আত্মার অন্তরালে পর্ব ২
প্রীতি আক্তার পিহু
আনায়া আর দাঁড়ায় না দৌড়ে রুমে চলে আসে। তার সম্পূর্ণ শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। কেন?পুরুষের গলার আওয়াজ তার মধ্যে এতটা পরিবর্তন কীভাবে আনতে পারে?হঠাৎ আনায়ার ঘাড়ে ঠিক পেছনটায় পুরোনো যন্ত্রণা শুরু হতে থাকে।তাড়াতাড়ি ড্রইর থেকে একটা পেইন কিলার বের করে খেয়ে নেয়।তার মাথা ব্যথা করছে এখন, সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বিছানায় পুনরায় শুয়ে পড়ে।
অপরদিকে,
ইউভান গিটার টা পাশে রেখে সেই সাদা ওড়নাটা হাতে তুলে নেয়। এরপর নাকের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিয়ে মেয়েলি সুভাস অনুভব করতে থাকে। ইউভান চাইলেও ওড়নাটা সরাতে পারছে না কেমন যেন নেশা ধরে গিয়েছে।বাঁকা হেসে ফিসফিসে বলে উঠে,
“ওয়েলকাম টু মাই ডার্ক ওয়ার্ল্ড। তোমাকে আমার অন্ধকার রাজ্যের রানি বানাবো। রক্তে ভেজা সিংহাসনে বসাবো, আর পরিয়ে দেবো তোমার মাথায় অভিশপ্ত মুকুট যার ভার তোমার আত্মা অবধি অনুভব করবে। কিন্তু তুমি কোথায় সুইটি?”
চোখ বন্ধ করে নেয় ইউভান চেয়ারে হেলান দিয়ে পা দুটো রেলিং এর উপর উঠিয়ে দেয়।ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকায় এক দৃষ্টিতে।
ভোরের কোমল আলো জানালা ভেদ করে আনায়ার মুখে পড়তেই মনে হয় যেন শীতল বাতাসে নরম ছোঁয়া এসে তাকে জাগিয়ে তুলে। এলোমেলো চুলগুলো তার কপালের পাশে নেমে এসেছে।
আনায়া ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা বাগানের দিকে আসে। বাগানে এসে হাত দুটি মেলে গভীর শ্বাস নেয়।বকুল ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ বাতাসে মিশে রয়েছে। আনায়া নীচু হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বকুল ফুলগুলো কুড়াতে শুরু করে। তার খোলা চুলগুলো ঘাসের উপর আলতোভাবে ছড়িয়ে আছে।এটা তার নিত্যদিনেরই কাজ।
ইউভানের ঘুম ভেঙে যায় চোখে-মুখে পড়া রোদ আর পাখিদের কিচির-মিচির আওয়াজে। সারারাত সে বেলকনিতে শুয়ে কাটিয়েছে। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় বাগানের কোণে থাকা অষ্টাদশী কেশবতির দিকে। ইউভান এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়। হঠাৎ তার হাত আপনা আপনি বুকে চলে আসে। তার হৃৎস্পন্দন মাত্রা অত্যাধিকভাবে জোরে চলছে। এ কেশ না বরং যেন সুরের মূর্ছনা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইউভান মনোযোগ দিয়ে দেখে কিন্তু কেশবতীর মুখ সে দেখতে পাচ্ছে না।অষ্টাদশী হাঁটু গেড়ে বকুল ফুল কুড়াচ্ছে।এক নজরে চেয়ে থাকে সেদিকে ইউভান।হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ধ্যান ভাঙে তার। সে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে রুমের দরজার দিকে এগোয়। দরজা খুলতেই দেখে আয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আয়ানের মুখে এক চিলতে হাসি।।
“ভাইয়া, ফ্রেশ হয়ে নে। আজ সকালে মিলে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব,”
ইউভান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “তুই যা, আমি আসছি।”
এই বলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েই থেমে যায়। কিছু একটা তাকে টেনে নিয়ে যায় আবার বেলকনির দিকে। কিন্তু এবার সে অবাক হয়ে যায় অষ্টাদশী আর নেই। সেই চুলের দোল, সেই মৃদু সুবাস, সেই শান্ত দৃশ্য কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। ইউভানের চোখ অষ্টাদশীকে খুঁজতে থাকে কিন্তু পায়না।দীর্ঘ নিশ্বাস, ফেলে পুনরায় ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায় সে।
সারাহ রাগে ফুঁসে উঠে বলল, “তুই কি পড়াশোনা করতে চাস না? সরাসরি বল, তোকে আমি বিয়ে দিয়ে দিই!”
আনায়া ভয় মেশানো কণ্ঠে মিন মিন করে বলল, “একটু বাগানেই তো গিয়েছিলাম, আপু। এমন করছো কেন?”
সারাহ চোখ গরম করে বলল, “ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা হয় না তোর, পড়তে বলেছি পড়া তো পড়িস না। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে নাম ভার্সিটি যেতে হবে।” বলেই হন হনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে।
আনায়া নির্লিপ্তভাবে ওয়াশরুমের দিকে এগোয় শাওয়ার নিতে। সে তার জীবন নিয়ে বড় সমস্যার মধ্যে আছে একদিকে সে তার উকিল হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে চায় অন্যদিকে পড়াশোনা করতে চাই না।এই ঝামেলা থেকে মুক্তি নেই তার।
ইউভান রেডি হয়ে সিঁড়ি থেকে নিচে নামছে তাৎক্ষণিক রুহি চিৎকার দিয়ে বলে, “ভাইয়া চলে আসছে।”
সবাই তা সেদিকে চোখ তুলে তাকায়। তানহা চোখ বড় বড় হয়ে যায়, খাবার মুখে নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছে ইউভানের দিকে।
তার পরনে সাদা একটি ইন করা শার্ট।শার্টটি তার শক্তিশালী চেস্ট এবং প্রশস্ত কাঁধের ওপর হালকা টান দিয়ে পরিপাটি দেখাচ্ছে। প্যান্টটি স্লিম-ফিট কালো স্যুইট প্যান্ট। শার্টের গলা কিছুটা খোলা, আর প্যান্টের প্রান্তে স্লিম ডিজাইনটি তার লম্বা এবং সুঠাম ফিগারের সাথে পুরোপুরি মানানসই।সে যে এক কথায় সুদর্শন পুরুষ তার কোন সন্দেহ নাই।
তানহা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ইউভান ধীর পায়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে নেমে আসে। টেবিলের চারপাশে সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার বাবা, চাচা এবং অন্য সদস্যরা টেবিলে বসে আছে। এরই মধ্যে রুহি বলে, “কেমন আছো ভাইয়া ”
ইউভান মৃদু হেসে বলে “ভালো আছি আমার বোনটা কেমন আছে? ”
রুহি আল্লাদি কণ্ঠে বলে, “এতদিন ভালো ছিলাম না ভাইয়া এখন তুমি আসছো এখন অনেক ভালো লাগছে”
সবাই মৃদু হাসে। ইব্রাহিম চৌধুরি মুখে গম্ভীর স্বর এনে বলল,
“বসো বাবা।”
ইউভান বাধ্য ছেলের মতো চেয়ার টেনে বসল। তার মুখে কোনো আবেগ নেই।সায়মা বেগম ধীর হাতে খাবার পরিবেশন করছে। আয়ান একেবারে রেডি হয়ে টেবিলে এসে বসল। তার মুখে একটি চাপা তৎপরতা, কারণ পারিবারিক ব্যবসা সামলানোর দায়িত্ব তাকে নিতে হয় প্রতিদিন।এই নিস্তব্ধ পরিবেশের মাঝে আহসান হঠাৎ গলা খাকারি দিয়ে বলল, “আজকে বাইরে না গেলে খুশি হব।”
তার কথায় ইউভান থমকে যায়। তার হাতের চামচ থেমে যায়। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বাবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার পক্ষে সম্ভব না পাপা। এত বছর পরে এখানে এসেছি, সবকিছু মানিয়ে নিতে সময় লাগবে।দু-দিন পর আমার কনসার্ট কিছু কাজ আছে সেখানে।”
আহসান কিছু বলতে যাবে, কিন্তু তার ভাই ইব্রাহিম তার হাত ধরে চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। এক মুহূর্তের জন্য পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়। সেই মুহূর্তে ইব্রাহিম শান্ত স্বরে ইউভানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আজকের দিনটা আমাদের জন্য বিশেষ প্রতি বছর চট্টগ্রামের ‘শাহ আমানত মাজার’-এ মিলাদ হয়। সেখানে খাবার বিতরণ করা হয়, দোয়া করা হয়। এত বছর তো তুমি ছিলে না, এখন আছো আমরা চাই তুমি যেন সেখানে উপস্থিত থাকো। …”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইউভান থেমে গেল। চামচটি ধীরে টেবিলে রাখল। সবাই চুপচাপ। আহসানের মুখে একধরনের কঠোর অভিব্যক্তি।ইউভান খানিকক্ষণ নিস্তব্ধভাবে বসে থাকে। তারপর মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। অর্ধেক খাওয়া খাবার রেখে বলল,
“এখন কিছু বলতে পারছি না। সময় পেলে চলে আসব।”
এ কথা বলে সে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। সবাই নিঃশব্দে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আহসান চৌধুরি মুখ আরও কঠোর হয়ে ওঠে।
এমন সময় আনায়া সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। তার ভেজা চুলগুলো এলোমেলোভাবে কাঁধে ছড়িয়ে আছে। নিচে নেমেই তার চোখ আটকায় দরজার দিকে।দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এক লম্বা, বলিষ্ঠ পুরুষ। । নিজ মনে সে বলল, “কে হতে পারে?”
কিছুক্ষণ সে দাঁড়িয়ে সেই দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু আর কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়ে নিজের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
টেবিলে বসে চারপাশে তাকিয়ে সে লক্ষ্য করল, সবাই গম্ভীর।এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে আনায়া কিছুই বুঝতে পারল না। রুহি বারবার আড়চোখে আনায়ার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু সে বিষয়টা বুঝতে পারল না।
তবু সে ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ টেবিলে বসে নাস্তা শুরু করল। মনে মনে ভাবল, “এত নীরব কেন সবাই? কোনো কিছু ঘটেছে নাকি?”
এরই মধ্যে সেখানে সারাহ এসে রুহি এবং আনায়াকে তাড়া দিতে থাকে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য। তাৎক্ষণিক আহসান গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“আজকে ওদের যাওয়া লাগবেনা আর তোমারও ভার্সিটি যাওয়া লাগবেনা।”
সারাহ বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়ে। তাৎক্ষণিক আহসান পুনরায় বলে সারাহকে,
“সাদনানকে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বল, আমরা একসঙ্গে মাজারে যাব। তোমাদের হয়ত বলা হয়নি, আজকে অনাথ আশ্রম এবং মাদ্রাসার শিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছি । কিছুক্ষণ পর সবাই রেডি হয়ে নাও, আমরা একসঙ্গে বের হব।”
রুহি আর আনায়া দুজনের খুবই খুশি। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। পারলে এখনই ডান্স দিত, আজকে ভার্সিটি যাওয়া লাগবে না, এর থেকে খুশির বিষয়ে আর কি হতে পারে! খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন তারা উপরে উঠতে যায় সিঁড়ি বেয়ে, তখন আনায়া রুহির হাত ধরে বলতে থাকে,
“আচ্ছা, আমি আসার আগে কি হয়েছিল বল তো? সবাই এরকম গম্ভীর, চুপচাপ ছিল কেন?আর বাসায় নতুন কে এসেছে?কালকে আমার পাশের রুমে একজনকে দেখলাম আয়ান ভাইয়ের কোন বন্ধু এসেছে নাকি? ”
তাৎক্ষণিক রুহি অবাক হয় বলে,
“তুই এখনো অবধি জানিস না কে এসেছে?৩০ বছর পরে আমেরিকা থেকে ইউভান ভাই ফিরেছে গতকাল। তুই কোন গ্রহের প্রাণীরে আলু নিজের ভাইয়েরা খবর রাখিস না।”
আনায়া চুপ হয়ে যায়।তার কাছে এখন সব ক্লিয়ার রাত্রেবেলা গানটা কে গেয়েছে তারমানে ঐটা ইউভান ভাই ছিল।সে এই ব্যক্তির কথা বহুবার শুনেছে তবে তার সাথে কখনো কথা বলা হয়নি আজ অবধি কারণ আনায়া ছেলেদের কাছ থেকে দূরত্ব মেইনটেইন করে চলে। আনায়ার বুকের ভেতর কেমন খচখচ করতে থাকে।রুহি ততক্ষণ খোঁচা মেরে বলে,
“কি হল কোথায় হারিয়ে গেলি?ইউভান ভাইয়ের কথা চিন্তা করছিস বুঝি?
আনায়া অস্থির হয়ে তাকায়।সে কোন মতে কাউকে বুঝতে দেবে না নিজের মনের অনুভূতি।নিজেকে স্বাভাবিক করে সিরিয়াস কণ্ঠে বলে,
“আমার বয়েই গেছে ওনার কথা ভাবার হুহু। এত হ্যান্ডসাম হ্যান্ডসাম ছেলে রেখে ৩০ বছরের বুইড়া ব্যাডার কথা কে ভাবতে যাবে?”
“তুই আমার ভাইকে বুইড়া বললি? তুই তাকে দেখলে চোখই ফেরাতে পারবি না আমার ভাই রকস্টার, হুহু।”
চোখ বড় বড় করে তাকায় আনায়া এজন্য ইউভানের গলার কণ্ঠ এতটা সুন্দর। আনায়া তো গলার কণ্ঠ শুনে গলে গিয়েছে কিন্তু সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না।
“তো আমি কি করবো তোর ফকস্টার ভাইকে দিয়ে শুনি? বয়স তো আর কমে যায়নি তাই না? ৩০ বছরের পর সবাই বুড়ো হুহু।”
বলেই হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে যাই আনায়া।এদিকে রুহি রাগের ফুসতে থাকে।তার ইউভান ভাইকে কিছু বললে তার বড্ড গায়ে লাগে। অপরদিকে আনায়া রুমে এসে শুধু সেই কণ্ঠের আওয়াজের কথা চিন্তা করে। কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না বিষয়টা।এই প্রথম কোন পুরুষের জন্য সে এতটা উতলা হচ্ছে।
চৌধুরি পরিবারের সবাই গাড়ির সামনে উপস্থিত হয়। একটি গাড়িতে বাড়ির বড়রা, সাথে আয়ান যাবে, আরেকটি গাড়িতে বাড়ির ছোটরা—সাদনান, সারাহ, আনায়া, তানহা, রুহি যাবে।নুরজাহান বেগনকে হুয়িল চেয়ারে করে নেওয়া হয়, বড়দের গাড়িটি চলে যায়। সাদনান ড্রাইভিং সিটে বসে আর তার পাশে সারাহ। রুহি এবং তানহা পিছনের সিটে বসছে। সবাই আনায়ার জন্য অপেক্ষা করছে সে এখনো বের হয়নি।
এরই মধ্যে বাসা থেকে আনায়া বের হয়, তার পরনে ছিল সাদা লম্বা গাউন, যার ওপর লাল রঙের কাজ করা ছিল। মাথায় সাদা ওড়না পেঁচানো, চুলগুলো পরিপাটি করে পেছন থেকে ছাড়া ছিল। মুখে কোনো মেকআপ প্রলেপ ছিল না, তার চেহারা ছিল স্নিগ্ধ, একেবারে স্বাভাবিক আর অপরূপ।
আনায়া গাড়িতে উঠে বসে। সাদনান ঠাট্টা স্বরে বলে, “তুমি সবসময়ই লেট হয়ে যাও, শালী সাহেবা। এ কারণে তোমার বিয়ে হবে সবার পরে!”
আনায়া হেসে বলতে থাকে, “আমার বিয়ে না হলে আমি বেশি খুশি হই।”
এরই মধ্যে রুহি হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, “পরে দেখিস, তুই যেন বিয়ের জন্য পাগল না হয়ে যাস!”
আনায়া রাগী চোখে রুহির দিকে তাকায়। তানহা বিরক্তি নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। এরই মধ্যে গাড়ি চলা শুরু করে উদ্দেশ্যে, শাহ আমানত মাজার।
আনায়াদের গাড়ি এসে থামে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শাহ আমানত মাজারের সামনে। সেখানে খান পরিবারের বড়রা আগে থেকেই উপস্থিত। আয়ান ও সাদনানসহ অন্যরা অনাথ বাচ্চাদের খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত সঙ্গে বড় বাবা এবং তার বাবারাও। আশেপাশে মাদ্রাসার শিশুরাও সারিবদ্ধভাবে বসে আছে, তাদের সামনে সাজানো প্লেট ভরা খিচুড়ি, মাংস এবং মিষ্টি।
আনায়া গাড়ি থেকে নামতেই চারপাশে মাজারের স্নিগ্ধ পরিবেশ তার চোখে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে তার দৃষ্টি মাজার প্রাঙ্গণে থাকা মানুষের দিকে যায়। মাজারের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, মহিলাদের এবং পুরুষদের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারিত। সায়মা বেগম পর্দার আড়ালে বসে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শুনছেন। রুহি ও সারাহও সেখানে যোগ দেয়। আনায়া চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে মাথার ওড়না টা একটু টেনে মায়েদের কাছে গিয়ে বসে।
এদিকে, বাইরে চৌধুরি পরিবারের পুরুষরা বাচ্চাদের খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত। আয়ান নিজ হাতে বাচ্চাদের খিচুড়ি পরিবেশন করছেন, আর সাদনান খাবারের প্লেটগুলো গুছিয়ে আনছে। দূর থেকে সবকিছু দাঁড়িয়ে দেখছে চৌধুরি পরিবারের দুই বড় কর্তা। শাহ আমানত মাজারের প্রবেশপথের পাশে দাঁড়িয়ে ইব্রাহিম এবং আহসান চৌধুরি গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। ইব্রাহিম গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
“ইউভানকে একবার ফোন দিলে কী এমন হতো ভাইজান?”
আহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখে অভিমানের ছায়া নিয়ে উত্তর দেন, “যার নিজের মধ্যে কোনো দায়িত্ববোধ নেই, তাকে জোর করে দায়িত্ববোধ শেখানো যায় না।”
ইব্রাহিম কিছুটা মৃদু হাসি দিয়ে বলেন, “আজকের সব আয়োজন আপনি কার জন্য করেছেন, ভাইজান? একবার নিজেকেই প্রশ্ন করুন।”
তৎক্ষণাৎ আহসানের চোখ নরম হয়ে আসে। যেন হৃদয়ের গভীর কোথাও কিছু বেদনা স্পর্শ করে গেছে।
এরই মধ্যে মাজারের গেটের সামনে কালো মার্সিডিজ গাড়ি থামে। গাড়ির দরজা খুলে নামল ইউভান। তার পরনে ছিল কালো পাঞ্জাবি। কাঁধের অংশ ছিল একটু চওড়া, আর বুকের সামনের দিকটা হালকা ফোলা, হাতের কাছা ছিল একেবারে খোলা, আর পাঞ্জাবির নিচের প্রান্ত গাঢ় ছাঁটে কাটা, যা হাঁটাচলার সময় মাটির কাছাকাছি এসে থেমে যাচ্ছিল।
ইউভান ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে এলো। আয়ান ছুটে এসে বলল, “তুই এসেছিস ভাই।পাপা তোর জন্য অপেক্ষা করছে চল।”
আহসান তখন সামনের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল। গম্ভীর মুখে ইউভানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আসবে যখন, একসঙ্গে বের হলে কি সমস্যা হতো?”
ইউভান কিছুটা শক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, “বলেছিলাম তো সময় পেলে আসব আর না হলে না। আমার কাছে আমার প্রফেশনটা বেশি ইম্পরট্যান্ট।”
আহসানের মুখ শক্ত হয়ে যায় কিন্তু কোনো কথা বলে না। ইউভানও কোন বাক্য ব্যয় না করে আয়ানের সঙ্গে উপরে যেতে থাকে। ইউভান চারদিকে চোখ বুলাই, এক কোণে একটি বড় সাদা পর্দা টাঙানো যা পরিষ্কার ও সতেজ। পর্দার অপর পাশে মহিলারা বসে আছেন, সকলেই মোনাজাত শেষ করে উঠে দাঁড়ায়।
এসময় ইউভান সায়মা বেগমের সঙ্গে কথা বলার জন্য পর্দার সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। পর্দার ওপাশ থেকে মহিলারা একে একে উঠে দাঁড়িয়ে, মাজার থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করে। তখন আনায়া তীব্রভাবে উঠে দাঁড়িয়ে, পর্দা সরিয়ে সামনে এগোতে যাচ্ছিল। তবে, তার কানের দুলটি অজ্ঞাত কারণে নিচে পড়ে তাই সে নিচে ঝুঁকে কানের দুলটি তুলে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে উঠে পর্দার সামনে এগোতে থাকে।
অন্যদিকে ইউভান পর্দার অপর পাশে দাঁড়িয়ে। সে হাত বাড়ায় পর্দা সরানোর জন্য। কিন্তু ঠিক তখনই, পর্দাটি ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে দুজনের মাঝখান থেকে।
পর্দা সরতেই আনায়া থমকে দাঁড়ায়। তার চোখ আটকালো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কালো পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন পুরুষ দেখে থমকে গেল তার দৃষ্টি। ইউভানের হাত থেমে গেল, তার চোখ নিবদ্ধ হয়ে গেল সামনে থাকা স্নিগ্ধ শুভ্র অষ্টাদশীর দিকে।
আনায়া থেমে দাঁড়িয়ে ইউভানের দিকে তাকিয়ে রইল।চমকে গেল সেই গাঢ় নীল চোখের মনি দেখে। এই চোখ তার বড্ড চেনা কিন্তু ঠিক মনে পড়ছে না কোথায় দেখেছে। কালো পাঞ্জাবি পরা সেই পুরুষটি এক জীবন্ত প্রতিমা লাগলো তার কাছে। বাতাসে মিশে থাকা গন্ধরাজের সুবাস আর তার হৃদয়ের বেখেয়ালি তাল একসঙ্গে দোল খাচ্ছে।এই তাহলে সেই ব্যক্তি যার কণ্ঠের স্বর আনায়ার হৃদয় উথাল পাথাল করেছে।ইউভান এক দৃষ্টিতে তাকায় আনায়ার পানে।তার কাছে মনে হলো অষ্টাদশী কন্যাটি যেন এক ফুল, যা তার হৃদয়ের বাগানে আজ নতুন করে প্রস্ফুটিত হলো।তাদের দুজনের দৃষ্টি একে অপরের উপর নিবদ্ধ।
হঠাৎ পেছন থেকে রুহির গলার আওয়াজ দুই মানবের মনোযোগ ছিন্ন হয়। রুহি ইউভানের সামনে এসে বলতে থাকে, “তুমি এসেছ ভাইয়া কিন্তু অনেক দেরি করে ফেলেছ।”
রুহির কথা শোনার পর আনায়ার লজ্জায় মাথা নীচু করে নেয়।তার ভিতরের অনুভূতিগুলো যেন হঠাৎ এক অশান্ত ঢেউয়ের মতো বয়ে যায়।
“এটাই কি তার মানে, ইউভান ভাই ?”—মনে মনে সে ভাবতে থাকে, তবে কিছু বলতে পারে না।আনায়া আর কিছু না বলে সামনের দিকে পা বাড়ায় তবে হুট করে আয়ান এসে তার মাথায় গাট্টি মেরে বলে,
“নিয়মকানুন কি সব পানিতে গুলিয়ে খেয়েছিস?বড় ভাইদের সালাম দিতে হয় জানা নেই তোর।ইউভানকে দেখে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে এলি কেন বড় ভাই হয় তোর ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করবি না?
আনায়ার কাছে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে , তবে সে সেটাকে সামলে নিয়ে পেছনদিকে ফেরে।যখন ইউভান সামনের দিকে চলে যাচ্ছিল, তাৎক্ষণিক আনায়া মৃদু কণ্ঠে ডেকে বলে— “বলছি, শুনছেন?”
ইউভান থমকে দাঁড়ালো, পেছন ফিরে এক গভীর দৃষ্টিতে তাকাল অষ্টাদশীর দিকে। আনায়া সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল। ইউভান গম্ভীরতা কিন্তু যেন এক নতুন সুর তুলে—
“শুনছি ম্যাডাম”—
এই কণ্ঠস্বর যা সরাসরি আনায়ার হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছায়। তার মন যেন একটা ছোট্ট ঝড়ে বয়ে যায়। আনায়া নীচু কণ্ঠে শুধালো,
“আসসালামু আলাইকুম ইউভান ভাই।”
ইউভান তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “অলাইকুম আসসালাম ম্যাডাম”।
মুহূর্তেই আনায়া চোখ বন্ধ করে নিয়ে নিজের মনে মনে আওড়াতে থাকে “ছেলেদের কণ্ঠে বুঝি এত মিষ্টি হয় কই তার আগে জানা ছিল না”।
ইউভান এবার আয়ানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলতে থাকলো, “এটা কে ঠিক চিনতে পারলাম না যে।”
আয়ান আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“ও হলো আনায়া তোকে গতকাল ওর কথা বলেছিলাম না তোমাকে?ছোট চাচুর ছোট মেয়ে।”
ইউভান কপালে ভাঁজ ফেলে মাথা নাড়ায়। এই কথাগুলো যেন আষ্টাদশীর হৃদয়ে এক অজানা অনুভূতির ঝড় তুলে দেয়। তার ভিতরে এক অস্বস্তি তৈরি হয়, যদিও সে নিজেই বুঝতে পারে না কেন তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চোখের কোণে একধরণের অশ্রু জমে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে, সে এক মুহূর্ত দেরি না করে সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করে। সোজা গাড়িতে এসে বসে পড়ে আনায়া। তার চোখের কোণে অশ্রু জমে , কিন্তু সে নিজের মনকে শক্তি দিয়ে আটকে রাখে। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে ওঠে,
“তোর কেন খারাপ লাগছে, আনায়া?একটু মন খারাপ করবি না ব্যাটা বুইড়া খাটাশ ফকস্টার।তোর কপালে হ্যান্ডসাম হিরো আসবে ওর থেকেও। এসব ফকস্টার এর জন্য একটু মন খারাপ করবি না হুহু।”
আরো হাবিজাবি বলে নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিতে থাকে আনায়া। এত কিছু ভাবতে ভাবতে গাড়িতে এসে বাকিরা পৌঁছায়, কিন্তু আনায়া গাড়িতে একদম চুপ ছিল। রুহি বারবার খোঁচাখুঁচি করেছিল, কিন্তু আনায়ার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয়নি। পুরো রাস্তা জুড়ে চুপচাপ ছিল সে। বাসায় ফিরে সন্ধ্যা হতে সময় লেগে যায়, কিন্তু আনায়া কারোর সঙ্গে কোনো কথা না বলে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। মন থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বই নিয়ে পড়তে বসে যায়।
পড়াশোনা শেষ করতে করতে রাত ১০টা বেজে যায়।আনায়ার এবার শরীরে জ্বালাপোড়া উঠে যায় তা এখন যে করেই হোক খোলা বাগানে যেতে হবে। ধীরে ধীরে আনায়া নিচে নামে চারপাশে তাকায়, দেখে কেউ নেই। এক দৌড়ে বাগানে চলে আসে, যেখানে একটি ছোট লাইট জ্বলছে। আলো থাকার কারণে তার সেরকম ভয়ও লাগে না বাগানে আসতে।বকুল গাছের সঙ্গে ঝুলানো দোলনায় বসে, চুলটা পুরোপুরি খুলে ছড়িয়ে পড়ে, ঘাসের উপর তার চুল ঝরে পড়ে ।
অমনি পেছন থেকে পায়ের আওয়াজ শোনে আনায়া হালকা ভয়ে ভরসা হারায়। পায়ের আওয়াজটি ক্রমশ তার দিকে এগিয়ে আসছে। এরই মধ্যে সে দোলনা থেকে নেমে জোরে চিৎকার করতে থাকে অপরদিকে রুহি ও চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে। দুজনই চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতে থাকে একসঙ্গে ।
আনায়া রুহির কণ্ঠস্বর শুনে চিৎকার থামিয়ে বলে, “আরে রুটি ! থেমে যা, এটা আমি গাধা!”
রুহি চুপ করে চিৎকার থামিয়ে তাকায়। তারপর প্রশ্ন করে, “তুই এত রাতে ডাইনিদের মতো দোলনায় ঝুলছিলি কেন? বল তো!”
এখানে আনায়ার মাথায় রাগ উঠে যায়, সে রেগে গিয়ে বলে, “তুই নিজে পেত্নী হয়ে, অন্যদের ডাইনি মনে করিস, তাই না?!”
রুহি বলতে থাকে “এত রাতে চুল ছেড়ে দিয়ে এরকম বাগানে বসে থাকলে কি মনে করবো আমি ”
আনায়া নাক কুঁচকে বলে, “এত রাতে বাগানে আসার জন্য সাহস লাগে তোর মধ্যে বিন্দু পরিমাণ সাহস নাই তুই তো ভীতুর ডিম ”
রুহির কথাটা গায়ে লেগে যায়,”তোর সাহস তো কম না আলু আমাকে ভীতুর ডিম বলিস আমি মোটেও ভীতুর ডিম না ”
আনায়া উচ্চস্বরে হেসে বলে, “তাহলে প্রমাণ কর। বাগানের ওই যে ভিতরে আম গাছটার ওদিকে তোকে একা একা হেঁটে যেতে হবে যদি যেতে পারিস তাহলে আমি বুঝে যাব তুই ভীতু না ”
রুহি কিছুটা থামে তারপরে রাজি হয়ে যায়। মনে মনে কিছুটা ভয় পেলেও বাগানের গভীরে হাঁটতে থাকে ধীরে ধীরে। কিছুদূর যাওয়ার পরে আনায়া মুখ দিয়ে একটি ভূতের আওয়াজ করে আওয়াজটি করে জোরে দৌড় মারে ওখান থেকে।
এদিকে ইউভানের গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামে। সে গাড়ি গ্যারেজে রেখে সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে হাঁটছে। ঠিক তখনই বাগানের অপর প্রান্ত থেকে দৌড়াতে আসে আনায়া। তার দ্রুতগতির হাঁটার শব্দে ইউভানের দৃষ্টি সেদিকে চলে যায়। আনায়া খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছিল, এক মুহূর্তের জন্য সে ব্যালেন্স হারিয়ে ইউভানের দিকে পড়তে যেতে থাকে। তাৎক্ষণিকভাবে ইউভান নিজেকে সরিয়ে নেয় এবং ফলস্বরূপ, আনায়া সুইমিং পুলে পড়ে যায়।পানির মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে কোন মতে পুল থেকে উঠে আসে আনায়া।
সে জোরে শ্বাস নিয়ে সামনে থাকা ইউভানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক মুহূর্তের জন্য, তার হৃদয়ে রাগ স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে। ধোঁয়া ওঠানো কণ্ঠে সে বলে,
“আপনি কি মানুষ হ্যাঁ? আমাকে একটুখানি ধরলেই কি হত? আপনার জন্য আমি পানিতে পড়ে গেলাম!”
তার চোখে আগুনের ঝরনা যেন ঝরছে।
ইউভান শান্ত ভঙ্গিতে, ঠান্ডা মাথায় উত্তর দেয়,
“আই এম সরি বাট এই সায়ন চৌধুরি ইউভান কখনো কোন মেয়েকে টাচ করে নিজেকে অপরিষ্কার করে না।”
আনায়ার অপমানে শরীর জ্বলে ওঠে। এমনিতেও সে তাকে ধরেনি, তার ওপর ইউভান তাকে অপমান করে কথা বলছে। ইউভান আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত চলে যায়।যেন কে মরল বাঁচলো দুনিয়াতে তারা তাতে কিছু যায় আসে না।আনায়া ইউভান চলে যাওয়ার পর, এক মুহূর্তে উচ্চস্বরে চিৎকার দেয়।
“অসভ্য! বদমাশ বুইড়া ফকস্টার! তোর কখনো বিয়ে হবে না! অভিশাপ দিলাম, সারা জীবন কোন মেয়ের স্পর্শ ছাড়াই তুই থাকবি।তোর মেশিন অকার্য হয়ে যাবে দেখে নিস।”
তারপর মুখ ভেঙ্গিয়ে আরও বলতে থাকে, “আমি কোন মেয়েকে টাচ করি না! হুহ! নিজেকে সাধু প্রমাণিত করতে চাচ্ছে, অসভ্য ব্যাটা মানুষ!” রাগের মাত্র এতটাই বেড়ে গিয়েছে কি বলছে নিজেও জানে না সে।
রুহি হাঁপাতে হাঁপাতে উপস্থিত হয়। আনায়া পুল থেকে উঠে দাঁড়ায়, তার শরীরে পানির ফোঁটা ঝরে পড়ছে। রুহি আশ্চর্য হয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,
“কোথা থেকে তুই এভাবে পড়েছিস?” কিন্তু আনায়া কোনো উত্তর না দিয়ে, গম্ভীর মুখে ধপ ধপ করে বাসার ভিতরে ঢুকে পরে। রুহি এক মুহূর্ত স্থির থাকে, তারপর ভয়ে চারপাশে তাকিয়ে এক দৌড় নিয়ে বাসার ভিতরে চলে আসে।
রাতে পুরো পরিবার একত্রিত হয়ে ডিনারের জন্য টেবিলে বসে। আনায়া ভেজা চুল নিয়ে, মাথা নীচু করে বসে আছে সেই সময় সাইমা বেগম জিজ্ঞাসা করেন,
“তুই এত রাতে গোসল কেন করেছিস?”
আনায়া ভালো করে জানে, যদি সে বলে সে বাগানে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছে, তার মা তাকে নিশ্চিত মারবে। তাই সে হাসতে হাসতে বলে,
“আসলে মামনি খুব মাথা যন্ত্রণা করছিল, এ কারণে শাওয়ার নিয়েছি।”
কেউ কিছু বলার সুযোগ পায় না। ঠিক তখনই আহসান বলেন, “ইউভান কোথায়? ও আসবে না খেতে?”
ইউভানের নাম শুনেই আনায়া কিছুটা থমকে যায়। তার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত রাগ জমে ওঠে। আর তখনই ইউভান সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। আনায়া চোখ তুলে সেদিকে তাকায় হঠাৎ তার চোখ আটক ইউভানের হাতের ট্যাটুর থেকে।সে সম্পূর্ণ হা হয়ে যায় তার মানে তার ওড়নাটা গতকাল ইউভানের হাতে ছিল? ইউভান কফি কালারের শর্ট হাঁটার টি-শার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজার পরিধানে, এলোমেলো চুলে, তার সোজা কপালের উপরে ছড়িয়ে পড়েছে। তার সেই ছন্নছাড়া অবস্থা যে কোনো মেয়েকে মুহূর্তে হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবে।আনায়ার মনে সেদিন ঘৃণা জন্মালে আজ তার উলটো হচ্ছে।
ইউভান আহসান এর সামনাসামনি, মেইন চেয়ারে বসে পড়ে। ডান পাশে রুহি এবং বাম পাশে আনায়া বসে থাকে। আনায়া কিছুটা তাকিয়ে তারপর চোখ নামিয়ে নিজের খাবারে মনোনিবেশ করে, মনে মনে নিজেকে গালি দেয়,
“আর একবারও ওই বদমাশ ফকস্টারের দিকে তাকাবি না, আনায়া! লোকটা একেবারে খারাপ, তোকে একটুও সাহায্য করল না।লোকটার হাতে ট্যাটু করা আর তুই এসব মোটে ও পছন্দ করিস না আনায়া।” নিজকে নিজে বিভিন্নভাবে বুঝ দিতে থাকে।
সাইমা বেগম খাবার পরিবেশন করছে। টেবিলের চারপাশে নীরবতা ছড়ানো, সবাই তাদের নিজস্ব রুটিনে খাবার খাচ্ছে। নুরজাহান বেগমের খাবার তার রুমেই খাইয়ে দিয়ে আসে আয়া । খাবার শেষে একে একে সবাই আস্তে আস্তে উঠে পড়ে।
অবশেষে টেবিলে রয়ে যায় তানহা, ইউভান, আর আনায়া। আনায়া খুব ধীরে ধীরে খাবার খায়, তার মনোযোগ অন্য কোথাও। তানহা বারবার ইউভানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। ইউভান খাবার খাওয়া শেষ শেষ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে যাবে ঠিক তখনই তানহা দ্রুত ইউভানের হাত ধরতে চাই। কিন্তু পারেনা ইউভান সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাত সরিয়ে রক্ত লাল চোখে তাকায়। তানহা কিছুটা দমে যাই এ কারণে। তানহা কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়, আনায়া সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কেন জানি না, তার মধ্যে রাগের এক তীব্র অনুভূতি উদিত হয়, তার খাওয়া আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। সে উঠে দাঁড়ায়।
তানহা একটু সরে গিয়ে নিজেকে সামলে মিন মিন করে বলতে থাকে, “ইউভান ভাই আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”
ইউভান হুংকার ছেড়ে তীব্র কণ্ঠে বলে, “আজকে প্রথম, আজকেই শেষ! আমাকে টাচ করার আগে দশবার ভাববি, পরেরবার থেকে এর ফল খুবই খারাপ হবে।মাইন্ড ইট!”
তানহা অপমানে মাথা নীচু করে দেয়। আনায়ার মুখে হঠাৎ হাসি ফুটে ওঠে। ভাগ্যিস তার ইউভান ভাইকে তানহা টাচ করতে পারিনি।ইউভানের তার কথাগুলো শেষ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। আনায়া মিটিমিটি হাসছে। তানহা অপমানে, রাগে ফুঁসে উঠেছে, এবং নিজ রুমে চলে যায়।
আনায়া হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলে, “এই বদমাশ ফকস্টার! এতদিনে আমার মন ভালো করার মতো কোন কাজ করেছে হিহি ওই শাকচুন্নিকে কথা শুনিয়ে।”
বলেই নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে, আজকের সমস্ত ঘটনা ভাবতে থাকে। তার মাথায় শুধুই ইউভানের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। বারবার ইউভানের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও, সে নিজেকে বুঝতে পারে না, কেন বারবার সেই কথাগুলো তার মনে আসছে। আনায়া নিজের চিন্তাকে গালি দিয়ে ঘুমের রাজ্যে চলে যায়।
মধ্যরাতে হঠাৎ,
চেনা পরিচিত গিটারের আওয়াজ শুনে আনায়ার ঘুম ভেঙে যায়। আজকেও আবার সেই গিটারের আওয়াজ, সেই পুরুষের কণ্ঠ। আনায়া মুগ্ধ হয়ে যায় তার কণ্ঠের সুর শুনে। সে বুঝতে পেরেছে কণ্ঠটা কার। বিছানা থেকে নেমে বেলকনি দরজা খুলে, সেখানে দাঁড়ায়। তার চোখ এখন ইউভানের রুমের অপর সাইডের বেলকনির দিকে। আজও ইউভান গিটার বাজিয়ে, চাঁদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে গান গাইছে। আনায়ার কানে গানের বাক্য গুলো বাজতে থাকে,
দেখলে তোকে বদলায় দিন, 🎵🎵
বদলায় রাত,বদলায় ঘুম, সঙ্গে সময় 🎵🎵
সন্ধ্যে হলে বন্ধ ঘরে, মনে পড়ে, 🎵🎵
তোরই কথা এমনই হয় 🎵🎵
কেন যে তোকে পাহারা পাহারা দিল মন 🎵🎵
কেন রে এত সাহারা সাহারা সারাদিন 🎵🎵
কেন যে তোকে পাইনা পাইনা মনে হয়, সারাটা দিন 🎵
আনায়া অবশ হয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে, চেয়ারে ঢপ করে বসে পড়ে। তার হৃৎস্পন্দন এত বেড়ে যাচ্ছে কেন? কেন এত এই অনুভূতি? গানের সাথে তার বুকের ভিতর অনুভূতি গুমোট হয়ে উঠছে। গানের সুর যেন তার মনের সাথে মিশে যায়।
হঠাৎ, গান থেমে যায়। আনায়া চোখ এখনো বন্ধ, কিন্তু সে অনুভব করে, কেউ তার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে। তাৎক্ষণিক সে চোখ মেলে তাকায়। সামনে দেখতে পায় ইউভান তার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সে, নিজেকে সামলিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
ইউভান তার বেলকনি থেকে মৃদু কণ্ঠে আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, “কিছু বলবি আনু?”
তাৎক্ষণিক তার হৃদয় দোল দিতে শুরু করে। চোখ আপনা আপনিই বুঝে আসে, এই ডাকটা কতটা আপন লাগছে তার কাছে। সে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। আজকে প্রথম তাকে এই নামে ডাকল—বাসার সবাই থাকে, আনায়া বলেই ডাকে। আনায়ার মন খুশির ঢেউয়ে ভেসে যায়।
এদিকে ইউভান কোন উত্তর না পেয়ে গিটার রেখে রুমের দিকে এগিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। তাৎক্ষণিক পেছন থেকে আনায়া ডেকে ওঠে, “বলছি, শুনছেন?”
ইউভান এবার পেছনে ফিরে বলে, “শুনছি, ম্যাডাম।”
আনায়া মাথা নীচু করে নেয়। তার মুখে আপনা আপনিই লাজুক হাসি ফুটে ওঠে। সে আর কিছু না বলে, এক দৌড়ে রুমে চলে যায়। ইউভান তার যাওয়ার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে।
আনায়া রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে, মৃদু হেসে বলে, “ইস, কি লজ্জা! আমি কেন এত লজ্জা পাচ্ছি? কি হয়েছে তোর, আনায়া না আনু?”
এটা বলে, বালিশে মুখ গুঁজে হাসতে থাকে একা একা। মুখ দিয়ে বলে, “আনু, উফ, কি সুন্দর শোনা যায় তার কণ্ঠে নামটা।”
আত্মার অন্তরালে পর্ব ১
হাসতে হাসতে পুরো বিছানায় কোলবালিশ নিয়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে। বিছানার এপাশ থেকে ওপাশ গড়িয়ে, হাসতে থাকে। এক পর্যায়ে বিছানা থেকে ঢপ করে পড়ে যায়। কিছুটা ব্যথা পেলেও, তার মুখে হাসি। সে নিজেও ওভাবে শুয়ে একা একা হাসতে থাকে। শেষে বলতে থাকে,
“ইশ, আমি কি প্রেমে পড়ে গেলাম বদমাশ বুইড়া ফকস্টারের?” বলে ঠোঁট কামড়ে আবার হেসে নিচে গড়াগড়ি খায়।