আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৭

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৭
প্রীতি আক্তার পিহু

সেই মুহূর্তেই, ইউভান মুখটা আনায়ার কানের সন্নিকটে এনে নিস্তব্ধ স্বরে বলল,
“অনেক ছেড়ে দিয়েছি তোকে আনু। আর না! সময় হয়ে এসেছে প্রাকটিক্যালি সব কিছু বোঝানোর। আর ইউ রেডি সুইটি?”
সদ্য স্নানশেষে ইউভানের অর্দ্ধনগ্ন দেহজুড়ে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ স্নিগ্ধ জলকণা।আনায়ার দৃষ্টি আটকালো ইউভানের নগ্ন বক্ষে,যেখানে কয়েকটা জলকণা জমে আছে।হঠাৎই ইউভানের সিক্ত চুল থেকে একফোঁটা শীতল জলবিন্দু টুপ করে পড়ল আনায়ার গ্রীবাপার্শ্বে।শীতল জলের সংস্পর্শে আনায়া আকস্মিক আঁখিদ্বয় বন্ধ করল।তার হৃদয় কাঁপন ধরল ভীতিতে নাকি সংকোচে, সে নিজেই নিরূপণ করতে পারে না।তখনই ইউভান ধীরে ধীরে আনায়ার কোমরে হাত রাখে।আনায়া চমকে উঠে কাঁপমান কণ্ঠে বলল,

“ছেড়ে দিন… কী করছেন আপনি? কেউ দেখে ফেলবে তো।”
ইউভান দৃষ্টি নামিয়ে ধীর ভঙ্গিতে আবার তুলে আনে। এরপর আনায়ার কোমরে আরও দৃঢ় আলিঙ্গনে চেপে ধরে তাকে টেনে আনে নিজস্ব নিকটতম সীমায়।মুহূর্তের মধ্যে আনায়ার ললাট গিয়ে ঠেকল ইউভানের সুগঠিত বক্ষদেশে।সেই মুহূর্তে, ইউভান গভীর স্বরে উচ্চারণ করল,
“দেখুক না! আমি তো আর কিছু আড়াল করছি না। এখন থেকে যা কিছু করব, সবাইকে দেখিয়েই করব।”
এক লহমায় আনায়ার চোখ বিস্ময়ে গোল হয়ে উঠল। সে ধীরে মাথা তোলে ইউভানের দৃষ্টিপাতে তাকায়।
ইউভান তার দিকে স্থির চাহনিতে তাকিয়ে আছে।
আনায়া এবার শুকনো ঢোক গিলে অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফুটিয়ে বলল,
“শুনুন, ভালো হবে না সাফ বলে দিচ্ছি। আপনি যা করছেন, তা একদমই শোভন নয়।”
ইউভানের ঠোঁটে রহস্যময় ম্লান হাসি ফুটে ওঠে। সে পুনরায় আনায়ার কর্ণছায়ায় মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“শোভন নয়? মন যখন কিছু কামনা করে, তখন কি সে যুক্তির দাঁড়িপাল্লায় মাপে ঠিক আর বেঠিক?”
এ কথা বলেই, ইউভান তার আঙুলের ডগাটি আনায়ার চিবুক ছুঁয়ে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনে গলার কাছাকাছি।আনায়ার নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ল অদৃশ্য শিহরণে। ইউভানের কণ্ঠের তপ্ত সঞ্চার আনায়ার কানের ভেতর দিয়ে হৃদয়ের অলিন্দ স্পর্শ করে যাচ্ছে।ইউভানের হাতের বিচরণ গাঢ় হচ্ছে এটা বুঝে আনায়া তড়িঘড়ি করে বলল,
“আপনি কী পাগল হয়ে গিয়েছেন ইউভান ভাই?”
ইউভান অমোঘ দৃষ্টিপাত করে অঁধর প্রসারিত করে হাসলো। তারপর ঠান্ডা শীতল কন্ঠে উত্তর দিল,
“এখন যদি পাগলের পাগলামি দেখাই সামলাতে পারবি তো?”

এহেন কথায় আনায়া চোখ তুলে তাকালো ইউভানের পানে।হঠাৎই তার দৃষ্টি আটকে গেল ইউভানের উন্মুক্ত গলার অ্যাডামস অ্যাপলএ।ভেজা শরীরের টানটান ত্বকের মাঝে গলার ঠিক মাঝ বরাবর তীক্ষ্ণ উঁচু হয়ে থাকা হাড়ের খাঁজ আনায়ার ভেতর অনিবার্য আকর্ষণ সৃষ্টি করে।আনায়া বড্ড ইচ্ছে হলো আঙুলের ডগা দিয়ে সে স্থানটি ছুঁয়ে দেখার!কিন্তু সাহস? আদৌ কি আছে তার এতটুকু সাহস?আনায়া হাত তুলতে গিয়েও থেমে গেল।ইউভান বিষয়টি লক্ষ্য করে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন হুমমম?আমাকে ছুঁয়ে দেখার বড্ড আকুলতা দেখতে পাচ্ছি তোর চোখে আমি।ডু ইউ ওয়ান্ট টু টাচ মি সুইটি?”

আনায়ার লজ্জায় মুখশ্রী লালিমায় বিভাসিত হলো।সে চোখ নামিয়ে লাজুক হাসল। ইশশশ কী লজ্জা!লজ্জায় মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে তার।ইউভান কীভাবে বুঝল তার চোখের ভাষা।তৎক্ষণ ইউভান ধীরে আনায়ার হাত তুলে নিয়ে তার গলার অ্যাডামস আপেল স্পর্শ করায়।মুহূর্তের মধ্যে আনায়া শিউরে ওঠে।তার পৃঠদেশ জুড়ে ঠান্ডা শীতল স্রোত নেমে আসল।সে হালকা মাথা উঁচু করল।তবে ঠিক তখনই…
আনায়ার দৃষ্টি হঠাৎই নেমে আসল ইউভানের বুকের ডান পাশে।সেখানে একটি গভীর ক্ষত চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।মাংস চিরে গভীরে ঢুকে যাওয়া সেই আঘাতটি দেখে কেঁপে ওঠে আনায়া।দেখে মনে হচ্ছে বহু পুরনো সেই ক্ষত।ক্ষত স্থানে ত্বকের উঁচু-নিচু ভাঁজ দেখে মনে হচ্ছে সেখানে কেউ দাঁত অথবা নখ দিয়ে ছিঁড়ে নিয়েছে মাংস।শুধু একটি নয় ইউভানের শরীরজুড়ে এমন আরও কত জায়গায় ক্ষত।প্রত্যেকটা ক্ষত দেখতে একই রকম,বহু পুরোনো দেখে মনে হবে কেউ দাঁত দিয়ে মাংস ছিড়ে এনেছে।আনায়ার হৃদয়ে যেন কেউ শাণিত কিছু বসিয়ে দেয়।তার গলায় কথা আটকে আসে। বুক ধড়ফড় করে ওঠে হাহাকারে।সে তড়িঘড়ি করে ইউভানের সেই ক্ষতের প্রান্তে আঙুল রেখে গলা কাঁপিয়ে শুধায়,

“আপনার শরীরের এই চিহ্নগুলো কিসের ইউভান ভাই?কী হয়েছিল আপনার?”
প্রশ্নটা শোনামাত্রই ইউভানের মুখের বর্ণ মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল।দৃষ্টিপাত থমকে দাঁড়ালো কয়েক সেকেন্ডে জন্য।চোয়াল কঠিন পাথরের মতো আঁটসাঁট হয়ে উঠল।হঠাৎ করেই রক্তাভ ধূসরতা ছেয়ে গেল ইউভানের মুখপটে।চোখজোড়া কাঁপতে লাগল অজানা কারণে।তার দৃষ্টি ঝাপসা হতে না হতেই ভেসে উঠল ভয়ংকর দৃশ্য।কী বীভৎস সেই দৃশ্য!নির্জন অন্ধকার কক্ষে জমে আছে পচা রক্তের গন্ধ।চারপাশে আতঙ্কের বিষাদবর্ণ ছায়া।চারদিক থেকে আসছে শুধু আর্তচিৎকার আর থকথকে রক্তস্রোত বইছে। ইউভান আবছা দেখতে পেল রক্তলিপ্ত ছেলেটিকে।হ্যাঁ সে-ই তো এটা! নিজেকে দেখছে সে রক্তভিজে শরীরে।শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে ইউভানের,এটা কি তার অতীত? না বর্তমানের কোনো অভিশাপ?
ইউভানের অস্বাভাবিক আচরণ প্রত্যক্ষ করে আনায়ার কণ্ঠনালি শুষ্ক হয়ে ওঠে।সে ইউভানকে উদ্দেশ্য করে পুনরায় উচ্চারণ করে,

“কী হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে? এমন অস্বাভাবিক আচরণ কেন করছেন?”
সঙ্গে সঙ্গেই নেত্রদ্বয় উন্মোচন করে তাকায় ইউভান।রক্তরঞ্জিত দৃষ্টিতে বিদ্ধ করে আনায়াকে।আনায়ার হৃদপিণ্ড ধকধকে করে উঠে ইউভানের সেই উগ্র দৃষ্টিতে।তখনই ইউভান চাপা দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“এই মুহূর্তে রুম থেকে বেরিয়ে যা আনু।”
আনায়া আতঙ্কাকুল হয়ে পড়ে।তার কাছে ইউভানকে সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে হচ্ছে।এমন ইউভান তো তার পরিচিত নয়।তবুও অন্তরের এক কোণে সাহসের ক্ষীণ স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল তার। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুষ্ক কণ্ঠে বলল,
“ইউভান ভাই… আপনার কি কিছু হয়েছে? দয়া করে স্পষ্ট করে বলুন আমায়।”
ইউভান অজানা এক প্ররোচনায় আত্মনিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে।তার গ্রীবার শিরা বিকটভাবে ফুলে ওঠে।অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রচণ্ড বেগে নিঃশ্বাস গ্রহণ করে বারবার।পরমুহূর্তেই গ্রীবা কাত করে আনায়ার দিকে চেয়ে পুনরায় বলে,
“চলে যা সানসাইন!পাগলামি করিস না প্লিজ! আমি সীমা লঙ্ঘন করে ফেলতে পারি।আমার চোখের সামনে দাঁড়াস না। বিদায় নে!”

আনায়া বুঝতে ব্যর্থ হয়, কিছুই স্পষ্ট হয় না তার কাছে।বক্ষের গভীরে চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে তার।সে পুনড়ায় কম্পমান কণ্ঠে বলে,
“ইউভান ভা……”
বাক্য অসম্পূর্ণই থাকল আনায়ার।তার আগেই ইউভান আনায়ার বাহু ধরে প্রচণ্ড টানে পিছনের দিকে নিক্ষেপ করে।আনায়া ধাক্কা খেয়ে ভূপতিত হলেও মাটিতে পড়ে না।ইউভান মুখ ফিরিয়ে বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে বলল,
“আই সেইড ইউ! গেট আউট!”

আনায়া সিক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু।সে উপলব্ধি করতে পারছে তার প্রস্থানই শ্রেয়তম।ইউভানের হিংস্র রূপের সাথে মোকাবেলা করতে সে ব্যর্থ। তাই সে বেদনাতুর হৃদয় বক্ষে ধারণ করে নিঃশব্দ পায়ে পিছু হটল। আনায়ার দরজার ওপারে অদৃশ্য হওয়া মাত্রই ইউভানের শরীর ঘেমে সিক্ত হয়ে ওঠে।তার গ্রীবার শিরা আরও স্ফীত হয়।সে কম্পিত হাতের ভর দিয়ে টেবিলে সামনে এসে দাঁড়ায়।দাঁড়িয়ে থাকাটা যন্ত্রণাদায় মতো ইউভানের নিকটে এই মুহূর্তে।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বিচলিত দৃষ্টিতে কিছু একটি খুঁজে। ঘরের সমস্তকিছু বিকল করে ফেলে সে।তবুও ইউভান স্থির হয় না।বিদ্যুৎবেগে ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা ইনজেকশন আঁকড়ে ধরে টেনে তোলে।এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে,দাঁতে দাঁত চেপে নিজের গ্রীবায় সেটি পুশ করে দেয়।এক নিমিষেই ইউভানের দেহ শীতল হয়ে ওঠে।চোখের লালাভ ঘোলাটে ছায়া ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে শুরু করে।তারপর তীব্র বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন কণ্ঠে শুধায়,
“আই’ম সরি সুইটি!আ আমি তোকে কষ্ট দিতে চাই না। আমার কাছে থাকলে তুই বড্ড কষ্ট পেতিস।এজন্য অনিচ্ছার শর্তও তোকে দূরে ঠেলে দিলাম।আমার আত্মার প্রতিটা স্পন্দন তুই, আমার সোলবিট!সরি! রিয়েলি ভ্যরি সরি!”
‘সরি’ একই কথা বারবার বলতে বলতে স্থির হয়ে হাঁটু গেরে মাটিতে বসে পড়লো ইউভান।

অপরদিকে, আনায়া বিমর্ষ হৃদয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। চারপাশে কী ঘটছে, সে কিছুই টের পাচ্ছে না।তার মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে ইউভানের অস্বাভাবিক ব্যবহার। আশ্চর্যজনকভাবে, সেই রুক্ষ আচরণের জন্য তার মনে একটুও রাগ কিংবা কষ্ট নেই। বরং বুকের গভীরে এক অজানা যন্ত্রণার স্রোত বইছে।ইউভানের গোপন ক্ষতচিহ্নগুলোর কথা ভাবতেই আনায়ার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।তার মনে প্রশ্নের ঢেউ উঠে, কী এমন ঘটেছে? ইউভান ভাইয়ের শরীরে এতগুলো আঘাতের চিহ্ন কেন? কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল নাকি?এসব ভাবতেই চোখের কোণে অশ্রু জমে ওঠে আনায়ার।হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ড্রয়িংরুমে বসে থাকা অতিথিদের উপর। খানিকটা বিস্ময়ে থমকে গেল সে, ইউভানের বড় মামারা এসেছে! সঙ্গে আছেন তাঁদের পরিবারের সকলে সাদনান, এবং তাঁদের বড় বোন তিন্নি।এমনকি তিন্নির ছোট্ট ফুটফুটে কন্যা তোহাও এসেছে।

তবে আনায়ার কিছু ভালো লাগছে না। তাই ভারাক্রান্ত অন্তর নিয়ে সে অন্যদিকে চলে যেতে উদ্যত হল ঠিক তখনই, দুই বছর বয়সী তোহা দৌড়ে এসে তাকে আলিঙ্গন করে ধরল।আনায়া একগাল মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে তোহাকে কোলে তুলে আদর করে।ঠিক তখনই সাদনান কটাক্ষভরে হেসে বলল,
“আহা! শালি সাহেবা অবশেষে নিদ্রাভঙ্গ করলেন। ওখানে দাঁড়িয়ে কী ভাবছেন? এখানে আসুন! হবু দুলাভাইকে আপ্যায়নের দায়িত্ব তো আপনারই।”
আনায়া হালকা এক চিলতে হাসল। তখনই রুহি তাকে কাছে টেনে নিজের পাশের আসনে বসাল।আনায়াকে দেখেই ইউভানের বড় মামা সাহেল শিকদার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“বাচ্চারা, তোমরা তো তাহলে গল্প করো। আমি উপরের ঘরে গিয়ে সবার সাথে একটু কুশল বিনিময় করে আসি।”
বলে স্থান ত্যাগ করলেন তিনি।আনায়া খুব নিখুঁতভাবে দৃশ্যটা পর্যবেক্ষণ করল,তবুও মৌনতা বজায় রাখল।
সে জানে তার বড় মামা কোনোদিনই তাকে সহ্য করতে পারেনা।তবু সবকিছু উপেক্ষা করে আনায়া তোহর সাথে খেলায় মত্ত হল।ঠিক তখনই সারাহ সকলের জন্য কফির ট্রে নিয়ে এল।এক কাপ কফি আনায়ার হাতে দিয়ে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলল,

“তুই নিজের দিকে একটুও নজর দিস না কেনো? এত বেলা অব্দি ঘুম! ভার্সিটিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে না তোর? রাতে খেয়েছিস কিনা কে জানে।নিজেকে যত্ন না করলে কীভাবে চলবে বল? আমি কি সারাক্ষণ পাশে থাকব বল?”
আনায়া বিরক্তির ভঙ্গিতে মুখ বিকৃত করে
কফির চুমুক দিয়ে বলল,
“হুহু তুমি আর যাবেই বা কোথায়?তোমাকে আমি এত তাড়াতাড়ি বিদায় দিতে পারি নাকি?প্রয়োজনে সাদনান ভাইয়াকে চিরজীবন অপেক্ষায় রাখব দেখে নিও।”
সাদনান হেসে উঠল।সারাহ তখন মমতামাখা চোখে চেয়ে রইল আনায়ার দিকে।তখনই রুহি মুখ খুলে বলে,
“আপুর আর মাত্র তিন দিন বাকি। তারপর শ্বশুরবাড়ির পথ ধরবে। আর তুই বলছিস যেতে দিবি না ভাইয়ার কাছে।”
আনায়া থেমে কফির মগটা হাতে নামিয়ে রেখে ছলছলে চোখে বলে উঠল,
“তোমরা সবাই মিলে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছ?সারাহ আপু তুমি বলো তো এই রুটি কি মজা করছে না আমার সঙ্গে?”

সারাহ গভীর এক নিশ্বাস ফেলে আনায়ার পাশে বসে মাথায় স্নেহভরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“মিথ্যা না রে, সত্যি বলছে। মেয়েদের তো একদিন না একদিন ঘর ছেড়ে পাড়ি দিতেই হয়।কারো আগে, কারো পরে। এতে মন খারাপ করার কিছু নেই। আমি তো চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছি না। মাঝেমধ্যে অবশ্যই ফিরে আসব আমার প্রিয় ছোট্ট বোনগুলোর কাছে।”
আনায়া তখন মুখ ভার করে মাথা নিচু করে ফেলল।
সারাহ কেবল তার বড় বোন নয়, বরং মায়ের স্থান নিয়েছে তার জীবনে।সারাহকে ছাড়া তার দিন কিভাবে চলবে এই ভাবনায় বুক কেঁদে ওঠে আনায়ার।পরিস্থিতির ভার লঘু করতে সাদনান হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
“উফফ শালীসাহেবা এমন করুণ মুখ করো না তো।
প্রয়োজনে তোমার আপুর সাথে তোমাকেও নিয়ে আসবো।বাসররাতে তোমরা দুই বোন মিলে আড্ডা দিবে আর আমি বসে বসে মশা মারব।”

আনায়া আর রুহি ফিক করে হাসল।সারাহ লাজুক মুখে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়।ঠিক তখনই আয়ান প্রবেশ করে ঘরে।চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
“কী অবস্থা সবার? আমাকে বাদ দিয়েই আড্ডা জমে উঠেছে নাকি?”
সাদনান গলা খাঁকারি দিয়ে হেসে উত্তর দেয়,
“তুই ছিলি না বলেই তো জমছিল না ভাই। আয় এসে বস।”
আয়ান এসে রুহির পাশেই বসল।রুহি সেটা দেখে নিজের শরীর একটু সরিয়ে নিতে চাইলেও তেমন একটা লাভ হলো না।আয়ানের দেহ স্পর্শ করে ফেলল তার শরীরকে।ঠিক সেই মুহূর্তে তিন্নি আয়ানের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে উঠল,

“তোমরা দুই ভাই কি তাহলে স্থির করেছ বিয়ে-সাদীর পথে আর পা রাখবে না? বাড়ির মেয়েদের তো বিদায় দিতেই হবে একে একে। আনায়া তো ছোট, তার পরেই আছে রুহির সিরিয়াল।”
তিন্নির কথাগুলি রুহির মোটেও পছন্দ হলো না।পিয়াস ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ের চিন্তাও করে না সে।আয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুহির দিকে।যেমন ইউভান আর আয়ান জমজ, তেমনি সারাহ আর রুহিও জমজ বোন।তবে রুহির শৈশবকালীন অসুস্থতায় তার পড়াশোনায় বড়সড় ছন্দপতন ঘটেছিল।বয়সে সে আনায়ার চেয়ে বড় হলেও চরিত্রে তাদের সম্পর্ক বরং বন্ধুত্বের মতো।সারাহ মাত্র কয়েক মিনিটের বড়,
তাই তাকে আপু বলে ডাকে রুহি।আয়ান পরিস্থিতি সামলিয়ে বলল,
“যাইহোক সবাইকে দেখছি ও কোথায়?ও কি বাসায় ফেরি নি আর?”
সাদনান মুখে গম্ভীর ভাব এনে উত্তর দিল,
“বাসায় ফিরতে না চাইলে তো আর জোর করা সম্ভব না।সে নিজের স্বপ্ন পূরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকুক।বাবার রাজনীতি সামলানোর জন্য আছি তো আমি।”
আয়ান আর কথা বাড়ালো না। সারাহ হয়তো বুঝতে পারছে এখানে কার কথা বলা হচ্ছে। তবে রুহি আর আনায়া অবুঝের ন্যয় তাকিয়ে আছে।তারা আজ অব্দি তাদের বড় মামাদের বাসায় যায়নি।তাই তারা তাদের পরিবার সম্পর্কে তেমন একটা জানেও না।আনায়া কিছুক্ষণ বাদে ভার্সিটি যাবে তার পূর্বে তোহার সাথে খেলেয় মেতে উঠল একটু।

ইউভান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে।পরণে একখানা কালচে শার্ট, আর গলার দিকের দুটি বোতাম খোলা।শার্টের হাতা সে মুড়িয়ে তুলেছে কনুই পর্যন্ত, ভাঁজ করে রাখা কাপড়ের গাঁথুনিতে তার কব্জির হাড় ও শিরার রেখাগুলো আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।তার বাম হাতে জড়ানো ধাতব নীল রঙের ডায়াল ও প্ল্যাটিনাম রিমে ঘেরা রাজকীয় ঘড়ি।চুলগুলি ওয়েভি স্টাইলে সজ্জিত, কিছুটা ঝুলে এসে কপালের ওপর পড়েছে।ইউভান ধীর পদক্ষেপে ‘Le Monde Sur Mesure’ নামক বিলাসবহুল সোনার কাঠামোগত পারফিউমটি হাতে তুলে নিল।ক্ষণমাত্রেই পারফিউমটির অন্তঃস্থ হীরাগুচ্ছ প্রখর আলোয় দীপ্তি ছড়াতে লাগল। পারফিউটির গায়ে ইউভানের নাম খোদাই করা।

এই পারফিউমটি ছিল সম্পূর্ণরূপে ইউভানের নিজস্ব নকশা ও পছন্দে Morreal Paris-এর মাধ্যমে কাস্টমাইজকৃত।বোতলটির সোনার আস্তরণ, হীরার বিন্যাস, ভরের সামঞ্জস্য ও সুবাসের প্রকৃতি সবকিছুই তার পছন্দের ছাঁচে গড়া।ইউভানের এই কাস্টমাইজড ‘Le Monde Sur Mesure’ পারফিউমটির মূল্য প্রায় ৯৮,৪৮৫ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ১২ কোটি টাকা।ইউভান এবার বোতলের মুখ খুলে শরীরের ঘাড়ের পাশে হালকা ছিটিয়ে দিল। মুহূর্তেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল দুর্দান্ত ঝাঁজালো গভীর সুবাস।
ইউভান আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ভার্সিটি উদ্দেশ্যে নিজ কক্ষ ত্যাগ করল।চলতি পথে হঠাৎ ইব্রাহিম চৌধুরীর ঘর থেকে ভেসে এলো কিছু কথা,যা শুনে ইউভান থেমে দাঁড়ালো।

“গতরাতে চট্টগ্রামের একটি অভিজাত ফাইভ-স্টার রিসোর্টে সংঘটিত হয়েছে এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ! এতে প্রাণ হারিয়েছেন বহু খ্যাতনামা শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। প্রাথমিক তদন্তে প্রতীয়মান হয়েছে এটি পূর্বপরিকল্পিত। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে বোমাটি কার দ্বারা, কীভাবে সংস্থাপন করা হয়েছে, তা উদ্ঘাটনের নিমিত্তে।”
সাহেল শিকদারের বলা বাক্য শুনে ইব্রাহিম চৌধুরী বিস্ময়াবিষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,
“এটা তো সেই রিসোর্ট… যেখানে গতকাল আমাদের অফিসিয়াল কনফারেন্স ছিল।আল্লাহর ভরসায় ছেলেমেয়েরা যথাসময়ে নিরাপদে আছে। কিন্তু এত জঘন্য, এত নিষ্ঠুর কর্ম কাদের দ্বারা সম্ভব?”
আহসান চৌধুরী পাশে বসে ছিলেন। তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্থির কণ্ঠে বললেন,

“এ নিশ্চয়ই কোনো অবোধ পিতা-মাতার কুলাঙ্গার সন্তানের কাজ। যার চরিত্রে নীতিবোধের বুনিয়াদ নেই, শিক্ষা-সংস্কারের ছোঁয়া পায়নি। তাই নিজের গোপন উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে নিরীহ মানুষের রক্তে পথ রাঙিয়ে দিচ্ছে।”
ইউভানের কর্ণকুহরে এই বাক্য প্রবেশ করতেই তার চোখ দুটো হঠাৎই তীক্ষ্ণভাবে সংকুচিত হয়ে উঠল। “কুলাঙ্গার সন্তান” এই শব্দটি অনাহূতভাবে তার হৃদয়ে গাঁথা হেঁকে বসলো। ইউভানের বুকের গভীরে অনির্বচনীয় জ্বালা জেগে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে তার ঠোঁটে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্যভরা নিঃশব্দ হাসি।এসব তোয়াক্কা না করে সে দৃঢ় পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল।কিন্তু হঠাৎই ইউভানের পা থেমে গেল। সে ঘুরে দাঁড়াল সোজা চলে এলো নুরজাহান বেগম তার মায়ের ঘরে।যেখানে বিছানায় তার মা বহু বছর প্যারালাইজড হয়ে শুয়ে আছে।ইউভান ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে তার মায়ের পাশে বসলো। মায়ের দিকে চোখ যেতেই বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল ইউভানের চোখের পাতায়। মায়ের কাঁপা হাতদুটো তুলে নিয়ে নিজের শক্ত হাতে ধরল সে।তারপর ঠোঁট ভিজিয়ে চাপা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল সে,

“মামনি!আমি নাকি কুলাঙ্গার সন্তান। কথাটা কে বলেছে জানো?”
নুরজাহান বেগমের অচল মুখে কোনো শব্দ ফোটে না।অবাক চোখে শুধু তাকিয়ে রইল ইউভানের পানে।তখনই ইউভান পুনরায় অধর কোণে ব্যঙ্গের বিদ্রূপ হাসি মেখে বলল,
“বাবা বলেছে মামনি!বলেছে আমি নাকি নিজের স্বার্থের জন্য মানুষের জীবন নিয়ে খেলি।আমি কুলাঙ্গার!”
স্বল্পক্ষণ থামল ইউভান! এবার তার শব্দগুলো বিচূর্ণিত যন্ত্রণায় উচ্চারিত হলো। প্রতিটি ধ্বনিতে তার হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে রক্তস্রোত ঝরে পড়ছে। সে পুনরায় মর্মন্তুদ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা মামনি, আমি কি সত্যিই এতটাই অধম? আমি কি জন্মলগ্ন থেকেই এমন ছিলাম?কেউ কি কোনোদিন স্বইচ্ছায় খারাপ হয় মমনি?আমার অধঃপতনের পেছনে একটি কালো জগৎ রয়েছে। সেই জগৎ কেউ অবলোকন করেনি মা।সে জগতে আমি তোমার প্রতীক্ষায় থাকতাম কিন্তু তুমি আসোনি। প্রতিটি রজনী নিঃসঙ্গতায় বিলীন হয়ে যেত আমার।তুমি আসোনি মামনি! একবারও না! কেন মমনি?কী এমন অপরাধ করেছিলাম আমি?”
এই প্রশ্নগুলো যেন তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বিদ্ধ করল নুরজাহান বেগমের হৃদয়ে।তার চোখের কোণে জমানো বেদনা অবশেষে ফুঁড়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা অশ্রুরূপে।ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা জাগল সন্তানকে বুকে চেপে ধরার, কিন্তু সে তো ব্যর্থ। ইউভান এবার থামল স্বল্পক্ষণ, মুখ নত করে স্মৃতির বিষাক্ত ছায়ায় আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল,
“জানো মামনি, এক ঝড়ের রাতে আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম একা।আমি শুধু একটিবার চাইতাম তুমি এসে বলো,ঘুমিয়ে পড়ো বাবা, আমি আছি। কিন্তু কেউ আসেনি মা, কেউ না।”

ইউভান এবার দুই হাত উচু করে নুরজাহান বেগমকে দেখিয়ে তীব্র অভিমান আর বিষাদের কণ্ঠে বলল,
“দেখো, এই দুইটা হাত একবার কেটে গিয়েছিল, খুব গাঢ়ভাবে। চারপাশে কেউ ছিল না। এতটা রক্ত ঝরছিল যে নিজেই নিজের ক্ষত সেলাই করতে হয়েছিল। কিছু খেতে পারছিলাম না। খাইয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না, মা।তবুও সেই রক্তরঞ্জিত হাতে নিজেকেই ক্ষুধা নিবারণ করতে হয়েছে।তুমি আসলে নাহ তাও!
এই কথাগুলো অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো আঘাত হানে নুরজাহান বেগমের হৃদয়-মর্মেতারে। বুকের ভিতর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো দহন।ইউভান হৃদয়বেদনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। আশ্চর্যজনকভাবে তবু তাঁর নয়নপাত্র থেকে এক বিন্দু অশ্রুও গড়িয়ে পড়ে না। সে স্বীয় বেদনা আবৃত রেখে পুনরায় বলল,
“প্রতি রাতগুলোতে আমি জানালার পাশে বসে থাকতাম। ভাবতাম হয়তো তুমি আসবে। হয়তো আজ তোমার মন ছুটে আসবে ছেলের কাছে। কিন্তু না… রাত অতিক্রান্ত হয়ে যেত, জানালার কাঁচ আবরণে ঢাকা পড়ত কুয়াশার জলকণায়।কিন্তু আমার ললাট কখনো ঢাকা পড়েনি তোমার স্নেহস্পর্শে।”
ইউভানের দৃষ্টি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে তার,তবুও সে থেমে যায় না। তার স্বর ক্রমে ক্রমে ফেটে পড়ে রক্তঝরা আত্মনিঃস্বরণে,

“মামনি, আমাকে কেউ কখনো হৃদয় থেকে ভালোবাসেনি। যদি একবারও বুঝতে পারতে, তোমাদের এই কুলাঙ্গার সন্তানের ভালোবাসার অভাবে প্রতিটি নিঃশ্বাসে কীভাবে যন্ত্রণার বিষ ঝরে পড়েছে। আমি তো মানুষ হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম মামনি। কিন্তু তারা আমাকে রূপান্তর করেছে এক বিভীষিকাময় দানবে। আমি আলোর পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলাম, অথচ প্রতিবারই তারা আমাকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। আর সেই কালো নিস্তব্ধতায় একটুকরো সোনালী রোদ হয়ে ধরা দিয়েছে আমার সানসাইন।”
এই কথাটি শুনে নুরজাহান বেগম বিস্ফারিত চক্ষে অপলক দৃষ্টিতে তাকালেন সন্তানের মুখপানে। তার সন্তানের উক্তির পূর্ণতার্থ তিনি অনুধাবনে ব্যর্থ হলেন।ইউভান এবার তার মায়ের হাত নিজের কপালে ঠেকিয়ে, নিষ্পাপ শিশুর মতো করুণ মিনতির স্বরে বলে উঠল,

“মামনি যদি কখনো ঠিকঠাকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠো তুমি, একটিবার শুধু আমাকে তোমার কোলের কাছে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিও।তোমার নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিও।আমার এই বায়না পূরণের জন্য হলেও তোমাকে সুস্থ হতে হবে।বুঝতে পেরেছ তুমি?বলো,তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে তো মামনি?”
এই অন্তিম প্রশ্নে নুরজাহান বেগমের বক্ষভূমি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল অস্ফুট মমতার উষ্ণতায়। তিনি দুঃসহ কষ্টে নয়নপাতা দুবার আবৃত করে সম্মতির প্রকাশ দিলেন। ইউভান ইঙ্গিত অনুধাবন করে মৃদু হাসি হেসে, মায়ের শরীরে অগোছালো চাদরখানি সুচারুরূপে সমন্বিত করে, বাতি নিভিয়ে নিঃশব্দে কক্ষত্যাগ করল।নুরজাহান বেগম স্থির নিস্পন্দ চক্ষু দিয়ে চেয়ে রইলেন সেই অভিমুখে।

ইউভান বিষন্ন হৃদয় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকালো জানালার পাশে দাঁড়ানো আনায়ার উপরে।মুহূর্তের মধ্যে তার দৃষ্টিতে ছড়িয়ে পড়ে মুগ্ধতা।আনায়া তোহাকে কোলে নিয়ে খেলা করছে।জানালা দিয়ে একফালি সোনালি আলো ঠিক আনায়ার চোখে এসে পড়ছে, ফলস্বরূপ, তার সোনালি চোখের রঙ আরো ঝকমকিয়ে উঠে।দেখে মনে হবে কোন দুর্লভ রত্নের ওপর সূর্যের আলো পড়েছে।ইউভানের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো আনায়ার সেই নয়নযুগলে। কিন্তু সহসা প্রশান্ত মুহূর্তটি কাঁচের কণার মতো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। খেলাচ্ছলে তোহা হঠাৎ আনায়ার চোখে সজোরে এক আঙুল প্রবিষ্ট করল।মুহুর্তেই আনায়া তোহাকে নামিয়ে, এক হাতে নয়ন আবৃত করে উচ্চকণ্ঠে আর্তনাদ করলো,
“আআহ্‌হ্‌!”
ইউভান বিস্ময়ে থমকে তাকাল। তাঁর ঠোঁট থেকে নির্গত হলো,

“ওহ শিটটট!”
এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে বিদ্যুৎবেগে ধাবিত হলো আনায়ার সন্নিকটে। ইউভান আনায়ার চোখ স্পর্শ করতেও ভীত যদি তার আনু আরও ব্যাথা পায়?সে কাঁপা কাঁপা হাতে বলে উঠলো,
“আনু! কী হয়ছে?চোখে লেগেছে? অনেক বেশি ব্যথা করছে নাকি?আনু!সে সামথিং প্লিজ সুইটি?”
আনায়া ধীরভাবে মাথা নেড়ে স্বীকার করলো। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ইউভান সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেল। নিজের চুল মুঠিবদ্ধ করে রুদ্ধ শ্বাসে বলে উঠলো,
“গড ড্যামিট!শিট! শিট! ইসস! আমি যদি একটু আগেই আসতাম।ইট’স মাই ফল্ট!”
পরক্ষণেই সে চারদিক তাকিয়ে বজ্রগম্ভীর স্বরে গর্জে উঠলো
“আয়ান!কোথায় সবাই!গাড়ি বের কর,হসপিটালে যেতে হবে আমাদের।”

এইদিকে আনায়া যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে। সে এক হাতে চোখ ঢেকে রেখেছে। ইউভান এবার আনায়ায় চোখে ফুঁ দিতে থাকল।তাতেও যখন কাজ হলো নাহ সে ধৈর্যহারা হয়ে বিচলিত কন্ঠে বলল,
“উফফ!তোর চোখ!না! না! কিছু হবে না তোর সুইটি। ব্যথা হচ্ছে খুব?কি করব আমি?শিটটটট!”
ইউভানের এই উন্মত্ত ব্যবহারে আনায়া বিস্ময়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো,
“ইউভান ভাই, আমি সুস্থ আছি। গুরুতর কিছু হয়নি। দয়া করে আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না।”
ইউভান তখন আনায়ার মুখমণ্ডল দু’হাতে আবদ্ধ করে বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল,
“তুই ঠিক নাই! ঠিক নাই মানে ঠিক নাই! তুই জানিস না চোখ কত সেনসিটিভ। তোর চোখ ইফফ!এই গোল্ডেন আইজ, আমার জান নষ্ট হয়ে যাবে যদি কিছু হয়। কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি।ডাক্তারের কাছে যেতে হবে আমাদের।”
পরমুহূর্তেই সে পুনরায় তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলো,
“আয়ানননননননন!”

হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তোহার দিকে। ইউভান রক্তাভ চোখে তাকিয়ে আঙুল নির্দেশ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“হেই ব্লাডি বিচ! ওয়াট দ্যা হেল ডিড ইউ ডু?”
আনায়া থমকে যায়।তার শরীর কেঁপে ওঠে।ইউভান বাচ্চার সঙ্গে এরূপ আচরণ করবে সেটা তার কল্পনারও বাইরে।সে কোনোমতে ইউভানকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ও বাচ্চা মানুষ ইউভান ভাই।দেখুন আমি ঠিক আছি একদম। দয়া করে আপনি উতলা হবেন না।”
ইউভান এবার আনায়ার বাহুদ্বয় আঁকড়ে ধরে শুধালো,
“নো ইউ আর নট!ইউ ক্যান’ট সি প্রোপারলি সুইটি।আর তুই বলছিস তুই ঠিক আছিস?আর ইউ কিডিং মি? তুই কি আমাকে পাগল বানাতে চাস?
এমন সময় আয়ান ও রুহি এসে পৌঁছাল। আয়ান এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
“কি হয়েছে ভাই? কার কি হয়েছে, কাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে?”
কিন্তু ইউভান কারো কথার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করছে নাহ।সে আনায়ার চোখে ফুঁ দিচ্ছে আর আপনমনে বিড়বিড় করে বলছে,

“নো! ইউর গোল্ডেন আইস!তোর চোখের কিছু হতে পারে না।ও গোড!
তোহা কোণায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর ভয়ে কাঁপছে।যদিও আনায়ার ক্ষত গুরুতর নয়, নয়নের অভ্যন্তরে জ্বালা অনুভূত হচ্ছে। সে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। এই দৃশ্য দেখে ইউভান আরও উদগ্র হয়ে ওঠে। শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

“সানসাইন! আমার দিকে তাকা তুই? চোখ মেল! সুইটি প্লিজ!শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”
ইউভানের এমন রূপান্তরিত আচরণে রুহি বিমূঢ় হয়ে গেল।আয়ান শান্ত কণ্ঠে বলল,
“ভাই আনায়ার চোখ শুধু একটু লাল হয়েছে। ওরকম কিছুই না! এত প্যানিক হচ্ছিস কেন তুই?”
ইউভান এক ঝটকায় আয়ানের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠল,
“তুই ডাক্তার? তুই জানিস চোখ কি হয়েছে? এখনি ডাক্তার লাগবে।গাড়ি বের কর!”
ইউভানের চিৎকারে পুরো বাসা কেঁপে উঠলো।আয়ান চারপাশ দেখে নিলো, ড্রয়িংরুমে তারা ছাড়া আর কেউ নেই। এমন সময় আনায়ার চোখে তীব্র জ্বালা অনুভব হয়, সে আবারও আর্তনাদ করে উঠলো,
“আহহহহহ! চোখটা জ্বলছে আমার।”

ইউভান তখন আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। আয়ানসহ সকলে হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। আনায়া বিস্ময়ে এক চোখে ইউভানকে দেখার চেষ্টা করে। ইউভান বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসে, এক হাতে আনায়াকে জড়িয়ে অন্য হাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরে ইঞ্জিন চালু করে দেয়।কিছু পথ অতিক্রম হতেই আরও দুইটা গাড়ি আসল সুরক্ষিত গার্ড ভর্তি।একটি গাড়ি ইউভানের সামনে এবং অপরটি পেছনে।আনায়ার চোখে যন্ত্রণা হলেও তার চেতনা অটুট।সে কম্পিত কণ্ঠে আওড়ায়,
“ই ইউভান ভাই! ”
ইউভান আনায়ার মাথা নিজ বক্ষের সঙ্গে আরো জোরে চেপে ধরল।তারপর সে কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল,
” সরি সুইটি!মাই ফল্ট! এভরিথিং মাই ফল্ট!সুইটি বেশি কষ্ট হচ্ছে হুমমম?এইতো চলে এসেছি আমরা একটু প্লিজ আর একটু সহ্য কর।”

আনায়া নিজের ব্যথাকে সামলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন ইউভান ভাই?সামান্য বিষয়ে কেউ হসপিটালে যাই?”
ইউভান রেগে গাড়ির স্পিড কয়েক গুণ তীব্র করে। ফলস্বরূপ আনায়া ইউভানকে বহুগুণ শক্তভাবে আলিঙ্গন করে ধরল। মুহূর্তের ব্যবধানে ইউভান কণ্ঠস্বর ঝাঁঝালো করে বলে উঠল
“হুশশশশশ!চুপটি করে শুয়ে থাক।একটু নাড়াচাড়া করিস না।বেশি নাড়াচাড়া করলে তোর আইসে ব্যাথা হবে আরও। প্লিজ সুইটি আমাকে আর পেইন দিস নাহ।”

আনায়া নিরুচ্চারে স্থির হয়ে রইল। ইউভানের ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপ সে অনুধাবন করতে পারছে না। ইউভানের সহস্র রূপ তার কাছে এক একটি অপরিচিত মুখোশ। ইউভান তার মাথায় স্নিগ্ধভাবে স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আপনমনে অস্পষ্ট স্বরে কিছু বিড়বিড় করছে।আনায়া এবার নীরব কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“আপনি উন্মাদ ইউভান ভাই।বদ্ধ উন্মাদ!”
ইউভানের অধরে এক চিলতে রহস্যাচ্ছন্ন হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়ল। সে আনায়ার কপালে অতিশয় কোমল চুম্বন এঁকে দিল, এতটাই মৃদু যে আনায়া তা অনুধাবনই করতে পারল না। এরপর ধীর কণ্ঠে শুধালো,
“তোর জন্য! কেবলমাত্র তোর জন্য সুইটি।”
আনায়া নিঃশব্দে নিজের মনে ভাবতে লাগল, “এই মানুষটা এতটা উন্মাদ হতে পারে? আমার চোখের সামান্য লালচে আভা নিয়ে? আমার চোখ তার এতটা প্রিয়?” এসব ভাবনায় ডুবে রইল আনায়া।খানিকক্ষণ পরেই ইউভান হসপিটালের সামনে এসে গাড়ি থামালো। ইউভান কোনো কথার অপেক্ষা না করে আনায়াকে দ্রুত কোলের মাঝে তুলে নিলো।

আশেপাশে দাড়ানো গার্ডদের প্রত্যেকের কোমরে ঝোলানো ব্ল্যাক ম্যাট হ্যান্ডগান, মুহূর্তেই তারা অবস্থান বদলে দু’পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।ইউভান আনায়াকে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো।করিডোরের এক প্রান্তে নার্স, রোগীর আত্মীয়; অপর প্রান্তে কিছু ইন্টার্ন চিকিৎসক স্থবির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সকলেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে দেখছে প্রখর চেহারার পুরুষটিকে। ইউভান আনায়াকে এমন সযত্নে আগলে রেখেছে যেন আনায়া তার আত্মার চেয়েও দামী সম্পদ।হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই ইউভান গর্জে উঠল,
“ইমারজেন্সি ক্যাবিন নাও!আইস ইনজুরি।”
আনায়া ক্রমগত হতভম্ব হচ্ছে।ইউভান এমন আচরণ করছে যেন আনায়ার বড়সড় কিছু হয়েছে।তৎক্ষণ।দ্রুত একজন নার্স সম্মুখে এগিয়ে এসে বলল,
“স্যার অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে চলুন।”

এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে ইউভান সেই নির্দেশ অনুসরণ করল। আনায়াকে কোলে করে সে কেবিনে প্রবেশ করল। দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই সেখানে উপস্থিত সকলের নিঃশ্বাস থেমে গেল। রুমের এক প্রান্তে দাঁড়ানো একজন অভিজ্ঞ চক্ষু বিশেষজ্ঞ; কিন্তু ইউভান প্রবেশ করতেই তাঁর মুখাবয়ব বিবর্ণ হয়ে উঠল। কারণ কক্ষের আগে থেকেই অবস্থানরত চারজন সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী।যারা ইউভানের প্রবেশমাত্র আরও এলার্ট হয়ে গেল। মহিলা চিকিৎসক থমকে তাকালেন ইউভানের দিকে।তারপর চারপাশের ভয়াবহ পরিবেশ উপলব্ধি করে আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,
“ওয়াট হ্যাপেন স্যার?”
ইউভান আনায়কে বেডে শুইয়ে দিলো। তারপর রীতিমতো কাঁপা কণ্ঠে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“প্লিজ ডু সামথিং! ওর চোখে ইনজুরি হয়ছে।সি ইজ হার্ট, ব্যান্ডলি হার্ট।প্লিজ! ওর চোখে কোনরকম ক্ষতি যেন না হয়।”

ডাক্তার ইউভানের বাগ্মীতা শুনে দ্রুততার সঙ্গে আনায়ার নিকট এসে চোখ পরীক্ষা করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। তোর মধ্যে বিস্মিত জড়িত কন্ঠে বললেন,
“স্যার শান্ত হোন প্লিজ।তেমন সিরিয়াস কোন ইনজুরি না সামান্য পরিমাণ লাল হয়েছে শুধু।চোখে সামান্য ধুলাবালি গেলেও এমনটা হয়।”
আনায়া এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে পূর্ব থেকেই জানতো ঘটনাটি অতটা গুরুতর নয়, তবুও ইউভানের পাগলামি জন্য সে চোখ থেকেছে। আনায়া ঠিক সেই মুহূর্তেই ইউভানের পুনরায় গর্জন শুনল,
“নো!ডোন্ট সে ইট’স নাথিং।হার গোল্ড আইজ.. ওহ শিটটট!”
আনায়া এবার কিছুটা বিরক্ত হয়। তার চোখ দুটো বন্ধ থাকলেও সে সবকিছু শুনতে পাচ্ছে।এক হাত দিয়ে ইউভানের হাত আকড়ে ধরল আনায়া।তখনই ইউভান শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তার দিকে। আনায়া মৃদু চাপা স্বরে শুধালো,
“আপনি প্লিজ একটু থামুন।ডক্টর যখন বলছে কিছু হয়নি শুধু শুধু কেন আপনি চিন্তা করছেন?”
ইউভান আনায়ার হাত আরও দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরল। তারপর সেই হাতটা ধীরে নিজের মুখের ধারে টেনে নিল। চোখ নামিয়ে আঙুলের গা ঘেঁষে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

“কিছু বলিস না সুইটি।আমি যখন ফিল করতে পারব তুই ঠিক আছিস, তখনই তুই ঠিক থাকবি তার আগে না।”
আনায়া স্তব্ধ হয়ে গেল। তার ওষ্ঠ থেকে আর একটি শব্দও নিঃসৃত হলো না। ইউভান এবার দৃষ্টিকে রক্তাভ করে তাকাল ডক্টরে দিকে। ডাক্তার বিস্ময়ে কাঁপতে কাঁপতে কিছু বলার প্রয়াস করল, কিন্তু ইউভান পুনরায় বজ্রনিনাদে বলে উঠলো,
“ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম,জাস্ট চেক হার আইস!আই ক্যন’ট টেক রিস্ক।আন্ডারস্ট্যান্ড?”
ডাক্তার এতটা প্রতিক্রিয়া আশা করেননি। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। কণ্ঠে ক্ষীণ কাঁপুনি নিয়ে বললেন,
“ওকে স্যার আমি ম্যাডামের চিকিৎসা করছি।আপনি একটু বাইরে যান প্লিজ! এত মানুষ থাকলে চিকিৎসা করা সম্ভব না।”
ইউভান কিছু বলবে এমন সময় পিছন থেকে হালকা কণ্ঠে ভেসে এলো,

“ইউভান ভাই প্লিজ। আমি ঠিক আছি, এবার অন্তত আমার কথাটা রাখুন, বাইরে যান প্লিজ।”
আনায়ার অনুরোধ সে উপেক্ষা করতে পারল না। চুপচাপ এক নজরে গার্ডের দিকে ইশারা করল, সঙ্গে সঙ্গে সকল নিরাপত্তারক্ষী বাইরে চলে গেল। ইউভানও আনায়ার দিকে একবার তাকিয়ে নীরবে দরজা অতিক্রম করল।ইউভান কক্ষ ত্যাগ করতেই ডাক্তার এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ধীরে ধীরে আনায়ার দিকে এগিয়ে এসে একটি ঔষধি ড্রপ তার চোখে প্রয়োগ করে বলল,
“চোখে এটা দিলে আরাম লাগবে হালকা লালভাবটা কমে যাবে।”
আনায়া মাথা নাড়ালো।ডক্টর এবার হালকা গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আঘাতটা কিভাবে লাগলো, বলবেন ম্যাডাম? স্যার তো একটু বেশিই রিঅ্যাক্ট করলেন।”
আনায়া হালকা হেসে উত্তর দিল,
“উনি এমনই, কিছু মনে করবেন না।”
ডাক্তার একচেটা হাসি দিয়ে বললো,

“ইট’স ওকে! তবে আপনি সত্যিই ভাগ্যবতী। কেউ চোখের সামান্য লালচে আভা নিয়েও এত উদ্বিগ্ন হতে পারে, সেটা স্যারকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আপাতত আপনি বিশ্রাম নিন, চোখ বন্ধ রাখুন।”
আনায়া হালকা হাসল। ইউভানের পাগলামির কথা মনে পড়তেই তার হৃদয়ের গহীনে অজানা উত্তাপ জেগে উঠল। ইউভানকে সে নিজ হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে, আর সেই ইউভান এতটা অস্থির হয়ে আছে তাকে ঘিরে এই ভাবনায় আনায়ার অন্তর ক্রমশ গলে যেতে লাগল।তার হৃদয় সত্যি বসন্তের আগমন ঘটলো।তবে এ বসন্ত ফুলের নয় বরং স্পর্শহীন প্রেমের ঋতুর যা চক্ষুগোচর নয়। আনায়া এবার ওষ্ঠ প্রসারিত করে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
“আপনার এই ব্যাকুলতাই আমার প্রতীক্ষার সমাপ্তি টেনে দিল ইউভান ভাই।আপনাকে ভালোবাসার তীব্রতা ক্রমগত বাড়ছে আমার।এই তীব্রতা কিভাবে কমাবো আমি?আপনাকে কাছে পাওয়া না অব্দি এই তীব্রতা যে কমবে না আমার।”

অন্ধকার কালকুটুরিতে ইন্সপেক্টর কৃষান আলিসার বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। সে এটুকু অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে যে, আলিসা সুস্থচেতনার কোনো নারী নয়। সে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত, অন্যথায় কেউ কিভাবে নিজ হাতে শৈশবের বন্ধুকে সমাহিত করতে পারে? কেমন করে একজন ধর্ষকের প্রতি মোহাবিষ্ট হতে পারে? আলিসার দৃষ্টিতে একরাশ শুন্যতা। সে নিঃশব্দে শির নিচু করে আছে। কৃষান এবার বিস্ময়ে আচ্ছন্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
“আপনি কিভাবে পারলেন নিজ বান্ধবীকে কবর দিতে?আপনার চোখের সামনে তাকে ধর্ষণ করা হলো আর আপনি তাকে ছেড়ে দিলেন?”
এতটা ধারালো প্রশ্নে ও আলিসা কেঁপে উঠেনি। নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কৃষানের চোখে। তারপর ধীরে, স্থির স্বরে বলল,

“কারণ আমি খারাপ।খারাপদের জন্মই তো হয় খারাপ কাজের জন্য।খারাপরা কারণ অকারণে খারাপ কাজ করে।”
কৃষান ঠোঁট কামড়ে ধরল।সে এবার পরের প্রশ্নটা ছুড়ে দিল,
“তাহলে বলুন, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া শিশুদের নিয়ে ক্যাসিনো কী করতো?”
এই প্রশ্নের পর পুরো ঘরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এক পলক চুপচাপ বসে থেকে আলিসা ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“এক্সপেরিমেন্ট করতো। আ আর জানোয়ারদের খাবার হিসেবে ব্যবহার করতো ওই নিরিহ বাচ্চাদের।”
কৃষানের চোখ বিস্ফোরিত। হৃদয়টা থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য তার।কেউ এতটা নির্মম কিভাবে হতে পারে? কতটা নির্মমতা!কতটা বিকৃতি! এভাবে কেউ কী পারেও?সে রক্তশীতল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
“কি বললেন আপনি? কিসের এক্সপেরিমেন্ট?”
আলিসা এবার চোখ নামিয়ে শান্তভাবে জবাব দেয়,
“মানব-জীববিজ্ঞানের নিষিদ্ধ অধ্যায় নিয়ে কাজ করতো ও, আররর আর…!”

কিছুটা স্থির হলো আলিসা। তার চক্ষু-প্রান্ত থেকে এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল। অশ্রুবিন্দুটি সে তার করদ্বয়ের আড়ালে নিঃশব্দে মুছে ফেলল। কৃষানের নেত্রে নেত্র স্থাপন করে ব্যাকুল অনুনয় নিয়ে পুনরায় উচ্চারণ করল,
“বলবো, আমি সব বলবো। কিন্তু তার আগে বলুন, আপনি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনবেন? আমি জানি ও এখনো কোথাও আছে। জীবিত আছে।”
কৃষান মুহূর্তকাল থমকে রইল। আলিসা নিজেই অভিযুক্ত। সংবিধান অনুযায়ী অপরাধিনী। কিন্তু সত্যটা সামনে আনতে হবে এখনই। কারণ এখনো বাংলাদেশ থেকে শিশুপাচার চলছে। আর যদি ক্যাসিনো ধরা পড়ে, তাহলে এ চক্রের মূল মাথাগুলোও ধরা পড়বে।সে গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
“আমি প্রতিজ্ঞা করছি। আপনার মেয়েকে ফিরিয়ে আনবো। তবে এখন আপনি আমাকে সব বলুন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।”

আলিসা সামান্য শিরদাড়া সোজা করল। অতঃপর নীরবতায় আচ্ছন্ন কণ্ঠে তার অতীত বর্ণনা আরম্ভ করল……..
আমেরিকা, নিউইয়র্ক সিটি,
ঘন নৈঃশব্দ্যের জঙ্গলে জেনির মৃতদেহ মাটির অতলে চাপা দিয়ে ক্যাসিনো পিছন ফিরে দাঁড়াল।আলিসা জেনির কবরের দিকে দীর্ঘ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে।তখন ক্যাসিনো জেনিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“তো আমাকে সাহায্য করার কারণ কি গার্ল?”
তার কথায় আলিসার মুখে রহস্যময় বিদ্রুপ ছড়িয়ে পড়ল।ঠোঁটে খেলল অন্ধকার হাসির রেখা। গা শিউরে ওঠা কণ্ঠে সে উত্তর দিল,
“এই আলিসা কোনোকিছুর বিনিময়হীন ত্যাগে বিশ্বাসী নয়, মিস্টার ক্যাসিনো। আমি যা করি, তার প্রতিদান দাবি করি।”
ক্যাসিনোর চোখে ছায়া পড়ল সংশয়ের। ডান চোখের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে উঠে সে বলে উঠল

“হুঁ! তাহলে বলো কি চাও তুমি? কত টাকা প্রয়োজন তোমার?
কথাটা শুনেই আলিসার ঠোঁটে ছায়া পড়ল ঠান্ডা হাসির। সে ধীরে একপা এগিয়ে এসে সরাসরি ক্যাসিনোর চোখে চোখ রেখে প্রতিধ্বনির মতো বলল,
“টাকা নয়, আমি চাই আপনাকে।”
ক্যাসিনোর বুক থরথরিয়ে উঠল। চোখে ফুটে উঠল বিভ্রান্তি। বিস্ময়ে গলা কাঁপিয়ে সে প্রশ্ন করল,
“তুমি কী বললে?”
আলিসার ঠোঁটের কোণে সেই একই রহস্যময় হাসি খেলে গেল। সে এবার সুস্পষ্ট স্বরে বলল,
“আপনাকে বিয়ে করতে চাই আমি।”
এই বাক্য বাজ হয়ে আছড়ে পড়ল ক্যাসিনোর অন্তরে। তার শিরদাঁড়ায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে কণ্ঠে চাপা আগুন নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি কি জানো আমি কে? আমি কী কী করেছি জানো তুমি?”
আলিসার দৃষ্টি তখন পাথরের মতো অচঞ্চল। স্থির অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সে উচ্চারণ করল,
“জানি। আপনি একজন পাশবিক ধর্ষক।”
এই একফোঁটা বাক্য কামানের গোলার মতো বুক চিরে ঢুকে গেল ক্যাসিনোর। চোখে জ্বলে উঠল অবিশ্বাস। গর্জন তুলে সে বলল,
“তাহলে তোমার হুঁশ আছে?”

আলিসা পুনরায় শিথিল পদক্ষেপে ক্যাসিনোর সন্নিকটে এগিয়ে এলো। এবার তার মুখাবয়বের হাস্যচ্ছবি সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ক্যাসিনোর রক্তরাঙা লাল চুলের উপর। প্রবলভাবে মোহাচ্ছন্ন করল আলিসাকে এই আগুনরঙা লাল চুলগুলো। তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হলো তার ছুঁয়ে দেখার।এ আকুল তাড়না সে রোধ করতে অপারগ হওয়ায়, স্নিগ্ধ হাতে ক্যাসিনোর চুল স্পর্শ করে উচ্চারণ করল,
“হ্যাঁ অথবা না উত্তর দিন আপনি।”
ক্যাসিনো হঠাৎ আলিসার চুলে মুঠি আঁকড়ে ধরল, টেনে নিল নিজের দিকে। ব্যথায় আলিসার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো চাপা কাঁপা শব্দ তবুও সে নীরব রইল। সেই দৃশ্য দেখে ক্যাসিনো ছায়াচ্ছন্ন কণ্ঠে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল,
“আর যদি না বলি বেইব? কী করবে তখন?”

আলিসা ধীরে তার হাত ছাড়িয়ে নিল, পকেট থেকে ফোনটা বার করল। চোখে জ্বলছিল ধূর্ত নিষ্ঠুরতা। সে ফোনে একটি ভিডিও প্লে করে ক্যাসিনোর চোখের সামনে ধরল,
“তাহলে একবার দেখুন এটি। ভাবুন তো, সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি প্রকাশ পেলে কী ঘটে যাবে?”
ক্যাসিনোর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। ভিডিওতে ছিল সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য যেখানে সে এক তরুণীকে নির্মমতার চূড়ান্তে ধর্ষণ করে দগ্ধ করছে। তার কপাল বেয়ে অজস্র ঘাম ঝরতে লাগল। কণ্ঠ কেঁপে উঠে বলল,
“এই মেয়ে তুমি এসব কী করছো? কী চাও?”

আলিসা ধীরে ফোনটা নামিয়ে ক্যাসিনোর গলায় দুই হাত রাখল। আঙুলগুলো দিয়ে সে গলা বরাবর নামাতে লাগল। সেই স্পর্শে ক্যাসিনোর চোখ ঘোলাটে হয়ে এলো।ঠোঁটে ছায়াপাত হাসি নিয়ে আলিসা ফিসফিস করে বলল,
“আপনাকে চাই আমি, মিস্টার ক্যাসিনো।নিজের মতো করে নাহ,আপনার মতো করেই আমি আপনাকে চাই।”
হঠাৎ ক্যাসিনো আলিসার আঙুল ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে আনল। আলিসার দেহ ধাক্কা খেয়ে তার বুকের সঙ্গে লেগে গেল। ক্যাসিনো হুইস্কি-মিশ্রিত কণ্ঠে কটাক্ষ করে বলল,
“তুমি কী চাও তা এখন বুঝতে পারছি। আমার সাথে রাত কাটাতে চাও তাই না বেইব? বিয়ের অজুহাতটা নিছক নাটক। চল আজকের রাতটা তোমার সঙ্গে কাটাব।”
বলেই সে ঠোঁট নামিয়ে আনল আলিসার ঠোঁটের দিকে, ঠিক তখনই আলিসা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে থামিয়ে দিল।সেই মুহূর্তে অটুট কণ্ঠে সে উচ্চারণ করল,

“আই লাভ ইউ, ক্যাসিনো। আই ব্যাডলি লাভ ইউ। আমি চাই পুরো পৃথিবী জানুক আপনি আমার। আমি নিষিদ্ধতায় আকৃষ্ট হই বরাবর তার প্রমাণ আপনি সয়ং।আমার জীবনে আমি আর আমার একাকীত্ব সঙ্গি ১১ বছর বয়সী আ্যশার ছাড়া কেউ নেই।”
তৎক্ষণ ক্যাসিনো চমকে উঠে প্রশ্ন করল,
“আ্যাশার কে?”
আলিসার খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ রইল। এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে সে বুঝতে পারছে না।তবুও ঠোঁট জোড়া ফাঁক করে বলল,

“তার কোনো পরিচয় নেয়!তাকে আমি রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি।সে কেবলমাত্র আমার একাকীত্ব সঙ্গী।ক্যাসিনো আমি আপনাকে কোনো কিছুতেই বাধা দেব না। কেবল একটি অনুরোধ এই দুনিয়াকে জানিয়ে দিন আপনি আমার। ম্যারি মি, প্লিজ… প্লিজ…!
ক্যাসিনো স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। সে একজন বিজ্ঞানী আর তাই সহজেই উপলব্ধি করল আলিসা মানসিকভাবে সুস্থ নয়। সে এক বিকারগ্রস্ত মানসিক রোগী।ক্যাসিনো মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করে বাঁকা হাসলো। তারপর অদ্ভুত কণ্ঠে সে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“ইয়েস! আই উইল ম্যারি ইউ।”

এই একটি বাক্যই যথেষ্ট আলিসার উদ্দীপ্ত হৃদয়কে শান্ত করার জন্য। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল প্রশান্তির হাসি। সে শক্ত করে ক্যাসিনোকে আলিঙ্গন করে নিল।ক্যাসিনো ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তাকিয়ে রইল।আলিসা আলগা হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“কাল আমাদের বিয়ে। আমি আমার সাথে করে আ্যাশারকে নিয়ে আসব। সাবধান আমার সঙ্গে কোনো প্রতারণার চেষ্টা করবেন না। ভিডিওটা পাবলিশ করতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না।”
আলিসার তর্জন শুনে ক্যাসিনো নির্মম হাসি ছুঁড়ে দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ইয়া বেইব! কোনো ছলনা করব না। চল এখন তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। আফটার অল, ইউ আর মাই ফিয়ন্সে।”

আলিসা হেসে ফেলল। হ্যাঁ, এটাই তো সে চেয়েছিল কেউ যেন তাকে নিজের বলে দাবি করুক।তার একাকীত্ব মিলিয়ে যাক। তার এই নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা পেল।আলিসা ক্যাসিনোর পিছন পিছন গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।গাড়ির মধ্যে টানটান নিরবতা দুজনের মধ্যে কেউ কারো সঙ্গে কোন কথা বলছে না। খানিকক্ষণ বাদ গাড়ি এসে থামলো আলিসার বাড়ির সামনে।আলিসা গাড়ি থেকে নামার আগে ক্যাসিনো বলে উঠল,
“কাল আমি আসব তোমাকে নিতে রেডি থেকো রোজ।”
‘রোজ’ শব্দটি বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আলিসার কানে। সে কাঁপা গলায় মাথা নাড়ল সম্মতিসূচকভাবে, এবং দ্রুত বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ল,কারণ আজ অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে।আলিসা যাওয়ার পরমুহূর্তে ক্যাসিনো তার দৃষ্টিকে সেদিকে স্থির রেখে শুধালো,
“আমি দানব!আর দানবরা কখনো ভালবাসতে জানেনা।তুমি আমার খেলার একটি গুটি মাত্র রোজ।তোমার মাধ্যমেই আমি আমার এক্সপেরিমেন্ট সফল করব।তুমি হবে আমার সাফল্যের চাবিকাঠি।”

কথাটুকু শেষ করাই সে উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়লো ক্যাসিনো।অপরদিকে গৃহের প্রধান প্রবেশদ্বারে আলিসা প্রবেশ করল। চতুর্দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে সে অ্যাশারকে অনুসন্ধান করল। হঠাৎ এক বিস্ফোরিত চিৎকারের শব্দে আলিসার দৃষ্টি আবদ্ধ হলো সিঁড়ির প্রান্তে তার সৎ বোন ক্লারা এবং আ্যশারের উপর।আলিসার চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠল।কারণ ক্লারা আ্যাশারকে নির্মমভাবে মারছিল।আলিসা মুহূর্তে উচ্চকণ্ঠে আর্তনাদ করে বলল,
“ক্লারা কী করছ?ওকে ছেড়ে দাও প্লিজ।ওখান থেকে নিচে পড়ে যাবে আ্যাশার।”
আলিসাকে প্রত্যক্ষ করে অ্যাশার কান্নায় ভেঙে পড়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
“রোজজজজ!”

আ্যশারের আর্তনাদ শুনে আলিসা ছুটে দৌড়ালো সেদিকে।ফ্লোরা সেটা দেখে বাঁকা হেসে ইচ্ছাকৃতভাবে আ্যশারকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ির নিচে নিক্ষেপ করে।সঙ্গে সঙ্গে আলিসা দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল আ্যশারকে।আ্যশার ভয়ে গুটিসুটি মেরে পরে রইল আলিসার কোলে।আ্যাশারকে একটুখানি ব্যথা পেতে দিল না আলিসা।বুক ধরফর করছে আলিসার,চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি পড়ল তার।তখনই সেখানে আলিসার সৎ মা উপস্থিত হয়।আলিসাকে এভাবে কাঁদতে দেখে তিনি কটাক্ষভরে বললেন,
“কোন দুঃখে কাঁদছিস তুই?এই ছেলে কি তোর রক্তের কেউ হয়?এই ছেলেকে যে বিনা পয়সায় বাসায় রেখে দিয়েছি শুকরিয়া জানা।”

এই প্রকার ব্যঙ্গভরা উক্তি আলিসার কাছে অসহনীয় লাগল। সে অ্যাশারকে কোলে তুলে নিলো এবং একটিও শব্দ না উচ্চারণ করে কক্ষের দিকে অগ্রসর হল।ঠিক সেই মুহূর্তে ফ্লোরা পেছন থেকে আলিসাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই মেয়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই?রান্না কি তোর মরা মা এসে করে যাবে?”
এই কথায় আলিসার শরীর রাগে যন্ত্রণায় ফেটে পড়লো। সে আ্যশারকে কয়েকগুণ শক্ত করে আকড়ে ধরল।পরক্ষণই পেছনদিকে ফিরে ক্লারার উপর তার ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি পারব না।”

ক্লারা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে স্থির হয়ে রইল।আলিসার এমন দুঃসাহসিকতা প্রত্যক্ষ করে সকলে নিঃশব্দে স্তব্ধ।পরবর্তী কোনো শব্দের আদান-প্রদান ব্যতীত, সে অ্যাশারকে বক্ষে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে কক্ষে প্রবেশ করল।নিরন্তর পরিশ্রমে অসীম ধৈর্যে সে অ্যাশারকে কোমলভাবে শান্ত করে নিদ্রায় নিমগ্ন করল।আজকে তার এবং আ্যশারের দুজনকেই না খেয়ে রাত পার করতে হবে।আলিসা আ্যশারের প্রতি অন্যরকম মায়া কাজ করে।কারণ আ্যশার তার নিঃসঙ্গ রাতের সঙ্গী।প্রায় মধ্যরাতের দিকে আলিসা উঠে দাঁড়িয়ে খোলা বেলকনি সামনে এসে দাঁড়ালো। চারদিকে মৃদু হাওয়া তার চুলগুলো পেছনের দিকে উড়িয়ে দিল।খানিকক্ষণ বাদ আলিসা হাত বাড়িয়ে ফোনটি উঠালো।দেরি না করে এসে ক্যাসিনো নাম্বারে ডায়াল করল। ওদিকে পার্টির হট্টগোল নেশামত্ত পরিবেশে ক্যাসিনো গ্লাসে মদের চুমুক দিচ্ছে।হঠাৎ ফোনের কম্পনে সে ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত করল।কলটি রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে আলিসার কণ্ঠস্বর শুনল,

“একজন ধর্ষকের মুল উদ্দেশ্য কি ক্যাসিনো?”
ক্যাসিনো আলিসার কণ্ঠস্বর অনুধাবন করলেও বাক্যার্থটি সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারল না।সে সন্দিগ্ধ উচ্চারণে বলল,
“মানে কী বোঝাতে চাইছো তুমি?”
“উত্তর চাই আমার ক্যাসিনো।”
ক্যাসিনো ঠান্ডা হাসি দিয়ে গ্লাসের অবশিষ্ট ওয়িনটুকু চুমুক দিল।তারপর নেশাগ্রস্থ কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই শিকারি!”
আলিসা নিজের চোখের কোনে অবশিষ্ট জলকণাটুক মুছে নিল।তার তীক্ষ্ণধারালো কণ্ঠে শুধায়,
“আপনার জন্য দুইজন শিকারি আমি ইতোমধ্যেই বাছাই করেছি আমি।”

আনায়া নিদ্রাচ্ছন্ন কেবিনে অনেকক্ষণ যাবৎ।ঠিক সেই সময় কেবিনের দরজায় ধীরে ধীরে একজন স্টাফ প্রবেশ করে।তার হাতে ছোট একটি ট্রেতে কিছু মেডিসিন।সে ভেতরে টেবিলে মেডিসিন গুলো রেখে পিছনে ফিরে চলে যাবে কিন্তু কিছু একটা তাকে আটকে দিল।ছেলেটির দৃষ্টি আটকালো আনায়ার দেহপর উপর।সে কামুক দৃষ্টিতে আনায়ার সম্পূর্ণ শরীর একবার পর্যবেক্ষণ করলো।ঠোঁট ভিজিয়ে সে এগিয়ে আনায়ার দিকে কাঁপাকাঁপা হাত বাড়ায়।কিন্তু সেই মুহূর্তেই দরজা খুলে প্রবেশ করে ইউভান।ইউভানকে দেখামাত্রই ভয়ে দূরে দাঁড়ালো।ইউভান ছুরির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ছেলেটির উপর।ছেলেটির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে, সে ভয়ে ভয়ে বলল,
“স্যার আমি আসলে দেখছিলাম ম্যাডাম ঠিক আছে কিনা।”
ইউভান অন্য দিক ফিরে হেসে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“থ্যাংকস ফর ইউর কেয়ার!এখন যেতে পারো তুমি।”

ছেলেটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।আর কোনরকম কথা না বাড়িয়ে সে কেবিন থেকে প্রস্থান করে।ইউভান এবার আনায়ার পাশে এসে বসল।চুলগুলো সরিয়ে কপাল ছুঁতেই ইউভানের চোখে পড়ে আনায়ার অভিমানী মুখাবয়বের উপর।হৃদযন্ত্রের গতি হঠাৎ করেই দ্রুত হয়ে ওঠে তার।ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে আনায়ার গাল স্পর্শ করল ইউভান।মসৃণ ত্বকের উষ্ণতায় আঙুল কেঁপে ওঠে তার।কিঞ্চিত পরিমাণ ঝুঁকে মোলায়েম কন্ঠে আওড়াল,
“আমার প্রাণপাখি!”
বলেই ইউভান তার আঙুল গাল ছুঁয়ে ঠোঁট বরাবর স্লাইড করে।আনায়ার ঠোঁটের নরম প্রান্ত ছুঁয়ে নামতে থাকে চিবুক বরাবর।এরপর নিরুত্তাপ দৃষ্টিপাত করে পুনরায় শুধালো,

“ইউর আইস আর ভেরি ডেঞ্জারেস সুইটি।তুই তোর চোখের দ্বারা আমার মতো ক্রিমিনালকে হিপনোটাইজ করেলি?ইউ আর সো ডেঞ্জারেস সুইটি!সো ডেঞ্জারেস! আই’ম এট্রাচড টু ইউর গোল্ডেন আইস।
খানিকক্ষণ থামল ইউভান।আচমকা আনায়ার চোখে গাঢ় চুমু খেলো সে। দীর্ঘ সময় ধরে ঠোঁটজোড়া আনায়ার চোখে ঠাই লাগলো।এরপর মুখ তুলে চেয়ে ঠান্ডা হাসি দিয়ে বলল,
“ইউ ব্রোকেন মি গার্ল! ব্রোকেন মাই হার্ট!ব্রোকেন মাই এভরিথিং!আই’ম গোনা লসিং ফাকিং মাইন্ড।”
বলেই গাঢ় চুম্বন খেলো আনায়ার কপালে।তারপর ইউভান ফোন দিয়ে কাউকে এসএমএস দিয়ে আনায়ার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল,

“আমার কিছু কাজ বাকি আছে সুইটি।তুই রেস্ট নে ততক্ষণে আমি পৃথিবী থেকে একটা আবর্জনা দূর করে আসি।”
বলেই এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে ইউভান কক্ষ ত্যাগ করল।প্রলম্বিত নিশ্বাস নিয়ে সে সোজা হাসপাতালের অভ্যন্তরের একটি পুরাতন পরিত্যক্ত রুমের দিকে পদচারণা করল।সেই রুমে পূর্ব হতেই গার্ডরা অপেক্ষা করছে তার।ইউভান সেই ঘরে প্রবেশ করল।তার দৃষ্টি থামল রুমের কেন্দ্রে স্থিত ক্ষতবিক্ষত যুবকটির দিকে।যুবকটি আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় কাঁপছে।আর এটি সেই যুবক যে কিছুক্ষণ পূর্বে আনায়াকে কুৎসিত দৃষ্টিতে দেখেছে।ইউভান ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে যুবকের সম্মুখে স্থির হলো।পরবর্তীতে ব্যঙ্গময় হাস্যভঙ্গি করে বলল,
“হ্যালো ব্রো!আর ইউ রেডি ফর ডাই?”
যুবকটি দৃষ্টিপাত করল।সে ইউভানকে দেখে অনুধাবন করল তার অপকর্মটি কোথায়।সে শুষ্ক কণ্ঠে অঙ্গার গিলে মিনতি সুরে বলল,

“স্যার প্লিজ,ভুল হয়েছে আমার। দয়া করে আমাকে মারবেন না। ছেড়ে দিন প্লিজ!”
ইউভান তখন ঠোঁট দিয়ে ‘ক্রিমিনাল’ সং এর টোন বাজিয়ে ছেলেটি চারপাশে ঘুরতে থাকলো।যুবকটি হতচকিত হয়ে দৃষ্টিপাত করল।বাঁশির সুর এতটাই বিভীষিকাময় হয়ে উঠল যে যুবকটি দুই হাত দিয়ে শ্রবণযন্ত্র রুদ্ধ করল।হঠাৎ ইউভান বাঁশি থামিয়ে অধরের কোণে শীতল বিদ্রূপমিশ্রিত হাসি সঞ্চার করে বলল,
“নো ম্যান! ইউভানের ডিকশনারিতে ক্ষমা নামক কোনো শব্দ নাই।সেখানে আছে কেবল অবধারিত মৃত্যু।”
বাকিটুকু বলে ইউভান গার্ডের দিকে ইশারা করলো সঙ্গে সঙ্গে গার্ডরা এক লম্বা লোহার স্ট্রাকচার বের করে,ছেলেটি চারদিকে হাত-পা মেলে বেঁধে ফেলল।মুখটাও কাপড় দিয়ে বাঁধল।ভয়ে সন্ত্রস্ত যুবকটি করুণ চাহনিতে নিরন্তর নিরীক্ষণ করতে লাগল ইউভানের দিকে।ইউভান ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে এক হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল যুবকের সম্মুখে।তার হাতে ধরা সূক্ষ্ম ধারাল ফ্ল্যাট পিনসার।কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই ইউভান যুবকের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির নখটি পাকড়াও করে হঠাৎ টান মারল।নখ তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোড়ার চামড়াটি ছিঁড়ে উঠে এলো।নখের নিম্নদেশ থেকে ধবধবে মাংস চুঁইয়ে উঠল।ব্যথায় কণ্ঠনিঃসৃত মুরগির মতো থরথর কাঁপতে লাগল যুবকটি।

এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ইউভান বিকৃত আনন্দে উদ্বেল হলো।সে নখ একের পর এক উপড়ে ফেলতে লাগল।নখের তলদেশে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে সেই ক্ষত থেকে রক্ত ধারা প্রবাহিত হলো। তীব্র যন্ত্রণায় শ্বাসরোধ হবার উপক্রম যুবকটির, চিৎকারও করতে পারছে না সে। প্রত্যেকটি আঙুলের মাংস উল্টে ঝুলছে।কি নির্মম দৃশ্য!যে কেউ অবলোকন করলে মর্মে গা গুলিয়ে উঠবে তার।ইউভানের দৃষ্টি ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। সে এবার যুবকের চোখে চোখ রাখে।হ্যাঁ, এই চক্ষুদ্বয় দিয়েই তো যুবকটি কলুষ দৃষ্টি দিয়েছে তার সানসাইনের উপর। সে কীভাবে এই দৃষ্টি অক্ষত রাখবে?ইউভান এবার হিশহিশিয়ে বলল,
“এই চোখ!এই দৃষ্টিপুট দিয়েই তুই আমার প্রাণপাখিকে শেষবার দেখেছিলি তাই তো?তাহলে এখন তোর৷ এই চোখ আমি উপরে ফেলব।”

এইটুকু বলেই ইউভান ছেলেটির চক্ষুর কোণে পিনসেটটি ঠেসে ধরল।তৎক্ষণাৎ যুবকের হৃৎস্পন্দন ধক করে উঠল।তার দেহ স্তব্ধ হলো অমানবিক বেদনায় এবং মুখগহ্বর থেকে নিঃসৃত হলো নিস্তব্ধ আর্তনাদ।ইউভান ধীরে ধীরে হাতের চাপে পিনসেট দিয়ে চক্ষুর কোণে টান মারল।ফলস্বরূপ ক্রমশ চোখটি উত্তোলিত হতে থাকল।যুবকের নিঃশব্দ আর্তনাদ তাঁর কণ্ঠবিন্দুতে আটকে যাচ্ছে,শুধু তার আত্মা মৃত্যু যন্ত্রণা উপলব্ধি করছে।একসময় চোখের কোটা থেকে রক্তে ভেজা স্নায়ুর দলা বেরিয়ে এলো। লালচে-সাদা স্নায়ুগুলো লম্বা হয়ে ঝুলে পড়ল ইউভানের হাতের তালুতে। কাঁচা রক্তে সিক্ত থকথকে চোখটি ইউভানের হস্তে লাফাচ্ছে।ইউভান সেই দৃষ্টিগোলকটিকে লাফাতে দেখে উন্মাদ উচ্চারণে হেসে উঠল।গলা ফাটানো সেই বিকারগ্রস্ত হাসিতে ভূমি প্রকম্পিত হলো।এরপর কাঁটার মতো খচখচে কণ্ঠে বলে উঠল,
“ইউর ফাকিং আইস!এ এই চোখ দিয়ে আমার সানসাইনকে কু নজড়ে দেখেছিলি তাই না?এই ফাকিং আইস দিয়ে?ইউ ব্লাডি বিচচ!”

বলেই ইউভান একইভাবে দ্বিতীয় চোখের কোণায় ঠেসে ধরল। দ্বিতীয় চোখটাও বেরিয়ে এলো গোড়া থেকে।আর সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়ল উষ্ণ রক্তরাশি।চোখ উপড়ে ফেলার পর একপাশে ছেলেটি মুখ হেলে পড়ে যায়।চোখের কোটরের চারিধারে ছিঁড়ে যাওয়া শিরা-উপশিরা রক্তসিক্ত হয়ে কাঁপছে। সেই কোটরের অন্তঃস্থল থেকে নিরবচ্ছিন্ন রক্তবিন্দু টুপটাপ শব্দে নীচে পড়ছে।আরও লম্বা স্নায়ু বেড়িয়ে আসল ইউভানের হাতের তালুতে।
ইউভান স্বস্তি পেল না তার ঘাড়ের পেশীদণ্ড ক্রোধে ফেঁপে উঠে।তার আঁখিদ্বয় লালচে আগুনের শিখার মতো প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে। সে রক্তসিক্ত চোখ দু’টিকে নিয়ে দৃঢ়ভাবে পিষে ফেলল নিজ হাতে।পরক্ষণে পুনরায় প্রতিশোধের শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল যুবকটির উপর। নিস্তেজ যুবকটির চোখের কোটরের ভেতর থেকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে মাথার অভ্যন্তরীণ শিরা-উপশিরা।মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ হতে কিছু লাল নালা নিঃসৃত হয়ে মুখ বেয়ে পড়ছে যুবকটি।তবুও ইউভানের অন্তর প্রশমিত হলো না।সে রক্তে ভেজা বুটজোড়া টেনে ধীরে ধীরে ছেলেটির কাছে এসে নিচু হয়ে বলল,
“হেই ম্যান গেট আপ নাও!তোকে আমি এত সহজে মরতে দিবো না। তোকে আমি ভয়ানক এক মৃত্যু উপহার দেব ব্লাডি বিচ!”

ইউভান গার্ডদের দিকে চোখের ইশারা করতেই দুজন গার্ড এগিয়ে এসে তার হাতে একটা দামী ব্র্যান্ডের কাঁচের অ্যালকোহলের বোতল ধরিয়ে দিল। ইউভান সেই বোতল খুলে ঢকঢক করে খেতে শুরু করে।অ্যালকোহল গলায় নামার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকটা ওপর-নিচ হচ্ছে বেশ জোরে। গলার অ্যাডামস অ্যাপল তীব্র গতিতে উঠানামা করছে। ঘামের ফোঁটা ইউভানের গলার পাশে জড়িয়ে গলদঘর্ম হয়ে নিচে পড়ছে।ইউভানের ফর্সা উন্মুক্ত বুকে ঘামে ভিজে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। ইউভান অবশিষ্ট অ্যালকোহল ঢেলে দিল যুবকটির মুখে।

মুহূর্তেই চক্ষুহীন কোটরের মধ্যে শীতল জলের স্পর্শে তাজা লালচে মাংস তীব্র টান দিয়ে উঠলো যুবকটির।সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো তার। তাতে বোঝা গেল জ্ঞান ফিরেছে ছেলেটির। ইউভান অঁধরে পিশাচসদৃশ হাসি মেখে ছেলেটি সম্মুখে এগিয়ে এলো। ইউভানের দেহপেশী এখন অধিকতর উত্তেজিত। উন্মত্ততার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ইউভান হাতে হাতুড়ি তুলে নিল।এক মুহূর্ত দেরি না করে সে হাতুড়ি দিয়ে জোরে ছেলেটির মাথা বরাবর কোপ মারলো।সঙ্গে সঙ্গে খুলির হাড় চিঁড়ে ঘিলু ছিটকে পড়ল চারদিকে। মাথার পেছনের দিকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল।খুলির ভাঙা টুকরো গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল ইউভানের শুভ্র কোটে।সেইখানেই যুবকটি প্রাণ ত্যাগ করল।কিন্তু ইউভান তাতেও সংযত হলো না। সে আপনমনে উচ্চারণ করতে লাগল,
“ইউ ব্লাডি বিচ! রাসেকল! আই’ল কিল ইউ ম্যান!”

বলতে বলতে সে আরও কয়েক প্রহারে যুবকটির মস্তক বিদীর্ণ করল। মাথার খুলি কেটে গিয়ে দুই পাশ আলাদা হয়ে গেল।ছেলেটি নাক ও ঠোঁট বিকৃত হয়ে ছিড়ে পড়ল।মগজের ছিটেফোঁটা মেঝেতে আছড়ে পড়ল। ইউভান ক্রমাগত দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে লাগল।আশেপাশের গার্ডরা মাথা নিচু করে ভয়ংকর দৃশ্যে ভয়ংকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল।এই নির্মম দৃশ্য তারা চোখ দিয়ে দেখতে অক্ষম।ইউভান এবার কোদাল তুলে যুবকটির পেট বরাবর কষে আঘাত হানল।সঙ্গে সঙ্গে পেটে চাকা চাকা মাংস ছিঁড়ে দুলে উঠল।পেটের চামড়া একদিকে ছিঁড়ে গিয়ে কাঁচা মাংসের স্তর উন্মুক্ত হলো।কোদালের নিচে চাপা পড়ে মাংস থেঁতলে গিয়ে রক্তের সঙ্গে মিশে গলদঘর্ম হয়ে পড়ল।ইউভান একের পর এক আঘাত হানল পেটের উপর। রক্তে সমগ্র মেঝে আবৃত হয়ে গেল। ছিন্ন পেটের অংশ দুইদিকে ছড়িয়ে গিয়ে গর্তের মতো তৈরি হলো।সে গর্ত থেকে অনর্গত রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

ইউভান এবার থেমে গেল। কনুই দিয়ে মুখমণ্ডলে ছিটকে পড়া রক্ত মুছে নিল।ইউভানের শার্টের অভ্যন্তরীণের বক্ষদেশের রক্তের ছোপ স্পষ্ট। কোদালটি সে পুনরায় উত্তোলন করে যুবকটির বক্ষদেশে সজোরে আঘাত হানল। প্রহারের সাথে সাথেই পাঁজরের হাড়ের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে এলো গাঢ় রক্তধারা। হৃদযন্ত্রের উপরে কোপ লাগতেই যুবকটির দেহ শেষবারের মতো কাঁপন ধরল।বুকের মাঝখানটা দুভাগ হয়ে পড়ে।পাঁজরের একপাশ ছিঁড়ে গিয়ে কোদালের ধার আটকে গেল হাড়ে।বহুকষ্ট করে টেনে বের করল ইউভান কোদালটিকে।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির মুখ থেকে গল গলিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।

ইউভান এবার তার হাত যুবকটি ছিন্ন বক্ষের ফাঁকে প্রবেশ করিয়ে রক্তসিক্ত কাঁচা মাংসের মধ্য থেকে ধমনী ছিঁড়ে একটানে কলিজাটি টেনে বের করল।কলিজাটি রক্ত থলথলে ভেতরের কচি রক্তনালীগুলো থেকে নিরবচ্ছিন্ন রক্ত ঝরছে ইউভানের হাতে।কলিজার দিকে ইউভান ক্ষুরধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে পৈচাশিক হেসে বলে উঠলো,
“এইটুকু কলিজা নিয়েই তুই আমার সানসাইনের দিকে তাকিয়েছিলি? হুুহু এইটুকু?লাইক সিরিয়াসলি ম্যান?এর চাইতে বেশি বড় কলিজা একটা কুকুরের থাকে।তুই তো তার থেকে ও অযোগ্য।”

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৬

বলেই ইউভান তার রক্তমাখা হাত দিয়ে থলথলে কলিজাটা ধীরে ধীরে চেপে ধরে।কলিজাটি তার হাতে মুঠোয় পিষে ফেলতে চায় ইউভান।কলিজার ভেতর থেকে তাজা রক্ত তার হাত বেয়ে পুরো শরীরে ছড়িয়ে গেল।ঠিক তখনই পেছন থেকে হঠাৎ এক শব্দ হলো।গার্ডরা সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে একসাথে বন্দুক তাক করল শব্দের উৎসের দিকে। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে তাকিয়ে তারা মুহূর্তের মধ্যে বন্দুক নামিয়ে ফেলল।মানুষটি ঠিক তদের দিকে অদ্ভুত চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে।ইউভান এবার ধীরে ধীরে পেছন ফিরে ঘুরে তাকালো।মুহূর্তেই তার রক্তরঞ্জিত দৃষ্টি শীতল হলো।সে অধর ভিজিয়ে নিঃশব্দ ঢোক গিলল।তার রক্তমাখা হাত থেকে কলিজাটা ঠক করে মাটিতে পড়ল।রক্ত ছিটকে এল তার পায়ের কাছে।এরপর বিস্মৃতির অতল থেকে ভেসে ওঠা কণ্ঠে বলল,
“সুইটি……..!”

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৮