আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৫

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৫
প্রীতি আক্তার পিহু

ড্রেভেন সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে তার পিছনে দৌড়াতে থাকে তার গতি যেন আরও তীব্র হচ্ছে।রাস্তায় ঘেউ ঘেউ করছে কুকুরগুলো, তাদের ভয়ঙ্কর আওয়াজ আরো গা শিউরে তুলছে। লোকটি তীব্র গতিতে দৌড়াচ্ছে। তার শিরদাঁড়ায় ভয় পেরিয়ে যাচ্ছে, তার হাত-পা কাঁপছে।ড্রেভেন জোরে চিৎকার দিয়ে বলে,
“স্টপ আমার হাত থেকে পালাতে পারবি না বাস্টা**।তোদের কে পাঠিয়েছে খুব ভালো করে জানে আমি। থেমে যা তা না হলে তোর মৃত্যু আরো বেশি ভয়ংকর হবে।”

বলেই ড্রেভেন হাতে থাকা কোদালটি লোকটির পা বরাবর মারে সঙ্গে সঙ্গে,সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে ওঠে। ড্রেভেনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।সে ধীরে ধীরে কাছে চলে আসে। লোকটি পা ধরে চিৎকার দিয়ে কান্না করছে।লোকটি ড্রেভেনের দিকে তাকিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে,
“আমাকে ছেড়ে দিন আমার কোন দোষ নাই, আমি তার কোন ক্ষতি করতে চাইনি বিশ্বাস করুন।”
ড্রেভেন লোকটি সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এরপর ভয়ংকর চাপা কন্ঠে বলে,
“আমার গোল্ডমেরি কে মারতে চেয়েছিলি তোরা? এত বড় কলিজা তোদের? এই ডেমনের কুইনকে এত সহজে মেরে ফেলতে পারবি। একবার প্রাণের ভয় করলো না তোদের?কে? কে তোকে এখানে পাঠিয়েছে নাম বল?”
লোকটি ব্যথায় কুকিয়ে যায় তার শিরদাঁড়ায় রক্ত জমে যাচ্ছে।ভয়ে ভয়ে পুনরায় বলে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” K.K সে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে।এবার আমাকে ছেড়ে দিন ড্রেভেন।”
ড্রেভেন উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে।পুরো নির্জন রাস্তায় তার হাসি আরো বেশি ভয়ংকর শোনা যাচ্ছে,
” তোদের জন্য আমি আমার কুইনকে শান্তি মতো দেখতেও পারবোনা। রাস্কেলের দল আমার সঙ্গে না পেরে আমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করতে চাচ্ছিস। কিন্তু এই ড্রেভেন বেঁচে থাকতে কখনো তার গোল্ডমেরির উপরেরটা আঁচ আসতে দেবে না।এসব করে কি ভেবেছিস আমাকে হারিয়ে ফেলতে পারবি? এবার মরার জন্য প্রস্তুত হয়ে যা। ”

লোকটির হাত-পা কাঁপছে।সে এখন ভালোমতো বুঝতে পারছে মৃত্যু তার খুবই কাছে। আতঙ্কে তার বুকের ভিতর শক্ত শ্বাস আটকে যাচ্ছে। ঠিক তখনই নিচ থেকে কুড়ালটি হাতে তুলে নেয় ড্রেভেন। এক মুহূর্ত দেরি না করে কুড়ালটি লোকটির মুখ বরাবর আছড়ে ফেলে, সেকেন্ডের মধ্যে তার মাথা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। চোখ মুখ নাক কিছু অবশিষ্ট থাকে না, মাথার মগজ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।কুকুরগুলো এতক্ষণ ভয়ংকরভাবে ঘেউ ঘেউ করছিল,তারাও এক মুহূর্তে চুপ হয়ে বসে পড়ে। রাস্তার চারদিকে রক্তে ভেসে যায়।
ড্রেভেন একটা আঘাতে থেমে থাকে না এই একটা আঘাতে তার মন কিছুতেই শান্ত করতে পারেনা সে অনবরত লোকটি দেহের উপর কোদাল দিয়ে আঘাত করে দেহটিকে ছিন্ন বিচ্ছন্ন করছে। সে এবার হাত থেকে কোদালটি ফেলে দেয় তার চোখে এক অন্যরকম উন্মাদনা। এবার রক্তে ভেজা হাত দিয়ে লোকটির ছিন্ন বিচ্ছিন্ন শরীরের ভিতর প্রবেশ করিয়ে কলিজাটা টেনে বের করে চোখের সামনে ধরে। তার মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে এটুকুতেই নিশংসতা থেমে থাকে না সে এবার লোকটির পেটে হাত ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি, বিকৃত, ইত্যাদি অংশ বের করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধার্ত কুকুরগুলো এক পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা লোভের বশে রক্ত-মাংস ছিঁড়ে খেতে শুরু করে।ড্রেভেন সেগুলা দেখে উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। তার সমস্ত শরীরের রক্ত লেগে আছে পুরো রাস্তা রক্তে বিছিয়ে গিয়েছে। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে কাউকে কল দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে একটি কালো রঙের গাড়ি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ড্রেভেন এক মুহূর্ত দেরি না করে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ির মধ্যে বসেছিল আর একটি লোক যার নাম ম্যাক্স।
ম্যাক্স ভয়ে ভয়ে ড্রেভেনের দিকে তাকায় সে বুঝে গিয়েছে আজ হয়তো আরেকটি প্রাণ চলে গিয়েছে পৃথিবী থেকে তাও আবার ড্রেভেনের হাতে। ড্রেভেন যার অর্থ শয়তান সে জানে সবকিছু ধ্বংস করতে, সে শুধু চেনে মৃত্যু আর রক্ত। ড্রেভেন টিস্যু দিয়ে নিজের শরীরের রক্তগুলো মুছতে মুছতে বলে,
” কি চিন্তা করছো ম্যাক্স?”
ম্যাক্স ঘাবড়ে ওঠে কাপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
“না মানে ওরা ফর্মুলার নেওয়ার জন্য ম্যামকে টার্গেট করছে এখন তাহলে কি করবেন স্যার।”
ড্রেভেন শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
” সুইজারল্যান্ড ব্যাক করব।”
ম্যাক্স থতমত খেয়ে যায়। তারপর কিছুটা সাহস সঞ্চালন করে বলে,
“তাহলে ম্যামের কি হবে ম্যাম কি এরকম একা রেখে যাবেন না মানে এখানে আরো একজন আছে যে ম্যাম কে মনে….
ড্রেভেন ম্যাক্সের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে ওঠে,

“সায়ন চৌধুরী ইউভান তাকে ছেড়ে দিয়েছি ছাড় দেইনি। আমার গোল্ডমেরিকে তার উপর সোপে দেই নি। শুধুমাত্র আমি তাকে আবিষ্কার করার অপেক্ষায় তারপর আমি আবার ফিরে আসব আমার কুইন এর কাছে। তখন এই ইউভান নামক কাটাকে উপড়ে ফেলে দিব আমি। আমার আর আমার হার্টের মাঝে কেউ আসতে পারবেনা।”
ম্যাক্স চুপ হয়ে যায়। ড্রেভেনের এর কথা বোঝার মত ক্ষমতা তার হয়নি আজ পর্যন্ত। তার চেহারায় সে এখন অব্দি দেখতে পারল না।সুইজারল্যান্ড থাকতেও কেউ ড্রেভেনের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে পারেনি শুধুমাত্র একজন ছাড়া। ডেমন একটা বিকৃত মস্তিষ্কের সাইকো। নীরবতা ভেঙে ড্রেভেন বলে ওঠে,
“তুমি কাল ভোরের সুইজারল্যান্ড চলে যাও আমার বাংলাদেশে কিছু কাজ আছে একদিন পর আমি আসছি। আগে গিয়ে ড্যরেন এর সঙ্গে দেখা করবে।”

ম্যাক্স মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।ম্যাক্স মনে মনে চিন্তা করতে থাকে না জানি আর কত নিরীহর প্রাণ যাবে এদের বিকৃত আনন্দের জন্য। শুধুমাত্র শখ পূরণের জন্য কত নিরীহ প্রাণের বলিদান দিবে ড্রেভেন আর ড্যরেন। জানালা দিয়ে শো শো ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে গাড়ির মধ্যে। ড্রেভেন ফোনের স্ক্রিনে গভীর চোখে তাকিয়ে বলে,
” মাই হার্ট তোমায় আমাকে ভালবাসতেই হবে।আমি নামক খারাপ মানুষকে তোমাকে ভালবাসতে হবে।কারণ আমি বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলি তোমার ওই সোনালী চোখের মাঝে গোল্ডমেরি।তোমার চোখের রং সূর্যাস্তের শেষ সোনালি আলো মতো, যা আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ।তুমি আছো,ছিলে এবং থাকবে আমার আত্মার অন্তরালে।”

আজকের সকালটা ঠিক সোনালী তুলোর মতো নরম।জানালার পাতলা সাদা পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের কিরণ ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। সেই কিরণ গিয়ে পড়লো আনায়ার মুখের ওপর।আনায়া কিছুটা জেগে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। আঠারো বছরের তরতাজা মুখটা রোদের আলোর ছোঁয়ায় আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনায়া আলতো চোখ মেলে দুই হাত ধীরে ধীরে উপরে তুলে পেছনে ছড়িয়ে দিলো।শরীরটা একটু বাঁকিয়ে বিছানায় কয়েকবার গড়াগড়ি খেলো আনায়া।এরপর এলোমেলো চুল নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসলো।চারপাশ একবার চোখ বুলিয়ে নিল আনায়া।তার পরনে সেই ইউভানের সাদা শার্ট পরা।হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় তার মুখে এক চিলটা হাসি ফুটে ওঠে।হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে গোপন সুখ যেটা আনায়া ছাড়া অন্যকে উপলব্ধি করতে পারবে না।আনায়া শার্টের কলারটা নাকের কাছে নিয়ে আরেকটু গভীরভাবে শ্বাস নিল। ইশশশশ শার্টে এখনো ইউভানের গন্ধ মিশে আছে।গত রাতে ছাদের মুহূর্ত গুলো মনে পড়তেই আনায়ার গাল রক্তিম হয়ে ওঠে।আনায়া হেসে ফেলল।ইউভানের সাথে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্তগুলো আনায়ার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।তবে এই ক্ষত থেকে আনায়া ব্যথা পায় না, বরং সুখ পায়।

সে এবার চাদরটা সরিয়ে ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নামলো। ঠাণ্ডা মেঝের ছোঁয়া পায়ে লাগতেই এক ঝটকায় পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো তার।ওয়াশরুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিলো আনায়া। আজ তার মনের ভেতরটা খুশিতে ভরে আছে। কারণ ইউভানকে নিয়ে তার সেই অস্পষ্ট ভালোবাসাটা যেন এখন একটু একটু করে সত্যি হয়ে উঠছে।আনায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো একটু পরিপাটি করে নিল।
এরপর পা ফেলে ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরোলো আনায়া।সে একবার চেরাচোখে চার দিক একবার তাকালো। চুপচাপ পা টিপে রান্নাঘর আসে সে, যেন কেউ দেখে না ফেলে তাকে। রান্নাঘরে সে ছাড়া আর কেউ নাই এটা দেখে আনায়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে কেটলিতে পানি দিলো।তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আজ ইউভানের জন্য কফি বানানো। কিন্তু সায়মা বেগম দেখলে নানা প্রশ্ন করবে এজন্য আনায়া লুকিয়ে এসেছে রান্না ঘরে।জীবনের এই প্রথম আনায়া রান্নাঘরে এসেছে কফি বানাতে তাও আবার ইউভানের জন্য।কফি বানানোর হেসে কাপটা মাত্র হাতে তুললো আনায়া। ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে সায়মা বেগম ডেকে ওঠে,

“আনায়া এই ভোরে রান্নাঘরে কী করছিস তুই?”
আনায়া চমকে উঠলো। কাপটা একটু কেঁপে উঠলো হাতে।সে ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে তার মামনির দিকে তাকালো। আনায়া এক মুহূর্তে ভাষা খুঁজে পায় না। মুখে অপ্রস্তুত হাসি খেলে যায় তার। চুলের একপাশ সামলে নিয়ে আস্তে বলে,
“আসলে, মামনি হঠাৎ খুব কফি খেতে ইচ্ছা করছিল তাই ভাবলাম নিজেই বানাই।”
সায়মা বেগম খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল তারপর অবাক কণ্ঠে বলেন,
“তাহলে সারভেন্টকে ডাকতি ? রান্না ঘরে তো তুই কোনোদিন আসিস না।”
আনায়া একটু গলা নিচু করে বলে,
“না মানে আমি ট্রাই করতে চেয়েছিলাম তাই এসেছি।সব সময় তো সার্ভেন্টই বানিয়ে দেয় কফি, তাই ভাবলাম আজ নিজে বানাই।”

সায়মা বেগমের মুখ নরম হয় একটু। মুখে তেমন কিছু না বলে ফিরে যান। আনায়া মনে মনে হাঁফ ছাড়ে।কাপটা নিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে একটু থামে। পেছন ফিরে দেখে মামনি এখন আর দাঁড়িয়ে নেই। তখন ঠোঁটের কোণে নিঃশব্দ এক হাসি খেলে যায়।সে এবার ইউভানের রুমের দিকে পা বাড়ায়। ধাপে ধাপে হৃদস্পন্দন একটু একটু করে বাড়ে আনায়ার। ইউভানের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আলতো করে টোকা দেয়।কিন্তু ভেতর থেকে সাড়া নেই। খানিক দ্বিধা নিয়ে ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢোকে আনায়া।মুহূর্তেই চোখ আটকায় বিছানার সাদা চাদরের উপর উদোম শরীরে শুয়া ইউভানের উপর।আনায়া স্তব্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইউভানের উন্মুক্ত বুক গভীর নিঃশ্বাসে উঠছে-নামছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়েছে কপালের উপর। আনায়া শুকনো ঢুক গিলে বুকের ভেতর কেমন জানি একটা নরম ঢেউ খেলছে তার।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে বিছানার দিকে। কাপটা বেডসাইডে রেখে বসে পড়ে চুপচাপ।হঠাৎই আনায়ার মনে সূক্ষ্ম বাসনা জাগে। তা বড্ড ইচ্ছে হলো ইউভানকে একটু ছুয়ে দিতে।আনায়া কাপা কাঁপা হাত বাড়ালো ইউভানের দিকে পর মুহূর্তে আবার থেমে যায়। নাহহ আনায়ার এতোটাও সাহস হয়নি এখনো! সে নিজেকে কোনমতে সামলিয়ে পিছনে ঘুরে দাড়ায়।

হঠাৎ এক হ্যাচকা টান অনুভব করে আনায়া। ইউভানের শক্ত হাত আনায়ার কবজিতে পড়তেই, শরীরটা হাওয়ায় ভাসার মতো অনুভব হয় তার। পর মুহূর্তেই আনায়া বিছানায় ইউভানের বুকের সাথে মিশে গেল। আনায়ার শরীর জমে যায়! হৃদয়ের সমস্ত ধমনি যেন আগুন ছুঁয়ে গেছে। তার চোখ কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে। তখনই ভারী পুরুষলী কন্ঠ শুনলো,
“সুইটি!”
আনায়া হঠাৎ স্তব্ধ। ইউভানের এমন ঘুম জড়িত কন্ঠে তার ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলছে। সে ছটফট করতে থাকে। ইউভান এবার একটু বিরক্ত হয়ে এক হাতে কোমর টেনে ধরে, আরেক হাতে চুলের গোড়ায় আলতো চাপ দিয়ে কাছে টেনে নেয় আনায়াকে। আনায়ার বুক ধরফর করছে,দম আটকে আসছে তার। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আওড়ালো—

“কী করছেন ইউভান ভাই ছাড়ুন।”
ইউভানের মুখ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে আনায়ার ঘাড় বরাবর। গাল ঘেঁষে ঠোঁট ছুঁয়ে যায় আনায়ার নরম ত্বকে।এরপর হুইস্কির কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে মারল,
“তুই কি আমাকে ছুঁয়ে দিতে চাস, সানসাইন?”
আনায়া চমকে যায়। চোখ মেলতেই দেখে ইউভান তার দিকে তাকিয়ে আছে ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে। আনায়ার লজ্জায় মাটি খুঁড়ে ভিতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। সে কি তাহলে ধরা পড়ে গেল ইউভানের কাছে? ইউভান নিঃশব্দে আনায়ার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। মুহূর্তেই শিউরে ওঠে আনায়া। ইউভান তার চুলে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলল,

“তুই এত কাঁপছিস কেন? ভয় লাগছে? ছুঁয়ে দিব তাই? নাকি খেয়ে ফেলবো বলে? কোনটা? কি ভেবেছিস আমি ঘুমিয়ে ছিলাম?”
আনায়ার চোখ বিস্ফারিত হয়। বুকের উপর চাপা পড়া অবস্থায় সে অনুভব করছে ইউভানের বুকের প্রতিটা ধাক্কা। তার ঠোঁট কাঁপে!ইউভানের গরম শ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে আনায়ার ঘাড়। সে অস্ফুট কন্ঠে শুধালো,
“আমি কিছু ভাবি নি। আমাকে ছেড়ে দিন এখন, তা না হলে চিৎকার করবো আমি।”
ইউভান আনায়ার কথার তোয়াক্কা না করে পুনরায় ঘোর লাগানো কন্ঠে শুধালো,
“ডোন্ট থিঙ্ক, জাস্ট ফিল মি, সুইটি!”

আনায়ার চোখ গর্ত থেকে বের হয়ে যাওয়ার মতো উপক্রম। ইউভানকে দেখে মনে হচ্ছে সে নেশা করেছে। কেমন মাতাল মাতাল লাগছে ইউভানকে আজ।আনায়া অনুভব করতে পারছে ইউভানের শরীরের তাপ।ইউভানকে এমন উন্মুক্ত দেখে আনায়া লজ্জায় মরে যায় যায় অবস্থা।ইউভানের শরীর এতটা গরম যে মনে হচ্ছে, কোনো দগ্ধ আগুনের উপর নগ্ন পা ফেলেছে আনায়া।তার শ্বাস বুকের পাঁজর ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইলো। তখনই ইউভান ধীরে আনায়ার গাল স্পর্শ করে। সেই স্পর্শে যেন সময় থেমে যায়। সে আনায়ার কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“আই ক্যান ফিল ইউর এভরি ব্রেথ নাও, সুইটি।”
সঙ্গে সঙ্গে ইউভান তার হাত চালিয়ে রাখে আনায়ার পিঠ বরাবর। এক মুহূর্তে এক শিহরণ আনায়ার মেরুদণ্ড বেয়ে উঠে যায়। ঠোঁট থেকে চাপা শ্বাস বের হয়।তখন আনায়ার মনে হলো, ইউভানের স্পর্শের তাপে যেন তার পিঠ গলে যাচ্ছে।আনায়া চোখ বন্ধ করে সামান্য ঠোঁট খুলে,
“ইউভান ভাই আমি…….”

আনায়া আর কিছু বলতে পারে না। ইউভান আনায়ার ঠোঁটে আঙুল রেখে থামিয়ে দেয়। আনায়া চোখ মেলে ড্যাবড্যাব করে শুধু চেয়ে রইল। ইউভান তার ঠোঁটে আঙুল রেখে স্লাইড করতে করতে বলে,
“হুশশশশশশ! ডোন্ট স্যই এনিথিং। বলেছিলাম না অসময়ে আসবি না আমার কাছে? শুনিস নি কেন আমার কথা? তোকে অসময়ে কাছে পেলে আমি কন্ট্রোলেস হয়ে যাই, কেন বুঝিস না তুই সানসাইন?”
আনায়া বুঝতে পারছে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে জটিল হচ্ছে। সে সর্বশক্তিতে দুই হাত দিয়ে ইউভানের বুকে ঠেলতে থাকে, কিন্তু প্রতিবারই ইউভানের শক্তির কাছে ব্যর্থ হয়। ইউভান ঠোঁট কামড়ে হাসে, আনায়াকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আনায়ার এবার ভীষণ কষ্ট হয় মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটা হাড় যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।তখনই ইউভান হিশহিশিয়ে বলে,
“এত ছটফট করছিস কেন, হ্যাঁ? কিছু করেছি আমি তোকে?”
হঠাৎ থেমে যায় ইউভান। খেয়াল করে দেখে আনায়ার চোখ কেমন ছটফট করছে। ঘাড় কাত করে বাঁকা হাসে ইউভান, তারপর পুনরায় বলে,
“তোর চোখ এমন ছটফট কেন করছে সানসাইন? আমি শুনতে পাচ্ছি,তোর চোখ চিৎকার দিয়ে বলছে আমি যেন তোকে ছুঁয়ে দিই।”

ইউভান ক্রমশুম উম্মাদের ন্যয় আচরণ করছে। আনায়াকে কাছে পাওয়ার অদম্য আকর্ষণ কাজ করছে তার মধ্যে।আনায়ার নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। বুকের ওপরে চাপা পড়ে থাকা ইউভানের শক্তপোক্ত শরীরটা তার ফুসফুস থেকে বাতাস টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার মুখ কুঁচকে যায় যন্ত্রণায়।সে ব্যথাজড়িত কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমার কষ্ট হচ্ছে প্লিজ ছেড়ে দিন।”

এই কথাটা ইউভানের কানে গিয়ে বিদ্যুৎপাতের মতো আঘাত করে। হঠাৎ সে যেন নিজের অবস্থান বুঝতে পারে। এক মুহূর্তের জন্য স্থির হলো ইউভান।আনায়ার ভীত চোখের দিকে তাকিয়ে ইউভান নিজের মধ্যে ফিরে আসে। সে দ্রুত দুই হাতে আনায়াকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়।ইউভানের চাপ থেকে মুক্ত হয়েই আনায়া হাপাতে হাপাতে উঠে দাঁড়ায়।মুহূর্তেই ইউভান উঠে বসে ঠোঁটে ঠোট চেপে বিড়বিড় করতে থাকে,
“ওহ শিট!শিট!ওয়াট দ্যা হেল এম আই ডুয়িং।’
ইউভানের চেহারা কেমন পরিবর্তন হয়ে যায় মুহূর্তেই।তার ঘাড় এবং হাতের রগ ফুলে ওঠে। চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করে। অপরদিকে আনায়া এক হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে। একটার পর একটা বড় নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করে কিন্তু নিঃশ্বাস আটকে আসে গলার কাছে।ইউভান এবার দাঁড়িয়ে পড়ে। চেহারাটা তীব্র হয়ে উঠেছে। আনায়ার পানে তাকিয়ে মুহুর্তে এসে গর্জে ওঠে,

” গেট আউট!এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বেরিয়ে যা, আনু।”
আনায়া অবাক হয়ে তাকায়।ইউভানের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না।তবে ভীষণ রাগ হয় ইউভানের কথায় তার।দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে ওঠে,
” আমারও খুব শখ জাগেনি আপনার রুমে থাকার বুঝেছেন?আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি আমাকে জোর করে আটকে রেখেছেন।”
ইউভান এবার হিশহিশিয়ে বলে,
“তুই এখানে এসেছিস কেন? আগে সাবধান করেছিলাম না এভাবে আমার রুমে আসবি না?এসেছিস বলেই তো আটকে রেখেছি না আসলে রাখতাম না।আর এক মুহূর্ত তোকে আমি চোখের সামনে দেখতে চাই না, বেরিয়ে যা!”
আনায়ার রাগে দুঃখে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে কান্নাটাকে আটকে রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“আপনার জন্য কফি নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু পুড়েছি আমি নিজে।আমার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে এখানে আসা, আপনার সামনে আসা।”

ইউভান শক্ত চোখে তাকায় আনায়ার দিকে।আনায়ার গলা ফাটে রাগে।আর কণ্ঠ কেঁপে উঠছে উত্তেজনায়। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে পেছন ঘুরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে।ঠিক তখনই ইউভানের ফোনটা বেজে ওঠে। আনায়া থেমে যায় চোখে আগুন নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।এরপর কোন কিছু না ভেবেই ইউভানের হাত থেকে ফোনটা তুলে আছাড় মারে ফ্লোরে।ফোনটা ঝনঝন শব্দে ছিটকে পড়ে যায়, স্ক্রিন চৌচির হয়ে যায়।ইউভান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ভাঙ্গা ফোনের দিকে। সে যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ তার।আনায়া এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে।ইউভান নিঃশব্দে সেদিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ে ইউভান।এই নিয়ে আনায়া তার দুইটা ফোন ভেঙেছে।ইউভান চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা চালাচ্ছে।হঠাৎই তার চোখ চলে যায় কফির মগের দিকে। সে হাত দিয়ে মগটি তুলে একটি চুমুক বসায়, সঙ্গে সঙ্গে মুখ কুচকে আসে কারণ কফিটা ঠান্ডা। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থাকে ইউভান এরপর দিগভ্রান্ত এক দম ফেলে বিড়বিড়ায়,
“ফা*****!”
আনায়ার বেরিয়ে নিজের রুমে এসে গজগজ করতে থাকে, “ওই ফক্সটারের কাছে গিয়ে আমি মস্ত বড় ভুল করেছি। এর চেয়ে ঠান্ডা কফি মুখে ঢেলে দিতাম, ভালো হতো।অসভ্য নির্লজ্জ লোক হুহু!”
ইউভানে চৌদ্দগুষ্টি গালি দিতে থাকে আনায়া একদমই কিছুক্ষণ।যতক্ষণ মন চাইলো ততক্ষণ বকবক করতে থাকলো একা একা।ইউভানকে গালি দিয়ে যদি সে একটু শান্তি পাই,তাহলে তাতে ক্ষতি কি?

অগাস্টের দুপুরগুলো যেন এক টুকরো জ্বলন্ত আগুন। আকাশজুড়ে সূর্যটা রাগী রাজপুত্রের মতো তাপ ছড়াচ্ছে।বাতাস নেই গাছের পাতাগুলোও ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে। রাস্তাগুলো রোদের তাপে উত্তপ্ত হয়ে আছে। কোথাও কোথাও ফাটা মাটির উপর ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে। ড্রয়িং রুমে বসে টিভিতে রোমান্টিক মুভি দেখছে রুহি আর আনায়া। দুজনেই মুভির সিনের প্রতি এতটাই মনোযোগী যে আশপাশের কিছুই টের পাচ্ছে না।ইউভান সকালেই ভার্সিটি চলে গিয়েছে। আনায়া রাগে ইচ্ছাকৃতভাবেই যায়নি আজ ভার্সিটিতে,তাই রুহিও যায়নি।এমন সময় হঠাৎ সদর দরজা দিয়ে ইউভান প্রবেশ করে। আনায়া ইউভানকে দেখে হচকচিয়ে উঠে রুহিকে খোঁচা দিয়ে বলে,
“এ্য্যএ্য্য বুইরা খাটাস ফকস্টার আইসা পড়ছে চ্যানেল পাল্টা রুটি।
রুহি তাড়াতাড়ি চ্যানেল পাল্টিয়ে খবরের চ্যানেলে দেয়। ইউভান অদ্ভুত দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে দুই কদম এগিয়ে আসে।রুহি মেকি হেসে বলে,
“ভাইয়া তুমি আজকে এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছো ভার্সিটি থেকে।তোমার তো রাতে আসার কথা ছিল না তাই না।”

ইউভান রুহির দিকে একবার তাকিয়ে তারপর ভ্রু কুঁচকে আনায়ার পানে তাকায়।আনায়া রাগে অন্য দিক মুখ ফিরিয়ে আছে। ইউভান অত কিছু পাত্তা না দিয়ে বলে,
“আজ রাতে অফিসে গেট টুগেদার আছে তাই রেডি হতে এসেছি আবার যাবো চলে এখন।”
আনায়া এবার অফিসের কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়। ইউভান ভাইয কোন অফিসে যাবে? কার অফিসে যাবে?তখনই রুহি তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” কার অফিস ইউভান ভাই?”
ইউভান কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে আয়ান এসে বলে,
“কার আবার আমাদের অফিস। তোরা অনেকদিন হলো বাইরে যাস না আজকে সন্ধ্যায় রেডি থাকিস আমি নিয়ে যাব।”

রুহি আনায়া দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে কোন অফিসের কথা বলেছে।ইউভান আড় চোখে আনায়ার রাগী মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে উপরে চলে যায়। ইউভান চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনায়ার মুখ ভেংচি মারে।হঠাৎ তার ধ্যান ভাঙ্গে কোলে নরম তুলতুলে কিছু একটা নাড়াচড়ায়।সে এবার নিজের কোলের দিকে তাকা সঙ্গে সঙ্গে হচকচিয়ে ওঠে। একটি ছোট বিড়ালছানা কোলের ওপর লাফালাফি করছে। আনায়া প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে মুখে হাসি ফোটে। আলতো হাতে বিড়ালটির ধরে সঙ্গে সঙ্গে বিড়ালটি আনায়ার কোল থেকে এক লাফ দিয়ে নিচে নেমে বাইরের দিকে চলে যায়।

অমনি মনটা খারাপ হয়ে যায় আনায়ার। সেও উঠে বিড়ালের পিছু পিছু বাইরে যায়। আনায়া বিড়ালটির পেছন তাড়া করতে করতে বাগানে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু বিড়ালটা থামার নামই নিচ্ছে না। সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বড় একটা লাফ দিয়ে খপ করে বিড়ালটিকে ধরে ফেলে। কিন্তু মাটি পিচ্ছিল হওয়ায় সোজা গিয়ে পড়ে কাদার মধ্যে আর কি সারা শরীরে কাদার মাখামাখি হয়ে যায়। চুলসহ জামাকাপড় জুড়ে শুধু কাদার মাখামাখি সঙ্গে বিড়ালটা ও ছাড় পায়নি।
আনায়া হাতে কিছুটা ব্যথা পাই একহাত দিয়ে কোলের উপর বিড়ালটিকে জোরে চেপে ধরে আছে সে যেন পালিয়ে যেতে না পারে। এবার নিজের দিকে তাকায় চুল সম্পূর্ণ কাদায় ভরে গিয়েছে নাক মুখ কুঁচকে বলে,
“বাহ ফ্রি স্পা হয়ে গেল আমার। এখন শুধু মুখে একটা শসা দিলেই পুরো হাইড্রা প্রো ফেসিয়াল হয়ে যাবে।আমার স্কিন তো কাদার মতো গ্লো করবে হুহু। ”

বিড়ালটা নির্বিকার মুখ নিয়ে আনায়ার দিকে তাকিয়ে আছে।আনায়া ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় বিড়ালটিকে কোলে নিয়ে তারপর নাক সিটকে বলে উঠে,
“শয়তানের চ্যালা তোর নামে প্রাণী মামলা করব আমি দেখে নিস।তুই বড্ড অবাধ্য একটু পোষ মেনে গেলে কি ক্ষতি হতো শুনি?”
এরই মধ্যে হঠাৎ একে ভারী পুরুষলী কন্ঠ শুনে আনায়া,
“বিড়ালকে পরে পোষ মানাবি আগে নিজে মানুষ হ বেয়াদব।”

কিছুটা চমকে চোখ তুলে তাকায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ আটকে যায় সামনে থাকা সুদর্শন পুরুষের ওপর। আনায়া ইউভানের পা থেকে মাথা অব্দি একবার পরক করে তৎক্ষণ থমকে যায় সে সাথে তার হৃদস্পন্দন ও। ইউভানের পরনে ব্লাক কালারের স্যুট প্যান্ট, যা ফর্সা শরীরে দারুন ভাবে মানিয়েছে। স্যুটের ভেতরে ব্লাক শার্টটের দুইটা বোতাম খোলা ফর্সা গলার আডামস অ্যাপল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।আনায়া ফ্যল ফ্যল চোখে ইউভানের উন্মুক্ত গলার দিকে চেয়ে রইল। স্যুট কিছুটা ফিটিং হওয়ায় বুকের পেশী এবং চওড়া কাঁধের গঠন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যা কাউকে ঘায়েল করে দেওয়ার মত।
হাতে গোল্ডেন ওয়াচ চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। স্যুটের উপর বুকের ডান পাশে ডায়মন্ডের ডিজাইনার Signet brooch লাগানো। আনায়া এক মুহূর্তে সকালের ঘটনা ভুলে গেল।সে নির্লজ্জের মতো বিরবির করে,
” এই বুইড়া খাটাস ফকস্টারকে তো হেব্বি ড্যাশিং লাগছে। এত সাজগোজ করেছে কেন দেখে মনে হচ্ছে কোন মুভির শুটিংয়ে যাচ্ছে হুহুহু।”

এরই মধ্যে ইউভান জোরে ধমক দেয় সঙ্গে সঙ্গে আনায়া কিছুটা কেঁপে ওঠে,
“থাপড়িয়ে গাল লাল করে দেব অসভ্য মেয়ে সারা শরীরে এভাবে কাঁদা মেখে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
আনায়া এবার চোখ নামিয়ে নিজের দিকে তাকায় সত্যি তো তার সমস্ত শরীরে কাদা মেখে একাকার। কি বিশ্রী দেখাচ্ছে ইশশশশ।আনায়া কাঁদো কাঁদো ফেস করে এক হাত দিয়ে শরীরের কাঁদা উঠানোর চেষ্টা করতে থাকে। সেটা দেখে ইউভান আর একটু বিরক্ত হয়ে বলে,
“তোকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো অভিজাত গৃহপালিত প্রাণীকে জঙ্গলে ছেড়ে দিলে যেমন হয়, ধীরে ধীরে সে তার আসল বন্য রূপে ফিরে আসে। তোর ও ঠিক একই অবস্থা। একেবারে ছাড় দিয়ে দিলে জংলি বানরের রূপ নিতে বেশি সময় লাগবে না।”
আনায়া হাঁ করে তাকিয়ে রইল। ইউভান যে তাকে উচ্চমানের অপমান করছে সেটা সে ভালো মতোই বুঝতে পারছে।তার নিজের উপর বড্ড রাগ হচ্ছে।এই অবস্থায় তাকে ইউভানের মুখোমুখি পরতে হলো?সে এবার অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বল উঠলো ,

“আপনি এমন কেন করেন ইউভান ভাই? একদমই মিষ্টি কথা বলতে পারেন না আামার সাথে।সকালে ও আমাকে শুধু শুধু ধমক দিলেন।”
ইউভান ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
“আমি তোর সাথে মিষ্টি কথা বলব কেন?”
“কেন আপনি তো অন্যদের সাথে ভালোভাবে কথা বলেন আমার সাথেই শুধু ঝাড়ি মারেন।”
ইউভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ায়,
“তুই অন্যদের মতো স্বাভাবিক হলে আমারও তোর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে সুবিধা হতো। কিন্তু তুই তো নিতান্তই একটা গর্দভ।”
সঙ্গে সঙ্গে আনায়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। তার জানের প্রাণের ফুসফুসের ইউভান ভাই তাকে গর্ধব বলছে এটা সে কিভাবে মেনে নিবে।অষ্টাদশীর কোমল নড়বড়ে হৃদয় পুনরায় ভেঙে যায়। সে গাল ফুলিয়ে ছল ছল নয়নে ইউভানের দিকে তাকায়। ইউভান ও সরু চোখে তাকালো অষ্টাদশীর কাদামাখা মুখোশ্রীর দিকে। সপ কিছুটা চাপা ঠান্ডা কন্ঠে শুধালো,

” তুই কি ভেতরে যাবি নাকি তোর কলিজা টা টেনে ছিড়ে তোর হাতে এনে দিব কোনটা?”
আনায়ার দম আটকে আসে মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হয় না। কথাগুলো কেমন যেন গলায় আটকে আসছে অভিমানে, কষ্টে, কান্নায়। বিড়ালকে আরো জোর করে কোলে আঁকড়ে ধরে মুখ ফুলিয়ে সামনে হাঁটা ধরে। ইউভান সেদিকে একনজর তাকিয়ে তারপর গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। আনায়া এবার সদর দরজার সামনে এসে থেমে ইউভানের যাওয়ার দিকে উঁকি মারে। হঠাৎ তার চোখ যায় জানালার গায়ে ঠেকে থাকা থাই গ্লাসের উপর তৎক্ষণ নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তার অন্তরটা কেঁপে ওঠে।পুরো মুখ কাদায় লেপটে আছে তাকে কোন জংলি ভূতের থেকে কম কিছু লাগছে না। আনায়া কাঁদো কাঁদো ফেস নিয়ে বলে উঠে,
“ছি আরু ছি তোকে কি বিশ্রী দেখাচ্ছে একবার জংলি পেত্নীদের মত। আর কোথায় ইউভান ভাইকে কি হ্যান্ডসাম ড্যাসিং লাগছে, আমার সঙ্গে তাকে একটুও মানাবে না। এভাবে ইউভান ভাইয়ের সামনের গিয়ে নিজের মান ইজ্জত সব পানিতে ডুবে আসছি ইশশশ।”

কষ্টে দুঃখে আনায়ার চিৎকার দিয়ে কান্না করতে ইচ্ছা করছে। সত্যি কি আনায়া ইউভানের মনে জায়গা পাবে?এই ছন্নছাড়া অগোছালো মেয়েটাকে কি ইউভান মেনে নিবে?নাকি সে শুধু মরীচিকার পেছনে দৌড়াচ্ছে?হঠাৎ অষ্টাদশীর হৃদয় বিষন্নতায় ভরে ওঠে কাউকে পাওয়ার আকুলতায়, আবার না পাওয়ার দুঃসহ কষ্টে।আনায়া মনে মনে আওড়াতে থাকে, “আপনি আমার কাছে ধোঁয়াশার মতো ইউভান ভাই। কি করলে পাবো আপনাকে নিজের করে সারা জীবনের জন্য?”
এমন সময় মনের গভীরে কোথাও একটা সুর বাজতে শুরু করে। একরাশ বেদনা আর অতৃপ্তির আবেগে ধীরে ধীরে পা বাড়ায় বাসার ভেতরের দিকে।পিছন ফিরে যেতে যেতে ফিসফিস করে গানটা গাইতে শুরু করে আনায়া,
❝ ওহে কী করিলে বলো পাইব তোমারে 🎶
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে 🎶
ওহে এত প্রেম আমি, কোথাও পাবোনা 🎶
এত প্রেম আমি, কোথাও পাবোনা 🎶
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে🎶❞

আমেরিকা, নিউইয়র্ক সিটি
আলিসা চোখ মেলে দেখে ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁইছুঁই। জানালার বাইরে বরফ গলছে একটু একটু করে।চোখ কচলে উঠে দাঁড়াল সে। ওয়্যারড্রোব খুলে ড্রেস বের করে ওয়াশ রুমে গেল ফ্রেশ হতে। এমনিতেও ভার্সিটিতে আজকে অনেকটাই লেট হয়ে গিয়েছে।ফ্রেশ হয়ে ব্যাগে গুঁজে নিলো ল্যাপটপ।এইডন তার ভাই এখনো ঘুমিয়ে আছে।আলিসা যাওয়ার আগে তার ভাইয়ের কপালে আলতো করে চুমু খেলো। নিচে নামার আগেই সিঁড়ির মাথা থেকে নিচের লিভিং রুমের দিকে নজর বুলালো আলিসা। সৎ মা যদি নিচে থাকত, তাহলে তার যাওয়া হতো না ভার্সিটি। তবে আজ লিভিং রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা। আলিসা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ল।তাদের বাসার গাড়ি আছে কিন্তু সেই গাড়ি শুধু তার সৎ বোন ফ্লোরার জন্য বরাদ্দ।আলিসা রোজ হেঁটে ভার্সিটিতে যাওয়া আসা করে।ভার্সিটিতে পৌঁছে ক্লাসরুমের দিকে এগোয় সে। জেনি তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী, ইতিমধ্যে ক্লাসে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। আলিসা প্রতিদিনের মতোই জেনির পাশে গিয়ে বসে পড়লো।জেনি আলিসাকে দেখে কপাল কুঁচকিয়ে প্রশ্ন করল,

“আজ তোর স্কিন এতটা গ্লো কেন করছে আলিসা বেবস?”
আলিসা হাত থেকে নোটবুক টা রেখে অবাক হয়ে বলল,
“মানে? আমি তো নিত্যদিনের মতো এসেছি। তুই আলাদা কি দেখলি আমার মধ্যে আজ?”
জেনি আলিসার গা ঘেষে বসে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল,
“আছে! আছে! আজ তোর মুখের রং অন্যরকম লাগছে আমার কাছে।সত্যি করে বলতো তুই কী আবার প্রেমে পড়েছিস নাকি?”
আলিসার চোখ বড় বড় হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে।সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিচু গলায় উত্তর দিল,
“হয়তো তুই ভুলও বলিস নায়। কিন্তু এটা প্রেম না।”
জেনি কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“প্রেম না? তাহলে কি?
আলিসা জানালার দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে বলল,
“এটা নিষিদ্ধ আকর্ষণ! একরকম টান যা আসক্তির মতো।”
জেনি আরও কাছে এগিয়ে আসে, কণ্ঠটা হালকা করে বলে,
“কার প্রতি আলিসা? প্লিজ বল।”
আলিসা মুখ ঘুরিয়ে জেনির পানে তাকায়।তারপর গম্ভীর কন্ঠে শুধায়,
“যার নাম মুখে আনাও বিপজ্জনক জেনি।যার দিকে তাকালেই আমার শরীর কাঁপে,যার প্রতি তীব্র টান আমার।”
“কে সে?”

আলিসা প্রস্তুত হয়ে জেনির কথার উত্তর দিতেই যাবে তার আগে ক্লাসরুমে স্যার প্রবেশ করে। সবাই মুহূর্তেই উঠে দাঁড়াই।আলিসা কথাগুলো গিলে ফেলে ক্লাসে মনোযোগী হয়।তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ করতে হবে কারণ আজ তার অনেক কাজ ভার্সিটি শেষে।কাল রাতে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আলিসা জেনেছে যে ক্যাসিনো আজ সন্ধ্যায় The Ritz-Carlton, Los Angeles ক্লাবে উপস্থিত থাকবে।আলিসা আজ মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে যে করেই হোক ক্যাসিনোর সাথে দেখা করবেই। তার এই আকর্ষণ তার পুঁষে রাখা যাচ্ছে না। তাই তো সে আজ ওই ক্লাবে যাবে ক্যাসিনোর মুখোমুখি হতে।ক্যসিনোকে তার অনুভূতি কথাগুলো অজ্ঞাত করতেই হবে আজ।আলিসা বিমোহিত হয়ে ক্যাসিনো কে কল্পনা করতে থাকল সম্পূর্ণ ক্লাস। এতেই তার অজানা সুখ লুকিয়ে আছে।
ভার্সিটি শেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। ক্লাস শেষ হতেই সবাই ব্যস্ত নিজের পথে।এই ভিড়ের মধ্যেই আলিসা হঠাৎ জেনির হাত ধরে বলল,

“চল আমার সাথে।”
জেনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“কোথায়?”
“সারপ্রাইজ।”
জেনি কিছু বুঝে উঠার আগেই আলিসা তার হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে যায় ভার্সিটি গেটের বাইরে।তারপর দুজনই গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি ছুটে চলে শহরের আলো ঝলমলে রাস্তায়।জেনি এবার একটু বিরক্ত নিয়ে বলে ওঠে,
” তুই কি বলবি আমরা কোথায় যাচ্ছি? তুই যদি না বলিস তোকে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিব আমি আলিসা।”
আলিসা জানালার বাইরে তাকিয়ে উত্তর দিল,
” আমার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।”

জেনি সম্পূর্ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।জেনি পুনরায় কোন প্রশ্ন করতে যাবে তার আগে আলিসা চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দিল তাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে থামে বড় ফাইভ স্টার হোটেলের সামনে।আলিসার চোখ মুখে উত্তেজনা খেলে যায়।সে ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামে। জেনি গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে সামনের দিকে তাকায়। মার্বেল পাথরের গায়ে সোনালী অক্ষরে লেখা হোটেলের নাম লেখা। গেটের দুই পাশে স্ট্যাচু, মাঝখানে ওয়াটারফল দেখা যাচ্ছে। জেনি এসব দেখে কাঁপা গলায় বলে,
“এখানে কেন? তোর ভালোবাসার মানুষ ফাইভ-স্টার হোটেলে কি করছে ?”
আলিসা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,
“আগে ভেতরেও তো চল, তারপর দেখতে পাবি।”

আলিসার চোখ জ্বলজ্বল করছে। সে হাত ধরে জেনিকে নিয়ে প্রবেশ করে ভেতরে।হোটেলের ভেতরে পা দিতেই একটা আলাদা জগতে ঢুকে পড়ে তারা।লম্বা মার্বেল পথ, দুই পাশে সোনালি কার্ভড পিলার, ছাদ থেকে ঝুলছে জুয়েল কাটার ঝাড়বাতি।সবকিছু মিলিয়ে রাজকীয় পরিবেশ। একটু সামনে এগোতেই আলিসা আর জেনি দেখতে পাই বড় বড় বিজনেসম্যানরা বসে ড্রিংকস করছে। হঠাৎ জেনি থেমে যায়। একটা জায়গার দিকে একটা দম্পতি খোলাখুলি চুম্বনে মগ্ন।এসব দেখে জেনির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।কেমন যেন গলা শুকিয়ে গেল তার। সে একটু কাচুমাচু হয়ে আলিসার হাত চেপে ধরে বলল,
“আলিসা এই জায়গাটা ঠিক না আমাদের জন্য। দেখ না কী করছে সবাই।”

আলিসা কোন কথার উত্তর দেয় না। তার কারণ অব্দি জেনির কোন কথায় পৌঁছাচ্ছে না। তার চোখ কেবল খোঁজে যাচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি ক্যাসিনো কে।আজ এই পার্টিতে ক্যাসিনো চিফ গেস্ট হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা।এজন্যই তো আলিসার এখানে আসা।জেনি কাচু মাচু হয়ে একসাইডে দাঁড়িয়ে পড়ে।তার আশেপাশের পরিবেশ দেখে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে।হঠাৎই স্টেজের মাঝখানে আলো জ্বলে ওঠে।চারপাশ অন্ধকারে ডুবে যায়। স্টেজ এর উপর এক ব্যক্তি এসে মাইকে ঘোষণা দেয়,
“লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যন আজকের রাতের সবচেয়ে স্পেশাল মুহূর্ত শুরু হতে চলেছে। আজকের চিফ গেস্ট ক্রিষ্টান ক্যাসিনো মুহূর্তেই উপস্থিত হয়েছে আমাদের মাঝে।আমরা একটি গেম এর আয়োজন করেছি।ক্যাসিনো চোখ বন্ধ রেখেই একজন মেয়েকে বেছে নেবেন। যেই মেয়েটির হাতে তিনি স্পষ্টভাবে হাত রাখবেন, সেই হবে আজকের লাকি উইনার। সেই মেয়েটি ক্যাসিনোর সাথে ডান্স করার সুযোগ পাবেন।”

পুরো হলে একসাথে গুঞ্জন উঠল।তখনই স্টেজের পাশে এসে দাঁড়ালো কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি।ব্যক্তিটিকে দেখে আলিসা বুকটা কেঁপে উঠল।ক্যাসিনোর পরনে কালো ব্লেজার পরা, বাদামি চুলগুলো সামনের দিকে এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে,ঠোঁটের কোণে হালকা একরোখা হাসি।যেই হাসি সোজা গিয়ে বিঁধে আলিসার বুকে।আলিসা আরো ভয়ংকর ভাবে আকৃষ্ট হয় ক্যাসিনোর এমন রূপে।তখনই মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়ায় সবাই খুবই আগ্রহী ক্যাসিনোর সঙ্গে ডান্স করার জন্য,কেউ আবার ক্যাসিনোর স্পর্শ পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর।ক্যাসিনোর চোখে একটি কালো স্যাটিন কাপড় বেঁধে দেওয়া হলো।ক্যাসিনো ধীরে ধীরে এক প্রান্ত থেকে হাঁটা শুরু করে। এক এক করে মেয়েদের সামনে এসে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়, তারপর সামনের দিকে এগোতে থাকলো। কারও হাতে স্পর্শ করল না। হঠাৎই আলিসার বুকের ভিতর একটা সাহস জন্ম নেয়।অজানা এক তীব্র আত্মবিশ্বাস তার মনের মধ্যে জেগে ওঠে।সে নিজের অজান্তেই লাইনের ছাড়িয়ে ক্যাসিনোর পিছন বরাবর দাঁড়িয়ে পড়ে। জেনি কিছুটা অবাক হয়।

হঠাৎ ক্যাসিনো থেমে দাঁড়ায়। সে অনুভব করতে পারে তার পেছনে কারোর উপস্থিতি।সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো।আলিসা ক্যাসিনো কে পেছনদিকে ঘুরতে দেখে কিছুটা বিচলিত হলো।তার বুকের ভিতর ঢেউ খেলে যায়।চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই, ক্যাসিনো আলিসার কোমরে আলতো করে হাত রাখে। মুহূর্তে আলিসার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। চারপাশের মেয়েরা হচকচিয়ে ওঠে।চারপাশের মানুষ হাততালি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে।স্পিকারে তখনই ঘোষণা শোনা যায়,
“We have our chosen one!”

ক্যাসিনো চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় আলিসাকে নিয়ে স্টেজে উঠল।মুহূর্তে চারপাশে লাইট নিভে গিয়ে স্টেজে বাতি জ্বলে ওঠে। একটি স্লো বিটের Euphoria-type instrumental মিউজিক বাজছে। প্রথম স্পর্শে ক্যাসিনো আলিসার কোমরের দুই পাশে হাত রেখে আলতো চাপ দেয়।সঙ্গে সঙ্গে আলিসার পিঠটা একটু কেঁপে ওঠে, তার নিঃশ্বাস গলার কাছে আটকে আসে।ক্যাসিনো এক ধাক্কায় আলিসাকে নিজের শরীরের দিকে টেনে আনে।আলিসা আলতো হেসে নুয়ে পরে ক্যাসিনোর বুকে। হ্যাঁ, এটাই তো চেয়েছিল সে!ক্যাসিনোর প্রতিটা ছোঁয়ায় তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে একরাশ আগুন।ক্যাসিনোর এক হাত আলিসার পেটের উপরে, অন্য হাতে ধরে রেখেছে আলিসার কাঁধ।চোখ বন্ধ করে নেয় আলিসা পূর্ণ আত্মসমর্পণের মতো।দীর্ঘ সময় এভাবে ডান্স করতে থাকল তারা।

কিন্তু হঠাৎই মিউজিকের টোন বন্ধ হয়ে গেল।চারপাশে লাইট আবার নিভে গেল, আলিসার শরীর থেকে ক্যাসিনোর স্পর্শ মিলিয়ে যেতে শুরু করে।তারপরেই হঠাৎ করে চারদিক থেকে শুরু হয় হাততালি। কিছুটা ঘাবড়ে যায় সে। মাথা ঘুরে যায় তার মুহূর্তেই। সে ধীরে ধীরে স্টেজ থেকে নেমে আসে। চোখের পলকে ক্যাসিনো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। চারপাশের মানুষের মাঝে ক্যাসিনোর ছায়াও নেই। আলিসা পাগলের মতো চতুর্দিকে ক্যাসিনো কে খুঁজতে থাকলো। হঠাৎই তার মাথায় জেনির কথা ঘুরপাক খেলো। জেনি তো এখানেই ছিল না?তার মনের মধ্যে চাপা একটা শঙ্কা জন্ম নেয়।সে চারদিকে তাকিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলে ওঠে,
“ওহ গড!জেনি মেয়েটা আবার কোথায় হারিয়ে গেল?ও তো কখনো এরকম পরিবেশে আসেনি।”
আলিসার টেনশন হতে থাকে জেনির জন্য। প্রায় আধঘন্টা ধরে সম্পন্ন পার্টি খুঁজে ও ক্যাসিনো এবং জেনিকে পাইনি আলিসা।আলিসা এসেছিল শুধুমাত্র ক্যাসিনোর সঙ্গে মনের কথা বলতে কিন্তু এখানে তার উল্টো হচ্ছে।আলিসা কাউকে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে কি সার্ভেন্টের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

” মিস্টার ক্যাসিনো তিনি কোন দিকে গিয়েছেন বলতে পারবেন?”
সার্ভেন্ট চোখ তুলে আলিসার দিকে তাকায়,তারপর ফিসফিসিয়ে বলে
“স্যার কে ৭০ নাম্বার রুমের দিকে যেটা দেখেছি কিছুক্ষণ আগে, দ্বিতীয় তলায়!”
আলিসার চোখ চকচক করে উঠলো।জেনির কথা মুহূর্ত এই মাথা থেকে বেরিয়ে গেল তার। এটাই বড় সুযোগ ক্যাসিনো কি নিজের মনের কথা বলার।দিকনির্দেশনা অনুসারে আলিসা দ্রুত দ্বিতীয় তলায় উঠে আসে।হঠাৎ করেই একটি দরজার দিক থেকে ভেসে আসে চাপা গোঙানির আওয়াজ।আলিসার শরীর কেঁপে ওঠে।সে চোখ তুলে তাকায় রুমটির দিকে। এই রুমের কথাই তো বলছিল সার্ভেন্ট!আলিসার মনের মধ্যে কু ডাকতে থাকে। সে দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজার ওপাশে কি হচ্ছে সেটা আলিশা জানেনা।কিন্তু তার বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে ক্রমশ। হাত বাড়িয়ে দরজার হাতলে রাখে আঙুল।হালকা করে ধাক্কা দিয়ে দরজাটি খুলে ফেলে।দরজার আওয়াজে ক্যাসিনো সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে হুংকার ছাড়ে,
“হু আর ইউ?”
মুহূর্তে আলিসা কেঁপে ওঠে।ক্যাসিনো ভয়ঙ্কর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আলিসার চোখ যায় বিছানায় নির্মমভাবে বেঁধে রাখা মেয়েটির উপর।মেয়েটি আর কেউ না বরং জেনি!

বাংলাদেশ,
চৌধুরী পরিবারের গাড়িটি বড় ফাইভ-স্টার রিসোর্টের সামনে এসে থামে।ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে আনায়া,রুহি এবং আয়ান নামে।আনায়ার পরনে ব্লাক গাউন, কানে ছোট ছোট দুইটা ডায়মন্ডের এয়ারিং, চুলগুলো কার্ল করে দুই সাইডে দেওয়া, মুখে হালকা মেকআপের প্রলেপ।রুহি হালকা পিংক কালারের গাউন পরেছে,ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক।আয়ান এবার রুহি আর আনায়ার পানে চেয়ে বলে,
“আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি তোরা ভিতরে যা।”

রুহি অন্য দিক মুখ ফিরিয়ে নিল।আনায়া মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁবোধক সম্মতি জানিয়ে রুহিকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ আটকায় চারদিকের জমজমাট পরিবেশের দিকে মৃদু ইংরেজি সঙ্গীত বাজছে, আশেপাশে বড় বড় বিজনেসম্যানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত। আনায়া এবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে কিন্তু তার দৃষ্টি শুধু একজনকেই খুঁজছে ইউভান। আনায়া কিছুটা বিচলিত কন্ঠে রুহিকে খোঁচা মেরে বলল,
“ইউভান ভাই কোথায় রে? আসেনি?”

“আমি তো তোর সঙ্গেই ছিলাম। তাহলে কিভাবে জানব ভাইয়া কোথায় ?”
আনায়া কিছু বলে না বিরক্ত নিয়ে একা একা পুরো পার্টির হলরুম জুড়ে ইউভানকে খুঁজতে থাকে।রুহি মনমরা হয়ে এককোণে বসে পরে।ইদানিং তার মন ভালো থাকে না কারণ পিয়াস।আয়ানের ওমন আচরণের পর থেকে, সে আয়ানের সাথে একটা কথা বলেনি।রুহির হৃদয় বারবার পিয়াসকে খুঁজে কিন্তু পাই না। বিশাল হলরুমে সোনালী ঝাড়বাতির আলো ঝলমল করছে, সারিবদ্ধভাবে বসে থাকা মানুষদের মাঝে ইউভানকে খুঁজে পাওয়া অসাধ্য। অষ্টাদশীর মন ইউভানের জন্য উদ্বেলিত হয়ে আছে।আনায়া তো হার মানার পাত্রী না।সে পুনরায় চারপাশে খুঁজতে থাকলো ইউভানকে।

কাঠের তৈরি লম্বা কনফারেন্স টেবিলের একদম প্রান্তে বসে আছে ইউভান। এক পা অন্য পায়ের ওপর তুলে রাখা, ঠোঁটের কোনে নির্লিপ্ত হাসি, যেন পুরো পৃথিবী তার পায়ের নিচে। সামনের টেবিলের অপর পাশে বসেছে বিদেশি ক্লায়েন্টরা। সব পুরুষ ক্লায়েন্টদের মধ্যে একজন মহিলা ক্লায়েন্টেও উপস্থিত আছে। প্রত্যেকের চোখে স্বার্থ এবং ঠোঁটে ভদ্রতার মুখোশ পরে আছে। চারপাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন অস্ত্রধারী সিকিউরিটি গার্ডএবং প্রেস মিডিয়ার লোকজনরা।ইউভানের ডান পাশে পিয়াস চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে কনফিডেন্ট ভঙ্গিতে।ইউভানের উপস্থিতি সকলের কাছে আশ্চর্যজনক।কারন তারা জানত চৌধুরী পরিবারে আরেক ছেলে আয়ান সাইন করতে আসবে।সেখানে ইউভানকে দেখে উপস্থিত প্রত্যেকের গলার পানি শুকিয়ে যায়। প্রত্যেকটা ক্লায়েন্ট চুপচাপ জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে নিজেদের চেয়ারে। কেউ কারো দিকে তাকানোর সাহসটুকুও করছে না। ইউভানের দিকে চেয়ে কারো কারো কপাল বেয়ে ঘাম গড়াতে থাকে নিঃশব্দে।প্রত্যেকের ইউভানকে এমন ভয় পাওয়ার কারণটা অজানা। এই নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে তাদের মধ্যে প্রধান ক্লায়েন্ট রিচার্ড প্রথমে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,

“আমাদের পক্ষ থেকে সমস্ত নথি প্রস্তুত স্যার। শুধু আপনার সম্মতিই দরকার।”
ইউভান কিছুক্ষণ চুপ রইল। ধীরে ধীরে সে তার আঙুল টেবিলের উপর রেখে কলমটা তোলে। ঠিক তখন মহিলা ক্লাইন্ট ক্লারা হালকা হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
“সাইনটা করে ফেলুন, মিস্টার ইউভান। প্রত্যেকটা ডিলের পেছনে বিশ্বাস আর ভালোবাসা থাকে। আমরাও সেই ভালোবাসার সঙ্গেই ডিলটা কনফার্ম করতে চাই।”
ইউভান কলমটা তুলতে গিয়েও থেমে যায়।চোখ সরু করে, ভ্রু তুলে ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,
“চুক্তিতে যদি ভালোবাসা লাগে, তাহলে তো ব্যাংকে প্রেমপত্র জমা দেওয়া উচিত জামানত হিসেবে তাই নয় কী?বাই দ্যা ওয়ে আর ইউ কলিং মি বাই মাই নেম?ইন্টারেস্টিং! ভেরি ইন্টারেস্টিং!আপনার সাহসের তারিফ না করলে নয়।”

ক্লারা হালকা কেশে ওঠে।তার গলার আওয়াজটা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে, টেবিলের চারপাশে বসা সব মানুষ এক মুহূর্তের জন্য থেমে একে অপরের দিকে চেয়ে উঠল।সে এবার মাথা নত করে নিচু কন্ঠে বলল,
“আই’ম সরি স্যার।”
ইউভান কিছু বলল না নিঃশব্দে তাকালো। ঠিক তখন একজন সিকিউরিটি গার্ড ভিতরে এসে কিছু একটা ফিসফিস করে রিচার্ডের কানে বলল।কথাটি শুনে রিচার্ডের কপাল কুঁচকে উঠল। তার চেহারার ভাবটা বদলে গেল মুহূর্তেই।রিচার্ড এবার সবার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“সাইনটা আমরা একটু পরে করি। আসলে সুইজারল্যান্ড থেকে কয়েকদিন আগে স্পেশাল গেস্ট এসেছিল।আজ এখানে সে ইনভাইটেড তাই তার আাসা অব্দি একটু অপেক্ষা করি আমরা।”
ক্লারা একটু কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে উঠলো,

“স্পেশাল গেস্ট? কে সে?”
এই প্রশ্নটার পর সবার মুখে কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ে। তখনই রিচার্ড হালকা থেমে গভীর কণ্ঠে উত্তর দিল,
“ড্রেভেন হান্টার!”
ড্রেভেনের নামটা শোনা মাত্রই ইউভান অধর প্রসারিত করে হাসল, যেন সে এই নামটাই শোনার অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। কিন্তু ঠিক তখনই ক্লারার ঠোঁটের কোনায় ব্যঙ্গ-হাসিটা মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।কনফারেন্স রুমের ভেতরে বসে থাকা প্রত্যেকটা সদস্য স্তব্ধ হয়ে রইল।একে একে সবার মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল অজানা শঙ্কায়।ক্লারার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরতে শুরু করে।ক্লারার বিষয়টা ইউভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে।।পরক্ষণেই কিছু একটা বুঝে সে সামান্য মাথা কাত করে বাঁকা হাসল।ইউভান ঠান্ডায় দৃষ্টিতে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে রক্তশীতল কণ্ঠে শুধালো,

“সময় কারোর জন্য থামে না,এন্ড আই’ম নোট দ্যা কাইন্ড অফ ম্যান হু ওয়েট।সো সাইনটা আমি এখনই করব।”
সবাই ইউভানের দিকে তাকিয়ে রইল নিঃশব্দে।সবার মুখ থমথমে,কেউ সাহস পেল নাহ কিছু বলার।রিচার্ড ঠোঁট খুলল, হয়তো কিছু বলবে, হয়তো আপত্তি তুলবে কিন্তু তার পূর্বেই ইউভান চাপা রাগে ঝলসে ওঠা চোখে তাকালো রিচার্ডের পানে।রিচার্ড আর একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। ঠোঁট দিয়ে গিলে ফেলল নিজের কথাগুলো।ইউভান আড়চোখে পিয়াসের দিকে তাকাল একবার।পরক্ষণে সামনে এগিয়ে এল পিয়াস।দুটো হাত বাড়িয়ে ধীরে ফাইলটা ইউভানের সামনে রাখল।কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে ইউভান একবার চোখ বুলাল।কলমটি তুলে নিয়ে যখন সে কলমটা ছোঁয়াতে যাবে সাদা কাগজের উপর,সেই মুহূর্তেই কনফারেন্স রুমের দরজাটা খুলে যায় এক ধাক্কায়।ইউভানের হাত থেমে গেল।তখন দরজা থেকে ঠান্ডা হিমশীতল পুরুষলী কন্ঠে ভেসে আসল,

“মে আই কামিং?”
মুহূর্তের মধ্যেই কনফারেন্স রুমের প্রত্যেকটা সদস্যের দৃষ্টি পৌঁছালো সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির উপর।সবার চোখে একসাথে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। চেয়ারে বসে থাকা কয়েকজনের আঙুল কাঁপছে, কারও ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছে এক অস্ফুট আশঙ্কায়।ক্লারার ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে ফাঁক করে,ভয়েজড়িত কন্ঠে উচ্চারিত করল,
“ড্রেভেন হান্টার।”

আর ঠিক তখনই দরজা দিয়ে প্রবেশ করে কয়েকজন শক্তপোক্ত সিকিউরিটি গার্ড। তারা নিঃশব্দে সামনে এসে ড্রেভেন আশেপাশে দাঁড়াল।ড্রেভেনের পরনে কালো স্কিন-ফিট লেদার জ্যাকেট, তার নিচে গাঢ় ধূসর শার্ট।আর তার মুখে আবৃত সেই চেনা পরিচিত ড্রাগন মাস্ক।ড্রেভেন ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো।ইউভান একটিবারও সেদিক তাকালো না বরং তার ঠোঁটের কোনে গোপন হাসি ফুটিয়ে তুলল।ড্রেভেন ধীরে ধীরে টেবিলের দিকে এগিয়ে এল। তখনই একে একে উঠে দাঁড়াতে শুরু করল সবাই।কিন্তু ইউভান সে স্থির হয়ে বসে রইল। ড্রেভেন ইউভানের পানে তাকিয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ঠোঁটে এক হালকা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে সে ধীরে ধীরে সামনের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসল।এরপর ঠান্ডা হিসেবি কণ্ঠে ইউভানের উদ্দেশ্যে বলল,

“স্ট্রেন্জ মিস্টার ইউভান! গেস্টকে ওয়েলকাম এন্ড রেসপেক্ট করার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন আপনার।বাই দ্যা ওয়ে আমাদের আবার সাক্ষাৎ হলো তবুও প্রত্যাশিতভাবে ইন্টারেস্টিং।”
ইউভান ড্রেভেনের দিকে একবারও না তাকিয়ে, টেবিলের উপরে রাখা কাগজটা নিজের দিকে টেনে নেয়। তার চোখে একটুও আগ্রহ নেই, যেন ড্রেভেনের উপস্থিতি তার কাছে মূল্যহীন। কলমটা হাতে তুলে নিয়ে নির্লিপ্তভাবে সাইন করে ফেলে সে। সাইন করতে করতে ইউভান হিংস্র কোমলতায় মোড়ানো কণ্ঠে বলল,
“রেসপেক্ট ইজ আরন্ড, নোট ডিমান্ডেড। আর আমি এমন কাউকে ওয়েলকাম করি না যে অপ্রত্যাশিতভাবে চলে আসে।”
ড্রেভেন হালকা ঘাড় কাত করে তীক্ষ্ণ ও ধারালো চোখে তাকালো ইউভানের পানে।তারপর চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি এনে বলল,
“অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা-সাক্ষাৎ সবসময় খারাপ না মিস্টার ইউভান। অনেক সময় চাপা পড়ে থাকা সত্যগুলো উঠে আসে তখন।”

ইউভানের চোখে হঠাৎ ঘন ছায়া নেমে আসে। চাপা রাগে ঝলসে ওঠা চোখে তাকালো সে।ইউভানের কঠোর দৃষ্টি দেখে তাদের মুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে।রুমের প্রত্যেকটা সদস্য মুহূর্তে নিঃশব্দ হয়ে যায়।এক বাঘ আর এক সিংহ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, আর যে কেউ যেকোন মুহূর্তে থাবা মারতে পারে।এই অজানা আতঙ্কে কেউ নিশ্বাস নিতেও সাহস পাচ্ছে না। সেই মুহূর্তে ইউভান বিদ্রূপে রঞ্জিত কণ্ঠে শুধালো,
“আই হেইট পিপল হু কাম আনএক্সপেকটেড্লি এন্ড কিছু সত্যকে মাটির নিচেই থাকা উচিত।”
মুখ ঢাকা ড্রাগনের মাস্কের আড়ালে ড্রেভেনের অভিব্যক্তি স্পষ্ট নয়।তবে তার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণভাবে সংকুচিত হলো।মুহূর্তেই সে ঠাণ্ডা বিস্ময়ে জমাট বাঁধা কণ্ঠে বলে উঠল,

“ওয়াই? আর ইউ আফরাইড? অপ্রত্যাশিত আগমন সবসময় কিছু না কিছু সঙ্গে নিয়ে যায়। তেমন আমার আগমন ও আপনার জীবন থেকে কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে।সো বি কেয়ারফুল!”
ইউভান চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে টেবিলের উপর হাত রেখে আঙুলগুলো একসাথে চেপে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।ড্রেভেন এহেন ঠান্ডা হুমকিতে তার মুখে ভয়ের বদলে ভয়ংকর হিংস্রতা ফুটে ওঠে।সে ড্রেভেনের পানে তাকিয়ে রক্ত শীতল কন্ঠে আওড়ালো,
“আমি হারানোর ভয় পাই না, ড্রেভেন। আমি ভয় পাচ্ছি তার জন্য, যে আমার কিছু কেড়ে নিতে আসবে। ট্রাস্ট মি, সে কিছু নিয়ে যেতে পারবে না, আফসোস ছাড়া।”

কনফারেন্স রুমে প্রত্যেকটা সদস্য নিঃশব্দে দুজনে ঠান্ডা লড়াই দেখছে। বিশেষ করে ক্লারা ইউভান আর ড্রেভেনকে পর্যবেক্ষণ করছে ভিন্ন দৃষ্টিতে।নিস্তব্ধতা ভেদ করে ড্রেভেন কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার পূর্বে ইউভান আচমকা হাসে।ঠোঁটে একরকম পাগলাটে কাঁপন নিয়ে বলল,
“ওপস! স্যরি! স্যরি! আফসোস নিয়ে ফিরবে কিভাবে? ফিরার জন্য তো শরীরটাই থাকবে না বিকজ আই উইল ব্রেক হিম ইনটু পিসেস, অন বাই অন।”
ড্রেভেন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চিবুকের পাশে হাত রাখে।একপলক ইউভানে এর চোখে চেয়ে বলে,
“আফসোস দুর্বলের জন্য, এন্ড আই নো হাউ টু ডিস্ট্রয়।”
ইউভান ঠোঁটে এক চিমটি হিমশীতল হাসি এনে, কণ্ঠে তীক্ষ্ণ হুঁশিয়ারি টেনে বলল,
“নেক্সট গেট রেডি টু বি ডিসট্রয়েড, মিস্টার ড্রেভেন হান্টার।”

হঠাৎ করেই ড্রেভেনের কাঁধ আর ঘাড়ে হালকা ঝাঁকুনি খেল।কাঁধের কাছ থেকে গরম ধোঁয়ার মতো কিছু একটা ছড়িয়ে পড়লো শরীরে। তড়িৎ বেগে ড্রেভেন উঠে দাঁড়িয়ে গা ঝাড়া দিয়ে নেয়।মুহূর্তেই টেবিলে বসা প্রতিটি সদস্য বিনম্র শ্রদ্ধায় উঠে দাঁড়ালো।কিন্তু ইউভান?সে একটুও নড়ল না। বসেই রইল, এক হাত টেবিলের কিনারায় রাখে অন্য হাতে রিভলভিং চেয়ারের হালকা ঘূর্ণিতে নিজেকে এগিয়ে-পিছিয়ে নিচ্ছে।যেন ড্রেভেনের দাঁড়ানো তার কাছে কিছুই এসে যায় নাহ। ড্রেভেন পেছনে ফিরে বের হওয়ার আগে থেমে পেছন ফিরে বলল,
“আপনি আমার থেকে অনেক ধাপ পিছিয়ে রয়েছেন মিস্টার। আমাদের আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই।”
ইউভানের ঠোঁটের ঠান্ডা নির্মম হাসি খেলে যায়। সে এবার ঠোঁট চেপে ধরে নিচু স্বরে বলে,

“সব সময় এগিয়ে থাকা মানেই জেতা না। অনেক সময় পেছনে থাকলেই সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায়, আপনার পতনটাও।”
ড্রেভেনের কোন অভিব্যক্ত দেখা গেল না।সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, হিমশীতল কন্ঠে উত্তর দিল,
“অল দ্য বেস্ট!”
বলেই ড্রেভেন সেখান থেকে প্রস্থান করে।কারণ সে বুঝতে পারছে তার শরীরে ভারসাম্য ঠিক নাই।তারপর একে একে সকলে আবার বসে পড়ে।ইউভান বাড়তি কথা ব্যয় না করে পুনরায় মিটিংএর অবশিষ্ট কার্যক্রম সম্পন্ন করে।

অপরদিকে আনায়া ইউভানকে খুঁজতে খুঁজতে ধীরে ধীরে উঁচু লাল কার্পেটের পথ ধরে উঠে দ্বিতীয় তলায়। চারদিকে চোখ বুলাই সে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু চারদিকে বড় বড় রুম ও দরজা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। আনায়া চারদিক হাঁটতে থাকে একেবারে নিরব। একপর্যায়ে এসে কোনদিকে যাবে বুঝতে পারে না। আনায়া ঘাবড়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“এইরে কোথায় এসে পড়লাম কোন দিক যাবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আল্লাহ পথ দেখাও এখান থেকে বের কর আমাকে উফফ।”
পা টিপে টিপে হাঁটতে থাকে সে। এক মুহূর্ত এসে আনায়া আর ঠিক করতে পারে না কোন দিক যাবে।সে পেছনদিকে ঘুরতে যাবে ঠিক তখনই সজোড়ে কারো সাথে ধাক্কা খায়।ফলস্বরপ আনায়ার গলা থেকে সামান্য আর্তনাদ বেরিয়ে আসে,
“আউচ।”
চমকে উঠে সে এক লাফে ঘুরে দাঁড়ায়।ততক্ষণ তার দৃষ্টি পড়ে উল্টো দিকে ঘুরে থাকা একজন দীর্ঘদেহী ব্যক্তির উপর।আনায়া তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,

“সরি!সরি! আমি সত্যি দেখতে পাইনি।”
তবে অপর পাশের ব্যক্তিটি কোন আওয়াজ আসে না, ব্যক্তিত্ব আর কেউ না বরং ড্রেভেন।ধাক্কার তীব্রতায় তার মাস্কটি নিচে পড়ে যায়।ড্রেভেন কিছুটা নিচে হয়ে মাস্কটি হাতে তুলে নেয়।আনায়া কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।তারপর ডান হাতটি দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়ে, পিছন ফিরে আনায়ার দিকে এক ঝলক তাকায় ড্রেভেন।
মুহূর্তেই আনায়ার শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠে।তার দৃষ্টি আটকে যায় পুরুষটির নীল চোখে।আনায়ার ভ্রুযুগল সামান্য পরিমাণ সংকোচিত হয়। এই চোখ আনায়ার বড্ড পরিচিত।আনায়ার মনে হলো সেই চোখ আগেও কোথাও দেখেছে কিন্তু, ঠিক কোথায় মনে করতে পারছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে খুব কাছের, খুব আপন কারও চোখ।আনায়া বিচলিত কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে তার পূর্বেই ড্রেভেন পেছন ফিরে মাস্কটি পরে
একটুও না দাঁড়িয়ে সামনে হাঁটা দেয়।হাঁটার সময় ড্রেভেনের চোখ মুখে অস্থিরতা ফুটে ওঠে। সে এক হাত দিয়ে মাস্কটি পুনরায় ঠিক চেহারাটা আড়াল করে নেয়।

আনায়া স্থির দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।তার হৃদয়ের গহীনে অজানা উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে।আনায়া অন্যমনস্ক হয়ে ধীরে ধীরে পিছিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটি বড় দরজার সঙ্গে ধাক্কা খায়, সাথে সাথে দরজাটি খুলে যায় আর আনায়া হুমরি খেয়ে পড়ে কনফারেন্স রুমের ভেতরে। তৎক্ষণে চারদিকে ঝলসে উঠে আলোয় ফ্ল্যাশ ক্যামেরার পরপর ঝলকানি, প্রেস মিডিয়ার উপস্থিতি। আনায়া আতঙ্কে দুই হাতে চোখ ঢেকে ফেললো। এত আলো যে চোখ মেলে তাকানো দুষ্কর। পুরো কনফারেন্স রুমে সকলের মাঝে বিস্ময়ের ঢেউ বয়ে যায় সাথে সাথে। সবার চোখ আনায়ার উপর।

আনায়া ধীরে ধীরে এবার চোখ মেলে তাকায় সামনে, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে তার কলিজাটা শুকিয়ে আসে। কারণ ইউভান ঠিক কনফারেন্স টেবিলের কেন্দ্রস্থলে বসে তার দিকে রক্ত লাভা চোখে তাকিয়ে আছে। ইউভানের কানে আসে চারদিকের মানুষের কথোপকথন, কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে বলছে মেয়েটা তো একেবারে পরীর মত সুন্দর।ইউভানের চোখ রাগে লাল হয়ে ওঠে সে এবার আনায়াকে পা থেকে মাথা অব্দি একবার পর্যবেক্ষণ করে। তৎখান তার মুঠি শক্ত হয়। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় রাগে। ইউভান উঠে দাঁড়িয়ে আনায়া দিকে এগোয়। চারদিকে ফিসফাস, চাপা গুঞ্জন প্রেস মিডিয়ারা সবার কেন্দ্রিক দিক এখন আনায়া। ইউভানকে এভাবে কোথায় দেখে আনায়ার কলিজার পানি শুকিয়ে আসে, সে ভয়ে এক পা পিছায়। কিন্তু ইউভান আকস্মিক আনায়ার হাত খপ করে ধরে নিমিষে বেরিয়ে নিয়ে আসে কনফারেন্স রুম থেকে। কনফারেন্স রুমের সবাই এমন দৃশ্য দেখে একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওরি করে।কেউ বুঝে উঠতে পারল না মেয়েটির সাথে ইউভানের কী সম্পর্ক!

অপরদিকে,
ইউভান প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে আনায়াকে টেনে ছাদে নিয়ে আসে। ছাদে পৌঁছানোর সাথে সাথে ইউভান আনায়াকে ঠেলে দেয়। আনায়া টলমল করে দু’পা পিছায়। ইউভানের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে, কপালের রগ দপদপ করছে, চোখদুটো লালচে আগুনের মতো জ্বলছে। সে এক পলকও চোখ সরাচ্ছে না আনায়ার উপর থেকে।আনায়া ভয়ে ফিসফিস করে বলে উঠে ,
” ইউভান ভাই প্লিজ আমি ইচ্ছা করে কিছু করিনি। সত্যি বলছি আমি তো আপ…..
ইউভান আনায়ার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বজ্রের মতো গর্জে ওঠে,
“চুপ! একদম চুপ। কলিজাটা টেনে ছিড়ে দি? ওটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে তোর।”
আনায়া কেঁপে ওঠে।তার দুই বাহু এমন শক্ত করে চেপে ধরেছে যে ব্যথায় সে চোখ বন্ধ করে ফেলে।কিন্তু পর মুহুর্তে কিছু একটা মনে পড়ায় আনায়া চোখ মেলে তাকাল।সোজা তার দৃষ্টি আটকালো ইউভানের নীল চোখের মনির দিকে।আনায়া সম্পূর্ণ আশ্চর্য হয়!দুইটা ব্যক্তির চোখে এত মিল কিভাবে থাকতে পারে? আনায়ার মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ আগের কথা যার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল সে ব্যক্তি তার চোখও ঠিক ইউভানের মতো নীল।আনায়ার মাথার উপরতে যাচ্ছে সব, কিছু একটার হিসাব সে মিলাতে পারছে নাহ।ইউভান আর ওই ব্যক্তিটার চোখের এত মিল কিভাবে হতে পারে এটাই ভাবতে থাকল সে। তার এই ভাবনার মাঝে,ইউভান পুনরায় কর্কশ কণ্ঠে বলে ওঠে,

“তুই কোন সাহসে ওখানে গিয়েছিলি?কোন সাহসে? তোকে নিষেধ করেছিল না আয়ান ? তোর কি এতটাই শখ? নিজেকে দেখানোর এত শখ?তুই কি জানিস ওখানে কতগুলো পুরুষের চোখ তোকে দেখছিল? ওরা তোর শরীর দেখছিল, তোর চেহারা দেখছিল। খুব ভালো লাগছিল তোর তাই না?!”
আনায়া ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।তবুও সে নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আপনি যা ভাবছেন তা একদমই না, প্লিজ বিশ্বাস করুন।”
ইউভান কোনোকিছু শোনার মুডে নেই। রাগ যেন এক মুহূর্তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। হঠাৎই সজোড়ে একটা চড় বসিয়ে দেয় আনায়ার গালে। আনায়া এক হাত দিয়ে গালটা চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ইউভানের দিকে।ইউভানের এহেন আচারণ তার হৃদয়ে গিয়ে আঘাত হানল। তখনই তার মাঝে জন্ম নিল ভয়ংকর রাগ।ইউভানের প্রতি ক্ষোভ জন্ম নিল আনায়ার হৃদয়ে।সে দুই হাত দিয়ে ইউভানকে ধাক্কা মেরে, কর্কশ গলায় বলে উঠল,

“আপনার সাহস হয় কীভাবে আমাকে চড় মারার? কোন অধিকার নিয়ে আপনি আমাকে স্পর্শ করলেন?আমাকে স্পর্শ করার কোন অধিকার নেই আপনার বুঝলেন?”
ইউভানের ক্রোধে চল শক্ত হলো।আনায়ার রাগী মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে ইউভান হুইস্কির কন্ঠে বুলি আওড়ালো,
“তোকে স্পর্শ করার জন্য যদি আমাকে কাগজ-কলমে স্বাক্ষর করতে হয়, তবে জানে রাখ সে চুক্তি আমি বহু পূর্বে কলমের আঁচড়ে সীলমোহর করে রেখেছি।তুই আমার…”
আনায়া ইউভানের অনুমতি তোয়াক্কা না করে, একহাত উঁচু করে ইউভানের কথা থামিয়ে দেয়।আজ আনায়ার সাহস পর্যায়ক্রমে একটু বেশি বেড়ে গিয়েছে।ইউভান সেটি লক্ষ্য করে অন্যদিকে ফিরে হাসল।সেই মুহূর্তে আনায়া চোখে জ্বলে ওঠা আগুন নিয়ে,
“আমি আপনার কী?বলে দিন আজ স্পষ্ট করে,

আপনার কি কোনো কাগজ আছে যেটা প্রমাণ করে আমি আপনার কিছু?কারণ আপনি যেভাবে আঘাত করলেন, তাতে মনে হলো আমি আপনার সম্পত্তি।আমার যা খুশি আমি তাই করবো, আপনি বাধা দিতে পারেন না।”
ইউভান নিঃশব্দে এক ঝাটকায় আনায়ার কোমোড় আকড়ে ধরে মিশিয়ে নেয় নিজের সঙ্গে।আনায়ার চোখ কোটার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম।ইউভানের স্পর্শে আজ ভালোলাগার পরিবর্তে রাগ হচ্ছে, কারণ বিনা কারনে ইউভানের গায়ে হাত তোলা তার একেবারে অপছন্দ। তখনই ইউভান কিছুটা ঝুঁকে হিশহিশিয়ে বলল,
“তোর কি মনে হয় তুই যা খুশি তাই করবি? তোর কি মনে হয় তোর এই সৌন্দর্য অন্য কেউ দেখবে, আর আমি সেটা মেনে নেব? আমি তোর শরীরের প্রতিটা ইঞ্চির মালিক। আমার অনুমতি ছাড়া তোকে দেখার অধিকার কারোর নেই যে দেখবে তাকে পুড়িয়ে দিব।আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ তোকে স্পর্শ করতে পারবেনা বুঝলি?”

আনায়া চমকে ওঠে, অবাক চোখে ইউভানের পানে তাকায়। তার মনে প্রশ্ন উঠতে থাকে সে কেন ইউভানের নিয়ন্ত্রণে চলবে? কেন তার সব কিছু ইউভানের ইচ্ছের উপর নির্ভর করবে? কেন সে অন্য কাউকে স্পর্শে আসতে পারবে নাহ? স্পর্শের কথা মনে হতেই, আনায়ার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে পুরনো কথা,ইউভান তাকে বলেছিল যে সে তার জীবনের দ্বিতীয় নারী, যাকে সে স্পর্শ করেছে।আনায়ার নিশ্বাস আটকে আসে মুহূর্তেই।তার মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকে হাজারো রকম। ইউভান তাকে অন্য কারো স্পর্শে আসতে মানা করেছে, তাহলে কেন ইউভান অন্য কাউকে স্পর্শ করবে? তার মাথায় ঝড়ের মতো চিন্তা বয়ে চলে। সে নিজেই যদি স্পর্শে নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে ইউভান কেন অন্য কাউকে স্পর্শ করবে?আনায়ার মধ্যে এক অজানা রাগ ও ক্ষোভ উদিত হয়।সারা শরীরের রক্তচাপ বেড়ে যেতে শুরু তার। দাঁতে দাঁত চেপে, রেগে গিয়ে বলে ওঠে,

“আমার যদি অন্য কাউকে স্পর্শ করা নিষিদ্ধ থাকে, তবে আপনি কেন আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে স্পর্শ করবেন? আপনি তো বলেছিলেন যে আমি আপনার জীবনের দ্বিতীয় নারী,তাহলে প্রথম নারী কে ইউভান ভাই?”
ইউভান এই কথাগুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় কিছুক্ষণ।তখনই ইউভানের চোখের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত অস্থিরতা ফুটে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের রং পাল্টে গেল, মুখের পেশি শক্ত হয়ে গেল ক্রোধে।মুহূর্তেই ইউভান আনায়াকে দুই হাতে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিল।ফলে আনায়া টাল সামলাতে না পেরে কিছুটা হেলে পড়ে, চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার।কিছু বুঝে উঠতে পারল নাহ আনায়া।তৎক্ষণ নীরবতা ভেদ করে ইউভান নিজের সমস্ত রাগ ও ক্ষোভ ঢেলে দিয়ে গর্জে উঠলো,

“এই মুহূর্তে বেরিয়ে যা,গেট আউট! এক সেকেন্ডও তো কেমন চোখের সামনে দেখতে চাই না।জাস্ট গেট লস্ট!”
আনায়া নিঃস্ব ক্লান্ত চোখে তাকালো,তার হৃদয়ের মধ্যে অজানা কষ্ট বয়ে যাচ্ছে। ইউভানের এই প্রত্যাখ্যান তার ভিতরকার কোমলতাকে ভেঙে দিল।আনায়ার কেন জানি মনে হলো,ইউভান শুধু তার প্রথম নারীকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে আর তাকে নিয়ে খেলছে। আনায়া আর সেখানে না দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু কিছু একটা ভেবে তার পা থামিয়ে দাঁড়াল। পিনপিনে নিরবতার মাঝে আনায়া আলতো হেসে হাহাকার মিশ্রিত কণ্ঠে ইউভানের উদ্দেশ্যে শুধালো,

“আমি আপনার চোখের সামনে কখনো আসবো না ইউভান ভাই।”
আনায়ার চোখ দিয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়ালো। বাড়তি কিছু না বলে সেখান থেকে প্রস্থান করে আনায়া। আনায়ার যাওয়ার পর মুহূর্তে ইউভান চাপা নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকালো।ঘাড়ে রক্ত ফুলে উঠেছে, চোখ দুটি অস্বাভাবিকভাবে জ্বলছে ইউভানের। চুলগুলো অগোছালো হয়ে পড়েছে কপালের উপর। সে তার হাতটা শক্ত করে ছাদের রেলিংয়ে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের রাগ এবং যন্ত্রণাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে রেলিংয়ের ওপর হাত দিয়ে সজোড়ে কয়েকটা কিল মারল। ইউভানের কানে বারবার বাজছে আনায়ার বলা শেষ কথা: “আমি আপনার চোখের সামনে আর কখনো আসবো না।” হঠাৎই ইউভানের হৃদয়ে যেন ঢক করে উঠল।

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৪

এটি মনে পড়তেই সে বিচলিত হয়ে উঠলো, তৎকালেই উদ্বিগ্ন হয়ে ছাদ থেকে নামল ইউভান। দুই-তিন মিনিটের মধ্যে আনায়া বেশি দূর যেতে পারবে না, কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো আনায়া এক মিনিটের মধ্যে উদাও! ইউভান চিন্তিত হয়ে তাকাল, ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়ির পাশে আনায়ার গলার লকেট পড়তে দেখে সে।ইউভান সেটি হাতে তুলে নিয়ে দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকালো। হঠাৎ তার কপালে ভাঁজ পড়ে কিছু একটা ঠিক নেই।হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় পকেট থেকে হেডফোন বের করে কানে দেয় ইউভান।তৎক্ষণ অপর পাশ থেকে এমন কিছু শোনে সঙ্গে সঙ্গে ইউভানের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। তার পুরো শরীর শক্ত হয়ে যায়। পরক্ষণেই ইউভান ক্ষিপ্র আগুনে জ্বলন্ত কণ্ঠে গর্জে উঠলো,
“ওহ শিট!শিট!ড্যমন!ফাকিং ম্যন!আমার সানসাইনের শরীরে যদি একটুও আঁচ লাগে, তোদের জ্যান্ত কবর দিয়ে রাখবো আমি।”

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৬