আত্মার অন্তরালে পর্ব ১১
প্রীতি আক্তার পিহু
আনায়া সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল।এক মুহূর্তে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া নিশংস ঘটনা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি ভিডিও আনায়ার ফোনে আসলো। আনায়ার কাছে সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে তাও সে কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে ভিডিওটা অন করে। মুহূর্তেই তার পুরো দুনিয়া উল্টে গেল।ক্যামেরার ফ্রেমে ইউভান আর তানহার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত চলছে। তানহার হাত ইউভানের চুলে জড়িয়ে আছে। ইউভানের ঠোঁট তানহার ঘাড়ে লেগে আছে… দুজনের শরীর একে অপরের এত কাছে যে নিঃশ্বাসের দূরত্বও নেই।
আনায়ার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল।পড়ল কিন্তু সে তুলল না।তার তো কাঁদার কথা তাই না? কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো তার চোখ থেকে একফোঁটা পানিও পড়ছে না। চোখের সামনে সেই দৃশ্য ঝকঝকে পরিষ্কার।কলিজাটা ধক করে উঠল, তারপর যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে একদম খালি হয়ে গেল।আনায়ার সমস্ত শরীর অসার হয়ে গেল। সে না সামনের এগোতে পারে আর না পিছনে হটতে পারে কেবল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
রাত গভীর। বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো ঘরটাকে অস্থিরভাবে আলোকিত করে তুলছে। পিহু বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে অনেকক্ষণ হলো ঘরজুড়ে শুধুই অন্ধকার আর বাইরে থেকে ভেসে আসা বৃষ্টির শব্দ। পুরো ফ্লাটে। তখনই দরজায় টোকা পড়ে।
“টক… টক… টক…”
পিহুর বুক ধক করে ওঠে। এই রাতের বেলা কে আসতে পারে? সে কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল পিহু, কিন্তু কোনো সাড়া দেয় না। কয়েক মুহূর্ত পর আবার শব্দ আসে। এবার একটু জোরে।
“দয়া করে… একটু পানি দেবেন?” দরজার ওপাশ থেকে পুরুষলী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
পিহু দ্বিধায় পড়ে যায়। অন্ধকারে একজন অপরিচিত পুরুষের কণ্ঠস্বর। তার মনে অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধে, কিন্তু সে দরজার ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছ। বৃষ্টিতে ভিজেছে সে।পিহু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আপনি কে?”
দরজার ওপাশ থেকে বেঁচেছি তখন বলে ওঠে,
“আমি এই ঝড়ের মধ্যে পথ হারিয়েছি। একটু পানি দেবেন? খুব তেষ্টা পেয়েছে।”
পিহু একটু দ্বিধা করেও দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়। দরজা খোলার সাথে সাথেই লোকটির পানে তাকায় পিহু। লোকটাকে দেখতে বড্ড অদ্ভুত লাগছে গায়ের রং দেখে মনে হচ্ছে ব্যক্তিটি বাইরের কোন দেশের।তবুও পিহু মনে সাহস নিয়ে বলে ওঠে,
“আপনি বসুন আমি পানি নিয়ে আসছি।”
লোকটি নিঃশব্দে ভিতরে প্রবেশ করে, যেন সে এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল।পিহু আর কোন কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।এমনিতেই তার মনের ভিতর খচখচ করছে।তখনই সোফায় বসা লোকটি সদর দরজার দিকে তাকায়।মুহূর্তে সদর দরজা থেকে চার পাঁচ জন মুখশধারী লোক ভিতরে প্রবেশ করে।পিহু থমকে যায়। তার বুকের ভেতর কেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠে।সে অনুভব করে কারোর উপস্থিতি। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন দরজা বন্ধ করে দেয় ঠাস করে।পিহু চোখ ছিটকে যায়। ৪-৫ জন অচেন লোকদের দেখে পিহুর কলিজার পানি শুকিয়ে এলো। সোফায় বসে থাকা মধ্যবয়স্ক লোকটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে পিহুর দিকে এগিয়ে আসে।পিহুর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিচে পড়ে যায়। তৎখানে পিহু রুদ্ধ কন্ঠে আওড়ায়,
“আ আপনারা কে?”
মুখোশধারী লোকগুলো কোন কথার উত্তর দেয় না।পিহু বুঝতে পারছে তার আশপাশে কোনো নিরাপত্তা নেই।সে আতঙ্কে একবার দেয়ালের সঙ্গে মিশে যায়। লোকগুলো তার দিকে লালচে, কামুক, জঘন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন পিহুকে গিলে খেতে চায়, টুকরো টুকরো করে ফেলতে চায়।পিহু পুনরায় বলে উঠে,
“দেখুন বেরিয়ে যান ভালো হবে না কিন্তু আমি পুলিশ ডাকবো।”
তখনই লোকগুলো উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলে,
“ভয় পেও না মিষ্টি মেয়ে আমরা তোমাকে কষ্ট দিতে আসিনি বরং আদর করতে এসেছি।”
পিহু থরথর করে কাঁপতে থাকে।তার লজ্জা ঘৃণায় কান গরম হয়ে আসছে।লোকগুলো থেমে নেই তার দিকে এগিয়ে আসছে। পিহু আর কোথায় সরবে? সে তো একেবারে দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে।পিহু নিজের বিপদ খুব ভালোমতোই বুঝতে পারছে। তার মাথার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চালন হতে শুরু করে আশেপাশে তাকিয়ে ভারী কিছু খুঁজতে থাকে আত্মরক্ষার জন্য।তখন-ই চোখ পড়ে ধারালো ছুরির উপর মুহূর্তেই অপেক্ষা না করে ছুরিটি হাতে তুলে লোকগুলো সামনে ধরে।
“আর এক পা সামনে এগুলা জানে মেরে ফেলবো।আমাকে দুর্বল ভাববেন না পিছনে সরুন বলছি আমাকে যেতে দিন।”পিহুর গলার কন্ঠ কাঁপছে।
লোকগুলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।পিহু এবার এক পা এক পা করে এগোয় লোক গুলো পিছায়।পিহু সুযোগ বুঝে সামনের দিকে জোরে দৌড় মারে পালানোর জন্য কিন্তু সফল হয় না। পেছন থেকে একজন হঠাৎ তার ওড়নায় টান দেয়।
ওড়নাটা ছিঁড়ে মেঝেতে পড়ে যাই।পিহু দুই হাত বুকে চলে আসে। তার হৃদস্পন্দন যেন থেমে যায় এক মুহূর্তে।লোকগুলো তার হাত হেচকা টান দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়।পিহু ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে।পিহু বুঝতে পারছে এখন তার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে তাই সে হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“না। না প্লিজ প্লিজ আমাকে কিছু করবেন না।দয়া করে আমাকে যেতে দিন।”
পিহুর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। কিন্তু তাতে কারও করুণা নেই।লোকগুলো ঘিরে ধরে তাকে।
একজন তার মুখের সামনে এসে বলে,
“চুপ করে থাকলে কিছু হবে না বেশি চেঁচালে খারাপ হবে।আমরা বেশি কষ্ট দিয়ে মারব না তোকে।”
পিহু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টি চকচকে হয়ে যায়, কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না। গলা থেকে কোনো শব্দ বের হতে চায় না। লোকগুলো হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে পিহুর শরীরে হাত রাখে মুহূর্তে বিদ্যুতের মতো ঝাটকা দিয়ে ওঠে পিহুর দেহ।আর যাই হোক নিজের সর্বস্ব জানোয়ারদের কাছে সে সপে দেবে না। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে লোকগুলোকে ঢাক্কা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে উল্টো পথে দৌড় মারে। রান্নাঘর পেরিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটে যায় পায়ে ঠকঠক শব্দ তুলে।তখনই এক ব্যক্তি আওয়াজ তুলে,
“ধর ওই মালটাকে।”
সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যে একজন পিহুর জামার আঁচল টান দেয়।কিন্তু পিহু জোরে ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।তার কাঁধে আঁচড় লাগে, জামার একপাশ ছিঁড়ে যায়।তবুও সে থামে না কারণ একজন মেয়ের কাছে তার সম্মান অনেক বড়।নিজের ঘরের দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে জোরে ঠাস করে বন্ধ করে দেয়।বাইরে থেকে লোকগুলো দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা মারছে।পিহু ঘরের এক কোণে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ে।তার নিঃশ্বাস ছোট হয়ে আসে।পিহু ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“দয়া করে আপনারা চলে যান। আমি আপনাদেরকে চিনি না আর না আপনাদের কোন ক্ষতি করেছি।”
তখনই পেছন থেকে বিকট আওয়াজ হয়।পিহু কেঁপে ওঠে।দরজার ওপাশ থেকে ভয়ংকর কণ্ঠ ভেসে আসে,
“দরজা খোল না হলে দরজা ভেঙে ফেলবো আমরা। আজকে তোকে আমাদের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
বলেই দরজা জোরে জোরে ভাঙতে থাকে।পিহু হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিছু পা হয়।আশেপাশে তাকিয়ে ফোন খুঁজতে থাকে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ফোনটাও বাইরে রয়ে গিয়েছে।কিন্তু ফোন পেলেই বা কি? কে আছে তার?কাকে কল দিবে?পিহুর আজ বড্ড কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে এজন্য যে সে এতিম।আজ হয়তো তার পরিবারের কেউ থাকলে এ বিপদের সম্মুখীন হতে হতো না তাকে। পিহুর এসব চিন্তা ভাবনার মাঝে দরজা ভেঙে মুখোশধারী লোকগুলো প্রবেশ করল। মুহূর্তেই পিহু ভয় ও আতঙ্কে ফ্রিজ হয়ে গেল, তার শিরা-উপশিরায় এক অজানা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। তখনই লোকগুলো ভয়ংকর কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এখন কোথায় পালাবে মামনি? আমাদের হাত থেকে আজ পর্যন্ত কোন মেয়ে রেহাই পায়নি সেখানে তুমি তো একা।”
বলেই কামুক দৃষ্টিতে তাকাই পিহুর পানে।মুহূর্তেই পিহুর শরীর কাঁপতে শুরু করে।পিহু সরতে সরতে একেবারে খাটের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। না সামনে না পিছনে কোন দিকে এখন সে এগোতে পারবে না।পিহু ভয়ে জড়িত কন্ঠে বলে উঠে,
“দেখুন আপনারা কি চান বলুন আমি সব দিব। শুধুমাত্র আমাকে ছেড়ে দিন। আমি তো আপনাদের কোন ক্ষতি করিনি বলুন? আবার সর্বনাশ করে আপনাদের কি লাভ?দয়া করে ছেড়ে দিন আমাকে।”
পিহুর আকুতি লোকগুলো কান অব্দি পৌঁছায় না। তারা পিহুর বাহু টেনে বিছানায় ছুড়ে ফেলে।পিহুর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এলো।তবুও মনের জোরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই এক লোক এসে তার দুই হাত দুই দিকে চেপে ধরে ঝুকলো কিছুটা।পিহু হাত পা ছোটাছুটি করতে থাকে তার চিৎকার এখন গলা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে।সে ব্যথায় কষ্টে আর্তনাদ করে উঠে বলে,
“আমার এত বড় ক্ষতি করবেন না দয়া করে আমার কেউ নাই। আমি এ পৃথিবীতে একা দয়া করে আমাকে মারবেন না।”
লোকটি লাঞ্ছনা দৃষ্টিতে পিহু শরীরের দিকে একবার নজর দিয়ে ঘৃণ্য বুলি আওড়ালো,
“তুই যেহেতু পৃথিবীতে একা তাই তোর বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়াতে কারও কোন কিছু যায় আসে না।তোর জন্য কাঁদার মত কেউ নাই তাহলে বেঁচে থেকে লাভ কি তোর? মরার আগে না হয় আমাদেরকে একটু সুখ দিয়ে মরলি।”
পিহু স্তব্ধ হয়ে যায় অনুভব করে পুনরায় যে তার বেঁচে থাকা পৃথিবীতে মূল্যহীন।লোকগুলো পিহুর বেঁচে থাকা নিয়ে উপহাস করে। এই একটা কথা পিহুর হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে চোখের কোন দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।তার জীবনতো একেবারে তুচ্ছ? সে এককি নিঃস্ব তার মরা বাঁচাতে পৃথিবীতে কারোর কিছু এসে যায় না। পিহুর বড্ড হাসি পায় তার নিজের জীবনের উপর। তার মনে যে আশার আলো টুকু ছিল সেটাও নিভে যায়।লোকগুলো তার শরীরের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে।সে মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে নিজের শেষ মুহূর্ত গুনতে থাকে।
তৎক্ষণ পিহু তার শরীরের উপর তরল কিছু অনুভব করে। প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে সে চোখ মেলে তাকায়।আর যা দেখে তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। রক্তাক্ত লোকটি তার শরীরে ঢলে পড়ল। পিহু হকচকিয়ে ওঠে ঢাক্কা মেরে লোকটিকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি বুঝে ওঠার জন্য সামনের দিকে তাকায় মুহূর্তে চোখ আটকায় একমুতো বয়স্ক মহিলার পানে।উসকো চুল মহিলাটির কয়েকটা চুল সাদা হয়ে গিয়েছে।চোখের নিচটাই কালচাটে কিন্তু চোখগুলো ভয় পাও রক্তের মত লাগে। নোংরা কাপড় পরা দেখে মনে হচ্ছে বহু বছর এক কাপড় পড়েই আছে।তখনই পিহুর দৃষ্টি আটকায় মহিলাটির হাতে থাকা রক্তাক্ত চাপটির উপর। পিহুর চোখ বড় বড় হয়েছে সে বুঝতে পারে এই লোকটিকে মহিলাটি মেরেছে।লোকগুলো মহিলাটির দিকে তেড়ে এসে বলে,
“এই বুড়ি আমাদের কাছে বাধা দেওয়ার সাহস কি করে হলো তোর? জানের ভয় নেই?”
মহিলাটি কোন কথার উত্তর দিল না সবাইকে অবাক করে রুদ্রমূর্তি রূপ ধারণ করল সে।একের পর এক আঘাত করতে থাকে লোকগুলোর উপর যেন তার প্রাণের কোন ভয় নেই। পিহু এসব দেখে আরো ভয় পেয়ে যায় বুঝতে পারে না কি করবে। তখনই মহিলাটি তার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“পালাও মা পালাও না হলে জানোয়ারা তোমাকে ছিঁড়ে খাবে।”
পিহু এক মুহূর্তে থেমে গেল। তার মন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, সে কী করবে। কিন্তু মহিলার কথা শুনে সে পালাতে চাইল না।মুখোশধারী লোকগুলো দ্রুত মহিলাটির হাত ধরে ফেলে।পিহু ঘাবড়ে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনারা দয়া করে তাকে ছেড়ে দিন সে আপনাদের মায়ের বয়সী।যা করার আমার সাথে করুন কিন্তু তাকে আঘাত করবেন না।”
লোকগুলো উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। পিহু কথার এখানে কোন দাম নাই। যে করেই হোক তাকে কিছু করতে হবে। কিন্তু কি করবে সে? মহিলাটি পিহুর দিকে তাকিয়ে গর্জন দিয়ে বলল,
“মা, এই জানোয়ারদের মারতে হবে হাতে অস্ত্র তুলে নাও আর শেষ করে তবে জানোয়ারদের। ”
পিহু সজাগ হয়ে ওঠে তার মন একবারে পরিষ্কার হয়ে যায়।এই মুহূর্তেই তার বাঁচার একমাত্র সুযোগ। সে দ্রুত রুমের দরজা দিকে পা বাড়ায় কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে লোকগুলো তার হাত আঁকড়ে ধরে। পিহুর ভেতরে আগুন জ্বলে ওঠে। সে আর দুর্বল হয় না, বরং মাথা ঠাণ্ডা রেখে পাশের ফুলদানিটা তুলে নিয়ে দ্রুত লোকটির মাথার দিকে আঘাত করে। ফুলদানির শক্ত অংশ মাথায় গিয়ে লাগতেই লোকটির মুখমণ্ডল থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। পিহুর চোখে মুহূর্তেই এক তীব্র প্রতিশোধের অগ্নিকুণ্ড যেন জ্বলতে শুরু করে। লোকটি ঝুঁকে পড়ে, তার শক্তি ক্ষয়ে যায়, আর পিহু আবার পা বাড়ানোর চেষ্টা করে।কিন্তু পুনরায় লোকগুলো মহিলাটিকে ছেড়ে তার হাত ধরে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, পিহু এক ঝাঁকুনি দিয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
মহিলাটি ছাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে এসে রান্নাঘরের দিকে আসে।কোন কিছু না ভেবেই গ্যাসের লাইন খুলে দেয়।লোকগুলো সেটি খেয়াল করে না তাদের পুরো মনোযোগ এখন পিহুর উপর।
“অনেক জ্বালিয়েছিস তুই আমাদের। আজ তোকে এমন মৃত্যু দিব তোর আত্মা অবধি কেঁদে উঠবে।”
পিহুর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে।লোকগুলো হাতে বন্দুক তুলে তার দিকে তাক করে। পিহু শুকনো ঢুক গিলে এই মনে হয় তার জীবনের অন্তিম সময়।লোকটি বন্দুকটা তার মাথা বরাবর ঠেকায়। পিহু চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় সঙ্গে সঙ্গে।
হঠাৎ, পুরো ঘরটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের আওয়াজে কেঁপে ওঠে। গরম বাতাসের শিখা ঘরটা তলিয়ে নিয়ে যায়, আর বাইরে পুলিশ সাইরেনের আওয়াজ শোনা যায়।লোকগুলো এক মুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে যায়।পিহুর মুখশ্রী আগুনে তীব্র শিখায় ঝলসে যায়। চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।লোকগুলো কিছুক্ষণের জন্য পিহুর কথা ভুলে যাই জানালা দিয়ে বাইরে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু বাইরে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।পুলিশরা অনেক আগে থেকেই তাদের খুঁজছে।সদর দরজার দিকে যাওয়া যাবে না সেদিকে আগুন লোকগুলো কোন উপায় না পেয়ে জানালা দিয়ে লাফ মারে। অপরদিকে পিহু আগুনের ধোঁয়ায় জোরে জোরে কাশতে শুরু করে চারদিকে তাকিয়ে মহিলাটিকে খুঁজে কিন্তু পায় না।
আগুন চারদিক থেকে গ্রাস করে নিচ্ছে ঘরটাকে। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে পিহুর চোখে-মুখে।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। শরীরের শক্তি যেন কোথাও হারিয়ে ফেলেছিল পিহু। আগুনের উত্তাপে তার হাতের চামড়া জ্বলে গিয়েছে কয়েক জায়গায়। ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে, চোখের পাতা ভার হয়ে আসছে। সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তখনই অন্ধকার আর ধোঁয়ার মাঝে এক লম্বা ছায়া দেখা দিল। সেই ছায়াটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। পিহু চাইলেও নাড়াতে পারছে না। সেই ছায়াটি তার একদম সামনে এসে দাঁড়ায়। পিহু ধোয়ার কারণে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না লোকটির মুখ। তখন হঠাৎ একটা শক্তপোক্ত হাত তাকে বুকের মধ্যে চেপে শুন্য তুলে নেয়।পিহুর শরীর ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে।
তার কাঁপা চোখের পাতা একবার কাঁপে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে চোখ খুলে তাকায় কাঙ্খিত পুরুষটির পানে। সেই চেনা নীল মনিওয়ালা চোখ।যে চোখের প্রেমে সে পড়েছে চেহারার আগে।যে চোখে একটুখানি তাকালে তার সমস্ত যন্ত্রণা নিমেষে মিলিয়ে যেত।পিহু অস্ফুট গলায় বলে ওঠে,
“ইউভান… স্যার?”
সেই চোখের দিকে তাকিয়ে তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।এই প্রথম সে ইউভানের চেহারা পুরোপুরি দেখতে পেল।পিহুর গলায় কষ্টে চাপা পড়ে থাকা ভালোবাসা যেন ফেটে আসতে চাইল।তবে তার শরীর সেই আবেগের ভার আর নিতে পারল না।শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এলো।চোখের পাতা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।ইউভান পিহুর নিস্তেজ হওয়া শরীরের দিকে একবার তাকিয়ে আগুনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে।
চারদিকে গভীর রাতের নিস্তব্ধতা। বাতাস যেন হাহাকার করে কেঁদে উঠছে। মাথার উপর নির্জন আকাশ যেখানে কোন তারা নেই, নেই কোন চাঁদের আলো শুধু অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মাঝখানে আনায়া একা হেঁটে চলছে নির্জন রাস্তায়। তার চেহারায় অনুভূতির কোনো চিহ্ন নেই। না কাঁদছে, না হাসছে, না আতঙ্কে ভীত, শুধু নিঃস্পৃহ এক ছায়া সে বর্তমানে।অনুভূতিহীন এক যন্ত্রের মতো হাঁটছে আনায়া।
তার চোখের সামনে ভেসে আসছে তানহা আর ইউভানের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো। সেই প্রতিটি দৃশ্য তীক্ষ্ণ ছুরি হয়ে আনায়ার হৃদয়ের একেকটা কোণা কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। ইউভানের মুখটা এখন তার জন্য একটা অভিশাপের মত। কীভাবে ইউভান এমন করল? কীভাবে এক মানুষ এতটা সহজে আরেকটা মানুষের সবটুকু ভেঙে দিতে পারে?আনায়া নিজের জীবনের উপরই বড্ড হাসি পাচ্ছে। সে এমন একটা মানুষকে নিজের সর্বস্ব তে ভালোবাসলো ভাবতেই ঘৃণা আসছে তার।রিসোর্ট থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে আনায়া।রাস্তার চারপাশে ভাঙ্গা গাছগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
নিস্তব্ধতার মাঝে বাতাসও যেন কাঁদছে, আর আনায়া সে শুধু হাঁটছে। তার কোন গন্তব্য নাই সে শূন্য পথে অপারেশন হচ্ছে শুধু। হঠাৎ…
দূর থেকে গাড়ির হর্নের আওয়াজ হয়। রাস্তার মোড় ঘুরে তীব্র গতিতে গাড়িটি আনায়ার দিকেই ছুটে আসছে।আনায়া চোখ তুলে তাকাল গাড়িটির পানে তার মুখে তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে উঠলো। আনায়া থামল না আর না গাড়িটি থামল। মুহূর্তেই গাড়িটি একদম তার সামনে চলে আসে। বিকট শব্দ হলো। গাড়িটি ধাক্কা মেরে আনায়াকে ছিটকে ফেলে দেয় কয়েক গজ দূরে। আনায়ার শরীরটা আকাশে ভেসে উঠে, তারপর ধপ করে পড়ে যায় রাস্তার একপাশে।
হাত ছড়িয়ে পড়ে ধুলোয়, কনুই ছিঁড়ে রক্ত ঝরে, হাঁটুতে ফেটে গেছে চামড়া। মাথার গভীর এক ক্ষত—সেইখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে গাঢ় লাল রক্ত। কপালের ডান পাশে আঁচড় লেগে গেছে, চুলগুলো জড়িয়ে গেছে রক্তে।আনায়া পড়ে আছে নিঃসাড়, নিঃশব্দ।গাড়িটি আরো দ্রুত গতিতে সেখান থেকে চলে গেল।
আনায়ার শ্বাস ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। সেই মুহূর্তে তার চোখের সামনে ভেসে আসে ইউভানের মুখ। কিন্তু কেন? যে মানুষটা তাকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিলে, সেই মানুষটা চেহারায় কেন বারবার তার চোখের সামনে আসে?আনায়ার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয় না।এত কিছু পরও তার চোখ দিয়ে এক ফোটা অশ্রু বের হয় না। আনায়া শুধু অপেক্ষা করছে তার মৃত্যুর।
তৎখান দূর থেকে কেউ ছুটে আসে আনায়ার দিকে।আনায়া নিভু নিভু চোখে তাকায় সেদিকে মুহূর্তে তার হৃদয় থমকে যাই।কালো ড্রাগনের মাস্ক পড়া ড্রেভেন হানটার নামক সেই ভয়ংকর ব্যক্তিটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু কেন?আনায়া বুঝে উঠতে পারে না।আনায়া এইটুক ধারণা করতে পারে হয়তো সুমনের মত তাকেও এখন এই জানোয়ার নামক লোকটা খুন করবে।তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সে জঙ্গলের সুমনের ভয়ংকর মৃত্যুর দৃশ্যটা। আনায়া শরীর নাড়াতে চেয়েও পারেনা। তার চোখ আটকায় সেই ড্রাগন মাস্কে। ভয়ের ছায়া ছড়িয়ে পড়ে তার ভিতরে। হাত কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে।আনায়া শরীরের সাথে তাল মিলাতে পারেনা অবশেষে তার চোখ নিভে আসে সঙ্গে তার শ্বাসও।
মুহূর্তে ড্রেভেন আনায়ার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে।
এক ঝাপটায় সে আনায়ার রক্তমাখা শরীরটা তুলে নেয় কোলে। তার কাঁধে মাথা এলিয়ে পড়ে যায়। ড্রেভেনের হাত কাঁপছে, হৃদস্পন্দন দ্রুত। সে চিৎকার করে ওঠে,
“গোল্ডমেরি চোখ খুলো।তাকাও আমার দিকে কুইন আমার। প্লিজ!”
আনায়ার দিক থেকে কোন সাড়া আসেনা। এখন তার মুখে পাগলামির ছায়া। চুল এলোমেলো, চোখ লাল, গলায় জড়ানো গলার শিরাগুলো ফুলে উঠেছে।সে এবার আনায়ার রক্তাক্ত মুখশ্রী আকড়ে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,
“এত তাড়াতাড়ি তুমি তোমার ডেভিল কিং কে রেখে যেতে পারো না। আমি যেতে দিব না তোমাকে।শুধুমাত্র তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি নিজেকে তোমার থেকে দূরে রেখেছি।তাও তোমাকে পারলাম না বাঁচাতে?তাহলে কী আমি ব্যর্থ গোল্ডমেরি?”
ড্রেভেন দুই হাত মাথায় রাখে। কি করবে সে? কোনমতে সে আনায়েকে নিয়ে হসপিটালে যেতে পারবে না। তাকে বাইরে কেউ দেখে ফেললে অনেক বড় সমস্যা হতে পারে।ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকটা গাড়ি এসে থামে।ড্রেভেন সতর্ক হয়ে আনায়াকে রেখে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।গাড়ি থেকে আয়ান আর রুহি নেমে আসে।আনায়াকে নিস্তেজ পড়ে থাকতে দেখে তাদের কলিজার পানি শুকিয়ে যায়। আয়ান দ্রুত বেগে আসে আনায়ার কাছে।রুহি কাঁদতে কাঁদতে আনায়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আনু এই আনু কি হয়েছে তোর? আয়ান ভাই দেখ না আলু কথা বলছে না।কিছু কর ভাইয়া।”
আয়ান ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।আনায়াকে পুরো রিসোর্ট খুঁজে পাচ্ছিল না বলে তারা রিসোর্ট এর বাইরে গার্ড এর কাছে শুনে যে আনায়া নাকি বাইরে গিয়েছে। আয়ান তখনই বিপদ আন্দাজ করে রুহিকে নিয়ে আনায়াকে খুঁজতে খুঁজতে রিসোর্ট থেকে বের হয়।আনায়ার ফোন ট্র্যাক করে লোকেশন জানতে পেরে এখানে এসে পৌঁছায়।রুহির কান্নার আওয়াজে আয়ানের ধ্যন ভাঙ্গে। তার আদরের বোন রক্তাক্ত অবস্থায় নিচে পড়ে আছে।আয়ানের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি রুহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“রুহি গাড়ির দরজা খোল আমাদের তাড়াতাড়ি হসপিটালে যেতে হবে।”
রুহি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা খোলে।আয়ান আনায়াকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। রুহি পেছনের সিটে আনায়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।আয়ান বারবার ইউভানের ফোনে কল দেয় কিন্তু ফোন বারবার বন্ধ বলছে। সে আশা ছেড়ে দিয়ে একাই আনায়াকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অপরদিকে কাছের আড়ালে এসব দৃশ্য ড্রেভেন দেখছে। গাড়ি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। দীর্ঘ দৃষ্টিতে চলে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল।এরপর শীতল কন্ঠে আওরায়,
“কাঙ্খিত সময়ের আগে তোমার আমার দেখা হওয়া মোটেও উচিত হয়নি গোল্ডমেরি।”
তখনই ড্রেভেনে চোখ যায় আনায়ার ফোনের দিকে। সে ফোনটা হাতে তুলে নেয় ফোনটা ওপেন করতে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ইউভানের ছবি।মুহূর্তেই ড্রেভেনের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।ড্রেভেন দুই হাতে নিজের চুল মুষ্টিবদ্ধ করে।চোখ জ্বলছে। মুখে একটা বিকৃত হাসি। সে ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে গর্জে উঠলো—
“ইউভাননননননননননননননননননন! ফাকিং ম্যাননননননননননন!”
একটা ছেলেমানুষের মত চিৎকার নয়, এ হলো একটা পশুর মতো গর্জন। গলার শিরা ফেটে যাওয়ার মতো করে উঠে এল সেই ধ্বনি। ড্রেভেনের সেই হিংস্র চাহনি কাউকে মেরে ফেলতে সক্ষম। সে ফোনটা এক ঝাঁকুনি দিয়ে ছুঁড়ে মারল। ফোনটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তায়। স্ক্রিনটা ফেটে কয়েক টুকরো। তার প্রতিটা চাঙর যেন ড্রেভেনের হৃদয়ে গিয়ে বিঁধলো।
ড্রেভেনের পাগলামো এখানে থামেনা। সে চুল মুঠো করে ধরে নিজেকে আঘাত করতে থাকে পাগলের মতো। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠছে,
“আহহ! আহররর!আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তুমি জানো কুইন? তুমি শুধু আমার এই ড্রেভেনের।”
ড্রেভেনের সামনে একগাছা গাছ, ঝড়ে কুঁকড়ে পড়ে আছে। সে নিজের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গাছের উপর আঘাত করতে থাকে।আর হিশহিশিয়ে বুলি আওরায়,
“ড্যাম ইট! আমি ছিলাম সেই মানুষ যাকে তোমার ভালবাসা উচিত ছিল। ড্রেভেন হান্টার। এই নামটা শোনার সাথে সাথে তোমার বুকের ভেতর কাঁপন উঠা উচিত ছিল। ওই ইউভান না, আমি… আমি… শুধু আমি গোল্ডমেরি।”
সে গাছের সঙ্গে দুই হাত জোরে ঠাস করে মারে।একটা, দুইটা, তিনটা প্রতিবার তার হাতের তালু ফেটে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। ড্রেভেন নিজের হাতের রক্তের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
“তোমাকে আমাকে ভালোবাসতেই হবে কুইন। কারণ তোমার হৃদয়টা আমার জন্যই গড়া হয়েছে। কোনো ইউভানের জন্য নয়।তোমাকে ড্রেভেনের নাম আত্মা, সত্তাকে ভালবাসতে হবে শুধু খুব শীঘ্রই।এই ড্রেভেনের সাথে তোমার আবার দেখা হবে।”
তৎক্ষণ ড্রেভেন সতর্ক চোখে চারদিকে তাকায়। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সে তার দাড়িয়ে থাকা কাঙ্খিত গাড়িতে উঠে বসে।তার অনেক কাজ।গাড়ি চলতে শুরু করে তীব্র গতিতে নির্জন রাস্তায়।
অপরদিকে,
আয়ানদের গাড়ি এসে থামে হসপিটালে সামনে।দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেচার নিয়ে ছুটে আসে কয়েকজন নার্স। আয়ান আনায়াকে স্ট্রেচারে শুয়ে দেয়।স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা আনায়ার নিথর দেহ দেখে রুহির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।ডাক্তার এগিয়ে এসে হাতের পালস চেক করে বলে ওঠে,
“এক্সিডেন্ট কেস মনে হচ্ছে, পেশেন্টের পালস দুর্বল। ব্লিডিং অনেক হয়েছে। সাথে সাথে আমাদের পুলিসকে ইনফর্ম করতে হবে।”
ডাক্তার এমন বলতেই আয়ান থমথমে গলায় বলে,
“আপনি শুধু চিকিৎসা করুন। বাকি যা কিছু করার আমি দেখবো।”
তার কণ্ঠে এমন চাপা গর্জন যেটা ডাক্তারকে এক মুহূর্তে থামিয়ে দেয়। ডাক্তার আর কিছু না বলে ইশারা দিয়ে বলে,
“ওটি প্রস্তুত করুন!”
রুহি তখনও থরথর করে কাঁপছে। আয়ান ছটফট করছে তার এখন অনেক ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে।তার মাথায় এখন কিছু আসছে না সে এবার রুহির দিকে চেশে বলে,
“তুই ইউভানকে ফোন দে। আমি রিসিপশনে যাচ্ছি, কিছু কাগজপত্র ও ফর্মালিটি আছে।ওকে ফোন দে তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসতে বল।”
রুহি মাথা নাড়ে। দ্রুত ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ইউভানের নাম্বার ডায়াল করে।কয়েকবার ফোন বন্ধ বলে তারপর কল রিং হয় হঠাৎ কল কনেক্ট হয়।রুহি কিছু বলতে যাবে তার আগে মেয়েলি কন্ঠ আসে,
“হ্যালো?”
কণ্ঠটা চেনা তানহার এটা।রুহি থমকে যায়।
“তানহা আপু?তুমি ফোন ধরলে? ইউভান ভাই কোথায়?”
ওপাশে কিছু মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপর তানহার কণ্ঠে একটু হকচকিয়ে যাওয়া স্বর,
“উহ… আমি তো জানি না। আমি তো ফোনটা ইউভান ভাইয়ের রুমে পেয়েছি। উনি কোথায় গেছে আমি জানি না।”
রুহির সন্দেহ জাগে, কিন্তু এখন কথা বাড়ানোর সময় নেই। সে বলে,
“তানহা আপু, দয়া করে তাড়াতাড়ি হসপিটালে আস। আনায়ার এক্সিডেন্ট হয়েছে, অবস্থা ভালো না।ইউভান ভাইকে পেলে দয়া করে খবরটা দিয়ে দিও।”
কথাটা শুনে তানহার ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক বিকৃত হাসি খেলে যায়।তারপর কোনো কথা না বলে কলটা কেটে দেয়।ঘরে অন্ধকার শুধু টেবিল ল্যাম্পের আলো। তানহা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। মুখে সেই সাপের মতো হাঁসফাঁস হাসি।সে কারো একটা নাম্বারে ফোন দেয়।
“হ্যালো?থ্যাংকস। আমার কাজ করে দেওয়ার জন্য… তোমার টাকা খুব শীঘ্রই পৌঁছে যাবে।”
তারপর ফোনটা রেখে দেয়।তানহা এবার ইউভানের ফোনটা হাতে নিয়ে চারপাশে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে, একটা আত্মতুষ্টির চাহনি তার চোখে।
“এটাই চেয়েছিলাম আমি… আনায়ার মৃত্যু। আর সেটা আমি করিয়েছি। নিজ হাতে না হলেও নিজের ইচ্ছেতে। এবার আমার রাস্তা একেবারে পরিষ্কার। ইউভান এখন শুধুমাত্র আমার একদম একা আমার।আনায়া এখন তোমাকে শুধু ঘৃণা করবে ইউভান কারন ওই বোকা মেয়ে তো কখনো জানবেই না ভিডিওটা আসলে মিথ্যা।”
তানহা পৈচাশিক হাসি দেয়।সে ইচ্ছে করেই আনায়ার এক্সিডেন্ট করিয়েছে। আর ইউভানের ফোনটাও তার একটি প্লানেরই অংশ। এখন আনায়া বেঁচে গেলেও সে শুধু ইউভানকে ঘৃণা করবে।
আয়ান রিসিপশনের ডেস্কে দাঁড়িয়ে ফর্মালিটিগুলো পূরণ করছে। কাগজে নাম লেখার সময় তার হাতটা কাঁপছে টেনশনে। কিন্তু কোন উপায় নাই ফর্মালিটিগুলো শেষ করতেই হবে। কোনোভাবেই পিছু হটার উপায় নেই তার।ঠিক সেই মুহূর্তেই আয়ানের পাশে এক নার্স এসে রিসিপশনে বলল,
“দয়া করে একটু দেখুন পিহু নামের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।তার বাসার কেউ থাকলে ডেকে দিন।
তখন রিসিপশনের একটি নার্স বলে ওঠে,
“কিছুক্ষণ আগেই এক লোক তাকে নিয়ে এসেছিল। এখানে দাঁড়িয়েও ছিল। তবে নামটা মনে আছে ইউভান। মনে হয় ইউভানই বলেছিল নিজেকে।”
ইউভান নামটা কর্ণে পৌঁছানো মাত্রই আয়ানের হাত থেমে যায়। কলমের আঁচড় অর্ধেকেই থেমে রয়ে যায়, তার দৃষ্টি শূন্য হয়ে যায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কীভাবে সম্ভব? ইউভান? এখানে?আয়ান কিছু বুঝতে পারি না তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। ইউভান এখানে কাকে নিয়ে আসবে?ঠিক তখনই হসপিটালের কাচের দরজার ওপারে এক চাঞ্চল্যকর দৃশ্য দেখা যায়। দরজা ধাক্কা মেরে এক যুবক দৌড়ে ভিতরে ঢোকে। তার চুল এলোমেলো, চোখ দুটি অস্থির আর মুখটা ঘামে ভেজা।আয়ানের দৃষ্টি ততক্ষণ সেদিকে যাই মুহূর্তে সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।ইউভান তার দিকে দৌড়ে আসছে।
তার গায়ের সাদা টি-শার্ট ঘামে ভিজে গিয়েছে।চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে কারোর জন্য ছটফট করছে।ইউভানকে দেখে দুইজন নার্স ছুটে এসে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
“স্যার! আপনার পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।”
কিন্তু তাদের কণ্ঠ ইউভানের কানে পৌঁছায় না। সে নার্সদের পাশ কাটিয়ে আয়ানের কলার চেপে ধরে। আয়ান মুহূর্তেই হতভম্ব হয়ে যায় কি হচ্ছে বুঝতে পারে না কিছু।তৎক্ষণ ইউভান গর্জে ছটফটে কণ্ঠে বলে,
“আমার আনু কোথায়?”
ইউভানের শব্দগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে ফুসফুস ভেঙে। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখ পড়ে তার দিকে।আয়ান অবাক হয়ে, হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইউভানের দিকে।হঠাৎ করে তার মুখে বেরিয়ে আসে,
“তুই এখানে কি করছিস ভাই?”
এই কথাটাই যেন ইউভানের রাগ আরও বেড়ে যাই।সে উত্তর না দিয়ে আয়ানকে ধাক্কা মারে।আয়ান এক ধাপ পিছিয়ে যায়, কিছুটা অসতর্কতায় কাঁচের ডেস্কের কোণায় ঠেকে গিয়ে আঘাত পায়।চতুর্দিকে কিছু লোক জড়ো হতে শুরু করে। হসপিটালের করিডোরে হঠাৎ করে কোলাহল তৈরি হয়।ইউভান তখনো সেই একই কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে,
“আগে জিজ্ঞাসা করেছি আমার সানসাইন কোথায়?”
চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যায় মুহূর্তে। নার্সরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে।তারা তো দেখেছিল যখন ইউভান পিহুকে নিয়ে এসেছে, তখন তার চোখেও ততটা অস্থিরতা ছিল না।একেবার শান্ত এবং ঠান্ডা ছিল। এখন কেন এমন করছে সেটা নার্সরা বুঝতে পারে না। তারা তো জানে পিহু ইউভানের কিছু হয় কিন্তু এখন তো সব উল্টো দেখছে।
আয়ান ইউভানকে এতটা উতলা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায়।সে এবার ইউভানের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“শান্ত হ ভাই আমি তোকে বনুর কাছে নিয়ে যাচ্ছি চল।”
ইউভান এক মুহূর্ত দাঁড়ায়। তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। সে কিছু না বলে আয়ানের পেছনে ছুটে চলে।ইউভান এসে দাঁড়ায় আনায়ার কেবিনের সামনে। ভেতরে ডাক্তাররা চিকিৎসা করছে আনায়ার।কিন্তু ইউভান কোন কিছুর পরোয়া না করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে। আয়ান চাইলেও আটকাতে পারিনি কারণ সে জানে তার ভাইয়ের জেদ। সেই মুহূর্তে একটা ডাক্তার এসে ইউভানকে থামিয়ে বলে,
“আপনি এখানে থাকতে পারবেন না। পেশেন্ট স্ট্যাবল হলেও অবজারভেশনে আছেন।দয়া করে বেরিয়ে যান।”
ভেতরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তারকে হঠাৎই ইউভান এক চাহনিতে বিদ্ধ করে ফেলে।
তার চোখ দুটো রক্তে রাঙানো ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলছে লাল আগুন।চোখের কোণে থাকা টান, নাকের পাখা ফুলে ওঠা, কপালে জমে থাকা টানটান রাগের রেখা সবকিছু মিলিয়ে তার উপস্থিতিই হয়ে ওঠে হিংস্র এক ঝড়।ইউভানের মোটেও পছন্দ না তার পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে এবার গর্জে ওঠে বলে,
“আমার সামনে থেকে না সরে যা।তা না হলে আজকে তোর জীবনের শেষ দিন হবে আই সুয়্যার ।
ইউভান সজোরে ধাক্কা দেয় সামনের ডাক্তারকে সাদা কোট ছিটকে পড়ে যায় মেঝেতে।আয়ান বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে বুঝে যায়, পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে নেই। ইউভান এখন যেকোনো কিছু করতে পারে।
সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ডাক্তারদের থামায়।
অবশেষে ডাক্তারেরা সরে দাঁড়ায়।
ভেতরে ঢুকে ইউভানের দৃষ্টি আটকায় নিথর অষ্টাদশীর পানে।সে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে আনায়ার দিকে।তার সানসাইন আজ ক্লান্ত, নিস্তেজ কিন্তু তার কাছেই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মুখ এটা।ইউভান থেমে যায়। প্রথমে দাঁড়িয়ে শুধু চেয়ে রইল আনায়ার মুখশ্রীর দিকে। কপালের পাশের চুল কিছুটা এলোমেলো। ইউভান হাত বাড়ায় তার হাত কাঁপছে। অনেক সাহস করে সে এক হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে আনায়ার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দেয়।তার কপালের পাশে ঠোঁট রাখে।তারপর পুরো দেহটাকে ঝুঁকে এনে জড়িয়ে ধরে।এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত… তারপর ইউভান হঠাৎ কাঁপতে শুরু করে।
বুকের ভেতরটা দপদপ করে ওঠে। চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে আনায়ার গাল বরাবর।ইউভান উপলব্ধি করতে পারছে আনায়ার শ্বাস ধীরে ধীরে কমে আসছে।ইউভান আনায়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে দিয়ে বলে,
” তুই এমন কেন করছিস উমমম রাগ করেছিস আমার উপর? আচ্ছা তাহলে উঠে রাগ দেখা আমার উপর আমি কিছু বলবো না তোকে। তোর নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না কেন আমি? এই আনু শ্বাস নে আমাকে একটু রাগাবি না। তোর কলিজা টেনে ছিঁড়ে ফেলব আমার অবাধ্য হলে। নিশ্বাস নে সানসাইন দেখ আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।”
আত্মার অন্তরালে পর্ব ১০
ইউভান আনায়ার গলায় মুখ গুঁজে নিল। আলতো করে ছোট রক্তাক্ত দেহটিকে জড়িয়ে ধরে। ডাক্তাররা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। ইউভান পুনরায় ফিসফিসিয়ে বলে,
“তোর ডাগর চোখের চাহনি না দেখতে পেলে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যাবে।তোর হাসির শব্দ না শুনলে আমার দুনিয়া থেমে যাবে সুইটি চোখ মেলে তাকা।”
আয়ান এবার ইউভানের দিকে এগিয়ে আসে। চোখে জল চেপে দেখে সবটা।আয়ানের অনুমতি পেয়ে ডাক্তারের আবার আনায়ার চিকিৎসা শুরু করে।আয়ান নিজেকে সামলিয়ে ইউভানের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠে,
“পিহু কে ভাই?”
ইউভান মুহূর্তে সজাগ চোখে তাকায় আয়ানের পানে।এরপর ঠান্ডা কণ্ঠে শুধালো,
“আমার দায়িত্ব।”