আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৬
প্রীতি আক্তার পিহু
ইউভানের নিশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে,চোখ দুটো জ্বলছে রাগে। এক মুহূর্তও দেরি না করে সে রিসোর্টের বাইরে বেরিয়ে আসে। চারদিক শুনশান, সবাই রিসোর্টের ভেতর পার্টিতে মত্ত। শুধু কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা আছে। ইউভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে। সে এক মুহূর্তও দেরি না করে গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরে। গাড়ির চলতে শুরু করে,প্রচণ্ড বেগে গাড়ি ছুটতে থাকে রিসোর্ট এর মেইন গেটের দিকে। ইউভান একবারও গতি কমায় না। গাড়ির সামনের বাম্পারে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে গেটটা বিকট শব্দে ভেঙে পড়ে রাস্তায়।ইউভান একপলক রিয়ার ভিউ মিররে একবার রিসোর্টের দিকে তাকায়।মুহূর্তেই তার চোখের সামনে কনফারেন্স রুমে আনায়ার দিকে সেই বাজে দৃষ্টিতে তাকানো মুখগুলো ভেসে ওঠে।ইউভান বাঁকা হেসে পকেট থেকে ছোট্ট রিমোটটা বের করে লাল বোতামটায় চাপ দেয়।
ধববববববব!প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে আকাশ ফেটে পড়ে। পুরো রিসোর্ট মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখায় ঘিরে ফেলে।পুরো রিসোর্ট জুড়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে। চারদিকে মানুষের চিৎকার, আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি। রিসোর্টের প্রতিটি কোন ঘন ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে যায়। গাড়িগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে।ইউভান গাড়ি চালাতে চালাতে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখল সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য। সঙ্গে সঙ্গে ইউভানের অধর খানিকটা প্রসারিত হলো। কারণ ওই কনফারেন্স রুমে একটি বোম ফিট করা ছিল যেটা আর কেউ না বরং ইউভান করেছে। ইউভান একহাতে স্টিয়ারিং ধরে, আরেক হাতে পকেট থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করে। হুইস্কির বোতলের ঢাকনাটা খুলে গলা উঁচু করে ঢক ঢক করে পুরো বোতলটা শেষ করে ফেলে সে।তারপর খালি বোতলটা সে জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।এরপর ঠান্ডা শীতল কণ্ঠে আওড়ালো,
“তোর জন্য হাজারো সাম্রাজ্য এভাবে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে পারি আমি সুইটি।জাস্ট ফর ইউ!বিকজ ইউ আর মাইন অনলি মাইন!”
সেই মুহূর্তে আনায়ার কথা স্মরণে আসতে ইউভানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। মুহূর্তে সে গাড়ির স্পিড কয়েক গুণ তীব্র করে ফোনে কাউকে এসএমএস দিল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঘুটঘুটে অন্ধকারে পুরোনো গোডাউনের মেঝেতে নিথর পড়ে আছে আনায়া। তার চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। ফিকে আলোয় আনায়ার মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছে সজ্ঞানে নেই সে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মুখোশধারী ব্যক্তি। ব্যক্তিটি আনায়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। থমথমে পরিবেশের মধ্যে ভারী শ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না।ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে আনায়ার দিকে এগিয়ে আসল। তারপর এক হাত দিয়ে নিজের মুখোশটি খুলে ফেলে।মুহূর্তেই এক ঝাঁক চুল মাজা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।ব্যক্তিটির চেহারাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সে আর কেউ না বরং ক্লারা।ক্লারায় আনায়াকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে এখানে তার লক্ষ্য পূরণের জন্য।ক্লারা হালকা হেসে মাথা কাত করে আনায়ার দিকে ঝুঁকে আসে। তার ঠোঁটের কোণে পাপিষ্ঠ হাসি খেলে যায়। হঠাৎ করেই সে ঠান্ডা বিদ্রুপপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠল,
“এবার তোমাকে কে বাঁচাতে আসবে জানো? ড্রেভেন হান্টার!”
পরমুহূর্তে এক ঝটকায় পেছনে সরে এসে উচ্চস্বরে হেসে উঠল সে।আনায়ার পানে তাকিয়ে পুনরায় অসভ্য ভঙ্গিতে বলতে থাকলো,
“কোথায় তোমার সেই পাগলা প্রেমিক হুম? এখনও তো এল না? সো স্যাড আনায়া।”
আনায়া নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করে আছে। ক্লারা আবার নিজের হাতের ঘড়ির দিকে তাকায়, ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
“সময় কিন্তু ফুরিয়ে যাচ্ছে ডার্লিং।কোথায় তোমার রোমিও? আরেকটু পরে তো তোমার প্রাণ বাঁচানোরও দরকার থাকবে না।”
সে হাঁটাহাঁটি করে। আচমকা আনায়ার মুখের সামনে বসে ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে,
“ভাবতেই অবাক লাগছে ড্রেভেনের প্রাণ ভোমরা আমার হাতে উফফ।”
ঠিক তখনই এক বিকট শব্দে গোডাউনের বিশাল লোহার দরজা ভেঙে পড়ে। দেয়ালের সাথে এমন জোরে আঘাত লাগে যে পুরো গোডাউন কেঁপে ওঠে। বাতাস ধুলায় ভরে যায়।ক্লারা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, বন্দুকটা দু-হাতে শক্ত করে ধরে। চোখ মুখে তার আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।তখনই ভারী বুটের আওয়াজ শুনা গেল।আবছা আলোয় আগুন্তিকের মুখাবয়ব খানিকটা স্পষ্ট হয়।ব্যক্তিটিকে সামনে দেখে ক্লারার ঠোঁটে বিজয়ের ঠান্ডা হাসি ফুটে ওঠে।তখন সে ঠোঁটের কোণে বীভৎস হাসি নিয়ে বিষমাখা কণ্ঠে বলল,
“ওয়েলকাম ড্রেভেন হান্টার!”
ড্রেভেনের পিছু পিছু রিচার্ড ও আসলো। সে ক্লারাকে দেখে এখানে কিছুটা অবাক হলো।ড্রেভেন মাথা কাত করে আনায়ার মুখপানে একবার তাকালো।মুহূর্তেই ড্রেভেনের অভ্যন্তরীণ আগ্নেয়গিরি জ্বলে উঠল তার দৃষ্টিতে। চোখের পাতা শক্ত করে ক্লারার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল। ক্লারার অন্তর কেঁপে উঠল সেই অগ্নিদৃষ্টি দেখে কিন্তু বাইরে কিছুই প্রকাশ করল না সে।ড্রেভেন নিঃশব্দে ধীর গতিতে এগিয়ে আসতে থাকল।এই দৃশ্য দেখে ক্লারা আতঙ্কিত হয়ে কাঁপা গলায় তড়িঘড়ি করে বলে,
“ওখানে দাঁড়াও সামনে এগোবে না। এক পা এগোলে আমি ওকে মেরে ফেলবো।”
ড্রেভেন মুহূর্তের জন্য থামল। মাথা একটু নীচু করে আনায়ার মুখপানে তাকায়,মাস্কের আড়ালে তার অভিব্যক্তি স্পষ্ট নাহ।তারপর সরাসরি সামনে ক্লারার পানে তাকিয়ে, সমস্ত প্রতিশোধের আগুন কণ্ঠে ঢেলে হিমশীতল গর্জনে বলে উঠল,
“ওর গায়ে যদি একটুও আঁচ পড়ে। আমি তোর শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত গুনবো।”
ক্লারা উন্মাদের মতো উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তার হাসির শব্দ ঘর কাঁপিয়ে তোলে।পুনরায় উগ্র গলায় ক্লারা চিৎকার করে ওঠে,
“ফরমুলা দাও ড্রেভেন।আমি ওকে ছাড়বো নাহ ফর্মুলার না দেওয়া পর্যন্ত।”
ড্রেভেন ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গহাসি ফুটিয়ে দৃষ্টিতে অমোঘ তাচ্ছিল্যে নিয়ে বলল,
“তোর মতো নর্দমার কীটের হাতে ফরমুলা তুলে দেবো?”
ক্লারা আর সহ্য করতে পারে না। তার সারা শরীর ক্রোধে থরথর করে কাঁপে।সে মুহূর্তেই উন্মাদের মতো চিৎকারে ফেটে পড়ল,
“নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাইলে ফরমুলা দাও। তুমিও মরবে, এই মেয়েটাকেও নিয়ে মরবে।”
ড্রেভেন কোন কথা তোয়াক্কা না করে ধীরে ধীরে দুই কাঁধ নামিয়ে এগিয়ে আসতে থাকল।এহেন দৃশ্য দেখে
ক্লারার আত্মবিশ্বাস মুহূর্তে টাল খেয়ে গেল। কাঁপতে থাকা আঙুলে বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিতে দিতে দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠে বলল,
“সামনে এগোবে নাহ, নয়তো আমি এখনই ওর মাথায় গুলি করবো।”
কিন্তু ড্রেভেন থামলো না।চোখের পলক না ফেলেই এগিয়ে আসতে থাকল।তার চোখ দুটো জ্বলছে আগুনের মতো।ক্লারার দেরি না করে আঙুল চাপ দিল ট্রিগারে।কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ড্রেভেন বিদ্যুতের গতিতে কোমরের পাশ থেকে পিস্তল বের করে শুট করল।বিকট আওয়াজে গুলি ছুটে ক্লারার কাঁধ বরাবর বিঁধল। সঙ্গে সঙ্গে ক্লারা ছিটকে পড়ে যায় মাটিতে। তার বন্দুকের গুলি সামান্য সরে গিয়ে আনায়ার পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যায়,তবে আনায়ার গায়ে লাগেনি।ড্রেভেন চ জাতীয় শব্দ করল ঠোঁট দিয়ে।রিচার্ড ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সবকিছু দেখতে থাকলো।এখন মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করা অর্থাৎ মৃত্যু। ক্লারা কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসতে চাইল, কিন্তু ব্যথায় গুঙিয়ে ওঠে।ড্রেভেন এবার আনায়ার দিকে এগিয়ে আসতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ক্লারা ড্রেভেনের পা শক্ত করে চেপে ধরে।ড্রেভেনের চাহনি তৎক্ষণাৎ ক্লারার দিকে পড়ে। ক্লারা ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে বলল,
“ভেবো না ফরমুলা ছাড়া যেতে দেবো তোমাকে আজকে আনায়ার কাছে।”
ড্রেভেন ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে শুধালো,
“ফরমুলা তো দূরের কথা তোকে আজকে জিন্দা রাখবো কিনা সন্দেহ।”
ক্লারা দেরি করে না পাশে পড়ে থাকা লোহার রডটি হাতে তুলে নেয়। ক্লারা সেই রডটা ভীষণ বেগে ড্রেভেনের মাথার দিকে ছুড়ে মারে। ড্রেভেন সামান্য নীচু হয়ে বাঁচে, রডটা পিছনের কাঁচের জানালা ভেঙে দেয়।ড্রেভেন এবার ক্লারার দিকে লাফিয়ে পড়ল, এক হাতে ওর গলা চেপে ধরে দেয়ালে ঠেলে দেয়।মুহূর্তেই ক্লারার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু ঠোঁটে তবুও বিকৃত হাসি নিয়ে বলল,
“আমাকে মেরে ফেললে ও পার পাবি নাহ তুই।কারণ K.K আবার নতুন কাউকে পাঠাবে ফরমুলা নেওয়ার জন্য। কয়জন কে মারবি তুই হ্যাঁ?”
ড্রেভেন চেপে রাখা ক্রোধে বলল,
“আফসোস K.K এর ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে যাবে।”
বলেই ক্লারাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।ক্লারা ছিটকে পড়ে আরেকবার। ব্যথায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসার চেষ্টা করে, কিন্তু এবার আর পেরে ওঠে না।ড্রেভেন সেটা দেখে ঠান্ডা গলায় বলল
“যেখানে পড়ে আছিস, ওখানেই পচে মর।”
বলেই সে এবার আনায়ার দিকে এগিয়ে আসে কিন্তু হঠাৎ ধপ করে একটা গ্যাস লাইট ছিটকে পড়ে মাটিতে আর ফচ করে আগুন লেগে যায়।মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আগুন।ড্রেভেন দুই কদম পিছিয়ে আসে, চোখ রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে তার ধোঁয়ার ভেতর।আগুন গোলাকৃতি আকারে ছড়িয়ে পড়ল আনায়াকে ঘিরে।হঠাৎ নিস্তব্ধতার মাঝে ভয়ংকর বাঁশির সুর বাতাসে ভেসে এলো। গা ছমছমে ক্রিমিনাল সং-এর ভয়ংকর মেলোডি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল।ড্রেভেন সতর্ক চোখে চারপাশ দেখতে শুরু করে।হঠাৎ ধোঁয়ার ভেতর ধীর পায়ে এগিয়ে এলো এক ছায়ামূর্তি।আগুনের ঝলসানো আলোছায়ার আবছা ভেতর দিয়ে ছায়ামূর্তির অবয়ব স্পষ্ট হতে লাগল।ড্রেভেনের তীক্ষ্ণ চোখ সেদিকেই আটকে গেল।বাঁশির সুর হঠাৎ করেই থেমে গেল।তারপরই শোনা গেল ঠান্ডা, গম্ভীর পুরুষলী কণ্ঠ,
“ডোন্ট ইউ ডেয়ার টাচ হার।সি ইজ মাইন! ”
ড্রেভেন মুখোশের আড়ালে ঠোঁট বেঁকিয়ে বিদ্রুপাত্মক হাসি দিলো।ঠিক তখনই আগুনের ছড়িয়ে পড়া লাল আভায় অপর পাশে আবির্ভূত হলো ইউভান।একপাশে ড্রেভেন, অন্যপাশে ইউভান।মাঝখানে অগ্নিপথের কেন্দ্রে অচেতন হয়ে পরে আছে আনায়া।ইউভানকে দেখে ক্লারা কিছুটা অবাক হয়।ইউভানকে সে এখানে মোটেও আশা করিনি। ইউভান সরু দৃষ্টিতে একবার তাকালো ক্লারার পানে।মুহূর্তে ক্লারা ভয়ে আরও গুটিয়ে গেল।ইউভানের গলার নিচে স্পষ্ট উঁচু-নিচু হচ্ছে অ্যাডাম’স অ্যাপেল প্রবল রাগে দ্রুত ওঠানামা করছে।গলার শিরাগুলো চওড়া হয়ে উঠেছে।তৎক্ষণ ইউভান ড্রেভেনের পানে পাথরের মতো কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে, দাঁত চেপে কড়া কণ্ঠস্বরে বলল,
“সাহসের তারিফ করতে হয় তোমার।এত সাহস কীভাবে এলো?এত সহজে আমি আনুকে স্পর্শ করতে দিব তোমায়?ওকে ছোঁয়ার কথা স্বপ্নেও ভেবো না। আই ডোন্ট গিভ দ্যাট রাইটস।”
মুহূর্তেই ড্রেভেন মুখোশপর আড়ালে কটাক্ষভরা হাসি দিল।তারপর চোখের কোণে একটা অবজ্ঞার ছায়া টেনে ছায়াচ্ছন্ন কণ্ঠে জবাব দিল,
“ওহ তাই নাকি? কে তোমাকে সেই অধিকার দিল মিস্টার ইউভান?”
ইউভান অধর প্রসারিত করে হাসলো।পরমুহূর্তে অমোঘ দৃষ্টিপাত করে, বিষাক্ত মাধুর্যে ভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কেউ দেয়নি, আমি নিয়েছি রক্ত দিয়ে লিখে এবং ভাগ্য দিয়ে স্বাক্ষর করে। যেটা আমার সেটা দাবি করতে কাগজ-কলমের দরকার পড়ে না।”
রিচার্ড ভীত চোখে আরও একটু সরে দাঁড়াল।তার বোধগম্য হচ্ছে না, ইউভান এখানে কেন এলো?তবুও নিশ্চুপ থেকে দুই পক্ষের ঠান্ডা লড়াই দেখতে থাকলো সে।তখনই ড্রেভেন চ জাতীয় শব্দ করলো।চোখ সামান্য সংকুচিত করে ঠান্ডা তিরস্কারের ভঙ্গিতে বিষ মাখা কণ্ঠে উচ্চারিত করল,
“প্রমাণ ছাড়া মালিকানা? আমার কাছে সেটা খুব ঠুনকো মনে হচ্ছে ইউভান। তুমি মনে করো আনায়া চিরকাল তোমার শিকলে বাঁধা থাকবে?”
এই কথা শুনে ইউভানের চোখ এক মুহূর্তের জন্য আনায়ার উপর পৌঁছালো।আনায়ার নিথর দেহের পানে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল তার।ইউভান আনায়া দিকে নিরুত্তাপ দৃষ্টি তাকিয়ে রইল।মুহূর্তেই তার ঠোঁট জুড়ে ঠান্ডা নির্মম হাসি ফুটে উঠল।সে আনায়ার উদ্দেশ্য হুইস্কির মতো গড়ানো কণ্ঠে শুধালো,
“সে শিকলে বাঁধা নেই। সহস্র নক্ষত্রের ভিড়ে সে নিজে থেকেই আমাকে বেছে নিয়েছে।”
পলকের মধ্যে আবার ইউভানের রক্তিম দৃষ্টি ড্রেভেনের ওপর পড়ল।সে বিদ্ধ করা কণ্ঠে পুনরায় বলল,
“ছিনিয়ে নিতে চাও ওকে আমার কাছ থেকে? এত সহজ সিংহের খাঁচা থেকে শিকারিকে নেওয়া?ছেড়ে দিব তোমাকে?
ড্রেভেন মাথা কাত করে উত্তর দিল,
“আমাকে ভয় দেখাচ্ছ হ্যাঁ? তোমার ওই সস্তা কথাই এই ড্রেভেন ভয় পাবে।সো ফানি ম্যান!ছিনিয়ে নিতে আমিও ভালো করেই জানি ইউ নো?”
সঙ্গে সঙ্গে ইউভান হাত উঁচু করে হিশহিশয়ে বলে উঠল,
“নোপপপ!আই সোয়ার ট্রাট মি আফসোস করার সুযোগটাও পাবে না তুমি।”
ড্রেভেন বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে, বিদ্রুপ করে প্রতিউত্তর করল,
“আর যদি আমি ছুঁয়ে দি?”
ইউভান এবার উচ্চস্বরে উম্মাদের ন্যায় হাসতে থাকলো। ক্লারার রক্তাক্ত দেহটি কেঁপে উঠল এই অস্বাভাবিক আওয়াজে।ইউভান হাসি থামিয়ে হুমকিমাখা গলায় বলল,
“তাহলে প্রস্তুত থেকো, যেই হাতে ছুঁয়েছো সেই হাত হারানোর জন্য।”
ড্রেভেন এবার আলতো করে হাসলো। ঠোঁটের কোণে আগুনের মতো ঝলসানো দৃঢ়তা নিয়ে বলল,
“আমি মুখে বলি না কাজ করে দেখাই।”
এই কথা বলেই সে আনায়ার দিকটায় কয়েক কদম এগিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ ইউভান আরেকটু নড়ে উঠল।তার ঘাড়ের পেশি শক্ত হয়ে চোখের মণি নীল রঙে চকচক করতে লাগল। ঠান্ডা জমাট কণ্ঠে সে বলল,
” ইউ নো ওয়াট ড্রেভেন?আমার ভেতরকার সত্তাটা ঠিক এইমাত্র আমাকে ফিসফিস করে বলল,”মে আই কাম আউট?”
এই কথা শোনার পর ড্রেভেন হঠাৎ থেমে গেল। তার পা জড়িয়ে গেল মাটির সঙ্গে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল ড্রেভেন। ক্লারা আর রিচার্ড কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। এমন করে ড্রেভেনকে থেমে যেতে তারা কখনো দেখেনি। ক্লারা চোখে বিস্ময়।সে বুঝতেই পারছে না ইউভানের কথায় ড্রেভেন কেন থেমে গেল?আনায়াকে ড্রেভেন ইউভানের কাছে দিয়ে দিল?ক্লারার কিছুটাই বিশ্বাস হচ্ছে না সে যতদূর জানতো ড্রেভেনের মতো হিংস্র মানুষ আনায়াকে কখনো ছাড়বেনা।ক্লারা এতটা আহত যে সে উঠে বসতেও পারছে না, শুধু নীরবে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তখনই পুনরায় ইউভান ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে ড্রেভেনের উদ্দেশ্যে বলল,
“আর ইউ রেডি নাও টু হ্যান্ডেল মাই ডার্কনেস?”
মুহূর্তেই ড্রেভেনের রক্তচক্ষু দৃষ্টি ইউভানের উপর গিয়ে বিধঁলো। সে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে, হাত শক্ত করে মুঠি বানিয়ে কয়েক কদম পিছু হটল।এহেন দৃশ্য দেখে ইউভানের অধর জুড়ে রক্তমাখা হাসি খেলে গেল।তারপর তার দৃষ্টি আটকালো আনায়ার পানে।আগুনের চারপাশে মাটি ফেটে কিছু পাথর বেরিয়ে আছে। ইউভান দেরি না করে ঠিক সেগুলোর ওপর পা ফেলে ধীরে ধীরে আগুনের গোলের ভেতরে পা রাখল।আনায়া নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে আছে।তার চুলগুলো চারপাশে ছড়িয়ে আছে,আগুনের তাপে মুখ লাল হয়ে আছে। ইউভান ধীরে ধীরে আনায়ার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল।এক হাতে আনায়ার ঘাড়ের নিচে, আরেক হাত পিঠের নিচে রেখে পরম যত্নে কোলে তুলে নিল।
সঙ্গে সঙ্গে আনায়ার মাথা ইউভানের বুকে এসে পড়ল নিঃশব্দে।ইউভান আনায়ার মুখে হাত বুলিয়ে চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে অস্থির কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“আই মিস ইউ সুইটি। দেখ আমি চলে এসেছি তোকে সাথে করে নিয়ে যেতে।প্রমিস আর একা ছাড়বো নাহ তোকে কখনোই নাহ।”
বলেই বুকজুড়ে আলিঙ্গন করল শক্ত করে।একটুক্ষণ আনায়াকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরল ইউভান।তারপর ধীরে ধীরে আনায়াকে কোলে তুলে নিল।আনায়ার মাথাটা ইউভানের কাঁধে এলিয়ে পড়লো।ইউভান আনায়কে নিয়ে বেড়ি এলো আগুনের ভেতর থেকে।পেছনে ড্রেভেন আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ হয়ে সবকিছু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে।তবে এই নিশ্চুপতার কারণ সম্পূর্ণ অজানা।ইউভান সামনে এগতো এগোতে ও থামল,একবার পেছন ফিরে ক্লারার পানে অদৃশ্য বিষ ঢেলে দেওয়া দৃষ্টিতে তাকালো।মুহূর্তেই ক্লারা ভয়ে আহত শরীর নিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো।পরমুহূর্তে ইউভান বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে বলল,
“আর ইউ লাকি আমি কোনো মেয়েকে ছুঁই না। তা না হলে তোমার অবস্থা খুব খারাপ হতো।তবে ভেবো নাহ ছাড়া পেয়ে যাবে।
এক পলকে ইউভান ড্রেভেনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে এক নির্মম বাঁকা হাসি টেনে বলল,
“কিন্তু আমি না মারলেও তোমার সমাধি খোঁড়ার জন্য কেউ একজন ঠিকই প্রস্তুত আছে।সে ফুলের কাটা উপরে ফেলবে আর আমি ফুলটা তুলে নিব।”
ড্রেভেন এবার উচ্চস্বরে হাসলো।হাসতে হাসতে একপর্যায়ে বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি কী ভেবেছো আমি ফুলটা দিয়ে দিয়েছি?এত সহজে?নো নো নো নেভার ম্যান!আমি ছাড় দিয়েছি ছেড়ে নয়।”
ইউভান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাসলো।এরপর আনায়াকে কয়েক গুন শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রুদ্ধ কণ্ঠে শুধালো,
“তুমি শুধু ফাইট করে যাবে বাট আফসোস শেষের দলিলের সিলমোহরের কাগজে একমাত্র আমার নামই লেখা থাকবে।ইতিহাসে বুকে তুমি নাম মাত্র যোদ্ধা আর আমি রাজা।ইউ নো রানি সর্বদা রাজারই হয়।সো আমার রাজ্য এবং আমার রানি ধারে কাছেও তোমার স্থান নেই।নেক্সট টাইম বি কেয়ারফুল!”
ড্রেভেন কোনো প্রতিউত্তর করল নাহ।চোখ নামিয়ে আনায়ার দিকে তাকিয়ে রইল।ইউভান কোন বাক্য ব্যয় না করে পেছনদিকে ফিরে আনায়াকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল।ড্রেভেনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেদিকে স্থির হয়ে রইল। রিচার্ড সম্পন্ন হতভম্ব সেটাই বুঝতে পারছে না ড্রেভেনের মতো মানুষ কেন ইউভানকে ছেড়ে দিল।কিছুক্ষণ বাদ ড্রেভেন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল এইবার তার দৃষ্টি সোজা ক্লারার উপর।ক্লারা মুহূর্তেই গুটিয়ে গেল। ঠোঁট কাঁপতে লাগল তার, হাতের তালু ঘামে ভিজে উঠল।ড্রেভেন মুখোশের আড়ালে দানবিক হাসি দিল।তারপর আড়চোখে রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন এখান থেকে বেরিয়ে যাও।এখন এমন কিছু হবে,যেটা তুমি সহ্য করতে পারবে না।”
রিচার্ড কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ড্রেভেন তার দিকে হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিল।
“আমি রিপিট করতে পছন্দ করি না।”
রিচার্ড ক্লারার দিকে একবার অসহায়ভাবে তাকিয়ে চুপচাপ পেছন ফিরে বেড়িয়ে গেল।ক্লারা এবার সম্পূর্ণ একা এবং অসহায়। ড্রেভেন এবার লম্বা রড নীচ থেকে হাতে তুলে নিল।এহে দৃশ্য দেখে ক্লারা কেঁপে উঠল।ড্রেভেন ধীরে ধীরে ক্লারার দিকে এগিয়ে এলো।তৎক্ষণ ক্লারা পেছনে সরতে সরতে বলে,
“আমাকে মারবেন না দয়া করে। আমাকে ছেড়ে দাও আমি আর কখনো আসব না।এবারের মত ক্ষমা করে দাও প্লিজ।”
ড্রেভেন থামল না। মুখোশের আড়ালে সে ঠান্ডা শীতল কণ্ঠে বলল,
“এটা আগে মনে রাখা উচিত ছিল তোর।”
বলেই লোহার রডটা সোজা ঢুকিয়ে দিল ড্রেভেন ক্লারার পেট বরাবর।পেট চিরে ধমনি ছিঁড়ে রক্ত শিষ দিয়ে বেরিয়ে এলো।ক্লারা জোড়ে আর্তনাদ করে উঠলো।সেই আর তোমাদের আওয়াজে ড্রেভেন পৈশাচিক আনন্দ পেল। ড্রেভেন রডটা বের করল সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ছিটকে তার গায়ে আছড়ে পরল।ক্লারার মুখ ফাঁক হয়ে গেল তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।দুই হাত পেতে রেখে নিচে ছটফট করছে সে। ড্রেভেন কোনো রকম থামল না। এক লম্বা শ্বাস নিয়ে সে রডটি আবার গরম করে এনে ক্লারার পিঠে চেপে ধরল। মুহূর্তে পিঠের চামড়া ফেটে গলগল করে মাংস ঝরে পড়ল, পাঁজরের হাড় উন্মুক্ত হয়ে গেল। ক্লারা তার শরীরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে টানতে টানতে কাঁদতে শুরু করল,
“ছেড়ে দাও! দয়া করে ছেড়ে দাও আমাকে। আমি জানি আমি ভুল করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। K.K চৌধুরি ম্যানসনে একটি বিড়াল রেখেছে যার মধ্যে ক্যামেরা……”
কথা শেষ করার পূর্বেই ড্রেভেন হঠাৎ করে ক্লারার পেটে গরম রড ঢুকিয়ে পাকস্থলীর পাশ দিয়ে ঘোরাতে থাকল।ক্লারা চোখ কোটা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম।ক্লারার ইচ্ছে করছে একবারে মরে যেতে কিন্তু সেটা ড্রেভেন হতে দিবে নাহ।ড্রেভেন আবার রডটি টেনে বের করতেই লাল গরম রক্ত ছিটকে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ল।ক্লারা গলাকাটার মুরগির মতো ছটফট করতে থাকলো।ড্রেভেনের চোখে কোনো মায়া নাই, সে কিছুতেই তার চোখে কোন সহানুভূতি দেখাল না।ড্রেভেন এবার গরম রডটি ক্লারা চোখের দিকে ঠেলে দিলো। মুহূর্তেই মাংস খসে খসে পড়ে চোখের কোটা বেরিয়ে আসে। চোখের মণি মুহূর্তে বিস্ফোরিত হয়ে কোটর থেকে মাটতে গড়িয়ে পড়ল।
ড্রেভেন রডটির উপর হাতের চাপ প্রয়োগ করলো ফলস্বরপ রডটি ক্লারার চোখ ফুঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করে মাথার ভেতরের ঘিলু পর্যন্ত পৌঁছাল। ঘিলুর নরম স্তরগুলো রডের তাপে জ্বলে উঠল।চোখের পাশ দিয়ে সাদা মাংস আর রক্ত একসাথে গড়িয়ে পরল মাটিতে।ড্রেভেন ইচ্ছাকৃতভাবে রডটা মাথার ভেতর একটু এদিক ওদিক ঘুরাতে লাগলো ফলে মগজের ভেজা নরম কোষগুলো গলে গলে বেরিয়ে এলো বাইরে।ঘন লাল কিছু তরল ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ল ক্লারার কপাল বেয়ে।তার শরীরটা ঢলে পড়ল সামনে।ড্রেভেন এবার থামল ক্লারার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ফিসফিস করে বলল,
“তোর শেষ ইচ্ছা কি বল পূরণ করতে চাই আমি?”
ক্লারার এক চোখ ফেটে ঘা আর জমে থাকা পুঁজ বপন হচ্ছে। আরেকটা চোখ আধা খোলা হয়ে আছে।সেই চোখ দিয়েই সে ড্রেভেনকে পানে ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকায়। তার মাথা আর কাজ করছে না। চিন্তা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে তার শরীর।তবুও গলার ভেতর থেকে নিঃস্ব কষ্টের শব্দ বেরুলো,
“ক কে তুমি?”
ড্রেভেন হেসে ওঠে। সেই হাসি বজ্রের মতো বিকট যা ক্লারার আত্মা কাঁপিয়ে তোলে। ড্রেভেন তারপর নীচু হয়ে হিশহিশিয়ে বলল,
“তোর মৃত্যু! বাই দ্য ওয়ে তোর শেষটা তাহলে পূরণ করেই নেই। সত্যটা জানার পর না হয় মরিস।”
বলেই ড্রেভেন উঠে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে এক হাত দিয়ে মাস্কটা খুলে ফেলে মুখ থেকে।মাস্কের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে একজোড়া চোখ নীল রত্নের মতো।ক্লারার এক চোখ পুরোপুরি নিভে এসেছে, তবু বাকি চোখে ধরা পড়ে সেই নীল দৃষ্টি।ক্লারা বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে দেখল।তারপরও শরীর থরথর করে কাঁপছে।মৃত্যু তার খুব কাছে বুঝতে পারছে সে। তবুও ঠোঁট ফাঁক করে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“ত তুমি তাহলে ও কে……”
শব্দগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। ক্লারা হাতগুলো দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে। ড্রেভেন এবার শেষ আঘাতটা হানে। ড্রেভেন আগুনে লালচে হয়ে ওঠা রডটি ক্লারার যৌনা* বরাবর ধরে মুহূর্তের মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলো ভিতরে। ছ্যাঁকা খাওয়া চামড়ার গন্ধে ঘর ভরে উঠল। ধাতব রডটা ফুসফুস ছিঁড়ে, পাকস্থলী বিদীর্ণ করে, হাড় ভেঙে মাথা পর্যন্ত পৌঁছাল।ক্লারা শেষবারের মতো জোরে ছিন্নচিৎকার দিয়ে উঠলো।মাথার খুলি চিরে রডের ডগাটা বেরিয়ে এলো।ক্লারার শরীরটা কেঁপে ওঠে,তারপর স্থির হয়ে পড়ে যায় মাটিতে।চোখে চিরতরের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।ড্রেভেন রডটি বের নাহ করে ওভাবেই রেখে দিলো।
ইউভানের গাড়ি চৌধুরি ম্যানশনের গেট পার হয়ে ভেতরে ঢুকলো।ইউভান বাড়ির সামনে গাড়িটি থামালো। তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।এগিয়ে এসে গাড়ির অন্য পাশ ঘুরে আনায়ার দরজা খুললো।আস্তে আস্তে সিটের দিকে ঝুঁকে আনায়ার চুল সরিয়ে দিল মুখ থেকে।আলতো হাতে আনায়াকে কোলে তুলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল ইউভান।ইউভান ধীরে ধীরে পা ফেলতে ফেলতে ম্যানশনের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকলো।আনায়ার রুমের দরজার সামনে এসে একহাতে হাতল চেপে দরজাটি খুললো।রুমটা নরম হলুদ আলোয় আলোকিত।ইউভান বিছানার পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো।আস্তে করে আনায়ার শরীর নিচের দিকে নামিয়ে পরম যত্নে বিছানায় শুইয়ে দিলো ইউভান।আবছা হলুদ আলোয় আনায়ার মুখশ্রী আরও কোমল আর স্বপ্নিল লাগছে। এলোমেলো চুলগুলো বালিশের গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে, ইউভান কিছুটা ঝুঁকে আলতো হাতে চুলগুলো ঠিক করে দেয়।ইউভান সোজা হয়ে দাঁড়াতেই যাবে তার পূর্বেই আনায়া আচমকা ইউভানের গলা পেঁচিয়ে ধরে।ইউভান সেটা হতভম্ব হয়ে তাকায় কারণ আনায়া সম্পূর্ণ নিস্তেজ।তখনই আনায়া ঘুমিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো,
“ইউভান ভাই!”
ইউভানের নিশ্বাস আটকে আসে অষ্টাদশীর আহ্লাদি কণ্ঠের এই সম্বোধনটায়।বাতাস ও যেন কেমন ভারী হয়ে উঠছে।ইউভান কিছুক্ষণ নির্বিকায় তাকিয়ে থেকে হুইস্কির কণ্ঠে উত্তর দিল,
“হুমমমম। ”
আনায়ার ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরছে। সে আধো আধো চোখ খুলে অভিমানী আহ্লাদি কণ্ঠে বলে,
“আপনি আমাকে এত কষ্ট কেন দেন উমমমমম?”
ইউভানের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সত্যিই সে তার সানসাইনকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। আনায়ার কোমল মুখাবয়বের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ইউভান। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে নিজের চওড়া তালুর ভেতর আলতোভাবে বন্দি করে নেয় আনায়ার মুখের আদলটা।তারপর কোমল কণ্ঠে বলল,
“সত্যি বুঝি আমি আমার সুইটিকে অনেক কষ্ট দিয়েছি?”
আনায়া জোর করে তাকিয়ে থাকতে চেষ্টা করে, কণ্ঠে রুদ্ধ আবেগের কম্পন নিয়ে বলল,
“হুমম! আপনি আর কষ্ট দিবেন না ইউভান ভাই। সত্যি বলছি, আমি আর সহ্য করতে পারবো না। শত আঘাত, শত যন্ত্রণায় আমি কখনো চোখের জল ফেলিনি। কিন্তু আপনি আমায় এমনভাবে ভেঙেছেন, যে আমি অবুঝ শিশুর মতো হাহাকার করে কেঁদেছি। আপনি আমার বড় শখের পুরুষ। যদি কখনও তা বোঝাতে পারতাম আপনাকে।”
ইউভান কোনো শব্দ খুঁজে পায় না। তার চেতনায় যেন ভাষা লুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু অপলক তাকিয়ে থাকে আবেগে আচ্ছন্ন আনায়ার মুখপানে। মুহূর্ত পরে তার ঠোঁটে রহস্যময় হাসির রেখা খেলে যায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাসে ভেজা কণ্ঠে সে বলল,
“আপনিও আমার তীব্র শখের নারী, ম্যাডাম। আপনার জন্যই আমার প্রতিটি হৃৎস্পন্দন ব্যথিত আর উত্তেজিত হয় সর্বদা। আপনি আমার হৃদয়ের অনির্বচনীয় চাহিদা।আপনি আমার এমন এক টান যা যুক্তি-তর্ককে উপেক্ষা করে আপনার দিকে আকৃষ্ট করে আমাকে। আপনি কি তা অনুভব করতে পারেন ম্যাডাম?”
আনায়া আরেকটু ইউভানের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।তারপর মাথাটা ইউভানের বুকে এলিয়ে দিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
“উহহহ তাহলে বলুন আর কষ্ট দিবেন না। না হলে আমি কান্না করব খুব।”
ইউভান এক হাত দিয়ে আনায়াকে আগলে নেয়।সে খুব ভালোমতো বুঝতে পারছে আনায়া ঘুমের মধ্যে অচেতন হয়ে কথাগুলো বলছে। জেগে থাকলে হয়ত এসব বলার সাহস পেত না।ইউভান স্পষ্ট বুঝতে পারল আনায়ার দৃষ্টির কোণে জমে থাকা অব্যক্ত অনুভূতিগুলো।এসব ভেবে ইউভান নিরুত্তাপ হেসে নেশালো কণ্ঠে শুধালো,
“হুশশশশশশ! দিব নাহ আর কষ্ট, প্রমিস।কখনো যেন আর তোর চোখে অশ্রু না দেখি কারণ,
তোর প্রতিটি অশ্রুবিন্দু আমার ভেতরটা উথালপাথাল করে তোলে।বহুপূর্বে প্রথমবার তোর চোখে চোখ রেখে কিছু একটা অনুভব করেছিলাম আমি।
আনায়া এবার মাথা উঁচু করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ইউভানের পানে।তার ঠোঁট ফাঁক করে ঠান্ডা বিস্ময়ে কণ্ঠে বলল,
“ক কী?”
ইউভান সরাসরি আনায়ার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে কুয়াশার মতো রহস্যময় কণ্ঠে উত্তর দিল,
“আমার সর্বনাশ।”
আনায়া পলক ঝাঁপটালো কয়েকবার।ইউভান ঠিকই বুঝতে পারল তার অবুঝ রানীর কিছুই বোধকর্ম হয়নি। জানালার পর্দা গুলো বারবার বাতাসে দুলছে বাতাসের সাথে বেলি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ ঘরে মই মই করছে।আনায়া মসৃণ মুখয়াবের পানে তাকিয়ে ইউভান হুইস্কির কণ্ঠে বলল,
“কতটা অাদুরে লাগছে তোকে জানিস?”
আনায়া বাচ্চাদের মত মুখ করে মাথা দুদিকে নারায়।তার চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে।।হঠাৎ কী মনে করে ইউভান দুহাত দিয়ে আনায়ার আদলটি আঁকড়ে ধরে গাঢ় চুমু খেলো কপালে। ধুকপুক করে ওঠে আনায়ার হৃৎস্পন্দন, আঁখিদ্বয় বন্ধ হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। ঢুলে পরে ইউভানের প্রশস্ত বুকে। মুচকি হাসে ইউভান ধীরে শুয়ে দেয় বালিশে, কিন্তু আনায়া শক্ত করে কলার চেপে ধরে আছে। কেমন যেন মুঠো ফাঁক করলেই হারিয়ে যাবে ইউভান।ইউভান আনায়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায়।আর সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টি বদলে যায়,
চোখে একরাশ নেশা জমে উঠে। হৃদয়ের স্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠছে।চোখের দৃষ্টি আরও গভীর হয়, তখন ইউভান আর নিজের হাত কন্ট্রোল করতে পারে না।
সে আনায়ার একগুচ্ছ চুল হাতে তুলে নিয়ে তার সুবাস নেয়। মুহূর্তেই চুলের সুবাসে ধীরে ধীরে আরো বেশি মাতাল হয়ে ওঠে। ইউভানের পুরো শরীরের মধ্যে কামুক আবেগ তৈরি হতে শুরু করলো।তার মধ্যে আনায়াকে স্পর্শ করা তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল।সে সেই আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে আনায়া চুলগুলো সরিয়ে গলার কাছ দিয়ে ধীরে স্লাইড করতে করতে ঠোঁটের কাছে এসে থামে।ঘুমের ঘোরে আনায়ার ঠোঁট কাঁপে সামান্য।ইউভান সামান্য ঢুকলো তার চোখে অদম্য নেশা।আনায়ার গোলাপ রাঙ্গা ঠোঁটে ইউভান আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে থাকলো।আনায়ার বুক ওঠা নামা করছে দ্রুতগতিতে।ইউভান
তার আঙুলগুলো আনায়ার ঠোঁটের দিকে চলে যায়। চামড়ার উপর হাত দিয়ে সে ঠোঁটের স্লাইড করে। গোলাপ রঙের ঠোঁটগুলোর উপর আঙুল চলে যেতে থাকে, আর হৃদয়ের স্পন্দন এক দমে বেড়ে ওঠে।ইউভানের নেশাক্ত তো দৃষ্টি আনায়ার অধরের দিকে।সে শুকনো ঢুক গিলে আনায়ার অধরের দিকে এগিয়ে এল।দুজনের নিশ্বাস এক মুহূর্তের জন্য এক হয়ে গেল। যখনই ইউভান আনায়ার অধর স্পর্শ করতে যাবে তার পূর্বে একটা বিড়াল ছানা লাফ দিয়ে এসে আনায়ার বুকের উপর পড়ে।সাথে সাথে ইউভানের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।
তার অনুভূতিগুলো খানিকটা বিলীন হয়ে যায়। সে চোখে ক্রোধ নিয়ে বিড়ালটির পানে তাকায়। বিড়াল ছানাটি আনায়ার মুখের সাথে মুখ ঘষতে থাকে।বিড়ালটির এমন কর্মকাণ্ড ইউভানের রাগের আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে।আনায়ার পাশে সামান্য বিড়ালকে তার সহ্য হচ্ছে না।অসহ্য বিরক্তির সাথে ইউভান তাড়াতাড়ি বিড়ালটিকে ধরে আনায়ার বুক থেকে সরিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর সে নিজের বসার জায়গা তৈরি করে পুনরায় আনায়ার নিকটে আসল।সামান্য পরিমাণ ঝুঁকে আনায়ার পানে দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামান্য হাসলো। হঠাৎই সে সামান্য ঠোঁট ফাঁক করে ফিসফিসিয়ে গেয়ে ওঠে,
❝ তেরে ইস্কপে,তেরে ওয়াকত পে,
বাস হাক হে ইক মেরা
তেরে রুহু পে,তেরে জিসমপে
বাস হাক হে ইক মেরা, বাস হাক হে ইক মেরা
উমমম…মম বাস হাক হে ইক মেরা।❞
রাত গভীর। আকাশও আজ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।কিন্তু চোখে এক বিন্দু ঘুম নেই পিহুর।
ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতার মাঝে একা জানালার দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে। ঠিক সেই মুহূর্তেই পেছন থেকে নরম পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
“পিহু মা আর কত রাত জেগে থাকবি? রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”
পিহু চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকায়।চোখে মুচকি হাসি নিয়ে হেঁটে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আজকে ঘুম আসছে না, মনি।তুমি আমাকে গল্প শোনাবে?”
মহিলার নামই মনি। যে ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছে পিহুকে। মায়ের অভাব সে কোনোদিন বুঝতে দেয়নি।
তাকে ঘুম পাড়িয়েছে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কষ্টের দিনগুলো পার করেছে।পিহুর আশ্রমেরি টিচার হলো মনি।মনি পিহুর মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলে,
“গল্প? এত রাতে তুই আবার ছোট বাচ্চা হলি নাকি?”
পিহু ফিক করে হেসে বলে,
“আমি তো আজও তোমার ছোট্ট পিহু। আসো, গল্প বলো না একটুখানি প্লিজ।”
মনি এক পাশে বসে, পিহুকে কোলে টেনে নেয়।
পিহু মাথা রাখে মনির কোলের উপর, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা এটি।এই একমাত্র মানুষ, যাকে সে চোখ বন্ধ করে নিজের বলেই ভাবতে পারে।তখনই মনি পিহুর মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প বলা শুরু করে,
“অনেক কাল আগে, এক রাজ্যে থাকত এক রাজা আর রানি। তাদের ছিল খুব সুখী সংসার। হেসে-খেলে দিন কাটত তাদের।একদিন তাদের ঘর আলো করে একদিন জন্ম নিল ছোট্ট ফুটফুটে এক রাজকন্যা।
গাল দুটো টোকা দিলেই লাল হয়ে যেত।রাজকন্যাটার বিশেষত্ব হলো তার লাল টকটকে চুল।দেখে মনে হবে আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো পরি।কিন্তু হঠাৎ একদিন এক ঝড় এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিল।রাজ্যে শুরু হল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে রাজকন্যা হারিয়ে ফেলল তার মা-বাবাকে।তখন কিছু দুষ্টু লোক রাজকন্যাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।ঠিক সেই সময়, হঠাৎ করে এক সাহসী যুবক এসে তাকে বাঁচিয়ে নেয়।আর রাজকন্যাটিকে সুরক্ষিত স্থানে রেখে আবার চলে যায়।সেই যুবকটির কারণেই রাজকন্যা বেঁচে ছিল কিন্তু….. ”
পিহু মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনছিল।মনি থেমে যাওয়াতে পিহু মাথা তুলে বলে উঠলো,
“কিন্তু কি মনি? তারপর কি হলো?”
মনি একটু থামে। চোখে-মুখে অস্বস্তির রেখা ফুটে উঠল তার।সে কিছুটা বিচলিত কণ্ঠে বলল,
“আজ অনেক রাত হয়ে গেছে মা। কাল তোকে ভার্সিটি যেতে হবে। এখন ভদ্র মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়।”
পিহু ছোটবেলা থেকে মনির সমস্ত আদেশই পালন করে।তাই সে চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মত উঠে দাঁড়ালো।কিন্তু হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়াই থামল।তার মনে পড়ে গেল বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া একটা প্রশ্ন।সে পিছন ফিরে মনির পানে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো,
“মনি আমার নামটা কে রেখেছিল?”
এক মুহূর্তে যেন সময়টা থেমে গেল।মনি গা ছমছমে নীরবতায় একটু কেঁপে উঠলো।পিহুর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে তার দিকে। মনি কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়।তবুও নিজেকে সামলিয়ে মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে উত্তর দেয়,
“আ আমি! আমি ছাড়া কে রাখবে তোর নাম?আমি ছোটবেলায় তোর নামটা রেখেছিলাম।কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
পিহু ঠান্ডা ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
“কিছু না মনে এমনি জিজ্ঞাসা করলাম।”
আর কোনো বাক্য ব্যয় করল না সে। পেছন ফিরে রুমের উদ্দেশ্যে উদ্যত হল।হাঁটতে হাঁটতে মনটা কেমন যেন শূন্য হয়ে আসে তার।হঠাৎই মনে হয় বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসছে।হৃদয়ের গহিন থেকে একটা চাপা কষ্ট উঠে আসছে, যেটার ব্যাখ্যা সে নিজেও জানে না। তাইতো সর্বদা সে নীরব থাকে। মনি তখন নিঃশব্দে পিহুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।হঠাৎই কণ্ঠে একরাশ হতাশা নিয়ে এসে বলে উঠলো,
“সে রাজকন্যাটি আর কেউ না সে হলো আরভিয়া জাহান পিহু।”
অতীত,
আমেরিকা, নিউইয়র্ক সিটি,
মুহূর্তে আলিসা কেঁপে ওঠে। ক্যাসিনো ভয়ংকর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলিসার চোখ যায় বিছানায় নির্মমভাবে বেঁধে রাখা মেয়েটির ওপর।মেয়েটি আর কেউ না বরং জেনি।সেই মুহূর্তে পৃথিবীটা যেন থেমে গেল তার। বিছানার উপর পড়ে থাকা জেনির দিকে চেয়ে, আলিসার চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে।জেনির হাত-পা রক্তাক্ত দড়িতে বাঁধা। শরীরের কোনো অংশই বাদ যায়নি নির্যাতনের ছোঁয়া থেকে।গায়ে একটাও বস্ত্র নেই, শুধু ক্ষতচিহ্ন আর রক্তরঙা দাগ দেখা যাচ্ছে শরীরে।হঠাৎই ক্যাসিনোর ধমকে ভাঙে আলিসার ধ্যান।
“এই মেয়ের কথা কানে যাচ্ছে না? এখানে কি করছো?”
ক্যাসিনোর গর্জে ওঠা গলায় আলিসা চমকে ওঠে।গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো শীতল স্রোত বয়ে যায় তার সারা শরীরে। পা দুটো অসাড় হয়ে আসে।তার চোখে তখন শুধু জেনির মুখ।জেনির চোখের ভাষা অসহায়! যেন একটা ভাঙা পুতুল কাঁদছে শব্দহীনভাবে, জেনির চোখে এক ফোটা বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। চোখ দুটো তীব্র আতঙ্কে ছলছল করছে মেয়াটার। চোখের জল নিয়ে তাকিয়ে আছে আলিসার পানে। এদিকে ক্যাসিনো আবার গর্জে ওঠে,
“এই মেয়ে তোমাকে এখনই মেরে ফেলবো আমি।সত্যি করে বলো তুমি কি?এখানে কি করছ? তা না হলে প্রাণ হারাবে।”
আলিসা ভয়ের শুকনো ঢুকলো।নিজেকে প্রস্তুত করে কোনোমতে মুখ খুলতে যাবে, তখনই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশের সাইরেনের শব্দ।সঙ্গে সঙ্গে ক্যাসিনোর মুখ কালো হয়ে যায়।তার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে আতঙ্কে।আলিসা পিছন দিকে ঘুরে দেখে, জানালার ফাঁক দিয়ে লাল-নীল আলোয় ঝলসে উঠছে চারপাশ।
ক্যাসিনো দুই হাত মাথায় দিয়ে ফিসফিস করে,
“ওহ গড! পুলিশ এসেছে। শিটটট!”
তার গলা কেঁপে উঠছে, ঘাম ঝরে পড়ছে কপাল বেয়ে। তখনই আলিসার মুখে এক টুকরো রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে।সে বুঝতে পেরেছে যে এখন হোটেলে রেইড হবে।অন্যদিকে, ক্যাসিনো ছুটে এসে শার্টটি তুলে গায়ে দেয়।হাত কাঁপছে, বোতাম আটাকাতে গিয়েও ভুল করছে।ক্যাসিনো সবকিছু রেখে বেরিয়ে যেতে যাবে, ততক্ষণ তার মাথায় জেনির কথা আসে।
হঠাৎ তার চোখ পড়ে বিছানার ওপর।জেনি তো বেঁচে আছে,যদি সে সব সত্যি বলে দেয়? ক্যাসিনোর সব ফাঁস করে দেয়?মাথার ভেতর বাজতে থাকে হাজারটা আশঙ্কা।ক্যাসিনো একেবারে দিশেহারা। ঘর জুড়ে অস্থিরতা।এই দিশেহারা অবস্থায় আলিসা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসল।ক্যাসিনো আলিসাকে দেখে ভ্রূ কুঁচকায়।আলিসা গভীর দৃষ্টিতে ক্যাসিনোর চোখে চোখ রাখে। তারপর ঠান্ডা শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। এ মেয়েটাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে দিন আমাকে।”
এহেন কথা শুনে ক্যাসিনো বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকাল।
তার দৃষ্টিতে প্রশ্ন।সে এটাই বুঝতে পারছি না তাকে কেন কেউ সাহায্য করবে?তৎক্ষণ সে কণ্ঠে সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি কেন আমাকে সাহায্য করবে?”
আলিসা ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে, চোখে জটিল অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বলল,
“সেটা না হয় পরে বলি। আগে এখান থেকে বের হওয়া যাক।”
ক্যাসিনো নির্বাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল।আলিসা দ্রুত ছুটে যায় জেনির দিকে। তার গায়ে একটা পাতলা কম্বল জড়িয়ে দিল তাড়াতাড়ি।জেনির হাত-পা বাঁধা মুখে আঁচড়ের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ওর উপর কী ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে।সে নীচু হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“সব ঠিক হয়ে যাবে আর একটু অপেক্ষা কর হ্যাঁ? আমি তোরে এখান থেকে নিয়ে যাব।আমার উপর বিশ্বাস আছে না তোর হুমম?”
জেনি চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ল। তবুও সে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁবোধক সম্মতি জানালো।আলিসা ক্যাসিনোর দিকে তাকাল সঙ্গে সঙ্গে ক্যাসিনো এগিয়ে এসে জেনিকে কাঁধে তুলে নিল।জেনি হতভম্ব হয়ে আলিসার পানে তাকালো।জানালাটা খোলা।আলিসা আর ক্যাসিনো খুবই সতর্কভাবে জেনিকে নিয়ে জানালা দিয়ে নিচে নামলো। গাড়ির পেছনের সিটে আলিসা জেনিকে জড়িয়ে ধরে বসে।জেনির কপালে ঠান্ডা হাত বুলিয়ে দেয়। ক্যাসিনো এবার গাড়ি চালাতে চালাতে পিছন দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল,
“কোথায় যাব?”
আলিসা চোখ সোজা জানালার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে উত্তর দেয়,
“জঙ্গলে।”
ক্যাসিনো ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“জঙ্গলে? কেন?”
আলিসা ঠান্ডা অথচ ধাতব কণ্ঠ বলে উঠল,
“পেছনে পুলিশ আছে।যেকোনো সময় ধরা খেয়ে যেতে পারি তাই দ্রুত চলুন।”
ক্যাসিনো একটু হেসে উত্তর দিল,
“তুই এখন আমাকে নির্দেশ দিস? বাহহ!”
গাড়ি গতি বেড়ে যায়। আলিসা জেনিকে বুকের মধ্যে আরও টেনে আনে। চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আলতোভাবে।জেনি নিঃশব্দে কাঁদছে কিন্তু মুখে একটাও শব্দ নেই। চোখে কেবল প্রশ্ন তার, যার কোন উত্তর নেই।আলিসা যেন শুনছে না কিছু শুধু নিশ্চুপ হয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে থামলেও জঙ্গলের সামনে।গাড়ি থামতেই ক্যাসিনো দরজা খুলে দ্রুত নেমে আসে। সে জেনিকে আবার কাঁধে তুলে নেয় নিঃশব্দে।আলিসা ধীরে নেমে পড়ে, চোখ তুলে ক্যাসিনোর দিকে তাকায়।এরপর রক্তভেজা কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আপনি ওকে নিয়ে ভেতরে যান। আমি আসছি।”
ক্যাসিনো একবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। কিছু না বলে, ঠান্ডা মুখে জঙ্গলের ভিতর দিকে পা বাড়ায় জেনিকে নিয়ে।আলিসা তখন গাড়ির পেছন থেকে দুটো কোদাল বের করে। তারপর নিঃশব্দে তাদের পেছনে পেছনে জঙ্গলের গহীনে প্রবেশ করে।জঙ্গলটা ভেতরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও অন্ধকার হয়ে ওঠে। ক্যাসিনো একটা নির্জন জায়গায় এসে জেনিকে নিচে শুইয়ে দেয়।তারপর দৃষ্টি আটকে যায় আলিসার হাতে থাকা কোদালের উপর।ক্যাসিনো কয়েক কদম এগিয়ে এসে চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি এতকিছু কেন করছো?”
আলিসা ঠান্ডা কণ্ঠে জবাব দিল,
“সব বলব একবার কাজটা শেষ করি। এখনো আমাদের হাতে বেশি সময় নেই যখন তখন পুলিশ চলে আসতে পারে।”
বলেই সে একটা কোদাল ক্যাসিনোর দিকে বাড়িয়ে দেয়। ক্যাসিনো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর সেটি নিয়ে নেয়।তারপর দু’জন একসাথে মাটি খুঁড়তে শুরু করে।ধীরে ধীরে কোদালের আঘাতে মাটি আলগা হচ্ছে। ওপাশে জেনি কাঁপা চোখে তাকিয়ে আছে। সারা শরীরে কোনো শক্তি নেই তার একটুখানি নড়তেও পারছে না। তার আলিসার প্রতি অন্ধ ভালোবাসা আর বিশ্বাস আজ যেন ঘোলা লাগছে।আলিসা?এটা কি সেই আলিসা যার সাথে যে ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছে? আর সেই আলিসা, আজ তার কবর খুঁড়েছে?কিন্তু কেন? কী ভুল করেছিল জেনি?জেনি বুঝতে পারল কিছু, আবার পারল না।মাটি খোঁড়া শেষ হলে ক্যাসিনো একবার চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ক্যাসিনো আলিসার দিকে একবার তাকিয়ে, নীরবে জেনিকে আবার কাঁধে তুলে নিল।এরপর এক মুহূর্ত দেরি না করে জেনিকে গর্তের ভেতর ফেলে দিল।
জেনে বুঝতে পারল এটাই হয়ত তার শেষ সময়। যন্ত্রণায় সমস্ত শরীর ফেটে পড়লো তার।হঠাৎ চোখের কোণ দিয়ে ঝরে পড়ল এক ফোঁটা পানি।ক্যাসিনো মাটি চাপা দিতে থাকলো জেনিকে। আর আলিসা নীরব হয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল সবকিছু।জেনির বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করা শক্তিটুকু তার একটুও নেই। সে না চিৎকার করতে পারছে, আর না বাধা দিতে পারছে। তৎক্ষণ আলিসা একমুঠো মাটি হাতে তুলে আনল। হাতটা থমকে গেল মাঝপথে তার।আলিসার চোখে কোনো অশ্রু নেই,কিন্তু তবুও ভেতরে কিছু একটা যেন ভেঙে পড়ছে।সে নীচু হয়ে জেনির নিথর মুখটার পাশে ফিসফিস করে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দিস। বিশ্বাস কর, তোকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম। এই পৃথিবীতে যদি কেউ আমার হৃদয়ের মানে বোঝে, সেটা তুই ছিলি।”
জেনির বুকের ভেতর ঘূর্ণি উঠল।তার দম বন্ধ হয়ে আসছে বেঁচে থাকার সমস্ত আকাঙ্ক্ষা মরে গেল তার।
আলিসা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পুনরায় বলল,
“কিন্তু আমার এই নিষিদ্ধ আসক্তি তোকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।এটা ভালোবাসা না এটা আমার নেশা।আর এই নেশাকে কাছে পাওয়ার জন্য তোকে বলিদান দিতেই হত।”
সে পাগলের মতো হাসল তারপর চোখের জল লুকাতে গিয়ে ফিসফিস করে আরও বলল,
“আমার ভালোবাসা তোকে কবরেও পৌঁছে দিল দেখেছিস কতটা ভয়ানক হয়ে গিয়েছি আমি?বিদায় জেনি!তোকে কোনোদিন ভুলবো না, অনেক মনে পড়বে তোর কথা।পারলে ক্ষমা করে দিস আমাকে।”
কথাটুকু শেষ করে আলিসা নিঃশব্দে মাটি তুলে জেনির মুখে ফেলল।মাটি পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেনির ঠোঁট কেঁপে উঠল, চোখ দিয়ে আরও এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।সর্বশেষে ক্যাসিনো সম্পূর্ণ মাটি চাপা দিয়ে জেনির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করল।আলিসা চোখের কোণ থেকে অগোচরে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
বাংলাদেশ,
রাতের গভীরতা যেন অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলেছে। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, একটি কালো রঙের গাড়িটি ছুটে চলেছে নির্জন ফাঁকা রাস্তায়। হেডলাইটের আলো ছাড়া চারপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ইউভান খুবই মনোযোগ সহকারে ড্রাইভিং করছে।জানালা দিয়ে আসা শো শো বাতাস তার চুলগুলোকে উড়িয়ে এলোমেলো করে দিচ্ছে।ইউভানের পাশের সিটে রাখা একটি কালো ব্যাগ মাঝে মাঝে নড়ছে। যেন ভেতরে কিছু একটা লাফাচ্ছে, ছটফট করছে। ইউভান পাশ ফিরে ব্যাগের দিকে একবার তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে থামলে অন্ধকার জঙ্গলের কিনারায়।ইউভান গাড়ি থেকে নেমে শক্ত হাতে ব্যাগটি তুলে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে লাগল।চতুরপাশে ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ ভেসে আসছে।একটু পথ এগিয়ে ঘন জঙ্গল পেরিয়ে ইউভান এসে দাঁড়াল এক পুরোনো ডুপ্লেক্স প্রাসাদের সামনে। কিন্তু পুরোনো হলেও এটাকে ভাঙা বাড়ি বলা যাবে না বরং একে বলা চলে নির্জন রাজপ্রাসাদ।বাসাটার গায়ে বুনে উঠেছে লতাপাতা। সামনের দেয়ালের উপরে একটা বিশাল সাপ ঝুলে আছে নিঃশব্দে ইউভানকে দেখে মাথাটা সামান্য নড়ল।
বাসার মূল ফটকের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে অন্তত ৫০ জন গার্ড সবাই কালো ইউনিফর্মে, চোখে কালো চশমা, মুখে নিঃশব্দ শৃঙ্খলা। সকলে মুহূর্তেই ইউভানকে দেখে সম্মানের সঙ্গে মাথা নীচু করল।ইউভান সোজা ফটকের দিকে এগিয়ে এল। গার্ডরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফটক খুলে দিল।যেন সিংহ প্রবেশ করছে তার গুহায়।ইউভান ভেতরে প্রবেশ করল গম্ভীর ভাবে।ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল অদ্ভুত সৌন্দর্য। বাসাটা ভেতর থেকে আশ্চর্যরকম সাজানো, দেয়ালের প্লাস্টার কিছুটা খসে পড়লেও, দেয়ালের পাশে সুশৃঙ্খলভাবে বসানো ছোট ছোট ইনডোর প্ল্যান্ট, স্নেক প্ল্যান্ট, আর অর্কিড।কয়েকটি কোণে কাঠের পুরোনো আসবাবপত্র সাজানো রয়েছে।বাসার ভেতরেও এিশ জনের মতো গার্ড সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে রোবটের ন্যায়।বাসাতে দেখতে পুরোনো দিনের মতোই রাজপ্রাসাদের মত।ইউভান আর সময় নষ্ট না করে সোজা রান্নাঘরের দিকে এগোল।রান্নাঘরটা অপেক্ষাকৃত গোছানো, যেন কেউ এখানে মাঝেমাঝে এসে কাজ করে। কাঠের মেঝেতে ধুলো জমলেও কাউন্টারটপটা পরিষ্কার।ইউভান ব্যাগটি নিচে নামিয়ে খুলে দিল তৎক্ষণ ব্যাগের ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো বিড়ালটি।
বিড়ালটি ছোটাছুটি করে এবং ম্যাও ম্যাও আওয়াজ করছে।ইউভান বিরক্ত হয়ে বিড়ালটিকে হাতে তুলে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“একদম চুপ। হুশশশ! কোনো শব্দ করবি না। তোর জীবনের শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে।”
বিড়ালটি ছটফট করতে থাকে, পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ইউভানের লৌহমুষ্টি থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।ইউভান প্রথমে হাতে গ্লোভস পড়ে নিল তারপর পাশে থাকা ধারালো ছুরি হাতে তুলে নিল।ধারালো ছুরিটা সোজা ঢুকিয়ে দিল বিড়ালের চোখের মধ্যে। চোখটা যেন কেটে গেল এক নিমিষে, রক্ত গড়াতে লাগল ধারার মতো। বিড়ালটা তীব্রভাবে চেঁচিয়ে উঠল, “ম্যাঁওউউউউ!”
আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল ঘরজুড়ে। বিড়ালটির শরীরটা কাঁপছে, ছটফট করছে কিন্তু ইউভানের হাতে কোন কম্পন নেই। ইউভান হঠাৎ থেমে গেল। তার দৃষ্টি স্থির বিড়ালের ছিন্নবিচ্ছিন্ন চোখের ভেতরে।হঠাৎ সে পাশের ছোট ব্যাগ থেকে বের করল একটা ধাতব হুকের মতো সরু টুল বের করল।সে টুলটা হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
“লেটস সি ওয়াট ইউ’আর হাইডিং!”
বলেই ধীরে ধীরে টুলটা ঢোকালো বিড়ালের ক্ষতবিক্ষত চোখের কোটরে।তখনই খচ শব্দ হয়ে টুলের শেষে যেন কিছু একটা আটকে গেল। ইউভান টেনে আনল সেটি খুব নিখুঁতভাবে।সে ধাতব বস্তুটি হাতের তালুতে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। এটি একটি ক্যামেরা যার লেন্সটা এখনও ফ্ল্যাশ করছে হালকা আলোতে।হ্যাঁ এটি সেই বিড়াল আর সেই ক্যামেরা যেটার কথা ক্লারা ড্রেভেনকে বলতে চেয়েছিল।আর এই কাজটা K.K এর লোক করেছে যেন আনায়ার উপর নজরদারি করতে পারে।সেই মুহূর্তে ইউভান ক্যামেরাটি চোখের সামনে তুলে ধরে শীতল কণ্ঠে বলল,
“ইউ ব্লাডি বিচ!আই ফা’ক ইউ ম্যান!”
বলে ক্যামেরাটি হাত দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে রক্তচাপা হাহাকার হাসি দিল।অপরদিকে বিড়ালটি গুমরে ওঠে, তার শরীর বিধ্বস্ত অবস্থায় ছটফট করে। বিড়ালের ছোট্ট পা দুটো অসহায়ভাবে আকাশের দিকে ছড়িয়ে আছে। ইউভান ধীরে ধীরে ছুরিটা রাখে বিড়ালের পেটের ঠিক মাঝখানে। একটু চাপ দিতেই চামড়াটা ফেটে যায় বিড়ালটির। সেই ফাটল দিয়ে গরম গরম লাল রক্ত বের হয়ে ফ্লোরে গড়িয়ে পড়ে। ইউভান থামে না। সে চামড়ার ধার ধরে আলতো করে টেনে ছাড়াতে থাকে। একটার পর একটা টানেই সাদা মাংসের স্তরগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাংসগুলো ছিন্ন হতে থাকে, ভেতরের তন্তুগুলো কেটে কেটে খুলে পড়ছে। একসময় পুরো বিড়ালটা শুধু মাংসের একটা রক্তমাখা দেহ হয়ে পড়ে রইল বোর্ডের ওপর।ইউভান দক্ষ হাতে বিড়ালটির চারটি পা আলাদা করে একপাশে রাখে। তার চোখে কোনো অনুশোচনা নেই।এই নিস্তব্ধতা ভেদ করে সে ফিসফিস কণ্ঠে বলতে থাকলো,
“আমার সানসাইনকে আমি ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। আর তুই! তুই তার শরীরের উষ্ণতা নিয়েছিস? কীভাবে নিয়েছিস বল? যেখানে আমি তার সেই নরম উষ্ণতা পাই না, সেখানে তুই তার তুলতুলে ঠোঁটের সংস্পর্শ পেয়েছিস।তোকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখি বল।”
ইউভান ভয়ংকর দৃষ্টি ফেলে বিড়ালটির মৃতদেহের উপর।সে বিড়ালের মৃতদেহ ধীরে ধীরে মিক্সচার মেশিনের ভেতরে রাখল। তার চোখে অদ্ভুত এক নৃশংস উল্লাস। ঠান্ডা কণ্ঠে নিজেই নিজেকে কিছু বিড়বিড় করে বলছে, তারপর সুইচ অন করে।তৎক্ষণ ইউভানের নোজ ব্লিডিং শুরু হলো। মুহূর্তের মধ্যেই একটি বিকট আওয়াজ হয়। মিক্সচার মেশিনের ভেতরে বিড়ালের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মাংসের টুকরো, হাড়ের খণ্ড, এবং রক্তের প্রবাহ মেশিনের ধারালো ব্লেডের আঘাতে ছিটকে পড়তে শুরু করে। চারদিকে বিদঘুটে মাংসের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ইউভানের মুখে কোনো ঘৃণা বা অনুশোচনা নেই। বরং তার ঠোঁটের কোণে অসুস্থ হাসির রেখা দেখা গেল।ইউভানের পুনরায় নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। ব্লাডিং ধীরে নয় বরং জোরে জোরেই গড়িয়ে পড়ছে। ইউভান হাতের গ্লাভস খুলে এক টুকরো টিস্যু দিয়ে রক্ত মুছল।কিন্তু তাতে কাজ হলো না বরং উল্টে তার শরীর স্নায়ু গরম হতে শুরু করল।
ইউভান তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে আসে। টেবিলের ওপরের সব পুরোনো কাগজ, বই, ও জিনিসপত্র সে ছুড়ে ফেলে দেয়। পাগলের মতো কিছু একটা খুঁজতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই পায় না। হঠাৎ মাথায় হাত দেয় কপাল ঘেমে ভিজে গেছে। তার চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। তার একটা জিনিস দরকার। খুব দরকার। কিন্তু সেটা কোথায়? কোথাও নেই। এই না পাওয়ার রাগে ইউভান একবার টেবিলে ঘুসি মারে।মুহূর্তের মধ্যে গার্ডরা ভয় পেয়ে দুই কদম পিছনে সরে যায়।তাদের কারোর মধ্যে সাহস নাই ইউভানের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করার। অপরদিকে ইউভানের নাক থেকে ক্রমশ রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।চোখের নীচ এবং ঘাড়ের শিরা ফুলে উঠেছে কয়েক গুণ।তার চোখ উতলা হয়ে ওঠে।
একপ্রকার উন্মত্ত হয়ে চারপাশে খুঁজতে রইল ইউভান আলমারি, সোফার নিচে, দরজার পাশে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে সে একটা ছোট ইনজেকশন খুঁজে পায়।
এক মুহূর্তও দেরি না করে সে ইনজেকশনটা নিজের হাতে পুশ করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে ইউভানের নিশ্বাস ধীর হয়, চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। শরীরটা কেমন হালকা লাগে তার।হঠাৎ শরীরের ভেতর একরকম গরম উত্তেজনা খেলে যায়।ইউভানের চোখের নেশা খেলা করে। ইউভান নিজের শরীরে পড়ে থাকা শার্টটি এক টানে খুলে ফেলে দিল। সে চোখের ইশারায় পাশে থাকা গার্ডকে কিছু বোঝায়। গার্ড কোনো শব্দ না করে দ্রুত পাশের টেবিল থেকে ওয়াইনের বোতল তুলে আনে।ইউভান হাত বাড়িয়ে বোতলটি নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো।কিছুক্ষণ বাদে সে এসে থামল একটি সুইমিং পুলের সামনে। কিন্তু এই পুল কোনো সাধারণ সুইমিং পুল নয়।এখানে জল নেই তার বদলে পুলটা পরিপূর্ণ তীব্র লাল তরল দিয়ে।সেই তরলটি রক্ত!মানুষের রক্ত!তাজা, উষ্ণ, ধকধকে মানুষের রক্ত দিয়ে পরিপূর্ণ পুলটি।
ইউভান বাঁকা একটা হাসি হেসে ধীরে ধীরে পুলে পা রাখল।প্রথমে রক্ত ইউভানের পায়ের গোড়ালি ছোঁয়, তারপর রক্ত ধীরে ধীরে হাঁটু, উরু হয়ে পেশীগুলো স্পর্শ করল।রক্তের স্পর্শে ইউভানের উন্মুক্ত শরীর আকর্ষণ তৈরি করছে।ইউভান এবার ওয়াইনের বোতল টা খুলে ঢক ঢক করে গলায় ঢালে এবং বারবার থেমে ফিসফিস করতে থাকে,
“আনু আমার! শুধু আমার অন্য কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।”
বিড়ালটি আনায়ার বুকে মাথা রেখেছে দৃশ্যটি চোখের সামনে আসতেই ইউভানের মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। সে দুই হাত মাথায় চেপে ধরে বলে,
“উফফফ!নো! নো! নো! ও কেন তোর বুকে মাথা রাখলো? কেন?…… উফফ! ত তুই আমার,শুধু আমার তোকে অন্য কেউ কেন স্পর্শ করবে?”
ইউভান আবার ওয়াইন মুখে নিলো। প্রতিবার ঢোক গিলবার সময় গলার পেশি ফুলে উঠে আবার নিচে নামে।আ্যডাম অ্যাপেলস তীব্রভাবে উঠানামা করছে।সে পুনরায় মাতাল কণ্ঠে বলল,
“নোপপপপ!নেভার এভার!আমি সব পুড়িয়ে দেবো, সব ধ্বংস করে দেব।তবুও তোর সংস্পর্শে কাউকে আসতে দিব না সুইটি।ইউ নো ওয়াট?ইউ আর মাই ডেঞ্জারেস অবসেশন।”
পরমুহূর্তে ইউভান তীব্রভাবে ওয়াইনের বোতলটি আছাড় মেরে ফেলল।ইউভানের নেশা ধরে গিয়েছে এবার।এই অদ্ভুত নেশার মাঝেই হঠাৎ তার চোখে পড়ে, সুইমিং পুলের গভীর লাল রঙের মাঝখান থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসছে এক রমণী।রমণীটির শরীর রক্তে ভেজা শরীর সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। ইউভান ঠোঁট ভিজিয়ে রমণীকে পানে তাকিয়ে নেশালো কণ্ঠে বলল,
“সুইটি!”
ইউভানের চোখে এখন আর কোনো বাস্তবতা নেই সে সম্পূর্ণ নেশার মধ্যে আচ্ছন্ন। সে হাত বাড়িয়ে রমণীর দিকে স্পর্শ করার চেষ্টা করল কিন্তু আফসোস! পারলো না কারণ রমণীটি আবার রক্তের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল।ইউভান এবার উদ্বিগ্ন হয়ে চারপাশে তাকালো।তারপর চিৎকার দিয়ে বলল,
“আনায়ায়ায়ায়ায়ায়া… য়ায়য়ায়া!”
ইউভান থামল কিছুক্ষণ। তারপর ঘাড় কাত করে ঠান্ডা বিষঝরা কণ্ঠে শুধালো,
“তোর সংস্পর্শে যারা আসবে, তাদের অস্তিত্ব আমি নিঃশেষ করে ফেলব।কারণ তুই কেবলই আমার,একান্তই আমার!তোর প্রতিটি উষ্ণ আলিঙ্গন শুধু আমার জন্য নির্ধারিত।তোর ওষ্ঠের উত্তাপ ছোঁয়ার অধিকার কেবল আমার নিয়তির অন্তর্ভুক্ত, অন্য কারও ভাগ্যপটে তা লিপিবদ্ধ নয়।তোর বক্ষস্থলে মাথা রাখার অধিকার শুধু আমার আছে, অন্য কারও নেই আর হবেও না।তোর পাশে থাকার অধিকার শুধু আমার সুইটি আর তোর থেকে বিচ্যুতি হলো এই ইউভানের ধ্বংস। ইউ আর মাই রুথলেসলি বিওন্ড প্যাশন লাভ সোলবিট।”
সকালে,
আনায়া ঘরের ভেতর বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে।গভীর ঘুমে মগ্ন আনায়া।কিন্তু হঠাৎ বাইরে গাড়ির হর্নের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল তার। দুই হাতে মাথা চেপে বিরক্তিকন্ঠ নিয়ে বলে,
“উফফফ, এত শব্দ কীসের?”
মাথা ভারী লাগছে তার,চোখ ফুলে গেছে।আনায়া ধীরে ধীরে উঠে বসে চারদিকে তাকায়। সে বাসায় কীভাবে এলো? কিছুই মাথায় ধরছে না।কিছুতেই মনে পড়ছে না, কাল রাতে কী হয়েছিল। শুধু এটুকু মনে আছে গত রাতে ইউভানের সাথে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর সে সিঁড়ি থেকে নামছিল।এরপর আর কিছু মনে পড়ছে না তার। আনায়া এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে ওঠে।কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। রুম থেকে বাইরে বের হয়ে আনায়া সম্পূর্ণ অবাক!পুরো বাসা ভর্তি মানুষজন কেন? কি হচ্ছে এখানে কিছু বুঝতে পারে না? ধীরে ধীরে সিঁড়ির কাছে এলো কিন্তু তখন ঘটলো আরেক বিপত্তি। সিঁড়ির সংখ্যা দেখে মাথা ঘুরে গেল। এতোগুলো সিঁড়ি কীভাবে পার হবে সে এখন?এক এক করে গুনতে থাকে আনায়া এক, দুই, তিন…. হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।সে এখন কষ্ট করে সিঁড়িবে নামতে পারবে না।সিঁড়ির পাশের রেলিংটার দিকে তাকায় আর সময় ব্যয় না করে একপাশে ব্যালেন্স করে বসে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নামল আনায়া।
এমন সময় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সায়মা বেগম। এই দৃশ্য দেখে তাঁর চোখ ছানাবড়া কপালে ভাঁজ পরল তার।সে আনায়ার দিকে তেড়ে এসে বলল,
“এটা কোন ধরনের নামার ধরণ আনায়া? যদি পরে গিয়ে ব্যথা পেতিস?”
আনায়া মুখে মেকি হাসি মেখে টেনে বলল,
“কিছুই হয়নি তো মামনি, রিল্যাক্স।”
হেসে এক দণ্ডে সব দোষ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে আনায়া।সায়মা বেগম একটুও গলে না। রান্নাঘরের কাউন্টার থেকে কফির মগটা এনে আনায়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আদেশ দিল,
“এইটা ইভানকে গিয়ে দিয়ে আয় রুমে।”
ইউভানের নামটা শোনামাত্রই আনায়ার চোখে এক তীব্র অভিমান জ্বলে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল রাতের মুহূর্ত ইউভান তাকে থাপ্পড় মেরেছে।সে তীব্র অভিমান নিয়ে বলল,
“আমি কেন মামনি?আমি পারবো না যেতে তুমি অন্য কাউকে বলো।”
সায়মা এবার বিরক্ত নিয়ে ধমক দিল,
“অন্য কেউ থাকলে কি তোকে বলতাম হ্যাঁ?বাসায় সবাই ব্যস্ত তোর মত কেউ খালি বসে নেই। এখন চুপচাপ যা কফি দিয়ে আয়।”
আনায়ার আর কী করার। মুগ গোমড়া করে যেতে থাকে ইউভানের রুমের দিকে। জীবনটাই তেজপাতা যতই চাই ওই বুইড়া ফকস্টার কাছ থেকে দূরে থাকবে।ততই যেন আরো বেশি করে যাওয়া লাগে তার কাছে।কালকের থাপ্পরের কথা ভুলিনি আনায়া।গাল তো না তার ঢোল পেয়েছে যখন ইচ্ছা তখন বাজিয়ে যাই হুহু। এসব চিন্তা-ভাবনা করতে করতেই আনায়া ইউভানের রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।সে সামান্য দরজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলো। চোখ ঘুরিয়ে দেখল একবার চারপাশ কোথাও নেই ইইভান। বিছানায় নেই, টেবিলে নেই, বারান্দাতেও না। আনায়ার চোখ কুঁচকে উঠল। বিরক্তি নিয়ে মগটা টেবিলের ওপর রাখল।সে এখানে এক মুহূর্ত দাঁড়াতে চাই না।তাই পিছনে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো কিন্তু তখন তার হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। আনায়া থেমে দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে তুলল। স্ক্রিনের আলোয় ভেসে উঠল খুব পরিচিত নাম্বার।আনায়া কলটা রিসিভ করে বলল,
“এই পরোটা! এতদিন পর তুই কোথায় ছিলি?”
ওপাশ থেকে পিহুর উচ্ছ্বাসে ভরা গলা বলল,
“সবকিছু বলব আগে আজ ভার্সিটিতে আয়।কতদিন দেখা হয় না তোদের সঙ্গে।বাই দ্য ওয়ে তোর গলার আওয়াজ এমন মানুষ কেন শোনা যাচ্ছে এত ভারী? শরীর ঠিক আছে তো তোর?
আনায়া উদাসীন হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় চলে আসল। একপাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বিষণ্ন কণ্ঠে বলল,
“আমার এক খবিশ বুড়ো ফকস্টার থুক্কু রকস্টার কাজিন আছে। যার জন্য আমার গলার এই অবস্থা।”
পিহু হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল,
“কী বুড়ো রকস্টার? আমি তো শুনেছি রকস্টাররা সবসময় হ্যান্ডসাম হয়।রকস্টারদের জন্য মেয়েরা মরিয়া হয়ে থাকে সবসময়।”
আনায়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“কোনো জিনিস পুরোনো হয়ে গেলে যেমন কাজের না, তেমন ঐ বুইড়ো খাটাশ সিঙ্গারের ইঞ্জিনও জং ধরে গেছে। ওটা ওই মেয়েদের আর কোনো কাজে লাগবে না তাই মরিয়া হলে ও বা কী?পুরোনো ইঞ্জিনে তেল ঢেলেও লাভ নায় ওটা আর চালু হবেনা।”
ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে ইউভান ধীর গলায় উত্তর দিল,
“ওহ তাই নাকি? আয় রুমে প্রাক্টিক্যালি বুঝিয়ে দি ইঞ্জিন ঠিকঠাক আছে নাকি।
আনায়া থতোমতো খেয়ে তাকাল সামনের দিকে।সে তড়িঘড়ি করে ফোনটা কেটে দিলো।গলার শুকনো ঢোক গিলে ধীরে ধীরে পিছন ফিরতেই তার নিশ্বাস আটকে যায়।ইউভান ঠিক তার সামনে, খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকজুড়ে জল টলটল করছে, সদ্য স্নান করে টাওয়েল জড়ানো শরীর থেকে পানি ফোঁটা ফোঁটা করে পড়ছে মেঝেতে। ভেজা চুলগুলো কপালের পাশে ঝুলে আছে।ইউভানের চোখ জোড়া তার উপরে নিবদ্ধ। আনায়া গলা নীচু করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শুধালো,
” না মানে।”
ইউভান একটু এগিয়ে আসল।ঠোঁটের কোনে এক টুকরো দুষ্টু হাসি নিয়ে পুনরায় বলল,
” কি হল ভয় পাচ্ছিস কেন?ইঞ্জিন স্টার্ট হয় নাকি চল দেখবি।”
আনায়া থতোমতো খেয়ে তাকাল।লজ্জায় তার মাটি খুঁড়ে নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছে।সে কোনোমতে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“দেখুন আপনি যা ভাবছেন তা মোটেও না।আমি আপনাকে নাহ অন্য কাউকে বলছি।আপনি শুধু শুধু কথা গায়ে মাখবেন না।”
আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৫
কিন্তু ইউভান নিঃশব্দে আনায়ার দিকে এক পা একটা করে এগোচ্ছে। এটা দেখে আনায়া ভয়ে পেছাতে পেছাতে গিয়ে একসময় রেলিঙের গায়ে ঠেকল। আর পেছনে যাওয়ার পথ নেই।আনায়া দৃষ্টি ইউভানের চোখের দিকে। ইউভানের চোখ অন্যদিন তুলনায় একটু বেশি ফোলা আর লাল লাগছে। ইউভান আনায়ার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। ইউভান আর একচুলও ফাঁকা রাখে না।সে একেবারে আনার গা মিশিয়ে দাঁড়ায় মাঝে কোনো দূরত্ব নেই।তার ত্বকের সঙ্গে ত্বক লেগে যায়। ইউভানের হিমশীতল শরীরের স্পর্শে আনায়া শিউরে ওঠে। সেই মুহূর্তেই, ইউভান মুখটা আনায়ার কানের কাছে এনে নীচু গলায় বলে,
“অনেক ছেড়ে দিয়েছি তোকে আনু। আর নাহ!সময় হয়ে এসেছে প্রাকটিক্যালি সব কিছু বোঝানোর।আর ইউ রেডি সুইটি?”