আত্মার অন্তরালে পর্ব ২০

আত্মার অন্তরালে পর্ব ২০
প্রীতি আক্তার পিহু

ব্যক্তিটি এবার চাপটি করতলে ধারণ করে এগিয়ে এসে উচ্চারণ করল,
“আনায়া বেবিডল! আর ইউ রেডি?”
আনায়ার দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়। তার চাহনিতে অস্থিরতা স্পষ্ট। নিঃশ্বাস থেমে আছে তার শ্বাসনালীতে।বুকের অভ্যন্তর এমনভাবে কাঁপছে যেন অন্তরস্থ হৃদপিণ্ডটি পালাতে চাইছে।আনায়া উপলব্ধি করতে পারে না যে, ব্যক্তিটি তার নাম কীভাবে জানল?ব্যক্তিটি তার দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসল। পরক্ষণেই আনায়া আর এক মুহূর্তও সেখানে স্থির না থেকে আতঙ্কে পেছন ফিরে প্রাণপণে দৌঁড় দেয়।ব্যক্তিটি এ দৃশ্য দেখে একরকম তাচ্ছিল্যভরা হাসি হাসে।সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় আতঙ্কে আনায়ার পদক্ষেপ বারংবার ব্যর্থ হচ্ছে।হঠাৎ করেই তার পদতলে থাকা কার্পেট সরে যায়।ফলত, আনায়া ভারসাম্য হারিয়ে সজোরে নিচে লুটিয়ে পড়ে।তখনই পেছন থেকে আগত পদধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়।আনায়া ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে লক্ষ্য করে, ব্যক্তিটি তার দিকে এগিয়ে আসছে।সে নিজেকে টেনে তুলে বসে।আনায়া পশ্চাদপসরণ করতে থাকে আর ব্যক্তিটি চাপাটি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে।এবার লোকটি নীরস কণ্ঠে উচ্চারণ করে,

“কোথায় পালাচ্ছো বেবিডল?”
আনায়া চারপাশে চেয়ে দেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে।ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“আ আমাকে ছেড়ে দিন। প্লিজ!ছেড়ে দিন!”
বলেই ব্যক্তিটি আচমকা আনায়ার নিকটে এসে মাথা অবনত করল।এক নিমিষে আনায়া তীব্র জিঘাংসা ও ভীতিতে চোখ বুঁজে ফেলে।ব্যক্তিটি পৈশাচিক হাসি হেসে খসখসে কণ্ঠে বলে,
“এত তড়িঘড়ি কিসের? তুমি তো নিজেই নেকড়ের খাঁচায় এসে আত্মসমর্পণ করেছো, বেবিডল।”
আনায়ার নিঃশ্বাস প্রায় স্তব্ধ।সে উপলব্ধি করতে পারছে এখন তার সঙ্গে বিপর্যয় অবধারিত।ঠিক তখনই তার চোখে পড়ে পাশে থাকা একটি ফুলদানির ওপর।ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে হাত বাড়িয়ে সেটিকে তুলে নিয়ে, এক মুহূর্তে আঘাত হানে ব্যক্তিটির দিকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটে যায় যে ব্যক্তি কিছু বোঝার অবকাশ পায় না।সে মস্তক চেপে তীব্র আর্তনাদ করে।
আনায়া আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে বেরিয়ে পড়ে দরজার পথে।পেছনে তাকানোর সাহসটুকুও করেনি সে।এ দৃশ্য দেখে ব্যক্তিটি অন্তঃস্থ গর্জনে চিৎকার করে ওঠে,
“আনায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়য়ায়া…”

আওয়াজটি রাত্রির নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে এসে আনায়ার কলিজাকে কাঁপিয়ে তোলে।লোকটির কণ্ঠস্বর কোনো সাধারণ মানুষের মতো নয়, বরং এক হিংস্র বন্য জন্তুর ন্যায়।আনায়া আরও দ্রুত ছুটে চলে প্রাণপণে।চারপাশে গভীর অরণ্য ঘন বৃক্ষরাজিতে আচ্ছাদিত।পাতার ফাঁক গলে এক ফোঁটা চাঁদের কিরণ এসে পড়েছে তার উড়তে থাকা চুলে।কাদামাটি মেশা পথটি ভেজা আর অতি পিচ্ছিল।আনায়া দৌঁড়াতে গিয়ে বারংবার পদস্খলনে বিপর্যস্ত হচ্ছে।হঠাৎ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে থমকে দাঁড়ায় সে।চোখের সম্মুখে অস্পষ্ট কয়েকটি ছায়ামূর্তি নড়েচড়ে ওঠে।তারা ধীরে ধীরে তার অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে।আনায়া আবছা আলোর ভিতর সেই ছায়ামূর্তিগুলোকে পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়।চার-পাঁচজন উচ্ছৃঙ্খল যুবক, প্রত্যেকের হাতে বন্দুক।আর এরা আর কেউ না বরং তানহার পাঠানো গুন্ডা।তানহা ইচ্ছাকৃতভাবে আনায়াকে এখানে পাঠিয়েছে যেন গুন্ডাগুলি তাকে মেরে ফেলতে পারে।তখনই আনায়াকে দেখে এক যুবক উচ্চারণ করে,

“কি রে মামনি, কতক্ষণ ধরে খুঁজে চলছি তোকে । আর তুই এখানে লুকিয়ে আছে?”
আনায়া বুঝে উঠতে পারে না, এই যুবকেরা কারা?
তবে এটুকু গভীরভাবে অনুধাবন করে, তারা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যেই এসেছে।আনায়া আতঙ্কে কণ্ঠস্বরটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।বর্তমানে সে নিজেকে একেবারে কোণঠাসা অনুভব করে।পেছনে সেই পিশাচসদৃশ ধ*র্ষ*ক ব্যক্তি আর সামনে উশৃংখল যুবকের দল।পালাবার কোনো পথ অবশিষ্ট নেই।
যুবকেরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে।তাদের মুখে হুমকিস্বরূপ বিকৃত হাসি ফুটে উঠেছে।আনায়া শঙ্কিত কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে ওঠে,
“আ… আমায় ছেড়ে দিন।”

উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা উচ্চহাস্যে ফেটে পড়ে।সেই হাসির বিভৎস শব্দে আনায়ার গা গুলিয়ে ওঠে।একজন তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত অবলোকন করে কদর্যভাবে বলে ওঠে,
“তোমায় ছেড়ে দিলে তো আমাদের লস মামনি।তোমার তো মরতে হবেই আমাদের হাতে।”
আনায়ার আতঙ্ক জমে গিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্তব্ধপ্রায়।তার হৃদয় খুঁজে ফেরে ইউভানকে।তার নিজেকে একেবারে অসহায় মনে হচ্ছে। ঠিক তখনই, অরণ্যের আঁধার ছিঁড়ে পায়ের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে এক শীতল কণ্ঠস্বর শোনা যায়,
“প্রাণ রক্ষা করতে চাইলে পালিয়ে যা।”
সঙ্গে সঙ্গেই উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা স্থবির হয়ে দাঁড়ায়।তাদের দৃষ্টি পড়ে আনায়ার পেছনে থাকা ছায়ার দিকে।
এক মুহূর্তেই তাদের মুখমণ্ডলের বিকৃত হাসি নিঃশেষ হয়ে যায়।তারা ফিসফিস করে বলতে শুরু করে,
“এ তো উনি! উনি তো।”

তাদের কণ্ঠনালি থেকে আর একটি শব্দও উচ্চারিত হয় না।ভয়ে কম্পমান হয়ে তাদের হাত থেকে পড়ে যায় বন্দুক।তারা আর স্থির থাকতে না পেরে আতঙ্কে বনের গহীনে ছুটে পালায়।আনায়া এ দৃশ্য দেখে সম্পূর্ণরূপে স্তম্ভিত।সে এবার ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকায়।এক মুহূর্তেই তার শ্বাস-প্রশ্বাস অস্থির হয়ে যায়।কারণ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেই পাশবিক ধর্ষক।আনায়ার মনে হয় তার পদতলের মাটি সরে যাচ্ছে।আর তখনই পেছনের আঁধার বিদীর্ণ করে উঠে আসে এক ভয়ানক কণ্ঠস্বর,

“আনায়া! বেবিডল, কোথায় পালিয়ে যাচ্ছিলে নেকের কাছ থেকে? তোমার গন্ধ তো নেক বহু দূর থেকেও পাই।”
শব্দগুলো ছুরির মতো মেরুদণ্ড বরাবর গেঁথে যায় আনায়ার।তার দেহে শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে।এই জানোয়ারটির নাম তাহলে নেক।এই নাম তো সে কখনও শোনেনি।তবে এই ব্যক্তি তার পরিচয় জানে কীভাবে?না! এইসব পরবর্তীতে ভাবা যাবে এখন তাকে নিজেকে রক্ষা করতেই হবে।আনায়া অধর কামড়ে নিজেকে সংহত করে।সে পুনরায় পেছন ফিরে এক কদম এগিয়ে যায় পালানোর উদ্দেশ্যে।ঠিক তখনই পেছন থেকে নেক চাপাটি দিয়ে আনায়ার জঙ্ঘার দিকে প্রচণ্ড আঘাত করে।এক তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভেদ করে বেরিয়ে আসে আনায়ার কণ্ঠনালি থেকে,
“আআআহ্!”

সে হোঁচট খেয়ে ভূমিতে পতিত হয়।কাদা, পাথর ও শুকনো ডালের অংশবিশেষ তার দেহে লেপটে যায়।
পায়ের নিচে এক ধার র*ক্ত ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে।
আনায়া অশ্রুসজল চোখে সম্মুখে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“প্লিজ! প্লিজ কিছু করবেন না। মুক্তি দিন!”
নেক সম্পূর্ণরূপে আনায়ার সম্মুখে এসে শীতল বিদ্রুপময় হাসি দিয়ে বলে,
“মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তো তোমায় বন্দি করিনি, আনায়া সোনা।”
আনায়ার দৃষ্টিতে অশ্রু টলমল করে।সে অনুভব করতে পারছে তার অন্তিম ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে।তবুও সে নিঃশব্দে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

“আপনি কে?”
নেক হেসে ওঠে।এক নিশ্বাসে কোমল কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“আমি হচ্ছি তোমার কল্পনার দুঃস্বপ্ন বেবিডল।”
আনায়ার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়।হঠাৎ সে কোমল মাটির ধুলা হাতে তুলে নেয়।প্রাণরক্ষার্থে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে নেকের চোখে ছুঁড়ে মারে ধুলার ঝাঁঝ।মুহূর্তেই ধুলাবালি উড়ে গিয়ে নেকের দৃষ্টিপথ আচ্ছন্ন করে।নেক তার চোখ মুছে ফেলে দুই হাতে।এই সুযোগে আনায়া উঠে দাঁড়ায়।রক্তাক্ত হাঁটুতে যন্ত্রণার সাগর সহ্য করেও হোঁচট খেতে খেতে ছুটে যেতে চায়।কিন্তু নেক ঝাঁপিয়ে পড়ে আনায়ার হাত ধরে ফেলে।দাঁতে দাঁত চেপে হিংস্র সুরে নেক উচ্চারণ করে,
“তোমার খুব স্পর্ধা বেবিডল। অতিরিক্ত সাহস নেকের একেবারেই অপছন্দ।”
আনায়া কান্নায় ভেঙে পড়ে।তার কণ্ঠে অসহায়তার সুর প্রতিধ্বনিত হয়,

“ছ ছেড়ে দিন!দয়া করে।”
নেক তাকে অব্যাহতি দেয় না।বরং শক্তভাবে টেনে তার পোশাকের হাতা ছিঁড়ে ফেলে।ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে জামার অংশ।আনায়া কান্নায় আর্তনাদ করে ওঠে,
“আআআহ্!!”

আনায়া প্রাণপণে ধস্তাধস্তি করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে।কিন্তু নেক আরও নৃশংস।সে আনায়াকে মাটিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।দুই বাহু দিয়ে দুই পাশে থাম তৈরি করে তাকে বন্দি করে রাখে।আনায়ার শরীরে এক ভয়ানক ঝড় উঠে।এখন কী ঘটতে যাচ্ছে তার সঙ্গে?নেক কি সেই মেয়েটির মতো অবস্থা করবে তার?সে কি আজই নিজ নারীত্ব হারাতে বসেছে?আনায়ার পুরো চিন্তাজগতে ঘুরপাক খায় ইউভানের অস্তিত্ব। না! তার ইউভান ভাই ছাড়া কেউ তার দেহে স্পর্শ করতে পারবে না।প্রয়োজনে সে আত্মত্যাগ করবে, তবুও নিজ মর্যাদা বিসর্জন দেবে না।সে এবার সমগ্র শক্তি দিয়ে দুই হাতে নেককে ধাক্কা দেয়।ধাক্কায় নেক কিছুটা পেছনে সরে যায়।আনায়া নিচ থেকে উঠে, রক্তাক্ত হাঁটু নিয়েও আবার ছুটে যেতে থাকে।নেক সেই দৃশ্য দেখে এক প্রকার কুটিল হাসি হেসে উচ্চারণ করে,
“বাহ বেবিডল! আমিও দেখি, শিকারি কতক্ষণ নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়।”

এটুকু উচ্চারণ করেই নেক পুনরায় আনায়ার পিছু ধাওয়া করে।পেছনে ভেসে আসে তার পদচারণার শব্দ।আনায়ার বুকের ভিতরে বন্য জন্তুর মতো কাপাকাপি শুরু হয়।তবুও থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যু।প্রকৃতির মাঝেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে,জোনাকির আলো নিভে গেছে, ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ থেমে গেছে, বাতাসও নিস্পন্দ।শুধু শোনা যাচ্ছে আনায়ার হৃদকম্পন ও নেকের পায়ের ধ্বনি।ঠিক তখনই দূরে কোথাও আলো ছায়ার মাঝে একটি অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।আনায়া স্থির হয়ে দাঁড়ায়।দৌড়ের ধাক্কায় তার নিঃশ্বাস কাঁপতে কাঁপতে উঠে।আনায়া নেকের পায়ের আওয়াজ আর শুনতে পায় না।তবুও তার ভয় থেমে নেই।সে এক ঠান্ডা ঢোঁক গিলে নেয়।আনায়া নিশ্চিত হয় সামনে দাঁড়ানো ছায়াটি নেক।জীবন বাঁচানোর শেষ আশাটুকুও নিভে যেতে থাকে আনায়ার অন্তরে।সে এবার চেখ বুঁজে চাপা শ্বাসে অভিমানি কণ্ঠে উচ্চারণ করে,

“আপনাকে নিয়ে অনেক অভিযোগ আমার, ইউভান ভাই।আপনি আসেননি!আমি চেয়েছি আপনি আসবেন, আমাকে বাঁচাতে আসবেন।কিন্তু আপনি এলেন না।”
বলেই আনায়া অঝোর অশ্রুবর্ষণ করছে।ঠিক তখনই জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে এক কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়,
“সুইটি…”

পরক্ষণে আনায়ার দেহের লোম কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে।সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে সম্মুখে তাকায়।এক পলকেই সে প্রত্যক্ষ করে ইউভান তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে।সেইক্ষনেই তাদের মাঝের সময় স্থবির হয়ে যায়।আনায়ার মনে হচ্ছে, সে এক অপার্থিব স্বপ্নে নিমজ্জিত।এটাই কি সত্যিই ইউভান ভাই?আনায়ার হৃদয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়।অন্যপ্রান্ত থেকে ইউভান ধীর পদক্ষেপে আনায়ার দিকে অগ্রসর হয়।এতক্ষণ সে সমগ্র পার্টিজুড়ে আনায়াকে খুঁজে ফিরেছে উন্মাদের মতো, কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পায়নি।ঠিক তখনই ইউভানের দৃষ্টি পড়ে আনায়ার বিপর্যস্ত দেহাবয়বের উপর।সঙ্গে সঙ্গেই তার সমগ্র জগৎ থমকে যায়।আনায়ার সমগ্র দেহ রক্তে সিক্ত।পোশাক, বাহু ও গালে রক্তচিহ্ন শুষ্ক হয়ে জমে গেছে।ইউভান থেমে দাঁড়াল ।বুকের বামাংশ হঠাৎ ব্যথায় টনটন করতে শুরু করে।আনায়া বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে নিজ উভয় হাত প্রসারিত করে ইউভানের দিকে।ইউভান এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে ছুটে এসে আনায়াকে আঁকড়ে ধরে।আনায়ার অধরে এক ম্লান হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়ে।ইউভান উন্মাদনার মতো উচ্চারণ করে,
“কি হয়েছে সুইটি?কাঁদছিস কেন? আমি তো এসেছি। এ এ রক্ত কেন?”

আনায়া নির্বাক কোনো উত্তর দেয় না।এই নিস্তব্ধতায় ইউভানের ক্রোধ আরও প্রবল হয়ে ওঠে।সে আনায়ার মাথা তুলে রক্তিম দৃষ্টিতে চেয়ে গর্জে ওঠে,
“উত্তর দিচ্ছিস না কেন? এ রক্ত এল কোথা থেকে? আনু কিছু বল।”
আনায়ার অন্তরস্থ বেদনার্ত কান্না যা এতক্ষণ ধরে দমে ছিল তা, ইউভানের স্পর্শ পেতেই প্রবল বেগে ছুটে বেরিয়ে আসে।হঠাৎ করেই সে ফুঁপিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।তার এই কান্না ইউভানের হৃদয়ের গভীরে শাণিত ছুরির মতো প্রবেশ করে।সে কাঁপা কণ্ঠে পুনরায় অনুসন্ধান করে,
“কান্না করছিস কেন সুইটি? হুঁ? আমি তো এখানে! কী হয়েছে বল আমায়?”

কিন্তু আনায়ার কান্না থামে না।সে আরও প্রবলভাবে বিলাপ করতে থাকে।ইউভানের শার্ট আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে আনায়া।বুক ফেটে বিদীর্ণ হয়ে পড়েছে তার।ইউভান তার বুকে মিশিয়ে নেয় আনায়ার রক্তাক্ত দেহখানা।ইউভান আর সহ্য করতে না পেরে অস্থির কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“আমার পৃথিবীকে এভাবে কাঁদতে দেখতে জন্মাইনি আমি, সুইটি।”
আনায়া এবার বহু কষ্টে ফিসফিস করে বলল,
“ই ইউভান ভাই আ আমি আর বাঁচব না।”

আনায়ার এই বাক্য শুনে ইউভানের রাগান্বিততা আরও তীব্র হয়।তার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করে।সে আনায়ার বাহু দুটো ধরে তাকে সোজা দাঁড় করায়।
আনায়া তখনো দম বন্ধ করে কাঁদছে।ইউভান পরক্ষণেই রক্তবর্ণ দৃষ্টিপাতে গর্জে ওঠে,
“কী বলছিস তুই? হ্যাঁ?কলিজা টেনে ছিঁড়ে ফেলি? অনেক সাহস জমেছে তাতে, তাই না?”
আনায়ার দুর্বল দেহ থরথর করে কাঁপে ইউভানের ক্রোধে।ইউভান এই উপলব্ধি করে তীব্র নিঃশ্বাস ছাড়ে এবং নিজেকে সংযত করার প্রচেষ্টা নেয়।এরপর সে আনায়ার অবয়ব দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কোমল কণ্ঠে শুধায়,
“জান নননন! আমার প্রাণপাখি কান্না থামা। দেখ আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কী হয়েছে বল আমায়।”

আনায়া কান্না থামানোর জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করে।তার অন্তর্দেহে অদৃশ্য ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হচ্ছে।শ্বাস গ্রহণ ক্রমশ দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে আনায়ার জন্য।সে অধর ফাঁক করে কিছু উচ্চারণ করতে চায়,কিন্তু হঠাৎ করেই তার কণ্ঠরোধ ঘটে।আনায়া খিঁনখিঁন করে কাশতে কাশতে মাটিতে বসে পড়ে।ইউভান উভয় হাতে তাকে আগলে নিল সঙ্গে সঙ্গে।আনায়া শ্বাস টানতে টানতে হিমশিম খাচ্ছে,প্রচণ্ড শব্দ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে।তার চোখ উল্টে যাচ্ছে।আনায়ার এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে ইউভানের বক্ষবিদার ঘটতে থাকে।সে অস্থির কণ্ঠে কাঁপতে কাঁপতে উচ্চারণ করে,
“সুইটি! কী হয়েছে তোর?”

আনায়ার নিঃশ্বাসের গতি ক্রমবর্ধমান।ইউভান তখন অনুধাবন করে এটি প্যানিক অ্যাটাক।তার হাতে ধরা আনায়ার শীতল হয়ে আসা আঙুলগুলি কাঁপছে।সে ঝুঁকে পড়ে, আনায়াকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করে।ইউভান তার শুষ্ক অধর ভিজিয়ে শান্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“আনু চোখে চোখ রাখ আমার।আমি এখানে আছি সুইটি। কিছুই হবে না, কিছুই না।”
তখন আর এক নিমিষও বিলম্ব না করে ইউভান আনায়াকে কোলে তুলে নেয়।গাড়ির নিকট পৌঁছে সে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে।আনায়াকে বুকে আগলে সে নিজে বসে পরে।সঙ্গে সঙ্গেই বেগ বাড়িয়ে ইউভান প্রস্থান করে সেই স্থান হতে।ইউভানের গাড়ির ধূলিঝড় তুলে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মাত্রই, গাছের আড়াল হতে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হয় নেক।তার নেত্রযুগল রক্তাত অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ।সে একটি ডাল দৃঢ়ভাবে ধরে এমন বলপ্রয়োগে যে ডালটি কঁকিয়ে শব্দ তুলে বিদীর্ণ হয়ে যায়।তার দাঁত কড়মড় করে ওঠে, ক্ষোভে কাঁপছে সর্বাঙ্গ।পরক্ষণে সে নিচু কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“আমি আসব!আবার আসব কেঁড়ে নেবো আনায়াকে তোর বুক থেকে।তোর আত্মার অন্তরাল থেকে আমি তাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসব। ও আমার! একমাত্র আমার!”

নেকের ক্রোধে কপালের শিরানলিকা গুলি দৃশ্যমানভাবে স্ফীত।তার অধর কম্পমান আর চক্ষুপল্লবও একটুও নড়ছে না।পরক্ষণেই তার স্বরযন্ত্র বেয়ে বেরিয়ে আসে এক বিকট আর্তনাদ,
“আআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআ!”

চিৎকারটি এত প্রবল যে নেকের কণ্ঠনালীর প্রতিটি শিরা ছিঁড়ে যাচ্ছে।পেছনের নিশাচর বাঁদুড়েরা আতঙ্কে গাছ ত্যাগ করে উড়ে যায়।নেকের চারিধার হতে একে একে গাছের শাখা-প্রশাখা থেকে বাদুড়গণ মুক্ত আকাশে বিচরণ করতে থাকে।কয়েকটা বাঁদুড় নেককে কেন্দ্র করে চক্রাকারে ঘুরে বেড়ায়।ঠিক সেই মুহূর্তে, নেক নিপুণ ভঙ্গিতে একটি বাঁদুড়কে হঠাৎ করেই করায়ত্ত করে।বাঁদুড়টি মুক্তির জন্য ডানাপাখা ঝাঁপটাতে থাকে।কিন্তি নেক তার শাণিত দাঁত বসিয়ে দেয় বাদুড়টির বাম পাখার গোড়ায়। মুহূর্তেই চামড়ার অন্তর্নিহিত ঘন কাল র*ক্ত হঠাৎই মুখগহ্বরে প্রবাহিত হয় তার।নেক দাঁত দিয়ে এক টান মেরে বাদুরটার পাখনার চামড়া ছিঁড়ে ফেলে।সে সেই চামড়া টেনে টেনে চিবাতে থাকে।তখনই তার দাঁতেরখাঁজে আটকে যায় সাদা স্নায়ুজাল।সে জিহ্বা দিয়ে তা সরিয়ে ঠোঁট চেটে নেয়।বাঁদুড়টি নেকের মুঠোর ভেতর ছটফট করতে থাকে।নেকের অধরকোণে র*ক্তধারা গড়িয়ে পড়ছে।তার চোখজোড়া লাল থেকে ধূসর রঙে রূপান্তরিত হয়।

নেক এবার বাদুড়টির পাখার কোমল পর্দা ছিঁড়ে মুখগহ্বরে গুটিয়ে একেবারে গ্রাস করে ফেলে।তার অধরের আশেপাশে গাঢ় কালো পশম ও র*ক্তরেণু লেপ্টে রয়েছে।সে বাদুড়টির দৃষ্টিজোড়া উপড়ে ফেলে গণ্ডদেশের অভ্যন্তরে স্থাপন করে তৃপ্তিভরে খায়।সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক আনন্দের রেখা ফুটে উঠে।সে তার মুখখানি নিয়ে আসে বাদুড়ের পাঁজরের সংলগ্নে।একেবারে বুকের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁত বসিয়ে চামড়ায় বিদীর্ণ করে আনে।ক্ষণমাত্রেই র*ক্ত নির্গত হয়ে তার মুখ ও কণ্ঠনালীর ওপর ধারা বয়ে যায়।সে সেই রক্ত জিহ্বা দ্বারা চেটে নিয়ে পুনরায় কামড় বসিয়ে বাদুড়টির বুকের মাংস ছিঁড়ে ফেলে।এইভাবে বাদুড়টির দেহাবশেষ সম্পূর্ণরূপে ভক্ষণ করে ফেলল নেক।নেকের এইরূপ হিংস্র আচরণ স্পষ্ট করে যে সে কোনো সাধারণ মানবসত্তা নয়, বরং এক ভয়ংকর পিচাশ।তার ঠোঁট থেকে কণ্ঠদেশ পর্যন্ত ঘন গন্ধযুক্ত কালোরক্ত গড়িয়ে পড়ছে।সে সেই র*ক্ত জিহ্বা দিয়ে লেহন করে হিংস্র কণ্ঠস্বরে উচ্চারণ করে,

“আই ওয়ান্ট ইউ বেবিডল! আই ওয়ান্ট টু টেস্ট ইউ!আই ওয়ান্ট ইউর গোল্ড আইস।”
—🌷—
অতীত,
আমেরিকার, নিউইয়র্ক
তারপর হঠাৎই ক্যাসিনো আলিসার পানে তাকিয়ে গম্ভীর সুরে বলল,
“বাই দ্য ওয়ে, লেটস গো। আমাদের এখনই বের হতে হবে।”
আলিসা হতচকিত দৃষ্টিতে ক্যাসিনোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সেই দৃষ্টিতে দোদুল্যমানতা সুস্পষ্টরূপে প্রতিফলিত।তার চাউনিটা ধীরে ধীরে সরে যায় আগুনে গ্রাস হওয়া সেই ঘরের দিকে। সেখানে থেকে আর ভেসে আসছে না ফ্লোরার কণ্ঠস্বরঅর্থাৎ, সে আর নেই।অতঃপর আলিসা অ্যাশারের হাত দৃঢ়ভাবে ধরে।ক্যাসিনো নির্বাকপণে এগিয়ে এসে আলিসার হাত দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করে উচ্চারণ করল,
“চলো। আর সময় নেই।”
পরবর্তী মুহূর্তেই তারা সেই অগ্নিদগ্ধ বাসা থেকে প্রস্থান করে।বাহিরে এসে ক্যাসিনো গাড়ির দরজা উন্মুক্ত করে। আলিসা অ্যাশারকে কোলে তুলে নিয়ে পিছনের আসনে উঠে বসে। ক্যাসিনো সামনের সিটে উঠে এক টানে গাড়ি স্টার্ট দেয়।গাড়ির অভ্যন্তরে এক প্রকার তীব্র নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।অ্যাশার আলিসার কোলের উপরে বসে আছে।কিছুক্ষণপরেই গাড়ি এসে থেমে যায় এয়ারপোর্টের সম্মুখভাগে।আলিসা বিস্ময়বিহ্বল হয়ে ক্যাসিনোর প্রতি প্রশ্ন নিক্ষেপ করে,

“আমরা কোথায় যাচ্ছি? ”
ক্যাসিনো গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়,
“সুইজারল্যান্ড।”
আলিসা কিছু উচ্চারণ করতে উদ্যত হয়, ঠিক তখনই ক্যাসিনো তার প্রতি দৃষ্টিপাত করে হাত দ্বারা ইঙ্গিত করে নিবৃত্ত করে,
“এখন নয়। যথাযথ সময়ে বলব।”

আলিসা আর কোনো বাক্যব্যয় করে না।অ্যাশারকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি থেকে নামে।তারা দ্রুতপদে এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। রাত ৩:৪৫-এর ফ্লাইট।ভিআইপি লাউঞ্জ অতিক্রম করে তারা বিমানে উঠে।আলিসার মনে অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেও, সে কিছুই জিজ্ঞাসা করে না।বিমানের তিন-সারি সিটের মধ্যবর্তী সারিতে বসে আলিসা। তার ডান দিকে জানালার পাশের সিটে অ্যাশার। আলিসা অ্যাশারকে কোলে থেকে সরিয়ে আলতোভাবে সিটে শুইয়ে দেয়।ক্যাসিনো নিশ্চুপভাবে পাশের আসনে অবস্থান করে।স্বল্প সময় পরেই বিমান আকাশপথে উড্ডয়ন করে।নিঃশব্দতাকে ভেদ করে আলিসা ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন উত্থাপন করে,

“সুইজারল্যান্ডে কেন যাচ্ছি আমরা?”
ক্যাসিনো ধীর কণ্ঠে জবাব দিল,
“কারণ ওখানে আমার বাড়ি।”
আলিসা আর কোনো অনুরূপ জিজ্ঞাসা করে না।স্বল্পকালিক নীরবতার পরে, হঠাৎ ক্যাসিনো দৃষ্টিকে স্থির রেখে আলিসার চক্ষুর সম্মুখে চক্ষু স্থাপন করে প্রশ্ন করে,
“তাহলে বলো নিজের বাবাকে কেন হত্যা করেছিলে?”
এই উক্তিটি যেন বজ্রাঘাতের ন্যায় পতিত হয় আলিসার হৃদয়ে।তার চিত্তে এক প্রকার সংকুচিত বেদনাবোধ সঞ্চারিত হয়। ঠোঁট নির্জীব হয়ে যায়, চোখে নীরব জলবিন্দু চমকায়। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাসে কণ্ঠরুদ্ধ কান্না গোপনে গিলে ফেলে।অতঃপর ধীরে উচ্চারণ করে,
“কারণ, সে আমার আপন বাবা ছিল না।”
ক্যাসিনো হঠাৎ অভিভূত হয়ে পড়ে। বিস্ময়ে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে।অবিশ্বাসী কণ্ঠে সে উচ্চারণ করে,
“অর্থাৎ?”

আলিসার চোখের প্রান্তদেশ থেকে দুটি অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।পরক্ষণেই সে ক্যাসিনোর চোখে গভীর দৃষ্টিপাত করে, হৃদয়ের অন্তঃস্থ থেকে উদ্ভূত কান্নার আর্তনাদ ঠেলে মুখ খুলে,
❝ আলিসা সেদিন নিজ জন্মদাত্রী মায়ের মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষ করে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। তার ওষ্ঠে কোনো আর্তনাদ ছিল না, প্রবাহিত হয়নি অশ্রু, কেবল নৈঃশব্দ্যের মাঝে তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিল এক মৌন বিষাদে।সে ওইদিন জঙ্গলে তার বাবার পাশে অচেনা মহিলাকে দেখেছিল।সে সেদিন তার বাবার পাশে এক অজ্ঞাত নারীর উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছিল।সেই নারীর ওষ্ঠে ছিল এক রহস্যঘন বিজয়ের হাসি।ভীতি, বিভ্রান্তি ও মানসিক বিপর্যয়ের ভারে নুয়ে পড়ে আলিসা নিঃশব্দে গাড়িতে ফিরে গিয়েছিল।তার পিতা সায়মন ফিরে আসার পর সে বারংবার জিজ্ঞাসা করেছিল,
“পাপা মা কোথায়?”

সায়মন তখন জবাবে বলেছিল,
“তোমার মা তোমাকে রেখেই চলে গেছে।”
এই বাক্যটি ছিল তীক্ষ্ণ খঞ্জরের মতো আলিসার সমগ্র বিশ্বাসকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল।তার পিতা যে মিথ্যাচার করছে তা সে হৃদয়ঙ্গম করেছিল।সেই মুহূর্তেই আলিসা উপলব্ধি করে, যে জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়,তার জননী চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।পরবর্তী দিনগুলো কেটেছিল আলিসার নিঃসঙ্গ শূন্যতায়।সায়মন তাকে স্বল্পকালের জন্য তার নানার বাসায় রেখে আসে। নানাবাড়ির নিরুপদ্রব পরিবেশও তার হৃদয়ের সেই শুন্যতা পূরণে সক্ষম হয়নি।কয়েকদিন পর, সায়মন যখন তাকে পুনরায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করায়, তখন আলিসার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে বাসায় দুটি নতুন মুখ।একজন সেই নারী যাকে সে সেইদিন জঙ্গলে রেখেছিল এবং অপরজন এক কিশোরী।সেদিন সায়মন আলিসার সম্মুখে নতজানু হয়ে বলেছিল,

“এটা তোমার নতুন মা। আর ও হচ্ছে তোমার বোন ফ্লোরা।”
আলিসা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল শুধু।কিন্তু সেই দৃষ্টিতে ছিল না কোনো আস্থাবোধ।সেই দিন থেকেই সে তার সৎ জননীকে অন্তরে স্বীকৃতি দেয়নি, সর্বদা দূরত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করেছে।তবে শুরুতে তার সৎ মা ভালোবেসেছে।আলিসার চুলে স্নেহময় স্পর্শ বুলিয়ে দিত,খাবার খাইয়ে দিত, ঘুম পাড়িয়ে দিত। কিন্তু দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়নি, শীঘ্রই তার সৎ মায়ের অন্তর্নিহিত রূপ উন্মোচিত হয়।কিছুদিন পরই আরম্ভ হয় নিষ্ঠুর ও পাষাণময় নির্যাতন।প্রতিনিয়ত আঘাতের শিকার হত আলিসা।একদিন সেই আঘাতের মাত্রা এমন এক নিষ্ঠুর পর্যায়ে উপনীত হয় যে, আলিসা তার বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বিহ্বলভাবে কান্না করে উচ্চারণ করে,
“পাপা, ওই আন্টি জঘন্য।আমাকে আঘাত করেছে।”
সায়মন তখন এক প্রচণ্ড ঝটকায় আলিসার কোমল গালে চড় কষে দেয়।পরবর্তীতে কর্কশ ও নির্মম কণ্ঠে উচ্চারণ করে,

“চুপ! জঘন্য কাকে বলছিস?তোকে বলিনি মা ডাকতে? মায়েরা মারেও আবার আদরও করে।”
ওইদিন আলিসা উপলব্ধি করেছিল যে তার পিতা আর তাকে স্নেহ করে না পরবর্তীকাল হতে সে সমস্ত নিপীড়ন নিঃশব্দে সহ্য করে নিতে শুরু করে।তার সৎ মাতার অমানবিক নির্যাতন আরও প্রবল হয়ে ওঠে। তাকে দিয়ে গৃহস্থালির সকল কার্যসম্পাদন করানো হতো।বাড়ির ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা, জামা কাপড় ধোয়া সব।শৈশবসুলভ আলিসা কেবল নিরবধি অশ্রু বিসর্জন করত।এই যন্ত্রণা উপেক্ষা করে সে দিনাতিপাত করছিল।তবে এই নিঃসহায়তার ভেতরেও তার জীবনে আরো এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে।রাত তখন প্রায় একটার কাছাকাছি।ঘরের জানালার কাঁচে বারবার বৃষ্টি এসে ধাক্কা দিচ্ছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে সেই অনেকক্ষণ আগে। আলিসার সৎ মাতা ওবো সেদিন বাসায় অনুপস্থিত।সে তার বাবার আসার প্রতীক্ষা করছিল।ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরের গেটের শব্দ হয়।আলিসা আকস্মিকতায় উঠে দাঁড়ায়, সে অনুধাবন করে যে তার বাবা এসেছে।এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে সে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে।তৎক্ষণ সায়মন মাতাল হয়ে দুলতে দুলতে ভেতরে প্রবেশ করে।আলিসা তবুও ছুটে গিয়ে বাবাকে আলিঙ্গন করে বলে,
“পাপা! তুমি এসেছো আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম একা থাকতে।”

সায়মনও আলিসাকে আলিঙ্গন করে।কিন্তু সেই আলিঙ্গনটি ছিল অপরিচিত। সায়মনের হাত ধীরে ধীরে আলিসার পৃষ্ঠদেশ বেয়ে নিম্নগামী হয়।সেই স্পর্শে স্নেহের পরিবর্তে বিদ্যমান ছিল এক অন্ধকারাচ্ছন্ন বাসনার রূপরেখা।আলিসার নেত্রজোড়া বিস্ময়ে প্রসারিত হয়।তার দেহ এক অজ্ঞাত আতঙ্কে জড়সড় হয়ে যায়।সে দ্রুত সায়মনের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়।এগারো বর্ষীয় কিশোরী আলিসার দেহগত কাঠামো যথেষ্ট আকর্ষণীয়।সায়মন বিকৃত হাসি দিয়ে ঘাড় নিচু করে আলিসার চোখের সম্মুখে ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করে,

‘আমিও তোমাকে মিস করছিলাম। তুমি তো এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছো।”
এ কথা বলেই সায়মন তার হাত আলিসার গলদেশের পার্শ্ব থেকে ধীরে ধীরে নিম্নাভিমুখে সঞ্চালন করে তার কাঁধে এবং বক্ষদেশে।আলিসার দেহ নিথর হয়ে পড়ে।তার শ্বাসপ্রশ্বাস থমকে যায়।সায়মনের দৃষ্টিতে সেই চিরচেনা স্নেহের পরিবর্তে প্রতিফলিত হচ্ছিল কুৎসিত লালসা।আলিসা কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করে,
“প পাপা।”

ঠিক সেই মুহূর্তে সায়মন হিসহিস শব্দে রুক্ষ কণ্ঠে বলে,
“হুশশশ! আমি তোর কোনো বাবা নই বোঝলি?
তুই তোর মায়ের পূর্বঘরের সন্তান।”
এই বাক্যটি আলিসার দেহের প্রতিটি লোমকূপকে স্ফীত করে তোলে।তার মানে যাকে সে দীর্ঘকাল ‘বাবা’ বলে বিশ্বাস করত,সে তার বাবা নয়। অন্যদিকে, সায়মনের অশুভ স্পর্শ ধীরে ধীরে মাত্রা অতিক্রম করে।আলিসা অনুভব করে এটা এক নোংরা, বর্জনীয় স্পর্শ।হ্যাঁ, তার মা তাকে শিখিয়েছে কোনটা স্নেহ আর কোনটা খারাপ স্পর্শ।আলিসার শরীর গ্লানিতে বিষাক্ত হয়ে ওঠে।আলিসা জোরালো কণ্ঠে বিলাপ করে বলতে থাকে,
“ছেড়ে দাও আমাকে পাপা। না… না…”

কিন্তু সায়মন নির্লজ্জভাবে নিজের সীমা অতিক্রম করে ফেলে।সে আলিসার বস্ত্রাবরণ অপসারণের প্রয়াস করে।আলিসা ধাক্কা দিয়ে সরতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়।ঠিক সেই মুহূর্তে তার দৃষ্টি পড়ে পার্শ্ববর্তী টেবিলে অবস্থিত এক ছুরির দিকে।আলিসা দিশাহারা অবস্থায় ছুরিটি হস্তে ধারণ করে সায়মনের বুকে আঘাত হানে।সায়মন পশ্চাৎপদ হয়ে মেঝেতে পতিত হয়।আলিসা খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।ঘরের মেঝেতে রক্তের ধারা ছড়িয়ে পড়ে।বাহিরে তখনও প্রচণ্ড ঝড় ও বৃষ্টি চলমান।আলিসা হঠাৎ লক্ষ করে সায়মন আর কাঁপছে না।সে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।তার হস্তদ্বয় কাঁপছে, নেত্রজোড়া কাঁপছে, ওষ্ঠে থরথর সঞ্চরণ।তার সম্মুখে নিথর হয়ে পড়ে আছে সেই ব্যক্তি যাকে সে ‘পাপা’ বলে সম্বোধন করত।

সেদিন সারারাত অঝোরে কেঁদেছিল আলিসা তবে কোনো পিতৃশোকের কারণে নয়, বরং ঘৃণায়।পরদিন, তার সৎ মা এসে বিভীষিকাময় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে পুলিশ ডাকে।তবে পুলিশ অনুসন্ধান করেও কিছুই প্রমাণস্বরূপ উদ্ধার করতে পারেনি, এমনকি ছুরিটিও নয়।কারণ, সেটি আলিসা পূর্বেই গোপন করে ফেলেছে। এগারো বর্ষীয় ক্ষুদ্র আলিসার প্রতি কারোর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি।এরপর থেকে আলিসার জীবন বর্ণহীন ও বিষণ্ণতার বাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।সেই দিন থেকেই সে আলিসা মেহেরিন থেকে রূপান্তরিত হয়ে যায় আলিসা রোজ নামের নির্মম মানবী হিসেবে।❞

অপরপাশে, গাড়িটি রাস্তা দিয়ে দুর্দমনীয় বেগে ছুটে চলছে।ইউভান এক হাতে স্টিয়ারিং এবং অন্য হাতে আনায়াকে আকুলভাবে আগলে ধরে আছে।আনায়ার মাথায় করুণ মমতায় হাত বুলিয়ে ইউভান তার কপালে স্নিগ্ধ চুম্বন এঁকে দেয়।আর আনায়া উন্মার্গ দৃষ্টিতে চোখ উল্টে একইসাথে প্রচণ্ড দ্রুততায় নিঃশ্বাস ফেলছে।সে এবার আনায়ার দিকে তাকিয়ে, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে ওঠে,
“সুইটি!ডোন্ট ক্লোজ ইউর আইস,প্লিজ!লুক এট মি সুইটি।”
আনায়া কিছু বলতে পারছে না তার শ্বাস কণ্ঠনালীতে বেঁধে আছে।ইউভানের শরীর স্বাভাবিক থাকলেও হৃদয়ে প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্কের কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে।
সে পুনরায়, ব্যাকুল ও ভাঙা কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“জান কষ্ট হচ্ছে খুব??প্লিজ বি পেসেনস সুইটি।”

আনায়ার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে দ্রুত।তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হচ্ছে সঙ্গে চেতনাও ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে আসছে।ইউভান এবার আনায়াকে কোলের উপর তুলে নেয়।আনায়ার মাথাটা এসে পরে তার বুকের গহ্বরে।
ইউভান দৃঢ়ভাবে তার মাথা বুকের সঙ্গে ঠেসে ধরে রাখে। আনায়া অস্পষ্টভাবে ইউভানের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে।তখনই সে তার কাঁপা কাঁপা হাত ধীরে ধীরে উঠিয়ে আনে ইউভানের গাল বরাবর।আনায়া কিছু বলতে চাইছে,কিন্তু প্রতিটি শব্দ তার কণ্ঠনালীর মাঝেই আটকে যাচ্ছে বারংবার।তবুও সমস্ত কষ্ট উপেক্ষা করে সে তার ঠোঁট ফাঁক করে উচ্চারণ করে,

“ই ইউভান ভাই…..”
এই নামটি উচ্চারণমাত্রই ইউভানের হৃদয়ে সহস্র তীক্ষ্ণ তীর একসাথে বিদ্ধ হয়।তার মাথা ঘূর্ণায়মান হয়ে ওঠে।
সে কম্পিত কণ্ঠে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে সুইটি? কিছু বলবি? বল প্লিজ..”
আনায়ার শ্বাসপ্রশ্বাস দিগ্বিদিক জোড়ে ওঠানামা করতে থাকে।চোখের নিচের পাতায় নিঃশব্দ অশ্রু সঞ্চিত হয়।প্রচণ্ড বিষণ্নতা ভর করা কণ্ঠে সে উচ্চারণ করে,
“আ আমি কিছু বলতে চাই আপনাকে।”
ইউভান এবার মুখটি আনায়ার নিকট নিয়ে গিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে,
“হু, শুনছি আমি।”

আনায়া কয়েকবার শ্বাস গ্রহণ করে।তার বুকের কেন্দ্রস্থলে যেন এক যন্ত্রণার বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে।
অন্তরের গহীনে জমে থাকা সহস্র অপূর্ণ বাক্য একযোগে উঠে আসে তার কণ্ঠপ্রান্তে।সে ঠোঁট ফাঁক করে অস্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করে,
“আ.. আমি আ আপ আপনাকে অনেক ভা ভা…”
ইউভান সঙ্গে সঙ্গেই আনায়ার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে থামিয়ে দেয়।হঠাৎ করেই তার হৃদস্পন্দনের ছন্দপতন ঘটে।সে করুণ সুরে, হুইস্কির মত গাঢ় কণ্ঠে বলে,
“হুশশ! এখন না সুইটি!যে অনুভূতিগুলো হৃদয়ের গভীর অতলে পাঁজরের আড়ালে সুপ্ত অবস্থায় লুকিয়ে রেখেছি,সেগুলোর প্রকাশের উপযুক্ত সময় এখনো আসেনি।”
আনায়ার চোখের কোণে নিঃশব্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

সে কান্নার আবরণে ঢেকে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে শেষ প্রচেষ্টায় কেঁপে কেঁপে বলে ওঠে,
“আমি আর পারছি না শ্বাস নিতে।”
এই একটি বাক্য যেন ইউভানের বক্ষে প্রবল পাথরের আঘাত হেনে বসে।তার হৃদয় কেঁপে উঠে অন্তস্তল থেকে।বিরহের অনল দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে তার সম্পূর্ণ মনোজগতে।পরক্ষণেই, ইউভান কণ্ঠরোধক আর্তনাদে উচ্চারণ করে,

“এই চুপ! থাপড়ায়ে গাল লাল করে ফেলবো তোকে, বেয়াদব!কী পারছিস না হ্যাঁ?আমাকে বাঁচতে দিবি না, তাই না?তোকেই পারতে হবে, বুঝলি?আমার জন্য হলেও পারতে হবে।তুই যদি না পারিস, আমার কী হবে?তোর শ্বাসপ্রশ্বাস থেমে গেলে, আমি কার মাঝে বেঁচে থাকবো?”
এই কথাগুলি বলার অব্যবহিত পর, ইউভান লক্ষ্য করেআনায়া নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে।সে ইউভানের বুকে স্থির হয়ে নিঃশব্দে পড়ে আছে।মুহূর্তেই বুকে ব্যথার তরঙ্গ বয়ে যায় ইউভানের।সে পুনরায় হাহাকারে বিমর্ষ কণ্ঠে বলে ওঠে,
“সুইটি! কী হলো?শ্বাস নিচ্ছিস না কেন?এই মেয়ে, নিঃশ্বাস নে!নাহলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবো তোকে।”
কিন্তু আনায়া আগের মতোই নিঃসাড় হয়ে আছে।
ইউভান এবার এক হাতে আনায়ার নাকের কাছে আঙুল রেখে লক্ষ করে শ্বাস চলছে তবে, তা অতিমাত্রায় ক্ষীণ নিভু নিভু।ইউভানের কপালে অশান্তির ঘাম বিন্দু বিন্দু করে গড়িয়ে পড়ে।তীব্র রাগে সে ঠোঁট দিয়ে চ শব্দ করে উচ্চারণ করে বলে,

“ওহ শিট!ফাকিং লাইফ।”
বলেই আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরে সে গাড়ি চালাতে থাকে উল্কার বেগে।
তার দৃষ্টিতে তখন আগুন, আতঙ্ক, অসহায়তা আর হাহাকার একত্রে জড়ো হয়ে আছে।কিন্তু হঠাৎই বাইরের আকাশের রঙ পাল্টে যায়।চারদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায় ঘন কালো মেঘে।বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে আকাশজুড়ে।আর হঠাৎ করেই এক তাণ্ডব ঝড় শুরু হয়ে যায়।বায়ু এমন প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত হয় যে,রাস্তার পাশে থাকা গাছগুলি একে একে দুলতে দুলতে ভেঙে পড়ে।প্রচণ্ড ঝড় এসে গাড়ির কাঁচে প্রচণ্ড ধাক্কা দিতে থাকে।ইউভান রাগে গাড়ি একপাশে দাঁড় করিয়ে দেয়।তার হৃদয়ের অন্তর্নিহিত ক্রোধ যেন বাইরের ঝড়ের সঙ্গে মিশে এক ভীতিকর আকৃতি ধারণ করে।বাইরের ঝড়-বৃষ্টি আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে।তখন ইউভান উপলব্ধি করে এই পরিবেশে হাসপাতালে পৌঁছানো সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।

তখনই আনায়া পুনরায় চেতনায় ফিরে ছটফট করতে থাকে।তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে শোঁ শোঁ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।বীভৎস বেগে তার বক্ষ উত্থান-পতন হচ্ছে।ইউভান এবার উপলব্ধি করে আনায়ার আবার প্যানিক অ্যাটাক শুরু হয়েছে।সে আনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে উদ্বেল কণ্ঠে বলে,
“সুইটি….!”
ইউভানের কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই আনায়া সাড়া দেয়।সে ইউভানের হাত প্রবলভাবে আকঁড়ে ধরে নিজের কাঁপা হাত দিয়ে।এই মুহূর্তে ইউভান নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসহায় ব্যক্তি বলে মনে করে।তার সানসাইনের ছটফটানি সে আর সহ্য করতে পারছে না।সে আনায়ার কপালে চুমু দিয়ে,ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়।তার বুক বিদীর্ণ হয়ে আর্তনাদ ফেটে বেরিয়ে আসে ঠোঁট ছুঁয়ে,

“আমাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার অধিকার দিইনি তোকে আমি।আমার পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে জান।প্লিজ! ধীরে নিঃশ্বাস নে, আমার যন্ত্রণা হচ্ছে।আমি আর পারছি না, সুইটি।”
তবু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।আনায়া আরও তীব্রভাবে ছটফট করতে থাকে।তার দেহটা আরও প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে থাকে।নিঃশ্বাসও ক্ষীণ হয়ে আসতে আসতে প্রায় অদৃশ্য হতে বসেছে।ইউভান লক্ষ্য করে,আনায়ার বুকের উঠানামা থেমে যেতে বসেছে।এক নিমিষের জন্য তার মনে হলো সে তার প্রাণপাখিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।বাইরের মেঘের গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠছে সমগ্র পৃথিবী।গাড়ির জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে।এই সময়েই হঠাৎ ইউভান অনাকাঙ্খিত কাজ করে ফেলে।সে আনায়ার অধরে নিজের অধর মিলিয়ে দেয়।এটা কোনো চুম্বন নয় বরং আনায়ার প্রাণ ফিরিয়ে আনার মরিয়া প্রয়াস।ইউভান বুকের গহীন থেকে বাতাস সংগ্রহ করে আনায়ার ঠোঁটে নিঃসৃত করে। তার বাঁ হাতটি আনায়ার মাথার নিচে এবং ডান হাত আনায়ার পিঠের কাছে ধরা।হঠাৎ করেই আনায়ার দেহটা কেঁপে ওঠে।

ইউভানের অধরের প্রবল ছোঁয়ায় আনায়ার দেহে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ে।তার দৃষ্টিপাত ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়।দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।ইউভানের এই পন্থা কাজে আসে, আনায়ার দেহের কম্পন ধীরে ধীরে ক্ষীণ হচ্ছে।তার শ্বাসপ্রশ্বাসও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসে।কিন্তু মুহূর্তেই সেই শ্বাসদানের চেষ্টাটা আর কেবল প্রাণ ফিরিয়ে আনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।ইউভান উপলব্ধি করে আনায়ার শ্বাস স্বাভাবিক হয়েছে।তবুও সে নিজেকে থামাতে পারে না।সে আনায়ার ওষ্ঠে গভীর চুম্বনে নিমজ্জিত হয়।তার হৃদয়ে তীব্র উত্তেজনার ছটফট করছে।ইউভান এবার নিজের সম্পূর্ণ ভার আনায়ার দেহের ওপর ছেড়ে দেয়।ফলস্বরূপ, আনায়া পিছনের দিকে ধাক্কা খেয়ে গাড়ির সিটে পিঠ ঠেকিয়ে আধ-শোয়া হয়ে পড়ে।এক নিমিষেই আনায়ার ক্ষীণ দেহ ইউভানের প্রশস্ত বুকের নিচে চাপা পড়ে।

ইউভানের অধরের অন্তঃস্থলে আনায়া অধর মিলে একেকার হয়।দুজন এক অপার্থিব সাগরে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।তখনই আনায়ার অধরের কোণে উষ্ণ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার বুকের গহীনে তীব্র ঝড় বইতে শুরু করে।ইউভানের এমন অপ্রত্যাশিত স্পর্শে আনায়া স্তম্ভিত ও ঘোরগ্রস্ত হচ্ছে।তার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে আসে।সে দু’হাত তুলে ইউভানের পৃষ্ঠদেশের পোশাক আঁকড়ে ধরে।আনায়ার এহেন প্রতিক্রিয়ায় ইউভানের উন্মত্ততা নিয়ন্ত্রণের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।সে আনায়ার কোমরের নিচে করাঘাত করে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।আনায়ার নিথর দেহ প্রতিটি স্পর্শে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে।ঠিক তখনই আনায়া বাঁধা দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেয়।পরক্ষণেই কয়েকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করে,

“ইউভান… না…”
কিন্তু ইউভান আনায়ার ঠোঁটে নিজের আঙুল রেখে তাকে থামিয়ে দেয়। সে মুখখানা আনায়ার কানের ধারে নিয়ে নরমস্বরে ফিসফিসিয়ে বলে,
“প্লিজ ডোন্ট মুভ!জাস্ট ফিল মি সুইটি।”
আনায়া শুষ্ক কণ্ঠনালীতে গলাধঃকরণ করল।ইউভানের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার কণ্ঠের পাশে এসে পড়ছে। ইউভানের স্পর্শে সে ধীরে ধীরে আত্মহীন হয়ে পড়ছে। তখনই আনায়া হঠাৎ করে বিকল কণ্ঠে বলে উঠল,
“আই কান’ট!”
ইউভান এবার আনায়ার মুখপানে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেশালু কণ্ঠে বলে,
“প্লিজ… জাস্ট ওয়ান্স মোর।”

বলেই ইউভান পুনরায় আনায়ার অধর আকড়ে ধরে। আনায়া এক অদৃশ্য টানে সমস্ত প্রতিবাদশক্তি হারিয়ে ফেলে। বাহিরে ঝড় ও বৃষ্টিতে প্রাকৃতিক জগৎ কাঁপছে, আর গাড়ির অভ্যন্তরে দুটি হৃদয় গভীর আকাঙ্ক্ষার টানে একে অপরের মাঝে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ইউভানের উন্মাদ আচরণে মনে হয় যে, সে শতাব্দীর পিপাসা মেটাচ্ছে। প্রতিটি চুম্বনে বহুদিনের দহন ঢেলে দেয় ইউভান।চুম্বনের মাঝে তার আঙুলগুলি ধীরে ধীরে আনায়ার পৃষ্ঠদেশ বরাবর উঠেছে কখনো বা কোমরের বাঁকে আসছে। এই পারস্পরিক ছোঁয়ায় আনায়ার নিরব দেহ বারবার শিহরিত হয়ে ওঠে।ইউভান এবার তার হাত দিয়ে আনায়ার হাতটি জানালার কাচের উপর চেপে ধরে। বাইরে অবিরাম বৃষ্টির ধারা এসে কাঁচে আঘাত করছে। আর সেই ঝাপসা কাচের ওপারে স্পষ্ট হয়ে উঠছে দুটি হাতের ব্যাকুল ছটফটানি। এই প্রথম ইউভানের এমন গভীর স্পর্শে আনায়ার হৃদয় গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে। তাদের ওষ্ঠ এবং ওষ্ঠের মাঝখানে কোনো দিগন্ত নেই কেবল আবেশ।

বাহিরের বৃষ্টি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে এবং তার সঙ্গে আনায়ার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে সে হঠাৎ জ্ঞান হারায়। ইউভান এবার স্থির হয়।সে মুখ তুলে দ্রুত শ্বাস নিতে থাকে। মুহূর্ত পর ভ্রু কুঁচকে আনায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আরেকটু পরে অজ্ঞান হলে কী হতো?বাইরের ঝড় না হয় থেমে গিয়েছে আমার হৃদয়ের ঝড়ের কি হবে?আমি আরএকটু না হয় হারিয়ে ফেলতাম নিজেকে তোর মাঝে।”

দীর্ঘ এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইউভান।বাহিরের ঝড়-বৃষ্টি ইতিমধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট এখনও সম্পূর্ণ স্বচ্ছ নয়, তবে ইউভান বিকল্প পথ অবলম্বন করে চৌধুরী ম্যানশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিছু সময় পর, তার গাড়ি থেমে দাঁড়ায় চৌধুরী ম্যানশন এর সামনে।নিঃশব্দে গাড়ির দরজাপট্ট খুলে নেমে আসে ইউভান। অপর পার্শ্বে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা আনায়াকে দুহাতে কোলে তুলে সে অন্তঃপ্রবাহিত হয় ম্যানশনের অভ্যন্তরে। তখনো বাড়িতে কেউ ফিরে আসেনি; কনভেনশন হলে সবাই মগ্ন।ইউভান ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে উপরের তলায়।
আনায়ার কক্ষে পৌঁছে, সযত্নে আনায়াকে বিছানার উপর শুইয়ে দেয়। আনায়ার মাথার নিচে একটি নরম বালিশ গুঁজে দিয়ে,গায়ে কোমল চাদরটি টেনে দিল ইউভান।অতঃপর সে আনায়ার পাশেই স্থির হয়ে বসে পড়ে।তার আঙুল আলতো করে স্পর্শ করে আনায়ার মুখমণ্ডল।তর্জনী ছুঁয়ে যায় তার অধর, গণ্ডদেশ, ললাট। ইউভানের চাহনিতে নির্বাক স্নিগ্ধতা।তবে হঠাৎ তার কপালে অনুচ্চ চিন্তার রেখা খচিত হয়। সে তৎক্ষণাৎ তার পকেট থেকে একটি হেডফোন বের করে কানে দেয়। চোখ বুজে নিবিষ্ট চিত্তে সে মনোসংযোগ করে কিছু আওয়াজের উপর।কয়েক মুহূর্ত পর তার কণ্ঠে চাপা গর্জনের মতো একটি শব্দ বেরিয়ে আসে,

“নেককক…”
সঙ্গে সঙ্গে সে চক্ষু মেলায়। তার দৃষ্টিতে প্রজ্জ্বলিত রৌদ্রের তেজ, চোয়াল দৃঢ় হয়ে ওঠে পাথরের ন্যায়। নিঃশ্বাস দ্রুততর ও ভারী হয়ে ওঠে।পরক্ষণেই, ইউভান আনায়ার মুখাবয়ব দুই হাতে আবদ্ধ করে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চারণ করে,
“এই পৃথিবীর হাজার পুরুষ যদি তোকে চোখ ভরে চায়,তাদের দৃষ্টি উপড়ে নেব আমি এক এক করে।
তাদের অস্তিত্ব ছিঁড়ে ফেলবো এমনভাবে,যেন তোর নামটা পর্যন্ত তারা উচ্চারণ করতে না পারে।কারণ তোকে চাওয়ার অধিকার কেবল আমার।তুই আমার দুঃস্বপ্ন, আমার নেশা, আমার পাপ,আমার সর্বনাশ। আর এই সর্বনাশটাকে আমি নিজের করে নিতে প্রস্তুত

কিন্তু তোকে হারাতে না।”
ইউভানের অধরে তখন প্রবল হিংস্রতা ও ক্ষিপ্রতা। ঠিক সেই মুহূর্তেপেছন থেকে এক নরম কণ্ঠের ধ্বনি ধ্বনিত হয়,
“ভাই…!”
ধীরে সে পেছনে ঘুরে তাকায়। আয়ানকে সে আগে থেকেই মেসেজ করে বাসায় আসতে বলেছিল। আয়ান রুহিকে সঙ্গে নিয়ে কনভেনশন হল থেকে তড়িঘড়ি করে চলে আসে।আয়ান এগিয়ে এসে আনায়ার নিথর অবয়ব দেখে ভ্রু-কুঞ্চিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে ভাই, আনায়ার?”
ইউভান কোমল অথচ স্থির স্বরে জবাব দেয়,
“তেমন কিছু নয়। সামান্য অজ্ঞান হয়েছে। আমার কিছুক্ষণ পরেই ফ্লাইট। রুহিকে বলিস ওর খেয়াল রাখতে।”
আয়ান কিছুটা ধীরে জানতে চায়,
“মানে? এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস?”
এক দীর্ঘশ্বাসে ইউভান তার উত্তর ব্যক্ত করে,
“সুইজারল্যান্ড। কয়েকটি জরুরি কাজ আছে।দুই দিনের মধ্যেই ফিরে আসবো।”
আয়ান বিষয়টি অনুধাবন করে শান্ত স্বরে প্রতিউত্তর দেয়,
“ঠিক আছে। তুই নিশ্চিন্ত থাক।”

ইউভান একবার আনায়ার দিকে স্থির দৃষ্টিপাত করে। তারপর ধীরপদে এগিয়ে এসে তার ললাটের নিকটে ঝুঁকে পড়ে। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আয়ান এক দৃষ্টি হেসে নিঃশব্দে কক্ষত্যাগ করে।ইউভান কিছুক্ষণ নিবিষ্ট দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে, আনায়ার কপালে একখানি স্নিগ্ধ চুম্বন এঁকে দেয়।তৎক্ষণ আনায়ার দেহে হালকা কম্পন অনুভূত হয়। সেই স্পন্দন দেখে ইউভান অল্প হেসে মৃদু স্বরে বলে,
“যত কাঁপাকাঁপি করার এখনই করে ফেলুন ম্যাডাম। কারণ আমি যখন ফিরে আসব, তখন কাঁপাকাঁপির সুযোগও পাবেন না আপনি।”
এই উক্তির পর সে আনায়ার অধরে হালকা চুম্বন এঁকে, চাদরটি আরেকটু সমবিন্যস্ত করে গায়ে টেনে দিল।তারপর ধীরে ধীরে নিঃশব্দে সে কক্ষ ত্যাগ করে।

আজ বহু দিন পর পিয়াস পদার্পণ করেছে চৌধুরী ম্যানশনে, ইউভানের নিদর্শনার পরিপ্রেক্ষিতে। গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে, ডানহাতে ধরা ফোনের পর্দায় একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে,এক রমনীর প্রতিচ্ছবির দিকে। রমণীর রক্তবর্ণ কেশরাশি ছড়ানো, রক্তিম ঠোঁটে লেগে আছে এক রহস্যময় হাস্যরেখা। পিয়াসের ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক নিঃশব্দ মুচকি।রমণীটি আর কেউ নন, পিহু। এই কয়েকদিনেই পিয়াস উপলব্ধি করেছে, তার শরীর ও চেতনাজুড়ে পিহুর প্রতি এক অপার কামনা ও অপরাধবোধে মিশ্রিত প্রেম জমাট বেঁধেছে। অথচ পিহু সর্বদাই তাকে কেবলমাত্র “বন্ধু” পরিচয়েই আবদ্ধ রেখেছে। এই কারণেই কখনো পিয়াস তার অনুভূতির আবরণ উন্মোচন করেনি।এই নিস্তব্ধতার মধ্যেই, হঠাৎ পিছন থেকে বজ্রকণ্ঠ সদৃশ এক কটাক্ষ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়,

“এই অসভ্য ছেলে! আমাদের বাসার পাশে দাঁড়িয়ে কি করছো তুমি হ্যাঁ?”
পিয়াস চমকে উঠে পিছনে তাকায়। রুহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, মুহূর্তে চমকিত হয় সে। এমন অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে রুহির উপস্থিতি এবং তার ভাষার ধরণ পিয়াসের নিকট বরাবরই রহস্যময় লেগেছে।রুহি গর্জমান ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে তার সম্মুখে অবস্থান নেয়।তার চোখে দাউ দাউ আগুন এবং কপালের শিরাগুলি উত্তপ্ত ও স্ফীত হয়ে আছে। সে কণ্ঠে প্রবল ক্ষোভ এনে বলে,
“এতদিন কোথায় গায়েব ছিলে পিয়াস? লুকিয়ে ছিলে কোথায়?”
পিয়াস দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে, স্বরকে সুস্থির করে উত্তর দেয়,
“আমি আপনাকে কোনো কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।”
রুহি উষ্মায় উত্তাল হয়ে, কণ্ঠরোষে উচ্চারণ করে,

“আপনিই আমাকে দিবেন। এত রাতে চোরের মতো বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কি করছেন? উত্তর দিন!”
পিয়াস ঠোঁটের কোণে এক বিরক্তির রেখা টেনে জবাব দেয়,
“এই যে মিস চোর বলছেন কাকে? আমি চোর হলে আপনিই তো পেতনি।”
রুহি খানিকক্ষণ থেমে যায়। অনেক দিন তার দৃষ্টির পরিধিতে পড়েনি পিয়াস। চক্ষু ভরে দেখার যে তৃষ্ণা জমা হয়েছিল হৃদয়ে, আজ সেই তৃষ্ণা রূপ নিয়েছে ক্ষোভে।রুহি ঠোঁট চেপে, তীক্ষ্ণ হাস্যরস মিশিয়ে বলে,
“তাই নাকি? পেতনিরা তো গলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার ছিঁড়ে খায়। তাহলে আমিই বা বাদ থাকি কেন?আপনাকেই খেয়ে ফেললে কেমন হয়?”
পিয়াস তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে নাক সিটকিয়ে প্রত্যুত্তর করে,
“ছি! আপনি একটা অশ্লীল, উগ্র ঝগড়ুটে মেয়ে।”
রুহি ভ্রূক্ষেপ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

“এই আপনি কাকে অশ্লীল বললেন হ্যাঁ? আমি কী দেহ হরণ করার মত অশ্লীল কাজ করেছি আপনার সাথে?”
পিয়াস অন্যদিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে উত্তর দিল,
“আপনি পারবেনও। আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস নেই।”
“তাহলে ঠিক আছে চলুন।”
“কোথায়?”
রুহি একচোখ টিপে কৌতুকপ্রবণ স্বরে বলল,
“আপনাকে দেহ হরণ করতে।”
এই অপ্রত্যাশিত সংলাপে পিয়াস শুকনো কেশে উঠে দাঁড়ায়। এতটা ঠোঁটকাটা রুহিকে সে আগে চিনেনি। সে ঠোঁট ভিজিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করে,

“আপনি আমার দেহ পেতে পারেন, তবে মন নয়।”
রুহি কণ্ঠ নামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয়,
“আপনার মন ধুয়ে ধুয়ে আমি পানি খাবো নাকি আমি? দেহ হলেই চলবে আমার, আপনার মন চুলোই যাক হু।”
পিয়াস স্থবির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রুহির এই শ্লেষাক্ত বচন তার কাছে নতুন নয়, কিন্তু এতটা স্পষ্টবাদিতা সে কখনো প্রত্যাশা করেনি।তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে ভেসে আসে পুরুষোচিত কণ্ঠ,
“রুহি।”
রুহি বিদ্যুৎপাতের মতো চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকায়। ইউভান হাতে একটি ট্রলি ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহির সমস্ত রোষ এক নিমিষে স্তব্ধ হয়ে যায়।ইউভান সামনের দিকে এগিয়ে এসে একবার রুহির চোখে দৃষ্টি দিয়ে বলে,

“রাত অনেক হয়েছে ভেতরে যা।”
রুহি নিরুত্তরভাবে মাথা ঝাঁকায়। অন্তিমবারের মতো পিয়াসের দিকে দৃষ্টি হেনে সে নিঃশব্দে পেছন ফিরে বাসার দিকে অগ্রসর হয়।ইউভান গাড়িতে উঠে বসে। পিয়াস স্বস্তির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, আজ ইউভান এসে ঠিক সময়ে তাকে উদ্ধার করেছে।ইঞ্জিন গর্জে ওঠে, ধূলিকণা উড়িয়ে গাড়িটি মেইন গেট অতিক্রম করে মিলিয়ে যায় নিশার অতলে।ঠিক তখনই গেটের অপর প্রান্তে প্রবেশ করে আরেকটি গাড়ি। কনভেনশন হল থেকে বাকিরাও একে একে প্রত্যাবর্তন করে। সকলের চেহারায় অবসাদের ছাপ স্পষ্ট, কেবল তানহা ব্যতীত।ইউভানের সুইজারল্যান্ডগমন সম্পর্কে আহসান ও ইব্রাহিম চৌধুরী পূর্বেই অবগত ছিলেন। আহসান চৌধুরী সকলকে উদ্দেশ্য করে শান্ত গলায় উচ্চারণ করেন,
“রাত অনেক হয়েছে। সবাই নিজ নিজ রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো।”
মুহূর্তে সকল সদস্য যার যার রুমে চলে যায়।শুধু তানহা দাঁত চেপে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ড্রয়িংরুমের সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। তারপর নিচু কণ্ঠে বলে,

“আজ তুমি বেঁচে গেছো, তাতে কী আসে যায়? আগামীকাল সকালের জন্য তোমার নামে এক নতুন সারপ্রাইজ প্রস্তুত করেছি আমি আনয়া। শুধু ইউভানের জীবন থেকেই নয়, তোমার অস্তিত্ব এই বাসা থেকেও মুছে ফেলবো আমি।”

দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার ক্লান্তিকর যাত্রার পর ইউভান অবশেষে অবতরণ করে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। প্লেনের দরজা খোলার সাথে সাথেই সে ধীরে স্থির পায়ে বেরিয়ে আসে। বিমানবন্দরের এক নির্দিষ্ট প্রান্তজুড়ে নিরাপত্তা বলয় কঠোরভাবে ঘিরে রাখা হয়েছে কারণ সেখানে কারও প্রবেশই নিষিদ্ধ। ইউভান অভিজাত ভঙ্গিতে তার প্রাইভেট হেলিকপ্টারের দিকে অগ্রসর হয়।তার পরনে জার্মান অভিজাত ডিজাইনারের কালো ট্রেঞ্চ কোট, যার ভেতর থেকে উদ্ভাসিত হচ্ছে ধূসর সাটিনের সূক্ষ্ম শার্ট। চোখে কালো সানগ্লাস, এবং তার ঘাড় অবধি বিস্তৃত চুল জেল দিয়ে নিখুঁতভাবে সেট করা। প্রাইভেট হেলিকপ্টারের ল দরজার পাশে প্রহরী সদৃশ চারজন দেহরক্ষী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের প্রত্যেকেই ইউভানকে সম্মানার্থে একযোগে মাথা নত করে। ইউভান নিঃশব্দে উঠে পড়ে তার ম্যাট ফিনিশ কালো প্রাইভেট হেলিকপ্টারে।

প্রায় আধঘণ্টা আকাশপথে চলার পর, হেলিকপ্টারটি অবতরণ করে এক সুবিশাল পঁচিশতলা অট্টালিকার ছাদে। ঐ বিল্ডিংটি নাম The Crystal Vault, যেখানে বিশ্বসেরা দুষ্প্রাপ্য ও নিষিদ্ধ হীরকখণ্ডের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। পুরো অট্টালিকাটি সাদা মার্বেলের মত চকচকে, গাঢ় আভিজাত্যে মোড়া।হেলিকপ্টারটির দরজা খুলতেই ইউভান সিঁড়ি দিয়ে নামল। ঠিক তখনই এক যুবক তার সম্মুখে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। ইউভান তার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি টেনে তোলে। যুবকের পরনে কালো শার্ট ও ধূসর ওয়েস্টকোট এবং বাদামি বর্ণের চুলগুলি সুচারুভাবে ব্যাকব্রাশ করে সাজানো।যুবকটি তখন গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,

“ওয়েলকাম স্যার!”
ইউভান বিনাবাক্য উচ্চারণে যুবকটিকে দুই হাতে আলিঙ্গন করল।যুবকটিও নিঃশব্দে ইউভানের কাঁধে হাত রাখে। ইউভান শীতল অথচ মসৃণ কণ্ঠে জবাব দিল,
“সি ইউ আফ্টার এ লং টাইম মাই ব্রাদার আভীর।”
আভীর ঠোঁট প্রসারিত করে এক প্রশস্ত হাসি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর গম্ভীর অথচ সম্মানসূচক কণ্ঠে বলে,
“আ’ইম ভেরি লাকি ম্যান বিকজ ইউভান চৌধুরী আমাকে ভাই বলে ডেকেছে।”
ইউভান একহাতে চুল পেছনে ঠেলল। আভীরের কথার অন্তর্নিহিত গভীরতা তার মনস্তত্ত্বে প্রবেশ করল। এক প্রশ্বাস নিয়ে পুনরায় উচ্চারণ করল,
“তাহলে যাওয়া যাক।”

আভীর সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। এরপর দুজনেই প্রাইভেট লিফটে প্রবেশ করে, গ্র্যান্ড ফ্লোরের উদ্দেশ্যে নেমে আসে।নিচে নেমেই তাদের অভ্যর্থনায় এগিয়ে আসে কয়েকজন সজ্জিত হোস্টেস, ইউভানের হাতে সুগন্ধি ফুলের তোড়া তুলে দেয়। চারপাশে ক্যামেরার ঝলকানি, সিকিউরিটি সিস্টেমের প্রযুক্তিসজ্জা, এবং সুপরিচিত ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের কালোসুটধারী প্রতিনিধিরা উপস্থিত।তখনই ইউভানের দৃষ্টি পড়ে হলরুমের এক কোণে ব্যক্তিটির উপর।সেই ব্যক্তিটি অন্যান্য আগত অতিথিদের সঙ্গে নিমগ্ন আলোচনা করছে। তার মুখাবয়ব দেখে ইউভানের ঠোঁটে জেগে ওঠে এক রহস্যময় ব্যঙ্গাত্মক হাসি।আভীর ইউভানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে দৃষ্টি ফেলে বলে ওঠে,
“তোর সব থেকে বড় শত্রু দ্যা গ্রেট সাইন্টিস্ট ক্রিস্টান ক্যাসিনো ওরফে K.K।”
ইউভান রক্তিম দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। নিম্নস্বরে উচ্চারণ করে,
“আমার শত্রু হওয়ারও যোগ্যতা নেই তার।”

আভীর ক্যাসিনোর দিকে অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিদ্রুপমিশ্রিত হাসি হেসে নেয়। হলরুমটির ছাদ থেকে ঝুলছে শত কোটি টাকার ঝাড়বাতি, দেয়ালে সোনালী কাঠের কারুকাজ। নিলামের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে কালো হীরকখণ্ড ‘দ্যা ব্লাক ডেথ ডায়মন্ড’ যার প্রারম্ভিক মূল্য নির্ধারিত ১০ মিলিয়ন ইউরো।ইউভান মুলত বাংলাদেশ থেকে ডায়মন্ড ক্রয় করতেই সুইজারল্যান্ডে এসেছে। ইউভান ও আভীর নির্ধারিত আসনে বসে পড়ে। চারপাশে উপস্থিত চীন, দুবাই, জাপান ও আফ্রিকার অপরাধ সাম্রাজ্যের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা।ইউভান চারদিক তাকিয়ে কাউকে অনুসন্ধান করল।তারপর কিছুটা নিচু হয়ে আভীরকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিস স্বরে সে বলে ওঠে,
“সে কী আসে নি?”

আভীর কপালে ভাঁজ ফেলে বিস্ময়মিশ্র কণ্ঠে বলল,
“মানে তুই কার কথা বলছিস?”
কিছু বলবে ইউভান এমন সময় ভেসে আসে মাইকে ঘোষকের কণ্ঠ,
“Ladies and Gentlemen, the bidding for The Black Death Diamond starts now.”
প্রত্যেক ক্রেতা প্রস্তুত হয়ে বসে আছে রত্নের মালিকানা অর্জনের উদ্দেশ্যে।ঠিক তখনই, আচমকা হলরুমের বিশাল দরজার দিক থেকে ভেসে আসে এক কঠিন পুরুষালী কণ্ঠ,

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৯

“আমাকে ছাড়াই প্রোগ্রাম শুরু হচ্ছে? দ্যাট’স এ ব্যাড আইডিয়া। আই ডোন্ট লাইক ইট!”
মুহূর্তে সকল দৃষ্টি ঘুরে যায় দরজার দিকে। ক্যাসিনো পেছনে ফিরে তাকায়, আর মুহূর্তেই তার মুখাবয়ব পরিবর্তন হয়ে যায়।কপালজুড়ে ঝরে পড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম।দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির পরনে দীর্ঘ ওভারকোট, পায়ে কালো বুট, এবং মুখ আচ্ছাদিত ড্রাগনের মুখোশে।কিন্তু ইউভান পেছনে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রইল হীরার উপর। ঠোঁটে ফুটে উঠল এক কটাক্ষপূর্ণ হাসি। তারপর উচ্চারণ করল,
“হি হ্যজ কাম!”

আত্মার অন্তরালে পর্ব ২১