্রেশ হয়ে এসে আদর করব।”
সোরায়াকে কথাটা বলেই মিরায়া ফ্রেশ হতে চলে যায়।
শাওয়ারে পানি পড়ে, কাঁধ থেকে বেয়ে নামতে নামতে তার মনের ক্লান্তিও যেন ভেসে যায়। মাথার চুলগুলো ধুয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করে —
এই ক্যাম্পাস, এই শহর, এই নতুন শুরু।
“নতুন জীবন শুরু হলো বুঝি… আজকের মতো দিন তো আর সব সময় আসে না।”
ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। চুল খোঁপা করে বাঁধে। একটুও সাজে না, তবুও নিজের মুখটা দেখে হালকা হাসে।

“ভেতর থেকে হাসলেই মুখটা সুন্দর লাগে”— বলে আয়নাকে।
তারপর মিরায়া নিচে নেমে যায় খাওয়ার জন্য। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সে একটা লম্বা ঘুম দেয়। বৃষ্টিতে ভেজার কারণে আজকে খুব শান্তির ঘুম এসেছে তার চোখে। তবে মাথাটা ভার হয়ে আছে।
(এদিকে দূরে কোথাও রায়ান তখনো জানে না, এই মেয়েটিই তার ভাগ্যকে উল্টে দিতে চলেছে…যার জন্য তার খাওয়া দাওয়া হারাম হওয়ার পথে)

ঢাকার অদূরে,একটা বিশাল খোলা জায়গা। নতুন নির্মাণাধীন ভবনের জন্য নির্ধারিত জমি। এখানে হতে যাচ্ছে “Rayan Industry’s” – রায়ানের আমেরিকান কোম্পানির বাংলাদেশ শাখার অফিস হেডকোয়ার্টার।
চওড়া গেট, আধা-পাকা রাস্তা, পাশে বাঁশে ঘেরা পাইলিং এরিয়া আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু হেলমেট-পরা শ্রমিক। মাটি কাটার মেশিনগুলো চলছে গম্ভীর গর্জনে।
রায়ান সাদা শার্টের ওপর কালো কোট পরে, সানগ্লাসে ঢাকা চোখে, পাশে মাহির আর দুইজন লোকাল ইঞ্জিনিয়ার।
একজন ডিলার দেখায়—
“স্যার, এই জায়গাটা মূল ভবনের জন্য বরাদ্দ। পেছনে পার্কিং আর ডান পাশে অফিস ব্লক প্ল্যান।”
রায়ান মাথা নেড়ে বলে—
“Okay. Soil testing এর রিপোর্ট কালকে দিবে তো?”
“জি স্যার। কাল সকাল দশটায়।”
কথা হচ্ছে, হাত নেড়ে প্ল্যান বোঝাচ্ছে সবাই… কিন্তু এই সময়টা রায়ানের জন্য যেন একটা অদ্ভুত ঘোলাটে স্তরে কেটে যাচ্ছে।

সে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে সানগ্লাস, মুখে স্থিরতা— কিন্তু ভেতরটা? ওখানে তখনই ঝড় চলছে।
মনে পড়ে — সেই দৃশ্য…
বৃষ্টির মধ্যে সাদা জামা পরা মেয়েটি, চোখ বন্ধ করে ঘুরছে, হাসছে, নাচছে… নিজের জন্য, কারো সামনে নয়।
সেই হাসি—যা ঠোঁট দিয়ে নয়, চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে।
সেই ভেজা চুল, কপালের টোল, সেই উষ্ণ চোখের গভীরতা— রায়ানের বুকের মধ্যে যেন হালকা কাঁপুনি দিয়ে ওঠে।
কাজের কথা শোনা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মাথার ভেতরে চলছে অন্য মুভি—
“এই মেয়ে কি পাগল ছিল?”
“কে নাচে এইভাবে রাস্তায়?”
“তবুও… এত সুন্দর লাগছিল কেন?”
“তাকে কেন মনে পড়ছে এতবার?”
“আমি কি সত্যি প্রেমে পরে গেছি?”

মাহির পাশ থেকে বলে ওঠে—
“ভাই, তুই শুনছিস তো? এই ডিলার বলছে ওরা ৩ দিনের মধ্যে সাইট ক্লিয়ার করবে।”
রায়ান কেঁপে ওঠে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।
“হুম? হ্যাঁ… হ্যাঁ শুনছি।”
তারপর আবার গম্ভীর মুখে ডিলারের দিকে তাকায়,
“ঠিক আছে, আমি কাল পুরো প্ল্যান একবার দেখে সিদ্ধান্ত নেবো।”
ডিলাররা মাথা নেড়ে চলে যায় অন্যপাশে।
মাহির তার পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ দেখে, তারপর হেসে বলে—
“তুই আবার কোথায় হারালি বল তো? সেই রাস্তার মেয়েটা ভাবনায় ঢুকছে বুঝি? তাহলে কি আমার পুরনো ভাবিকে জীবন থেকে তারিয়ে নতুন ভাবি আনতে চাইছিস?”
রায়ান গলা খাঁকারি দেয়, কিন্তু কিছু বলে না। আবার কি ভেবে যেন এক ফাঁকে বলেই ফেলে—
“কোথাও হারাইনি… কেবল ভাবছিলাম, কত অদ্ভুতভাবে কেউ কারো ভেতরে ঢুকে পড়ে… বিনা অনুমতিতে। এমন ভাবি দিতে পারলে মন্দ হতো না।”

মাহির হাসে, কিন্তু এবার আর ঠাট্টা করে –
-“ইস্! তাহলে তো বলতে হবে মেয়েটা বেশ সুন্দর। আমি দেখতে পারলাম না । বড়ো একটা মিস হয়ে গেল।”
রায়ান মাহিরের কথায় চোখ কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে-
“মুখ সামলে কথা বল। যা আমার তা আমারি তোকে জিজ্ঞেস করেছি নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে তুই আমার হৃদপাখিকে দেখিসনি।”
মাহির চোখ বড়ো করে-
“আমার হৃদপাখি!”
রায়ান – “তোর না গাধা আমার হৃদপাখি, শুধু আমার। আচ্ছা চল আবার ওই রাস্তা দিয়ে যাবো যদি আমার হৃদপাখিকে আর একটা বার দেখতে পাই।”
মাহির – “দেখতে পেলে কি করবি?”
রায়ান-” আমার কাছে রেখে দিব যত্ন করে।”
মাহির -“যদি না থাকে , যদি উড়ে যেতে চায়?”
রায়ান কুটিল হেঁসে উত্তর দেয় –
“জোর করে আমার হৃদয়ের খাঁচায় বন্দিনী বানিয়ে রাখবো। তবুও ওকে আমার হতে হবে। ওর ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক।”

সামনে বিশাল ফাঁকা জমি,
পেছনে সবার হাঁটাচলা, অথচ রায়ানের চোখ যেন খুঁজে ফেরে….
“হৃদয়ের আকাশে মুক্তভাবে উড়তে থাকা তার হৃদপাখির খেয়ালে।”
সে একবার আকাশের দিকে তাকায় —
“বৃষ্টি হলে কি ও আবার নাচবে? আমার হৃদপাখি আর একটা বার কি আমাকে দেখা দেবে?”

সময় – রাত ৯:৫০
বৃষ্টি থেমেছে। চৌধুরী বাড়ির বারান্দা থেকে টিপটিপ জল ঝরছে।
রায়ান দীর্ঘ দশ বছর পর আজ চৌধুরী বাড়ির দরজায়।রায়ান ঢুকল দোরগোড়া পেরিয়ে। তার চোখে নতুন জায়গার প্রতি কোনো বিস্ময় নেই—এটা তার পরিচিত ঠাঁই, তবু অচেনা হয়ে গেছে সময়ের সাথে।
সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন—রামিলা চৌধুরী।
তার মা। মাকে এত বছর পর সামনাসামনি দেখেই রায়ানের বুক কেঁপে উঠল। চোখে গাঢ় ফ্রেমের চশমা, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, মুখে সেই কঠোর অভিজাত ভাব
রায়ান কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে বলে ওঠে:
“আম্মু…”

রামিলা চোখ তোলে রায়হানকে নিঃশব্দে জড়িয়ে ধরে বললেন-
“এসেছিস? দশ বছর অনেক লম্বা সময়, রায়ান । কিভাবে পারলি মাকে কষ্ট দিতে?”
রায়ান মাথা নিচু করে বসে পড়ে সামনে।
কোনো প্রতিক্রিয়া না দিয়ে বলে:
“তোমার শরীর ভালো তো, আম্মু?”
রামিলা ঠান্ডা গলায়:
“শরীর ঠিকই আছে। মনটাই পুরনো হয়ে গেছে বোধহয়।”
একটা দীর্ঘ নীরবতা…দুজনের মাঝে আবেগ ।
রায়ান জানে, এই সম্পর্ক আর আগের মতো নয়।
মা, হয়তো তার অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু আজ মুখে হাসি নেই।
রামিলা চৌধুরী- “ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। খাবার দিচ্ছি। তুই আসবি বলে আজ সব তোর পছন্দের রান্না করেছি।”
রায়ান মিষ্টি হেঁসে বলল- “আচ্ছা, আমি এখুনি আসছি।”

ডাইনিং টেবিল – পরবর্তী দৃশ্য
রায়ান বসে খাচ্ছে। ঘরের পরিবেশ তবু ভারী।
রায়ান পকেট থেকে সেই নীল খাম বের করে রাখে টেবিলে।
রামিলা চৌধুরী বিস্মিত মুখে জিজ্ঞেস করেন-
“এটা কি রায়ান?”
রায়ান স্বাভাবিক স্বরে বলল
“এইটা ডিভোর্স পেপার, মা। আমি আমার কথা কথিত বউকে মুক্তি দিতে চাই আর নিজেও এই বাঁধন থেকে ছাড়া পেতে চাই। তুমি চট্টগ্রাম এ গিয়ে সাইন করিয়ে নিও। আমি আর এই সম্পর্ক রাখতে চাই না।”
রামিলা খামটা খুলে দেখে, এক মুহূর্তে চুপচাপ। তারপর উঠে দাঁড়ায়।
“সাইন আমি কাল সকালেই নিয়ে দেব। সে এই বাড়িতেই আছে, upstairs.”
রায়ান হঠাৎ থেমে যায়।
চোখ সরু হয়ে আসে।

“সে এই বাড়িতে?”
“মানে… ও এখানে আছে এখন?”
রামিলা কাঁচা গলায় উত্তর দেয়:
“হ্যাঁ, কেন? এতদিন যে ছিল না, এখন এলেই সব মুছে যাবে—তুই এমন ভাবিস না। সে তোর বউ। কাগজে কলমে। আমিই দায়িত্ব নিয়ে রেখেছি তাকে এই বাড়িতে।
কাল সকালে ওকে ডেকে সাইন করিয়ে দেবো। তুই এসে নিয়ে যাস। ও এই বাড়ির মেয়ে হয়ে এই বাড়িতে থাকবে।”
রায়ান দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখে রাগ।
“তুমি আমাকে না জানিয়ে কেন… কেন এখানে রাখলে তাকে?”
রামিলা গম্ভীর গলায়:
“কারণ ও আমাদের দায়িত্ব। তোমার পালিয়ে যাওয়াতে আমরা তা অস্বীকার করতে পারি না।”
রায়ানের কণ্ঠ ফাটে:

” ঐ অনাথ মেয়ের জন্য তোমার ছেলে দশ বছর অনাথের মতো দেশের বাইরে একা ছিল আম্মু। আমি আর নিতে পারছি না । এই সম্পর্কটা শেষ করতে এসেছি। আর সহ্য হচ্ছে না। আর এই বাড়িতে ওই মেয়ে থাকলে আমি থাকবো না। কালই চলে যাবো।”
পিছন থেকে রায়হান চৌধুরী হঠাৎ বলে উঠলেন-
“রামিলা ওকে বলো চলে যেতে এত বছরে ওর এই বাড়িতে না থাকায় কারো কোনো সমস্যা হয়নি এখনো হবে না।”
নিজের বাবার মুখে এমন কথা শুনে রায়ান পিছনে তাকিয়ে ডেকে উঠলো-
“আব্বু…।”
রায়হান চৌধুরী ছেলের সাথে অন্য কোন প্রকার কুশল বিনিময় না করেই পিছন ফিরে নিজের রুমে চলে গেলেন।
রামিলা হেসে ফেলে একরকম:

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৬

“ভালোই তো… অবশেষে তুই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস।
আমি তোর সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করব না। শুধু মনে রাখিস, যে মেয়েটা তোর বিয়ে করা বউ,আর তার একান্ত ভাবে কেবল তুই আছিস। যেটা না সে জানে আর না জানার উপায় রাখছিস তুই।”
রায়ান আর কিছু বলে না। শুধু নিঃশব্দে উঠে চলে যায় নিজের রুমে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৭ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here